তালাচাবি
এজেন্ট বলেছিলেন, 'বাড়ির সিকিউরিটি হেবি। একেবারে পিসফুল থাকতে পারবেন।' আগের বাড়িতে একতলার সিঁড়ির দরজা রাতের ছ'ঘণ্টা ছাড়া সারাদিন খোলা থাকত, লোকে দোতলায় উঠে একেবারে আমাদের ঘরের দরজায় বেল বাজাত, আমরা প্রথম সাত দিন আই হোল দিয়ে দেখে তারপর না দেখেই খুলে দিতাম। এ বাড়িতে ও সব গা এলানি চলে না, মেন গেটে কলিং বেল, মেন গেট দিয়ে ঢুকে গলি বেয়ে এসে সিঁড়ির দরজায় তালা, সে তালা পেরিয়ে দোতলায় উঠলে তবে আমাদের নাগাল পাওয়া যাবে।
তাতে আমার পিস কিছু বাড়েনি। বেল বাজলে প্রতিবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখতে যেতে হয় কে এসেছে। কেউ কেউ আবার গলি বেয়ে সিঁড়ির দরজা পর্যন্ত আসেন না, মেন দরজায় বেল বাজিয়ে ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন কাকের বাসা চুল নিয়ে, রং চটা জামা-পরা অবস্থাতেই যাও মেন গেট পর্যন্ত তদন্ত করতে। পায়ে হাওয়াই চটিও থাকে না সবসময়।
সেদিন অবশ্য মেন গেট পর্যন্ত যেতে হল না। নিচের দরজা খুলেই সারপ্রাইজ, অর্চিষ্মান সতেরো মিনিট আগে এসে গেছে। আঙুল গলানো পলিথিনের প্যাকেটের ভেতর ঠোঙা, ঠোঙা থেকে চমৎকার অস্বাস্থ্যকর সুবাস বেরোচ্ছে। নিজের জন্য আলুর চপ, আমার জন্য বেগুনি। চায়ের সঙ্গে খেতে দারুণ মজা হবে। খাওয়ার পর আঙুলের ডগা থেকে নোনতা গুঁড়ো চাটতেও মজা। তবে সবথেকে মজা হবে খাওয়ার পর। এক গ্লাস জল খেয়ে নিলেই ব্যস। ফ্রিজ থেকে খাবার বার করা নেই, মাইক্রোওয়েভে গরম করা নেই, থালায় নিয়ে বসে চোয়াল ব্যথা করে চিবোনো নেই, বাসন মাজাও নেই। দিনের পাট ওইখানেই চুকল। খুব বাড়াবাড়ি হলে ল্যাপটপের তলা থেকে বেরিয়ে এক গ্লাস ইনো গুলতে হবে, ব্যস।
কিন্তু সেদিন অত আনন্দের মুখে বাধা পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে ঢুকে দরজায় সাঁটা হুকে চাবি ঝোলাতে যাব, চাবি নেই। অথচ নিচে নামার সময় চাবিটা আমার হাতে ছিল, আমি জানি।
জানি কারণ আমাদের এ বাড়ির দরজার তালা ইয়েল লক। তালাচাবির ভ্যারাইটি মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসে ছিল না, কাজেই আমার কোনও আইডিয়া নেই ওই ব্যাপারে। কিন্তু ইয়েল লক কাকে বলে জানতাম। পৃথিবীর যত অলস গোয়েন্দাগল্প লেখক ইয়েল লককে বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন। ইয়েল লকওয়ালা দরজা বাইরে থেকে টেনে দিলে বন্ধ হয়ে যায় এবং চাবি ছাড়া খোলা যায় না। এ তালা বাজারে চালানোর সময় নিশ্চয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, হাতল ধরে টানুন, দরজা বন্ধ করুন। দরজার তালায় চাবি ঘোরানোর মূল্যবান পনেরো সেকেন্ড বাঁচান। ওই সময় বরং ক্যান্সারের ওষুধ কিংবা মঙ্গলে পৌঁছোনোর শর্টকাট আবিষ্কার করে ফেলুন।
আর যদি চাবি ঘরের ভেতর ফেলে দরজা টেনে দেন, তালা ভাঙুন। ভুলেছেন কেন? ভুগুন এবার। আপনার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীনের ভোগাই উচিত।
আমরা সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম বলা বাহুল্য। তাড়াতাড়ি কর, গ্যাসটা দেখেছ? বারান্দার দরজার ছিটকিনি তুলেছ?-র এইসব গিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ের এক এবং অদ্বিতীয় প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছিল, 'চাবি নিয়েছ?' একজন দরজা ধরে দাঁড়াতাম, অন্যজন চাবি বার করে চোখের সামনে ঝোলাতাম। ঝুলন্ত চাবিকে দু'জোড়া চোখের ফুল ভিউতে রেখে আমরা দরজা বন্ধ করতাম।
বেশি সতর্ক হয়েছিলাম আমি। ইয়েল লকের সঙ্গে আমার মোলাকাত এই প্রথম নয়। ইয়েল লক-ঘটিত কিছু পরিস্থিতি আমার চেতনায় এমন ট্রমাটিক ছাপ ফেলেছে, পার্ট ওয়ানের রেজাল্টও ফেলেনি। নিজের বাড়ির দরজায় ইয়েল লক দেখে সে সমস্ত ট্রমা ফিরে এসেছিল। দরজার বাইরে চাবি হাতে নিয়ে ছাড়া পা রাখতাম না, ডোর স্টপার ঠেসে দরজা হাঁ করে খুলে নিচে গেলেও চাবি নিয়ে যেতাম। কারণ নিশ্চিত ছিলাম, আমি নিচে যাওয়া মাত্র কোনও রসিক ভূত হাওয়া দিয়ে দরজা ঠেলে বন্ধ করে দেবে। আমি রং চটা টি শার্ট পাজামা পরে বন্ধ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।
বেশি সতর্ক হয়েছিলাম আমি। ইয়েল লকের সঙ্গে আমার মোলাকাত এই প্রথম নয়। ইয়েল লক-ঘটিত কিছু পরিস্থিতি আমার চেতনায় এমন ট্রমাটিক ছাপ ফেলেছে, পার্ট ওয়ানের রেজাল্টও ফেলেনি। নিজের বাড়ির দরজায় ইয়েল লক দেখে সে সমস্ত ট্রমা ফিরে এসেছিল। দরজার বাইরে চাবি হাতে নিয়ে ছাড়া পা রাখতাম না, ডোর স্টপার ঠেসে দরজা হাঁ করে খুলে নিচে গেলেও চাবি নিয়ে যেতাম। কারণ নিশ্চিত ছিলাম, আমি নিচে যাওয়া মাত্র কোনও রসিক ভূত হাওয়া দিয়ে দরজা ঠেলে বন্ধ করে দেবে। আমি রং চটা টি শার্ট পাজামা পরে বন্ধ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।
কাজেই আমি চাবি হাতে নিয়েই নেমেছি।
কিন্তু ওই মুহূর্তে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না, সবই ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। রোজ হাতে নিয়ে নামি, হয়তো আজই ভুল হয়েছে? ঘরের দরজা থেকে সিঁড়ির দরজা পর্যন্ত চাবি হারানোর সম্ভাব্য রুট তন্নতন্ন খোঁজা হল। জিনিস হারানোর একটা বাজে ব্যাপার হচ্ছে, খোঁজার জন্য পুরো বাড়িটা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া। বাথরুমের শেলফে, বাইরের দরজার সম্পূর্ণ উল্টোদিকের বারান্দায় কারিগাছের টব, কোনও জায়গাই চাবি থাকার পক্ষে অসম্ভাব্য নয়। অফ কোর্স, আমি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের ঢাকনা তূলে চাবি ফেলে দিইনি, কিন্তু তা বলে ওটা খোঁজা বাদ দেওয়া তো যায় না। অর্চিষ্মান ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের ঢাকনা তুলে দলামোচড়া কাগজ টান করে দেখতে দেখতে বলল, 'এই তো অমুক রিসিট এইখানে!'
চাবি?
নেই।
আমি কেঁদে ফেলার আগের স্টেজে গিয়ে 'সরি সরি' বলতে লাগলাম, অর্চিষ্মান রিসিট ভাঁজ করে পকেটে পুরতে পুরতে বলল, 'আহা, এ তো আমার হাতেও হতে পারত।'
অবান্তরের পড়ুয়া যদি কেউ থেকে থাকেন, পার্টনারের খোঁজ করছেন বা করবেন, আপনার প্রতি আমার একটা পরামর্শ আছে। হাইট, রং, বাড়িগাড়ি, অন-সাইট ট্র্যাভেলের সুযোগ, ধর্মে মতি, ঐতিহ্যে শ্রদ্ধা, সাধুসন্ন্যাসীতে বিশ্বাস, এসবের সঙ্গে সঙ্গে পার্টনারের কাম্য গুণের চেকলিস্টে আরেকটা বিষয়ও যোগ করে রাখুন। কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে (ক্ষতির দায় যদি সত্যি সত্যি অন্যপক্ষের হয়েও থাকে) নালিশের খাঁড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ার গুণ। লিস্টের বাকি সব গুণের মতো চকচকে নয়, কিন্তু মারাত্মক দরকারি।
গোটা বাড়ি খোঁজা হয়ে যাওয়ার পর হাল ছাড়তে হল। 'কোথায় যাবে?' 'পাখা লাগিয়ে উড়ে তো যাবে না?' অস্থির আর্তনাদেরা 'যা হওয়ার হয়ে গেছে।' 'আর ভেবে লাভ নেই' ইত্যাদি শ্রান্ত উপলব্ধিতে পর্যবসিত হল। সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার খোঁজায় ক্ষান্ত দিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বার করার সময় হয়েছে।
অফ কোর্স, আমাদের ডুপ্লিকেট চাবির ব্যবস্থা ছিল। এ চাবি ঘরের ভেতর ফেলে বেরোতে আমার যে তিনমাসের বেশি লাগবে না এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির দরকার নেই। আর এই রকম গোলমেলে তালাওয়ালা বাড়ির একটাই চাবি থাকলে অর্চিষ্মানের রাতে ঘুম হবে না। আমরা নিজেরাই ডুপ্লিকেট করাতাম, কিন্তু আবিষ্কার হল অলরেডি একটা ডুপ্লিকেট আছে। আমাদের মতোই কোনও অগোছালো ভাড়াটে করিয়ে রেখেছিল নিশ্চয়। ডুপ্লিকেটটা আসলটার সঙ্গে একই গোছায় রাখা। যদি গোছা ভেতরে রেখে বেরিয়ে যাই, ও জিনিস কোনও কাজেই লাগবে না। তাই আমরা ডুপ্লিকেট চাবিটা বাড়ির বাইরে কোথাও রাখার ব্যবস্থা করার কথা ভেবেছিলাম। বাড়ির বাইরে আমাদের একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে অফিস। আমার অফিস অপেক্ষাকৃত কাছে তাই ডুপ্লিকেট চাবি আমার অফিসেই রাখার স্থির হয়েছিল। আমার ডেস্কে একটা ডাবর হানির বোতল, যেটায় আগে মানি প্ল্যান্ট থাকত, দেহ রাখার পর খালি পড়ে ছিল, তার মধ্যে সে চাবি পুরে বোতলের মুখ বেশ করে এঁটে বন্ধ করা আছে।
এখন সে চাবি উদ্ধার করার সময় এসেছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন বাধ্য হয়ে অফিস যাই। এ সপ্তাহে ছ'বার যাওয়া হবে। ষষ্ঠবার সেধে যাব। রাত আটটার সময়।
বেরোনোর আগে চা খাওয়া যাক। মুখ তেতো, মন ভার, নিজের অপদার্থতায় তখনও নিজের ওপর রেগে গুম। পলিথিন থেকে বেগুনির ঠোঙা বার করে এলোমেলো ভাঁজ খুলছি, ভাঁজ থেকে থালার ওপর ঠুন করে পড়ল চাবির গোছা।
সিঁড়ির নিচে দরজা খুলে পলিথিনের ব্যাগ আঙুলান্তর করার সময় আঙুল খসে চাবি বেগুনির পলিথিনের ভেতর পড়ে গেছে। নিঃশব্দে।
ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অত সুস্বাদু বেগুনি আর কখনও, কোথাও খেয়েছি কিনা মনে পড়ছে না।
Eita khub bhalo hoche.. bhabar chesta korchilam kothay jete pare chabi... beguni er packet mathay aseni.. :)
ReplyDeleteআমারও না, ঊর্মি।
DeleteHaha.. Yale lock kintu oti bhoyonkor jinis..
Deletedarun...khub bhalo laglo galpo ta..
ReplyDeleteare harano jinis pawa gele ki aram je hoy..
prosenjit
তা ঠিক।
Deleteএসবের সঙ্গে সঙ্গে পার্টনারের কাম্য গুণের চেকলিস্টে আরেকটা বিষয়ও যোগ করে রাখুন। কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে (ক্ষতির দায় যদি সত্যি সত্যি অন্যপক্ষের হয়েও থাকে) নালিশের খাঁড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ার গুণ। .....bishal boro gun...kono sandeho nei. ei lock er samasya khub bhugechhi. Kheyal thakto na, pasher flat e babar khub bondhu thakten, kotha bolte bolte sakalei hoyoto beriye esechhi aar doramm....byas. Prothom prothom khub asubidhe hoto. Tarpor aaste aaste soye gechhilo. kintu amader nijeder flat hoyar somoy baba oi lock kichhutei bosate chaini jate amader sabar sammati chhilo.
ReplyDeleteসেই, শখ করে কেন কেউ এই তালা লাগাবে আমার যুক্তির বাইরে, সুস্মিতা।
Deleteঅবান্তরের পড়ুয়া যদি কেউ থেকে থাকেন, পার্টনারের খোঁজ করছেন বা করবেন, আপনার প্রতি আমার একটা পরামর্শ আছে। হাইট, রং, বাড়িগাড়ি, অন-সাইট ট্র্যাভেলের সুযোগ, ধর্মে মতি, ঐতিহ্যে শ্রদ্ধা, সাধুসন্ন্যাসীতে বিশ্বাস, এসবের সঙ্গে সঙ্গে পার্টনারের কাম্য গুণের চেকলিস্টে আরেকটা বিষয়ও যোগ করে রাখুন। কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে (ক্ষতির দায় যদি সত্যি সত্যি অন্যপক্ষের হয়েও থাকে) নালিশের খাঁড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ার গুণ। লিস্টের বাকি সব গুণের মতো চকচকে নয়, কিন্তু মারাত্মক দরকারি।
ReplyDelete- দু'হাত তুলে সমর্থন|
হাই ফাইভ, অন্বেষা।
Deleteঅসংখ্য অকারন নাগরিক জটিলতার মধ্যে একটি হচ্ছে এই তালাচাবি, বাঁচোয়া যে আপনাদের বেশি ভুগতে হলো না।
ReplyDeleteসত্যি, নালক। এমনিতেই এত জটিল জিনিসকে ইচ্ছে করে আরও জটিল করে এইসব ইয়েল-মিয়েল করার কোনও মানে হয়?
DeleteHahaha ... shotti, oi nischinti r tulona hoye na ... thanda beguni o omrito mone hoye :-)
ReplyDeleteসিরিয়াসলি, শর্মিলা। জোর বেঁচেছি।
Deleteঅবান্তরের পড়ুয়া যদি কেউ থেকে থাকেন, পার্টনারের খোঁজ করছেন বা করবেন, আপনার প্রতি আমার একটা পরামর্শ আছে। হাইট, রং, বাড়িগাড়ি, অন-সাইট ট্র্যাভেলের সুযোগ, ধর্মে মতি, ঐতিহ্যে শ্রদ্ধা, সাধুসন্ন্যাসীতে বিশ্বাস, এসবের সঙ্গে সঙ্গে পার্টনারের কাম্য গুণের চেকলিস্টে আরেকটা বিষয়ও যোগ করে রাখুন। কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে (ক্ষতির দায় যদি সত্যি সত্যি অন্যপক্ষের হয়েও থাকে) নালিশের খাঁড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ার গুণ। লিস্টের বাকি সব গুণের মতো চকচকে নয়, কিন্তু মারাত্মক দরকারি।
ReplyDelete- অতিশয় খাঁটি কথা
কিন্তু আপনার লাইফে একটা তালাচাবির গেরো আছে। প্যারিসেও বিপদে ফেলেছিল না?
এই ইয়েল লকই ফেলেছিল। জীবনে ওই রকম বিপদে আমি কমই পড়েছি। সত্যি বলতে কি পাসপোর্ট হারানোর থেকেও বেশি ভয় পেয়েছিলাম। কারণ ভাষার অসুবিধে।
Delete