ওটেসা মশফেঘঃ দুটি উপন্যাস





(স্পয়লার আছে, তবে ওটেসা মশফেঘের গল্প প্লটনির্ভর নয় কাজেই স্পয়েল করার কিছু নেই। সাহস করে পড়তে পারেন।)

ওটেসা মশফেঘের দুটো উপন্যাস পড়লাম। Eileen এবং My Year of Rest and Relaxation। মশফেঘ আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ছোটগল্প সংকলন Homesick for Another World দিয়ে। অর্ধেক পড়েছি। এই পোস্টে উপন্যাসদুটো নিয়েই কথা হবে। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে লেখাগুলোর গুণগত মানের কোনও সম্পর্ক নেই। হোমসিক যতটুকু পড়েছি, ইমপ্রেসড কিছু কম হইনি।

আইলিন, ওটেসা মশফেঘের প্রথম উপন্যাস। দু’হাজার পনেরোয় প্রকাশিত, দু’হাজার ষোলোয় ম্যান বুকার প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টিত, একই বছরের হেমিংওয়ে ফাউন্ডেশন/পেন পুরস্কারে পুরস্কৃত। ‘মাই ইয়ার অফ রেস্ট অ্যান্ড রিল্যাক্সেশন’ প্রকাশ পায় দু’হাজার আঠেরোয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার।

দুয়েক জায়গায় মশফেঘের লেখালিখির সঙ্গে বেল জার-এর তুলনা দেখেছি। আমার মতে মিলটা বহিরঙ্গের। বেল জার-এর মূল চরিত্র একলা নারী, মশফেঘের উপরোক্ত দুটি উপন্যাসের মূল চরিত্রও একলা নারী। বেল জার প্রথম পুরুষে লেখা, আইলিন এবং মাই ইয়ার-ও। বেল জার ক্যারেকটার স্টাডির টেক্সটবই হিসেবে গণ্য হতে পারে, মশফেঘও চরিত্রচর্চা করেন, প্লটের দিকে ঘেঁষেন না। তবু প্ল্যাথের টোনের সঙ্গে মশফেঘের টোনের দূরদূরান্তের অমিল। প্ল্যাথের মূল সুর যেখানে বিষাদ, মশফেঘের সেখানে বীভৎস কৌতুক। কৌতুকের কোয়ালিটি বীভৎস বলছি না, রসটা বীভৎস।

উনিশশো চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সাল। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী আইলিন, অ্যামেরিকার একটি ছোট শহরের, যা দেখতে শহরের মতো হলেও আমাদের গ্রামের থেকেও একটেরে, একটি কিশোর অপরাধী সংশোধনাগারে চাকরি করে। ইনমেটসদের সঙ্গে দেখা করতে আসা দর্শনার্থীদের, বেসিক্যালি মায়েদের, লেজারে সই করিয়ে কমলা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসায়। হাতে তাঁদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কোয়েশ্চেনেয়ার ধরায়।

দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

টিভি দেখেন?

দেখলে, কোন অনুষ্ঠান প্রিয়?

কোয়েশ্চেনেয়ারের কোণে গম্ভীর ফন্টে ঘোষণা থাকে, চাইলে প্রশ্নের উত্তর অ্যানোনিমাসলি দেওয়া যাবে।

মশফেঘের লেখা আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ায় যার রসিকতায় জোরে হাসতে অস্বস্তি হয়। শিওর হওয়া যায় না কথাটা অ্যাকচুয়ালি হাসির কি না।

আইলিনের মা মৃত, বাবা মাতাল। আইলিনকে যতরকম ভাবে যন্ত্রণা দেওয়ার দেন। কনকনে রাতে বাড়ি ফিরলে আবার দোকানে পাঠান। বাড়িঘরদোর শোচনীয়। টাকার টানাটানি আছে কিন্তু অভাবটা মূলত যত্নের। বাড়িময় ছত্রাকার বাবার পর্ন ম্যাগাজিন, যেগুলো আইলিন মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখে।

এ রকম সিচুয়েশনে কেউই থাকতে চায় না, আইলিনও পালাতেই চায়। চায় বলেই গোটা সংসারে আইলিনের আত্মার আত্মীয় বাবার লজঝড়ে গাড়িখানা, আকণ্ঠ গিলে অ্যাকসিডেন্ট করার পর থেকে বাবাকে যেটার কাছ ঘেঁষতে অনুমতি দেওয়া হয় না। আইলিন জানে পালাতে হলে এই খোঁড়া পক্ষীরাজই ভরসা।

মাই ইয়ার অফ রেস্ট অ্যান্ড রিল্যাক্সেশন-এর নামহীন মূল চরিত্রটিরও উদ্দেশ্য পালানো, আইলিনের একশো আশি ডিগ্রি তফাতের পরিস্থিতি থেকে। উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত বট্মবিহীন ট্রাস্ট ফান্ড, নিউ ইয়র্ক সিটির পারিবারিক ব্রাউনস্টোনে ঝাড়া হাতপা অধিষ্ঠান, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি, আর্ট গ্যালারির চাকরি। মাইনে নামমাত্র কিন্তু চাকরির কোনও দরকারও মেয়ের নেই। (সুবিধের জন্য এই পোস্টে এবার থেকে মেয়েটিকে "ব্র্যাট" সম্বোধন করা হবে।) গল্পের শুরুতে জানা যায় ব্র্যাটের চাকরি গেছে এবং ব্র্যাট আনএমপ্লয়মেন্ট বেনেফিটের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। ওর নখের ময়লা ওই কয়েকটা ডলারের জন্য রীতিমতো দৌড়োদৌড়িও করছে। ব্র্যাটের এহেন আচরণ অধিকাংশ (করে গোনা যে ক'জনের সঙ্গে ব্র্যাট মেশে) লোকের বুদ্ধির অগম্য কিন্তু সবথেকে বেশি অগম্য ব্র্যাটের বন্ধু রেবার।

রেবা ব্র্যাটের পুরোনো বন্ধু। এত পুরোনো যে ব্র্যাট জানায় রেবার সঙ্গে বন্ধুত্বে এখন পড়ে আছে, যে কোনও পুরোনো সম্পর্কে যা পড়ে থাকে, ঘৃণা আর ঈর্ষা। দুটো লোককে বেঁধে রাখার ক্ষমতা যাদের প্রেমভালোবাসার থেকে বেশি বই কম না। ঈর্ষাটা রেবার দিক থেকে। টাকা রোজগার রেবার কাছে নন-নেগোশিয়েবল, ব্র্যাটের চাকরিবাকরি বেসিক্যালি শোভা। কিন্তু ব্র্যাটের যে ব্যাপারটাতে সবথেকে বেশি গাত্রদাহ বোধ করে রেবা তা হল শুধু সম্পদেই ব্র্যাটের সৌভাগ্য শেষ হয়নি, ব্র্যাট অপরূপ সুন্দরী এবং সূক্ষ্মদেহ। সৌন্দর্য জন্মসূত্রে লাগা লটারি মেনেও নিলেও, ফিগারের ব্যাপারটা রেবা মেনে নিতে পারে না। চোদ্দঘণ্টা হাড়মাস এক করে হাস্‌ল সেরে জিমে দু'ঘণ্টা দৌড়ে এবং আধপেটা খেয়েও রেবা নাদুস, সকালে পিৎজা বিকেলে বার্গার সাঁটিয়েও ব্র্যাট নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকে হাঁটার মতো সুতনু।

ইট’স সো আনফেয়ার। ঘন ঘন বলে রেবা। আই লাভ ইউ-ও বলে ঘন ঘন। ঘন ঘন মনে করায় পার্থিব ষড়ৈশ্বর্য এবং অপার্থিব রূপ থাকা সত্ত্বেও রেবা ছাড়া ব্র্যাটের কোনও বন্ধু নেই, ছিল না কোনওদিন, ভবিষ্যতে থাকার চান্সও নেই। ব্র্যাট নিরুত্তর থাকে।

আমার মতে তিন রকম চরিত্রের চর্চামূলক লেখা পাঠকপ্রিয় হতে পারে। যদি চরিত্রটির সুখদুঃখ, উচিতঅনুচিতবোধ, জীবনের স্ট্রাগল পাঠকের সঙ্গে এমন মিলে যায় যে চরিত্রটি বেসিক্যালি পাঠকের  কুম্ভমেলায় হারানো সহোদর। এই রকম গল্পের প্রত্যাশিত খামতি, যথেষ্ট কৌতূহল এবং অভিনবত্ব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়া। দ্বিতীয়, যদি চরিত্রটা এমন আজগুবি, পাঠকের ধ্যানধারণা যুক্তিবুদ্ধির এমন বাইরে হয় যে চোখ সরানো অসম্ভব হয়। যেমন পাগলা দাশু, কাক্কেশ্বর কুচকুচে। এর সমস্যা রিলেটেবিলিটির। তিন নম্বর চরিত্ররা ওপরের দু'রকমের কম্বিনেশন এবং ইন্টারেস্টিংতম। যারা এতখানি আলাদা যে পাঠক তাদের প্রতি অশেষ কৌতূহল বোধ করে, আবার আচমকা ঝিকিয়ে ওঠা মিলে অন্ধ হয়।

পরিস্থিতির দিক থেকে তো বললামই, রকমসকমের বিচারেও আইলিন এবং ব্র্যাট সাধারণ লোকের যুক্তিবুদ্ধির কতখানি বাইরে বুঝতে দুটো ঘটনা যথেষ্ট। প্রথম ঘটনাস্থল আইলিনের সংশোধনাগার, ঘটনা ফেয়ারওয়েল। যাঁর, তিনি হোমরা এবং জঘন্য। সকলেরই অপছন্দ কিন্তু হোমরা বলেই হোক কি মানুষের অভিনয়ক্ষমতা অবিশ্বাস্য বলে, সে অপছন্দ কোনওদিন প্রকাশ্যে আসেনি। এমনকি ফেয়ারওয়েলের দিনও না। সারা অফিস সাজে, মানে জেলখানার প্রেক্ষাপটে যতখানি সাজা সম্ভব। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই বিবর্ণ দেওয়ালে সেলোটেপ সাঁটা স্ট্রিমার্স, ন্যাড়া টেবিলে কেক ও কোকাকোলা ঘিরে অপ্রস্তুত হেসে অনিচ্ছুক অফিস। সার্কাসঅন্তে সবার সঙ্গে হাত মেলান হোমরা। শেষবারের মতো কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলেন, কিছুরা সেটুকুরও অধিকারী নয়, হ্যান্ডশেকের সঙ্গে শুধু ঠোঁটটেপা হাসি। আইলিন দ্বিতীয় দলে। আইলিন, অফ কোর্স, কোনও দলেই না। হ্যান্ডশেকের কিছু আগে বাথরুমে গিয়ে (নাকি ফাঁকা অফিসঘরে বসেই, ভুলে গেছি, আইলিন বলেই সন্দেহটা জাগছে) নিজের যোনিতে দুই আঙুল ঢুকিয়ে নেয়। লোকটার হাতে ওই আধোয়া হাত মেলায় আইলিন।

ব্র্যাটের চাকরি যায়। ব্র্যাটের দোষে না, ব্র্যাটের বসের অসভ্যতায়। ব্র্যাট কিছুই বলে না। খালি খারিজ হওয়ার দিন (নাকি পরের দিন?) রাতে চুপিচুপি ঢুকে গ্যালারির মেঝের মাঝখানে মলত্যাগ করে আসে।

সুস্থমস্তিষ্কের লোকজনের প্রতিশোধের আইডিয়ার সঙ্গে আইলিন আর ব্র্যাটের আইডিয়ার অমিল স্পষ্ট। কিন্তু আমার মতে অমিলটা প্রতিশোধের রকমের থেকেও অন্য জায়গায়। সুস্থমস্তিষ্কের প্রতিশোধের একটা প্রধান শর্ত প্রদর্শন। প্রতিশোধের পাত্রকে জানানো যে দেখো, আমি তোমার ওপর প্রতিশোধ নিলাম। যে কারণে প্রতিশোধের আরেক নাম 'দেখিয়ে দেওয়া'। ইউটিউব রিলে যে প্রতিশোধের হুদ্দুহুদ্দু নমুনা। মোটা বলে বয়ফ্রেন্ড/বর ছেড়ে গেছে, রোগা এবং হট হয়ে দেখিয়ে দিলাম। এখন পাত্তা দিলি না, পঁচিশ বছর পর জ্ঞানপীঠ ঘোষণা হলে হাত কামড়াস। এক অভিনেতার ইন্টারভিউ শুনেছিলাম, একটি বড় রোল পাওয়ার পর তাঁর ছবিসহ প্রোমোশনাল ব্যানার ঝোলানোর তিনটি লোকেশন বাছার সুযোগ দেওয়া হলে প্রথম লোকেশনটা তিনি ল্যাং-মারা বয়ফ্রেন্ডের বাড়ির মোড় বেছেছিলেন।

আইলিন এবং ব্র্যাটের প্রতিশোধের লক্ষ্যরা কোনওদিন জানতেই পারবে না যে আইলিন এবং ব্র্যাট তাঁদের ওপর প্রতিশোধ নিল। আইলিনের কেসটা তো ছেড়েই দিন। আগের দিন চাকরি যাওয়া এবং পরের দিন সকালবেলা গ্যালারির মেঝেতে ওই দৃশ্য উন্মোচিত হওয়ার সমাপতন থেকে এটা ব্র্যাটের কাণ্ড সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যদি বলেন, আমি বলব নয়, কারণ সামাজিক আর্থিক সাংস্কৃতিক ভাইট্যাল স্ট্যাটসের বিচারে এ আচরণের সঙ্গে ব্র্যাটকে মেলানো অসম্ভব।

প্রতিশোধের মজা কি এতে নিরানব্বই শতাংশ মাটি হয় না? অন্যদের হয়তো হয়, আইলিন এবং ব্র্যাটের হয় না। কারণ, আমার সন্দেহ, আইলিন আর ব্র্যাটের প্রতিশোধের উদ্দেশ্য দেখিয়ে দেওয়া নয়। রাগ ঘৃণা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে গোটা মানবজাতির প্রতি ওরা দুজন আরও কিছু অনুভূতি পোষণ করে যা রাগ, ঘৃণা ইত্যাদির থেকে কোটিগুণে হিংস্রতর।

অনুকম্পা। তাচ্ছিল্য।

আইলিন এবং ব্র্যাট জানে, পৃথিবী ওদের প্রতিশোধও ডিজার্ভ করে না।

এ উপলব্ধি সকলেরই  কখনও না কখনও হয়, কাজেই সকলেই জানে উপলব্ধিটা একটুও আরামদায়ক নয়। আরামদায়ক নয় বলেই অধিকাংশ লোক হাওয়া সামান্য ঘুরলেই দৌড়ে এ সত্যের থেকে দূরে যেতে চায়। বেঁচে থাকা যে শেষমেশ আনন্দের এ আশ্বাসের জন্য হাঁকপাঁক করে। মানুষের ওপর আশা রাখার আরামের জন্য লালায়িত হয়। আইলিন আর ব্র্যাট সেটা করে না। ওরা কষ্টটার মধ্যে থাকে, শখ করে নয়, থাকে কারণ জানে কষ্টটাই সত্যি, কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই। জেলখানার অফিসঘরে বসে আইলিন, চব্বিশ বছরের আইলিন, যে বয়সের আমিকে 'অ্যাডাল্ট' বলতে আজকাল বাধে আমার, জীবনের মানে খুঁজে পায়।

". . . one long sentence of waiting out the clock.”

আইলিন বলে,

"Those people with perfect houses are simply obsessed with death. A house that is so well maintained, furnished with good-looking furniture of high quality, decorated tastefully, everything in its place, becomes a living tomb.”

আইলিন মানুষ চেনার টোটকা দেয়।

“It’s easy to tell the dirtiest minds—look for the cleanest fingernails.”

আইলিন প্রেমে পড়ে। জেলখানাতেই চাকরি করা একটি যুবকের। সে ছেলে সুঠাম, রূপবান, চৌকস। আইলিন যে এ পৃথিবীর মাটিতে হেঁটে চলে বেড়ায় সে তথ্যটাও ছেলের রাডারে নেই। থাকার কথাই ছিল না। আইলিন সেটা জানে। জেনেও খোঁড়া পক্ষিরাজে চড়ে ছেলেটার বাড়ির সামনে গিয়ে বসে থাকে অগোচরে। খুব যে যন্ত্রণায় দীর্ণ হয় বোধ হয় না। উল্টে যন্ত্রণা পাছে কম পড়ে সেই আশঙ্কাতেই যেন অভিযানে বেরোনোর আগে থেমে, জামাকাপড় সরিয়ে আয়নায় নিজের অপ্রতুল স্তনের দিকে তাকিয়ে চট করে একবার শিহরিত হয়ে নেয়।

ব্র্যাটের আকাঙ্ক্ষার পুরুষ বারংবার বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি না, আমাকে আর ফোন করবে না। ব্র্যাটকে ছেড়ে সে মাঝবয়সী এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করে। (গল্পের শেষে আমরা জানতে পারি তারা ইয়োরোপে মধুচন্দ্রিমায়।) ব্র্যাট দমে না। ফোন করে হুমকি দেয়। এক্ষুনি এসে সেক্স না করলে সে আত্মহত্যা করবে। ছেলেটি আসে, প্রেমহীন সঙ্গম সেরে, "এই শেষ," বলে প্যান্টের জিপ টেনে বেরিয়ে যায়। দরজা দিয়ে, চিপ্সের প্যাকেট খুলে ব্র্যাট টিভির সামনে বসে।

কতশত অবান্তর ইন্সিকিওরিটি আর অকারণ ইনডিগনিটির মধ্যে দিয়ে নিজেদের ছেঁচড়ানোর স্মৃতি পাঠকের মনে আসে। তৎকালীন গ্লানি, পড়ে থাকা অনুতাপ। আইলিনকে এবং ব্র্যাটকে দেখে বিস্ময় জাগে। কী করে পারে? এমন অবলীলায় এই সব গ্লানিটানি হ্যান্ডল করতে? সে কেন এখনও পারে না? এখনও কবেকার সে সব গ্লানির স্মৃতিরা এসে এখনও তাকে অস্থির করে?

কারণ এগুলোকে সে স্বাভাবিক বলে মানেনি। বয়সে ছোট হলেও আইলিন এবং ব্র্যাট অলরেডি বুঝে ফেলেছে যে জীবন হল ইনসিকিওরিটি এবং ইনডিগনিটির মিছিল। কাজেই এগুলোকে দূরে না ঠেলে আলিঙ্গন করাই বুদ্ধিমানের।

বিশ্বাস করতে অসুবিধে হতে পারে, কিন্তু আইলিন এবং ব্র্যাটের গল্প আসলে ফিল গুড এবং রিলেটেবল।  হয়তো সেই কারণেই মশফেঘের এই দুটি উপন্যাস এত বাজারসফল। ফিল গুডের পয়েন্টে পরে আসছি, রিলেটেবিলিটিটা বলে নিই। আইলিন এবং ব্র্যাট দুজনেই পালানোর কথা ভাবে। জেলখানার অফিসঘরে বসে আইলিন ভাবে উনিশশো চৌষট্টি সালে, ব্রাউনস্টোনে বসে ব্র্যাট ভাবে দু'হাজার আঠেরোয়, দু'হাজার তেইশেও পৃথিবীর কোনও না কোনও কোণায় বসে কেউ না কেউ পালানোর কথা ভাবছে। "আই অ্যাম ডান" বলে উঠে হাত ঝেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা বারংবার চালিয়ে দেখছে মাথার ভেতর। বেঁচে থাকা বা বেঁচে থেকে যেতে হওয়ার মধ্যে, এক না একদিন ঠিক হিমালয়ে চলে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার থেকে বেশি সত্যি, বেশি রিলেটেবল মানুষের জীবনে আর কিছু থাকবে না কোনওদিন।

পালানো অর্থ এখানে আক্ষরিক নয়। আইলিন শুধু জেলখানার চাকরিটা থেকে পালাতে চাইছে না, বাবার খপ্পর থেকে পালাতে চাইছে না, ব্র্যাটের লক্ষ্যটাও কেবলমাত্র রেবার টক্সিক সঙ্গ বা অশনবসনব্যসনে লেপটে থাকা দিনগত পাপক্ষয় থেকে মুক্তিলাভ না। মশফেঘের নায়িকাদের অ্যাম্বিশন অনেক বেশি। 

দুজনেই চাইছে নিজের নিজের জীবনটা থেকে পালাতে। টোটাল ওভারহল। আইলিনের চাওয়াটায় তীব্রতা আছে কিন্তু বাঁধন কম। পালাতে একদিন হবেই সেটা জানে, কিন্তু কীভাবে, কোথায়, কার সঙ্গে ইত্যাদি লজিস্টিক্স ধোঁয়া ধোঁয়া। ষাটটা বছর এগিয়ে আসার জন্যই হোক বা টাকাকড়ি, রূপ, কলম্বিয়াটলম্বিয়া মিলিয়ে ব্র্যাট আইলিনের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, প্রোঅ্যাকটিভ। 

ব্র্যাট উপায় বার করে ফেলে।

জীবন কীসে বদলায়? কখন বদলায়? কে বদলায়? দারা পুত্র পরিবারের ক্ষমতা নেই, প্রেম ঘৃণা ঈর্ষারও না, ঠেকে শেখাটেখা ওভাররেটেড। টুকটাক ঠুকপালিশের জন্য পয়লা জানুয়ারির রেসলিউশন ঠিক আছে, তার থেকে বেশি কিছু চাইলে, স্থায়ী কিংবা আমূল, একজনেরই দ্বারস্থ হতে হবে। নবজন্ম মানুষকে একজনই দিতে পারে।

মৃত্যু।

কিন্তু ব্র্যাট বুদ্ধিমান, মৃত্যুর ঝামেলাটা সম্পর্কে অচেতন নয়। ওপারে কী আছে কে জানে, হয়তো নতুন জীবন হল না, মরেঝরে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল। ব্র্যাট নবজন্ম চায়। নতুন জন্মটা দেখে, ছুঁয়ে, চেটেপুটে প্রত্যক্ষ করতে চায়, একেবারে মরে যাওয়া ওর উদ্দেশ্য নয়।

একেবারে মরে না গিয়ে মৃত্যুর সবথেকে কাছাকাছি কীভাবে যাওয়া যায়? নাইনের অংক ক্লাসে এই প্রসঙ্গটা কীভাবে উঠেছিল এখন কল্পনায় আঁটছে না। র-দিদিভাই বলেছিলেন, প্রতিদিন আটঘণ্টার জন্য আমরা মনুষ্যেতর যোনি প্রাপ্ত হই। দিদিভাইয়ের মতে মানুষকে মানুষ করে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারা, যেটা ঘুমের মধ্যে অসম্ভব। ঘুমোলে আমাদের শরীরটা দলা পাকিয়ে যায়, আমরা আর মানুষ থাকি না। ঘুরিয়ে বললে, জ্যান্ত থাকি না।

“Sleep felt productive. Something was getting sorted out. I knew in my heart—this was, perhaps, the only thing my heart knew back then—that when I'd slept enough, I'd be okay. I'd be renewed, reborn. I would be a whole new person, every one of my cells regenerated enough times that the old cells were just distant, foggy memories. My past life would be but a dream, and I could start over without regrets, bolstered by the bliss and serenity that I would have accumulated in my year of rest and relaxation.”

ব্র্যাট ঠিক করে, এক বছর ধরে ঘুমোবে। বাড়ি ভর্তি প্রেসক্রিপশন ড্রাগস, মুঠো মুঠো খেয়ে। একলপ্তে বাহাত্তর ঘণ্টা ঘুম। বাহাত্তর ঘণ্টা পর উঠে সে পিৎজা, যা বন্ধু রান্নাঘরে রেখে গেছে, খাবে। জামাকাপড় ছেড়ে নতুন সেট জামাকাপড়, যা বন্ধু লন্ড্রি করে রেখে গেছে, পরবে। বন্ধুকে মুচলেকা দিইয়ে নেয় ব্র্যাট, ব্র্যাটকে জাগানোর বা ব্র্যাটের সঙ্গে কোনওরকম ইন্টারঅ্যাকশন করার চেষ্টা সে করবে না। 

এইখানে গিয়ে মশফেঘের গল্প  রিলেটেবিলিটি থেকে সব থেকে দূরে লাফ দেয়। কারণ বাস্তবে বেঁচে থেকে নবজন্ম হয় না। জীবন ভোল পালটায় না। কেবল শুঁয়োপোকারাই পারে প্রজাপতি হতে, মানুষ পারে না। এইখানে মশফেঘের গল্প চূড়ান্ত ফিল গুড হয়ে ওঠে কারণ আইলিন আর ব্র্যাট দুজনেই প্রজাপতি হয়ে যায়। এক বর্ষণমুখর রাতে আইলিন বেরিয়ে পড়ে। চিলেকোঠার ঘর ছেড়ে, বাড়িভর্তি পর্ন ম্যাগাজিন ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে, শহর ছেড়ে এবং শহরের বাইরে বেরিয়ে তার আত্মার আত্মীয় গাড়িটি পর্যন্ত ছেড়ে, পূর্বাশ্রমের শেষ খোলসটি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করে।

বছর ঘোরে, ব্র্যাটের ঘুম ভাঙে। এই ঘুম ভাঙার মুহূর্তটি পাঠকজীবনের অন্ত পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। এই মুহূর্তটিতে মশফেঘ আবারও কান ধরে আমাকে নতজানু করেন।

কারণ প্রজাপতি হই না হই, ছোটখাটো কিছু রং তো বদলায় জীবনের এদিকওদিক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি বদলগুলো ঘটে আমাদের অচেতনে, অবহেলায়। আমাদের যে টুপি পরানো হয় যে জীবন বদলাতে একটা মাধ্যমিকের মার্কশিট লাগে, কিংবা একটা নতুন গাড়ির চাবি, বা নতুন ফ্ল্যাটের দেওয়াল-গড়ানো স্বস্তিকার হলুদ কুমকুম, প্রথম দেখার মুহূর্ত কিংবা শেষ ফোন নামিয়ে রাখার, সত্যিটা হচ্ছে ওগুলো সব ইভেন্ট, যারা আমাকে ভাঙবে কী, নিজেদের গুরুত্বের ভারে নিজেরাই টলমল। সত্যিকারের ভাঙন যখন ঘটে, যদি ঘটে অ্যাট অল, সেটা হয়তো কোনও জুলাই মাসের বেলা তিনটে, যখন দু'শো উনিশের জানালা দিয়ে এম জি রোডের জ্যামের দিকে তাকিয়ে আছি।

মশফেঘ সেটা জানেন। তাই ব্র্যাটের ঘুম ভাঙান একটি ন্যাড়াবোঁচা মুহূর্তে। সুনামির বেগে ছুটে চলা একটি আখ্যানে (প্লটবিহীন গল্পের এই রিডেবিলিটি আমি কম দেখেছি) ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষেন। ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে বসা পাঠকের চোখের সামনে মুহূর্তটিকে উন্মোচিত করেন, যাবতীয় অকিঞ্চিৎকরতার মহিমায়, তুচ্ছতার তীব্রতায়। ব্র্যাটের নবজন্ম ঘটে। মুহূর্ত জীবনভর হয়।

আইরিনও পালাতে পারে। শেষের দুটি পাতার কোনও একখানে আমরা জানতে পারি সে একটা বর জুটিয়েছে। নিজের নতুন জীবনের বর্ণনায় আইলিন বলে, “Here is how I spend my days now. I live in a beautiful place. I sleep in a beautiful bed. I eat beautiful food. I go for walks through beautiful places.”

এত আকাঙ্ক্ষার নবজন্মের জন্য একটিমাত্র প্যারা? সারাজীবনের স্বপ্নপূরণের বর্ণনায় একটিমাত্র জ্যালজেলে বিশেষণ? বিস্ময়ের। আবার বিস্ময়েরও কি? আইলিনের নতুন জন্মের হাবভাব, রকমসকম, ভাবভঙ্গি আমাদের চেনা। দিবারাত্র ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে, ব্লগে, বিয়েবাড়িতে, আধচেনা ডাইনিং টেবিলের চারধারে, নিজেদের বেডরুমে সে সব জীবনেরা প্যারেড করছে। এক প্যারাগ্রাফের থেকে বেশি আর কীই বা লেখার থাকে এ সব জীবনদের নিয়ে?

যাবতীয় মহার্ঘ আসবাব, অলংকরণ বিদায় করে, গুডউইল থেকে সস্তার এবড়োখেবড়ো চেয়ারটেবিল চৌকি কিনে এনে বাড়ি সাজায় ব্র্যাট। রেবাকে ডাক পাঠায়। ওয়ার্ডরোব খালি করে জামাকাপড়, সুগন্ধী দিয়ে দেয়। রেবা উত্তেজনায় কাঁপে। বারবার জিজ্ঞাসা করে, একেবারের মতো দিয়ে দিচ্ছ তো? মাইন্ড চেঞ্জ করবে না তো? নাকি এও তোমার একবছর ধরে ঘুমনোর মতো কোনও খেয়াল? রেবা ট্যাক্সিতে ওঠার আগের মুহূর্তে ব্র্যাট বলে, আই লাভ ইউ। লুটের মাল সামলাতে ব্যস্ত রেবা উত্তর দেয় না। ট্যাক্সিতে উঠে চলে যায়।

চরিত্রকে কেন্দ্রে লেখার একটা সুবিধে হচ্ছে, ভালো করে লিখতে পারলে প্লট ফুরোলেও চরিত্রগুলো ফুরোয় না। বাস্তব জীবনের মতোই। অধিকাংশ পরিচিতিই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে শুরু এবং শেষ হয়, কেউ কেউ ঘটনাক্রম অতিক্রম করেও থেকে যায়। আইলিন আর ব্র্যাটের গল্প ফুরোয়। কিন্তু মশফেঘের এই দুই মেয়েকে আমি ভুলতে পারি না। চলতে ফিরতে ব্র্যাটকে ভাবি। কী করছে? সবথেকে বেশি দেখি একটি দৃশ্য। এন ওয়াই সি-র একটি অগোছালো পার্কে কিংবা অপরিচ্ছন্ন রাস্তায় কিংবা তকতকে নদীপারের একটি বেঞ্চে বসে আছে। ঘুম ছুটে যাওয়া একটি আশ্চর্য মেয়ে, উদ্ভট মানুষ। পা ঘিরে ঘুরছে বদমেজাজি পায়রার দল। টনটনে জাগরণ নিয়ে সে শুষে নিচ্ছে এই অর্থহীন পৃথিবীটাকে। আইলিনকে দেখি। বয়স্ক আইলিন। গম্ভীর আইলিন। একটি বিউটিফুল জীবনের বিউটিফুল জেলখানায় বসে যে মন দিয়ে, নিখুঁত করে নিজের নখ কাটছে।

Comments

  1. বই দুটোর একটাও পড়িনি, তবে যেরকম প্রশংসা করলেন, এক্সপেকটেশন আগেই অনেক বেশি হয়ে গেলো!

    আর - "ব্র্যাট"? বেচারি গল্পের মেয়েটি, জানতেও পারলো না তার কি নামকরণ হয়ে গেলো! তবে নামটা চমৎকার হয়েছ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এক্সপেকটেশন বেড়ে যাওয়া অবশ্য ভয়ের, রাজর্ষি। আমার খুব ভালো লেগেছে পড়ে, শুধু এটুকুই বলছি।

      Delete
  2. Ei boi duto konodin pora hobe kina janina, Tobe tomar abantor thekei sondhan paoa kudrat rangibirangi porchi ekhon :)

    ReplyDelete
  3. Somehow ei post ta miss hoye gechilo.. duto boi e poRte hobei.. thanks for sharing.

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. পড়ে দেখতে পারেন, ভালো লাগতে পারে, ইন্দ্রাণী।

      Delete

Post a Comment