ভুরু কুঁচকে, কুচবিহারে
ক’মাস আগে তেজপুরে একজন প্রাক্তন সহকর্মীর মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে এলেন মাবাবা। অর্চিষ্মান শুনে বলল, আবার? ও নাকি গত ছ’বছরে মাবাবাকে যত বিয়েবাড়ি খেতে দেখেছে সবই আসামে। কথাটা সত্যি নয়, বলা বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গেও মাবাবা যথেষ্ট বিয়েবাড়ি খেয়ে বেড়ান, তার সাড়ে নিরানব্বই শতাংশ আমাদের পাড়ায়। আসামে বিয়ে খেতে যাওয়ার ব্যাপারটা খানিকটা অভিনব বলেই বোধহয় বছরে একটা বিয়ে খেতে গেলেই চোখে পড়ে। অবশ্য বছরে একবার করে আসামে বিয়ে খেতে যাওয়াটাও অর্চিষ্মানের মানদণ্ডে যথেষ্ট বেশি বলে বিবেচিত হতে পারে, জানি না, জিজ্ঞাসা করে দেখতে হবে।
যাই হোক, কথাটা হল আমার বাবামা আমার মতো নন, চাকরিজীবনে দুজনে যথেষ্ট চেনা লোক জুটিয়েছেন যাঁরা এখনও, রিটায়ারমেন্টের সাড়ে ছ’বছর পরেও, তাঁদের ডেকে ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়াচ্ছেন। আমি ভাইরাল ফিভারে ভুগে সাতদিন বাদে অফিসে গেলে কারও তাপউত্তাপ দেখা যায় না। অফিসে আমার থাকাও যা, না থাকাও তাই।
তেজপুরে বিয়ে নাকি দারুণ কেটেছে। দেশী বউ সাহেব বরের বিয়ে, এক্সট্রা উত্তেজনা। জামাইয়ের জুতো লুকোনোর পর সাহেব বরপক্ষর সঙ্গে দিশি শ্যালিকাদের টাকা নিয়ে দরাদরিতে কী মারাত্মক মজা হল, মা ফোনে সব খবর দিলেন। একটা ভালো ব্যাপার করেছেন ওঁরা, জুতো চুরি আর টাকা চাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের প্রাদেশিক ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন আবার ডান্স ফ্লোর ফেঁদে বলিউডি নাম্বারের সঙ্গে নেচেগেয়ে প্যান-ইন্ডিয়ান ঐতিহ্যও বরণ করার উদারতা দেখিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমিও নাচলে নাকি? মা বললেন, পাগল হলি সোনা? বললাম, আহা নাচা মানে কি ডান্স ফ্লোরে নেমে ব্রেকিং আ লেগ? শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন তালের ছন্দ ছড়াল বলা যায় না, দর্শকাসনে বসেই শরীর দুলল, হাত আকাশপানে উঠে তালে তালে নড়ল। সে রকম কিছু ঘটে থাকলে বল, লজ্জা পেয়ো না। নিজের নৃত্যরত চেহারা কল্পনা করে মা কুটিপাটি হলেন তারপর রান্নাঘরের খোলা দরজা পেয়ে বেড়াল ঢোকার উপক্রম করছে দেখে ফোন কেটে দিয়ে বেড়াল তাড়াতে গেলেন।
তেজপুর রওনা দেওয়ার আগে পরামর্শ দিতে গিয়েছিলাম, এতদূর ঠেঙিয়ে যাচ্ছ যখন একটু ঘুরেবেড়িয়ে ফিরতে পার। জানা গেল সে রকমই ব্যবস্থা হয়েছে। ধুবড়িতে আসাম পর্যটন বিভাগের ‘প্রশান্তি’ খুলেছে, ঘর বুক করাও হয়ে গেছে, দু’রাত থেকে ফিরবেন।
শুনেই মনটা ধুবড়ি ধুবড়ি করে উঠল। মা আসামের অনেক জায়গায় বদলি হয়েছেন, বঙ্গাইগাঁও, জোড়হাট; বাবাও কিছুদিন তেজপুরে ছিলেন; সব জায়গাতেই আমি গেছি, কিন্তু ধুবড়িতেই মা সবথেকে বেশি সময় থেকেছেন আর ধুবড়ির কথাই আমার সবথেকে বেশি মনে আছে। জে এন ইউ থেকে গরমের আর শীতের ছুটিতে সোজা ধুবড়ি যেতাম। ইউনিভার্সিটির জমজমাট ক্যাম্পাস লাইফের পর মায়ের টিভিহীন এক কামরার ভাড়াবাড়ি বোরের হদ্দ হতে পারত, কিন্তু হত উল্টোটাই। রাত জেগে আড্ডামারা, পড়াশোনায় ফাঁকি, হৃদয়ঘটিত নাটকীয়তার পর ওই ক’দিনের শান্তি বুকের ভেতর সেই যে মিশে যেত, মিশে গেল চিরদিনের মতো, কোনওদিন ফিকে হয়নি।
মাকে বললাম, সেনগুপ্তদের বাড়িতে যাবে মা?
সেনগুপ্তদের বাড়ি ছিল পুলিস কোয়ার্টারের উল্টোদিকে। পুরোনো ধাঁচের বাড়ি, বাইরে থেকে দেখতে বিরাট, ভেতরে অলিগলি, ভাগবাঁটোয়ারা। গলি দিয়ে ঢুকে ডানদিকের বাইরের বড় ঘরটাই ছেলেরা যুক্তি করে ভাড়া দিয়েছিল। ওই ঘরে বাড়ির মাতৃআর্ক থাকতেন। ওটাই ছিল সবথেকে বড় ঘর, আলোবাতাসও যেটুকু আসার ওই ঘরে আসত। লাগোয়া রান্নাঘর আর বাথরুম আগে থেকেই ছিল নাকি পরে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ভাড়া দেওয়ার সময় "সব সেপারেট" বলে দর বাড়ানো যায়, জানি না।
এমনিতে তো বসে বসে সে বাড়ির লোকদের কথা মনে করার কোনও কারণ নেই, করিয়ো না ,কিন্তু মা যেই না বললেন ধুবুড়ি গেছেন, অমনি সব হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল। চার ভাই, ভাইয়ের বউ, তাদের ছেলেমেয়ে, সবার নামধাম চেহারা সব দেখি পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে। ভাইয়েদের এক মেজদি বাড়িতে থাকতেন না, মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতেন, তাঁর মুখখানাও ভুলিনি।
গত পনেরোটা বছরের প্রতিটি সেকেন্ড আমি গুনে গুনে বেঁচেছি, আর ধুবুড়ির বাড়ির লোকগুলো কি না গোটা সময়টা চোখের আড়ালে এক লাফে পার করে এসেছে তাই তাদের লাফটা অবিশ্বাস্য ঠেকে। টলমল পায়ে হাঁটা আধো আধো কথা বলা মেয়েটা এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে শুনে হাঁ বন্ধ হয় না। সেজ সেনগুপ্তর ছেলে প্রতি সন্ধেয় তার ক্লাস থ্রির অংক ইংরিজি দেখিয়ে নিতে মায়ের ঘরে আসত, এখন সে চাকরিবাকরিতে ঢুকে পড়েছে। মেজ সেনগুপ্তর একমেয়ে ছিল রুমকি, স্কুলের বড় ক্লাসে পড়ত, আমাকে সঙ্গে করে চুলের ক্লিপ আর চোখের কাজল কিনতে যেত, তার নাকি বিয়ে, ছেলেপুলে সব সারা। মেজ সেনগুপ্তরা মেয়ের বাড়ির কাছে, কলকাতায় শিফট করে গেছেন। ওদের ভাগটা বন্ধ পড়ে আছে। মায়ের ঘর পেরিয়ে আরও খানিকটা এগোলে বাঁদিকে ছিল ওদের ঘর দু'খানা। তালাদেওয়া বন্ধ দরজাটা কল্পনা করে আমারই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাঁদের অলরেডি বয়স্ক দেখেছিলাম তাঁদের কথা আর জিজ্ঞাসা করলাম না।
ধুবড়িতে সেভাবে দেখার কিছু ছিল না, কিন্তু আবার ছিলও। একটা গুরুদ্বারা ছিল, সেখানে নাকি স্বয়ং গুরুনানকের পদধূলি পড়েছিল। আর ধুবড়ির নেতাধোপানীর ঘাটেই নাকি বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের কলার ভেলা এসে ঠেকেছিল। সারাদিন বাড়িতে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে কাটাতাম, ছুটির সময় হলে মায়ের অফিসের দিকে গুটি গুটি যেতাম, মায়ের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের, কোনওদিন গদাধরের ধারে বসে বাদামভাজা খেতাম, সন্ধে নামলে গৌরীপুরের মাঠ পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। কোনও কোনওদিন বাজার ঘুরে ফেরা হত, টাটকা আলুপটল কিনে বাড়ি এসে রান্না বসাতেন মা, আমি চিৎপাত হয়ে খাটে শুয়ে হয় মায়ের ফোনে স্নেক খেলতাম নয় গল্পের বই পড়তাম। মাঝে মাঝে আমি যে কিছুই করছি না খালি মা খেটে মরছেন সে মর্মে নকল আক্ষেপ প্রকাশ করতাম। মা বলতেন, রোজ একা একা নিজের জন্য রাঁধেন, এই যে এ'কটা দিন রান্নার সময় আমি খাটে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি, এ নাকি স্বর্গসুখের থেকে কম কিছু না।
কোনও কোনও শনিরবি ডিনারে চাউমিন খেতে যাওয়া হত বাজারে। দোকানের নামে হয় ব্যাম্বু নয় গার্ডেন, কিংবা দুটো শব্দই একসঙ্গে ছিল এমনও হতে পারে।
সব হইহই করে মনে পড়ে গেল। মা বললেন, নিউ কুচবিহার থেকে ট্রেন ছাড়বে বিকেলে। ওঁরা দুপুরদুপুরই ধুবড়ি ছেড়ে কুচবিহার চলে আসবেন, শহর ঘুরে, দুপুরের খাওয়া খেয়ে ট্রেনে উঠবেন।
লাফিয়ে উঠলাম।
মনে আছে মা, তুমি আমাকে এক শনিবার কুচবিহার বেড়াতে নিয়ে এসেছিলে?
ধুবড়িতে পাছে আমার মুখ মেরে না দেয় সে জন্য মা আমাকে এক শনিবার বাসে চড়িয়ে আমাকে কুচবিহার নিয়ে এসেছিলেন। দু’ঘণ্টার রাস্তা বাসে। রাসমঞ্চ দেখেছিলাম, রাজবাড়ি বন্ধ ছিল সারাইয়ের জন্য,কিন্তু বাইরে থেকে দেখতেই কী অপূর্ব। কত বড় মাঠ। সব দেখেশুনে, ঘুরেটুরে,কোনও একটা দোকানে খেয়ে আবার বাসে চড়ে ব্যাক টু ধুবুড়ি।
কী মজা হয়েছিল বল মা?
হয়েছিল? মা অবাক। কিন্তু তোর তো যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না একটুও। বাসে করে অতদূর গরমের মধ্যে। আমিই জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর গিয়ে বেরোলো রাজবাড়ি বন্ধ, তুই ভুরু কুঁচকে রয়েছিলি সারা রাস্তা...আমার এত আফসোস হচ্ছিল...
ভুরু? কুঁচকে? আমার? পনেরো বছর আগের আমার মুখখানা হাতড়াতে থাকি। আমার তো বাস, ঝাঁকুনি কিছুই মনে নেই, খালি ভয়ংকর গরম মনে আছে। ভ্যাপসা গরম। তাও ঘামটাম মনে নেই। খালি মনে আছে বাতাসে আর্দ্রতা এত বেশি হয়েছিল যে শেষমেশ আর থাকতে না পেরে টুপটাপ জল ঝরতে শুরু করেছিল। রাজবাড়ি ঘেরা সবুজ মাঠ ভিজেভিজে। গাড়িবারান্দার তলায় জনাদশেকের সঙ্গে আমরাও দাঁড়িয়েছিলাম। বৃষ্টি ধরতে শান্ত রাসমঞ্চ। দুপুরে কুচবিহারেই খাওয়া হয়েছিল, কী খেয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু মায়ের সঙ্গে রেস্টোর্যান্টে বসে খেতে খারাপ যে লাগেনি তাতে কোনও সন্দেহই নেই।
মোদ্দা কথা, ভুরু কোঁচকানোর কোনও কারণই থাকতে পারে না।
কিন্তু মা তো মিছে কথা বলছেন না। ভুলও করছেন না। সারাসপ্তাহ অফিস ঠেঙিয়ে, দুবেলা রান্না করে, আমাকে শহর ঘুরিয়ে, শনিরবি বাসে চড়িয়ে নিয়ে অন্য শহরে বেড়াতে গিয়েছিলেন শুধু আমার মন রাখবেন বলে, আর আমি মুখ হাঁড়ি করে মাকে মর্মে মর্মে বোঝাচ্ছিলাম এর থেকে বাড়িতে শুয়ে থাকতে আমার কত বেশি আরাম হত। অপরাবোধে ভাজা ভাজা করছিলাম।
*****
মা, তোমার স্মৃতি থেকে ওই বাঁদর অকৃতজ্ঞ মেয়ের কোঁচকানো ভুরু কী করে মুছে দিতে হয় বলে দাও। চল আরেকবার কুচবিহার যাই দুজনে বাসে চড়ে। আরেকবার দুজনে রাজবাড়ির বাগানে, রাসমঞ্চের ছায়ায় ঘুরে আসি, তারপর কোনও একটা চাইনিজ দোকানে ঢুকে হাক্কা চাউমিন আর লাইম সোডা খাই।
এবার ভুরু একটুও কুঁচকোবে না, স্রেফ গালভরা হাসি আর বুকভরা ভালোলাগা থাকবে। কারণ ওই দুটোই শেষপর্যন্ত থেকে যায়।
ধুবড়ীর ওই গুরুদ্বারের হালুয়াটা আমার মারাত্মক পছন্দ হয়েছিল। এখনো মনে আছে. আমার মেজপিসির বাড়ি ছিল ধুবড়ি। আমি আমরা আদরপিসি ডাকি। বিশাল বড় ছড়ানো বাড়ি, ওদিকের স্টাইল মতন ইউ শেপের, পেছনে বাগান, কুয়ো। প্রায় সপ্তাতিনেক ছিলাম। স্বপ্নের মতন কেটেছিল দিনগুলো। মনে আছে ফেরার সময় হেঁচকি তুলে কেঁদেছিলাম ফিরতে চাইনা বলে। তখন ছোট ছিলাম, ইচ্ছে অনিচ্ছেয় প্রিটেনসের কোন জায়গা ছিল না। আজকে ওরকম হলে বোধয় মুখে হাসি, মনে কান্না নিয়ে ফেরত চলে আসব।
ReplyDeleteযা বলেছ, চুপকথা। তোমার সঙ্গে ধুবড়ি কমন পড়ায় খুব ভালো লাগল।
Deleteতাহলে ঘুরেই আসুন আর সাথে খানিক ডুয়ার্স ।
ReplyDeleteআর বলবেন না, নালক। ডুয়ার্স ডুয়ার্স করছি কবে থেকে, হচ্ছে আর না।
DeleteHmm Kakimar sathe eirokom ekta trip hole khub bhalo hobe..
ReplyDeleteকিন্তু হবে বলে মনে হয় না।
DeleteEi mon kharap gulo jaye na :(
ReplyDeleteহক কথা, অর্পণ।
DeleteLekhata boro mon chhunye gelo...
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুস্মিতা।
DeleteKuntala besh kichudin por por tor blog pori. Ek tana portei thaki. Khanikta neshar moton. Khub bhalo lagere.
ReplyDeleteআরে পাপড়ি যে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
DeleteAmar 15 year old meye r kotha bhabchi ar khub hanschi. Hopefully 20 years por ei rokom kichu likhbe. Kintu ekhon tumi jemon korechile thik seirokom i kore!!!
ReplyDeleteBM
নিশ্চয় লিখবে, বি এম।
Deleteআমি কখনো কুচবিহার যাইনি, ধুবড়িও না...আর উপরে একজন বললেন না, এই খারাপ লাগা গুলো সরানো যায়না, সত্যিই তাই বড় অপরাধবোধ হয়।
ReplyDeleteও হ্যাঁ আমার অফিসেও তাই তাই বা না থাকি কিছু যায় আসেনা।
ওইরকমই ভালো, প্রদীপ্ত। অফিসে সবার নয়নের মণি হয়ে থাকার বিপদটাই বেশি আমার মতে।
Deleteকুন্তলাদি, পরের বার কুচবিহার গেলে আমার বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকলো :)
ReplyDeleteআরে নিশ্চয় নিশ্চয়, ঊর্মি।
DeleteAmi cooch behar er meye. Kintu aj 12 bochor baire. Apnar lekhay chotobelar shahar ta k khuje pelam. Brishti bheja rajbarir ghas gulo jno amakeo daklo. Valo laglo.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, শ্যামশ্রী। আমি কুচবিহার একবারই গিয়েছি, কিন্তু শহরটা এখনও চোখে লেগে আছে।
Delete