শিবুদের কলকাতা ভ্রমণ
কই আমার তো ঠাণ্ডা লাগছে না। কেন বল তো? কারণ আমি রোজ চান করি। তোরা চান করবি না, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা করে চেঁচাবি…
ভোরবেলা অর্চিষ্মানকে ঠেলে তুলতে ব্যর্থ হয়ে, “তুমি চালিয়ে এস, আমি বন্ধ করে আসব,” এই সব প্রমিস মিথ্যে জেনেও পাম্প চালিয়ে এসে শুয়ে শুয়ে এই বাণী শুনতাম। রোজ। বচন সামান্য আলাদা আলাদা।
একেকবার মনে হত লেপের আরাম ছেড়ে উঠে গিয়ে চানদাদাকে দেখে আসি। আর যাকে রোজ সকালে জ্ঞানের ভিকটিম হতে হচ্ছে সে বেচারাকেও।
বাড়ি গেলে পাম্প চালানোটালানোর দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হয় না। অর্চিষ্মানের কথা বলতে পারি না, নাকতলা এবং রিষড়ার আমার প্রধান দায়িত্বটা থাকে আরাম করার। যতক্ষণ পারা যায় মুড়িশুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকব, মা চা করে ডাকবেন, বাথরুম থেকে এসে দেখব বাবা বিছানা তুলে রেখেছেন, এইরকমই চালচলন। এইবার একটু অন্যরকম হল কারণ বাবা মা দুজনেই অন্যত্র ব্যস্ত, কাজেই নাকতলার বাড়িতে আমরা দুজন।
এবারের ছুটি অন্যবারের থেকে বেশি ছিল। খানিকটা কাজের জন্য, খানিকটা আনন্দ করার জন্য। আর আনন্দই যদি করব তবে একেবারে চুটিয়েই করব।
কিন্তু আনন্দ করার ধকল মারাত্মক। শেষদিনে এমন অবস্থা হয়ছিল, জীবনে প্রথম মজা করার টু ডু লিস্ট বানাতে হল। পাছে কিছু মিস হয়ে যায়। সত্যি বলব, দু’ডিগ্রির দিল্লিতে একা ফিরে এসে নিজের নিরানন্দ ঘরটিতে ঢুকে হাঁফ ছেড়েছিলাম। সে প্রাণঘাতী আনন্দের গল্প, যেটুকু যা মনে আছে বলছি।
নাহুমটাহুম ফ্লুরিজটুরিজ
বোঝো। শনিমঙ্গলবার কালীবাড়ি যেতে আছে নাকি?
মিমির প্রশ্নটা শোনার পর উত্তরটা মারাত্মক সহজ মনে হচ্ছিল কিন্তু গোড়াতে আমাদের মোটা মাথায় এই সহজ সত্যিটা ঢোকেনি বলাই বাহুল্য। না হলে কেউ, মামা-মিমির জন্য ভালোবেসে হলেও, চব্বিশে ডিসেম্বর সন্ধেবেলা কেক কিনতে নাহুমের দোকানে যায় না। যত সব বাঙালে কারবার। অর্চিষ্মান হাফ বাঙাল হয়েও নিজেকে বাগবাজারের ঘটি বলে চালায়, কাজেই এই বাঙালপনার দায় নিতে চাইবে না। কিন্তু আমি আগাপাশতলা বাঙাল, আমার কোনও অসুবিধে নেই। গিয়ে দেখি দোকান পেঁচিয়ে লাইন লিন্ডসে স্ট্রিট ছুঁয়েছে। নাহুমের দোকান অবধি পৌঁছতেই আমাদের সব বোকামো খরচ হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যিস, লাইনে দাঁড়ানোর প্রশ্নই যে ওঠে না সে বিষয়ে দুজনেই একমত হলাম। তারপর সাধনা শুরু হল ওই জনসমুদ্র থেকে বেরোনোর। হেঁটে হেঁটে কোমর ব্যথা। তার মধ্যে এদিকওদিক উড়ে আসা থুতু, অনালোকিত ফুটপাথ থেকে প্লাস্টিকের ফুল ধরা কিশোর হাত, দোকানের সামনে অঞ্জলি পেতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা - আমি সিরিয়াসলি ভেবেছি শনিমন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন, তারপর আবিষ্কার করলাম তিনি দুই হাতে কাগজের প্লেটে স্যান্ডুইচ না বার্গার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, সসের প্রত্যাশায়। উবার আসতে নিল আরও তিরিশ মিনিট, ও তল্লাট ছেড়ে বেরোতে লাগল আরও এক ঘণ্টা। মাঝরাতে মামাবাড়িতে পৌঁছে সুগার অ্যান্ড স্পাইসের পাম কেক মিমির হাতে তুলে দিয়ে সাফাই গাইলাম। মামা মিমি বললেন, দিদিসোনারও নাকি এক্স্যাক্টলি এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বড়দিনের বাজারে নাহুমে লাইন দিয়ে হন্যে হয়ে লাস্টে পাড়ার দোকানের কেক কিনে বাড়ি ফেরা। শুনে আমরা খুব গলা খুলে হাসলাম।
সত্যি কথা বলতে কি নাহুমটাহুম যেতাম না, তারপর চতুর্দিকে ইহুদি দোকান + মুসলিম বেকার + খ্রিস্টান পরব = #কলকাতা ইত্যাদি দেখেশুনে পেটের ভেতর এমন ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং জাগল যে যেতেই হল। কলকাতাতেই (বা অন্য যে কোনও শহরেই) এমন আজুবা সম্ভব বলে একেকটা স্ট্রে ঘটনা উল্লেখ করে লোকে যখন হ্যাশট্যাগ দেয়, সিরিয়াসলি হাসি পায়। এই কলকাতার বাসে যে পরিমাণ যৌন হেনস্থা আমি সয়েছি পৃথিবীর আর কোনও সিটির বাসে, এমনকি দিল্লির বাসেও, সইতে হয়নি। সিটি নিয়ে লোকে এত উত্তেজিত কেন কে জানে। হট সিটি, কুল সিটি, বুদ্ধিমান সিটি, গামবাট সিটি। আমি যে ক'টা সিটিতে থেকেছি, সব সিটিতেই দু’পা দু’হাত দু’চোখওয়ালা মানুষ থাকে আর তারা সবাই এক্স্যাক্টলি একরকম। সমান বাঁদর, সমান গাধা। রোগা মোটা সমান হাঁদা।
কলকাতার শ্রেষ্ঠত্ব একটা জায়গাতেই আমি মেনে নিতে রাজি আছি। আমার মামাবাড়ি কলকাতায়। এখন আবার মামাশ্বশুরের বাড়িও কলকাতায়। কলকাতা সি আই ডি-র এক এপিসোডে একটা সংলাপ ছিল, একজন কুলাঙ্গার মামার গালে থাবড়া মেরে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়ে অফিসার বলছেন, "মামা শব্দটা দুটো মা দিয়ে তৈরি আর আপনি কিনা সেই শব্দের অপমান করলেন?"
দুটো মামাবাড়ি মানে চার বার মা। কাজেই গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। মামাবাড়ির অন্যতম প্রথম স্মৃতি যা আমার মনে আছে, আমার সন্দেহ অনেক মামাবাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গেই তা কমন পড়বে। তখনও কসবার বাড়ি হয়নি, মাঝের হাটে ছোটমামীর কোয়ার্টার ছিল। কোয়ার্টারের মেঝেতে বাবু হয়ে বসে খাচ্ছি, ও পাশে মা বসে খাচ্ছেন, এ পাশে মামী বসে খাবার দিচ্ছেন। খেয়েই যাচ্ছি খেয়েই যাচ্ছি, পেট ভরে গেছে কিন্তু থামছি না। মায়ের খাওয়া শেষ, মামী বলছেন, আস্তে আস্তে খাও সোনা, কোনও তাড়া নেই। এটাও মনে আছে, বাড়ি ফেরার পথে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে, মা, আজ যেমন পেট ভরেছে এত আগে কখনও ভরেনি। মা সিরিয়াস মুখে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, তাই বুঝি?
মা নেই, কিন্তু মামাবাড়িতে খেয়ে পেটভরার ফিলিংটা অবিকল আছে। চা কেক, চানাচুর, মিষ্টি। ভাত বেগুনভাজা শুক্তো চচ্চড়ি মোচা ধোঁকা ফুলকপি পায়েস। কী করে সব চেটেপুটে শেষ করি কে জানে। মামাবাড়ি গেলে পাকস্থলীর আয়তনও বেড়ে যায় নির্ঘাত।
কলকাতাকে যদি কোনও হ্যাশট্যাগ দিতেই হয় তাহলে আমি দেব #মামাবাড়ি।
যেটুকু বাঙালপনা বাকি ছিল সেটা পূরণ হয়ে গেল বড়দিনের সকালে ফ্লুরিজে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে। সে যন্ত্রণার কথা আর ফুলিয়েফাঁপিয়ে ব্যাখ্যান চাই না। শুধু কয়েকটা বুলেট পয়েন্ট দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমরা সাড়ে ন'টা নাগাদ যখন পৌঁছেছি তখনই অলরেডি দরজার বাইরে সিকিউরিটি খাতাপেন নিয়ে দাঁড়িয়ে নামের লিস্ট বানাতে শুরু করেছেন। আমাদের নাম লেখানো হল ছত্রিশ নম্বরে, এদিকে ঢুকেছে তখন মোটে পাঁচ না ছয়। ঝাড়া দু'ঘণ্টা পর আমরা যখন ঢুকলাম তখন লিস্ট পৌঁছেছে সাতাত্তরে এবং অপেক্ষারতরা কেউই রণে ভঙ্গ দেওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছেন না। সে একেবারে অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার। দেখার মতো কাণ্ডকারখানা। ওই ভিড়ের চল্লিশ শতাংশ লোক যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমরা তাঁদের মতো নই। এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে আমাদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে তাঁদের মতো না হওয়া। কিন্তু বলাই বাহুল্য, আমরা আসলে এক্স্যাক্টলি তাঁদের মতো, না হলে এই রকম অতি স্পেসিফিক একটা পরিস্থিতিতে তাঁদের সঙ্গে যেচে কনুই ঠেলাঠেলি করতে যেতাম না।
সত্যি বলতে কি আমার অত বেশি গ্লানি হয়নি। ভালোই তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। অন্যের বোকামোয় মনোযোগ দিয়ে নিজের বোকামো অগ্রাহ্য করছি। সামনে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সব কাজ উনি করছেন, লাফালাফি করে নাম লেখাচ্ছেন, উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছেন লিস্টের নাম কদ্দুর এগোল, জায়গা হল কি না, কখন হতে পারে, আর ওঁর সঙ্গে যারা এসেছে তাঁরা পেছনে দাঁড়িয়ে খালি বলছে, এত ভিড়ে কেউ আসে এত ভিড়ে কেউ আসে। এদিকে নিজ দায়িত্বে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সাহসও নেই। ভদ্রমহিলা শেষমেশ বললেন, আরে এত নালিশ করলে হবে, ভিড় দেখতেই তো এসেছি। আমার মহিলাকে ভারি পছন্দ হয়ে গেল। আমরা ওঁর অনেক পরে হলেও ওঁর পাশেই টেবিল পেয়েছিলাম। খুব খাচ্ছিলেন। অমলেট লাও, কফি লাও। যা খাচ্ছিলেন সবাইকে দিয়েথুয়ে খাচ্ছিলেন। খোলা মনের মানুষ।
এটা নিশ্চয় মার্ফি'স ল গোছের কিছু হবে, খেয়াল করে দেখেছি আমার সামনে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে তারা সকলেই গন্তব্যে (টিকিট কাউন্টারে, পোস্টআপিসের কাউন্টারে, এক্ষেত্রে রেস্টোর্যান্টের টেবিলে) গিয়ে যত সময় নেয়, আমার তার অর্ধেক সময়ে কাজ হয়ে যায়। কিছুতেই লাইনে দাঁড়ানোর সময়টুকু উশুল করা হয় না। টেবিলের আশায় দু'ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে, টেবিল পাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। কোনও মানে হয়? আমরাও টেটিয়া হয়ে চা কফি নিয়ে আরও আধঘণ্টা টেবিল দখল করে রইলাম।
আমার টোফু স্ক্র্যাম্বলটা খেতে সত্যি সত্যিই ভালো ছিল। অর্চিষ্মান জানিয়েছে ওর এগস বেনেডিক্টও মচৎকার ছিল। খেয়েদেয়ে দু’পিস চকোলেট কিনে, সাড়ে ন'টা টু সাড়ে বারোটা, জীবনের তিনটে ঘণ্টা ফ্লুরিজকে গচ্চা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। অর্চিষ্মান বলল, বস্স্, এই প্রথম এই শেষ। আমি বললাম, নেভার সে নেভার।
সিনেমাটিনেমা
মজা করার লিস্টে দ্বিতীয় আইটেম ছিল সিনেমা। প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো আর সাগরদ্বীপের যখের ধন। আমার কেন যেন দুরাশা ছিল মিতিনমাসি এখনও কলকাতার হলে আমার প্রতীক্ষায় বসে থাকবেন। ছিলেন না। মিতিনমাসি মিস আমার দু’হাজার উনিশের টপ থ্রি আফসোসের মধ্যে একটা। কবে যে হইচইয়ে দেবে। শুধু শঙ্কুটাই দেখা হল। আবার বাঙালে কারবার করে পঁচিশে ডিসেম্বর হলে গিয়ে 'যখের ধন'এর টিকিট পেয়ে যাব ভেবে সকালবেলা বুক করতে গিয়ে দেখি সোল্ড আউট।
গল্পটা সবাই জানে। ব্রেজিলে শঙ্কুর সেমিনারে ডাক এসেছে, এদিকে নকুড়বাবু সকালবেলা "তিলুবাবু আছেন নাকি" বলে শঙ্কুর গিরিডির বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। গোলা তেঁতুলের আচার খেতে খেতে তাঁর মাথায় বাজ পড়েছে, তিনি ত্রিকালজ্ঞ হয়ে গেছেন। ব্রেজিলে গেলে শঙ্কুর বিপদ আছে এই কথা আগেভাগে জেনে তিনি এসেছেন সাবধান করতে। এরপর সেক্রেটারি হয়ে তিনি শঙ্কুর সঙ্গে ব্রেজিল গেলেন, সেখানে সত্যি সত্যি শঙ্কুর বিপদ হল, নকুড়বাবুর সৌজন্যে সে বিপদ দূরও হল, সঙ্গে ফাউ হিসেবে অ্যানাকোন্ডা আর সোনার শহর এল ডোরাডো দেখাও হল।
শঙ্কু সিনেমার একটা ভালো ব্যাপার বলে নিই। আমার চেনা অনেকের বিদেশী হ্যাংওভার থাকতে দেখেছি। বিদেশী পুলিস ঘুষ খায় না, বিদেশী পকেটমাররা পকেট মারে না, বিদেশী রাজনীতিকরা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা। শঙ্কু দেখলে সে হ্যাংওভার ঘুচে যাবে। সব বিদেশী অভিনেতারা দেশীদের তুলনায় খারাপ অভিনয় করেন। যবে থেকে প্রসেনজিতের মজারু বন্ধুর অভিনয় করার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন তবে থেকে আমার শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে ভালো লাগে, এখানে নকুড়বাবুর চরিত্রেও ভালো লেগেছে। নিউটনের চরিত্রে অভিনয় করা বেড়ালটি মারাত্মক ভালো দেখতে। শঙ্কু নিয়ে আমার বেশি কিছু বলার নেই, তবে আমার মাথায় শঙ্কু বলতে নিড়বিড়ে, অল্প কুঁজো, রুগ্ন চেহারার একটা আধবুড়ো লোকের ছবি ভাসে। ধৃতিমান সে তুলনায় বড্ড স্মার্ট।
প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো দেখে সেটাই মনে হল যা সত্যজিৎ রায়ের গল্প নিয়ে বানানো সন্দীপ রায়ের বেশিরভাগ সিনেমা দেখলেই হয়। সিনেমাগুলো গল্পের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে না। মানে সিনেমাটা দেখলে কিছু তো আলাদা আবেগ জাগবে, হয় নস্টালজিয়া, কিংবা মায়া, কিংবা রাগ, কিংবা দুঃখ, কিংবা থ্রিল, সে রকম কিছু জাগে না। আমি সাধারণত উল্টো মতেরই পথিক, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সোর্স মেটেরিয়ালের প্রতি এতখানি একনিষ্ঠ না থাকলেই বোধহয় ভালো হত। অভিনেতারা বলার আগেই যদি আমি সংলাপ বলে ফেলি তাহলে কেমন একটা না? কী জানি, নতুন রকম করতে গেলেও আবার লোকের রাগ হতে পারে, আমাদের শৈশবের নস্ট্যালজিয়া মাটি করার তুই কে।
রুটিটুটি
কলকাতায় এখন যদি কিছুর ব্যবসা ফাঁদতে হয় তো রুটির ব্যবসা ফাঁদা উচিত। কলকাতার লোকেরা বাড়িতে রুটি বানানো ছেড়ে দিয়েছে বলে খুব নিন্দে করছিলাম, সেজকাকু বলল, কলকাতা কেন, তুই সন্ধেবেলা রিষড়া বাজারে যা না, দেখে আয় কী অবস্থা। বাজার ছাপিয়ে লোকে নাকি এখন বাড়ির জানালা থেকে রুটি বিক্রি করছে। এই ছুটির মধ্যে একদিন মজা করে হাক্লান্ত হয়ে রাত সাড়ে ন'টার সময় গাঙ্গুলিবাগানের মোড়ে বাস থেকে নেমে রিকশা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে যেতে যেতে দেখি ছোট ছোট ঠেলাগাড়ির সামনে প্রায় নাহুমের সমান লাইন। প্রথমটা ভেবেছি চপের দোকান। রাত দশটার সময় বাঙালি চপ খাবে তো পেটের রোগ হবে না কী, বলে কস্টিক কমেন্ট পাস করেছি, অর্চিষ্মান বলল, চপ না রুটি। আমি তো হাঁ। কুড়ি হাত দূরে দূরে রুটির ঠেলা। প্রতিটাতেই সমান ভিড়। অর্চিষ্মান বলল, চল এদের রুটি তরকারি খাই, এত লোকে খাচ্ছে যখন নির্ঘাৎ ভালো কিছু। মিস করা উচিত হবে না। আমি বললাম, পাগল, পেট ফেটে মরি আর কী। তুমি খাও, আমি মর্যাল সাপোর্ট দেব।
যাই হোক, রুটি কিনতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটল। অর্চিষ্মান পাটুলির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য সবসময় আমাকে বলবে, এখানে আলি আকবর খান থাকতেন, জান? রাস্তার ওপারে আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি, দেখেছ? সেই সন্ধেয় অর্চিষ্মান দাঁও মারল। প্রথম তো বাস থেকে নেমেই দেখি সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে লেখক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। রুটির দোকানের দিকে এগোতে এগোতে দেখলাম উল্টোদিক থেকে একটা ছোট মতো মিছিল আসছে, পেছন পেছন হাঁটছেন মৌসুমী ভৌমিক। দেখেশুনে এমন ইমপ্রেসড হয়ে গেলাম যে সবাইকেই মনে হতে লাগল, ইনি নিশ্চয় কেউ। ইনি নিশ্চয় কেউ। এই প্রসঙ্গে সম্ভবত আনন্দবাজারে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পড়া একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। অনির্বাণ এবং তাঁর বন্ধু জোড়াসাঁকোয় পঁচিশে বৈশাখ না ওই রকম কোনও একটা রাবীন্দ্রিক দিবসে কোনও একটা অনুষ্ঠানে গেছেন। স্বভাবতই চাঁদের হাট বসেছে। থিকথিক করছে তারকা। এমন সময় রাস্তার উল্টোদিক থেকে দুজন মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে অনির্বাণের চাপদাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী পরা বন্ধুকে বলতে লেগেছে, আপনি কি কেউ? ও দাদা, আপনি কি কেউ?
রুটি কিনতে দাঁড়ালাম। আগুনের ওপর চাটু উল্টো করে রেখে তার ওপর রুটি সেঁকে তারপর স্লাইড করে ধারের দিকে নামিয়ে এনে আগুনের আঁচ দিয়েই রুটি হয়ে যাচ্ছে। চাটু সরাতে হচ্ছে না। আরও অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ পনেরোটা রুটি নেবেন, কেউ কুড়িটা। মোদ্দা কথা, দাঁড়াতে হবে। এর মধ্যে অর্চিষ্মান শান্তিপুরী জুড়েছে, আমার জন্য তোমাকে দাঁড়াতে হল, সরি সরি। তিতিবিরক্ত হয়ে হাই তুলতে তুলতে এদিকওদিক তাকাতে গিয়েই দেখি কোণের আবছায়াতে কাঁচের চৌকো বয়ামের ভেতর টিমটিমে বালবের আলোয় আলোকিত ফুচকার ছোট্ট ঢিবি! পেটে রুটি তরকারির জায়গা না থাকলেও ফুচকার জায়গা নেই তো বলিনি। গেলাম। খেলাম। ভালোই খেতে, তবে ঝাল কম। বারংবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ভদ্রলোক কেন যেন কিছুতেই ঝাল বাড়ালেন না। প্রতিশোধ হিসেবে মোটে এক প্লেট খেয়ে ক্ষান্ত দিলাম।
রুটির দোকানে ফিরে এসে দেখি ভিড় আরও বেড়েছে। ভিড়ে দাঁড়ানো এক বাবা-ছেলের জুটিকে আগেই খেয়াল করেছি এবং করা ইস্তক বাবাকে দেখে ভারি অস্বস্তি হয়েছে। খালি মনে হয়েছে, ইনি নিশ্চয় কেউ, ইনি নিশ্চয় কেউ।
রুটির দোকানে ফিরে এসে দেখি ভিড় আরও বেড়েছে। ভিড়ে দাঁড়ানো এক বাবা-ছেলের জুটিকে আগেই খেয়াল করেছি এবং করা ইস্তক বাবাকে দেখে ভারি অস্বস্তি হয়েছে। খালি মনে হয়েছে, ইনি নিশ্চয় কেউ, ইনি নিশ্চয় কেউ।
জানতাম পরামর্শ চাইতে গেলে অর্চিষ্মান চোখ কপালে তুলবে। বলা যায় না, হয়তো রুটির মায়া ত্যাগ করে চম্পটই দিল। তাই আমি আর কালক্ষয় না করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম। “আপনি কি কেউ” জিজ্ঞাসা করিনি অবশ্য, ওর একটু ভদ্রস্থ ভার্সান; আপনি কি অভিনয় করেন?
ভদ্রলোক বললেন, অভিনয় করেন না কিন্তু উনি টিভিতে তবলা বাজান। আগেও অনেকে নাকি ওঁকে চিনতে পেরেছে। ছেলেটির সঙ্গেও আলাপ হল, শাস্ত্রীয় সংগীত শিখছে। সেও অচিরেই হয়তো পরিচিত হবে।
পরদিন সকালবেলা যথারীতি চানদাদার জ্ঞানে ঘুম ভাঙল। চানটান সেরে আমরা চড়ে বসলাম উবার ইন্টারসিটিতে। গন্তব্য রিষড়া। দিল্লি রোড ছেড়ে যেই না গাড়ি বাঁক নিল, স্টিয়ারিং-এ বসা সৌরভ, বাঘাযতীনের পোলা, বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন, আহহহ, কতদিন পরে গ্রাম দেখলাম।
আরিব্বাস রে বড়দিনের সময় নাহু,, পার্ক স্ট্রীট যাবার সাহস করেছ,শঙ্কুও দেখছ এতো বিরাট সাহসের ব্যপার। আমাদের এখানে রুটির দোকানে এখনো তেমন ভীড় হয়না। সব মিলিয়ে দারুণ মজায় কেটেছে মনে হচ্ছে ছুটি।
ReplyDeleteসাহস না, বোকামো বল, প্রদীপ্ত। তবে মজা হয়েছে এটা ঠিক।
Deletechristmas-er diin flury's? sahos aache !!! ;)
ReplyDeleteওটাকে বোকা সাহস বলে, অন্বেষা।
Delete"চতুর্দিকে ইহুদি দোকান + মুসলিম বেকার + খ্রিস্টান পরব = #কলকাতা ইত্যাদি দেখেশুনে পেটের ভেতর এমন ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং জাগল যে যেতেই হল। "
ReplyDeleteliterally rofl :)
সিরিয়াসলি ,কাকলি। যত্তসব।
Deleteeto kichur sathe singara ar paramount chilo agei porechi.. sob miliye to darun moja.. seshe baghajatin er pola ke ekbar pele dekhe nitam...
ReplyDeleteহাহা, যা অভিভূত মুখ করেছিল যদি দেখতিস, ঊর্মি।
DeleteBaah khub bhalo laglo lekhata pore.... mon bhalo kore deoa lekha.... apnar sathe ekta chhotto mil aachhe aamrao Christmas er porer din lunch e Flurys gechhilam aar opchano bhire porechhilam
ReplyDeleteআরে, চব্বিশ ঘণ্টা আগে পরে একই লোকেশনে! একেই বলে সমাপতন, সুস্মিতা ।
DeleteDaarun lekha hoyeche.. nahoum, flurys er golpo darun laglo..
ReplyDeleteBTW kena ruti torkari kirokom chilo? :)
khub bhalo thakben.
Indrani
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। আরে আমি তো খাইনি কেনা রুটি তরকারি, একে গলা পর্যন্ত ভরা ছিল তার ওপর আবার ফুচকা। বাড়ি ফিরে অর্চিষ্মান যখন রুটি তরকারি নিয়ে বসল তখন আমি আধা ঘুমে। ভালোই ছিল নিশ্চয়। খারাপ হলে বলত।
Delete4numberplatform e ekta notun lekha porlam.. chorom.. songe ekta age na dekha chobi o :)
ReplyDeleteতুই এত তাড়াতাড়ি কী করে পড়ে ফেললি চার নম্বরের লেখা?! ছবিটা ভালো না?
DeleteHaha.. follow kori majhe majhe.. aj sokale dekhte peye gelam .. chobita khub bhalo hoyeche.. ekdom lekhika lagche..
Deleteহাহা, সেইজন্যই তো দিয়েছি। অ্যাট লিস্ট ছবি দেখে মনে হয় যাতে।
Deleteদেখেছেন,একটুর জন্য আপনার সঙ্গে দেখা হলনা। আমরা ২১ তারিখে শঙ্কু দেখলাম। সিনেমার সঙ্গে আপনার সঙ্গে একমত। দেখতে ভাল লাগলেও, বইয়ের থেকে এক্সট্রা কিছু নয়। মিতিনমাসি আর যখের ধন দেখতে যাওয়া হয়নি। বাগবাজার আর হুগলি ব্যালেন্স করে বাচ্চা রেখে যে শঙ্কুটা দেখতে পেরেছি এটাই ঢের। নাহুমের কেক গত শীতে কিনেছিলাম, এবছর তাই আর চেষ্টা করিনি। চব্বিশ-পঁচিশ তারিখ বাড়িতেই কাটিয়েছি। "আপনি কি কেউ?" গল্পটা একেবারে সেরা!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সুগত। আপনার ছুটি তো ফুরিয়ে এল?
Delete"ফুরিয়ে এল" স্টেজ পেরিয়ে আমরা আবার বরফের দেশে এসে পড়েছি প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে।
Deleteওহ।
Delete'আপনি কি কেউ' পড়ে খুব আনন্দ পেলাম। বলা যায় না কোনো সময়ে কোনো স্থানে আপনিও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন।
ReplyDeleteহাহা, হলে একঘর হবে।
Delete৩০শে ডিসেম্বর দিল্লীতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো অনেকদিন কুন্তলার লেখা পড়া হয়নি। মনে পড়ছিল, স্টেট ক্যান্টিনে খাওয়ার লেখাগুলো। তোমার মেল আইডি জানিনা যে যোগাযোগ করবো।
ReplyDeleteভালো থেকো গো। এখন তো ঘনঘন কলকাতা আসবে, কখনো কোন রাস্তার মাঝে হয়তো দেখাও হয়ে যাবে।
সেই বইমেলার মতো, তাই না?
Deleteহয়তো তাই।
ReplyDeleteকাকীমা ভালো আছেন। তুমি আর কাকু সুস্হ থেকো।
থ্যাংক ইউ।
Delete