তখনও যা, এখনও তাই
কালই বাছাবাছি নিয়ে ভাবছিলাম। কেন এটা, কেন ওটা নয়। একেবারে আলটপকা ভাবনা নয়। কাজ ফেলে ক্যান্ডি ক্র্যাশ খেলছিলাম, কাজেই জীবনের চয়েস এবং চয়েসজনিত পরিণতি নিয়ে ভাবার উপযুক্ত সময় ছিল। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে চালে ভুল হয়ে গেল, দান হেরে গেলাম, লাইফ ফুরিয়ে গেল। ওই মুহূর্তে কাজে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত কিন্তু আমি বাছাবাছি বিষয়ে গুগল কী বলছে সেটা নেড়েঘেঁটে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঘুম থেকে উঠে থেকে লাফ দিয়ে খাট থেকে নামব না নেক্সট পঁয়তাল্লিশ মিনিট ইন্টারনেটে আড়ি পাতব? দাঁত মাজব নাকি নিজেকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করে আড়াই মিনিট বাঁচাব? ক্যান্ডি ক্রাশ খেলব নাকি পড়তে বসব? নতুন পেজ নতুন উইন্ডোতে খুলব না নিউ ট্যাবে? আপডেট নাউ নাকি রিমাইন্ড মি লেটার? ট্রাই টুনাইট? ইন অ্যান আওয়ার? রিমাইন্ড মি টুমরো? - এইসব হিজিবিজি এবং গুরুত্বপূর্ণ মিলিয়েটিলিয়ে নাকি সারাদিনে আমরা গড়ে পঁয়ত্রিশ হাজার সিদ্ধান্ত নিই। ভাবুন সারাজীবনে কত হবে। তার থেকেও সাংঘাতিক হচ্ছে যে এই প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমাদের একটি বিকল্প থেকে অন্য বিকল্পে সরিয়ে নিয়ে যায়, যেগুলো জুড়তে জুড়তে আমাদের জীবনের ফাইন্যাল চেহারাটা তৈরি হয়। যে বিকল্পগুলো আপনি বাছলেন না সেই জীবনগুলো আপনার হল না, যেগুলো বাছলেন সেগুলো জোড়াতাড়া দিয়ে একটা জীবন দাঁড়াল।
সব সময় যে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তেমন কোনও মানে নেই। অনেক বছর আগে, ওয়ান-টোয়ানে পড়ি, কাকু সাইকেলে বসিয়ে লটারির দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন। সোনা একটা বেছে দে তো।
সেদিনের আগে আমাকে লটারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বাছতে বলার মতো গুরুত্ব দেয়নি কেউ। জীবনের লাগাম অন্যের হাতে। যেমন নাচায় তেমন নাচি। পড়তে বসতে বললে বই খুলি। ঘুমোতে বললে চোখ বুজি। বাছাবাছির দৌড় বলতে স্টুডেন্ট কর্নারে দাঁড়িয়ে সামনের তিন বছরের জন্য পেনসিলবক্সের আকার নীল রকেট হবে না লাল জাহাজ। সে জায়গায় লটারি!
জানপ্রাণ দিয়ে বেছেছিলাম। কাজে দেয়নি।
বেশিদিন গেল না, সামনে আরেক জোড়া বিকল্প এসে দাঁড়াল। লটারি বাছার থেকে একশোগুণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শেষমেশ "টাকা মাটি, মাটি টাকা" আর এই বিকল্পের ওপর আমার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় বা "আইডেন্টিটি"এর একটা অংশ নির্ভর করছিল। অংশ বলছি কারণ জাতি-ভাষাগত গোদা পরিচয়টা চাই না চাই জন্মসূত্রে সারাজীবনের মতো কপালে সেঁটে গেছে, আরও কিছু কিছু আইডেন্টিটি চাপিয়ে দেওয়ার আগেও আমার মতামত চাওয়া হয়নি। যেমন পূর্বপুরুষ কোন দিক থেকে আসবেন, জীবনভরের গুরুদেবের নাম জিজ্ঞাসা করলে কার নাম বলতে হবে ইত্যাদি। সে মারাত্মক সাসপেন্স। বাড়ির সকলেই বেছে ফেলেছে। স্কুলের বন্ধুরাও একে একে সব শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে।
তৃতীয় বিকল্প ছিল একটা, না বাছার। বলার, আহা, দুজনেই তো বেশ, নিজের নিজের মতো করে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, বঙ্গসংস্কৃতিতে দুজনের অবদানই তো অনস্বীকার্য, ইনি যদি ইন হন উনি তবে ইয়াং...
আমি আপনাকে বেছেছিলাম।
একেবারে কাকুর লটারি মার্কা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া নয়। ততদিনে স্কুল থেকে ফিরে পাড়ার লাইব্রেরিতে যাই, জাবদা ক্যাটালগের 'স' দিয়ে নাম শুরু হওয়া লেখকদের পাতার একটা নির্দিষ্ট নামে পৌঁছে একধারসে গিলি। সেই সিলেবাসের গল্প থেকে তৈরি হওয়া সাকুল্যে দুটো সিনেমা গরমের, পুজোর, শীতের ছুটিছুটি-তে দেখি। ততদিনে অন্ততঃ সাতবার দেখে ফেলেছি, আরও সাতচল্লিশবার মিনিমাম দেখব।
তবু আমি জোর গলায় বলতে চাই আমি আপনাকে অটোপাইলটে বাছিনি। সেটা করতে হলে আপনার রাইভ্যালের পালে এর থেকে ঢের বেশি হাওয়া ছিল। (হতে পারে এটা নিজেকে একটি বিশেষ আলোয় দেখতে চাওয়ার কামনা থেকে কল্পনা করছি, কিন্তু আমার ধারণা হাইফেনের পরে যে আপনার নামটা বসে সেটাও আপনাকে বাছার অল্প কারণ ছিল।)
সাফল্যের চুড়োয় হালছাড়া ভুঁড়ি আর চোখের কোলে ফুলে ওঠা বিশৃঙ্খলার ভিড়ে আপনার স্পষ্ট দৃষ্টি আর তীরের মতো সোজা দাঁড়াতে পারা তখনও লক্ষ করিনি। আপনার নাটক, আপনার পদ্য, গদ্য, এবং আরও যাবতীয় যা চর্চা সম্পর্কে তখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
যখন আলো জ্বলল, ইমপ্রেসড হলাম। খুব বেশি না। আমার বাছা তো কবেই সারা।
এখন বাছতে বললে কে জানে লাল জাহাজ আর নীল রকেটের মধ্যে কোনটা বাছতাম। যে রেটে বুড়িয়েছি, লাল এবং নীলের ফারাক উপেক্ষা করে, রকেট এবং জাহাজের আকাশপাতাল নস্যাৎ করে সম্ভবতঃ বলতাম, পেনপেনসিল রাখা নিয়ে তো কথা, দিন যা হয় একটা।
লটারি বাছতে বললে? ওয়েল।
কিন্তু এখনও, এই মুহূর্তেও যদি আবার প্রসঙ্গ উঠত, আমি আপনাকেই বাছতাম। সেই পাড়ার লাইব্রেরি থেকে শুরু করে চোরা পিডিএফে পৌঁছনোর রাস্তায় অযুতনিযুত কোটিঅর্বুদ বিকল্প বাছতে বাছতে আমি আপাতত যা হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও আরও যা যা হব বলে আঁচ পাচ্ছি, আমার সেই আমি-র পক্ষে আপনাকে বাছাটা একেবারে কানায় কানায় মেলে।
মোদ্দা কথা, আমি আপনার টিমে আজীবন ছিলাম, আমরণ থাকব।
একমত কুন্তলা। অন্য কোনও টিমে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারিনি কোনওদিন, আর পারবও না। লেখাটা ভাল লাগল।
ReplyDeleteআপনার সঙ্গে মিল আবিষ্কার করে অবাক হওয়া অনেকদিন পেরিয়ে এসেছি, সুগত, তবু রইল হাই ফাইভ।
Deleteওই স দিয়ে লেখকের গল্প পড়ার সময়, ছুটি ছুটি দেখার সময়ই বেছে ফেলেছিলাম, ওটাই ফাইনাল সারাজীবন, অন্য দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ও হয়নি কখনো ..
ReplyDeleteহাই ফাইভ, ঊর্মি।
DeleteChotobelaye ek baar dekhe e bhalobeshe felechilam. Konodin ar kono team er kotha bhabar karon paini. Buk ta ekhono kemon byatha byatha korche, hu hu korche. Khub bhalo likhecho Kuntala.
ReplyDeleteহ্যাঁ, এটা ঠিক সেলেব্রিটি বিয়োগের মতো ঠেকছে না, শর্মিলা।
DeleteEkdam i apnar sathe ekmot. Onar team e to prothom thekei. sei anugotyo ei jibone aar konodin bodlabe na. Mone hochche boro kaachher keu chhere chole gelen.
ReplyDeleteসেটাই তো, সুস্মিতা। আসলে সাংস্কৃতিক পরিচয়টাকে অত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না তো সবসময়, ওটা যে নাওয়াখাওয়ার মতোই জড়িয়ে থাকে প্রতিমুহূর্ত, সেটা এই রকম ঘটনাগুলো কান মুলে বুঝিয়ে দিয়ে যায়।
DeleteLekhata pore khub bhalo laglo. Ek raash mon kharap er majheo Soumitra Babu'r ujjal chokh aar hashi ta mone pore gelo.
ReplyDeleteUni chirokaaler bhalobasha'r byakti - Phelu da'i hok aar Mayurbahon'i hok ba amader moner modhhyer Apu - uni shobshomoy boro ekta jayga niye thakben.
একমত, কেকা।
Delete