দুটো বই
Elizabeth Strout
'অলিভ কিটরিজ' পড়ে স্থির করেছিলাম এলিজাবেথ স্ট্রাউট যা লিখেছেন, লিখবেন, সব আমি পড়ব। পারিনি। 'অলিভ কিটরিজ'-এর সিকোয়েল 'অলিভ, এগেইন' পড়েছি। আর পড়েছি 'মাই নেম ইজ লুসি'।
পড়ে স্ট্রাউটের একটা ধরণ বুঝেছি সেটা হচ্ছে একটা চরিত্র বাছা এবং সেই চরিত্রটির পিছু পিছু হাঁটা। এই হাঁটাই তাঁর উপন্যাস। 'মাই নেম ইজ লুসি'-র লুসি বার্টনের পিছু হাঁটতে হাঁটতে দ্বিতীয় উপন্যাস এসেছে, 'এনিথিং ইজ পসিবল'। পড়া হয়নি। কিন্তু তৃতীয় উপন্যাস যখন বেরোল আগের বছর, 'ওহ, উইলিয়াম!', ঠিক করলাম হাতে গরম পড়ে ফেলা যাক।
উইলিয়াম লুসির প্রাক্তন স্বামী। কাজেই গল্পটা বুঝতে গেলে লুসি সম্পর্ক একটু জেনে রাখলে সুবিধে। এই জানাটা আপনি 'মাই নেম ইজ লুসি'তে সবথেকে ভালো করে জানতে পারেন, তবে 'ওহ, উইলিয়াম!'দিয়ে শুরু করলেও অথৈ জলে পড়বেন না।
লুসি বার্টন, অ্যামেরিকার হতদরিদ্র এবং অনালোকপ্রাপ্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। দারিদ্র্য অন্যতম হলেও প্রধানতম প্রতিকূলতা নয়। ভালোবাসা, স্নেহ, আদরের আগল, বাচ্চাদের শরীর ও মনের বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ - দরিদ্র পরিবারেও যেগুলো অনায়াসে এবং নিয়মিত লভ্য থাকে, সেগুলোর প্রত্যেকটি, প্রত্যেকটি অনুপস্থিত ছিল লুসির বাড়িতে। বাবা মা দুজনেই নিজের নিজের মতো করে ক্ষতবিক্ষত এবং ভারসাম্যরহিত ছিলেন এবং সে চোট তাঁরা উশুল করতেন ছেলেমেয়েদের ওপর।
ওই পরিবেশ থেকে লুসি বার্টনের মতো একটি সাকসেস স্টোরি বেরোনো, অবিশ্বাস্য। লুসির দুই ভাইবোনই পারেনি। লুসির ছিল বুদ্ধি। তার থেকেও তীব্রতর ছিল আত্মসংরক্ষণের প্রবৃত্তি, যা তাকে স্কুলের পরেও বাড়ি না গিয়ে বই খুলে বসিয়ে রাখত। গতে বাঁধা শিক্ষাকে যত গালিই দেওয়া হোক না কেন, বারংবার আশ্চর্য ডানা দিতে সক্ষম হয়েছে মানুষকে, বাস্তবে এবং কল্পনায়। লুসিও সেই ডানা অর্জন করে এবং স্কুল শেষ করে ওই দুঃস্বপ্ন থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসে, এক দয়ালু এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষিকার হাত ধরে।
এবং জীবনের খেলায় জেতে। পড়াশুনো শেষ করে পেশায় ঢোকে, তারপর লেখালিখিতে। নামডাক হয়। পেশাগত ভাবে সফল অনেকেই হয়, লুসির জয়ের যেদিকটা আমাকে সবথেকে বিস্মিত করে সেটা হল জীবনের শুরুর ওই ছিন্নভিন্ন সম্পর্কের স্মৃতি অগ্রাহ্য করে লুসি একটি সফল ব্যক্তিগত জীবন গড়ে তুলতে পারে।
'ওহ, উইলিয়াম!'-এর সময় লুসি প্রৌঢ়। লুসির দ্বিতীয় স্বামী মৃত। প্রথম স্বামী উইলিয়ামের সঙ্গে লুসির দুই মেয়ে; সফল, প্রতিষ্ঠিত এবং মা বাবার সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কে আবদ্ধ। উইলিয়াম দুটি বিয়ে করেছিলেন লুসির সঙ্গে সংসার ভাঙার পরে। একজন মারা গেছেন, আরেকজন ছেড়ে গেছেন।
আপাতত লুসি ও উইলিয়াম দুজনেই একা। এবং একটি অ্যাডভেঞ্চারে উপনীত হওয়ার মুখে। অ্যাডভেঞ্চারের মূলে উইলিয়ামের জীবনের একটি রহস্য, উইলিয়ামের মৃত মা, এবং পারিবারিক ইতিহাসের কিছু ছিঁড়ে নেওয়া পাতা।
যতটা রোমহর্ষক করে আমি লেখার চেষ্টা করলাম তার তিলপরিমাণ রোমহর্ষণও নেই 'ওহ, উইলিয়াম!'-এ এবং এটা নিন্দে না। নাটকীয়তার অনুপস্থিতি স্ট্রাউট-এর লেখার বৈশিষ্ট্য। অথচ এমন নয় যে নাটকীয়তার অভাব। শিশু নির্যাতন, মনোরোগ, অকথ্য দারিদ্র্য, বৈবাহিক কূটকচালি, ছেড়ে যাওয়াযাওয়ি, মৃত্যু সব আছে। সবের মধ্যে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেছেন স্ট্রাউট। কেউ কেউ থাকে না, রক্তগঙ্গা বয়ে গেলেও ক্ষত চেপে ধরে বলতে থাকে আরে ধুর কিছু হয়নি, একটা ব্যান্ডেড হলেই হবে, আর আরেকজন প্রিন্টারের পাতায় কেটে গেলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়, স্ট্রাউট ওই প্রথম দলের। শৈশবের ভয়াবহ স্মৃতির, যার লেপাপোঁছা বর্ণনা 'মাই নেম ইজ লুসি'-এ পাঠক পড়েছে, 'ওহ, উইলিয়াম!'-এ সে স্মৃতিচারণা করতে গিয়েও লুসি থমকে গেছে। কী হবে ও সব মনে করে ভেবে।
কিন্তু পাঠকের মনে পড়ে গেছে কী ঘটেছিল। ছবির মতো।
স্ট্রাউটের গল্প বলা থেকে যদি কোনও নীতিশিক্ষা খুঁড়ে তোলা যায়, সেটা এটা। অনুভূতি/ প্রতিক্রিয়ার মাত্রা দাগিয়ে বোঝানোর দরকার পড়ে না। না লেখাতে, না জীবনে।
স্ট্রাউটের লেখা তিনটে উপন্যাসের মধ্যে এইটিই আমার মনে ধরেছে সবথেকে কম। লেখা নিয়ে বলার কিছু নেই। এত কম বর্ণনাওয়ালা লেখাও যে এত বেশি মায়াবী হতে পারে, স্ট্রাউটের লেখা না পড়লে বিশ্বাস করতাম না। শুরুটা দিব্যি চলছিল, মাঝপথে পৌঁছনোর অল্প আগে থেকে গল্প গতি হারাতে শুরু করল। আমি ভাবছি কে জানে হয়তো কোনও ঘটনা আদতে নেই, এই রকমই চলবে। ছাড়ব ছাড়ব করছিলাম, তারপর বেরোলো যা সন্দেহ করেছিলাম সত্যি। ঘটনা আছে, ঘনঘোর ঘটনা, কিন্তু তারা সব গুঁড়িশুড়ি মেরে বসে আছে বইয়ের শেষ তৃতীয়াংশে। শেষের কুড়ি পাতায় স্ট্রাউট যাকে বলে ফিনিক্সের মতো পাখা মেললেন এবং একটি অসামান্য, অসামান্য অন্ত নামালেন। তিনি যথার্থেই ওস্তাদ।
মীরার দুপুর
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
ধরুন পাঁচের দশক। নির্দিষ্ট করে উনিশশো তিপান্ন। এক নারী। শিক্ষিত। রুচিশীল। সুন্দরী। মীরার গুণাবলী আমি যে ক্রমে লিখলাম বইতে সেটা উল্টো বলা হয়েছে এবং এটাতে লেখকের কোনও কুমতলব নেই। পহেলে দেখনদারি, মেয়েদের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি, তখনও ছিল, এখনও আছে। অন্যরকম কিছু প্রমাণ করতে গেলেই জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে অসৎ হতে হত।
যাই হোক, মীরার রূপের মায়া যেই না পেরিয়ে যাবেন, বেরোবে মীরা অসামান্য মেয়ে। গুচ্ছ বড়োলোক ছেলে আশেপাশে ঘুরঘুর করা সত্ত্বেও মীরা বেছেছে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং গরিব (মীরার নেকনজরপ্রার্থী প্রেমিকদের কারও কারও তুলনায় তো হদ্দ) অধ্যাপক হীরেনকে। অর্থাৎ গোল্ডডিগারের উল্টো যদি কিছু হয় মীরা হচ্ছে তাই। দেবিত্বের পারা আরও কয়েকধাপ চড়বে।
ভালো লোক দেখলেই ভগবান ঝামেলা হোম ডেলিভারি করেন, এখানেও তাই হল। মীরার অমন বুদ্ধিমান স্বামী হীরেন অসুস্থ হয়ে চাকরি হারাল। মীরা টসকাল না। ‘তোমার জন্য আমার লাইফ হেল হয়ে গেল’ বলে গঞ্জনা দিল না, ‘বাবামা হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিলেন গো’ বলে কাঁদল না। (যদিও কাঁদলে অযৌক্তিক হত কারণ মীরা নিজের ইচ্ছেয় হীরেনকে বেছেছিল কিন্তু স্ট্রেসের মুহূর্তে ও রকম অনেক অযৌক্তিক কথা বলে মানুষে। মীরা বলেনি। কারণ মীরা মানুষ কম, দেবী বেশি।)
মীরা নীরবে সংসারের হাল ধরল। সস্তা পর্দা কিনল কিন্তু রুচির সঙ্গে আপোষ করল না। অপেক্ষাকৃত কমদামি পাড়ায় উঠে আসতে বাধ্য হল, কিন্তু নতুন বাড়ি আর তার সজ্জা দেখে সবাই বলল, এ বাড়ি তো আগেরটার থেকে কত্ত ভালো। কত্ত বেশি আলো বাতাস। এবার হীরেন ভালো হয়ে উঠবে।
মানুষরূপী দেবতাদের সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে জানেন, অভিজ্ঞতাটা অস্বস্তিজনক। আর এ তো সান্নিধ্য নয়, সহবাস। হীরেনেরও হল। আকণ্ঠ অস্বস্তি। কান ফাটানো বউয়ের প্রশংসা, কৃতজ্ঞতার ভার, মেল ইগো মিলিয়েটিলিয়ে অসুখ সারার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকল।
কিন্তু হীরেনের কী হল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই, কারণ গল্পটা মীরার। সারা দুপুর মীরা কী করে তার। এমন অসামান্য নামকরণ আমি স্মরণীয় অতীতে দেখিনি। নামটার প্রেমে পড়ে গেছি।
মীরা সারা দুপুর ঘুরে বেড়ায়। চাকরির সন্ধানে, টাকার ধান্দায়। স্বামীর যত্ন করে। ওষুধ খাওয়ায়। সংসারের হাল শক্ত করে ধরে রাখে।
বাংলা সাহিত্যে এই রকম মেয়ের গল্প কেজি কেজি লেখা হয়েছে। মীরার দুপুর তাদের থেকে কেন আলাদা জানতে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর সাহায্য করবে।
১। টাকা জোগাড়ের সব রাস্তা বন্ধ হওয়ার পর মীরা হাত পাততে যায় সেই পুরুষটির কাছে যার বাবার পয়সার উল্টো দাঁড়িপাল্লায় হীরেনের স্ট্রাগলকে বসিয়ে, যার টাকার গরমের সঙ্গে হীরেনের জ্ঞানবুদ্ধি সমাজচেতনার তুল্যমূল্য চুল চিরে মীরা একদিন হীরেনকে বেছেছিল। প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক এখন একটি মহার্ঘ হোটেলের মহার্ঘ রুমে বসবাস করে। দুপুরবেলা মীরা সে হোটেলের ঘরে যায় এবং টাকা নিয়ে আসে।
রাস্তায় বেরিয়ে মীরার কান্না পায়। কেন?
২। ওই সময়েই একটি চেনা মেয়ের সঙ্গে মীরার দেখা হয়। মেয়েটি ফসফস সিগারেট ফোঁকে, ডাইনেবাঁয়ে পুরুষসংসর্গ করে। মীরার প্রতি আপামর জনসাধারণের যতটা সাষ্টাঙ্গ শ্রদ্ধা, মেয়েটার প্রতি ততটাই ঘৃণা এবং থুতু ছুঁড়ে দেওয়া। দু-এক পশলা কথা বলে জানালা দিয়ে হাত নেড়ে পাশে অপেক্ষাকৃত তরুণ সঙ্গী ও ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে গাড়ি চালিয়ে মেয়েটি চলে যায়। মীরার মনে কী অনুভূতি হয়?
৩। টাকা জোগাড়ের পর (যা মীরা একাধিক দিন হোটেলে গিয়ে প্রেমিকের থেকে জোগাড় করে, প্রেমিক এখনও মীরার প্রেমে মগ্ন, যাওয়া মাত্র ওয়ালেট খুলে দিয়ে দেয়) মীরা কি বাড়ি ফিরে আসে? নিজের হাতে বানানো ওই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়-এর ছবি ভেসে উঠলে তার কী মনে হয়?
কেজিদরে লেখা বাঙালি দেবীদের গল্পের উত্তরের সঙ্গে এই উত্তরগুলো মিলবে না।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখার যে জিনিসটি আমাকে সর্বপ্রধান টানে সেটা হচ্ছে নিরীহ, মধ্যবিত্ত, ভালোমানুষ জীবনের হিংস্রতা। আমরা প্রত্যেকে যে কী অমিতপরিমাণ হিংস্রতা নিজেদের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি, মুচকি হাসিতে, ঠেস দেওয়া কথায়, আড়চোখের চাউনিতে, কিংবা উদ্যত হাতের চড়ে, যা নেমে আসার তো দূর অস্ত, কখনও উঠে দাঁড়ানোর সাহসও জুটিয়ে উঠতে পারে না, শুধু আমাদের ফ্যান্টাসি জুড়ে প্রতিনিয়ত রাজত্ব করে, সেই সব ফ্যান্টাসির থেকে নিজেদের লুকোতে অনুমতি দেন না জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। অপরিমেয় নির্মমতায় সেগুলোকে নগ্ন করে চোখের সামনে প্যারেড করান। শিহরিত হতে বাধ্য করেন।
লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে স্ট্রাউটের সঙ্গে নন্দীর একটা মানানসই তুলনার জায়গা আছে। স্ট্রাউট যেমন যাবতীয় নাটকীয়তার টোপ অবহেলে এড়ান, নন্দী ঠিক উল্টোটা। রাঁধাবাড়া ভাতখাওয়া বেঁচে থাকা খুঁড়ে খুঁড়ে নাটকীয়তা বার করে আনেন। ক্লাইম্যাক্সের নাটকীয়তা আমার স্পষ্টতই ওভারডোজ ঠেকে। অর্চিষ্মান জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কোনও দোষই দেখে না, ওর মতে গল্প যেভাবে এগিয়েছে, চরিত্রদের যে ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাতে নাকি ওই পরিণতি এবং প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত। আমি একমত হইনি, বলেছি, হ্যাঃ। ও রকম করে না কেউ। নিখাদ সাইকোপ্যাথ ছাড়া।
এত রহস্য করছি কারণ ক্লাইম্যাক্সে মারাত্মক গায়ে কাঁটা দেওয়া সব ব্যাপারস্যাপার ঘটেছে, বলতে গেলে স্পয়লারের ঠাকুরদা হয়ে যাবে। আপনারা পড়ে নেবেন।
সুযোগ পেলে পড়বেন কিন্তু অবশ্য করে।
কিন্তু আরেকটা জায়গার কথা বলতে পারি, বইটা নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা চালানোর সময় 'তারপর ওই জায়গাটা মনে আছে' বলে যে জায়গাটার কথা মনে করে দুজনেই হ্যাঁ হ্যাঁ বলে লাফিয়ে উঠেছিলাম। ওই দৃশ্যে কিছু স্পয়েল করার নেই, কিন্তু মীরার দুপুরের চাল টিপে ভাত বোঝার জন্য যে দৃশ্যটি আমাদের মতে অপরিহার্য।
হীরেনের এক বোন মাঝে মাঝেই হীরেনের বাড়িতে আসে। মীরার অনুপস্থিতিতেই বেশি আসে, তার মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজার দরকার নেই, হয়তো ওই সময় তার আসা সুবিধে। বাকি সবার মতো মীরার প্রতি অভ্রংলেহী সম্ভ্রম তার, হীরেনের প্রতি আকণ্ঠ সহানুভূতি। দুটো, আমাদের সন্দেহ, সম্পর্করহিত নয়। বৌদি যে দেবী, কথোপকথনের শুরুতে সেটা স্বীকার করে নিয়ে সে জানতে চায়, কেমন আছে হীরেন। হীরেন বলে। এই রক্তমাংসের মানুষটির সান্নিধ্যে সে আরেকটু মানুষের মতো হয়ে ওঠে। চলে যাওয়ার সময় বলে, আসিস কিন্তু আবার। এ বলায় বোনের প্রতি দাদার আদেশ নেই, অনুরোধও না। খোলাখুলি আর্তনাদ আছে।
এই বোনটির একটি স্বভাব হচ্ছে, ঘরে বিস্তর বসার জায়গা, চেয়ার, টুল যাবতীয় আসবাব থাকা সত্ত্বেও সে অবধারিত বসে হীরেনের বিছানায়। এবং চলে যায় বিছানার চাদরের অল্প একটু জায়গা কুঁচকে রেখে। প্রত্যেকবার।
বাড়ি ফিরে স্বামীর খবরাখবর নিতে গিয়ে বা নেওয়ার আগেই ওই কুঁচকে থাকা বিছানার চাদরে চোখ পড়ে মীরার। অমুকে এসেছিল? কেমন আছে ইত্যাদি কুশলপ্রশ্ন করতে করতে বারবার তার চোখ যায় ওই জায়গাটায়। কিন্তু মীরা কিছু বলে না।
কীই বা বলবে? মীরা না হয় দেবী। আমার আপনার মতো নশ্বরেরাও কিছু বলতে পারতাম না। কী বলব? তোমার বোন চেয়ারে বসতে পারে না কেন? কেন বিছানায় বসে প্রতিদিন? আমার গাপিত্তি জ্বলে যায়?
বলব না। কারণ উল্টোদিকের লোকটা স্তম্ভিত হয়ে ভাবত, এ কার সঙ্গে বাস করি আমি? এত নীচ, ছোটমন, অসভ্য, ছিঃ।
কাজেই গিলে নিতাম। যদিও বার বার চোখ চলে যাওয়া আটকাতে পারতাম না। যতবার যেত চামড়ার নরম অংশে আলতো ব্লেড চালানোর মতো অনুভূতিটা সহ্য করে নিতাম। নিজেকে দেবী বলে চালানোর উচ্চাশায় নয়, শুধুমাত্র মনুষ্যসমাজের মেম্বারশিপ বজায় রাখার প্রার্থনায়।
এবং পরের দিন আবার বাড়ি ফিরে দেখতাম বিছানার চাদরটা অল্প কুঁচকে রয়েছে। আগের দিনের ক্ষতটার ওপর আবার ব্লেড আলতো ঘষা খেত।
আমাদের ওপর যে ব্লেডগুলো চলে প্রতিনিয়ত, যেগুলোর প্রতিবাদ করা যায় না, চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠা যায় না, কারণ বিষয়গুলো কেঁদে ওঠার মতো নয়, কারণ লোকে পাগল বলবে, শিউরে উঠবে, ছিটকে যাবে, কিন্তু ব্লেড চলবে রোজ, রোওজ, রোওওজ - জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ওই ব্লেড চালানোগুলো মেলে ধরেন। পাতায় পাতায়। প্যারায় প্যারায়।
সময়ের বিচারে কত নম্বর পায় মীরার দুপুর? প্রায় সত্তর বছর পার করে?
এ নিয়ে আগেও বলেছি। এই সব বিচার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত, বিশেষ করে বিচারক আমার মতো আনাড়ি ও অশিক্ষিত হলে। সেখানে আমার বিচারে স্রষ্টার প্রতিভার দৌড়ই রায় স্থির করে। অপেক্ষাকৃত অল্প প্রতিভাধরের সময়ের দোষকে যত কড়া হাতে নম্বর দিই, বেশি প্রতিভাধরকে, তখন ওইরকমই হত, বলে পাশ করিয়ে দিই ডিস্টিংশন সহ।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর প্রতিভা নিয়ে আমি নিঃসংশয়। তবু সময়ের ছাপ তো পড়েছেই। ভাবুন, একজন সক্ষম, শিক্ষিত মহিলা সারাদিন টইটই করে টাকা ধার করে বেড়াবে, তবু চাকরি করবে না! ইন্টারভিউই দিতে যাবে না! কারণ চাকরি করার অগৌরবের থেকে তার একশোগুণ সম্মানের মনে হবে পুরুষের কাছে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়ানো! (এলমোর লেনার্ড বলেছিলেন একজন লেখক প্রতি একলাখ শব্দে দুটি, মেরেকেটে তিনটি বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহারের স্বাধীনতা অর্জন করেন। যে আমি এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করি, সেই আমিও তিনটি বাক্যে তিনটি বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম। তবেই ভাবুন পড়তে বসে কত বড় হাঁ করেছিলাম মাথার ভেতর।)
একটা জায়গাতেই জাজ করলাম জ্যোতিরিন্দ্রকে, মীরার রূপ এবং গুণ অন্তত সাতজন পুরুষের চোখ দিয়ে বর্ণনা না করালেই পারতেন। মেল গেজ-এর হদ্দমুদ্দ। যতবার এই গেজের সামনে পড়ি (বাস্তবে ছেড়ে দিন, গল্পের বইয়ের কথাই বলছি) ততবার মনে পড়ে পুরুষকে কেন্দ্রে রেখে তো কম আখ্যান রচনা হয়নি আমাদের, তার চোখের পাতা, হাতের আঙুল, কব্জির দার্ঢ্য, চোয়ালের কাঠিন্য নিয়ে এর শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক শতাংশ লাফালাফিও যদি হত।
যাকগে মরুকগে। কী হলে কী হত-র থেকে জরুরি এবং আগ্রহোদ্দীপক প্রশ্ন হচ্ছে, যে লেখক মেল হলে মেল গেজ আদৌ এড়ানো সম্ভব নাকি, আর ফিমেল হলে ফিমেল গেজ। এ প্রসঙ্গে একটা ভয়ানক হাসির গল্প শুনলাম সেদিন। আপনারাও শুনুন। শুনতে গিয়ে যদি মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক তাহলে বলব আপনি অযৌক্তিক নন, সঙ্গে সঙ্গে আলতো করে এই ব্লগের নামটার কথাও মনে করাব।
ইউটিউবে একটি বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে একজন বললেন যে পড়া শুরু করার আগে যদিও তিনি জেনেই শুরু করেছিলেন যে লেখক পুরুষ, কিন্তু পড়তে শুরু করে তাঁর আবার ক্রমাগত মনে পড়তে লাগল, রাআআআইট, লেখক পুরুষ বটে।
গল্পটি লেখক লিখেছেন একজন নারীর বয়ানে। এ রকম দৃশ্য নাকি ঘটেছে গল্পে যেখানে নারীটি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে এবং নেওয়ার সময় নিজের স্তনের ওঠাপড়ার কথা ভাবছে।
অবান্তরের মহিলা পাঠকরা সাক্ষ্য দেবেন আশা করি। আমরা যখন শ্বাসপ্রশ্বাস নিই তখন শ্বাসপ্রশ্বাসই নিই, প্রত্যঙ্গের মুভমেন্টে মনোযোগ দিই না।
বলা বাহুল্য, সব পুরুষ লেখকরা এই কাণ্ড করবেন না। ঠিক যেমন মহিলারাও পুরুষের বয়ানে লিখতে গিয়ে গোলমাল বাধাবেন। আমি মজার কথা হিসেবেই বললাম, কোমর বেঁধে কিছু প্রমাণ করার জন্য নয়। অন গড ফাদার মাদার।
সময়ের ছাপ মীরার দুপুরের ওই মেল গেজে নেই, ও জিনিস হইহই করে চিরআধুনিক। বরং ওই 'ধার করব তবু চাকরি করব না' মনোভাবটা তামাদি হয়ে পড়েছে।
তাতে অসুবিধে নেই। কারণ ওই চাকরি চুলোয় দিয়ে ধার করতে বেরোনোটা 'মীরার দুপুর'-এর প্লট। পয়েন্ট নয়।
পয়েন্ট হচ্ছে ধার করতে বেরিয়ে সারা দুপুর শহরের রাস্তায় টইটই করতে করতে মীরা কী ভাবে। সারাদুপুর পর্দা টানা মীরার মাস্টারপিস সংসারের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে হীরেনের মনের ভেতর কী কী খেলে যায়।
গত সত্তর বছরে মেয়েদের চাকরি করাটা তেষ্টা পেলে জল খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। মীরার অমন সাধের পর্দার প্যাটার্ন মিউজিয়ামে ঢুকে গেছে, বাড়িভাড়া সত্তর কেন, সম্ভবত সাতশো গুণ বেড়েছে, কলেজের অধ্যাপকের মাইনেও। বাঙালির মুখের ভাষা, শরীরের পোশাক, তিনবেলার খাওয়া, সব ভোল পাল্টেছে।
কিন্তু ভোলের ভেতরটা?
একটা খবর দেখলাম সেদিন। রিচার্ড অ্যাটেনবরো, ক্যালিফোর্নিয়া মরুভূমির একটি প্রাচীন, যেমনতেমন প্রাচীন না, হাজার দশ বছরের বুড়ো এক কাঁটাঝোপ, যা দিব্যি জীবন্ত এখনও, তার ছবি তুলতে আর ভিডিও করতে গিয়েছিলেন চল্লিশ বছর আগে। সম্প্রতি আবার গিয়েছেন এবং উল্লসিত জানিয়েছেন যে চল্লিশ বছরে সে ঝোপ সিকি ইঞ্চি, হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, গোটা এক ইঞ্চি না, এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ লম্বা হয়েছে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর সুবিধেটা হচ্ছে তিনি আমাদের ভেতরটার ওপর তাঁর সার্চলাইট ফেলেন। পর্দা, চাকরি, পোশাকআশাক, শিক্ষাদীক্ষা, রুচির পালিশ আলোর বেগে বদলে যায়, ভেতরটা বদলায় ওই দশহাজার বছরের বুড়োহাবড়া কাঁটাঝোপের তৎপরতায়। কাজেই মীরা, হীরেন, আপনি, আমি, আমরা সবাই সত্তর বছরের এপার ওপারেও উনিশ আর বিশ রয়ে যাই। অ্যাকচুয়ালি, সাড়ে উনিশ আর পৌনে বিশ।
এবং জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কালজয়ী থেকে যান, মীরার দুপুর সমকালীন।
Dwitiyo boitar somalochona pore gae kanta dilo. Prothomta kichhu kom bhalo na. Kintu dwitiyo somalochonata pore kichhukhon thum mere bose chhilam. Okopot lekha to khub besi pora jae na, tai apnar blog niyomito pore besh ananda pai.
ReplyDeleteআরে, থ্যাংক ইউ। মীরার দুপুর পড়ে ওই অনুভূতিটাই হবে। গায়ের প্রতিটি রোম খাড়া হয়ে উঠবে। এবং যতবার মনে পড়বে, পড়া শেষ হওয়ার পরেও, ততবার ঘটবে এ প্রতিক্রিয়া। যদি পড়া না থাকে, জোগাড় করে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে।
DeleteMeerar Dupur porechhi - college thakte. Oi dhoroner boi porar mushkil achhe. Lukonor poth pawa jae na je.
Deleteঠিক। আর আমাদের পড়া তো বেশিরভাগই "এসকেপ" করার উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্যসাধনে মীরার দুপুর ডাহা ফেল।
DeleteMeerar Dupur onek age porechhi. Abar porte hobe. Khubi bhalo legechhilo.
ReplyDeleteApni apnar boi pora niye aro likhun. Ki je bhalolage ei entry gulo porte.
ReplyDeleteমীরার দুপুর একঘর, সায়ন। আমি এই প্রথম পড়লাম, কিন্তু আরও অনেক বার পড়ব।
Deleteআমারও লিখতে ভালো লাগে বই পড়া নিয়ে, কিন্তু শক্তও লাগে। তবু লিখব। আপনার মতো বন্ধুর উৎসাহের উত্তরে এইটুকু পরিশ্রম তো তুশ্চু।
কি ভীষণ ভাবে চিরে চিরে দেখেছো দ্বিতীয় বইটি !
ReplyDeleteএতো বুক রিভিউ পড়েছি, কিন্তু তোমার মতো এরকম বিশ্লেষণধর্মী, এতটা সূক্ষ্ম চিন্তার রিভিউ খুব কম পড়েছি।
হ্যাটস অফ, কুন্তলা!
আরে, থ্যাংক ইউ, কাকলি। আমি ভয়ানক সরল রিভিউ লিখি, এতই সরল যে সেটাকে রিভিউ পদবাচ্য বলবেন না আসল রিভিউকারেরা। লজ্জাই করে। কিন্তু শেষমেশ নির্লজ্জ কি না, তাই লিখি এবং প্রকাশ্যে এনে ফেলি।
Deleteকিন্তু মীরার দুপুর অদ্ভুত, অসম্ভব, অসামান্য। পড়া না থাকলে পড়ে দেখতে পার। আমি নিশ্চিত ভালো লাগবে।
Olive Kitteridge porechi. Olive Again tao porechi kintu I found it okay.
ReplyDelete"My name is Lucy Barton" amar shobtheke bhalo legechilo. Jodi o Lucyr golpo ta kintu America r ekta demography te onekbar dekha geche in reality (Hillbilly Elegyta poro if not you already have), lekha ta bhari sundor chilo.
পড়ব পড়ব, বং মম। যাই দৌড়ে জোগাড় করি। থ্যাংক ইউ।
Delete