মেমেন্টো মোরিঃ শারদীয়া কৃত্তিবাস ১৪৩০


অন্যেরা উপন্যাস কেমন করে লেখেন তো জানি না, আমি কোনওদিন লিখলে কেমন করে লিখব সে নিয়ে একটা কপোলকল্পনা ছিল। অনেক ফেঁদেটেদে। সাড়ে বেয়াল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা পেঁয়াজরসুন দিয়ে কষিয়ে। যত মনের কথা উগরে, যত গায়ের ঝাল ঝেড়ে।

তারপর মে মাস নাগাদ একদিন শৈলেন, প্রতিভাসের কৃত্তিবাসের শৈলেন সরকার, ফোন করে বললেন, উপন্যাস লেখেন?

বললাম, রোজই ভাবি লিখব লিখব। শৈলেন বললেন, আর না ভেবে লিখে ফেলুন। অল্প লোভ আর অনেক ভয় হল। লোভ কারণ আমার কল্পনায় উপন্যাস লেখা একটা রোমহর্ষক ব্যাপার। ভয় কারণ এত কঠিং কাজ শিওর আমার দ্বারা হবে না।

তারপর শৈলেন অ্যাকচুয়াল হাসির কথাটা বললেন। কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের একটা শারদীয়া উপন্যাস লিখতে হবে। আপনাকে সময় দেওয়া হবে দেড়মাস। অর্থাৎ কি না ছয় সপ্তাহ।

জয়পুর ভ্রমণের একটা দু'হাজার শব্দের পর্ব নামাতে আমার লাগে সাতদিন। তাও ডাল কচুরি খেলাম না পেঁয়াজ কচুরি, কফি খেলাম না লস্যি, কোন অটোভাইসাব আমাকে কী দাগা দিলেন-এর ফিরিস্তি। যদি সেই স্পিডেও লিখি, আর যদি শব্দসীমার লোয়ার লিমিটও ধরি, কুড়ি হাজার শব্দ স্রেফ টাইপ করতেই আমার লেগে যাবে দশ সপ্তাহ। তারপর ধরুন গল্পে তো কুন্তলা সকালবেলা দু'নম্বর মার্কেটে গিয়ে দাদুর কচুরি আর অন্নপূর্ণার বোঁদে খাচ্ছে লেখা যাবে না, কিছু চরিত্র আকাশ থেকে পেড়ে আনতে হবে। তাদের প্রেমভালোবাসা, ল্যাং, প্রতিশোধ ভাবতে হবে। টাইপ করতে হবে। কাটপেস্ট করতে গিয়ে আদৌ পেস্ট হল কিনা, নাকি দু'বার পেস্ট হয়ে গেল চেক করতে হবে। মোটামুটি ছ'মাস থেকে ন'মাসের ধাক্কা।

রাজি হয়ে গেলাম।

পরদিন সকালে উঠে লিখতে বসলাম। মাথার মধ্যে একটা গল্পের হালকা ছায়া ছিল, সেটাকেই বাড়াব। ওয়ার্ড লিমিট সেট করলাম। রোজ এত শব্দ আর গল্পের এতখানি করে লিখব। মেন্টেন করতে পারলাম না। দুয়েকদিন লেখা কমপ্লিটলি বাদ পড়ল। লেগে রইলাম। অবশেষে একেকটা দিন ওয়ার্ড লিমিট পার হয়ে যেতে শুরু হল। একটা ভিন্ন টাইমফ্রেমে গল্পটা ফেললাম। পঞ্চাশ সালে মেয়েরা কী ঘড়ি পরে কলেজে যেত এইসব আজাইরা প্রশ্ন করে ইন্দ্রাণী, তিলকমামা, দিদিমণিকে ব্যতিব্যস্ত করলাম।

চার সপ্তাহ দু'দিন পার করে তিনদিনের দিন ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলারও আগে টের পেলাম হচ্ছে না। আমার না-দেখা সময়ে গল্প ফেলে উতরোনো, এই সময়সীমায়, আমার ক্যালিবারের লেখকের কর্ম না। গল্প এনে ফেললাম এক্স্যাক্টলি আমার সমসময়ে। ষোল হাজার শব্দ ফেলে দিলাম। যা লেখা হয়েছিল তার হাজারচারেক বাঁচানো গেল, বাকি ষোল (অ্যাকচুয়ালি, আরও বেশি কারণ এডিট করতে বসে বাদ পড়বে) আমাকে দেড় সপ্তাহে লিখতে হবে।

একজন প্রফেসর বলেছিলেন, যে কোনও ফিল্ড সার্ভেতে, প্যানেল ডিসকাশনে, ইন্টারভিউতে, ফোকাস গ্রুপে, একটা প্রশ্ন তিনি করেনই। হোয়াট সারপ্রাইজড ইউ? লিট রিভিউ লিখতে গিয়ে, হেঁটে হেঁটে জঙ্গল থেকে স্যাম্পল কালেক্ট করতে গিয়ে, ডেটাকে হুলা হুপের মধ্য দিয়ে ছোটাতে গিয়ে হোয়াট সারপ্রাইজড ইউ?

জীবনের প্রথম উপন্যাস (ডিসক্লেমার আসছে) সম্পূর্ণ করতে গিয়ে ওই মুহূর্তটা আমার সবথেকে বিস্ময় ও সারপ্রাইজের। এই যে প্রায় শেষ ল্যাপে গিয়ে আমি ওই অ্যামাউন্টের শব্দ ফেলে দিয়ে গল্পটা নতুন করে লিখতে শুরু করলাম, ডেডলাইনে কাজ শেষ করা নিয়ে নিজের ওপর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না থাকা সত্ত্বেও, আমি একটুও ভয় পেলাম না। কেন পেলাম না তাও জানি। কারণ ভয় পাওয়ার আমার সময় ছিল না।

ডেডলাইন আমি মেন্টেন করতে পারিনি। এক সপ্তাহ পেছোতে হয়েছিল। বলা বাহুল্য, আমি নভিস লেখক, প্রবেশনে ছিলাম। অর্থাৎ, যদিও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই লেখার প্রস্তাব এসেছিল, লেখা রিজেশনের অধিকার তাঁরা নিজেদের কাছে রেখেছিলেন।

সেটাও আরেকটা বিস্ময়। অত তেড়েফুঁড়ে লিখেছিলাম বলেই বোধহয় মুভ অন করে যাওয়া সারপ্রাইজিংলি সোজা হয়েছিল। অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে কখনওসখনও লেখাটা উঁকি দিত। যদি অ্যাকসেপ্টেড হয়েই যায়? একদিন সন্ধেবেলা সিলেক্ট সিটি ওয়াকের এসক্যালেটরে পা রাখব, ফোন বাজল। অ্যাকসেপ্টেড।

অভিনন্দনটন্দন, কেয়া বাত, দ্যাখালে বটে-র ধার দিয়ে গেল না অর্চিষ্মান। খাওয়াও বলে নিকটবর্তী স্টারবাকসে ঢুকে পড়ল। গিজগিজে ভিড়, কিন্তু একদম কর্নারের দুজনের বসার একটা টেবিল খালি পেয়ে গেলাম। অর্ডার দেওয়ার লাইন কাটার চেষ্টা করল একটা বান্ধবীওয়ালা ছেলে, বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছি না টের পেয়ে লাস্ট মোমেন্টে 'পহেলে আপ' বলে কোমর ঝুঁকিয়ে সরে দাঁড়াল।  মনে পড়ল, এই স্টারবাকসটার জায়গায় অনেক বছর আগে কফি বিন অ্যান্ড টি লিভস্‌-এর শাখা ছিল। অর্চিষ্মানের কাঁধের ওপর দিকে মলের বাইরের দিকের যে কাচের দেওয়াল, তার পাশের সিটটায় মায়ের সঙ্গে বসে কত কফি আর অমলেট আর স্যান্ডউইচ খেয়েছি। মা শুনলে খুশি হত?

অর্চিষ্মান প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে, ট্যাটু করালে কী ট্যাটু করাব। ট্যাটু আমি কোনওদিন করাব না। আহা, যদি কেউ মাথায় বন্দুক ধরে? তাহলে প্রজাপতি না, চাঁদের ষোলকলা না, অর্চিষ্মানের অ তো মেরে ফেললেও না। ইয়েস, নো, ব্রিদও না। লিখলে একহাতের কবজির কাছে লিখে রাখব মেমেন্টো মোরি। রিমেমবার, ইউ উইল ডাই। অন্য হাতে আমোর ফাতি। লাভ অফ ফেট।

ট্যাটু করাইনি। কিন্তু প্রথম উপন্যাসের নাম 'মেমেন্টো মোরি' রেখেছি। ব্যাপারটা 'হাই ভোল্টেজ স্পার্ক' লেভেলের হচ্ছে কি না সে নিয়ে বুকধুকপুক ছিল এবং গোড়াতে কর্তৃপক্ষের একাংশ নামটা নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিলেন। পালটাতে বললে পালটাতেই হত। স্রেফ নাম পছন্দমতো দিতে পারলাম না বলে উপন্যাস কুরবানি দিয়ে দেওয়ার কনভিকশন বা কমিটমেন্ট আমার নেই। তারপর কর্তৃপক্ষের আরেক তরফ থেকে গ্রিন সিগন্যাল এসে গেল। যাক বাবা। এবার জীবনের শেষ উপন্যাসের নাম 'আমোর ফাতি' রেখে মরতে পারলেই বেশ বলিউডি অন্ত হবে।

উপন্যাস উপন্যাস বলছি বটে, লেখাটা উপন্যাস ক্যাটেগরির আন্ডারেই পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু আমি কি সত্যিই উপন্যাস লিখেছি? একুশ হাজার শব্দের একটা লেখা কি উপন্যাস হতে পারে? ইংরিজি সাহিত্যের বাজারে, যেটা আমি ধরে নিচ্ছি আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সবথেকে বড় বাজার, হারগিজ না। পঞ্চাশ হাজার না পেরোলে নো উপন্যাস, পঞ্চাশ হাজারও বেয়ার মিনিমাম, আশি হাজার হলে মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা কিছু দাঁড়িয়েছে ধরে নেওয়া যায়। কাজেই আমি একটা বড় গল্প বা বিরাট বড় ছোটগল্প লিখেছি। সত্যিকারের উপন্যাস, স্যাডলি, আমি এখনও লিখে উঠতে পারিনি।

ঘাবড়াচ্ছি না। এখনও লিখিনি, কপালে থাকলে লিখে ফেলব। এটাও যেমন লিখে ফেললাম। কেমন লিখেছি সে নিয়ে অত মাথা ঘামাচ্ছি না। এক, পাঠকের বিচারে ভালোমন্দ আমার হাতে নেই, দুই, আজ থেকে বছরখানেক পরে, ইন ফ্যাক্ট, এখনই লেখাটা আবার নিজে পড়লে 'ধরণী দ্বিধা হও' মনে হবে সেও গ্যারান্টি। যত ভুল, যত ইন্ডালজেন্স ছিটকে ছিটকে গুলির মতো চোখে এসে বিঁধবে। মনে হবে যে যে লেখাটা পড়েছে বা লেখাটার দিকে দৃকপাত পর্যন্ত করেছে, একটা ন্যাতাবালতি নিয়ে তাদের দৃষ্টি এবং স্মৃতি থেকে লেখাটার যাবতীয় অস্তিত্ব ঘষে ঘষে মুছে ফেলি।

কিন্তু এই সত্যিটা তখনও সত্যি থাকবে, যে, যে সময়ে আমি লেখাটা লিখেছিলাম, সেই সময়ের আমি, ওই সময় ও পরিস্থিতির সমস্ত সুবিধে, অসুবিধে, সীমাবদ্ধতা নিয়ে আবার লিখতে বসলে এটাই লিখত। ওই কুন্তলার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ছিল, সে সবটা দিয়েছে।

শুধু গায়ের ঝালটা মনের মতো ঝাড়া হয়নি। সেটার জন্য আরেকটা উপন্যাসের অ্যাটেম্পট নিতে হবে মনে হচ্ছে।

পত্রিকাটি কিনে পড়তে চাইলে লিংক নিচে রইল।

শারদীয়া কৃত্তিবাস ১৪৩০ 



Comments

  1. অভিনন্দন আর শুভকামনা - পাঠকসমাদৃত হোক।
    ব‍্যতিব‍্যস্ত হ‌ইনি একেবারেই। সামান্য খোঁজখবর নিতে গিয়ে পুরনো দিনের গল্প শুনেছি বরং, কিছু স্মৃতির ওপর জমা ধুলো বা মরচে সাফ হয়েছে। লাভ‌ই হয়েছে।
    উপন্যাসের বিজ্ঞাপন দেখে বাজি ধরেছি বন্ধুর সঙ্গে- ঘড়ির প্রশ্নটা এই উপন্যাস সম্পর্কিত। বন্ধু এই ঘড়ি সার্ভেতে ডাটা যুগিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম, উত্তর জানতে সেই মাস ডিসেম্বর।

    পড়ার অপেক্ষায় আছি। অধীর আগ্রহে যাকে বলে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঘড়ি সার্ভেই বটে। আপনার মতামতের জন্য আমার আগ্রহও অধীর।

      Delete
  2. ei আজাইরা প্রশ্ন maane ki go?
    Memento Mory (naki mori) naam aar taar maane ta pochhondo holo. Tobe tattoo koraar shahosh hobe bole mone hoy na, amaar dour borojor Whatsapp-er description obdhi
    naam ta shune Bombyx Mori-r kota-o money porlo

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঢাকাইয়া ভাষায় এই ব্লগটার নামই 'আজাইরা'। অর্থাৎ যা অবান্তর। হাবিজাবি। পয়েন্টলেস।

      মেমেন্টো মোরি সকালবিকেল জপতে পারলে কাজে দেয়, অর্পণ। জীবনের ওঠাপড়াগুলো সত্যিই গায়ে লাগার পক্ষে হাস্যকররকম তুচ্ছ লাগে। না না, ট্যাটু ইজ টু মাচ কমিটমেন্ট। করার পরমুহূর্ত থেকে আফসোস হবে কেন করলাম।

      Delete
  3. Memento mori aar amor fati shune ryan haliday r video kichu mone poRlo.. stoicism o holo na.. tattoo toh holoi na.. oboshyo bhaijhi dot pen, sketch pen, acrylic pen, maay fountain pen diye sara gaaye bimurto chobi aankte prochondo agrohi.

    khub khub khub bhalo laglo khobor shune. onek congratulations.. sharodiya kine phelbo.. aaro onek onek likhun..

    jaipur er lekhatao daarun hoyechilo.. oi somoyei amader benaras jawa cancel holo, baRishuddho proti protyek e osustho hoye.. sei dukkhe ekebaarei mujjhyoman hoyechilam.. anyway asche bochor aabar hobe.. na holeo onyo kichu hobe..

    khub bhalo thakben.

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার ইন-হাউস ট্যাটু আর্টিস্টের ওপর খুবই নজর দিলাম, ইন্দ্রাণী। এ রকম শিল্পী বাড়িতে থাকা প্রিভিলেজ। আমাদেরও বাড়িতে এখন সবার, মানে দুজনেরই অসুখ। ভাগ্যিস কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল না। শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনিও খুব ভালো থাকবেন।

      Delete
  4. অনেক অনেক অনেএএএএএএএক অভিনন্দন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😊থ্যাংক ইউ, মিজানুর।

      Delete
  5. খুব ভালো খবর, অনেক অভিনন্দন !! দেখি, পড়া হয় কিনা।

    অনেক ছোটবেলায়, ফেলুদা পড়ে গোয়েন্দা উপন্যাস (হ্যাঁ, গল্প নয়, সোজা উপন্যাস) লেখার শখ হয়েছিল একবার। চরিত্রদের মধ্যে ডায়ালগ ব্যবহার করিয়ে ছোট ডায়েরির পাঁচ-ছয় পাতা ভরিয়েছিলাম, গোয়েন্দার কাছে একজন ক্লায়েন্টও আনিয়েছিলাম, ব্যাস ওই অবধি। ওটাই সবচেয়ে বেশি প্রগ্রেস আমার জীবনের গল্প লেখা নিয়ে। তারপর আর হয়নি। "প্লটের অভাব" বলি। (অ্যাস ইফ প্লট পেলেই অনবদ্য উপন্যাস লিখে ফেলবো!)

    ReplyDelete
    Replies
    1. সোজা উপন্যাস বলে নিজেকে ঠাট্টা করবেন না রাজর্ষি। বহু সাহিত্যিকই জীবনে একটাও ছোটগল্প না লিখে একের পর এক উপন্যাস লিখে গেছেন। ছোটগল্প দিয়ে শুরু করা অ্যাকচুয়ালি কনফিডেন্স কম থাকার লক্ষণ।

      Delete
  6. অনেক অনেক অভিনন্দন। কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে যা জীবনে যখনই মনে পড়ে একটা আনন্দ দিয়ে যায়। এই উপন্যাসটা (আমি উপন্যাসই বলছি) শেষ করতে পারা, অ্যাক্সেপ্টেড হওয়াটা সেরকম একটা মুহূর্ত।
    এবার তোমার টার্গেট শব্দসংখ্যার উপন্যাস লেখো এই কামনা রইলো।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  7. বাহ, প্রতি বছর আসুক উপন্যাস

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটা আবার বাড়াবাড়ি হতে পারে।

      Delete

Post a Comment