জয়পুর ৫ঃ বেগুনি হাতি, বান্টা, কুমার শানু



আমের প্যালেস ঘোরা শেষ, অরিজিন্যাল ই রিকশা দাদা একবার ফোন করে ফেলেছেন, কিন্তু রামসিংজী ছাড়বেন না, আরেকটা জায়গায় যেতে হবে। সমস্ত টুরিস্ট স্পটের একচেটিয়া, শপিং পয়েন্ট। সকলেই বলেন, কিনতে হবে না, শুধু দেখবেন।

তিনতলা দোকানের বাইরে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটল। এক ভদ্রলোক ব্লক প্রিন্টিং করে দেখালেন। সে অসামান্য ব্যাপার। শাকপাতা থেকে নিষ্কাশিত সবুজ রঙে ব্লক চুবিয়ে কাপড়ে চেপে ধরে হাতির বর্ডার আঁকলেন। তারপর আরেকটা ব্লক ফুলটুল থেকে নিষ্কাশিত বেগুনি রঙে চুবিয়ে সাবধানে আগের হাতির শুঁড়ে শুঁড় আর ল্যাজে ল্যাজ মিলিয়ে চেপে ধরতেই সবুজ আউটলাইনের ভেতর বেগুনি বডিওয়ালা হাতি রেডি। তারপর গোটা কাপড়টা আরেকটা কী জলে চুবোলেন, ব্যাকগ্রাউন্ড রং হয়ে গেল। একঘণ্টা শুকিয়ে চুবোলে নাকি রং আরও বেশি ফুটত। দেখেশুনে এমন হাহাকার হল। এই কাজটা কেউ আমাকে করতে দাও গো। কিচ্ছু চাইব না, ঘ্যানঘ্যান করব না, খালি এককোণে বসে রঙে ব্লক চুবোব আর হলুদ সবুজ গোলাপি বেগুনি হাতি আঁকব। 

লিফটে করে ক’তলায় যেন গেলাম। ওঁরা এত কিছু দেখাতে চাইলেন, বেডকভার, ওয়াল হ্যাংগিং, পেখমমেলা ময়ূর, আমার কুর্তি, অর্চিষ্মানের শার্ট। আমরা বললাম, টেইম নেই টেইম নেই, বলে ছুটে চললাম। সত্যিটা হচ্ছে, এত সাধাসাধির উত্তরে না করার মতো চরিত্রের জোর আমার নেই। কিনতেই যদি হয় এমন একটা কিছু কিনতে হবে যা অ্যাকচুয়ালি কাজে লাগবে। ময়ূর আর ওয়াল হ্যাংগিং ওখানেই বাদ। জামাকাপড় পরতেই হয়, কাজেই কুর্তাই বেস্ট অপশন। অর্চিষ্মান কিছুতেই শার্টের জন্য ঘাড় পাতল না। ভদ্রলোক বললেন, কী মাপের? বললাম, কেন আমার? ভদ্রলোক দেড় সেকেন্ডে সম্পূর্ণ নন-ক্রিপি ভাবে আমাকে আপাদমস্তক মেপে চেঁচালেন, অমুক নম্বরওয়ালা বান্ডিল নিকাল।

কুর্তার ঢিপি কাউন্টারে আছড়ে পড়ল। ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে, এইটা দেখুন, বলে প্যাকেট খুলতে যাচ্ছিলেন, আটকালাম। জাস্ট বাণ্ডিলটা ছড়িয়ে রাখুন। রাখলেন। আমি মাথার ভেতর দ্রুত আপনবাপনচৌকিচাপন খেলে একটা সবুজ আর একটা তুঁতে কুর্তার পলিথিন তুলে নিয়ে বললাম, প্যাক করুন প্লিজ। বলে নিজেরাই চেক আউট কাউন্টারের দিকে দৌড়লাম। এদিক ওদিক থেকে বেডকভার, ময়ূর, পাথরের প্রলোভন ছিটকে ছিটকে এল, কান দিলাম না। দাম দেওয়ার সময়ও থামিনি সম্ভবতঃ, জায়গায় দাঁড়িয়ে জগিং করছিলাম। প্যাকেট হাতে পেয়ে আবার দৌড় শুরু হল। উজ্জ্বল আলোকিত কানাগলির মধ্য দিয়ে ভিডিওগেমের মতো আমরা দৌড়ে চললাম, একজায়গায় গিয়ে নো এক্সিট, আবার উল্টো পথে দৌড় দৌড়, লিফটে ঢুকে গ্রাউন্ড ফ্লোর টিপতে যাব, একী আপনি কে, সেকেন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপছেন কেন, কারণ এখানে আছে বিশ্বের নিখুঁততম তাজমহলের রেপ্লিকা, তাই বুঝি, কী আর করা, নেমে বাঁ দিকে বেঁকে দূরে কাচের ঘরের মধ্যে তাজমহলের রেপ্লিকা, নিখুঁতই বটে কিন্তু ততক্ষণে উচ্চকিত হতে শুরু করেছে পাথর আর গ্রহরত্নের সেলস পিচ, আবার উল্টোপথে ছুট ছুট, কী মুশকিল লিফটটা আসে না কেন, এসে গেছে, টিং শব্দে দরজা খুলে গেছে, ঢুকে পাগলের মতো ডোর ক্লোজ-এর ত্রিভুজ টিপছি, একটা গলা চিৎকার করে বলছে, ম্যাডাম, ফ্রি মে হাথ দিখানা থা কেয়া?

দোকানের বাইরে গাছের নিচে গজল্লা করছিলেন, রামসিংজীর পাওনা চুকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে আমের প্যালেসের পর্ব শেষ হল। এবার আমাদের রিকশা ভাইসাবকে খুঁজে বার করতে হবে, কিন্তু তার আগে ঠাণ্ডা, জলীয় কিছু ভেতরে ঢালা দরকার। দিল্লিতেও অসভ্য গরমের সঙ্গে ডিল করি বছর বছর, কিন্তু রাজস্থানী রোদের ব্যাপার আলাদা। সেই যে একটা অ্যাড হত, সূর্য মাথার ভেতর স্ট্র দিয়ে সব এনার্জি শুষে নিচ্ছে, সেই রকম ব্যাপার। প্যালেসের গেটের বাইরে মসালা ছাস মরুভূমিতে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অদৃশ্য হয়েছে।

এমন সময় ফট্‌। ঘাড় ঘোরানোরও আগে চিনেছি। এবং হাঁটতে শুরু করেছি। অর্চিষ্মানেরও চোখে পড়েছে ততক্ষণে। আরে, বান্টা পাওয়া যাচ্ছে, বলতে বলতে ও-ও খুশি হয়ে দৌড়ল আমার পাশে পাশে। ই-রিকশা ভাইসাবও বান্টালাভার। সবাই মিলে বান্টা খাওয়া হল। বান্টা আমার ক্ষেত্রে অনেকটা ফুচকার মতো। জীবনে এমন কোনও বান্টার দেখা পাইনি, যার সঙ্গে আলাপ বাড়াতে ইচ্ছে হয়নি। ভালোমন্দ ইমমেটেরিয়াল। যদিও এই বান্টাটি ফার্স্টক্লাস ছিল। ভালোমন্দের বাছ না করলেও ভালোমন্দের বিচার আমার আছে। অনেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ মশলা, টপিং ইত্যাদি দেন, সেগুলো অবান্তর বলেই মনে করি। বেসিক যে মশলাটি ব্যবহার হয় ক্ল্যাসিক বান্টায়, সেটাই বেস্ট। বান্টা খেয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু হল।


জলমহলে থামা হল। নাহারগড়ের ছায়াছায়া পাহাড়ের পাহারায়, মান সাগর লেকের মাঝখানে অপূর্ব এক প্রাসাদ। ভাইসাবের সকালের সতর্কতাবাণী সত্যি। জলটা প্যাথেটিক নোংরা। গন্ধ বেরোচ্ছে। খোঁজ নিলাম বোটিং হয় কি না, হয় না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম। লাঞ্চের সময় হয়েছে, লাঞ্চ হয়নি। হওয়ানোর ইচ্ছেও নেই। ওই গরম আর ওই রোদে খাওয়ার কথা মাথাতেও আসছে না। আরেক গ্লাস করে বান্টা খাওয়া যাক। রাজস্থানে সর্বত্র বান্টা। এই বান্টাটাও ভালো তো বটেই, সমস্যাটা যা বললাম, বাহার বেশি। কী একটা লংকাবাটা মতো মিশিয়েছিলেন ভদ্রলোক। খারাপ না, জাস্ট বাহুল্য। এঁর বোতল খোলার পদ্ধতিটা আগে দেখিনি। একটা হাওয়া বার করা সাইকেলের টায়ারের টিউবের মতো জিনিস বোতলের মুখে চেপে ধরলেন, চোঁওওও শব্দ হল, ফট করে বোতল খুলে গেল।

হোটেল ফিরে স্নান সারলাম। বেশিক্ষণ নিজেদের সময় দেওয়ার ইচ্ছে নেই, কারণ এখন ঘুমোলে ঘুমিয়েই পড়ব। চা বলা হল, এল না। আমরা আশাও করছিলাম না, জাস্ট যেটা ঘটছে সত্যিই ঘটছে কিনা সেটা কনফার্ম করার জন্যই অর্ডার দেওয়া। তারপর ‘চল বেরোনো যাক’ বলে বিছানা থেকে নিজেদের ছিঁড়ে তুলে বেরিয়ে ফেললাম। গন্তব্য গতকালের কিউরিয়াস লাইফ ক্যাফে। ঘণ্টাতিনেক থেকে আবার একটু বেরোনোর ইচ্ছে আছে। অর্চিষ্মানের বান্টা হজম হয়ে গিয়েছিল বোধহয়, বলল, ক্যাফের উল্টোদিকে ওই দোকানটায় যাবে?

কোন দোকানটা?

অর্চিষ্মান মনে করাল। কফিশপের পাড়াটা আমাদের চমৎকার লেগেছিল। গতকাল অটো থেকে নেমে দোকানে ঢোকার আগে হেঁটে হেঁটে একটু এদিকওদিক গিয়েছিলাম। তখনই বেকারিটা চোখে পড়েছিল। বিরাট ছড়ানো বারান্দার ওপারে নর্ম্যাল একটা বাড়ি। নাম জয়পুর বেকারি না কী যেন । বাইরেটা এত কম চকচকে যে ভরসা জাগে ভেতরটা নিশ্চয় দুর্দান্ত হবে। ভেতরটাও খোলামেলা। যা বুঝলাম, পাড়ার পুরোনো দোকান। অর্চিষ্মান একটা পেস্ট্রি আর একটা চিকেন না মাটন প্যাটিস নিল, আমি ভেজ প্যাটিস। বাড়ির জন্য চিজ পাফ, কুকিস নেওয়া হল। বোকার মতো ব্যাকপ্যাকে পুরে আনতে গিয়ে অধিকাংশই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, যাকগে নিজেরাই খেয়েছি, অসুবিধে হয়নি। খেয়েটেয়ে ক্যাফেতে ঢুকে পড়লাম।

ফিরে আসার পর একদিন অর্চিষ্মান টুইটার থেকে দম নেওয়ার জন্য মাথা তুলে বলল, বরুণ গ্রোভারও জয়পুরে বেড়াতে গিয়ে তিনটে জায়গায় গেছে,বুঝলে। অমুক জায়গা, তমুক জায়গা আর কিউরিয়াস লাইফ ক্যাফে। বলেই আবার ভুস করে ডুবে গেল। ক্যাফেটা সত্যি ভালো, আমার কথা বিশ্বাস না হলে বরুণ গ্রোভার সাক্ষী। যাই হোক, ক্যাফেতে বসে কাজ শুরু করার আগে ইউটিউব দেখছি, অর্চিষ্মান ঝুঁকে পড়ে বলতে লাগল, একজন টুইটার সেলেব নাকি আমাদের পাশের টেবিলে এসে বসেছেন। চমৎকার সব ওক জোক লেখেন, পড়ে অর্চিষ্মান গড়াগড়ি খেয়ে হাসে। আমি বললাম, যাও গিয়ে বল যে আপনার কনটেন্ট আমার ভালো লাগে, তাতে অর্চিষ্মান এমন মুখ করল যেন প্যারাশুট ছাড়া প্লেন থেকে লাফাতে বলেছি।

খিদে ছিল না। বোর হয়ে মাশরুম ব্রুশকেটা অর্ডার করলাম। আমার ভালো লাগল, অর্চিষ্মান একেবারে মুগ্ধ। পাঁচটা দিয়েছিল। দুটো খেয়ে ভীষণ বেশি অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। আমিও দুটো খেলাম। খেয়ে বললাম, লাস্টেরটা তুমি খেয়ে নাও, আমি খেলে আমার পেট ফেটে যাবে। সব কথা এত বাড়িয়ে বল কেন দেখি, বলে খুব আরাম করে তিন নম্বরটা খেল অর্চিষ্মান। বলল, বাড়ি এসে নাকি বানাবে।

সন্ধে পেরিয়ে গেল। আমাদের ইচ্ছে অ্যালবার্ট মিউজিয়ামটা দেখার, যাতায়াতের পথে দেখেছি, অপূর্ব বিল্ডিং। ভেতরটাও ভালোই হবে নিশ্চয়। কিন্তু ক্লান্ত লাগছিল। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, থাক। টুকটাক খেয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।

অর্চিষ্মানের সম্পত কচুরিতে খাওয়ার খুব শখ। ইউটিউবে অনুভব সাপরার দিল্লি ফুড ওয়াকস চ্যানেলে দেখেছি। সম্পতে আরও ভ্যারাইটির কচুরি ভাজা হয় নিশ্চয়, কিন্তু বিখ্যাত হচ্ছে 'বিনা ছিলকে কা আলু'র কচুরি। সম্পতের দোকান একেবারে  বিশুদ্ধ গলির ভেতর। গলির মুখে অটো ছেড়ে দিলাম। বাকি পথটুকু হেঁটে যাব। হাঁটা শুরু করে মিনিট পাঁচেক পরেই এমন একটা জিনিস চোখে পড়ল যেটার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম।

পাতাসি। আমার বাকেট লিস্টে আছে, ফুচকার একশো আট রূপ না দেখে মরব না। জয়পুরে ফুচকা ভজিত হন পাতাসি নামে। দেখতেশুনতে, খেতে দিল্লির পানিপুরির মতোই। ইউটিউবে জয়পুরের বিখ্যাত পাতাসিওয়ালাদের স্টল দেখেছি। একজনকে ভীষণ মনে ধরেছিল। তাঁর ফুচকা দুই ভ্যারাইটির। এস পি = স্পাইসি ফুচকা। ডি এস পি = ডেঞ্জারাস স্পাইসি ফুচকা। আমাদের যা ভাবগতিক, ডি এস পি-র পিছু ধাওয়া করার এনার্জি হবে না। কাজেই নর্ম্যাল স্পাইসিই হোক। ফুচকা মন্দ হলেও খাই, কিন্তু এঁরটা যে ভালো হবে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ মহিলা ক্লায়েন্টেলের উপস্থিতি। চেহারা বলে দিচ্ছে, স্থানীয় মহিলা। রোজ বাড়ি ফেরার পথে খেয়ে ফেরেন। ফুচকার কোয়ালিটির আলটিমেট সার্টিফিকেট।

এঁর ভালোত্বের আরও প্রমাণ পাওয়া গেল। ফুচকাওয়ালাদের কাছ থেকে আমি কখনওই শুকনো চাই না। চেনারা তো আপসেই দেন, ইনি অচেনা হয়েও নিজে থেকেই দিলেন। এটা ওঁর মহত্ব তো বটেই, একটু কলার তুলেই বলছি ফুচকা কনজিউমার হিসেবে আমার কোয়ালিটির সার্টিফিকেটও। অভিজ্ঞতায় দেখেছি যদি খদ্দের সজ্জন হয়, ফুচকাওয়ালারা যেচে ফাউ শুকনো অফার করেন। আমার একটা গুপ্ত গর্বের জায়গা হচ্ছে আজ পর্যন্ত সমস্ত অচেনা ফুচকাওয়ালাই আমাকে ওই ফাউটি অফার করেছেন। যেদিন করবেন না বুঝব আমার তরফ থেকে খামতি হয়েছে।

ফুচকা খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সরু গলি। দু’পাশে বাড়ি, বন্ধ দোকান। বড় রাস্তার আলো পেছনে পড়ে। গলির ভেতরে দূরে দূরে টিমটিমে ল্যাম্পপোস্ট। ভারতবর্ষের শহরের এই চরিত্রটা বারবার দেখেছি। একটা বোম্বেটে, জমজমাট রাজপথের দশ হাতের মধ্যে একেবারে নিভন্ত গলি। সম্পতের দোকান বেসিক্যালি হোল ইন দ্য ওয়াল। কিন্তু লক্ষণ ভালো, প্রচুর লোক্যাল লোক। সন্ধেবেলার ভাজাভুজি খেতে এসেছেন। রাজস্থানীদের একবস্তা বেসন আর একগঙ্গা তেল দিলে ওঁরা বিশ্বজয় করে আসতে পারেন। প্রকাণ্ড লোহার কড়াইয়ে তেলের সমুদ্রে ভাজা হচ্ছে রোগা গাঠিয়া, মোটা গাঠিয়া, রোগা সেউ, মোটা সেউ, প্লেন বুঁদি, মসালা বুঁদি, আরও পঞ্চান্ন রকম জিনিস। আমরা (অ্যাকচুয়ালি অর্চিষ্মান, কারণ আমি সত্যিই ফাটো ফাটো) এ সব খাব না। অর্চিষ্মান খাবে কচুরি।

এখানে কথাটা বললে মনে হবে আমি পার্টিকুলারলি সম্পতের ভদ্রলোকদের সম্পর্কে বিষোদ্গার করছি, কিন্তু সে রকম না। আমরা গোমড়ামোতে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভাঙতে পারি। হেসে কথা বলা তো অনেক দূর, আমরা আই কনট্যাক্ট করি না, আমাদের এনার্জি মাটির তলা দিয়ে বয়। খুব স্মার্ট লোক হলে হয়তো গিয়ে ধাঁইধপাধপ এই দিন সেই দিন বলে দিত, আমরা সেই টাইপ নই, কেউ আমাদের দিকে মুখ তুলে, কী চাই, জানতে চাইলে কনফিডেন্স পাই। দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, এমন নয় যে ভিড়। একজন ভাজছেন, একজন ফোন দেখছেন। 'ভাইসাব' 'ভাইসাব' ডাকলাম। প্রথমবার বেশি মৃদু হয়ে গিয়েছিল বোধহয়, নো সাড়া। আবার ডাকতে সাড়া পাওয়া গেল। আলুর কচুরি পাওয়া যাবে জানতে চাইলে ঘাড়টা কোনদিকে নড়ল, আদৌ নড়ল কি না, বুঝতে পারলাম না। আলোর কথা না বলাই ভালো। আমি যদিও ওঁর ব্যবসার ব্যালেন্সশিট দেখিনি, কিন্তু আরেকটা বাল্ব লাগাতে অসুবিধে হত না বলেই মনে হয় না। আমি সত্যি বুঝতে পারছিলাম না কচুরি পাওয়া যাবে কি না, অর্চিষ্মান দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ছেঁড়া কাগজের টুকরোতে চড়ে একখানা কচুরি এসে উপস্থিত হল। অর্চিষ্মান খেল, আমি একটু ভেঙে মুখে দিলাম।

কচুরি ভালোই। কিন্তু সত্যি বলছি, যদি আরেকটু আলো জ্বলত, আচ্ছা আলোটালো যদি ছেড়েও নিই, যদি ভদ্রলোক আমাদের মুখের দিকে তাকানো বা আমাদের প্রশ্নের বোধগম্য উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতেন, তাহলে ওই কচুরিটাই মিনিমাম দেড়গুণ বেটার খেতে লাগত। ততক্ষণে আরও খদ্দেররা আসছেন যাচ্ছেন, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে না। চেনা ক্রেতাবিক্রেতার নর্ম্যাল সম্ভাষণটুকু পর্যন্ত না। এটা শুধু জয়পুরের ওই পার্টিকুলার গলিতে ওই মুহূর্তে ঘটছে সেটা নয়। সর্বত্র এ জিনিস ঘটে। কারও মুখে হাসি নেই, এনার্জি নেই, আগ্রহ নেই, কারও কিছু যায় আসে না।

অর্চিষ্মান বলে, অচেনা লোক দেখলে দাঁত বার করাটা অ্যামেরিকান ফ্রেন্ডলিনেস। ওই দিয়ে এখানকার বিচার কোর না। কথা বাড়াই না, কিন্তু আমার সন্দেহ ব্যাপারটা এত গুরুতর না। সমস্যাটা অনেক ঠুনকো। বেসিক্যালি, আমরা ডিফেন্সিভ। আন্ডারকনফিডেন্ট। হাসব, যদি ধার চায়? ধার চাইলে যে হেসেই না করে দেওয়া যায়, এটা শিখিনি।

যাকগে, হয়তো বেশি ভেবে ফেলেছি। সম্পত খুবই নামী দোকান। প্রচুর ভ্যারাইটি। সেটা আরেকটা অসুবিধে। ওই ধরণের দোকানে তো সব আইটেম আলাদা আলাদা জায়গায় রেখে প্রপার লেবেলিং করা হয় না, অত বহ্বারম্ভের দরকারও নেই, অন্ততঃ যদি অ্যাটিচিউডটা এমন করে রাখেন যাতে কোনটা কী জিজ্ঞাসা করতে তোতলাতে না হয়, সেটাই এনাফ।

সবাইকে ভাজাভুজি কিনতে দেখে আমাদেরও ইচ্ছে হল। কী নেব কী নেব ভাবছি। কর্তৃপক্ষের থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝে কাউন্টারের এদিকে মনোনিবেশ করলাম। সবাই খুব বুঁদি কিনছিলেন দেখলাম। মসালা বুঁদি কেজি কেজি বিক্রি হচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে শিওর রায়তায় ঢালবেন। সে নিয়ে আমরা কী করব। অপেক্ষার ফল ফলল, একজন একটা স্কুটিতে চড়ে এসে ব্যাজার মুখে বললেন, মিক্স দো কেজি। কান খাড়া, চোখ সরু করলাম। যিনি ভাজছিলেন, ভাজা থামিয়ে অনেকটা গাঠিয়া, অনেকটা সেউ, অনেকটা বুঁদি, আরও আমাদের নাম না জানা কী সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা বস্তা বেঁধে ভদ্রলোককে দিলেন, স্কুটি ভটভটিয়ে রওনা দিল। আমরা লাফিয়ে পড়ে বললাম, ওই যে উনি যেটা নিলেন আমরাও নেব। ভাজিয়ে বললেন, কিতনা? একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি, তখন একটি রেয়ার মানবিক স্পর্শে ভদ্রলোক নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে একটা মাপমতো ঠোঙায় সব মিলিয়েমিশিয়ে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, এত টাকা দিন।

হাঁটতে শুরু করলাম। হাতে গুগল ম্যাপ। দুপাশে চেপে এসেছে বসতবাটি। এ পাড়া মধ্যবিত্ত, কাজেই দুটো বাড়ির মধ্যে কোনও ফাঁক নেই, বাগান যা কিছু ব্যালকনির টবে। তবু বাহারের দরজা, আর দরজার সামনে রক। সেই রকে জটলা করছেন পাড়ার সিনিয়র সিটিজেন মহিলারা, পাশে ওয়াকার রাখা। উল্টোদিক থেকে আসা গরুকে সাইড দিতে রকগুলো আমাদেরও কাজে লাগছিল। গরু নিরাপদ দূরত্বে এগিয়ে গেলে আবার হাঁটা শুরু করছিলাম। হাতে গুগল ম্যাপ, অন্ধকার গলিতে বাজছে, ‘অব তেরে বিন, জি লেঙ্গে হাম’। যেন আর কোনও অপশন আছে।

একেবারে অন্ধের মতো হাঁটছিলাম না। উদ্দেশ্য ছিল। লস্যিওয়ালা। জয়পুরের বিখ্যাত লস্যির দোকান। এবং সম্ভবতঃ সবথেকে বেশি টুকলি হওয়া দোকানও বটে। সেটার জন্য দোকানের নাম খানিকটা দায়ী কি? মানে লস্যিওয়ালা নাম রাখলে আর কীই বা আশা করা যেতে পারে? সবাই লিখেছে অরিজিন্যাল দোকান এম আই রোডের ৩১২ নম্বর দোকান, সেটাই টার্গেট করে এগোচ্ছিলাম। সে দোকান বন্ধ বেরোলো। অসুবিধে নেই, পাশে অন্ততঃ চারটে ‘লস্যিওয়ালা’ নামের দোকান গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজনের থেকেই লস্যি অর্ডার করা হল। একটাই, কারণ তখন লস্যি খেলে আমার সত্যি ফেটে যাওয়ার চান্স ছিল।  লস্যিতে চুমুক দিয়ে, দেড় সেকেন্ড থেমে, সাধাসাধি না করে গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিল অর্চিষ্মান। বুঝলাম, সিরিয়াস। চুমুক দিলাম। ভালো বটে। তবু খাব না। কারণ, তবলা মাস্টারমশাই বলতেন, ভালোর একটুই ভালো। অর্চিষ্মান পর পর দু’গ্লাস খেল। তারপর আমরা উবার অটো ধরে হোটেলে ফিরে এলাম।



Comments

  1. Oi beguni haathi ta amio dekhechhilam. ekdom oibhabei. oi dokaan (jeta shob autowala/guide ra daabi kore shob jochhorder maajhe ekmatro khati dokaan) shekhane amrao gechhilam. chokkhulojja katate na pere bed cover kinechhilam. bikreta dabi korechhilen ote naaki thandar shomoy gorom aar goromer shomoy thanda laagbe...ta hobe hoyto.
    oi dokaane chomotkaar jyotishi , jini binamulye tomaar bhobishyot bole deben. tarpor tumi taar suggest kora pathor ta porbe ki porbe na tomaar byapaar. tini amaake dekhei bolechhilen je amaar jeebon er sreshto shomoy cholchhe , ebong cholbe. ekebaare sunishchit korte sudhu ektu pathor boshano angti nilei hobe. sheta niyi ni bolai bahulyo. tobe tar porer koek maash ki ki holo sheta bhodro lok ke bole ele kharap hoto na.

    tomaar khabaar gulo shei bhabe explore kora hoyni. ekhon kolkata chole eshechhi tai. pore abaar kokhono gele dekhbo

    aar lekha ta 2-3 baar pore tobe Kumar Sanu ke khuje pelam. protomei pawa uchit chhilo jodio

    ReplyDelete
    Replies
    1. লাস্ট লাইনটা পড়ে হাসছি। উল্লেখটা সূক্ষ্ম হয়েছে জেনে খুশি হয়েছি। আমি তো তেমন খাবার এক্সপ্লোর করিনি, সব রান অফ দ্য মিল। আরও কত খাওয়াদাওয়া করার আছে জয়পুরে।

      এই চক্ষুলজ্জাতেই মরলাম আমরা। যদিও বেডকভারটা ভালো চয়েস। ওই একটা জিনিস, কাজে লেগেই যায়। আমার কুর্তাদুটোও ভালো কেনা হয়েছে। ভদ্রলোকের স্কিল আছে বলতে হবে, এরকম ফিট আমার কোনও জামা করে না।

      কলকাতায় চলে গেছ শুনে নজর দিলাম। আমি যে কবে যাব।

      Delete
  2. এই প্রথম আপনার লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়ে চিন্তিত হলাম, চাপ নিলাম।
    শপিং পয়েন্টের অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে একদম হরর স্টোরি।
    দোকানে গিয়ে পরিমান বোঝানোর কাজটা অবশ্য আমি খুব ভালো করে থাকি। হাত দিয়ে দেখিয়ে দিই, 'এই এতটা মতো হবে, এরম ওজনের জিনিস দিন' বা ওনাদেরকেই দেখিয়ে দিতে বলি, ২০০গ্রাম কি ১০০ গ্রাম কতটা মতো হবে।
    বান্টা কখনো খাইনি, কিন্তু মাঝে মধ্যে সাউথের লাইনের ট্রেনে শিয়ালদা যাবার সময়, ফট ফট করে বোতল খুলতে দেখে খুব লোভ হয়েছে। বাবার বকুনির ভয়ে কখনো খেয়ে দেখিনি।
    নেক্সট বার খাবো.. খাবই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সোনারপুরে মাসির বাড়ি যেতে গিয়ে ওই ফট শব্দ আমিও প্রথমবার শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, বৈজয়ন্তী। আমিও খাইনি। আমার বান্টা খাওয়া প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে।

      আপনার মাপ দেখানোর পদ্ধতিটা চমৎকার। অ্যাপ্লাই করে দেখব।

      খুব একটা হরর স্টোরি কিন্তু ছিল না শপিং-এর অভিজ্ঞতা। আমি একটু রং চড়িয়েছি বোধহয়। সব জায়গায় যেমন হয় তেমনই ছিল।

      Delete
  3. Jomati lekha. Khub anando pelam Kuntala.

    ReplyDelete
  4. চমৎকার ঘুরেছ। তবে এবারে তোমাদের খানিক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে মনে হচ্ছে। বান্টা ব্যপারটা কি? ছাঁস টাইপ কিছু?
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. এবার তো কফি শপে কাজ করলাম আর অটো চড়ে এদিকওদিক গেলাম। দৌড়ঝাঁপের ঠিক উল্টোটা।

      বান্টা হচ্ছে মশলা সোডা।

      Delete

Post a Comment