জয়পুর ৬ (শেষ): জ্যামিতিবাক্স ও যন্তরমন্তর


সকালে উঠে যথারীতি অসামান্য ভালো ব্যবহারের সঙ্গে চা পেলাম। হয় দুপুরবেলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সেট অফ কর্মীরা আর টি ডি সি গনগৌরের দখল নেন, নয়তো ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড কেস।

আজ শেষ দিন। বিকেল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে আজমের শতাব্দী জয়পুর জংশনে ঢুকবে, আমাদের তুলে (যদি না অন্য ট্রেনে উঠে বসে থাকি) পাঁচটা পঞ্চাশে দিল্লির দিকে রওনা দেবে। যা করার তার আগে করে নিতে হবে।

শুরুতেই মিসঅ্যাডভেঞ্চার। চাঁদপোল বাজারের মিশ্র রাজাজি কা রাস্তায় মহাবীর রাবড়ি ভাণ্ডার। ইউটিউবে দেখেছি ইয়াবড় বেজারের রুটি আর আলুর তরকারি খাচ্ছে সবাই বসে, সঙ্গে রাজস্থানী কুইজিনের কাঁঠালিকলা, গোটাগোটা লংকার আচার। লাস্টে রাবড়ি। সকাল প'নে নটা নাগাদ পৌঁছে দেখি দোকানের ঝাঁপ ফেলা, বাইরে দাঁড়িয়ে একজন টুথব্রাশ চিবোচ্ছেন। সাড়ে এগারোটায় খুলবে। ধুত্তেরিকা বলে যন্তরমন্তরের দিকে এগোলাম। বেশি দূর না, হেঁটেই যাব।

এঁরা যে ব্যবসা করতে জানেন, ভালোবাসেন, বোঝা যায়। শহর জুড়ে বাজার। গমগমে, জমজমে। চৌমাথার এক কোণে ফুলের বাজার পেরিয়ে, একে একে খুলতে থাকা দোকানের সামনের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যন্তরমন্তরে পৌঁছলাম।টিকিটের দাম প্রণামীকাটিং। বাহান্ন টাকা, বেয়াল্লিশ টাকা, একষট্টি টাকা।

যন্তরমন্তর দেখলেই আমার মনে হয় দৈত্যদের জ্যামিতিবাক্স খুলে সব পড়ে গেছে। উপমাটা র‍্যান্ডম না। আমি আর সোমা দাস একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হয় বেশি আস্তে কিংবা বেশি জোরে হেঁটে ফেলেছিলাম। মোট কথা প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। আপনি যদি লোক্যাল ট্রেনে কখনও দীর্ঘ সময় ধরে যাতায়াত করে থাকেন জানবেন, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন ছেড়ে দেওয়া যায় না। এর সঙ্গে তাড়াহুড়োর সম্পর্ক নেই। আপনার গন্তব্যের উপযুক্ত একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি দুলকি চালে ভাবছেন এটা গেলে ক্ষতি নেই পরেরটা তো আসবে, এ অসম্ভব। টের পেয়েছিলাম প্রায় শৈশবেই। মা হাওড়া, আমি উত্তরপাড়া, কাজেই আমরা এক ট্রেনেই যেতাম। রবিকাকু লেভেল ক্রসিং-এর এপারে নামিয়ে দিতে না দিতে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকত এবং মা দৌড়তে শুরু করতেন। আমার ফিনফিনে কবজি চেপে ধরে। প্রথম প্রথম মিনমিনে গলায় চেঁচাতামও, ছুটছ কেন, এটা তো হরিপাল, আমাদের ব্যান্ডেল তো পরে আসবে।

মা পরে আফসোস করতেন। তোকে কত অত্যাচার করেছি সোনা। ওইটুকু মেয়েকে নিষ্ঠুরের মতো ছুটিয়েছি। সময়ের দাস না হয়ে সময়কে নিজের দাস বানানোর মূল্যবান শিক্ষা দিতে ফেল করেছি। মাকে বলতাম, আরে তুমি তো আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ছোটাওনি। মজা দেখানোর জন্যও না। তোমার ততদিনে ট্রেন দেখলেই ছুটতে শুরু করার কন্ডিশনিং হয়ে গেছে। ইউ ওয়্যার হেল্পলেস।

ঘটনার সময় আমার ক্লাস সিক্স, সোমা ক্লাস এইট, দুজনেরই কন্ডিশনিং সমাপ্ত। কাজেই ট্রেন দেখে দুজনেই দৌড়তে শুরু করলাম। ট্রেন ভোঁ দিয়ে দিয়েছে, দরজায় ঝুলন্ত ভিড় 'আরও জোরে, আরও জোরে' চেঁচাচ্ছে, এমন সময় ট্রেনের নাকের ডগায় পৌঁছে সোমার ব্যাগের খোলা চেন থেকে ক্যামেলের কমলাহলুদ জ্যামিতিবাক্স ছিটকে পড়ল। কাঁটা, কম্পাস, চাঁদা, সেট স্কোয়্যার, স্কেল, পেনসিল ছত্রাকার হয়ে গেল উত্তরপাড়া আপ প্ল্যাটফর্মে।

একটা গণ 'যাআআআহ'-এর ঢেউ উঠে মিলিয়ে গেল। সোমার মুখটা এখনও স্পষ্ট। চাকা বসে যাওয়ার পর কর্ণের মুখের কাছাকাছিই হবে। সোমা উবু হয়ে মালপত্র কুড়োতে শুরু করল, আমি দৌড়ে দৌড়ে অল্প দূরে গড়িয়ে যাওয়া পেনসিল রবারটবারগুলো কুড়িয়ে আনতে শুরু করলাম। কুড়োতে কুড়োতেই টের পেলাম, ট্রেনটা থেমে আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু ট্রেনের জালিকাটা জানালার ওপার থেকে একজোড়া চোখ আমাদের দেখছে। যেটা টের পাইনি সেটা হচ্ছে অত দয়ালু দৃষ্টি জীবনে খুব বেশি পড়বে না আমাদের ওপর। পলাতকেরা সব জ্যামিতিবাক্স বন্দী হল, সোমার ব্যাগের চেন বন্ধ হল, ঝুলন্ত কাকুজেঠুরা দরজা ছেড়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে রাস্তা খালি করে রেখেছিলেন, দৌড়ে প্রথম কামরার গেটের কাছে আসতেই, 'উঠে পড় কিচ্ছু হয়নি' টাইপের উৎসাহবাণী দিলেন। উঠে পড়লাম, ড্রাইভারের কামরা থেকে একজোড়া চোখ উঁকি মেরে ভেতরে ঢুকে গেল, ভোঁ বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।

যন্তরমন্তর দেখলেই আমার সেই ছত্রাকার জ্যামিতিবাক্স মনে পড়ে। তফাৎ শুধু বাক্সটা সোমার না, কোনও ছুটন্ত দৈত্যবালিকার। বাক্স খুলে কাঁটাকম্পাসগুলো এদিকসেদিক, সেট স্কোয়্যারটা উঁচিয়ে রয়েছে আকাশে। সে সব ছত্রাকার যন্ত্রপাতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে গলে গেলাম। অন্য সব জায়গায় গাইড না নিলেও একরকম, ঝাড়লন্ঠনের ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট না জানলেও তার সৌন্দর্য একই থাকে, কিন্তু এই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের টুলকিট কেউ না বুঝিয়ে দিলে কঠিন। তবু আমরা নিজেরাই ঘুরছিলাম। অর্চিষ্মান বোর্ড পড়ে, যন্ত্রপাতিগুলোর কর্মপদ্ধতি বোঝার এবং আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। আমি হাই তুলছিলাম। গাইডরা ব্যস্ত হয়ে দর্শনার্থীদের দল নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন। প্রায় চল্লিশ শতাংশ দর্শনার্থী বিদেশী। কারও কারও উত্তেজিত দৌড়োদৌড়ি দেখে কৌতূহলী হলাম। রহস্য উন্মোচন হল। রাশিচক্রের বারোটির নামে বারোটি থাম, সবাই দৌড়ে দৌড়ে নিজের নিজের জন্মরাশির থামের সামনে দাঁড়িয়ে, থাম জড়িয়ে, রাশির নামের প্লাকের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, এক পা হাওয়ায় তুলে, হাঁ করে উত্তেজনা বুঝিয়ে ছবি তুলছেন। বাজার অল্প খালি হলে আমরাও ছবি তুললাম, তবে অত শরীর বেঁকানোচোরানো বা মুখভঙ্গির কনফিডেন্স আমাদের নেই, আমাদের পোজ বলতে সোজা দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে অকওয়ার্ড হাসি। সে ছবি আর দেখাচ্ছি না।

অনতিদূরের দোকান থেকে দুটো মসালা শিকঞ্জি আর একটা ভেজ প্যাটিস কিনে বেঞ্চে বসা গেল।

বেড়াতে গিয়ে যে সবসময় পাঁচশো বছরের পুরোনো ইট কাঠ কংক্রিট কাচ সেরামিকের ভাঙাচোরা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই দেখতে হবে, সে রকম মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। মানুষও দেখা যায়। সমসাময়িক, সাধারণ মানুষ। কিচ্ছু কম এন্টারটেনিং না। উল্টোদিকের বেঞ্চে একটি রাজস্থানী ফ্যামিলি (খুব সম্ভব) এসে বসল। মা বাবা ছেলে মেয়ে আর বোধহয় ছেলেমেয়ের মাসিপিসি বা কাকাজেঠু টাইপের কারও ফ্যামিলি, মোট কথা দুটো পরিবার। সব টিনএজার কি তার থেকে একটু বড় বাচ্চা, ডেফিনিটলি বিলো বাইশ। শান্ত, ভদ্র অথচ ক্যাবলা না। আধুনিক সাজপোশাক কিন্তু ডিসট্র্যাকটেড না। সর্বক্ষণ ফোন খুটখুট করছে না। 'আই অ্যাম টু কুল ফর দিস' মুখ করে দূরে দাঁড়িয়ে কান খোঁচাচ্ছে না। বাবা মা পিসি মাসিদের ছায়ায় বেঞ্চে বসিয়ে নিজেরাই দৌড়ে দৌড়ে সব অর্ডারটর্ডার দিয়ে খাবার এনে, বসে শান্ত হয়ে খেয়ে নিজেদের এবং বাকিদের কাগজের প্লেট জড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে আবার খুশি খুশি মুখে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে চলে গেল। কে বলে নতুন জেনারেশনের কিছু ভালো নেই।

প্যাটিসের দোকানে দুটি মেয়ে কাজ করছিল। দোকানের বাইরে এক ভদ্রলোক কার্টন তুলে এখান থেকে ওখানে রাখছিলেন। ফোনে কথা বলছিলেন। তিনজনের ডি এন এ-এর কমনত্ব আঁচ করতে তিন সেকেন্ডও লাগবে না। শান্ত, নিভুনিভু বড় মেয়েটি দোকানের পেছন দিকে শিকঞ্জিটিকঞ্জি বানাচ্ছিল, প্যাটিস মাইক্রোওয়েভে গরম করছিল। ফ্রন্টিয়ার সামলাচ্ছিল ছোট মেয়েটি। খুব জোর হায়ার সেকেন্ডারি। নিজের কাজকে ভালোবাসলে কেমন দেখতে লাগে, তার পারফেক্ট নমুনা।  যা বুঝলাম, মেয়েটা দোকান চালানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পোকেন ইংলিশে শানও দিচ্ছে। এমন যদি কেউ দোকানের দিকে তাকায়ও যাকে দেখে সন্দেহ হতে পারে পাসপোর্ট ইন্ডিয়ান নয়, লাফিয়েঝাঁপিয়ে টুপি নেড়ে, হ্যালো স্যার, ওয়েলকাম ম্যাম, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। তার মানে এই নয় যে ইন্ডিয়ান পাসপোর্টওয়ালাদের অবহেলা করছিল। আমাদের সঙ্গেও চনমনে হয়েই কথা বলছিল, নিখুঁত সার্ভিস দিচ্ছিল, কিন্তু ইংরিজি বলার সুযোগ এলে এনার্জি আকাশে।

কাল যে ইস্যু নিয়ে সম্পত কচুরি ভাণ্ডারের মুণ্ডুপাত করছিলাম, এই মেয়েটির অ্যাটিচিউড তার পারফেক্ট অ্যান্টিডোট। কোটি কোটি ইউটিউব রিভিউ, হিডেন জেমের শিরোপা নিয়েও সম্পত ঝিমোচ্ছে আর এই বাচ্চা মেয়েটা একটা জেনেরিকস্য জেনেরিক দোকানে বসে, কোল্ডড্রিংকসের অ্যাডে অক্ষয়কুমারের হাসিতে যার নাম পর্যন্ত চাপা পড়ে গেছে, কী অসামান্য কাস্টমার সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। ওই দোকানের অন্ততঃ টোয়েন্টি পার সেন্ট বিক্রি মেয়েটার ডিরেক্ট অবদান। যেমন, আমরা শিকঞ্জি অর্ডার করার পর হাসিহাসি মুখে জিজ্ঞাসা করেছিল, ইউ ওয়ান্ট প্যাটিস? টোটালি ফ্রেশ। প্যাটিস খাওয়ার আমাদের কোনও দরকারই ছিল না তখন, মেয়েটা বলল বলে নিয়ে নিলাম।

ওই বয়সে আমি কী ছিলাম সেটা মনেও করতে চাই না, স্যাড হচ্ছে আমি এই বুড়ো বয়সেও এ রকম নই। এই সব ভেবে হাল্কা বিষণ্ণ হচ্ছি এমন সময় বাবার ফোন শেষ হয়ে গেল। তিনি দোকানে ঢুকে পড়ে মেয়ের দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, পঢ়াই নেহি করনা হ্যায় কেয়া? মেয়েটার মুখের আলো যে দ্রুততায় নিভল, শিকঞ্জির গ্লাস দিয়ে মুখ যথাসম্ভব আড়াল করে খুব হাসলাম কারণ পড়তে বসার কথা শুনলে আমাদের মুখের চেহারা এখনও এক্স্যাক্টলি ওই রকম হয়। দেশকালবর্ণপ্রজন্ম নির্বিশেষে পড়তে বসাটা একই রকম ট্রমাটিক। মেয়েটার মতো স্মার্ট হলে ওই মুহূর্তে বাবাকে গিয়ে বলতাম পঢ়াই করে আপনার মেয়ের যা শিক্ষা হবে তার থেকে অনেক বেশি হবে এই দোকানে পাঁচশো রকম লোককে প্যাটিস আর শিকঞ্জি খাইয়ে। কিন্তু আমি স্মার্ট নই, তাই চেপে গেলাম।

বারোটায় চেক আউট। ব্যাগ গুছিয়েই বেরিয়েছি, গিয়ে জাস্ট সই করে, বাকি টাকা মিটিয়েই বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু তার আগে খেতে হবে। চেক আউট করে খাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের ইচ্ছে চেক আউট করে আর ঘোরাঘুরি না করে সোজা, ঠিকই ধরেছেন, কিউরিয়াস লাইফ ক্যাফে-তে গিয়ে ঢোকা, সেখান থেকে সময়মতো বেরিয়ে স্টেশন চলে যাওয়া। অচেনা দোকান এক্সপ্লোর করতে গিয়ে সকালে বাধা পড়েছে, চেনা দোকানেই গেলাম। লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সেম টেবিলেই বসলাম। জয়পুরে গিয়ে রাজস্থানী থালি না খেয়ে ফেরাটা অন্যায়, কিন্তু এল এম বি-তে থালি পেতে পেতে লাঞ্চটাইম অর্থাৎ সাড়ে এগারোটা। তখন এগারোটা দশ বা পনেরো। ওয়েট করার মানে হয় না। তাছাড়া আমাদের সি পি-র রাজস্থালীর থালিও তো মন্দ নয়, ওটাও তো রাজস্থান থেকে যাওয়া লোকেরাই রাঁধেন, জয়পুরের থালির থেকে আর কত আলাদা হবে। এই সব সান্ত্বনা দিয়ে অন্য খাবারই অর্ডার করলাম। ছবিগুলো কোন ফোনে কে জানে তাই দেখাতে পারছি না, কী খেয়েছিলাম সে স্মৃতিও হাতড়াতে হচ্ছে। ডাল কচুরিটা সম্পর্কে নিশ্চিত। যেটা আমি নিয়েছিলাম। যদিও সর্বত্র লেখা আছে এল এম বি-র পেঁয়াজ কচুরি বিখ্যাত, গতকাল খেয়ে ভালোও লেগেছে, কিন্তু এঁদের ডাল কচুরি আমাকে শুইয়ে দিয়েছে। কচুরি খেলাম, যত পারা যায় লাল চাটনি সবুজ চাটনি খেলাম, চা তো আছেই।

ব্যস। আমাদের জয়পুর ঘোরা এসেনশিয়ালি ওখানেই ফুরোল। কত কিছু হল না। বেশিরভাগই হল না। অ্যালবার্ট মিউজিয়াম দেখা হল না। জয়পুরের কোটি কোটি বাজারের একটায় দেড়শো না কত বছরের পুরোনো খেলনার দোকানের খবর পেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম রংচঙে ঘাগরাপরা একটা মেয়েপুতুল কিনে আনব, কাবার্ডের ওপর কেনিয়া না ঘানা থেকে অর্চিষ্মানের আনা বেগুনি গায়ে ছোট ছোট কালো ফুল আঁকা পুঁচকে জলহস্তীটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। টিভি দেখতে দেখতে একটা লম্বা লাঠি দিয়ে মাঝেমাঝে খোঁচাব, কোমর বেঁকিয়ে নাচতে শুরু করবে। মেয়েটার নাম রাখব বাসন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভোর ভোর বেরিয়ে গুলাবজীর চা আর আমূল বাটারলেপা মোটা পাউরুটি খাওয়া হল না। শহরের বাইরে গুলাব চাঁদের ডেয়ারিতে কেসর পিস্তা মাখন নামের ডেজার্ট পাওয়া যায়, পিওর মাখন চৌকো করে কেটে পেস্তাবাদামটাদাম ছড়ানো, চামচ দিয়ে কেটে কেটে লোকে মুখে পোরে আর চোখ বুজে উঃ আঃ করে। দেখেই শরীরের ভেতর কেমন করছিল, ভাবুন, স্রেফ মাখন চামচ দিয়ে কেটে কেটে খাওয়া, কিন্তু অর্চিষ্মান দেখে থেকে খাবে বলে লাফাচ্ছিল। খাওয়া হল না।

নাহারগড় ফোর্টের কিনারে দাঁড়িয়ে অনেক নিচে ছড়ানো গোলাপি বাড়িঘরদোরের মধ্যে জেগে থাকা যন্তরমন্তরের ত্রিভুজের দিকে তাকিয়ে 'হাজার হাজার ডক্টর হাজরা' ফিসফিস করা হল না।

কলকাত্তা চাট সেন্টারে খাওয়া হল না। দিল্লি বোম্বাই চণ্ডীগড়ের লোকেরা জয়পুর বেড়াতে গিয়ে ওই ঠেলার চাট খেয়ে, ভিডিও করে ইউটিউব ভরিয়ে দিচ্ছে, আর আমরা পাটুলি আর রিষড়া থেকে গিয়ে আরেকটু উদ্যোগ নিয়ে কলকাত্তার চাট খেতে যেতে পারলাম না। চাটের সঙ্গে কলকাতার কোনও সম্পর্কই নেই, প্রোপ্রাইটরের বাপদাদা কে কবে কলকাতায় এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, আবার ফিরেও গেছেন, শুধু ছেড়ে আসা শহরটার নাম এখনও লিখে রেখেছেন দোকানের মাথায়। আর যদি কখনও ফিরে যাওয়া না হয়?

জয়পুরেও আবার ফেরা হবে কি? এত কাছে থাকি, না হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আবার যাওয়ার কথা মাথায় এলে হয়তো মনে হবে, দূর কী একশোবার করে একই জায়গায় যাওয়া, অন্য কত জায়গা আছে আনএক্সপ্লোরড। জয়পুরও যে আনএক্সপ্লোরডই রয়ে গেল, কত জিনিস দেখা হল না, খাওয়া হল না, অভিজ্ঞতা করা হল না, সেটা সম্ভবতঃ ম্যাটার করবে না। সমস্ত না-হওয়ার মতো এই না-হওয়াগুলোর ওপরেও জীবন সময়ের ব্যান্ডেড সেঁটে দেবে।

শেষ


Comments

  1. আপনার আর সোমার গল্পটা যাতা রকম ভালো। ক্লামসি হোক, তবু হিরোর এন্ট্রি সিন।

    আর বর্ণনা শুনে আমার মনে হচ্ছে, রাজস্থান নাহোক, রাজস্থানি থলির সাথে অন্তত মোলাকাত করতেই হবে শিগগিরই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. রাজস্থানী থালি একেবারেই বাকেট লিস্ট আইটেম। একবার চেখে নিন, বৈজয়ন্তী।

      Delete
  2. জয়পুরের যন্তর মন্তর মনে আছে , জ্যামিতিবক্সটা ভালো বলেছ , পুরো সিরিজটাই পড়ে খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete

Post a Comment