পাটিসাপটার প্রতিশোধ
নাকতলার মা পাটিসাপটা পাঠিয়েছেন। ওপরের প্রসেনজিৎ পাটিসাপটা আর পায়েস দিয়ে গেছে। মনে পড়ল মা নাড়ু পাঠাতেন। পাঠাতেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন, গেলে ফেরার সময় প্যাক করে দিতেন বয়াম ভরে।
সবার মতো আমারও মনে হয়, আমার মায়ের মতো নাড়ু কেউ বানাতে পারে না। মায়ের মিষ্টির হাত ভালো ছিল, পায়েস, নাড়ু, মালপো - খুব বেশি বানানোর সময় পেতেন না, কিন্তু যখনই বানাতেন আমি একবারে চারটে নাড়ু, তিনটে মালপো, আড়াইবাটি পায়েস খেয়ে ফেলতে পারতাম।
ছোটবেলায় চিনির নাড়ুকে গুড়ের নাড়ুর থেকে বেশি গুরুত্ব দিতাম। যে বাড়িতে বিজয়ায় চিনির নাড়ু খেতে দিত, একটা সফট কর্নার জন্মাত তাঁদের প্রতি। এর আর আর কোনও কারণ ভেবে বার করতে পারছি না শুধু এইটা ছাড়া যে আমাদের বাড়িতে চিনির নাড়ু হত না। ওই একই কারণে বাসি পাউরুটিকে হাতে গরম আটার রুটির তুলনায় বেশি সম্মান দেখাতাম, ভাবতাম দোতলায় থাকার অনুভূতি নিশ্চয় স্বর্গে থাকার অনুভূতির কাছাকাছি, ট্রেনে হাওয়া খেতে খেতে স্কুলে যায় যত হতভাগ্যের দল, খুপচি ভ্যানগাড়িতে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি হয়ে স্কুলে যেতে গেলে পূর্বজন্মের পুণ্য লাগে।
এখন দল বদল করেছি। নাড়ু মাত্রেই ভালো, চিনি গুড় যারই হোক - অর্চিষ্মানের এই নন-পার্টিসান অবস্থানকে সম্মান জানিয়েই বলছি, গুড়ের নাড়ু একটুখানি হলেও (অ্যাকচুয়ালি, নো কন্টেস্ট) বেশি ভালো।
অর্চিষ্মানকে তখনও ভালো করে চিনি না। ফেভারিট রং, ফেভারিট সাহিত্যিক, ফেভারিট বাংলা ব্যান্ড পেরিয়ে একদিন ফেভারিট পিঠের প্রশ্ন উঠল। আমিই তুললাম নির্ঘাত; অবান্তর কথা তখনও আমার একচেটিয়া ছিল। অর্চিষ্মান বলল ওর বেস্ট লাগে গোকুল পিঠে। তারপর জুড়ে দিল, আর সবথেকে বিশ্রী কোন পিঠেগুলো লাগে বলত? ওই যে ইডলির মতো দেখতে কিন্তু ইডলির মতো নরম নয়, না মিষ্টি, না নোনতা, একগাদা নারকেল নয়তো গুড় ছাড়া খাওয়া যায় না, পাশটা অনেকসময় পুড়ে পুড়ে যায়...
চিতই পিঠে? অর্চিষ্মান মুখ ছেতরে বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ চিতই। ওঃ, কিছু খারাপ খেতে।
পিঠের পছন্দ না মিললে প্রেম টেঁকে?
এদিকে আমার এই প্রেমটা টেঁকানো দরকার ছিল। সত্যি দরকার। কুড়ির গোটা দশকটা প্রেমে পড়তে আর প্রেম থেকে বেরোতে কেটে গেছে, তিরিশে পা দেব আর আড়াই মাস বাদে। বারবার তিনবারের বার এই আমার লাস্ট চান্স, এর পর জীবন নির্ঘাত প্রেমহীন কালাহারি।
এও জানতাম যে অর্চিষ্মানের দরকার আমার দরকারের তুলনায় অনেকাংশে কম। এবং সে জানা নিয়ে কষ্ট পেতাম না। কুড়ির কোঠার যাবতীয় বোঝাবুঝির যে দশ শতাংশকে এখনও, এই চল্লিশেও ঠিক বলে বিশ্বাস করি, তার মধ্যে একটা হল যে পৃথিবীতে কোনও সম্পর্ক ফিফটি ফিফটি হয় না। জগতের যাবতীয় সম্পর্কে দায় সর্বদাই একপক্ষের বেশি, কমিটমেন্ট সর্বদাই একদিকে তীব্রতর, ভেঙেচুরে গেলে একপক্ষের চোট একইঞ্চি হলেও অন্যপক্ষের তুলনায় বেশি গভীর। মা মেয়ে পর্যন্ত লেভেল প্লেয়িং মাঠে দৌড়োয় না, আর এ তো ধেড়ে বয়সের তিন মাসের প্রেম।
শুনেছি ভবিষ্যৎ মসৃণ করার প্রথম ধাপ হচ্ছে অতীতের চোটআঘাত ক্লিয়ার করা নেওয়া। আমিও করেছি। বলেছি যা বলার। অর্চিষ্মান বলেছে এই বাবদে ওর কিছু বলার নেই কারণ এটাই ওর ফার্স্ট অ্যান্ড…
না, আর কিছু বলেনি। বা বলার উপক্রমও করেনি। স্রেফ ফার্স্ট বলেই সুস্পষ্ট দাঁড়ি টেনেছে। তাতেও খুশিই হয়েছি। শুনতে ভালো বলে যা প্রাণে চায় বলে যাওয়ার ক্ষতিকারক অভ্যেসটা যে অর্চিষ্মানের নেই, ইন ফ্যাক্ট, দরকারের বেশি কথা বলার অভ্যেসই যে অর্চিষ্মানের নেই, সেটা ওর প্লাস পয়েন্টের তালিকার প্রথম তিনের মধ্যে রেখেছি।
মোদ্দা কথা, অর্চিষ্মানের এই সবে ফার্স্ট অ্যাটেম্পট। আমার এটাই লাস্ট। তাছাড়া শুধু অ্যাটেম্পটের ব্যাপার তো নয়। যদিও ঘর পোড়া গরু, মন বলছে এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম।
আচমকা এই চিতই পিঠের গেরো।
চিতই পিঠের প্রতি আমার যে খুব ভালোবাসা বা আনুগত্য ছিল তেমন নয়। যা ছিল তা হল অভ্যেস। বিজয়ায় যেমন যাকে সামনে পাই প্রণাম করি, সরস্বতী পুজোয় যেমন মায়ের বাসন্তী শাড়িতে নিয়ম করে আলুরদমের ঝোল ফেলি, তেমনি সংক্রান্তিতে চিতই পিঠে খাই। ভালো লাগে কি না হু কেয়ারস? তবে খারাপ লাগারও কোনও কারণ নেই। বছরে চারপাঁচদিন খাই। আঁচে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে ভাজতে হয় না, খাটে বসে টিভিতে মহাভারতের যুদ্ধের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকাকালীন গরম পিঠে উড়ে পাতে এসে পড়ে। ঝোলাগুড় যথাসম্ভব এবং কয়েকবার যথাসম্ভবের বেশি চুবিয়ে মুখে তুলতে গিয়ে বেডকভারে পড়লে চট করে আঙুল দিয়ে মুছে দিই। রাতে পিঁপড়ে কামড়ালে দেখা যাবে। আমার না দেখলেও চলবে, কারণ এ খাটে আমি শুই না।
তা বলে চিতই আমার প্রিয়তম পিঠে ছিল না। আমার প্রিয়তম ছিল নলেন গুড়ের পায়েস (যেটা আপনাদের সবার মায়ের মতো আমার মাও পৃথিবীতে বেস্ট বানাতেন) আর পাটিসাপটা। পাটিসাপটা এখনও আমার ফেভারিট পিঠে। সারাজীবন থাকবে। পাটিসাপটার থেকে ভালো পিঠে পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
নাকতলার মায়ের সঙ্গে এইসব গল্প হচ্ছিল। মা বলছিলেন যে যদিও ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য শুকনো পাটিসাপটাই বেস্ট কিন্তু ছোটবেলায় মায়েরা শুকনো পাটিসাপটা খেতেন না। মায়েদের বাড়িতে সর্বদা ঘন দুধে ডোবানো পাটিসাপটাই হত। এমন নয় যে রাঁধিয়েরা শয়ে শয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে আবার ঘণ্টাখানেক ধরে জ্বাল দিয়ে দুধে সর ফেলার জন্য হেদিয়ে মরতেন; ওসব তরিবত হত খাইয়েদের মুখ চেয়ে। মায়ের দাদুকে আদর করে থালায় শুকনো পাটিসাপটা বেড়ে দিলে তিনি অবাক হয়ে পরিবেশকের মুখের পানে তাকিয়ে থাকতেন। এর থেকে গোটা নারকেল আর এক খাবলা গুড় আর এক বস্তা চালের গুঁড়ো সামনে রেখে গেলেই হত।
আমাদের বাড়িতে পাটিসাপটা দুধটুধে ডোবানোর পাট ছিল না। আমাদের বাড়ির পিঠেপুলির চরিত্র ছিল আমাদের বাড়ির অধিকাংশ চরিত্রের মতোই; ন্যাড়াবোঁচা এবং যতটুকু না হলে নয়। কিন্তু তা বলে তাঁদের হ্যান্ডেল করা সহজ মনে করার কারণ নেই। ওইরকম সাদাসাপটা বহিরঙ্গের ভেতর যে ওই পরিমাণ প্যাঁচঘোঁচ লুকিয়ে থাকতে পারে, অকল্পনীয়।
পাটিসাপটার চরিত্রও খানিকটা সে রকমই বিভ্রান্তিজনক। প্লেটের ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকা সাদাসাপটা নরম মোলায়েম শরীরের আড়ালে অবিশ্বাস্য জটিলতা। রসে ডোবানো বা রসহীন যে সংস্করণই ধরুন না কেন।
গোলার ঘনত্ব, পুরের পাক, উনুনের আঁচ, রাঁধুনির কবজির নমনীয়তা, সাবলীলতা ইত্যাদি তো আছেই কিন্তু আসল খেলা এর কোনওটাই নয়। আসল খেলা খেলা হবে, যেখানে সব খেলাই আসলে খেলা হয়। মনস্তত্ত্বের মাঠে। যখন আপনি পাটিসাপটার দিকে তাকিয়ে থাকবেন আর গরম কড়ায় পিঠ পেতে, বাষ্পের ফুটফাট বুদবুদ ফাটাতে ফাটাতে পাটিসাপটা আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এবার পুর স্থাপন করে করে কড়াই থেকে তাকে গুটিয়ে তোলার অপেক্ষা। পাটিসাপটা যদি টের পায় যে এই স্টেপে আপনার আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে (এবং থাকলে টের পাবেই, কেউ আটকাতে পারবে না), খুন্তির কানায় সামান্যতম দ্বিধা, পরিণতির সাফল্য সম্পর্কে সুতোপরিমাণ সন্দেহের আঁচ - পাটিসাপটা প্রাণপণ কড়াই আঁকড়ে ধরবে, ছোঁয়ামাত্র ছিঁড়েখুঁড়ে একশা হবে, পুড়েঝুড়ে শেষ।
বিপক্ষকে বেইজ্জত করার জন্য যে বারংবার এই রকমের ভায়োলেন্ট মৃত্যুবরণ করতে পারে, তাকে হেয় করা বোকামি।
আমাদের বাড়িতে পাটিসাপটা ভেজেই ক্ষান্ত দিত লোকজন, রসের হ্যাপা করতে দেখিনি কোনওদিন। বাকিরা কেন করেননি জানি না, মা কেন করেননি তার একটা ব্যাখ্যা আছে। এবং সেটা সময়ের অভাব নয়। ইচ্ছে থাকলে চব্বিশঘণ্টার মধ্যে থেকে লোকে সবকিছুর জন্যই সময় বার করে নিতে পারে। মাও পারতেন। কই, অফিস থেকে ফিরে আমার হোমওয়ার্কের খাতা দেখে একটি শব্দ খরচ না করে, স্রেফ মুখের ভাব দিয়ে আমার হাতপা পেটের মধ্যে সেঁধোতে তো কোনওদিন সময় কম পড়েনি? বছরে পাঁচবার পাটিসাপটা বানাতে সময় কম পড়ত হতে পারে না। ইচ্ছে না করার ব্যাখ্যাটা বরং অনেক বিশ্বাসযোগ্য। এ রকম শর্টকাট অন্যান্য পিঠের ক্ষেত্রেও নেওয়া হত। দশবার মালপো হলে সাতবারই রসে ভেজানোর স্টেপটা বাদ দেওয়া হত এবং সে শুকনো মালপো এককণাও খারাপ খেতে হত না।
নাকতলার মায়ের জীবনেও ব্যস্ততার অভাব ছিল না বা এখনও নেই, কিন্তু ইচ্ছে আছে। আমরা গেলেই তিনি দিস্তা দিস্তা গোকুল পিঠে ভেজে খাওয়ান। সে অতি জটিল এবং জমকালো পিঠে, ভেতরে পুর, বাইরে মিষ্টি খোলস, রসের আস্তরণ। বাড়িতে জন্মে খাইনি। সে পিঠে মা আদর করে প্লেটে বেড়ে তো খাইয়েইছেন, পিঠের ছোটখাটো পাহাড় ডাইনিং টেবিলের ওপর ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখেও দিয়েছেন, যেটা আমার মতে প্লেটে বেড়ে দেওয়ার থেকেও চমৎকার প্র্যাকটিস। আসাযাওয়ার পথে, মাঝরাতে উঠলেটুঠলে চুপচাপ টুপটাপ মুখে ফেলার সুবিধে।
ভালো খাবার, দরকার না থাকলেও নিভৃতে খেতে ভালো লাগে। হাটের মাঝে আইসক্রিম খাওয়ার আনন্দ এক, অন্ধকার রাতে ফ্রিজের দরজার আলো জ্বালিয়ে আইসক্রিম খাওয়ার আনন্দ আরেক।
আমাদের বাড়িতে আরেকটা সোজা পিঠে হত, মূলতঃ ঠাকুমা করতেন, চুষি পিঠে। ওই পিঠের একটা ভালো ব্যাপার ছিল জিনিসটা একই সঙ্গে পিঠে এবং পায়েস। ও জিনিস কেউই শুকনো ভেজে খায় না, খাওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের ফাঁকিবাজ বাড়িতেও ওই চুষিপিঠে বানিয়ে ঘন দুধে ফুটিয়ে পায়েস বানিয়ে খাওয়া হত।
গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ইন্টারেস্টিংতম ছিল পিঠে বানানোর স্টেপটা। কাজটা ঠাকুমা করতেন রান্নাঘরের দরজার কাছে পা ছড়িয়ে বসে। এমনিতে আমি লোককে কাজ করতে দেখলে চট করে উত্তেজিত হই না। কাজ করা ভালো, যে করছে তার চরিত্রগঠন হচ্ছে, তাতে আমি বাগড়া দেওয়ার কে? কিন্তু পৃথিবীতে একটা দুটো অতি বিরল কাজ আছে, যেটা কাউকে একা একা করতে দেওয়া যায় না। পরিশ্রমে ভাগ বসাতে হাত নিশপিশ করে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ওই চুষিপিঠে বানানোর কাজ। ওই যে একচিমটে পিঠেমাখা ডান হাত দিয়ে তুলে বাঁ তেলোতে একটিমাত্র ঘষা দিয়ে নির্ভুল অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশে রাখা বাটিতে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলা, এ জিনিস পুনঃপুনঃ দেখতে দেখতে একবার যার বাঁধ না ভাঙে, একবার যার মনে না হয় আমিও এই ম্যাজিকটা করে দেখি, তার ক্ষুরে ক্ষুরে প্রণাম।
কড়াইশুঁটি ছাড়ানো এই গোত্রের আরেকটা কাজ। কতক্ষণ দেখবেন? পাঁচ মিনিট? দশ মিনিট? তারপর ছাড়াতে নামতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে দু'চারটে মুখে চালান করতেও।
মৌলালি থেকে চোখের ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডের উল্টোকোণের কচুরির দোকান ছিল, বাসস্ট্যান্ডের থেকে বেশি ভিড়। তখন নাম জানতাম না গন্ধটার, এখন জানি হিং-এর। মোড় ভরে থাকত গন্ধে। ফুটন্ত তেলের ভাপ, অতগুলো লোকের লোভী অপেক্ষা মিলিয়ে যে পরিবেশটার সৃষ্টি হত, সেটা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিরিশেরও বেশি বছর আগে স্থান, কাল, পাত্রের ত্র্যহস্পর্শের একটি বিন্দুতে থেমে আছে, তাকে রেপ্লিকেট করা অসম্ভব।
কচুরির সন্ধানে দোকানের ভেতর মাবাবা অদৃশ্য হলে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বা দাঁড়িয়ে পড়তাম। দোকানের গায়ে একচিলতে বেঞ্চিতে বসে এক ভদ্রলোক শালপাতার ঠোঙা বানাতেন। যাতে রেখে খদ্দেররা কচুরি আর আলুর তরকারি খাবে। এদিকের বান্ডিল থেকে একটা শালপাতা তুলে, আঙুলের এক মোচড়ে তিনকোণা টোকা বানিয়ে, পাতলা কঞ্চি গুঁজে সিকিওর করে, ওপাশের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া।
ভদ্রলোক নির্ঘাত মিনিটে মিনিমাম নব্বইটা প্লেট বানাতেন। সমস্ত শরীর নিথর এবং টানটান, চোখ আঙুলে স্থির। এদিকের বান্ডিল থেকে একটা শালপাতা তোলা, আঙুলের মোচড়, কঞ্চি নেওয়া, গোঁজা, ওদিকের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলা, বান্ডিল থেকে শালপাতা তোলা, আঙুলের মোচড়, কঞ্চি নেওয়া, গোঁজা, ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলা, শালপাতা তোলা, আঙুলের মোচড় - এই পুনরাবৃত্তির যেন আদি নেই, অন্ত নেই, বিরতি নেই, জীবনচক্রের মতোই এ চক্র নিয়তিনির্ধারিত এবং নিরন্তর।
যেদিন প্রথম ওই চক্র ভেঙে ঠোঙাটা ঝুড়িতে না ফেলে চোখ তুলে মুচকি হেসে ঠোঙাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেছিলেন ভদ্রলোক...আচ্ছা আচ্ছা ভূতের সিনেমা দেখে অত চমকাইনি।
সারাজীবনে অনেক মহার্ঘ উপহার পেয়েও অত খুশি হয়েছি কি? দুই হাতে সেই এঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল ধরে বাড়ি ফিরেছিলাম। তারকেশ্বর লোকালের সেদিনের ভিড় সেদিন যদি আমাকে চেপ্টেও দিত, নিজের প্রাণটা বাঁচানোর আগে আমি যে ঠোঙাটাকে বাঁচানোর একটা অ্যাটেম্পট নিতাম, সে নিয়ে আমি আজ, এত বছর পরেও নিঃসন্দেহ।
এটাও ঠিক, ঠোঙা পেয়ে যত বর্তে গিয়েছিলাম তার থেকেও বেশি খুশি হতাম যদি আমাকে উনি একটা, একটামাত্র ঠোঙা, হাতে করে বানাতে দিতেন। আমার মাথার মধ্যে ওঁর যা ছবি, বানাতে চাইলে দিতেন না সে আমি কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু আমি সাহসী বাচ্চা ছিলাম না, বলেই উঠতে পারিনি।
এবং সে মাহেন্দ্রক্ষণ অন্তর্হিত হয়েছে। জীবনে শালপাতার ঠোঙা বানানোর স্বপ্ন আমার পূর্ণ হবে না। জীবনে একটিমাত্র অক্ষত পাটিসাপটা কড়াই থেকে থালায় ট্রান্সফার করার স্বপ্নও অধরা রয়ে যাবে।
ভালো জিনিসের এই একটা অসুবিধে। কথা নেই বার্তা নেই, গোটা পরিস্থিতিটাকে করুণ করে তুলতে পারে। নির্মেঘ আকাশের মতো মন নিয়ে কবীর সুমনের প্রেমের গান শুনতে বসুন, দশ মিনিটের মধ্যে ভেসে কূল পাবেন না। অমন চমৎকার পাটিসাপটা খেতে খেতেও কেবল হাহাকার। কী হল না। কী হতে হতে ফসকে গেল। কীসের জন্য চেষ্টাই করলাম না। কার প্রতি কী নির্মমতা দেখালাম। কে আমাকে কবে দাগা দিল।
অর্চিষ্মান সেই যে "তুমিই আমার ফার্স্ট" বলে মুখে কুলুপ আঁটল, স্রেফ চক্ষুলজ্জার খাতিরেও আর মোটে দুটো শব্দ জুড়ে বাক্যটাকে একটা সুমধুর পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়ার ভদ্রতা দেখাল না। এগারো বছর ধরে অসহনীয় সাসপেন্সে ভাজাভাজা করল। আরও কত বছর করবে কে জানে।
বিজোড় পাটিসাপটা নিয়ে শুরু করেছিলাম। একটা পড়ে আছে প্লেটে। হকটুকু ভেঙে নেব বলে হাত বাড়িয়ে আড় চোখে অর্চিষ্মানের দিকে তাকালাম। শিলাজিৎ দলবল নিয়ে কার বাড়ির ছাদে উঠে গান ধরেছেন, তানসরগম সহযোগে 'পিন্ডারি পলাশের বন' চলছে পঁচিশ মিনিট ধরে। অর্চিষ্মান এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে, ও ঘরে ডাকাতি হয়ে গেলে টের পাবে না।
হাতের অবস্থানটা সামান্য শুধরে নিয়ে পাঁচের আটভাগ পাটিসাপটা আত্মসাৎ করলাম।
আপাতত এইটুকু প্রতিশোধ দিয়েই কাজ চালানো যাক।
কি করে এত মচৎকার লেখা ক্রমাগত লিখে যেতে পারো কুন্তলা? লেখাটা পাটিসাপ্টার মতোই ভীষণ ভালো হয়েছে| শেষের দিকে একটু মন খারাপ হলো| পাটিসাপ্টা সত্যি সব থেকে ভালো পিঠে, এই ব্যাপারে একমত| বানানোও সোজা| ছোটবেলায় আমিও মায়ের সাথে চুষি বানিয়েছি, আমাদেরও চিতই পিঠে হতো| গোকুল পিঠে আমাদের বাড়িতে কখনো হতোনা আর শ্বশুরবাড়ির এটা স্পেশাল পিঠে| খুব ভালো লাগলো পিঠে স্পেশাল লেখা|
ReplyDeleteপিঠেপুলি বিষয়ে আপনার আমার পরিস্থিতি এত মিলে গেছে দেখে খুশি হলাম, অমিতা। লেখা ভালো লেগেছে জেনেও। থ্যাংক ইউ।
Deleteবাহ্ দারুন লিখেছেন, আমিও ছোটবেলার আমাদের বাড়ির সমস্ত পিঠেপর্ব চোখের সামনে দেখতে পেলাম, ইনফ্যাক্ট কোথাকার কোন একটা কচুরির দোকানের সামনে এরকম ঠোঙা বানানো দেখার কথাও মনে পড়ল, কিন্তু কোথায় কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
ReplyDeleteপাটিসাপটা আমারও ফেভারিট। (দুধে ডোবানো, শুকনো- সবরকমই)
ছোটবেলায় পাউরুটিকে হাতে বানানো গরম রুটির থেকে কিংবা স্কুলবাসে যাওয়াকে মায়ের সাথে অটোয় যাওয়ার থেকে বেশি গুরুত্ব আমিও দিয়েছি কিন্তু খুব হাস্যকরভাবে আমি বহুদিন পর্যন্ত জানতাম না যে নারকেলের নাড়ু গুড় ছাড়া চিনিরও হয়। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে এসে জানলাম এবং খেয়ে মনে হয়েছে, এটা কোনোদিক থেকেই আমার ফেভারিট নাড়ুর জায়গা নেওয়ার যোগ্য নয়। কাজেই আমার ফেভারিট নাড়ু গুড়ের তৈরি নারকেলের নাড়ু, ছিল, আছে থাকবে।
"বিপক্ষকে বেইজ্জত করার জন্য যে বারংবার এই রকমের ভায়োলেন্ট মৃত্যুবরণ করতে পারে, তাকে হেয় করা বোকামি।" - হাহা! ঠিক বলেছেন।
"এবং সে জানা নিয়ে কষ্ট পেতাম না। কুড়ির কোঠার যাবতীয় বোঝাবুঝির যে দশ শতাংশকে এখনও, এই চল্লিশেও ঠিক বলে বিশ্বাস করি, তার মধ্যে একটা হল যে পৃথিবীতে কোনও সম্পর্ক ফিফটি ফিফটি হয় না। জগতের যাবতীয় সম্পর্কে দায় সর্বদাই একপক্ষের বেশি, কমিটমেন্ট সর্বদাই একদিকে তীব্রতর, ভেঙেচুরে গেলে একপক্ষের চোট একইঞ্চি হলেও অন্যপক্ষের তুলনায় বেশি গভীর।" -- থ্যাংক ইউ।
ওহ বাই দ্য ওয়ে, আমি আমার ফেভারিট নাড়ু খেতে খেতেই কমেন্টটা করছি। আজকাল খেতে খেতে, সকালে উঠে, শুতে যাওয়ার আগে... যখনই অবান্তরে আসছি, নতুন পোস্ট পাচ্ছি। অবান্তরের পারফরম্যান্সে আমি মুগ্ধ।
থ্যাংক ইউ, আধিরা। নাড়ু খাচ্ছ জেনে হিংসে করলাম। গুড়ের নাড়ুর শ্রেষ্ঠত্বে হায়েস্ট ফাইভ। অবান্তরের ছুটি ফুরোতে চলল, আগামী দিনে পোস্টের সংখ্যা কমার সম্ভাবনা প্রবল। সেটা এড়ানোর জন্য প্রবল চেষ্টা করব ভেবে রেখেছি, কিন্তু কিছু বলা যায় না।
Deleteআহাহা পাটিসাপটা আমার অতি পছন্দের একটা জিনিস। পিঠে বলিনা আমরা পাটিসাপটা কে, মালপোকেও না।ওরা আলাদা জাতের জিনিস। যাইহোক, আমাদের বাড়ির পাটিসাপটা একটু অন্যরকম হয়, আমি নারকেলের ছাঁই দেওয়া পুরের থেকে ক্ষীরেরটা বেশী ভালোবাসি, আর বাইরেটাও খেয়াল করেছি অন্যান্য বাড়ির থেকে মায়ের বানানো জিনিসটার চরিত্রগত তফাৎ আছে কিছু। কী তফাৎ কে জানে! আর মায়ের বানানো ওই পাটিসাপটা আমি গোটা দশেক একসাথে খাই।
ReplyDeleteওই ইডলির মতো পিঠেটার নাম আমাদের বাড়িতে আস্কে পিঠে। সেও ভারী পছন্দের
প্রতিশোধটা মচৎকার হয়েছে।
ভালো হয়েছে কি না, প্রতিশোধ? পাটিসাপটা মালপো পায়েসকে পিঠের দলে ফেলা অন্যায় আমিও মানি। তবে মালপো পায়েস (নলেন গুড়ের নয়) বছরের অন্য সময় হলেও আমাদের বাড়িতে পাটিসাপটা এই পৌষ সংক্রান্তির বাজারে অন্যান্য পিঠেপুলির সঙ্গেই হত বলে একই সঙ্গে গল্প ফাঁদলাম আরকি।
Deleteamader barite ami special arekta special patisapta hoto, nonta patisapta. Chhotobelay mishti khete chaitam na bole amar Dhubri basini pishi amader barite asamer special nonta patisapta chalu korechhilen. tobe ajkal jekono pithe pelei borte giye kheye feli. ar chupi chupi bole chinir narur opore pokkhopat ta amar ekhono achhey.
ReplyDeleteঅর্চিষ্মানও চিনির নাড়ুর প্রতি দুর্বল, কাজেই ওর হয়ে তোমাকে হাই ফাইভ, চুপকথা। নোনতা পাটিসাপটা আমি কখনও খাইনি ধুবড়ি তোমার আমার কমন পয়েন্ট! তুমি গেছ নিশ্চয়? কী সুন্দর না শহরটা? ব্রহ্মপুত্রের ধারটা, আহা।
Deleteপৃথিবীতে কোনও সম্পর্ক ফিফটি ফিফটি হয় না। জগতের যাবতীয় সম্পর্কে দায় সর্বদাই একপক্ষের বেশি, কমিটমেন্ট সর্বদাই একদিকে তীব্রতর, ভেঙেচুরে গেলে একপক্ষের চোট একইঞ্চি হলেও অন্যপক্ষের তুলনায় বেশি গভীর।"" <3
ReplyDeleteহাই ফাইভ।
Deleteঅর্চিষ্মান যখন চিতই পিঠের বদনাম করলো তখন তুমি কি করলে সেটা বললে না তো? আর আরো একটা জিজ্ঞাস্য হলো লেখার নাম পাটিসাপটার প্রতিশোধ কি করে হলো, কুন্তলার প্রতিশোধ হওয়া উচিত ছিলোনা?
ReplyDeleteপাটিসাপটা যে পিঠের পর্যায়ে পরেনা সেটা এই প্রথম শুনলাম| মালপোয়া আর পায়েস আমিও মনে করিনা পিঠে! কিন্তু পাটিসাপটা কি দোষ করলো যে তাকে পিঠের সম্মান দেয়া যাবেনা!!
হাহা, কিছুই করিনি, অমিতা। সকলেরই মত প্রকাশের অধিকার আছে ভেবে চুপ করে ছিলাম।
Deleteযে সব আমার মতো ফাঁকিবাজ রাঁধিয়ে চৌরসে ডোবানো পাটিসাপটা পরিবেশন করতে বাধ্য হয় তাদের জন্য মৎমস্তিষ্কপ্রসূত শর্টকাট... কন্ডেন্সড মিল্ক প্লাস এলাচগুঁড়ো।
ReplyDeleteআরে এটা দারুণ টিপ, অদিতি! থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
Delete