আত্মপরিচয় ২ঃ পুষে রাখো পাঁজরাতে



ডাকবাংলা বলে একটা ওয়েবপোর্টাল খুলেছে, সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক এবং সেলিব্রিটিকেন্দ্রিক। পোর্টালে একজন সেলিব্রিটি নস্ট্যালজিয়া নাড়াঘাঁটা করতে করতে বলছিলেন যে তিনি ছোটবেলায় অমুক ইউনিভার্সিটির সামনের তমুক ক্যাসেটের দোকান থেকে ক্যাসেট কিনতেন।

অমনি অর্চিষ্মানের মুখচোখ জ্বলজ্বলিয়ে উঠল। "ওই দোকান থেকে আমিও ক্যাসেট কিনতাম! সুমন আর চন্দ্রবিন্দুর কনসার্টের টিকিটও পাওয়া যেত ওই দোকানেই।" বলতে বলতে আমার দিকেই তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও পষ্ট দেখলাম আসলে ও আমাকে দেখছে না, ওর দৃষ্টি আমার কপাল ফুঁড়ে, বাড়ির দরজা ভেদ করে পৌঁছে গেছে পনেরোশো কিলোমিটার দূরে। মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাসেটের দোকানের সামনে।

ঘরে ঘরে এ জিনিস ঘটল। যারাই শুনল প্রথিতযশা গায়কের নস্ট্যালজিয়ার ইতিবৃত্ত, সে বৃত্তে ওই ক্যাসেটের দোকানটার অবস্থান, যারা ওই দোকানে যেত, যারা পাশ দিয়ে যেত, যারা আর কোনওদিন যাবে না ঠিক করেছিল এবং যারা দোকানটার অস্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবত সম্পূর্ণ অনবধান বা উদাসীন ছিল, তাদের সবার দৃষ্টি এবং চেতনা নিজের নিজের অবস্থান থেকে ধাবিত হল দোকানটার দিকে। আর সেই সম্মিলিত মনোযোগ আত্মস্থ করে দোকানটা ক্রমশঃ বড় হতে শুরু করল। জ্যোতির্ময় হতে শুরু করল। সেই ক্রমবর্ধমান জ্যোতির্ময়তা অবশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক মানসে প্যাঁট করে একটা বিশালকায় বঁড়শি বিঁধিয়ে ফেলল। দোকানটা আর স্রেফ একটা নশ্বর বেচাকেনার স্থান রইল না, হয়ে উঠল বাংলা গানের, বাংলা সংস্কৃতির, বাঙালির জগতের একটি মাইলফলক। সিলমোহর।

আমি ভাবতে লাগলাম আমার ছোটবেলার স্টেশনের পাশের ক্যাসেটের দোকানটার কথা। যেখান থেকে সুমনকে নিয়ে এসে ভাইঝির হাতে তুলে দিয়েছিলেন পিসি। সেই সুমন, যিনি বালিকাবেলায় আলাপপরিচয় সেরে ঘাপটি মেরে ছিলেন, যৌবন ফিরে গেলে আবার গ্রাস করবেন বলে। সে দোকান নেই আর, বলা বাহুল্য। পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়ার্ল্ড সময়ের যে ঝড়ে উড়ে গেছে, রিষড়া স্টেশন রোডের দশফুট বাই দশ ফুট ক্যাসেটের দোকান তা ঠেকাতে পারবে আশা করাই অন্যায়।

কী যেন নাম ছিল দোকানটার? কে যেন বসত খালি কাউন্টারের ওপারে ম্লান মুখে? বাবা ছেলে? না দুই ভাই? কার চশমা ছিল আর কার টাক?

কাকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পাওয়া যাবে মাথায় এল না।

অর্চিষ্মানের ক্যাসেটের দোকানের সঙ্গে যা ঘটেছে, গণস্মৃতিতর্পণে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হওয়া, নশ্বরতা ছাপিয়ে অমরত্বের দিকে রওনা দেওয়া, উল্টোটাও কি ঘটে? একটা জিনিস বা জায়গা, স্মৃতিচারণার ক্রমাগত অভাবে ক্রমশঃ ঝাপসা হতে হতে একসময় নেই হয়ে যেতে পারে কি? মানুষের নামের ক্ষেত্রে ভাবনাটা আমাকে আগেও ভাবিয়েছে, অবান্তরে সে নিয়ে ফেনিয়েওছি। আমার ছোটবেলার সব সাক্ষী যখন মরে যাবে, তখনও কি ছোটবেলাটা থাকবে? সোনা বলে কেউ যখন ডাকবে না তখনও কি সোনা বলে কেউ থাকবে? সেদিন কবীর সুমনের একটা চমৎকার ভিডিও দেখছিলাম ইউটিউবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণে, সেখানে সুমন একঝলক উল্লেখ করলেন যে ওঁর ডাকনাম টুটুল। ভাবা যায়? ওই গম্ভীর বয়স্ক লোকখানি, জিনিয়াস জুড়েটুড়ে নিজের আসল বপুর একশোগুণ বেশি বড় হয়ে উঠেছেন, তিনি নাকি টুটুল। আমি কল্পনা করতে পারছি না, কিন্তু সুমন নিশ্চয় পারছেন? শুধু পারছেন না, পাচ্ছেনও। জুন মাসের দুপুরে ছাতাছাড়া রোদ্দুরের তাতের মতো শুনতে পাচ্ছেন টুটুল বলে ডাকছে একগাদা চেনা গলা।

নাকি এতদিন পর ধাঁধা লাগছে? কারা ডাকছে? কে টুটুল?

ঠাকুমার বালিশের পাশে বরিশালবিষয়ক যে বইটা রাখা থাকত দুপুরে খেয়ে উঠে পড়ার জন্য, দেশের লোক দেখলেই যে ঠাকুমা লোকটার সমস্ত তাড়া অগ্রাহ্য করে জিজ্ঞাসা করতেন খুঁটিনাটি, সেও হয়তো ওই আশ্বাসের জন্য যে যা মনে আছে গোটাটাই কল্পনা নয়। পুকুরটাও সত্যি, পুকুরের ওপর হেলে পড়া তালগাছটাও।

এই যে সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরোন পাড়া, পুরোন স্কুলের এত ঘোঁট পাকানো, সব আসলে একে অপরের স্মৃতিকে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টায়। বিশেষ করে আমাদের মতো যে সব সেলিব্রিটিহীন স্কুল এবং সেলিব্রিটিহীন পাড়ার স্মৃতিচারণায় আপামর সমাজ গুঞ্জিত হয় না, সে সব পাড়ার লোকেদের বেঁধে বেঁধে থাকার একটা প্রধান উদ্দেশ্য আমার স্মৃতি তোমার স্মৃতি জুড়ে জুড়ে একটা জায়গা, একটা সময়কে সচল এবং সজীব রাখা। বাস্তবকে কল্পনা না হতে যেতে অ্যালাউ করা। অতিরিক্ত অতীতমুখিনতায় আমার অস্বস্তি হয় বলে আমি এ সব গ্রুপ এড়িয়ে চলি। তাছাড়া অনেকসময় ঝোঁকের চোটে এই সব জমায়েতে অতীতের আপত্তিকর দিকগুলোকেও ধুমধাম করে উদযাপন করা হয়, সে বসে দেখা ভারি কষ্ট।

জুমে যে সেদিন ফটাস করে নিজের নাম মুছে নিজেকে বাঙালি বলে রি-আইডেন্টিফাই করে ফেললাম, বাঙালি আমি কীসে? ভাষায়? খুলির গঠনে? বইমেলায়? বেনফিশে? শুক্রবার ছুটি পেলে প্রথমেই শান্তিনিকেতন গেলে কেমন হয় মনে পড়ায়? বাঙালি বললে যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বোধ এবং চেতনার ছবি মাথায় ভেসে ওঠে, সেই ছবিটিতে?

নাকি বাঙালি এক স্থানিক আইডেন্টিটি? উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে বিহারের মাঝখানের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশের হিসেবে আমি বাঙালি?

আইডেন্টিটি তৈরিতে ইতিহাসের গুরুত্ব কথায় কথায় স্বীকার করি, কিন্তু ভূগোল আমাদের কম কিছু তৈরি করে না। ভূগোল মানে সূর্যরশ্মি আমার বাড়িকে কত ডিগ্রি অ্যাংগেলে হিট করে আমার ত্বকে কত পোঁচ মেলানিন বোলায়, সে আইডেন্টিটির কথা বলছি না। আমি বলছি তার থেকে অনেক ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ গণ্ডির কথা।

আমাদের আইডেন্টিটির একটা বিরাট অংশ স্মৃতিনির্ভর, আর স্মৃতির ভরসা স্থান। আমার মতে কাল এবং পাত্রের থেকেও অনেক বেশি। যে কোনও ঘটনায় প্রেক্ষাপটের ভূমিকা অসীম। লেখার ব্যাকরণে হোয়াইট রুম সিন্ড্রোম বলে একটা অবগুণ আছে। চরিত্রদের কথোপকথনে মনোযোগ দিতে গিয়ে  লেখকরা অনেকসময় চতুষ্পার্শ্ব বর্ণনা করতে ভুলে যান, তখন সেটা হয়ে যায় হোয়াইট রুম সিনড্রোম। কিছুই তো হাওয়ায় ঘটে না। প্রথম দেখার পাড়ার মাঠ। শেষ দেখার এয়ারপোর্ট। কালপুরুষ চেনার ছাদ। প্রথম অ্যাপ্রাইজালের মিটিং-এ টেবিলে রাখা জলের গেলাসের ঢাকনার প্যাটার্ন।

ওই প্রেক্ষপটটা যদি পায়ের তলা থেকে টেনে নেওয়া হয়, ট্রুম্যান শো সিনেমাটার মতো প্যাক আপ বলে চারপাশ দেওয়ালমেওয়াল ঘাড়ে করে নিয়ে চলে যায় কেউ, তাহলেও কি স্মৃতিগুলো একই থাকবে?

আমার চিবুকের নিচে একটা ক্ষত আছে, চট করে দেখা যায় না, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উটের ভঙ্গিতে গলা চুলকোনোর মতো অদ্ভুত কিছু যদি না করি। ওই ক্ষতটার আইডেন্টিটি নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে একটা ধন্দ সৃষ্টি হয়েছে। পাত্র নিয়ে নয়, পাত্রটা নিশ্চিতভাবেই আমি। কালটাও বছরখানেকের এদিকওদিকে স্থির। গেরো স্থানঘটিত। দুটো স্থান ক্ষতটার দখল নিতে চায়। স্কুলের খেলাঘরের লোহার পিলার, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে সোজা গিয়ে গোঁত্তা? নাকি লিলুয়াপাড়ার মোড়? মোড়ের মাথায় সিমেন্টবালির গোলা। গোলার সামনে ভোম্বলের ভ্যানের সামনের চাকা আকাশে, পেছনদিক থেকে ঝরঝর করে বালি ঝরে রাস্তার ওপর পাহাড় তৈরি করছে। আমি সাইকেলে করে ফিরছি কোথাও একটা থেকে, বালিতে চাকা হড়কে পপাত চ। রিকশাস্ট্যান্ডের কাকুরা দৌড়ে এসে তুলেছিলেন। ভোম্বল কালপ্রিট হলেও সেও ছুটে এসেছিল, স্বীকার করছি।

সে বালিসিমেন্টের গোলা হাওয়া হয়ে গেছে কবে। গত দশ বছরে সে গোলা নিয়ে কারও সঙ্গে স্মৃতিচারণ করার সুযোগ হয়নি। রিকশাস্ট্যান্ডও নেই যে গিয়ে কনফার্ম করব। রিকশা ব্যাপারটাই উঠতে বসেছে। এখন লোকে তিন ভাগ ভাড়ায় তেরো গুণ স্পিডে টোটো চড়ে যাতায়াত করে। একমাত্র আশা ভোম্বল। খুঁজে না পেলে, ব্যস। চিবুকের দাগের একটা সম্ভাব্য সোর্স বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। ওই মোড়ের চারপাশের বাড়িগুলো হয় সম্পূর্ণ ভোল বদলেছে, নয় নতুন হয়েছে। নেক্সট দশ বছরে পাড়ার কারও স্মৃতিতে গোলাটা থাকবে কি না সন্দেহ।

তখনও কি দাগটা থাকবে?

আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি, গোঁড়ামি ভেঙে স্কুলে প্রাক্তনীদের গ্রুপে ঢুকে একবার জিজ্ঞাসা করে আসি, খেলাঘরের গোঁত্তাটা কারও মনে আছে কি না।

*

একটা ছুতোয় এক ধাক্কায় খান চারপাঁচ নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। এ ঘটনা ইদানীং ঘটে না, ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। আপনি-আজ্ঞের সশ্রদ্ধ সদূরত্ব আলাপচারিতা চলছে, এমন সময় আড়ি পাততে গিয়ে এঁদের একজনের জীবনচরিতের একটি বুলেট পয়েন্ট আমাকে থমকে দিল।

ওয়েন্ট টু - স্কুলের নাম।

আমার স্কুল নয়। যাদের স্কুল তারা দিনে দু'বার, সকাল সাড়ে দশটা আর বিকেল চারটে বাজলে, আমার বাড়ির সামনে দিয়ে দলে দলে যেত আর আসত। কোনও কোনও স্কুল কামাইয়ের বিরল দিনে আমি সে গণ-যাতায়াত দেখতে পেতাম, সাইকেলের মিছিলের বেলের স্লোগান শুনতে পেতাম।

লাফিয়ে পড়ে যে সে দেখাশোনার দখল নেব কনফিডেন্স পেলাম না। নবগ্রাম পশ্চিমবঙ্গে অন্তত সাড়ে সাতশোখানা আছে, বিদ্যাপীঠ সাড়ে সাতহাজার। কে জানে আমার চেনাটা কি না। সাউথ নামওয়ালা স্কুলের অভাব থাকার কথা নয়, পয়েন্ট শব্দটাতেও এমন কিছু শশী থারুরোচিত দুর্গমতা নেই, কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি পশ্চিমবঙ্গের কোনও বাঙালির কাছে স্কুলের নাম বলতে গেলে সাউথ পয়েন্টের কোনও ছাত্র বলে উঠবে না, "সাউথ পয়েন্ট বলে একটা স্কুল আছে কলকাতায় আমি সেখানে পড়ি।"

বোকা বনব ধরে নিয়েই টাইপ করলাম। আপনি অমুক স্কুলে পড়তেন? আমার বাড়ি তমুক পাড়ায়। আপনি হয়তো চিনবেন না।

রেলের কর্মচারীদের কোঅপারেটিভ পাড়া পশ্চিমবঙ্গে আছে অন্ততঃ সাত লাখ।

গড়িয়ার কাউকে আমি এই আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে দেখিনি। ধাম জিজ্ঞাসা করলে আমি যে হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল যাওয়ার পথে উত্তরপাড়া আর শ্রীরামপুরের মাঝখানে রিষড়া বলে হ্যানাত্যানা মহাভারত ফেঁদে বসি, গড়িয়ার অতি নিড়বিড় লোকও সে পথে হাঁটবেন না। বলে উঠবেন না, নাকতলা আর টালিগঞ্জের মাঝখানে গড়িয়া বলে একটা জায়গা আছে আমি সেখানে থাকি। তাঁর মাথাতেই আসবে না যে গড়িয়ার নাম কেউ না শুনে থাকতে পারে। কারণ গড়িয়া কেনই বা কেউ চিনবে না? কেউ যদি স্বীকার করেই ফেলে ওই দিকটা বিশেষ চিনি না, গড়িয়াওয়ালারা হাঁ করে থাকবেন। এ কোথাকার গাঁইয়া রে, গড়িয়া চেনে না?

চিনব না মানে কী? কত গেছি ও পাড়ায়। আমার বন্ধু থাকত তো। কী কাণ্ড।

বলে উক্ত ব্যক্তি বন্ধুর বাড়ির অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করলেন। বেসিক্যালি, আমার বাড়ির ঠিক পেছন দিক। ও বাড়ির তিনতলা ছাদের রেলিং-এর ওপর দিয়ে এপ্রিল মে-র দোপাটি বেল গন্ধরাজ আর ডিসেম্বর জানুয়ারির ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা গাঁদা পরিবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে জেঠি (উক্ত বন্ধুর মা) চেঁচিয়ে মাকে "খুব ভালো হচ্ছে" বলে উৎসাহ দিতেন, মা যখন আমাদের বাড়ির পেছনের চাতালে বসে রবিবারের ছুটির রোদ্দুরে তাঁর নতুন খেলনাকে খুব মন দিয়ে তেল মাখাতেন।

এই তথ্যটা পাঁচমিনিটের আলাপীকে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের চেনা, তাই দিলাম। তাছাড়া সমাপতনের চোটে আমি হাঁ করে ছিলাম, উত্তর দিতে পারিনি। ওপাশের লোক হয়তো ভাবছিলেন আমি তখনও চিনতে পারছি না জায়গাটা, তাই আরও খোলসা করতে গেলেন।

অমুকদিক থেকে তমুকদিকে যদি যান, পাশাপাশি দুটো মুদির দোকান পেরিয়ে, এখন আছে কি না জানি না (একটা আছে, আরেকটা নেই), একটা রিকশাস্ট্যান্ড পড়বে। উল্টোদিকে একটা গোলা ছিল সম্ভবতঃ সিমেন্ট বালি ডাঁই করা থাকত সেখান থেকে ডাইনে ঘুরে…

আমার চিবুকের নিচে চিনচিন করে।

গোলা থেকে ডাইনে ফুলস্পিডে ঘুরছে একটা মেয়ে, ইরাবতীদির (ইরাবতীদি যত হুমকি দেয়, খবরদার বতী বলবি না, শুধু ইরা, আমরা তত ইরাবতী বলে ডাকি) কোচিং সেরে ফিরছে, মোড়ের মাথায় ভ্যানগাড়ির সামনের চাকা আকাশে তুলে বালি ঢালছে ভোম্বল, সতর্ক হওয়ার টাইম নেই, বাড়ি গিয়ে চান করে খেয়ে ধরতে হবে পনে দশটার ব্যান্ডেল, যেটা হোপফুলি ন'টা সাতান্নর আগে ঢুকবে না।

সতর্ক করা দরকার, কিন্তু এতদূর থেকে চেঁচানো বৃথা। তাই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। যদি মেয়েটার অস্বস্তি হয়,  ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে আমার চোখে কড়া চোখ ফেলে। কাজ দেয় না। সে মেয়ের মনোযোগ কেবল ব্যান্ডেল মিস এবং তৎপরবর্তী হেনস্থায় মগ্ন। আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। সব শেষে যে আমাতেই এসে মিলতে হবে, এখনও মাথায় ঢোকেনি ওর। আর সেই আমাতে এসে মেলার রাস্তাটায় কত কিছু হবে, কত কিছু হবে না, কত ইচ্ছে পূর্ণ হবে, কত খানখান, কত ট্রেন মিস, কত ভুল গলিতে ঘোরাঘুরি। সে সব মিস হয়ে যাওয়া ট্রেনের জানালায় বসে কত কুন্তলা টা টা করতে করতে পালাবে,  কত কুন্তলাকে কানাগলির অন্ধকারে ফেলে রেখে প্রাণ হাতে পালাবে আরেক কুন্তলা।

আমার ধারণা, ধারণা নয়, বিশ্বাস, সে সব কুন্তলার, সে সমস্ত আমির শুরু এবং হয়তো শেষমেশও পোরা আছে ওই মোড়ে। ওই সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, ট্রেনের ভোঁ, ভ্যানগাড়ির ঊর্ধ্বমুখ চাকা, ইরাবতীর কোচিং ক্লাস, রেলিঙের পাশ দিয়ে উঁকি মারা পিওনির থোকার পাশে প্রতিবেশীর আলাপে।

জুমের ছোট্ট খোপে এত কিছু আঁটানো যাবে না তাই সংক্ষেপে বাঙালিই সই। আসল আইডেন্টিটিটার কথা অবান্তরে লিখে রাখলাম।

Comments

  1. কী ভাল লাগল❤️

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সুদীপ।

      Delete
  2. বৈজয়ন্তীMay 28, 2021 at 12:38 AM

    কি যে মুশকিলে পড়েছিলাম, কিছুতেই গানটা মনে করতে পারছিলাম না.. ছন্দ মনে পড়ছে, কিন্তু সুর কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। পেটে আসছে, মুখে আসছেনা। শেষে গুগল উদ্ধার করলো।

    এই লেখাটার সাথেও এমন একটা আত্মিক যোগাযোগ হলো কি বলবো।
    বাঙালী লেখাটার সাথে একমত হয়েছিলাম। এটার সাথে পাড়ার গলিতে কুমির ডাঙা আর লোকের বাড়ির পেছনের সেপটিক ট্যাংকের উপর লুকোচুরি খেলা অবধি হ্যান্ডশেক হয়ে গেলো।
    সেই আমি আর এই আমির মাঝখানের আরো অনেকগুলো আমিকেও মনে করলাম।
    খুব ভালো করে ভেবে দেখেছি, আমার নস্টালজিয়া-বিলাসিতার মূল কারণ, সেই সময়টায় ফিরতে চাওয়া নয়, সেই সময়টার আমিটায় ফিরতে চাওয়া। 'নোবেল পেতে দশ বা বারো'-য় ফিরতে চাওয়া।

    নিজের কি কি মনে পড়লো, সেসব বাদ দিলেও, এই যে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা মেয়ে সাইকেল করে ভ্যানগাড়ির ঊর্ধ্বমুখ চাকা আর বালির স্তুপের দিকে হৈহৈ করে এগিয়ে আসছে, সেটাও কিযে ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যান্ডশেক রইল আমার দিক থেকেও, বৈজয়ন্তী। কুমিরডাঙা একটা মচৎকার খেলা। লক অ্যান্ড কি খেলা হত কি? ওটা খুব খেলেছি, কুমিরডাঙার পরেই সম্ভবতঃ। আমার আমিগুলোই আমাকে পিছু টেনে রাখে, এটা একদম ঠিক বলেছেন। না হলে আর কীসের মায়া।

      গানটা মনে পড়াতে পারায় এক্সট্রা পুলকিত বোধ করছি। গানটা আমার ওই দলের প্রিয় পাঁচটা গানের মধ্যে একটা।

      Delete
  3. khub khub bhalo laglo

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। আমারও ভালো লাগল আপনার ভালো লেগেছে জেনে।

      Delete
  4. আহা, কি ভাল লাগল! স্টোনচিপস-এ হড়কে সাইকেল নিয়ে আছাড় খাওয়া মনে পড়ে গেল, আর বললে বিশ্বাস করবেননা, সেটাও ভাল লাগল। আপনি কোকো সিনেমাটা দেখেছেন? সেখানেও খানিকটা ঐরকম বলা হয়েছে, যে যতদিন মৃত মানুষকে কেউ মনে রাখে, ততদিন তার সত্যিকারের মৃত্যু হয়না ইত্যাদি। ওই মফস্বল নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার ব্যাপারটাও মোক্ষম বলেছেন। আমার বাড়ি হুগলি শুনলে তো আবার অনেকে মানতেই চায়না হুগলি বলে কোনও শহর আছে। হয় ধরে নেয় হুগলি জেলার কোথাও একটা, নাহলে চুঁচুড়া বা ব্যান্ডেল এর যে কোনও একটা ধরে নিয়ে সেটাই বলতে থাকে।
    আর ওই হেলে পড়া তালগাছের কথাটা শুনে আরেকবার আপনার সেই ঠাকুমার থেকে ধার করা গল্পটা মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, স্টোনচিপসে তো মারাত্মক লেগেছিল, সুগত। দেখুন সময় সে মারও মধুর করে তুলেছে। হুগলির লোকেদের রিষড়ার লোকদের থেকেও বেশি ঝামেলা, সত্যি। আপনাদের তো আবার লোকে হুবলির সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলে, আপনিই বলেছিলেন একবার। কী জ্বালা।

      Delete
  5. Rishra ke chora mofossal bola jaabe ki na janina, tobe lekha ta pore mone jhil mil lege gelo..

    Identity byapar ta besh golmele...sthaan kaal patro nirbhor...
    Aar sheygulo to bheeshon poribortonshil..

    Aar yeh...amio shei south point ei portam....

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটু আগে প্যাকেটের লাস্ট কুরকুরেটা অম্লানবদনে খেয়ে ফেলে যে আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ানক ব্যথিত মুখ করে বলল, ওহ, তুমি খেতে? সেও সেই সাউথ পয়েন্টে পড়ত, অর্পণ।

      যদিও কুইজ ছিল না, কিন্তু মনে মনে তো চাইছিলাম সবাই চিনুক লাইনটা। চিনে ফেলার জন্য একশোয় একশো, আর সে চেনা এমন মোক্ষম করে প্রকাশ করার জন্য ফাউ পঞ্চাশ, মিলেজুলে একশোয় দেড়শো। হাততালি, টুপিখোলা, অভিবাদন।

      Delete
  6. Ki mochotkar lekha.. sedin wa University te ekta attachment elo, bangali hobar ekta condition holo, ekta friend abosyoi South point er hobe! : Papiya

    ReplyDelete
    Replies
    1. এবং চেনা কেউ গড়িয়ায় থাকবে, পাপিয়া। না হলে ভেজ বিরিয়ানি বলে কিছু হয় না বলে যতই চিক্কুর পাড়ো, বাঙালিত্ব অথেনটিক হবে না।

      Delete

Post a Comment