পুরী ৩ঃ কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই


পুরীর বিচে সূর্যোদয় দেখার আনন্দ যারা দেখেছে সবাই জানে। সে আনন্দের জন্য অ্যালার্ম দিয়ে উঠতে আমার আপত্তি নেই। এদিকে অর্চিষ্মানের মতে পুরীর বিচের পাঁচশো মিটারের মধ্যে শুয়ে, অ্যালার্ম বন্ধ করে যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোনোর আনন্দও কম নয়। একসঙ্গে থাকতে থাকতে দুটো লোক একে অপরকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে। বদলায়। যার ব্যক্তিত্বে পাপোষভাব প্রবল, স্বাভাবিকভাবে তার বদলই বেশি ঘটে। কাজেই আমিও আজকাল অ্যালার্ম দিয়ে উঠে সূর্যোদয় দেখতে বেরোনোর বদলে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোই প্রেফার করি।

যদিও ওই তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সির ট্রাকের হর্নের মধ্যে অর্চিষ্মানের পক্ষেও ঘুমোনো অসম্ভব। চা খেয়ে বেরোলাম। হোটেলের সামনে স্নানের ধুম। ঢেউয়ের থেকে মানুষ বেশি। লোকের মজা যে সংক্রামক, সে নিয়ে ইউটিউব রিল দেখেছি। নিউ ইয়র্ক সাবওয়েতেই হবে, কারণ সব রিল ওখানেই শুট হয়। একটা স্টেশন থেকে একজন পেশাদার অভিনেতা মোটামুটি ফাঁকা একটা ট্রেনে উঠলেন। উঠে উল্টোদিকের দরজার কাছে চলে গেলেন তারপর কানে এয়ারপড গুঁজে ফোন স্ক্রোল করতে শুরু করলেন। এই পর্যন্ত কোনও বিস্ময় নেই। তারপর ভদ্রলোক হাসতে শুরু করলেন। যেমন আমরা হাসির রিল দেখে হাসি। আমাকে জোর করে হাসতে বললে আমি ফ্রিজ করে যেতাম বা এমন বাড়াবাড়ি করে গড়াগড়ি খেয়ে হেঁচকি তুলে হাসতাম যে সবাই ভয় পেয়ে দৌড়ত। এই ছেলেটি আমি নয়, পেশাদার অভিনেতা। হাসি পাচ্ছে অথচ পাবলিক প্লেসে হাসি চাপার চেষ্টা করেও পারছে না, অল্প অল্প, দমকে দমকে হাসি বেরিয়ে আসছে, সেই ভাবটা পারফেক্ট ফোটাতে পেরেছিল। ছেলেটার হাসি বা হাসি চাপার চেষ্টা দেখে প্রথমে একদু’জন করে, তারপর চার পাঁচ, ন’দশ করে গোটা কামরা হোহো হাসতে শুরু করল। এবং এই সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট দ্বারা প্রমাণ হল যে হাসি, মজা, আমোদ ইত্যাদি আবেগ সংক্রামক।

মাঝবয়সী কয়েকজন মহিলা, ওডিশারই মনে হল, স্নানে নেমেছেন। এবং পণ করেছেন যাই হোক না কেন একে অপরের হাত ছাড়বেন না। পুরীর সমুদ্রে স্নানের জন্য এর থেকে খারাপ স্ট্র্যাটেজি আর হয় না। একজন পড়লে বাকিদের পড়া ছাড়া সমস্ত বিকল্প বন্ধ। আবার এটাও যেহেতু সত্যি যে পড়াতেই বেশি আনন্দ, তাই এঁরা ঢেউয়ের ধাক্কায় পড়ছেন এবং ওঠার উপক্রম করতে করতে (হাত ধরে) আরেকটা ঢেউ এসে যাচ্ছে, আবার ধরাশায়ী হচ্ছেন এবং এই করে করে উঠতেই পারছেন না। এই উঠতেই না পারাটা এঁদের মধ্যে অপরিসীম ফুর্তির জন্ম দিচ্ছে এবং এঁরা ননস্টপ হেসে চলেছেন, আশপাশের স্নানার্থী এবং ভয়্যারিস্টিক দর্শনার্থীদেরও হাসির উৎস হচ্ছেন। আমরাও মিনিটদুয়েক সে আনন্দ উপলব্ধ করে হাঁটা লাগালাম।

স্নানের প্ল্যান ছিল না। এমনি হাঁটব। একবার বি এন আর হোটেলে থেকেছিলাম, তার সামনের বিচটা, বেসিক্যালি পান্থনিবাসের সামনের বিচ ফাঁকা ছিল মনে আছে। সেদিকেই হাঁটতে থাকলাম। অনতিদূরে বালির ওপর এক ভদ্রলোক বুকে হাঁটছেন। দুজনেই দেখেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারিনি। এগিয়ে বুঝলাম শরীরচর্চা হচ্ছে। ভদ্রলোক বালির ওপর উপুড় হয়ে শুয়েছেন, দুই হাতে ভর দিয়ে আপার বডি উত্তোলন করেছেন। বেসিক্যালি, অর্ধ ভুজঙ্গাসন। এবার ওই অবস্থায় দুই হাতে লাফিয়ে লাফিয়ে গোটা শরীরটাকে টেনে টেনে চলেছেন। চলেছেন সমুদ্রের উল্টোদিকে, কাজেই চড়াই উঠতে হচ্ছে। জিনিসটা করতে কী পরিমাণ জোর (শরীর এবং মনের) খরচ হচ্ছে টের পেয়ে আমাদের হাঁটার স্পিড আপসে কমে গেল। প্রায় কুড়ি হাত মতো গিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন এবং হেঁটে হেঁটে আবার শুরুর জায়গায় ফিরে এলেন। উপুড় হয়ে শুলেন, অর্ধ ভুজঙ্গাসন হলেন, শুরু হল সেই অমানুষিক পরিশ্রম।

উঠে দাঁড়ানোর সময় ভদ্রলোকের ঘর্মাক্ত রোদে পোড়া শরীরটি আমাদের নজরে পড়েছিল এবং সেই পুরোনো প্রবাদটি আবার স্বমহিমায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ভেরিফাই না করলেও শিওর আর যে কথাটা আমাদের দুজনেরই মাথায় এসেছিল সেটা হচ্ছে নাটক্র্যাকার খেতে খেতে, নেটফ্লিক্স দেখতে দেখতে সুতনু বা সুতনুকা কাউকে দেখলেই যে বলাবলি করি, চল বডি বানাই, সেটা করতে এর পর থেকে লজ্জা হওয়া উচিত।

অনতিদুরে লাল গামছার খণ্ড উড়ছে। ওডিশায় গামছা কাঁঠালিকলার সাবস্টিটিউট। গামছা থেকে একটা দড়ি বেরিয়ে বালির ওপর দিয়ে সমুদ্রে ঢুকে গেছে। মাছ ধরার জালের ও রকম দড়ি বিচের যত্রতত্র ছড়ানো। কাজেই সেটাও নিপাত্তা করেছি। করে যেই না দড়িতে পা রেখেছি, চারদিক থেকে প্রবল চিৎকার শুরু হল। অর্চিষ্মান বাঁদিকে তাকাল, আমি ডানদিকে। বাঁদিক থেকে একজন কর্তৃপক্ষ টাইপ লোক হাত নেড়ে অর্চিষ্মানকে দড়ির পেছনে যেতে বললেন, ডানদিক থেকে একটি অবভিয়াসলি বাঙালি পরিবার, দড়ির এক ইঞ্চি এপারে স্নানরত, সে পরিবারের একটি মেয়ে, কত হবে তিরিশ ম্যাক্স, চোখমুখ ঘুরিয়ে হাত নাড়িয়ে আমাকে বলল, দড়ির ওপারে গেলেই টাকা দিতে হবে।

চোখ ঘুরিয়ে প্রোলেতারিয়েত বন্ডিং ব্যক্ত করলাম। মেয়েটা হাসল।

আমাদের হেনস্থা আরেকজনও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ক্ষীণতনু ভদ্রমহিলা, খটখটে শুকনো। আমাদের মতো অন্যদের দেখে ভিক্যারিয়াস স্নানের আনন্দ নিতে বেরিয়েছেন। তিনি উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপারটাকে আরেকটু বিস্তৃত করলেন।

দড়ির ওপারটা হচ্ছে গোল্ডেন বিচ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। ওই বিচেও ঢোকা যায়, স্নান করা যায়, কিন্তু ফি-এর বিনিময়ে। সরকার টাকা পান, খদ্দের পান পরিষ্কার, ভিড়হীন বিচ। এটা খুব পুরোনো সিস্টেম বলে মনে হলে না। আগের বার ওই বিচেই স্নান করেছিলাম, টাকা দিতে হয়েছিল বলে তো মনে পড়ল না। মহিলার আমাদের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছে তখনও ফুরোয়নি। বললেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? এই প্রশ্নটার উত্তর আমরা সর্বদাই খেলিয়ে দিই। বলি যে আমরা আদতে পশ্চিমবঙ্গের, কিন্তু থাকি দিল্লিতে। মহিলা ওডিশারই লোক। মহিলা বললেন, ইজ দিস ইয়োর ফার্স্ট টাইম ইন পুরী? উত্তরে দাঁত বার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। মহিলা বুঝলেন। অফ কোর্স, মেনি টাইমস। তারপর টা টা করে এগিয়ে গেলেন।

এই ধরণের ইন্টারঅ্যাকশন আমার প্রিয়। নামধাম জানার অবকাশ নেই। কারণও না। মোলাকাতটা আমার মনে থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। যথার্থে নো স্ট্রিংস অ্যাটাচড।

গোল্ডেন বিচের দিকে হাঁটার একটা কারণ ছিল। কাল রাতের শব্দের সমুদ্রের মধ্যে ঘুমের দুঃস্বপ্ন আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল পান্থনিবাসে গিয়ে সম্ভাব্য খালি ঘরের খোঁজ নিতে। বিচ ছেড়ে রাস্তায় উঠে এলাম। এক কাপ চা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। একটু এগিয়ে ডানদিকে বেঁকলেই চওড়া ফাঁকা রাস্তা। পুরী হোটেলের সামনেটার মতো গ্যাঞ্জাম না। যে কোনও জায়গায় সকালবেলা হাঁটার আমার একটা ফেভারিট অংশ হচ্ছে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য। সাইকেলে, রিকশায়, ভ্যানে, পদব্রজে। স্নান করে, পেতে চুল আঁচড়ে দলে দলে চলেছে। মুখ দেখে আমি আর অর্চিষ্মান প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করি কার হোমওয়ার্ক হয়েছে, কার হয়নি। মনে হয় সবাইকে ডেকে বলি, কত কিছু শিখবে এখনও, জীবন কত দিকে ধাইবে, কত কিছু ঘটবে, বুকের মধ্যে কত আনন্দ টের পাবে, কত দুঃখ, কত সুখ, কত অসুখ, কত ঠিক, কত ভুল। সব মিলিয়ে একটা রুদ্ধশ্বাস, ব্রেকনেক যাত্রা শুরু হবে আর ক’দিনের মধ্যেই। বলি না, অফ কোর্স। পুরো পাগল হয়ে যাব যেদিন, বলব।

রাস্তার দুপাশে সরকারি অফিস। এখানে বাঙালি আগ্রাসন অ্যালাউ করা হয়নি, নামটাম সব ওডিয়ায় লেখা। অনেকখানি জমিঘেরা সুন্দর বাড়ি। অধিকাংশই একতলা। থাক থাক তিনকোণা জানালা। কম্পাউন্ডে আমগাছের প্রতিপত্তি। কয়েকটা অন্য বড় গাছও আছে, তেঁতুলপাতার মতো পাতা, তবু শিওর হতে পারি না।

গোল্ডেন বিচের প্রবেশপথের বাইরের রাস্তার ধারে যোগা ম্যাট পেতে ব্যায়ামের আসর বসেছে। ধরে নেওয়া যায় ব্যায়ামবীরেরা সকলেই স্বাস্থ্যের উন্নতি চান, কিন্তু যে উপায়ে তাঁরা এই উন্নতিসাধনে লিপ্ত হয়েছেন, যোগবিশারদ বা শরীরচর্চাবিদ না হয়েও নব্বই শতাংশ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, লক্ষ্যভেদ কঠিন। এর আগে কী ব্যায়াম হচ্ছিল জানি না, কিন্তু আমরা যখন তাঁদের দেখলাম, নব্বই শতাংশ নিজের নিজের ম্যাটের ওপর শুয়ে আছেন। চিত হয়ে, কাত হয়ে, উপুড় হয়ে। পাশের লোকের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে হলে জাস্ট এদিক থেকে ওদিকে গড়িয়ে যাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে দুটো গল্প মনে পড়ে গেল বলে নিই। চেনা একজন বিপাসনা ক্যাম্পে গেছিল দশ দিনের জন্য। আমরা তো খুব উৎসাহ নিয়ে, কী হল কী হল বল, বলে গ্লাস বাগিয়ে বসেছি। সে জানাল যে ঢোকার মুখে জেলে যেমন হয়, ফোনটোন সব বাজেয়াপ্ত করে নিল নেক্সট দশ দিনের জন্য। শুনেই অর্চিষ্মান ঘোষণা করল, আমি যাচ্ছি না, তুমি যেতে হলে যাও। ও সিঁড়ি উঠতে উঠতে পর্যন্ত টুইটারে ডুমস্ক্রোলিং করে, ওর পক্ষে ফোন ছাড়া বাঁচা সত্যিই শক্ত। বললাম, দাঁড়াও এখনই হাল ছেড়ো না। টোটাল মৌনব্রতর ব্যাপারটা আগেই জানা ছিল। সেটা আমার আর অর্চিষ্মানের খুব অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। আমাদের একসঙ্গে যাওয়ায় সে বাবদে সুবিধে খুব হবে না। চেনা লোক গেলে পাশাপাশি কটেজে থাকতে দেওয়া হয় না, যাতে রাতের বেলা দেওয়ালে টোকা মেরে চিটিং না করা যায়। আমার একটাই অসুবিধে লাগল, ধ্যানের পরিমাণটা মারাত্মক বেশি। খেপে খেপে প্রায় দশ বারো ঘণ্টা। একটা ঘরে সবাই সোজা হয়ে ধ্যানমুদ্রায় বসে থাকবে। মাইকে মৃদু গলায়, নিচু ডেসিবেলে গাইড বলে চলবেন, ব্রিইইদ ইইইইইন, ব্রিইইদ আআআউট। শুনতে শুনতে তোমার সমস্ত শরীরের মধ্যে থেকে যত টক্সিক চিন্তা ভাবনা বেরিয়ে যাবে। শরীরের গিঁট খুলে যাবে, মাথার জট ছেড়ে যাবে।

অর্চিষ্মান যখন জিজ্ঞাসা করল, এটা শুয়ে শুয়ে করা অ্যালাউড? বুঝলাম এ জন্মে বিপাসনায় যাওয়ার (অন্ততঃ যুগলে যাওয়ার) স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।

দ্বিতীয় গল্পটা আরেক প্রিয়জনের থেকে শোনা। সেও খুব সিরিয়াসলি যোগব্যায়ামের ক্লাস করে। সেও বলছিল, যেদিন ক্লাসের সূচিপত্রে যোগনিদ্রা থাকে, ফুল ক্লাস প্রেজেন্ট প্লিজ।

আমার একটা থিওরি আছে। যদি স্বাস্থ্যচর্চাকারীরা কাছাকাছি থাকেন, খাবারের দোকান, পার্টিকুলারলি অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান ক্যান নট বি ফার বিহাইন্ড। লোকে জিম থেকে বেরিয়েই আণ্ডাপরাঠা খায়, পার্কে দশ চক্কর মেরেই গেটে পার্ক করা ঠেলায় খাস্তা কচুরি। দিল্লিতে আমাদের একটা প্রিয় সাউথ ইন্ডিয়ান দোকান আছে, মাইসোর ক্যাফে, হোল ইন দ্য ওয়াল। কখনও কখনও সক্কাল সক্কাল ইডলি দোসা ফিল্টার কফি মেদু বড়া খেতে যাই। দোকানটা দিল্লির সাইকেলউৎসাহীরা প্রায় দত্তক নিয়ে ফেলেছেন। ডেকাথলন থেকে কেনা ফ্লুরোসেন্ট সবুজ লিক্রা জ্যাকেট, লাইটওয়েট এরোডায়নামিক রেসিং হেলমেট, মাউন্টেন বাইক জুতো, সাইকেলের খোপে গোঁজা এরগোনোমিক গ্রিপ, ওডোর কন্ট্রোল, ফ্রেশ ফিলিং ওয়াটার বটল। ডেকাথলনের। অর্চিষ্মান কিনেছিল একটা। আমি গাপ করেছি। নাটক্র্যাকার খেতে খেতে গলায় নুন আটকালে পাশ থেকে তুলে চুমুক দিই। সকাল সাতটা নাগাদ দোকানের সামনে ফুল গিয়ার পরিহিত সাইক্লিস্টদের জ্যাম লেগে যায়। ছোট দোকান, ঢোকার জায়গা থাকে না, তার মধ্যে আমাদের মতো অলম্বুষরা টেবিল দখল করে থাকলে তো আরওই চমৎকার। কিন্তু তাঁরা যথার্থ স্পোর্টসম্যান, বীরের মতো বাইরের ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে প্লেট প্লেট গরমাগরম কুড়কুড়ে মেদু বড়া আর গ্যালন গ্যালন ফিল্টার কফি খেয়ে এতক্ষণের ক্যালরি খরচের শোধ তোলেন।

যথারীতি, আমার থিওরি ফুলপ্রুফ। মোড়ের মাথায় একজন দিদি, এক কড়াই তেলে চমৎকার অস্বাস্থ্যকর জিনিস ভেজে ভেজে তুলছেন আর ডাঁই করে পাহাড়ের মতো রাখছেন। পাছে যোগব্যায়ামের দল এসে আমাদের আগেই সব ভাজাভুজি ফুরিয়ে ফেলেন, তাড়াতাড়ি অর্ডার দিলাম। বড়া, পুরী, পরোটা, ইডলি সবই আছে। যাই নেবেন, চল্লিশ টাকা। আমি মেদু বড়া ফ্যানাটিক, অর্চিষ্মান শিঙাড়া। আমার প্লেটে এক হাতা সম্বর, এক হাতা চাটনি ছড়িয়ে, অর্চিষ্মানের সামোসা ঘিরে একহাতা ছোলে ঢেলে দিদি আঙুল তুলে দেখালেন, রাস্তার ওপারে গাছের ছায়ায় দুটি লাল টুকটুকে নীলকমল চেয়ার পাতা। সম্বর টইটম্বুর প্লেট দুই হাতে ধরে পা টিপে টিপে রাস্তা পেরোচ্ছি, একটা অন্ততঃ বারো সিটার এস ইউ ভি এসে হর্ন দিতে লাগল। অদ্ভুত।

চল্লিশ টাকায় চারটে ফ্রিসবির সাইজের মেদু বড়া। শেষ করতে সময় লাগবে। অসুবিধে নেই। সামনেই একটা গেস্টহাউস। কোন একজন বাবাজীর নামে। গেস্টহাউস থেকে এক বাঙালি পরিবার বেরোলেন। খুব জল্পনা চলল। দিদির থেকেই ব্রেকফাস্ট খাবেন নাকি অটো চড়ে গ্রিনার প্যাশ্চরের সন্ধানে বেরোবেন। বেরোনোই স্থির হল। বাবা বোধহয় ক্রমাগত ঠকে যাচ্ছেন, তাই মেয়েকেই ফাইন্যান্সের রাশ ধরতে হয়েছে। কড়া গলায় বলল, পঞ্চাশ টাকার এক টাকাও বেশি দেবে না, বাবা। গেস্টহাউসের রোদেলা বারান্দায় আড়াইফুট সাইজের বালিকা। বাবামা এখনও রেডি হচ্ছেন বোধহয়। বালিকা রেডি। হলুদ জামা, কালো সানগ্লাস, বেগুনি চুড়ি, দুই ঝুঁটিতে গোলাপি ফিতে। অর্চিষ্মানের খাওয়া হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এল। মেদু বড়া শেষ না হতে হতেই চা চলে এল। চা খেলাম। মাথার ওপর তেঁতুলপাতা মার্কা পাতাওয়ালা গাছটা ঝিরিঝিরি হাওয়া দিল।

একসময় বড়া এবং চা শেষ হল। খেয়ে টাকা দিয়ে টিস্যু দিয়ে চেপে চেপে ঠোঁট মুছছি, বিশ্বাস করবেন না, উল্টোদিক থেকে সেম এস ইউ ভি-টা এসে হর্ন দিতে লাগল। অদ্ভুত।

পান্থনিবাসের মাঠ আর সমুদ্রতটের মাঝখানে সুন্দর টানা বাগান। হাঁটার রাস্তা। খাটো সবুজ বেড়া দিয়ে চৌকো চৌকো ভাগ। একেকটা ভাগের দু’পাশে লাল পাথরের প্রশস্ত বেঞ্চি। আমাদের যেহেতু কোনও এজেন্ডা নেই লাল বেঞ্চে বসার সময় আছে। অবশেষে একটা খোপের একটা বেঞ্চ খালি পাওয়া গেল। একটাই ক্যাচ। উল্টোদিকের বেঞ্চে একজন ভদ্রলোক বসে প্রাণায়াম করছেন। পা টিপে টিপে উল্টোদিকের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। ভদ্রলোকের নিভৃত ওয়েলনেস চর্চায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য খুবই অপরাধবোধ হচ্ছিল। ফিসফিস করে আলোচনা চালাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে আমার গলা অল্প জোর হয়ে যাচ্ছিল, অর্চিষ্মান অমনি আমার হাতে চিমটি কাটছিল। গলা নামিয়ে ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম কপালভাতি করতে করতে ভদ্রলোক কড়া দৃষ্টি হানছেন।

অবশেষে উনি হাল ছেড়ে মাঠ ছাড়লেন। আমরাও স্বাভাবিক গলায় গল্প করতে লাগলাম। গল্প না, তর্ক। একজনের মত ছিল যে নিজের কাজের সঙ্গে যদি সর্বক্ষণ সেই কাজের বেস্ট নমুনার তুলনা করি তাহলে সেই কাজ পৃথিবীর সামনে আনতে এমন কমপ্লেক্স হবে যে আর এনেই ওঠা যাবে না। আরেকজনের মত ছিল যে অতশত তুলনায় না গিয়ে ক্রমাগত সেই কাজটা, খারাপ হলেও, প্রোডিউস করে যাওয়া। এবং নিজের স্বস্তির মাত্রা বুঝে সে জিনিস লোকচক্ষুর সামনে আনা। কারণ ক্রমাগত অভ্যাসে কাজের কোয়ালিটি বাড়তে বাধ্য।

অনেক যুগ আগে, যখন সকলেই ব্লগ লিখত, এক ভ্রমণব্লগারের মুখবন্ধে পড়েছিলাম, তিনি ব্লগ লেখার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। কারণ ব্লগ পড়তে তাঁর মারাত্মক বোরিং লাগে। তবু তিনি ভ্রমণব্লগ কেন লিখতে শুরু করেছেন? কারণ কী করলাম, কী খেলাম, কী ভাবলাম ইত্যাদি হ্যাজানো বোরিং ব্লগে যা যা কাজের তথ্য পাওয়া যায় না সেগুলো প্রোভাইড করা। ট্রেনের সময়, প্লেনের সময়, বাসের ভাড়া, হোটেলের দাম। কয়েকটা দ্রষ্টব্য জিনিসের বর্ণনা যদি দিতেই হয় নিতান্ত দেওয়া যেতে পারে। স্ট্রিক্টলি দু'লাইন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। নিজেরা যখন নতুন কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করি ওই ধরণের ব্লগগুলোই খুঁজে দেখি। ওগুলোই কাজে লাগে। যে তথ্যগুলো আমার বেড়াতে যাওয়ার ব্লগের একশো মাইলের মধ্যেও পাওয়া যায় না।

ধ্রুপদী ছাপা পত্রিকার পারস্পেক্টিভ থেকে ভাবলেও, অবান্তরের ভ্রমণসংক্রান্ত ব্লগপোস্টগুলো স্ট্রেট ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে যাবে। একে তো কাজের তথ্য নেই, তার ওপর ক’কাপ চা খেলাম, তাতে চিনি নিলাম কি না, কে বিচে চান করতে করতে চেঁচিয়ে কী বলল, কোন এস ইউ ভি কতবার হর্ন দিল, কে ক'রাউন্ড কপালভাতি করল, ক’রাউন্ড অনুলোমবিলোম, হু কেয়ারস?

মাঝে মাঝে ভাবনাটা আমার মাথাতেও আসে না তা না। কিন্তু তারপর ভাবি, পত্রিকায় না লিখে অবান্তরে যে লিখছি সে তো এই জন্যই। সাপ ব্যাং বিচ্ছু, যা খুশি লিখব। কোনও ক্রিটিকের তোয়াক্কা না করে ছাপিয়ে দেব। আর সেটাই যদি করব, তাহলে ওই কপালভাতির এপিসোডটা আমাকে লিখতেই হবে। ওই সকালের এলিয়ে বসে থাকাটা, দূরে সমুদ্র, ভদ্রলোকের কপালভাতি করতে করতে আমাদের দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখা, আমাদের ভয়ে ভয়ে গলা নামিয়ে কথা বলা, ওই মুহূর্তটা ছাড়া দু’হাজার তেইশের পুরী ট্রিপ অর্থহীন। ওই মুহূর্তটা পৃথিবীর আর সবার কাছে যত বোরিং, আমার কাছে ততটাই ইন্টারেস্টিং। আর আমার কাছে যেটা ইন্টারেস্টিং, সেটা আমি না লিখলে আর কে লিখবে?

ফোন বাজল। বিশ্বনাথ।

কী করছেন? কী প্ল্যান আজকের?

কী আবার প্ল্যান। সকাল থেকে যা করছি, সারাদিন তা-ই করব। ওখান থেকে উঠে আবার কোথাও একটা গিয়ে বসব। সেখান থেকে উঠে আবার কোথাও।

সেটাই বললাম। এই তো, বসে বসে সমুদ্র দেখছি। কোনও প্ল্যান নেই।

চুয়াল্লিশ পার সেন্ট বিস্ময়, ছাপ্পান্ন পার সেন্ট বীতরাগ মিশিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, কী যে এত সমুদ্র দেখেন আপনারা। সেই একঘেয়ে। তার থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। চিলিকা ঘুরে আসুন।




Comments

  1. বিশ্বনাথের দয়ায় ফের পড়লে নাকি! না ওড়িশা ট্যুরিজম এর বাসেই গেলে নাকি কিচ্ছু না করে বসে রইলে?
    চমৎকার হচ্ছে আর হ্যাঁ এরকম বাজে কথাত জিনিসই পড়তে ভালোবাসি। কাজের জিনিস অনেক আছে থাক, অবান্তর খানিক অকাজেরই থাক।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
  2. একদম লাস্ট কিস্তিতে কমেন্ট করব ভাবছিলাম, কিন্তু একটা কথার প্রতিবাদ না করে থাকতে পারলামনা।
    আপনার ভ্রমণ পোস্ট অকাজের?
    আপনার লক্ষ্ণৌ পোস্টগুলো দেখে দেখে প্ল্যান করেছি, ঘুরেছি, খেয়েছি, পুরো গাইডবুক বানিয়ে।
    (এমনিতেও ঐ সিরিজ টা, আমার মনে হয়, আপনার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড গুলোর মধ্যে পড়ে।)

    খাসা লাগছে এটাও।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কতদিন হয়ে গেল লখনৌ গেছি। আবার যেতে হবে একবার।

      Delete
  3. amio tibro protibaad janachhi. arunachal ta tomaar blog porei anuprerona sudhu na...kaajer details o pelaam

    Bipasana camp shune Runaway Grave-er kotha mone holo...o jinish amaar dhara hobe na...
    phone ba chup chaap thaka ta problem na...shorbokhon arekjon-er instruction sona poshabe na

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ওখানে আই গেস লোকে তখনই যায় যখন মনে হয় নিজের হাত থেকে সমস্ত কন্ট্রোল চলে গেছে, এবার কেউ পথ না দেখালে চলবে না।

      Delete
    2. maane keu bolbe:
      Dhoro, shokto kore dhoro.. oshanti achhe? dukhho achhe? khobh achhe? Klanti achhe?

      Delete
    3. একশোয় একশো।

      Delete
  4. কিছুদিন আগে আমার মা মাসি পুরী ভুবনেশ্বর ঘুরে এলেন, গোল্ডেন বিচে চেয়ার পেতে বসেছিলেন, এটা নতুন অভিজ্ঞতা ওদেরও|
    মেদুবরা আমারও বেশি ভালো লাগে ইডলি দোসা থেকে, আবার আমি সিঙাড়ারও ফ্যানাটিক| আমি হয়ত দুটোই অর্ডার দিতাম|
    অন্যদের মতো আমিও প্রতিবাদ করছি ট্রাভেল ব্লগের ব্যাপারে| আমিও তো উদয়পুর বেড়িয়েছি পুরো তোমার ব্লগ ফলো করে| প্যারিসেও তোমার লেখা পড়ে কিছু জায়গায় গিয়েছি|
    ছোটবেলায় পুরী যাইনি তাই অন্যদের মতো পুরীর নস্টালজিয়া নেই আমার| সেটা খুব দুঃখের ব্যাপার| কয়েক বছর আগে পুরী প্রথমবার গিয়ে আমার বেশি ভালো লাগেনি| কত আশা নিয়ে গিয়েছিলাম !

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাক, জেনে ভালো লাগছে যে আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত কাজে দেয়। পুরী ব্যাপারটা, বুঝলেন অমিতা, আমার ধারণা সেই ব্যাপারগুলোর মতো যেটার সঙ্গে ছোটবেলার একটা ডিরেক্ট সংযোগ আছে। মানে ছোটবেলায় করলে বড়বেলায় ভালো লাগবে, ছোটবেলায় না করলে বড়বেলায় ভালো লাগবে না। আমাকে জীবনে প্রথমবার এখন পুরীতে গিয়ে ছেড়ে দিলে আমি বোধহয় পাঁচমিনিট সারভাইভ করতে পারতাম না।

      Delete
  5. তোমার মত এইরকম ব্লগই আমার কাছে কাজের । আগের ছবি দেখেই ভাবলাম চিলকা আসবে বোধহয় , বসে থাকলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটা চিল্কার ছবি টের পেয়েছিস? গুড গুড।

      Delete
  6. অকাজের ব্লগ পোস্টই সবচেয়ে কাজের হয়

    সুদীপ

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুনে ভালো লাগল, সুদীপ।

      Delete

Post a Comment