মহালয়া
উৎস গুগল ইমেজেস
আমাদের এদিকে বাংলা সিনেমা আগে তাও যা দুয়েকটা আসত, বন্ধ হয়েছে। পুজোয় বাঘা বাঘা পরিচালকদের যা সব বাংলা সিনেমা রিলিজ করেছিল, একটাও আসেনি, ভাবতে পারেন? ভাগ্যিস হইচই-এ ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হল, তাই আর পিছিয়ে পড়তে হল না।
আমরা তাই আশা ছেড়ে দিয়েছি। এবার যা যা দেখার ইচ্ছে থাকবে, নয়ডা গিয়েই দেখব। শুক্রবার দুজনেরই ছুটি ছিল, ঝকমকে রোদ্দুর ছিল, তাপমাত্রা হয়তো এই শেষ উইকএন্ডের মতো সহনীয় ছিল, কাজেই ভাবলাম বাংলা সিনেমা দেখে উদযাপন করি। নয়ডার হলে দুটো সিনেমা চলছিল, মহালয়া আর মুখার্জিদার বউ। নাম দেখে বাছতে দুজনেই একমত হলাম। কেটে ফেললাম মহালয়ার টিকিট।
সৌমিক সেনের পরিচালনা, কাহিনী, চিত্রনাট্য আর সৌমিক সেন ও তন্ময় মুখার্জির সংলাপে একশো আট মিনিটের ‘মহালয়া’র গল্প নিয়ে স্পয়লার-সতর্কতা জারির দরকার নেই। উনিশশো ছিয়াত্তর সালে, উনিশশো একত্রিশ থেকে চলে আসা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সম্প্রচার স্থগিত করে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বদলে উত্তমকুমারের মন্ত্রোচ্চারণে ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ অনুষ্ঠান সম্প্রচারণের ঘটনা নিয়ে বানানো হয়েছে মহালয়া।
তখন ভারতবর্ষে এমারজেন্সি। রাজনীতি, সংস্কৃতি সবেতেই সরকারি চোখরাঙানি চলছে। শুরুতে কিশোরকুমারের সঙ্গে আকাশবাণীর দিল্লির বড়কর্তা শশী সিনহার (প্রসেনজিৎ) কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে যায় যে শিল্পীর অধিকারে ডাইনেবাঁয়ে হস্তক্ষেপ চলছে। এই পরিস্থিতিতে ওপরমহলের নজর পড়ে কলকাতা আকাশবাণীর অন্যতম জনপ্রিয় এবং দীর্ঘজীবী অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনীর ওপর। পুরোনো বদলে নতুনকে বরণ করার সদিচ্ছে বা সব বিষয়ে সরকারি নাক গলানোর বদিচ্ছেয় সমন জারি হয় মহিষাসুরমর্দিনীর খোলনলচে বদলে নতুন ‘মহালয়া’ শুরু করার।
সকলেই যে ব্যাপারটার বিরুদ্ধে ছিলেন তেমন নয়। “বড়দা” “বড়দা” বলে চালালেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে চিনতে কোনও অসুবিধে হয় না। বম্বেতে সিনেমার কাজে ব্যস্ত থাকা এবং রিহার্সালে যোগ না দিতে পারার জন্য ওঁকে গাইতে দেননি, সেই নিয়ে পঙ্কজ মল্লিকের ওপর হেমন্তের রাগ ছিলই, তিনি সাদরে নতুন অনুষ্ঠানের নেতৃত্বের ভার নেন। স্টার পাওয়ার দিয়ে বাজিমাত করার জন্য গানে আশা লতা ইত্যাদিদের বরাত দেওয়া হয়। কিন্তু বলা বাহুল্য, গোটা উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকেন মহানায়ক উত্তমকুমার। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রিপ্লেসমেন্ট।
উনিশশো ছিয়াত্তরের তেইশে সেপ্টেম্বর ঊষাকালে উত্তমকুমারের মহালয়া সম্প্রচারিত হল। গোটা শহরের “অ্যালার্ম ক্লক ওভারটাইম খাটল।” তারপর শুরু হল ব্যাকল্যাশ। খবরের কাগজের হেডলাইন জুড়ে নিন্দে, রকে রকে ছ্যা ছ্যা, দোতলা থেকে রেডিও আছড়ে ফেলে ভাঙতে লাগল বাঙালিরা।
প্রথমে সিনেমাটার কী কী ভালো বলে নিই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে শুভাশিস মুখার্জির অভিনয় মারাত্মক ভালো, উত্তমকুমারের রোলে যীশুও ভালো, দিল্লির আকাশবাণীর মেজকর্তা মিস্টার ব্যানার্জির রোলে কাঞ্চন মল্লিকও চমৎকার। তাঁর বদমাস “হিন্দুস্থানি” ভিলেনের চরিত্রটি একেবারেই পরিমিত নয়, কিন্তু প্রসেনজিৎ পরিমিত এবং যথাযথ অভিনয় করেছেন। অবশ্য একজন আস্ত “ইন্ডাস্ট্রি”র থেকে এ পারফরম্যান্স প্রত্যাশিতই। আজকালকার অন্যান্য বাংলা সিনেমার তুলনায় সংলাপে ওপরচালাকি প্রায় নেই, সেটসজ্জাও বাস্তবসম্মত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িখানা বাজখাঁই হলেও মধ্যবিত্ততার ছাপটা মেন্টেন করা হয়েছে। ঘরের কোণে একখানা ইনডোর প্ল্যান্ট গুঁজে দেওয়া হয়নি।
সিনেমাটার মূল অসুবিধে হচ্ছে যেহেতু গল্পটা জানা, টানটান ব্যাপারটা নেই। চেনা গল্পে নাটকীয়তা উৎপাদনের যদি কোনও ফরমুলা থেকে থাকে, মহালয়া কর্তৃপক্ষের সেটা জানা ছিল না বা প্রয়োগ করে উঠতে পারেননি। কাজেই সিনেমাটা বোরিং হয়েছে। অন্তত আমার লেগেছে। সংলাপের মান নিয়ে আমার অভিযোগ নেই, পরিমাণ নিয়ে আছে। সকলেই ক্রমাগত কথা বলেন, বলতেই থাকেন। গোটা সিনেমাটা সংলাপে বলা হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না।
নস্ট্যালজিয়ার হেস্তনেস্ত তো আছেই। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের পর কনস্ট্রাকটিভ কিস্যু করেনি, হিন্দুস্থানি বসের ভয়ে মহালয়া না শুনে টাইমে অফিসে আসা মানে পা চাটা ইত্যাদি মানসিকতার প্রতি কর্তৃপক্ষের পক্ষপাত স্পষ্ট। যাক, সে পক্ষপাত অনেকেরই থাকে কাজেই এ সব নিয়ে আমি নিন্দে করতে চাই না। তাছাড়া সিনেমা শুরু হওয়ারও আগে ব্যাপারটা যে নস্ট্যালজিক হতে চলেছে সে ব্যাপারে আমি প্রস্তুত ছিলাম, কাজেই চোখে লাগেনি।
যেটা চোখে লেগেছে সেটা হচ্ছে সিনেমার সাষ্টাঙ্গ ভঙ্গিটা। রবীন্দ্রনাথ, উত্তমকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ - সকলের প্রতিই এ সিনেমা গলবস্ত্র। যারা খারাপ তারা একেবারে যমের অরুচি আর যারা ভালো তারা ধোয়া তুলসীপাতা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দায়ে পড়ে একটু ভিলেন ভিলেন দেখাতে হয়েছে কিন্তু তিনি লাস্ট সিনে কেঁদে প্রায়শ্চিত্ত করেছেন, কাজেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রতি একটি নব্য অভিনেতার (আধুনিকতার প্রতিনিধি) ‘জ্ঞান দেবেন না, দাদু’ জাতীয় ডায়লগবাজির অসভ্যতা এবং তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অনুরাগীর (সাবেকিয়ানার প্রতিনিধি) ছোকরাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করার বাড়াবাড়িটা না থাকলেও হত। প্রসেনজিতের শশী সিনহার চরিত্রটি একটি আনকালচার্ড, বাঙালিবিদ্বেষী ‘অবাঙালি’র ক্যারিকেচার। আর উত্তমকুমার যেন বড় বেশি অ্যাপোলোজেটিক। উনি হয়তো সত্যিই দুর্গা দুর্গতিনাশিনী দায়ে পড়ে করেছিলেন, অনুষ্ঠান সম্প্রচারের আগে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়ি গিয়ে দেখা করেছিলেন এ সবই আমি বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু দুর্গা দুর্গতিনাশিনী ওইরকম ভয়াবহরকম মুখ থুবড়ে পড়ার পর, চতুর্দিকে রি রি পড়ার পর, ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী চালিয়ে রেডিও কর্তৃপক্ষের নাকখত দেওয়ার পর, একবিন্দু না টসকে, একটুও না দুঃখ পেয়ে, হাসিহাসি মুখ আর ছলছল চোখে ‘এতদিনে সত্যি সত্যি পুজো এল’ বলে ওঠাটা আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না। অত বড় স্টার এত ইগোহীন হন না। এত ইগোহীন হলে অত বড় স্টার হওয়া যায় না।
একটা অবান্তর আবদার | Ayn Rand, Fountainhead বা Atlas-Shrugged নিয়ে আপনার মতামত কী তা জানার খুব আগ্রহ আছে আমার | এই নিয়ে একটা লেখা পেলে খুব ভালো হয় |
ReplyDeleteহাহা, এ নিয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই, সম্বরণ। কারণ আমি আয়ান র্যান্ডের একটাই বই পড়েছিলাম, ফাউন্টেনহেড, পড়ে নমো করে চলে এসেছি। আর কিছু পড়ার সাহস বা ইচ্ছে কোনওটাই হয়নি।
Deletehahaha
Deleteকী আর বলব ট্রেলার দেখে মুগ্ধ আমিও ল্যাব কেটে সিনেমাটা first day first show দেখতে গিয়েছিলাম, তারপর...
ReplyDeleteআর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অনুরাগী সাবেকিয়ানার প্রতিনিধি গলাধাক্কা দেওয়ার পরেই আবৃত্তি শুনে বললেন "আপনার কণ্ঠস্বরে আমার বুকের ভেতর বৃষ্টি ঝরে"। অসহ্য! আপনি তবুও অনেক ভাল জিনিস দেখতে পেয়েছেন, মহালয়া দেখতে গিয়ে আমার নিজেরই ওপরে যা রাগ হল!
ময়ূরী
হ্যাঁ হ্যাঁ ওই বুকের মধ্যে বৃষ্টি-টা আমারও মনে আছে, ময়ূরী। আর সিনেমার চরিত্ররা কিছু একে অপরের মুখের সামনে প্রশংসা করতে পারে। আপনি তো জিনিয়াস, আপনি তো স্থিতধী, আপনি তো স্টার, আপনি তো ভগবান... ক্রিঞ্জফেস্ট যাকে বলে।
Deleteযদিও এই সিনেমাটি দেখা হয়নি তবে 'হার্বাট' দেখার পর থেকেই আমার বিশ্বাস যে শুভাশীষ বাবু যাকে বলে লুকানো হীরা ।
ReplyDeleteআমিও শুভাশিসের ফ্যান, নালক। এতই ফ্যান যে আজকাল টিভিতে প্রসেনজিতের মজারু বন্ধুর চরিত্রওয়ালা সিনেমগুলোতেও ওঁকে দেখতে ভালো লাগে।
Deleteঅসাধারণ হয়েছে রিভিউ ,যদিও সিনেমা টা দেখিনি। কিন্তু এই অতিভক্তি ব্যাপারটা বাঙালির মজ্জাগত তাই তোমার অবসারভেশন যথাযত।
ReplyDeleteএই লাইন টা too good হয়েছে :)
"বীরেন্দ্র কিশোরের বাড়িখানা বাজখাঁই হলেও মধ্যবিত্ততার ছাপটা মেন্টেন করা হয়েছে। ঘরের কোণে একখানা ইনডোর প্ল্যান্ট গুঁজে দেওয়া হয়নি। "
থ্যাংক ইউ কাকলি। তোমার কমেন্ট পড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নামের টাইপোটা ঠিক করে দিলাম। ইনডোর প্ল্যান্টের ভয়টা যুক্তিযুক্ত কিনা বল?
Deleteআমার কমেন্ট এও typo আছে :)
Deleteআজকাল আবার দেখি সব হিন্দি/বাংলা সিনেমা বা সিরিজ গুলোতে বাড়ির ফ্লোর গুলো হার্ডউড - কবে কখন কেন আমাদের দেশের সিমেন্ট এর মেঝে হার্ডবোড হয়ে গেলো কেজানে!
আরে এখন হার্ডউড প্রচণ্ড চলছে, কাকলি। রাস্তায় যেতে যেতে বিজ্ঞাপন দেখি ফ্ল্যাটের, হার্ডউড ফ্লোর লেখা থাকে বড় বড় করে। ন্যাতা বোলাবে কী করে কে জানে। সম্ভবতঃ কার্পেট পেতে রাখতে হবে। গরমকালে গড়াগড়ি খাওয়ার আরাম হাওয়া। অবশ্য গরম না লাগার জন্য সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশনিং থাকবে। সেটারও বড় বড় অক্ষরে বিজ্ঞাপন থাকে, হার্ডউড মেঝের ঠিক ওপরেই।
DeleteMAc computer ar iPhone ta bolle na? Real life e sobai windows pc ar android use kore kintu cinema te....
Deleteহাহা, তাও ঠিক। তবে আমার অফিসের বাচ্চাকাচ্চাদের দেখলে ম্যাকের ব্যাপারটা খুব একটা অতিরঞ্জন মনে হয় না।
Delete