চোদ্দ বছরে


একটা বাচ্চা জন্মে অ্যালজেব্রায় পৌঁছে যায়, ইলিয়াডের যুদ্ধ শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়, সীতা কিডন্যাপ হয়ে ফিরে আসেন।

ব্লগবয়সের চোদ্দ বছর মানুষের হিসেবে কত? একশো চোদ্দটোদ্দ হবে। আমার সঙ্গে যাঁরা ব্লগ লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ক'জন আর ব্লগ লেখেন আমি শিওর নই। যাঁরা লিখছেন, প্রাণভরে লিখছেন। অন্য কোনও সবুজতর প্রান্তরে।

সে প্রান্তরে তাঁদের মুভ করার সিদ্ধান্ত বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করার দরকার নেই। ট্রেন আবিষ্কার হলে কেউ গরুর গাড়ি চড়ে না। ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হলে কেউ তালপাতার পুঁথি বগলে নিয়ে ঘোরে না। লেখকরা (যদি সাহস করে ব্লগারদের লেখক বলার সাহস দেখাই-ই) অন্য মাধ্যমে সরে গেছেন যেখানে পাঠক আছেন। পাঠকরা সেই মাধ্যমে সরে গেছেন যেখানে লেখক আছেন।

আমি অবান্তরে ঝাণ্ডা গেড়ে বসে আছি। ফুটফলস কমতে কমতে শ্মশানের সন্নাটা, আইবলস নিভতে নিভতে অমাবস্যার অন্ধকার। আমাকে ভুল প্রমাণ করার বা আশ্বাস দেওয়ার দরকার নেই। ব্লগস্পটে স্ট্যাটস বলে একটা ব্যাপার আছে। সত্যিটা আমি জানি।

সরতে পারিনি। সরতে পারি না বলে নয়। কোনও ব্যক্তি, নীতি, আদর্শের সঙ্গে লেগে থাকার বদভ্যেস আমার ছিল না কোনওদিন। হয়তো সেই চমকটাই আমাকে সরতে দেয়নি। যে আমি জানুয়ারির সাত তারিখ পৌঁছতে না পৌঁছতে রেজলিউশন ছেড়ে দিই, একটা রুমাল তিনদিক সেলাই করে নামিয়ে রাখি, সেই আমি চোদ্দ বছর ধরে একটা ব্লগ লিখলাম কী করে?

এবং শুধু লিখিনি, মন দিয়ে লিখেছি। বাইরে থেকে দেখে টের না পাওয়া যেতে পারে, বা আমি আনস্মার্ট কর্মী হতে পারি, কিন্তু এ কথা সত্যিই বলে বোঝানো অসম্ভব, অবান্তর আমার কতখানি এনার্জি এবং পরিশ্রম অধিকার করে রাখে। জীবনে আর কিছুর পেছনে এত পরিশ্রম করিনি গত চোদ্দ বছর ধরে যত অবান্তর লিখতে করছি। অবান্তরকে ফাঁকি দেওয়ার কল্পনাও মাথায় আসেনি। চোদ্দ বছর কেটে যাওয়ার পরও অবান্তরের প্রতিটি পোস্ট লিখতে আমি সমান পরিশ্রম, সমান সময় দিই।

না দিলেও চলত। দৌড়তই হয়তো। কারণ এমন তো নয় যে এই সময়টায় আমার অন্য কিছু করার নেই। কাজের কাজ যদি নাও করি, অন্য লেখালিখি নিয়েও ঘষটানো যেত। অনেস্ট বন্ধুরা স্পষ্টই বলেছে, ব্লগ বোরিং। পড়তে ভালো লাগে না। গল্পউপন্যাস লিখিস তো চেষ্টা করে দেখতে পারি।

চেষ্টা করছি না একেবারে তা নয়। আরও করা যেত। এই এখন অবান্তর না লিখে গল্প লেখা যেত। হয়ত আরও কয়েকজন বেশি লোক সেই গল্পগুলো পড়ত। কাল একটা গল্প জমা দিতে হবে। ফিফটি পার সেন্ট লেখা বাকি। কী হবে কে জানে।

তবু অবান্তরই লিখছি। তবু অবান্তর লিখব। কেন, সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। আর ভাবি না। প্রশ্ন না করার সংযম দেখালে উত্তর আপনি এসে সামনে দাঁড়ায়। অবান্তর টিঁকে গেছে কারণ এই একটা কাজ আমি সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে, নিজের জন্য করেছি। কেউ আমাকে কাজটা করতে বলেনি, কোনও রিটার্নের মুখ চেয়ে আমি কাজটা করিনি।

সেই জন্যই রিটার্ন পেয়েছি। কী রিটার্ন সেটা সর্বসমক্ষে বলার দরকার নেই। আমি জানে আর জানে অবান্তর। সে জানা আমাদের দুজনের মধ্যেই থাক।

অনেকদিন পর্যন্ত অ্যাকটিভলি কল্পনা করতাম, অবান্তরের শেষ পোস্টটা কবে, কখন লিখব। লেখার সময় মনের ভাব কেমন হবে। ছোটবেলায় মা বকলে যেমন কল্পনা করতাম এই যে আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করব, অনেক অনেক বছর পর আবার যদি কোনওদিন দুজনের দেখা হয় (এই অনেক অনেক বছর মা কোথায় যাবেন, আমিই বা কোথায় যাব, সে সব লজিস্টিকস বোরিং) তখন আমার মনের ভাব, মায়ের মনের ভাব কেমন হবে, অনেকটা সেই রকম।

হ্যাপি বার্থডে, অবান্তর। পরের চোদ্দর জন্য হাঁটা শুরু করা যাক।

Comments

  1. বোধহয় একদিন অফিসে কাজ না করে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে আপনার ব্লগটা খুঁজে পেয়েছিলাম। দেখে যাতা খুশি হয়েছিলাম, একসাথে এত লেখার ভান্ডার, সবচেয়ে বড় কথা, ভালো লেখার। তারপর থেকে পেছনে গিয়ে গিয়ে শুরু অবধি সব কটা পোস্ট শেষ করেছি, বোধহয় মাস দেড়েক লেগেছিল।
    সেটা 2014 বা 2015..
    তারপর থেকে রোজের ফোন ঘাঁটার সময় নিয়মিত উঁকি ..বাকি নিয়মিত-র লিস্ট বদলাতে থেকেছে, কিন্তু অবান্তর আছে নিজের জায়গায়।
    হসপিটালে থাকতে হয়েছিলো কদিন, তখনও সকাল বিকেল উঁকি মেরে নতুন পোস্ট খুঁজতাম।
    এখনও ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে প্রথম হোয়াটসঅ্যাপ আর তারপর নিউজ আর অবান্তর...

    আপনি খুব বড় লেখক হোন এটাই চাই, কিন্তু আপনার অবান্তর মোটেই অবান্তর নয়।
    চোদ্দো থেকে চল্লিশ হোক।
    হ্যাপি বার্থডে, অবান্তর।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, বৈজয়ন্তী। ভালো লাগল।

      Delete
  2. ¨তবু অবান্তরই লিখছি। তবু অবান্তর লিখব।" - এই লাইন টা খুব আশ্বস্ত করলো।
    সঙ্গে আছি কুন্তলা , তোমার লেখার আকর্ষণে আরও চোদ্দ বছর থাকবো।
    তবে ব্লগ চালানো সত্যি খুব থ্যাংকলেস একটা উদ্যোগ - নিজেও সেটা হাড়েহাড়ে বুঝেছি !

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ চাওয়ার জায়গাই নেই, কাকলি। যা করেছি, করছি, নিজের জন্য। বাকিটুকু উপরি।

      Delete
  3. অনেক শুভেচ্ছা অবান্তরের জন্মদিনে- অবান্তরের গরুর গাড়িই যেন চলে আরো চোদ্দ বছর | দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো অবান্তরের শেষ পোস্টের কথা পড়ে | পুরোটা পড়ে নিশ্চিন্ত হলাম | আরো অনেক অনেক লেখো - তোমার লেখা তুলনাহীন|

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, অমিতা। অবান্তর চালাতে নিজের পরিশ্রমের কথা সাতখান করে বললাম, আমি এটা মন থেকে বলছি, আপনাদের কয়েকজনের অবান্তরের প্রতি এই অটল ভালোবাসা আমাকে বিস্মিত করে। সত্যি বিস্মিত করে। কৃতজ্ঞও।

      থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. শুধুমাত্র অবান্তরের জন্য ব্লগস্পট এ এখনো আসি। অনিয়মিত হয়ে গেছি, বহুদিন কমেন্ট করিনা, তবু আসি। পুরোনো পোষ্ট পড়ি, একই রকম হাসতে থাকি, বাড়ির পোষ্টগুলো পড়তে গিয়ে প্রবাসী বাঙালি হয়ে যাওয়া আমার ও গলার কাছটা একই রকম ধরে আসে। ভালো থাকবেন কুন্তলা দি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ময়ূরী।

      Delete
  5. Amrao achi Kuntala. Tomar lekha prothom porechilam ISI-te, kon shaal mone nei, but 2016r age to botei. Asha ekhon komeche, satyi i. besh kichu post porao hoy na. comment to karai hoy na, tobu amra achi. majhe majhe eshe dekhe jai, pori. purono post refer kori, khuje pori, kono kono lekha khujeo pai na. Berate jaoa, dilli te khaoa emon jinish er jonyo to ashi i, emnio `golpo gacha' porte ashi. Abantor amar jiboner shatheo otoproto bhabe jorito.
    By the way, amar r amar bhaier modhye `biryani-cha' shobdota besh popular -- tomar lekhatei paoa.

    Comment post kara jachhilo na.

    Bhalo theko.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি একটু ভয়ে ভয়েই ছিলাম, যে এই পোস্টটা হাজিরা নেওয়ার মতো হয়ে যাবে। সে জন্য কমেন্ট অফ করে রেখেছিলাম। পরের পোস্ট করে তারপর কমেন্ট খুলেছি।

      এটাই স্বাভাবিক। এই ধরণের ব্লগে দীর্ঘসময় ধরে উপস্থিতি ধরে রাখা, নেক্সট টু ইমপসিবল। কাজেই আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। একসময় নিয়মিত আসতেন সেটা অনেক, এখনও মাঝে মাঝে আসেন সেটাও অনেকই। আমি নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করি।

      আপনারাও ভালো থাকবেন। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  6. Apnar blog 2015 theke porchi. Prothom jokhon khuje pelam roj bose ekdom prothom theke chapano lekha gulo o pore felechi.
    Apnar lekar frequency ta jokhon besi chilo roj e ekbar kore blog e ese ghure jetam. Ekhon sotti bolte roj asa hoina kintu jokhon asi sobkota notun post ekbare pore feli. 14 yr hoe gelo sune sotti nostalgic hoe gelam, blog er madhyome apnar jiboner Nana poriborton jante perechi, sei songe nijer jiboner sob odhyay gulo o mone pore gelo ek jholok. Ha eta sotti ekhon blog er theke fb tei lekhar vir o pathoker vir besi. Tobu ei blog amar onek diner sathi, eka eka lunch er somoy amake eka lagte deini. Valo thakben.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুহানি।

      Delete

Post a Comment