পুরী ২ঃ অর্চিষ্মানের সঙ্গে দেখা


পান্থনিবাসকে গাল পাড়লাম, পুরী হোটেলেও কেউ ফোন তুলছিলেন না। অর্চিষ্মানের কাছে কাঁদুনি গাইতে গেলাম, সে 'ওরে বাবা কুন্তলা এখন টাইম নেই, পরে দেখছি' বলে কাটিয়ে দিল। তক্ষুনি বাবা ফোন করলেন। ভালনারেবল্‌ মোমেন্টে বেরিয়ে পড়ল। এই তো পুরী যাব ভাবছি, এদিকে কোথাও ঘর নেই।

চেনা অনেক বাবা এই তথ্যটাকে জাস্ট একটা তথ্য হিসেবে নেবেন। নৈরাশ্যবাদী বাবা হলে বলবেন, এত ঘনাঘন বুকিং করে যাওয়া যায় নাকি? আশাবাদী বাবা হলে বলবেন, চেষ্টা করতে থাক, পেয়ে যাবি নিশ্চয়। গীতা পড়া বাবা হলে বলবেন, চেষ্টা করার কর, পেলে যাবি, না পেলে যাবি না।

আমার বাবা এই টাইপের নন। আমার মাও এই টাইপের ছিলেন না। আমার মা হ্যান্ডস্‌ অন মা এবং হ্যান্ডস্‌ অন শাশুড়ি ছিলেন। একবার অর্চিষ্মানের জন্ডিসের খবর পেয়ে মা গোটা আষ্টেক বাতাবিলেবু পৌঁছতে আজকের ট্রেনে দিল্লি এসে কালকের ট্রেনে আবার ফিরে গিয়েছিলেন।

বাবা মায়ের মতো বাড়াবাড়ি করেন না। বাবা আমার জীবনের বাছাবাছা ক্ষেত্রে হ্যান্ডস্‌ অন। পড়াশোনা, কেরিয়ারের ক্ষেত্রে একেবারেই হ্যান্ডস্‌ অফ। সেই অ আ ক খ স্টেজ থেকেই। কেন, সে নিয়ে অবচেতনে কোনও ব্যাখ্যা তৈরি হয়েছিল নিশ্চয়। এক বিরল দিনে বাবা বাড়িতে ছিলেন এবং মা ছিলেন না। আমি ইংরিজির 'বিউটিফুল' বানানটা নিয়ে ফাঁপরে পড়েছিলাম। অথচ হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে। বাবার শরণ নিতে হল। বাবা বলে দিলেন। আমি লিখে নিলাম। মা বাড়ি ফিরলেন। মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বানানটা বাবা বলে দিয়েছে, ঠিক আছে মা?

আবার আমার জীবনের অনেক ক্ষেত্রে বাবা অসুবিধেজনক রকম হ্যান্ডস্‌ অন। এই গল্পটা অনেকবার বলেছি, আবার বলব। চার বছর বয়সে বাবা স্থির করলেন সোনার সাঁতার শেখার বয়স হয়েছে। এবং বাবা যেভাবে শিখেছেন সোনাকেও সেই ভাবেই শিখতে হবে। মাঝখানের বত্রিশ বছরে পৃথিবী যে বদলে গেছে, রেললাইনের ওপারে একটা সাঁতার শেখার স্কুল খুলে গেছে, সেখানে নীল স্বচ্ছ দিঘিতে ট্রেনড প্রফেশনালদের কাছে রিষড়ার তামাম শিশুরা সঠিক টুপি পরে সঠিক টেকনিকে সাঁতার শিখছে এই সব কনসিডার করা হবে না। আমাকে সাঁতার শিখতে হবে বাবার টেকনিকে। বাবা আমাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। দিয়ে ঘাটে দাঁড়িয়ে গুলতানি মারবেন। আড়চোখ আমার দিকে রাখতেও পারেন, নাও পারেন। প্রথম সাতদিন "সাঁতার" থেকে ফিরে রান্নাঘরে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম। পরের সাতদিন কাঁদতাম না। তারপর ঝুলোঝুলি করতাম যে আমি যে পুকুর পারাপার করতে শিখেছি, রান্না সারা আর অফিস যাওয়ার মাঝের ফাঁকে মাকে গিয়ে সেই কেরামতি হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। মা ঘাড় পেতেছিলেন।

আমাকে সাইকেল শেখানোর সময়েও বাবার আশ্চর্য এনার্জি দেখা গিয়েছিল। ততদিনে বাবার টাইপ জেনে ফেলেছি। আমাদের স্কুলে প্রার্থনার সময় একটা পাঠের ব্যাপার থাকত। এক খেলাঘর ভর্তি চোখ বুজে বসে থাকা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে একজনকে কিছু জ্ঞানের কথা রিডিং পড়তে হত। আমিও পড়েছি বারকয়েক। একটি পাঠের বিষয় ছিল শেখা। পৃথিবীতে তিন রকমের শেখা হয়। দেখে, শুনে, ঠেকে। বাবা বিশ্বাস করতেন তৃতীয় রকমের শেখায়। সাইকেল শিখতে চাও? আছাড় খাও। সাঁতার শিখতে চাও? হাবুডুবু খাও। আমি বাবার থেকে এককদম এগিয়ে বিশ্বাস করি আসলে পৃথিবীতে শেখা বলেই কিছু হয় না। আছাড়ই খাও বা হাবুডুবু, হন্যেই হও বা ল্যাজেগোবরে, আসলে কিচ্ছু শিখবে না। এক গাড্ডায় বারবার পড়বে।

বাবার হ্যান্ডস অন হওয়ার আরও অনেক উদাহরণ আছে। হায়ার সেকেন্ডারির পর আমার জন্য স্কুটি কিনে এনেছিলেন। ফটফটে দিনের বেলায় বাবা আমাকে স্কুটিসহকারে মাঠে নিয়ে যেতেন এবং নিয়ম করে রোজ পঞ্চাশ পাক ঘোরাতেন। পাড়ার লোকেরা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে, 'দারুণ হচ্ছে মেজদা,' ইত্যাদি বলে বাবাকে উৎসাহ দিত। আমার ভাগ্যেও উৎসাহ জুটত, তবে মানুষের না। স্কুটি চড়ে ফুল স্পিডে স্টেশনের দিকে উড়ে যেতাম, পাড়ার এবং পাশের পাড়ার কুকুররা ঘেউ ঘেউ করতে করতে পেছন পেছন ছুটত। তারপর ধরুন টাইপ করা। বাড়িতে বাবার উদ্যোগেই বেশ শুরুর দিকে কম্পিউটার এসেছিল। ঢবকা ডেস্কটপ। সেই ডেস্কটপে আমার বসতে পাওয়ার একমাত্র শর্ত ছিল টাইপিং শেখা। প্রপার টাইপিং। কি-বোর্ডের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দু’আঙুলের খটাখট না। বাবা ছিলেন জর্জ টেলিগ্রাফ জেনারেশনের প্রোডাক্ট। টাইপিস্ট স্টেনোগ্রাফার হয়ে ঢুকে অফিসের সিঁড়ি বেয়েছেন। ততদিনে অথরিটির চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর বদভ্যেস থেঁতলে দেওয়া হয়েছে কাজেই আমি বিনা প্রতিবাদে সপ্তাহের পর সপ্তাহ 'আ কুইক ব্রাউন ফক্স জাম্পড ওভার দ্য লেজি ডগ' টাইপ করে গিয়েছিলাম। বাবা টাইপস্কুলের চারপাঁচ ব্যাচের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন টাইপিস্ট ছিলেন শুনেছি। স্পিড এবং অ্যাকিউরেসি দু'দিক থেকেই। অ্যাকিউরেসি জানি না, স্পিডের ব্যাপারটা মোটামুটি ম্যানেজ করেছিলাম। ডেস্কটপে বসে ব্রাউন ফক্স আর লেজি ডগ টাইপ করার অন্ততঃ বছর দশেক পর একদিন বাড়িতে ল্যাপটপে টাইপ করছি, বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, এ তো আমার থেকে বেটার স্পিডে টাইপ করে। বাবার মুখটা এখনও মনে আছে।

বাবাকে আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সর্বদা হ্যান্ডস অফ-ই ভেবেছি, কিন্তু আমার জীবনের রিসেন্ট একটি সুনামিতে বাবার স্টেপ আপ করা আমাকে চমকে দিয়েছে। বাবাকে "হাড়ে হাড়ে চেনা"র গর্ব গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আসলে আমরা কাউকেই চিনি না। রক্তের লোক হলেও।

যাই হোক, মোদ্দা কথা, পুরী হোটেলে বুকিং পাওয়া যাচ্ছে না বাবাকে জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। দশ মিনিট পর বাবার ফোন এল। লিখে নে সোনা। পুরী হোটেলের নম্বর, ইমেল। পুলিন পুরী হোটেলের নম্বর, ইমেল। আরও যেন কী একটা হোটেলের নম্বর, ইমেল। লিখে নিলাম। পনেরো মিনিট পর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। প্লিজ কল মিস্টার বিশ্বনাথ দাস, পার্সন ইন চার্জ অফ পুরী হোটেল ট্র্যাফিক ডেস্ক। বাবা নাকি এর মধ্যে বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন। বিশ্বনাথ জানিয়েছেন ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। আমাকে খালি আজ সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় ফোন করে কথা বলতে হবে। সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় আমরা সাকেতের পি ভি আরে বসে এত জঘন্য একটা সিনেমা দেখছিলাম যে নামটা খুব ভেবেও মনে করতে পারছি না। পরদিন বেলা দশটা নাগাদ ফোন করলাম। আধঘণ্টার মধ্যে বুকিং-এর অ্যাডভান্সের রিসিটের ছবি ফোনে এসে গেল।

অরিজিন্যাল প্ল্যানের একটাই তফাৎ ঘটল। বিশ্বনাথ জিজ্ঞাসা করলেন ভুবনেশ্বর থেকে আমার পুরী আসার প্ল্যান কী? বললাম, কেন বিজু পটনায়েক এয়ারপোর্ট থেকে বারামুন্ডি বাসস্ট্যান্ড, বারামুন্ডি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে পুরী হোটেল। কপাল ভালো হলে জানালার সিটে বসে। বললাম, চিন্তা করবেন না, আমার কোনও অসুবিধে হবে না, এভাবে আগেও গেছি। তাতে বিশ্বনাথ বললেন যে আমার সুবিধেঅসুবিধে নিয়ে ওঁর কাঁচকলা। উনি আমাকে ঘর বুকিং-এ ফেভার করলেন, কাজেই আমিও যদি ওঁর গাড়ি ভাড়া নিয়ে ওঁকে ফেভার করি তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়িপাল্লায় সমান হয় আরকি। বলা বাহুল্য, এ ভাবে বলেননি। খুবই চার্মিং গলায় বলেছিলেন যে আমরা গাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি, সেই গাড়িতে যদি আপনি হোটেলে আসেন তাহলে আমরা খুবই খুশি হব।

অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা বাড়াবাড়ি না করে গাড়িতে যাও। বাবা বললেন, গাড়িতেই যা, না হলে খারাপ দেখায়। তাই আমি আমার প্রো-পাবলিক ট্রান্সপোর্ট স্ট্যান্স ত্যাগ দিয়ে বিশ্বনাথের পাঠানো সদাশিবের গাড়ি চড়ে পুরী হোটেলে চললাম। ভাড়া বাসের থেকে মারাত্মক রকম বেশি লাগল। সময় বাসের সমানই লাগল। জানালার বাইরে বাসের সমান ভিউ দেখা গেল। ফাউয়ের মধ্যে গাড়িটা এসি আর মাঝরাস্তায় সদাশিবের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়ার সুবিধে। মুখ্য সুবিধেটা বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে ভদ্রতা। একটা প্রিভিলেজের অংশ না হলে যে ভদ্রতাটা আমি করতে পারতাম না। কাজেই প্রমাণ হল ভদ্রতা করতে হলেও প্রিভিলেজ লাগে।

হোটেলে পৌঁছনোর আগে একটা মুহূর্ত যতবার পুরী গেছি ততবার চমকেছে, জীবনে আরও যতবার পুরী যাব ততবার চমকাবে। আকাশটা আচমকা অনেকটা লম্বা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা। কী করে হয় কে জানে। কারণ দৃষ্টি আটকে হাবিজাবি কনস্ট্রাকশন,ঝুপড়ি। তারই মধ্যে পেছনের আকাশটায় একটা কিছু ঘটে, বুকের ভেতর নিশ্চিত টের পাই এই হাবিজাবি হরেদরের ওপারে একটা ভীষণ আশ্চর্য জিনিস আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

মোড় ঘুরে দুটো বিল্ডিং পরেই পুরী হোটেল। তার মধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে যতখানি দেখা যায় সমুদ্র দেখে নিলাম। রিসেপশনের কাজ সারলাম। একজন এলেন ব্যাগ বয়ে দিতে। বওয়ার কিছুই ছিল না। আড়াই দিনের ট্রিপের মালপত্র আমার ব্যাকপ্যাকেই ঢুকে যায়। আর কাঁধে একটা পার্স, যা গুণবিচারীর থেকে দর্শনধারী বেশি। চেক ইন করা ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সবার ব্যাগ আসছে, চারপাশ থেকে সহযাত্রীদের ভিড় ক্রমশঃ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, কানেক্টিং ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসছে, আমার ব্যাগের দেখা নেই, নির্ঘাত কেউ আমার ব্যাগ নিজের ভেবে তুলে নিয়ে চলে গেছে, কিংবা প্লেনে ওঠেইনি। অলরেডি শট নার্ভ সিস্টেমের ওপর এতসব ফালতু চাপ বরদাস্ত করতে আমি রাজি নই। চেক ইন অ্যাভয়েড করার জন্য ইউটিউব দেখে মিলিটারি কায়দায় ব্যাগ প্যাক করা প্র্যাকটিস করেছি । সবাই জামা ভাঁজ করে, আমি রোল করি। সত্যিই জায়গা বাঁচে। তা বলে কি যাঁদের কোট প্যান্ট ব্লেজার প্যাক করতে হয় তাঁরা ওভাবে রোল করতে পারবেন? কিংবা প্রাণে ধরে পাটোলা বা পৈঠানি শাড়ি? কিন্তু আমার সুতির কুর্তি, সুতির টিশার্ট, জিনসের প্যান্ট গিল্ট ফ্রি হয়ে রোল করা যায় এবং ব্যাকপ্যাকের তলায় কোথায় যে ঢুকে যায় দেখাও যায় না।

সাহায্যের অফার রিফিউজ করে নিজের ব্যাগ নিজেই বয়ে ভদ্রলোকের পিছু পিছু অ্যাসাইনড ঘরে ঢুকে এলাম। তখনও ঘর বাছা ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে বুঝতে পারিনি, কারণ প্রথমেই দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছি এবং নিজের চোখে দেখারও আগে ফোন বাগিয়ে একটা ফটাস করে ছবি তুলেছি। এত ফটাস যে ফোনটা সোজা করে ধরারও টাইম হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপে আপলোড করার আগে এডিটের অপশনে গিয়ে বেঁকা সমুদ্র স্ট্রেটেন করে, এক সেকেন্ড ভেবে একটু এনহ্যান্সও করে দিলাম। একমিনিটের মধ্যে অর্চিষ্মানের রিপ্লাই এল, কীঈঈঈঈ নীঈঈঈঈল। অল্প অপরাধবোধ হল। লিখে পাঠালাম, ঠিক এতটাও নীল নয়। কিন্তু যথেষ্ট নীল আর যথেষ্ট বড়। সত্যিকারের সমুদ্রের মতোই।

ভদ্রলোক ততক্ষণ সময় নষ্ট না করে কোথায় জল, কোথায় তোয়ালে, কোথায় এক্সট্রা চাদর বালিশ এইসব গড়গড়িয়ে বলে বেরোনোর উপক্রম করছেন। দাঁড়ান দাঁড়ান, আর্তনাদ করে বারান্দা থেকে দৌড়ে এলাম। টিভিটা কী করে চালাতে হয় বলে দিয়ে যান প্লিজ। ভদ্রলোক মুখে বিতৃষ্ণার ভাব ফুটিয়ে বললেন, বাংলা চ্যানেল তো, বলে চারপাঁচবার রিমোটের বোতাম টিপলেন। নর্থ পোলে স্কি মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে থাকলেও যে আমাকে বাঙালি বলে বোঝা যাবে সে নিয়ে সন্দেহ এতদিনে ঘুচেছে, তবু প্রত্যেকবার কেউ আমাকে বাঙালি ধরে ফেললে কেমন দমে যাওয়া ফিলিং হয়। এত গ্লোবাল সিটিজেন হওয়ার ইচ্ছে, কেবল চেহারাটা  শয়তানি করে সব মাটি করছে। ততক্ষণে স্ক্রিন জুড়ে জি বাংলা, কালারস বাংলা, রূপসী বাংলা, স্টার জলসা, এ বি পি আনন্দ, সোনি আট। বুকের মধ্যে ঢেউ তোলা উচ্ছ্বাস চাপা দিতে দিতে বললাম, যে কোনও একটা চালিয়ে দিয়ে চলে যান। ভদ্রলোক বললেন, একটু ওয়েট করুন। টিভিটা গরম হোক। বলে বেরিয়ে গেলেন।

টিভি গরম হল। ভদ্রলোককে যে কোনও একটা চ্যানেল বলেছিলাম বটে, আসলে জানতাম কোনটা দেখব। সোনি আট। সি আই ডি-র বদলে ক্রাইম পেট্রোলের ম্যারাথন চলছে। অল্প দমলাম, বেশি না। জামাকাপড়, জুতো ছেড়ে ফোন তুলে রিসেপশনের নম্বর ডায়াল করে চায়ের অনুরোধ জানাতে তাঁরা জানালেন সুইচবোর্ডে একটা সুইচ আছে দেখুন ঘণ্টার ছবি আঁকা, সেটা টিপলেই বয় আপনার দরজায় হাজির হবে, যা চাই বলে দেবেন।

লেবার অ্যাবান্ডেন্ট ইকনমির আদর্শ ব্যবস্থা। প্রতি তলায় করিডরের কোণে এক ভদ্রলোক সকাল ছ'টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, বেল বাজলে এসে চাহিদা শুনে যোগানের ব্যবস্থা করবেন। তাঁকেই বললাম চায়ের কথা। চা এসে গেল, আমি দরজা এঁটে বিছানায় আধশোয়া হয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ক্রাইম পেট্রোল দেখতে থাকলাম।

এবং টের পেলাম যতটা ফুর্তি হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। কারণ একটা বিকট হল্লা বন্ধ জানালাদরজা ভেদ করে ফুর্তিতে বাগড়া দিচ্ছে। হল্লার উৎসটাও জানি। একটু আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ছবি তোলার সময় দৃষ্টিরেখার সামান্য ডানদিকে বালির ওপর প্যান্ডেলটা। কিছু একটা পুজো হচ্ছে। স্থানমাহাত্ম্যের কথা মাথায় রেখে শ্রাদ্ধও হতে পারে। প্যান্ডেলের মাল্টিকালার বিচার করলে প্রথমটাই মোর প্রব্যাবল। সেই প্যান্ডেলের ভেতর থেকে প্রবল আবেগে মন্ত্রোচারণ মাইকের মাধ্যমে ভেসে আসছে।

এইখানে আমি একটা ওপিনিয়ন দেব। যে কোনও ধার্মিক অনুষ্ঠানে মাইক বন্ধ করে দেওয়া উচিত। হ্যাঁ, এর মধ্যে ভোরবেলার উদাসী আজানও পড়বে। আমরা শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে শুনলেও এবং শুনে নস্ট্যালজিয়ায় মাখোমাখো রচনা ফেসবুকে নামালেও মনে রাখতে হবে আওয়াজটা কারও বাড়ির কাছে এবং হতেই পারে তাঁর ভোর চারটের সময় ও জিনিসের খপ্পরে পড়ার কোনও ইচ্ছে নেই। একই ট্রিটমেন্ট মাইকে অঞ্জলির মন্ত্র পড়ানোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের ছোটবেলায় লোকে এত ধার্মিক ছিল না, সিরিয়াসলি। ওইটুকু তো পাড়া, একসঙ্গে পঁচিশজন অঞ্জলি দেয় কি না সন্দেহ, ঠাকুরমশাইয়ের বুমিং ভয়েসই যথেষ্ট ছিল। এখন মাইক ছাড়া নাকি চলছে না। বাবা শুনলাম এই মাইকে মন্ত্র পড়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব রেখেছিলেন। তাতে কমিটি থেকে নাকি জানানো হয়েছে, না মানে মেজদা, পুজোর সময় মন্ত্র শোনা গেলে বেশ একটা ভক্তিভক্তি ভাব সারা পাড়ায় ছড়িয়ে থাকবে। বাবাকে তো আর 'আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ'বলা যায় না, বাবা ভাববেন মেয়ের পাগলামির ওষুধে আর বাগ মানছে না, কিন্তু স্রোতের বিরুদ্ধে বাবার মতপ্রকাশে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম।

মতপ্রকাশের কারণ জেনে অবশ্য একটু দমে গিয়েছিলাম। ব্যাপারটার এগেইন্সটে দাঁড়ানোর পেছনে আমার যেমন একটা অবিশ্বাসের উদযাপন আছে, তোমার বিশ্বাসের উদযাপন করতেই হয় নিজের বাড়ির ভেতর কর, মাইকের গজাল মেরে আমার বাড়িতে (এবং ভাইসি ভার্সা) ঢুকিয়ো না, বাবার অতসব প্রগতিশীল স্ট্যান্ড না। বাবার প্রধান আপত্তি, মন্ত্রোচ্চারণের নামে “ধ্যাষ্টামি”টা প্রতিহত করা। মোড়ের মাথায় চোঙা লাগিয়েছে, আমাদের পুরোনো টিভির ভলিউম হায়েস্টে নিয়েও বাবা তারক মেহতা কি উল্টা চশমা-র ডায়লগ শুনতে পাচ্ছেন না, কাজেই হাল ছেড়ে মিউট করে মন্ত্রই শুনছেন। আমাকে বলছিলেন, বুঝলি সোনা, অঞ্জলি হচ্ছে। নতুন পুরুত বলছে “শরণ্যে ত্রম্‌”। বলে গ্যাপ দিচ্ছে। সবাই সমস্বরে বলছে "শরণ্যে ত্রম্‌"। পুরুত আবার বলছে, "বকে গৌরী"। আবার গ্যাপ। সবাই ভক্তিভরে বলছে "বকে গৌরী"। এটা শোনার পর থেকে বাবা মাইকে মন্ত্র পড়ার বিরুদ্ধে ফুট সোলজারিং করছেন।

একই লজিকে গানও বন্ধ হওয়া উচিত। ভোর চারটে থেকে পাড়া কাঁপিয়ে 'মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো' কিংবা দশমীরাতের বিষাদ খানখান করে 'দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি'ও ক্যান্সেল। স্বীকার করছি এটা ক্যান্সেল হলে আমার গলায় অল্প দলা পাকাবে। কিন্তু নিয়ম ইজ নিয়ম। আমার অপছন্দের সব বন্ধ হবে আর পছন্দের সব যেমন চলার তেমন চলবে তা তো হয় না।

তাছাড়া গান বন্ধ করা নিয়ে যুক্তি টলমল করলে অর্চিষ্মানের সেই সহকর্মীর কথা মনে করি। পকেট ফর্টির হাতে গোনা পাঞ্জাবী ফ্যামিলির মধ্যে একটি ফ্যামিলির সদস্য। অর্চিষ্মান অতশত না জেনে, বা জেনেও ব্লাইন্ড স্পট নিয়ে যাকে খুব রসিয়ে রসিয়ে বলেছিল, কাল রাতে আমি (অর্চিষ্মান) আর আমার বউ কেমন রাত একটা পর্যন্ত অঞ্জন দত্তর (আ বেংগলি সেলেব্রিটি) রাত দেড়টা পর্যন্ত প্রোগ্রাম শুনেছিলাম। প্রোগ্রাম অন্তে, রাত দেড়টার সময় এক প্যান্ডেল ওপচানো বাঙালি মিলে (আমি না, আমার বউ) ছলছল কণ্ঠে ‘পুরানো সেই দিনের কথা”, (আ নস্ট্যালজিক টেগোর সং, হুইচ মোস্ট লিভিং বেঙ্গলিস ক্যান সিং ফ্রম মেমোরি) গেয়েছিল।

মেয়েটি সুচারু ঘাড় নেড়ে বলেছিল, পাতা হ্যায়। কারণ প্যান্ডেলের চোঙাটা ওদের বাড়ির দিকেই ঘোরানো ছিল। দু'সেকেন্ডের নীরবতা পেরিয়ে অর্চিষ্মান বলেছিল, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। ইট মাস্ট বি হরিব্‌ল্‌। তাতে মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলেছিল, আরে কুছ নহি ইয়ার, পাঁচ দিনই তো হ্যায়।

যতবার অন্য ভাষার, অন্য ধর্মের, অন্য সংস্কৃতির এবং অন্য সামাজিক ক্রস-সেকশনের উৎসবের উল্লাস আমার মধ্যে দাঁতকিড়মিড়ের জন্ম দেয়, অর্চিষ্মানের সেই কলিগের কথা ভাবি, রাত দেড়টায় যার বাড়ির দিকে তাক করা লাউডস্পিকারে পাঁচশো লোক গলা ছেড়ে বেসুরে “আয় রে তবে আয় রে সখা” চিল্লিয়েছিল, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।

শব্দের আরও একটা বৈশিষ্ট্যের কথা নিশ্চয় সবাই জানেন। একই ভলিউমে শব্দ হতে থাকলে সেটা কিছু সময় পরে জোরে প্রতিভাত হয়। মানে ধরুন কানে স্পটিফাইয়ে ট্রু ক্রাইম গুঁজে ঘুমোতে গেলাম। প্রথমটা মনে হল কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, খুনের সময় খুনী ভিকটিমের গলা কত জোরে কতক্ষণ টিপে ধরে ছিল এই সব রোমহর্ষক ডিটেল মিস হয়ে যাচ্ছে, তখনও ভলিউম বাড়াই না। কারণ পাঁচ মিনিট বাদে এই অপ্রতুল ভলিউমই স্পষ্ট ও যথেষ্ট হয়ে উঠবে।

একই লজিক অনুসরণ করে প্যান্ডেলের মন্ত্রোচ্চারণ ক্রমশঃ জোর থেকে আরও জোর থেকে আরও জোর হয়ে ঘণ্টাচারেক পর সহ্যাতীত হয়ে দাঁড়াল।

আমার গ্র্যান্ড আইডিয়া ছিল যে অর্চিষ্মান যতক্ষণ ভুবনেশ্বরে বোর হবে আমি একা একা বেরিয়ে পুরী (অন্ততঃ পুরী হোটেলের আশপাশ) এক্সপ্লোর করব। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কোনও একটা তিনমাথার মোড় আসবে, সেটার একটা ধরে নাকবরাবর হাঁটব, চোখ আলগোছে ফেলে রাখব ডানদিকে, ফাইন্যালি একটা পয়েন্ট আসবে যেখান থেকে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে অসংখ্য রাস্তা গেছে। তারই কোনও একটা ধরে আনতাবড়ি ঘুরব। বেশ হিউয়েনসাং হিউয়েনসাং ফিলিং আসবে। ক্লান্ত হলে কোনও একটা সি ভিউওয়ালা দোকানে ঢুকব। প্রেফারেবলি কফি শপ। টুং টাং বিলিতি গান বাজবে। জানালার বাইরে আদিগন্ত নীলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দেব। মগজে দুএকটা গভীর ভাবনা, তিনচারটে সলিড উপলব্ধি কি আর আসবে না? সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়ার ওম পোহাব আর দীর্ঘশ্বাস ফেলব।

বাস্তবে, ওই প্রচণ্ড আওয়াজ আর খটখটে রোদ্দুরে মেজাজ এমন খিঁচড়ে গেল যে আমি আর বেরোলাম না। ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্রাইম পেট্রোল চালিয়ে চোখ বুজে, মাথা দপদপানি নিয়ে চিৎপাত হয়ে রইলাম। খিদের খ না থাকা সত্ত্বেও স্ট্রেস ইটিং এর হাঁড়িকাঠে মাথা পেতে দুপুরবেলা এক প্লেট ফ্রায়েড রাইস, সন্ধেবেলা একপ্লেট, আটটা কোস্টারের সাইজের ভেজ পকোড়া খেয়ে ফেললাম।

রাত আটটা নাগাদ রুমের বেল বাজল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় দুমদাম বেতালা তবলার বোল। নিশ্চিন্তে দরজা খুললাম। অর্চিষ্মান ঘরে ঢুকে ব্যাগ ছুঁড়ে ঘরের কোণে ফেলে বিছানায় ধপাস করে বসে বলল, স্বর্গদ্বার যে একটা রিয়েল শ্মশান, জানতে না তো?

কোণে বসে থাকা দাদাকে ডেকে এক পট চা, চিনি সাইডে, আনতে বলে দরজা ভেজিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কবে জানলে?

অর্চিষ্মান বলল, আসতে আসতে মালটিপল চিতা জ্বলতে দেখলাম। তখন ক্লিক করল। ভাবা যায়? এতদিন পুরী আসছি, এই পাড়ায় থাকছি, অথচ নামকরণের সার্থকতাটাই মিস করে গেছি।

অর্চিষ্মানের বয়সে না হলেও, আমিও বেশ বড় বয়সেই রিয়েলাইজ করেছিলাম যে স্বর্গদ্বার ব্যাপারটা আক্ষরিক স্বর্গের দ্বার। চেপে গিয়ে অর্চিষ্মানের লেট উপলব্ধি নিয়ে যতখানি হাসা যায় হাসলাম।

রাতে এদিকওদিক না ঘুরে পুরী হোটেলের রেস্টোর‍্যান্টেই খাওয়া ঠিক হল।
খাবারের অর্ডার দিয়ে খামোকাই তিনকোণা ভাঁজের একটা টিস্যু তুলে নিয়ে শুকনো ঠোঁট আবার শুকনো করে মুছে টেবিলের ওপার থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে মুচকি হেসে অর্চিষ্মান বলল, হোটেলটা খুবই “অ্যান্টি-রোম্যান্টিক।"

আর বলামাত্র পুরী হোটেল সংক্রান্ত যে অস্বস্তিটা এতক্ষণ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল সেটা পূর্ণ গ্লোরিতে আমার সামনে দাঁড়াল।

এমন কিন্তু নয় যে আমি আর অর্চিষ্মান ভয়ানক রোম্যান্টিক কাপল, নিভৃত গুনগুনের জায়গা না পেলে গুমরে মরি। রোম্যান্টিক জায়গা বলতেই যে ছবিগুলো ভেসে ওঠে, টিমটিমে আলো, টুংটাং বাজনা, “ডেট”-এর ভেনু হিসেবে ওই রকম জায়গা আমরা পছন্দও করি না। যে জায়গায় চারদিকে কোলাহলের দেওয়াল সেখানেই আমাদের আড্ডা জমে ভালো। যেমন ধরা যাক, অন্ধ্র ভবনের ক্যান্টিন, সারাভানা ভবন, বা শুক্রবার রাতে ডিফেন্স কলোনির ফোর এস বার। যেখানে চারপাশের হল্লাগুল্লার চোটে দুজনকে প্রায় চেঁচিয়ে কথা বলতে হয় উইথ ফুল কনফিডেন্স যে কেউ আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না বা শুনতে চাইছেও না। ওই সব জায়গায় বসে, কোলাহলের নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তায় আমরা আমাদের জীবনের জটিল জট অনেক ছাড়িয়েছি।

পুরী হোটেলের অ্যামবিয়েন্সের অনিভৃতির কালপ্রিট ভিড় নয়। কারণ এর থেকে অফিসটাইমের হাওড়া কিংবা শেয়ালদা স্টেশনও বেশি রোম্যান্টিক। আনরোম্যান্টিকতার উৎস অর্চিষ্মানের মতে ভিড়ের কম্পোজিশন। ওর ভাত মাটন (যেমন হওয়ার কথা) আমার হট অ্যান্ড সাওয়ার স্যুপ (বেশ খারাপ) এসে যাওয়ার পর অর্চিষ্মান বলল, চারদিকে তাকিয়ে, আহ্‌ অত অবভিয়াসলি না, দেখো, নিজেই বুঝতে পারবে।

দেখলাম। আমরা ছাড়া বাকি সমস্ত ইউনিটই মিনিমাম দুই প্রজন্ম থেকে শুরু করে, দু’তিনটে টেবিলে তো খুব সম্ভব চারপ্রজন্মও মনে হল। বাচ্চা চেঁচাচ্ছে, মা কান মুলছে, দুই কিশোর কাজিনে চোখাচোখি চলছে, ঠাকুমা/বড়ঠাকুমার মাংকিক্যাপের ফাঁক থেকে বেরোনো অবতল গাল প্রবল আন্দোলনে খাবার চিবোচ্ছে। পাশের টেবিলে সদ্য কৈশোর শেষ করা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে এসে বসল। ফোন আকাশে তুলে, ঘাড় সাতাশি ডিগ্রিতে বেঁকিয়ে খানসতেরো সেলফি তোলা শেষ হলে মেনু খুলে খাবার বাছতে বসল। মা গর্জন করে উঠলেন, এই জন্য তোর বাবার সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আড়ি পাতছি টের পেয়ে আমার দিকে বিষদৃষ্টি হেনে মেয়েটি মাকে “শ্‌শ্শ্‌” বলল। মা ফোনে চিৎকার করলেন, তুমি কোথায়, অর্ডারটা কী করে দেওয়া হবে?

মোদ্দা কথা হচ্ছে, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে এত ঘোরসংসারী ভাব, যে আমাদের মতো অল্পসংসারীদের পক্ষে অস্বস্তিজনক।

খাওয়া শেষ করে বিচে নামলাম। অহংকারই পতনের মূল। যে জিনিসগুলো নিয়ে গর্ব করেছি জীবনে ঠিক সেই সেই জায়গাগুলোতেই চড় খেয়েছি। তবু শিক্ষা হয়নি। পোস্টের শুরুতে নিজের প্যাকিং-প্রাওয়েস নিয়ে অত পেখম মেললাম, পুরীতে যাচ্ছি অথচ বালিতে হাঁটার চটি প্যাক করিনি। কাল সকালে দু'জোড়া চপ্পল কিনতে হবে।

জুতো খুলে হাতে নিলাম। আবছা অন্ধকারে বালির ওপর সন্দেহজনক ছায়াছায়া এড়িয়ে হাঁটছি। শ্রীরামপুর কালভার্টে কোমরজল পেরোনোর সময় মা বলতেন, এগুলো কিন্তু জল নয়, জানিস তো সোনা? এই মুহূর্তে থাকলে নিশ্চয় বলতেন, এগুলো কিন্তু বালি নয়, জানিস তো সোনা?

বিচের এই জায়গাটায় দীপাবলীর মতো আলো। রথের মেলার মতো ভিড়্। মাছের বাজারের মতো গন্ধ। ঘন ঘন শাঁখের আওয়াজ। সম্ভাব্য ক্রেতাদের ডেমো দিচ্ছেন বিক্রেতারা। দূরে দু'তিনটে লাল হলুদ সবুজ আলোর বিম তরবারির একে অপরকে কাটাকুটি করছে। হাই এনার্জি গীতবাদ্যের আওয়াজ, এত দূর থেকে কথা সুর আলাদা করা যাচ্ছে না, কিন্তু উচ্চসংস্কৃতির চর্চা যে হচ্ছে না সেটা বোঝা যায়। অর্চিষ্মান বলল, চল চল দেখে আসি কী মজা হচ্ছে। জুতো পরে রাস্তায় উঠে পড়লাম।

ওই জায়গাটায় কোনও উড়িয়া গর্গকে নিয়ে গেলে তার বিপি কী পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে ভাবতেও শংকা হয়। অধিকাংশ দোকানের নাম বাংলায় লেখা। ষোল আনা বাঙালি থেকে শুরু করে ভজহরি মান্না, সব চেনা দোকান শাখা মেলেছে। সকলেই বাংলায় কথা বলেন, বাংলায় কথা বললে উত্তর দেন। হাঁটতে শুরু করলাম। সাগরিকা হোটেল দেখে অবভিয়াস রেফারেন্সটা চালাচালি করলাম। আসল স্বর্গদ্বার, যেটা অর্চিষ্মান কয়েকঘণ্টা আগে আবিষ্কার করেছে, পেরিয়ে গেলাম। তখনও একাধিক চিতা জ্বলছে ভেতরে। ওই পরিস্থিতিতে যে ক্লিশেতম কথাটা মাথায় আসার সেটাই এল। দেওয়ালের ওপারে কিছু লোক ছাই হয়ে যাচ্ছে আর বাইরে মাছভাজা, শঙ্খধ্বনি, টোটোর হর্ন, সাইকেডেলিক আলোর নাচ, কানফাটানো "শীলা কি জওয়ানি" (ততক্ষণে গানের লিরিক্স উদ্ধার করতে পেরেছিলাম)। একটু পর গানের সঙ্গে নাচটাও দেখব।

এই যারা নাচছে, খাচ্ছে, হাসছে, নিজেদের ছাড়া বিশ্বশুদ্ধু লোকজনকে জাজ করতে করতে হাঁটছে, এরা প্রত্যেকে জানে আর কয়েক বছরের মধ্যে (মাস, দিন বা ঘণ্টাও হতে পারে) নিজেরাও দাউ দাউ জ্বলবে। এই জানাটা তাদের আচরণে এককুচি প্রভাবও ফেলছে না। এটা জীবনের জয়ের লক্ষণ নাকি টোটাল পাগলামির?

ব্র্যাকেটে আদি লেখা তিন চারটে নৃসিংহ খাজা সেন্টার পেরোলাম। অবশেষে গানবাজনা, আলোর তলোয়ারের উৎস গোচর হল। একটা লক্ষ্মীঠাকুর বিসর্জনের জন্য এসেছে। একটা ভ্যানে আলমারি সাইজের স্পিকার, আলোর তলোয়ারের উৎসও সেই ভ্যানে। একটা ভ্যানে ডিজাইন করা আলোর কলকা। একটা ভ্যানে মালক্ষ্মী। তিনটে ভ্যানের সন্নিকটে তিনটে দল। প্রথম ভ্যান, যেখানে আলোর তরবারি বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর আলমারি সাইজের স্পিকার থেকে গান বাজছে তার সামনে চার পাঁচটি ছেলের দল নাচছে। নাচ বলাটা ইউফেমিজম। শরীরের মধ্যে ভূমিকম্প বলাটাই উচিত। বোঝাই যাচ্ছে বাহ্যিক অনুঘটকের সাহায্যে নাচিয়েদের শারীরিক এবং মানসিক শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ানো হয়েছে, বা উল্টোটা। বাহ্যিক অনুঘটক শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তির সমস্ত বোধ কিছুক্ষণের জন্য উধাও করে দিয়েছে।

দ্বিতীয় ভ্যানের আলোর কল্কার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ট্র্যাডিশনাল ওডিশি ড্রেস পরা কয়েকজন বাদক। কাঁসি এবং গলায় ঝোলানো ছোট ঢাক বাজাচ্ছেন। কান খাড়া করে খেয়াল করেছি, দু'হাতের মধ্যে দাঁড় করানো ভ্যানের বলিউডি অপসংস্কৃতি তাঁদের তাললয়ের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটাতে পারছে না। টুপি খোলার মতোই ক্ষমতা। তিন নম্বর ভ্যানে মালক্ষ্মীর মূর্তির সামনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন নিঃসন্দেহে পূজারী। হাতে প্রদীপ এবং ঝালর এবং ঘণ্টা। দশ হাত দূরের 'শীলা কি জওয়ানি" এবং পাঁচ হাত দূরের ঢোল ও কাঁসি থেকে সম্পূর্ণ ইমিউনড হয়ে মগ্ন মুখে ঘণ্টা নেড়ে মালক্ষ্মীর বিদায়কালীন আরতি করে চলেছেন।

দূরে একটা ক্যাফের নাম লাল আলোয় ঝলমল করছে। মিত্র ক্যাফে। খিদে একটুও নেই, তবু অর্চিষ্মান ঢুকল। দেখি যদি কফি আর টুকটাক কিছু পাওয়া যায়। ও সব বাহানা, আসলে পদবীতুতো পার্শিয়ালিটি। কফিটফি কিছু নেই। পাওয়া যাবে শুধু ভেজ থালি, মটন থালি, চিকেন থালি, ফিশ থালি। অর্ডার দিতে হলে নেক্সট দশ গোনার মধ্যে দিতে হবে কারণ কিচেন বন্ধ হয় হয়। রিসেপশনের ছেলেটা মেনুকার্ড বাগিয়ে ধরে এক, দুই, তিন গুনতে শুরু করল, অর্চিষ্মান হার মেনে বেরিয়ে এল। বারান্দার দেওয়ালে এক ভদ্রলোকের ছবি খুব মালাটালা পরিয়ে টাঙানো। অর্চিষ্মানকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে বললাম, তোমার কোনও কাজিন দাদুটাদু নাকি? অর্চিষ্মান বলল, তোমার প্রাণঘাতী রসিকতাগুলো বন্ধ কর প্লিজ।

হাঁটতে হাঁটতে এত অবধি গেলাম যেখানে বিসর্জনের গীতবাদ্য প্রায় অশ্রুত হয়ে এসেছে। আলোর দূষণও অদৃশ্য। অন্ধকারে ঢেউয়ের শব্দ, ঢেউয়ের মাথায় কুচিকুচি ভাঙতে থাকা সাদা। মিনিটদশেক দাঁড়িয়ে রইলাম। পেছনে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি, ভুজঙ্গনিবাসের মতোই, সামনের জমিতে লম্বা লম্বা ঘাস গজিয়ে গেছে। বাড়িটার পাঁচিলঘেঁষা ছোট বোর্ড। সম্পূর্ণ ওড়িয়াতে লেখা। কাজেই বাড়িটা কেন, কীসের, অজানাই রয়ে গেল। বোর্ডটা আদৌ বাড়িটার পরিচয়জ্ঞাপক কি না তাই বা কে বলতে পারে।

একটা টোটো এল। উঠে পড়লাম। আবার মিত্র ক্যাফে পেরোনো হল। লক্ষ্মীঠাকুর তখনও জলে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, নাচিয়েদের এনার্জি তখনও টইটম্বুর। হোটেলের মেন গেট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন দাঁড়িয়ে গজল্লা করছিলেন। আমাদের দেখে গেট খুলে দিলেন। ওপরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় বডি ফেললাম। সমুদ্রের এত কাছে, অথচ ঢেউয়ের শব্দ প্রায় অশ্রুত। মনে হচ্ছিল মাঝরাস্তায় বিছানা পেতে শুয়ে আছি আর চারপাশ দিয়ে হর্ন বাজিয়ে অসংখ্য টোটো, অটো, রিকশা, কোটি কোটি লোক, শাঁখের বেচাকেনা করতে করতে, মাছভাজা চিবোতে চিবোতে মিছিল করে চলেছে। আর সব ছাপিয়ে বিসর্জনের ভ্যান থেকে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে বাজছে, আমি কলকাতার রসগোল্লা, ও আমি কলকাতার রসগোল্লা।




Comments

  1. বুদ্ধদেব গুহ বোধহয় কোনো একটি লেখায় স্বর্গদ্বারকে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক শ্মশান বলেছিলেন। সেই থেকে ওটাকে শ্মশান বলে জেনেছিলাম। আর পুরীর বিচ দেখলে আমার চন্দননগরের কথা মনে পরে। ইংরেজি উপনিবেশের মাঝে ফরাসি কলোনি‌। ওটা উড়িষ্যায় বাঙালি উপনিবেশ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. উপনিবেশটা একদম পারফেক্ট শব্দ, অর্ণব।

      Delete
  2. Puri ke amaaro bangali Uponibesh mone hoyechhe..
    Odhiya gargo shiggiri chole ashbe... bangali gargo ele aar Odhiya ashte deri ki...

    tomaar lekha ta pore mon ta abaar berate jabaar jonno daka daki shuru korlo.. kobe eroko jawa jaabe ke jaane...

    ReplyDelete
    Replies
    1. পুরী তো। দুম করে চলে যাও। নিজেই নিজেকে সারপ্রাইজ দিয়ে।

      Delete
  3. এহেহে পুরী হোটেল তো বেজায় ডুবিয়েছে!
    এত আওয়াজ আমারও অসহ্য লাগে। দু পা হাঁটলে দশট থুতুফেলা লোক আর বিশটা অটো/টোটো/বাইক এর হর্ণ পেরোতে হয়।
    আজকাল ওই লাইট হাউসের দিকটা বেটার শুনেছি, মানে একটু ফাঁকা।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ওই জায়গাটায় আর থাকা যায় না।

      Delete
  4. "নতুন পুরুত বলছে “শরণ্যে ত্রম্‌”। বলে গ্যাপ দিচ্ছে। সবাই সমস্বরে বলছে "শরণ্যে ত্রম্‌"। পুরুত আবার বলছে, "বকে গৌরী"। আবার গ্যাপ। সবাই ভক্তিভরে বলছে "বকে গৌরী" ।"

    সর্বত্র এই 'শরণ্যে ত্রম্‌' আর তারপর গ্যাপ - শুনলেই মাথা খারাপ হয়ে যায় !
    ভীষণভাবে relatable ।

    বাকি লেখাও অতি চমৎকার - রসিয়ে রসিয়ে পড়ছি ।

    হ্যাপি নিউ ইয়ার কুন্তলা ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাপি নিউ ইয়ার, কাকলি। খুব ভালো কাটুক ২০২৪।

      Delete

Post a Comment