সাফাই
কেমন আছেন সবাই? আমি সরি, ভেরি সরি, এতদিন অবান্তরকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। ব্যস্ততার কথা গেয়ে রেখেছিলাম বটে, কিন্তু ব্যস্ততার জন্য কিছুই আটকায়নি, আটকায় না কখনও। অবান্তর তো নয়ই। আসল কথা হচ্ছে ব্যস্ততা অন্তে হাতে যা সময় ছিল, তাতে টাইপ করার ইচ্ছে ছিল না। ঢের লোভনীয় ঠেকছিল সিলিং-এ চোখ সেঁটে শুয়ে থাকার প্রস্তাব।
ইচ্ছেটা কখন প্রথম জাগল ঠিক মনে করে বলতে পারি না, তবে বাড়ি বয়ে দরজা খটখটিয়ে ওঁরা যখন দেখা করতে এলেন তখনই হবে। অনেকদিন আসেননি তাই খিলটিল ঢিলে দিয়েছিলাম, কড়ার আওয়াজ পাওয়ামাত্র না ভেবেচিন্তে খুলে দিয়েছি। দেওয়ামাত্র, হ্যালো ডার্কনেস, মাই ওল্ড ফ্রেন্ড।
যখন আসেন দল বেঁধেই আসেন। কারওর নাম আমি জানি না, সম্পর্কটা ঠিক নামধাম জেনে বন্ধুত্ব পাতানোর নয়। কাজ দিয়েই পরিচয়। এবার যারা এসেছিলেন এবং আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের একজনের নাম আমি রেখেছি, "কীসের জন্য?' কারণ তিনি যাবতীয় কুশলবিনিময় এড়িয়ে, আমার টুঁটি টিপে ধরে বিশ্রী গন্ধওয়ালা মুখ আমার মুখের আপত্তিজনকরকম কাছে নিয়ে এসে কেবলই জানতে চাইছিলেন, "কীসের জন্য? কীসের জন্য?" আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন সামান্য তফাতে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছিলেন আর জিজ্ঞাসা করছিলেন, "কী লাভ?", আরেকজনের, ইনি মোটামুটি সব দলের সঙ্গেই আসেন, নড়েন না চড়েন না, ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকেন বা বসেও পড়েন মেঝেতে অনেকসময়, পাথরের মতো শরীরে বয়ে চলে কেবল চোখের জল আর ঠোঁটের প্রায় অদৃশ্য নড়াচড়া। কান একেবারে কাছে নিয়ে গেলে শোনা যায়, "সব ভুল হয়ে গেল, সব ভুল, সঅঅব ভুউউউল।"
বলতে যান, "ভুল হয়েছে তো ঠিক করে নিলেই হয়," পাশ থেকে চেনা গলা, কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ির ওপর টোকা মেরে বলে উঠবে, "ঠিক করবে? ক'টা বাজে দেখেছ?'
অফ কোর্স, এঁর কথা ভুললাম কী করে? ইনিও সব দলে কনস্ট্যান্ট। কেবলই ঘড়ি দেখেন, আমাকে দেখান আর ঘোষণা করেন, পরীক্ষা শেষ। আমাকে ফ্যালফ্যালিয়ে রেখে ফাঁকা খাতা হাতের তলা থেকে টান মেরে নিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে যান।
কানে তুলো গুঁজে চোখে ঠুলি পরে ডুব দেওয়া ছাড়া বাঁচার রাস্তা নেই। যতটা গভীরে পারা যায় নিজেকে পুঁতে দেওয়া ছাড়া। যেখানে এদের প্রশ্ন আর কান্না আর ঘড়ির টিকটিক পৌঁছয় না। অন্তত আশা করা যায়, পৌঁছবে না। যেখানে ভীষণ চুপচাপ চারধার, এত চুপচাপ যে কোনও হেসে ওঠার স্মৃতি পর্যন্ত নেই। ভীষণ অন্ধকার। এত অন্ধকার যে গাছের পাতা গলে রোদের কুচি এসে পড়েছিল জীবনে কোনওদিন কল্পনা করা যায় না। ভীষণ ফাঁকা। ভীষণ ঠাণ্ডা। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে সমান করে দেওয়ার কেউ নেই, কেউ নেই জমে যাওয়া আঙুলের ডগা মুঠোয় নিয়ে উষ্ণ করে দেওয়ার।
ওই অন্ধকূপে ভরসা কেবল মাসল মেমোরি। টুথব্রাশে টুথপেস্ট লাগানোর এনার্জিটুকু সম্বল করে চালানো গোটা দিন। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ল্যাপটপের সামনে প্রেজেন্ট প্লিজ। ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ। কেমন আছো-র উত্তরে 'ভালো' বলে হাসা। ওটা নতুন গল্প লেখার সময় নয়। সোমেনকে মেসেজ পাঠানো, এ মাসের চার নম্বরের গল্প পরের মাসে পাঠাই, না হলে গল্পের ওপর, আপনার ওপর আর নিজের ওপরেও অবিচার হবে।
সোমেনের ধমনীতে, আমার অনেকদিনের সন্দেহ, রক্তের বদলে দয়ামায়া বইছে, রাজি হয়ে যান।
আর সেখান থেকেই হয়তো সব ঘুরতে শুরু করে। বিষে বিষ নয়, এক্ষেত্রে ঘরে ঢুকে পড়া গুণ্ডাদের নির্মমতার চোখে চোখ ফেলে দাঁড়াতে পারে খালি মায়াদয়া আর "ষাট ষাট"। ওঁরা যত জোরে চিৎকার করবেন, "কিস্যু হবে না তোমার, অপদার্থ কোথাকার," তত জোরে কাউকে হেসে উঠতে হবে। পড়া-না-হওয়া পরীক্ষার আগের রাতে অফিস থেকে ফিরে এসে যেমন মা উঠতেন। "কই দেখি কী বাকি আছে? ইস, এইটুকুর জন্য এত কান্না? দাঁড়া আমি চান করে এসে সব ঠিক করে দিচ্ছি।"
সব আস্ফালন, দাপাদাপির মুখে এক খাবলা নুন।
সোমেন যে আমাকে বকলেন না, অপদার্থ বললেন না, এতে ওই অন্ধকারেও বুকে বল এল। সৌরভ স্টোর্সে গেলাম, না গেলে চলছিল না কারণ হোম ডেলিভারি দেওয়া ওঁরা বন্ধ করেছেন সামলাতে পারছেন না বলে আর আমার ব্রিটানিয়া মারি ফুরিয়েছে। মা 'টা' ছাড়া চা খেতে পারতেন না। একমুঠো মুড়ি হলেও হত। কিন্তু সবথেকে ভালোবাসতেন দু'খানা মারি বিস্কুট আর চায়ের কাপ নিয়ে খাটের কিনারাটায় বসতে। চুরি করা একচিলতে শান্তিতে বসে পা দোলাতে।
জীবনের কাছে রাখা নন-নেগোশিয়েবল দাবিগুলোর সঙ্গে এটাও যোগ করেছি আজকাল। যতদিন বাঁচব, দু'খানা মারি বিস্কুট ছাড়া চা খাব না।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কালো ল্যাজমোটা কুকুরটা চেঁচাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে। কী হয়েছে কে জানে, কেউ সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভেঙেছে বোধহয়, শাসন করছে। মারাত্মক সর্দার কুকুর। চেঁচানি থামতে যেই না মুখ খুলেছি অর্ডার দেব বলে, আবার চিৎকার। আবার বিরতি, আবার উদ্যোগ নিতে না নিতেই আবার চিৎকার। বারতিনেক ঘটার পর মাস্কের আড়াল থেকে আমি আর সৌরভ স্টোরসের ভদ্রলোকের (ওঁর নাম সৌরভ কি না এটা আমার জীবনের প্রথম তিনটে কৌতূহলের একটা, এখনও সাহস করে উঠতে পারিনি, করলেই জিজ্ঞাসা করে ফেলব) ওই যে হালছাড়া হাসি তিন সেকেন্ডের, যে হাসিটা সারাজীবনের মতো কেবল আমাদের দুজনের হয়ে রইল, তাতে দোমড়ানো শিরদাঁড়াটা সামান্য টান হল। অন্ধকারটা পাতলা হল আরও একটু।
আর সেই নিরবচ্ছিন্ন টোকা তো আছেই। গোড়াতে এত ক্ষীণ যে সন্দেহ হয় সত্যি শুনছি নাকি সব ভেল্কি? হয়তো ওই লোকগুলোই গলা বদলে ফাঁদ পাতছে। "উঠে এসো, চলে গেছে সব।"
ধীরে ধীরে অন্ধকার পাতলা, নীরবতার দশ ইঞ্চি দেওয়াল ফুঁড়ে অটোর হর্ন, নেড়ির চিৎকার, কোকিলের ডাক, এই ভরা মে-মাসে! টোকার আওয়াজ আর ভ্রম নয়, এই অন্ধকারের মতো সত্যি। আওয়াজ অনুসরণ করে হাতড়ে হাতড়ে দরজা, দরজায় খোদা ছোট চৌকো জানালায় ছোট ছিটকিনি। খুট করে খুলে, চোখটোখ কুঁচকে কোনওমতে আলোর বাণ ডজ করে বলি, "কী চাই?"
চেনা মুখ মুচকি হেসে বলে, "টিভিতে ভালো খবর চলছে, তোমার মনের মতো, দেখবে না?"
তারপর তো অন্ধকারটন্ধকার হাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহখানেকও। কী জঘন্য ভাবুন। চল্লিশ পার হওয়ার পর কোথায় ভাবলাম যে ক'টা সেকেন্ড বেঁচেবর্তে আছে সব নিংড়ে নেব, তার মধ্যে কিনা আবার পুরোনো অসুখের দাপাদাপি? সবথেকে বিশ্রী ব্যাপার, প্রায় বাজি ধরে বলা যায়, এই শেষ নয়, আবার আসবে। আবার টুঁটি টিপে ধরবে, আবার আমাকে পালাতে হবে প্রাণ হাতে করে।
সে যখন হবে তখন হবে। এখন যা গেল, আরও যা যাবে, তার শোক ছেড়ে যেটুকু রইল সেটার প্রতি তেড়েফুঁড়ে লাগি। প্রশ্ন উঠতে পারে, অবান্তর কি এতদিনেও আমার মাসল মেমোরির অংশ হয়ে উঠতে পারেনি? এই এগারো বছরেও? সেটা পরীক্ষা করার জন্য অল্প অল্প করে লেখার চেষ্টা করেছিলাম ওই অন্ধকারে বসেই, ফল যেটা হয়েছে সেটা অবান্তরের রেগুলার প্রলাপের থেকেও অসংলগ্ন এবং অবান্তরতর। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। লোকে বলে বটে ফার্স্ট ড্রাফট হাবিজাবি লেখার জন্যই, কিন্তু হাবিজাবির তো একটা সীমা থাকে। ও জিনিস ভদ্রস্থ করে পাবলিশ করতে এখনও ঝাড়া সাড়ে তিনঘণ্টার খাটুনি লাগবে।
তবু এই যে আবার অবান্তরে এলাম, এই পোস্টটা পাবলিশ করব আর আধঘণ্টার (একঘণ্টার এক মিনিট কমে হবে না, অভিজ্ঞতায় জানি) মধ্যেই, এ ভারি আনন্দ দিচ্ছে। দেড় মাসের জন্ডিস পেরিয়ে উঠে স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার মতো আনন্দ।
সে আনন্দের শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক শতাংশ আনন্দও যদি আপনাদের আমাকে দেখে হয়, জীবন ধন্য মনে করব। অনুপস্থিতির জন্য আবারও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। দেখা হচ্ছে শিগগির।
"Happiness can be found even in the darkest of times, if one only remembers to turn on the light." Ondhokar theke alor jogote protyabortoney swagoto. Ebong highest five. :)
ReplyDeleteহায়েস্ট ফাইভ, বিম্ববতী। আর এক লক্ষ থ্যাংক ইউ।
Deleteআরে স্বাগতম স্বাগতম। ফিরে গেছো ব্যস আর কি, এবার আবার অবান্তর ভরে যাবে। চারদিকে এখন টাটকা বাতাসই বইছে (করোনার মধ্যেও), পালানো যাবেই না 😊
ReplyDeleteহাহা, ওই হাওয়াটাও হেল্প করেছে, প্রদীপ্ত। এবার খালি করোনা বিদায় হওয়ার অপেক্ষা।
Deletekhub bhalo thakben. khub bhalo laglo aapni bhalo hoye gechen dekhe.
ReplyDeleteemon e kharap somoy. kichu korar o nei. aami o oi alo chaya aschi jacchi shorir kharap korchi.
bhalo somoy aschei. sobai bhalo thakbo.
Indrani
থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। যেমন মানুষ হলে শেষের দুটো বাক্য এমন নিশ্চিন্তে উচ্চারণ করা যায়, সে রকমই থাকবেন আজীবন। আপনার ছায়া দূর হয়ে শুধু আলোটুকু থাক এই কামনা করি। শরীরের যত্ন নেবেন।
Deleteভালো থেকো, আনন্দে থেকো কুন্তলা দি, এঁরা আমার সঙ্গেও দেখা সাক্ষাতের ইচ্ছেয় আসেন, ঠেলে গুঁতিয়ে পালিয়ে আসতে চাইলেও, কারোর না কারোর কাছে ধরা পড়তেই হয়। বড় বিশ্রী লাগে, চাপ চাপ অন্ধকারে ডুবে যেতে।
ReplyDeleteবিশ্রী বলে বিশ্রী, শাল্মলী? অসহ্য।
Deleteশরীর,মন দুইয়ের যত্ন নিও
Deleteরাইট, শাল্মলী। একটা ঢিলে দিলেই অন্যটা ঝামেলা পাকায়।
Deleteআপনাকে ডিমেন্টরে ধরেছিল কুন্তলা। বেশি করে চকোলেট খেয়ে দেখেছিলেন কি, কাজ হয় কিনা? তবে চিকিৎসা যাই হোক, কাটিয়ে যে উঠেছেন এটা খুবই আনন্দের খবর। আপনাকে ফিরে আসতে দেখে আমরাও খুব ভরসা আর ফুর্তি পেয়েছি। আপনার গানটা (ওটা মুছে যাওয়ার আগেই আমি দেখেছিলাম) খুবই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট। এবার সাবধানে থাকুন, আর কাউকে ঢুকতে দেবেননা - এই পুরোনো আততায়ীদের তো নয়ই, আর ওই খুদে খুদে কাঁকরোলের মতন দেখতে ভাইরাসগুলোকেও না।
ReplyDeleteএকদম, ডিমেন্টর ছাড়া ওরা কেউ না। এই একটা জিনিস রোলিং একেবারে যাকে বলে প্রফেটের মতো লিখে গেছেন। অবিকল ওইরকমই ঘটে। অন্তত আমার সঙ্গে।
Deleteশুভেচ্ছা পেয়ে খুশি হলাম। ডিমেন্টরদের হারাতে বন্ধুদের আশ্বাস ধন্বন্তরী। গানের লাগসইপনার উপলব্ধি মিলে যাওয়ায় হায়েস্ট ফাইভ।