পাড়া
উবার সৌরভের সমর্থনে একটা কথা বলা যায়, দিল্লি রোড থেকে বাঁক নেওয়ার পর খানিকটা জায়গা সত্যি গ্রামের মতই। 'বাংলাদেশের গ্রামের বৈশিষ্ট্য যাহা জান লিখ' প্রশ্ন এলে শহরের ছাত্ররা যা যা লিখবে তার সবই ওই কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে আছে। গাছ? আছে। পুকুর? আছে। বাঁশবন? আছে। মাঠ? আছে। মাঠের প্রান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৯৯)? আছে। সদ্য পোঁচ দেওয়া কটকটে কমলা রঙের শিবমন্দির? আছে। ছাদের ওপর শিক বার করা আধপাকা বাড়ি? আছে।
বাঁশবনের মাথা ছাড়িয়ে দূরে দোতলা বাড়ির মাথায় উঁচু সবুজ রঙের মুখব্যাদান করা, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে থাবা তোলা মানুষপ্রমাণ ডাইনোসরের স্ট্যাচু? আছে।
আমাদের পাড়ায় একটা বাড়ি ছিল যার বারান্দার মাথাটা জাহাজের মতো তিনকোণা ছিল বলে বাড়িটার নাম হয়ে গিয়েছিল জাহাজবাড়ি। কাউকে ঠিকানা বলতে গেলে দারুণ সুবিধে। জাহাজবাড়ি থেকে তিনটে বাড়ি এগিয়ে বাঁদিকের বাড়িটা। ছোট শহরে এ রকম ল্যান্ডমার্ক থাকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে হামেশাই চোখে পড়ে, ঘেঁষাঘেঁষি ছাদের মাথায় সিনটেকস কিংবা প্যাটন ট্যাংকের ভিড়ে আচমকা একটা মস্ত বড় ফুটবল। মারাত্মক রিয়েলিস্টিক। কে বলবে জলের ট্যাংক। আমার মায়ের এই রকম একটা ল্যান্ডমার্কের শখ ছিল। মা একটা বড় বাড়ি বানাবেন, বাড়ির ছাদে সেতার বাজানো একটা লোকের মূর্তি থাকবে।
আমার মা বাড়ি (ফ্ল্যাট) বানিয়েছিলেন, বিয়াল্লিশ বছরে নিজে নিজেই গিয়ে সেতারের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। কী ভাগ্যিস দুটোকে পাঞ্চ করেননি। মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বলি, থ্যাংক ইউ। মায়ের এই ছবিটা সম্ভবত পাসপোর্ট ফোটোর এনলার্জমেন্ট। মৃদু হাসিতে আড়ষ্ট ভঙ্গি। অন্য কেউ বুঝতে পারবে না; মা স্বাভাবিকের থেকে বেশি মুখ নিচু করে রেখেছেন। ক্যামেরাম্যান বলেছিল নিশ্চয়, বৌদি মুখ আরেকটু নিচু করুন। আমাকেও বলে। চিন্ থোড়া নিচে কিজিয়ে। যেই না বলে, মায়ের সামান্য উঁচু করা উদগ্রীব মুখখানা মনে পড়ে যায় আর মায়ের একটা লক্ষণ আমার মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি মনে পড়ে মন ভালো হয়ে যায়।
ছবিটা প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। মনে হত আমার মায়ের মতো দেখতে না। এক সেকেন্ডের বেশি তাকাতে পারতাম না। এখন পারি। মা ছবির মধ্যে সেটল করে গেছেন। ঠাকুমা তারও আগে, পিসি তার অনেক আগে। বাড়িশুদ্ধু সবাই দেওয়ালে সেটলড। আমি আর বাবা খালি মেঝেতে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছি।
ছবির নিচে দেওয়ালে পোঁতা পেরেকে চাবি ঝোলে। বেল বাজলে তড়িঘড়ি ঘোষণা করি, আমি যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি। কারও নিজের কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর দরকার নেই। বাড়িতে আছি, একটা কাজে তো লাগি। ফল উল্টো হয়। কোনওবারই গ্রিলের তালার চাবি খুঁজে পাই না। প্রত্যেকবার চাবি কোথায় চাবি কোথায় হইচই পড়ে। শেষটা অন্য কাউকে এসে উদ্ধার করতে হয়। চাবি ঝুলছে আমার নাকের সামনে, অথচ আমার চোখে পড়ছে না। এমন নয় যে নতুন জায়গা পাল্টানো হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ বছর চাবি ওইখানেই ঝুলছে। এই রকম আরেকটা অসম্ভবের উদাহরণ সুইচ। গত চার পাঁচ বছর ধরে আমাদের সব ঘরে, কালো, গোল, খটাস সুইচের বদলে সাদা রঙের আধুনিক তন্বী এবং মৃদুভাষিণী সুইচ। আমার এখনও মুখস্থ হয়নি কোনটা কোন আলোর। ভাড়াবাড়ির সুইচ একবেলায় কণ্ঠস্থ হয়ে যায়, এদিকে বাড়িতে টিউবলাইট জ্বালাতে গেলে ফ্যান, নাইটলাইট, প্লাগ, আরও যে ক'টা সুইচ আছে সব টিপে অবশেষে টিউবের সুইচে পৌঁছই। প্রত্যেকবার। এভরিটাইম। আসলে এটা মনের ষড়যন্ত্র। প্রতিরোধ। যা নেই, তাকে ধরে রাখার।
বেল বাজছে। আমার ছোটবেলায় বেলটেল ছিল না। দরজায় কড়া ছিল। লোকে এসে খটাখট নাড়াত। বেশিরভাগ সময় নাড়ানোর দরকার হত না যদিও। দরজা খোলাই থাকত। আমাদের সদর ঘরের ছিটকিনির একটা বিশেষত্ব ছিল। যদি আপনি ছিটকিনিটা সিম্পলি ঠেলে তুলে দিতেন, আমরা বলতাম হাফ ছিটকিনি, তাহলে বন্ধ দরজার ওপার থেকে কড়া ধরে জোরে (খুব জোরেও না) টানলেই ছিটকিনিটা খটাস করে নেমে দরজা খুলে যেত। পাড়াশুদ্ধু সকলেই জানত এই হাফ ছিটকিনির কথা। কাজেই সবাই এসে দরজা বন্ধ দেখলেই কড়া ধরে টানত। সত্যি সত্যি লোক আসা বন্ধ করতে হলে ছিটকিনি তুলে ডান বা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিতে হত। ওটাকে আমরা বলতাম ফুল ছিটকিনি। যেটা শুধু রাতেই দেওয়া হত। দিনের বেলা ফুল ছিটকিনি দেওয়া থাকলে বেশ একটা বকাবকির ব্যাপার হত। বাড়ির লোকে চেঁচাত, কে ফুল ছিটকিনি দিয়েছে? কার এত সময় আছে বার বার দরজা খুলতে যাওয়ার? বাইরের লোকেরা রাগ দেখিয়ে বলত, বাব্বা, তোমরা দিনের বেলায় দরজায় খিল দিয়ে বসে আছ কেন গো?
এবার আমি প্রতিজ্ঞা করে এসেছি যে চাবি খুঁজে পাবই। পেলাম। গ্রিলের বাইরে কাকিমা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সোনা, কবে এলে? চার কোণা থেকে জরির সুতো ঝোলা লাল রঙের কার্ড হাতে নিয়ে এসেছেন; আমি জানি কীসের নেমন্তন্ন, বুবুনের ছেলের মুখেভাত। আমি তো থাকব না, থাকলে কত মজা হত। সত্যি বলতে নেমন্তন্ন খাওয়ার থেকেও মজা হয় আমার বুবুনের ছেলের মুখেভাতের খবর পেয়ে। নিজের মুখেভাতের বছরখানেক পর যে এসেছিল পাড়ায়, তার নাকি আবার ছেলে, সে ছেলের আবার নাকি মুখেভাত। কাকিমাকে বলি, বুবুন বিবেকানন্দকে বিবেকানানন্দ বলত, আর হাত নেড়ে নেড়ে নেড়ে ফুলকো লুচি ফুলকোলুচি/ অল্প সুজি, অল্প আলুরদম...ভাবা যায়? কাকিমা বলেন, বুবুনের কথা ভাবলে চলবে শুধু সোনা? আমরা যখন এসেছি তুমি ক্লাস ফাইভ। ভাবা যায়?
কাকিমা কার্ড রেখে চলে যান। আমি তালা দিই। কাকে আটকানোর জন্য এত তালাচাবির বন্দোবস্ত কে জানে। কেউ আসেই না। একসময় আসত। সকাল বিকেল দুপুর সন্ধে, যখন তখন, বিনা নেমন্তন্নে, প্রাইভেসির তোয়াক্কা না করে, যার সঙ্গে দরকার, তার নাম ধরে চেঁচাতে চেঁচাতে। অমুকদা, তমুকদি, ঠাকুমা, মাসিমা, সোনা, বৌদি...যত না লোক, তার থেকে বেশি সম্পর্ক। এখন মানুষ বেড়েছে, সম্পর্ক আর নেই। সবাই যে যার বাড়িতে চকচকে তালাচাবি সেঁটে বসে আছে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কুকুরগুলো চেঁচাচ্ছে। আমার পাশের জায়গাটা খালি। অর্চিষ্মান চলে গেছে দুপুরবেলাতেই খেয়েদেয়ে। জানালা বন্ধ, কারণ ডিসেম্বর মাসে আমাদের বাড়িতে জানালা খুলে শোওয়ার নিয়ম নেই। তাপমাত্রা যাই হোক না কেন। মা জানালা বন্ধ করতে করতে বলতেন, জানালা খুলে?! পাগল নাকি। বাইরে হিমবাহের মতো ঠাণ্ডা। মায়ের পক্ষে হিমবাহের ঠাণ্ডা কেমন হয় জানার কোনও উপায় নেই, কারণ মা কোনও হিমবাহের সামনে জীবনে যাননি। কিন্তু আমিও যেহেতু যাইনি, মা জানতেন মাকে হিমবাহের উপমা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারব না। বন্ধ জানালার ওপাশে চাঁদ উঠেছে, নাকি কুয়াশায় ঢেকে আছে কে জানে। কুকুরগুলো একমুহূর্তের জন্য থেমেছে। সমস্ত ইন্দ্রিয় জড়ো করে শুয়ে আছি। যদি কিছু টের পাওয়া যায়। কোথাও কোনও সাড়া। আর ঘুম আসবে না মনে হয়, কিন্তু আসে।
আধোঘুমে কুকুরগুলোর আবার শুরু করা চিৎকার শুনি। এত চেঁচায় কেন কে জানে। কী দেখে চেঁচায়? কে এই হিমবাহের মতো ঠাণ্ডায় রাস্তায় বেরিয়েছে? হয়তো ভোররাতে শিফট শুরু হবে কারও, মাফলার পেঁচিয়ে সাইকেল চড়ে চলেছেন, বা কোনও মাতাল বাড়ি ফিরছে।
ঘুমন্ত মগজে আরও একটা সম্ভাবনা উঁকি মারে। ওরা তো আমাদের থেকে উন্নত, ওরা আমাদের থেকে অনেক বেশি কিছু টের পায়। ওরা হয়তো টের পাচ্ছে পুকুরপাড়ের কাটা পড়া বটগাছটা কুয়াশার ভেতর আবছা হয়ে জাগছে। ওরা হয়তো স্পষ্ট দেখছে মোড়ের মাথার দোতলা বাড়িটা মুছে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে একটা সবুজ মাঠ। কোমর সমান আগাছা জন্মানো সুকান্ত উদ্যানের ভাঙা ঢেঁকিটা কখন জোড়া লেগে গিয়ে ক্যাঁচকোঁচ করে দুলছে। সাফ হয়ে যাওয়া মাখনদাদুর বাগানের অদৃশ্য তালগাছের মাথায় নামছে শকুনের দল। বেড়ে চলা সংসারের খাঁই মেটাতে এক্সট্রা ঘর কিংবা মনিহারি দোকানের তলায় চাপা পড়া বারান্দাগুলো বেরিয়ে পড়ছে। কালো বর্ডার ঘেরা লাল মেঝের ওপর যে যার খেলনা, পুতুল ছড়িয়ে বসেছে। কাল ঝুলন।
ওরা হয়তো দেখতে পাচ্ছে মানুষগুলোকেও, হাট করে দরজা খুলে রাখা বাড়িগুলোর মধ্যে যারা হাওয়ার মতো ভেসে ভেসে ঢুকছে বেরোচ্ছে, একে অপরকে ডাকছে চেনা সম্পর্ক, চেনা নাম ধরে। যে নামগুলো ভোটার লিস্ট থেকে কাটা পড়ে গেছে অনেক দিন।
সত্যিই তো। মানুষ বেড়ে যাচ্ছে, অথচ সম্পর্ক কমে যাচ্ছে।
ReplyDeleteআমার তো তাই মনে হয়।
Deleteaahaa re :(
ReplyDelete.....
DeleteKi mil .. amader makhlar bario dorja sudhu vejano thakto.. ratre khil.. ar onek bochor pore ekta tala esechilo.. makhlay ekta nouka bari o chilo jano.. school theke kachei..barandar samne nouka banano chilo tai.. tomader baritar motoi amader o janlar pashe Gach pala pukur esob chilo.. ekhon baritai nei.. :) odbhut bhabe chabi guliye fela baparta ki onnoder o hoy? ekbar baba bhul kore baire tala diye bajar chole gechilo .. tokhon e ekjon eseche.. bhaggis chotobelar bondhu cum relative take baranda diye chabi diye bolechi tui tala khule dhok..edike confidently bhul chabi diyechi.. se gheme neye ek kando.. jak ge.. chotobela,barir hariye jawa manush sob mile kachakachi sob memories.. khub bhalo laglo..
ReplyDeleteহাহা, তালার গল্পটা ভালো, ঊর্মি। সত্যি এত তালাচাবির ঘনঘটা যে কেন।
Deleteraat sare tintey tomar lekha ta porchhilam. sesh korei ek jholok baire takalam. keno janina bhorsha hochhilo voter list e bochhor tin holo bad pora ekjonke dekhte pabo ektukkhoner jonya.
ReplyDelete😢
Deleteভুল তো ভাবোনি, হতেই তো পারে....অন্য ডাইমেনশনে এরকমই কিছু হয়, কুকুরেরা টের পায় হয়ত।
ReplyDeleteহতেই পারে।
DeleteAha, khub sundor mayabi lekha :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অরিজিত।
Deletemone hoy..amar o erokom mone hoy..na ki mone hoate bhalobashi? baba chole jaoar por chena beralta hotat jokhon gayer kache ador kore jay...hotat ekta achena kak onekkhon deke jay...mone hoy..babao bolten dekhchish kakta dekei jachche...asole atiprakrito r modhye ekta protriti ache...na hoy dhora choyar baire...tobuo kothay ache..lukiye hasche othoba adda dichche tara sobai....amar bhabte bhaloi lage emon...mon chuye mon kharap kore dilo lekhata..
ReplyDeleteএ রকমটা সত্যিই হয় কিন্তু।
Deleteহারিয়ে যাওয়া মানুষকে ফিরে পাওয়ার আকুতি,সবার ই এমন হয়। তবে এমন করে ভাবতে বা লিখতে কতজন পারে? শেষ দুটো প্যারাগ্রাফ এ কার লেখার যে ছোঁয়া পেলাম... অন্য পাঠকরা বলতে পারবেন হয়তো। বিভূতিভূষণ কি?
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, কাকলি।
Deletebhalo laglo. ektu khub shundor bishonnota anubhob korlaam.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, রাজর্ষি। ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগল।
Deleteমন কেমন করা লেখা এটা খুব কুন্তলা দি. অভিযোগ করছিনা কিন্তু.
ReplyDeleteহাহা, বুঝেছি সূচনা। বইমেলা গেলে নাকি?
Delete