পুরী ১ঃ সদাশিবের সঙ্গে দেখা


অর্চিষ্মানের কনফারেন্স শেষ হতে বেলা চারটে বাজবে (পরে ছ’টা দাঁড়াল)। সকালের ফ্লাইটে ভুবনেশ্বর পৌছে এয়ারপোর্টে বসে বোর হওয়া যায়। অর্চিষ্মানের হোটেলে পৌছে বোর হওয়া যায়। 'আমার বউ এসে আমার ঘরে কয়েকঘণ্টা থাকবে' বলতে অর্চিষ্মানের প্যালপিটেশন হলে অন্য হোটেলে বসে বোর হওয়া যায়। নয়তো সোজা পুরী চলে গিয়ে বোর হওয়া যায়।

বোরডমের সঙ্গী হিসেবে হোটেলের টিভিতে সি আই ডি-র থেকে সমুদ্র বেটার। সোজা পুরীই যাওয়া স্থির করলাম। পান্থনিবাসেই খোঁজ নেওয়া হয়েছিল প্রথমে। ওয়েবসাইট খুলল না। ফোনও তুললেন না কেউ। গিয়ে দেখলাম ওঁদের একটা গোটা উইং সারানো হচ্ছে। বাকি উইং ফুল। অর্চিষ্মান সমুদ্রতটস্থিত অন্যান্য হোটেলের সাজেশন দিয়েছিল, আমি বললাম, পুরী হোটেল। এমন ভাবে বললাম যাতে অর্চিষ্মান বুঝতে পারে যে এটাই শেষ কথা।

এত হোটেল থাকতে পুরী হোটেল কেন সেটা রহস্য আবার রহস্য নয়ও। সে রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে, সব রহস্যের চাবিকাঠিই আজকাল যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, শৈশবে। লোকে মাধ্যমিকে ছড়াচ্ছে, অফিসে ধ্যাড়াচ্ছে, সম্পর্কটমপর্কের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না, সব পোস্ট-শৈশব ট্রমা সিন্ড্রোম। যত গ্যাঁড়াকল বাবামা পাকিয়ে রেখেছেন। বিশেষ করে মা। যখন গলা মোটা করা উচিত ছিল গালে চুমু খেয়েছেন, যখন গালে চুমু খাওয়া উচিত ছিল পিঠে স্কেল ভেঙেছেন, উঠতে বসতে শুতে ঘুমোতে ইতিহাসের নম্বর থেকে শুরু করে বসে আঁকোতে ঘোষবাবুর মেয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন, 'আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ' ইত্যাদি অস্ত্যর্থক আশ্বাসের বদলে 'আবাআআর সুপারহিট মুকাবলা দেখছিস্‌’ জাতীয় নঞর্থক হুংকারে আমরণ ট্রমার সৃষ্টি করেছেন, বাচ্চার ঘ্যানঘ্যানানি থেকে একমুহূর্তের মুক্তির জন্য নির্বিচারে জেমস্‌ পপিন্সের হাই ফ্রুকটোজ সুগার চাটিয়েছেন, জন্মদিনের পায়েসটা পর্যন্ত অরগ্যানিক ওয়াইল্ড মধু দিয়ে বানানোর কেয়ার করেননি, প্রোটিনটোটিনের পারসেন্ট নিয়ে মাথা ঘামানো তো ছেড়েই দিলাম। ছাঁদাবাঁধা ইস্কুলে পাঠিয়ে ইতিহাস ভূগোল ভৌতবিজ্ঞানে নম্বর পাইয়ে ভেবেছেন কেল্লা ফতে করলেন।

আজকালকার মাবাবারা ওই সব ভুল করছেন না। সবার বাচ্চাই অলটারনেটিভ স্কুলে যাচ্ছে। একটা অলটারনেটিভ স্কুলের কথা শুনলাম, মাসে দু’লাখ টাকা মাইনে, এদিকে বাথরুম নেই। মাঠ আছে। যাও, গর্ত খোঁড়ো, কাজ সেরে, মাটি চাপা দিয়ে, সালফেট প্যারাবেন ফ্রি অর্গ্যানিক সয়েল ঘষে হাত ধুয়ে ফেরত আসো। এক ট্রিপে সাসটেনেবিলিটি, সেলফ সাফিশিয়েন্সি, জীবনভরের 'আই অ্যাম বেটার দ্যান এভরিবডি এলস্‌' হাই হর্স রাইডিং ফ্রি। আমাকে যিনি খবরটা দিলেন তাঁর মেয়ের স্কুলের মাইনে এক লাখ, তাই এখনও ফ্লাশ ব্যবহার করতে হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, দুই স্কুলের তফাৎ বোঝা যায়? তিনি চোখ গোল করলেন, বোঝা যায় না আবার? আমার মেয়ে তো এখনও কিছু কথা শোনে। ওই স্কুলের গেট থেকে, দেওয়ালে, সিলিং-এ, দরজায় ছাপ্পান্ন ফন্টে মোটো ছাপা, ডাউট এভরিথিং। পড়তে বস বললে স্যাক্সোফোন বাজাতে বসবে, স্যাক্সোফোন কোথায় বললে বই নিয়ে আসবে, কাউকে প্রণাম কর বললে সেমিনার নামিয়ে দেবে কেন বয়সে বড় হওয়াটা শুধুমাত্র প্রণাম করার ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না।

দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললাম। আমার চারটাকা মাইনের সিসনর্ম্যাটিভ নিউরো-কনভার্জেন্ট বালিকা বিদ্যালয়ে একটার বেশি দেড়টা প্রশ্ন করলেই কান মুলে দেওয়া হত, “বাধ্য” ছিল পৃথিবীর সেরা সার্টিফিকেট। গত সপ্তাহে বাড়ি ঘুরে এলাম, বাবা এই তেতাল্লিশ বছরের বুড়ো মেয়েকেও বললেন, প্রণাম কর। যাকে প্রণাম করতে বললেন পঁয়ষট্টি শতাংশ প্রব্যাবিলিটি সে আমার থেকে বছরদুয়েকের ছোট। সেও প্রতিবাদ করল না, আমিও আর ঘাঁটালাম না, প্রণাম করে ফেললাম। আমার “বাধ্য” অর্জন অটুট রইল। 

এত হোটেল থাকতে পুরী হোটেলের পেছনেও আমার শৈশব এবং, বলা বাহুল্য, মা। পুরী যখনই যাওয়া হত হলিডে হোম জাতীয় জায়গায় থাকা হত। বি এস এন এল-এর, তখন ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকম ছিল, হলিডে হোম। ক্যালকাটা টেলিফোনসের হলিডে হোমও হতে পারে, অত ডিটেলস মনে রাখার বয়স ছিল না আমার। যারই হোক না কেন, হলিডে হোমগুলো হত সমুদ্র থেকে একটু ভেতর দিকে। বড় বড় অনেকগুলো ঘর থাকত। সবথেকে লোভনীয় ফিচার ছিল রান্নাঘর। সবাই উল্লসিত হতেন, দু’বেলা টাটকা শাকসবজি মাছমাংস আনা হবে, তারপর সেগুলো “সবাই মিলে” রান্না করে খাওয়া যাবে। যা ফুর্তি হবে, শেষ হয়েছিল ঘটিগুলোকে, থুড়ি, মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দেওয়ার সময়।

এই “সবাই মিলে” রান্নাবান্না করাটা একটা গ্রস আন্ডারস্টেটমেন্ট, বলাই বাহুল্য। যারা বাড়ির রান্নাঘরে রান্না করতেন, হলিডে হোমের রান্নাঘরেও রান্নাটা তাঁরাই করবেন, কিন্তু রান্নাঘরটা যেহেতু বদলে যাবে, সামহাউ তাঁদের দারুণ আনন্দ হবে। অ্যাকচুয়ালি আনন্দ হবে কি না সেটা তাঁদের থেকে কখনও ভেরিফাই করা হয়েছে বলে মনে পড়েনি। এটা আরেকটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। কখন, কোথায়, কীভাবে রান্না করলে আনন্দ বেশি হবে, বা কী রান্না করলে ঝামেলা কম হবে (ভাতে ভাত বসিয়ে দাও, বেশি ঝামেলার দরকার নেই), বা রান্না সম্পর্কে যে কোনও তাত্ত্বিক বক্তব্য তাঁদেরকেই রাখতে দেখেছি, যাঁরা রোজকার রান্নাটা করেন না।

আবার গোটা জীবন রান্নাঘরে কাটানো লোকও দেখেছি, যাঁরা পুরীর হলিডে হোমে "সবাই মিলে" রান্নাবান্না করে খাওয়ার প্রস্তাবে বালিকার মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। তখন তাঁদের শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতাম। এখন দৃষ্টি নরম হয়ে এসেছে। হয়তো সত্যিই তাঁদের রান্না করতে এত ভালো লাগত যে বাড়িতে রান্না করে আশ মিটত না, বাইরে গিয়েও রান্না করতে ইচ্ছে করত। বা করতে করতে রান্না করাটাই তাঁদের আইডেন্টিটির পার্ট হয়ে গিয়েছিল। পুরী যাচ্ছি বলে তো আইডেনটিটি বাড়িতে ফেলে যাওয়া যায় না।

কোনও একবারের বিরল পুরী যাত্রায় আমরা হলিডে হোমে না থেকে পুরী হোটেলে থেকেছিলাম। একটা হোটেল, যেখানে কাউকে রান্না করতে হয় না। বারান্দায়  বসে হাঁটু নাচাতে নাচাতে সমুদ্র দেখো। খিদে পেলে ফোন করে ঘরে খাবার আনাও, নয়তো নিচে বিচে গিয়ে মাছভাজা আর চমচম খাও, নয়তো হোটেলের নিজস্ব রেস্টোর‍্যান্টে সুন্দর সুন্দর চেয়ারটেবিলে বসে, 'এই লাও সেই লাও' বিনীত হুকুম কর। আরও বিনীত আর ভদ্র কাকুরা কাচের প্লেটে যা চাই সব নিয়ে আসবেন। তখন পৃথিবীতে যাঁকে সবথেকে বেশি ভালোবাসতাম (এখনও বাসি), সেই বেড়ানোটায় তাঁকে এত খুশি দেখেছিলাম এবং টের পেয়েছিলাম যে এই খুশিটার পেছনে সম্ভবতঃ হোটেলটার একটা ভূমিকা আছে। সেই টের পাওয়াটা আমার চেতনায় পুরী হোটেলকে একটি দীপ্তিবলয়ের মধ্যে স্থাপিত করেছিল।

পুরী হোটেল নিয়ে এত কথা বলছি কারণ এবার পুরী হোটেলে থাকার আমার সিদ্ধান্তটা ব্যাকফায়ার করেছিল এবং গোটা বাষট্টি ঘণ্টা অর্চিষ্মান “বলেছিলাম” কলার তুলে ঘুরেছিল। সে বিষয়ে পরে বিস্তারে বলব।

আপাততঃ এয়ারপোর্ট থেকে বেরোই। হোটেলের পক্ষ থেকে সদাশিববাবু গাড়ি নিয়ে আসবেন আমাকে কালেক্ট করতে। হোয়াটসঅ্যাপে গাড়ির নামধাম এসে গেছে, যার মধ্যে আমার কাজে লাগবে শুধু নম্বর। হোয়ার মেসেজে গাড়ির রকমও মেনশনড ছিল কিন্তু রকম শুনে গাড়ি চেনার চেষ্টা এ জীবনের মতো ত্যাগ দিয়েছি।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে, সেই শেষরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, টি থ্রি-র কার্ণাটিক ক্যাফেতে বসে ফিল্টার কফি খেয়ে, উইন্ডো সিটে বসে আক্ষরিক আকাশবাতাস দেখতে দেখতে, পাঁচদিনের অদর্শনের পর অর্চিষ্মানের সঙ্গে দেখা হওয়ার ফুরফুরে ফিলিংটা অবশেষে অন্তর্হিত হল। এয়ারপোর্টের লাগোয়া রাস্তায় কোটি কোটি গাড়ির স্রোত। কেউ যাত্রী নামাচ্ছে, কেউ যাত্রী তুলছে, কেউ কী করছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যাই করুক না কেন, করার সময়সীমা সাড়ে তিন সেকেন্ড অতিক্রম করলেই একজন রোগা পুলিস একটা তেলচকচকে, লম্বা বাঁশ আস্তে করে তাদের বনেটে ঠেকাচ্ছেন। 

রাস্তাও একটা না। দুটো প্যারালাল। একটা এয়ারপোর্টের লাগোয়া। একটা ছোট্ট বুলেভার্ড মতো জিনিসের ওপারে আরেকটা রাস্তাও আছে। সেটা দিয়েও স্রোতের মতো গাড়ি আসছে। সদাশিবের গাড়ি কোন স্রোতে আসবে আমি শিওর নই। এটা ততটাও সমস্যা নয়, ফোনে ক্লিয়ার করে নেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতেই সদাশিব আমাকে ফোন করলেন। তুলে 'হ্যালো' বললাম এবং বলামাত্র শেষ এবং আমার মতে গোটা পরিস্থিতির সবথেকে অপ্রত্যাশিত এবং অনতিক্রম্য সমস্যাটির সৃষ্টি হল।

জনা চারপাঁচের একটি দল। চোখে পড়েছে গেট দিয়ে বেরোনোর সময়ই। মেরুন সোনালি ইউনিফর্ম,  সেম কম্বিনেশনের টুপি। কারও হাতে ড্রাম, কারও বিউগল, কারও প্রকাণ্ড কাঁসি। বাকি সমস্যাদের মতোই আমিও তাঁদের দেখেছি এবং দেখেও আমার জীবনে তাঁদের কনসিকোয়েন্স গ্রসলি আন্ডারএস্টিমেট করেছি।

আমি 'হ্যালো' বলামাত্র তাঁরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্রসমূহ বাজাতে শুরু করলেন। কোনও কৃতী সন্তান ফিরছেন মনে হয়, অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমি চিৎকার করে "কুছ শুনাই নেহি দে রহা হ্যায়" বললাম। ওদিক থেকে ফোন কেটে গেল। বাজনাও থেমে গেল। এবং ঠিক এই ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি হল, একবর্ণ বাড়িয়ে বলছি না, মিনিমাম চারবার। সদাশিবের ফোন আসা, আমার ফোন তোলা, সদাশিবের কথা বলতে শুরু করা, জগঝম্প শুরু হওয়া, সদাশিবের ফোন কেটে দেওয়া এবং জগঝম্প থেমে যাওয়া। ওঁরা ও রকম খেপে খেপে বাজাচ্ছিলেন কেন কে জানে। কৃতী সন্তানের অ্যারাইভালের আগে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন? তাহলেও তো টানা বাজানোর কথা। মনে হয় কৃতী সন্তানকে কেউ চেনেন না, তাই বারবার ফলস্‌ স্টার্ট হচ্ছিল।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে এইসব দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি একেবারে অচেতন ছিলাম না। দু'বেলা অ্যাংজাইটির ওষুধ খাই, আমার মানসিক অবস্থার জন্য প্রতিকূলতম পরিস্থিতি অ্যানটিসিপেট করে প্রস্তুত থাকা আমার  ডি এন এ-র প্যাঁচে ঢুকে গেছে। সে রকম একটা প্রতিকূলতা হচ্ছে ভিড়ের মধ্যে কাউকে চিনে বার করা। কলেজে পড়ার সময় অনেক বন্ধুকে দেখেছি কনফিডেন্টলি যে চৈত্র সেল চলাকালীন হাতিবাগানে মিট আপ স্থির করতে। কেমন মজা হবে সেই কল্পনায় ভাসতে ভাসতে ফোন রেখে দিতে। ফোন রাখা আর দেখা হওয়ার মাঝের আঠেরো ঘণ্টা ডান হাতের নখ দিয়ে খুঁটে বাঁ হাতের ছাল তুলে না ফেলতে। বন্ধুর থেকে বেশি, এমনকি সোলমেট হয়ে ওঠার বেশ কিছু সিম্বল প্রকট হয়ে ওঠা সত্ত্বেও, সকাল দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে হাওড়া স্টেশনের দশ থেকে এগারো নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে দাঁড়াতে বলেছিল বলে একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।

সদাশিব তো টোটাল অচেনা। গেমপ্ল্যান ঠিক করে রেখেছিলাম। ফোন করে বলব অমুক নম্বর গেটের সামনে দেখবেন বাসন্তীর ওপর সাদা সুতোর কাজ করা জামা পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে, খরখরে শনের মতো সাদা চুল, লাল টিপ, ভোঁতা নাক, ব্যক্তিত্বহীন চিবুক। এতেই যথেষ্ট স্পেসিফিক হবে মনে হয়েছিল। এর মধ্যে মিউজিক্যাল ওয়েলকাম কমিটি, পুলিস, তেলমাখানো বাঁশ ইত্যাদি হার্ডল কল্পনা করিনি।

অর্চিষ্মান এই সব সময় থাকলে সুবিধে হয়। আমার সমস্ত শংকার সত্যি হওয়ার স্টেপ বাই স্টেপ পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকে। আচ্ছা ধর, সদাশিবকে তুমি চিনতে পারলে না। কী হবে? আমি বলব, সদাশিব রেগে যাবেন। তখন অর্চিষ্মান বলবে, উফ্‌ ওই সব ভেগ, ইমোশনাল কনসিকোয়েন্স না। অ্যাকচুয়ালি কী ঘটবে সেটা বল। আমি বলব, সদাশিব রেগে যাবেন, ভীষণ রেগে পুরী ফেরত চলে যাবেন। অর্চিষ্মান বলবে, ওকে। তখন তুমি কী করবে? আমি ভেবে বলব, উবার ডেকে আমিও পুরী চলে যাব। অর্চিষ্মান বলবে, ব্যস। মিটে গেল। 

এত কিছু করতে হল না। আমি যে মুহূর্তে চোখ সরু করে গাড়ির নম্বর চিনতে পারলাম, সদাশিবও সেই মুহূর্তে উইন্ডস্ক্রিনের ওপার থেকে হাত তুললেন। গাড়িতে উঠে পড়লাম। সাড়ে তিন কেন, দেড় সেকেন্ডও লাগল না। কোথায় যেন ঠং করে বাঁশে বনেটে কন্ট্যাক্ট হল। সদাশিবকে বললাম, লোকজনের কোনও সিভিক সেন্স নেই। দেখছে এত জ্যাম, তবু গড়িমসি করবে। বাজনা শুরু হল। কোলের ওপর তর্জনীর তাল তুললাম। 

জানালার বাইরে ভুবনেশ্বর সরে সরে যেতে লাগল। বিবেকানন্দ রোড সম্ভবতঃ নাম রাস্তাটার, সেই রাস্তায় কতগুলো ঘমাসান বাড়ি দেখলাম। শহর ছেড়ে মাঠঘাট আকাশবাতাস ক্ষেত বাঁশবন শুরু হল। ক্ষেতে ইলেকট্রিকের পোল পোঁতা। পোলগুলো সব একদিকে হেলে রয়েছে। জোর ঝড় হয়েছিল?  বড় রাস্তায় মেশা ছোট রাস্তার মোড়ের বটগাছ গুঁড়ি ঘিরে বাঁধানো বেদীতে ছোট করে ছাঁটা চুলের বালিকা ফ্রক পরে, পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পাশে প্লাস্টিকব্যাগ। কল্পনা করি ওই প্লাস্টিকের ভেতর আছে গানের খাতা। ও অপেক্ষায় আছে একটা ভ্যান কিংবা টোটোর, চেনা রাস্তা বলে মাবাবা নিশ্চিন্তে একা ছেড়ে দিয়েছেন। বিনুনিবাঁধা বালিকার সাইকেলের ঝাঁক গাড়ি পার হয়ে উল্টোদিকে চলে যায়। এসি গাড়ির বন্ধ জানালায় নাক ঠেকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে যতক্ষণ পারা যায় দেখি। ভেতর থেকেও ওদের অট্টহাসি শুনতে পাই।

জনপদ আসে। শ্যেনচক্ষু থাকি, এস বি আই-এর নীল বোর্ডের লাস্ট লাইন, কিংবা হোসিয়ারির দোকানের মাথায় রণভির সিং-এর আবক্ষ ছবির নিচে কোথাও যদি খুদি খুদি করে ইংরিজিতে জায়গাটার নাম পাই। আমার একটা গোপন অযৌক্তিক বিশ্বাস হচ্ছে, সুন্দর নামওয়ালা জায়গা আর সুন্দর নামওয়ালা মানুষ সুন্দর হয়। আসাম, ওডিশা আমার এই বিশ্বাসের পালে জোর হাওয়া দিয়েছে। মায়ের মুখে গৌরীপুরের মাঠের নাম শুনেই আমি জানতাম এই মাঠ রূপসী না হয়ে যায় না। বা যে দ্বীপের নাম মাজুলি, সে আর কত কুরূপ হবে? তেমনি একটা জায়গার নাম যদি হয় কোরাপুট, সূর্য পশ্চিমে উঠলেও সে কুদর্শন হতে পারে না। বা ভিতরকণিকা। কিংবা ময়ূরভঞ্জ। একটা দোকানের বোর্ডে লেখা দেখলাম 'সত্যবাদী সাইকেল শপ'। মনে করে রাখলাম। অর্চিষ্মানকে বলব। একটু এগিয়ে দেখলাম 'সত্যবাদী হার্ডওয়্যার স্টোর'। মিনিট পাঁচেক পর 'সত্যবাদী পুলিস স্টেশন' দেখে সত্যিটা স্পষ্ট হল।

ফোন বার করে দেখলাম, রাস্তার মিনিট তিরিশ মতো বাকি। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী যেতে লাগে দেড় ঘণ্টা। অন্ততঃ তিনঘণ্টা যদি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা না যায়, তাহলে আর বেড়াতে গিয়ে লাভ কী? রাস্তাটাকে লম্বা করার আশায় রিয়ারভিউ আয়নায় চোখ রেখে জানতে চাইলাম, চা পাওয়া যাবে কোথাও?

আস্ক অ্যান্ড ইউ শ্যাল রিসিভ। সদাশিব জানালেন, যাবে। একটু পরে, ভালো চা পাওয়া যাবে। আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ কোনও তাড়া নেই। মিনিট পাঁচের মধ্যেই বাঁদিকে একটা দোকানের দলের সামনে গাড়ি স্লো হল। দরজা খুলে নামতে যাব, সদাশিব আমার আগে নেমে পড়লেন। আপনি বসুন, আমি এনে দিচ্ছি। না না সেকি, বললাম। কানে নিলেন না। সাহস বেড়ে গেল। জানালা নামিয়ে বললাম, চিনি ছাড়া হবে কিনা একটু জিজ্ঞাসা করুন না।

কথোপকথনের পর সদাশিব মুখ ঘুরিয়ে জানালেন, রেডিমেড পাওয়া যাবে না তবে বানিয়ে দেওয়া যাবে। আমি বললাম, না না  সে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে, চিনিশুদ্ধুই খেয়ে নেব। সদাশিব বললেন, আপনার তাড়া আছে বুঝি? আমি বললাম, আমার তো কোনও তাড়াই নেই। কখনওই থাকে না (এটা জোরে বলিনি), ভাবলাম আপনার যদি থাকে।

চিনি ছাড়া চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনের টুলে বসলেন সদাশিব। বারদুয়েক সাধলাম, চা বা টা কোনও বিকল্পতেই ঘাড় পাতলেন না। আমি গাড়ির দরজা খুলে, বাইরের দিকে পা ঘুরিয়ে বসলাম। চা এসে গেল। একটা কুকুর গোল্লা পাকিয়ে শুয়ে রইল। একটা মাছি ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে গোটা দৃশ্যের একমাত্র সাইন্ডস্কেপ তৈরি করল। বুকের ভেতর খতিয়ে, খুব খতিয়ে খননকার্য চালিয়ে, মগজের কোণায় কোণায় সার্চলাইট ফেলে দেখলাম, এক্স্যাক্টলি ওই মুহূর্তটায় আমার সত্যিই কোনও দুঃখ নেই।


Comments

  1. "তখন তাঁদের শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতাম। এখন দৃষ্টি নরম হয়ে এসেছে।"
    Sotyi, joto boyesh badchhe, ager generation ke onektai notun chokhe dekhte parchhi.

    "কখন, কোথায়, কীভাবে রান্না করলে আনন্দ বেশি হবে, বা কী রান্না করলে ঝামেলা কম হবে (ভাতে ভাত বসিয়ে দাও, বেশি ঝামেলার দরকার নেই), বা রান্না সম্পর্কে যে কোনও তাত্ত্বিক বক্তব্য তাঁদেরকেই রাখতে দেখেছি, যাঁরা রোজকার রান্নাটা করেন না।"
    Absolutely!!!

    Ei duto ukti khub bhalo laglo. Baki lekhato shundor. Oi welcome korar jonyo jogjhompo bajano ta ban howa uchit. Ekbar Delhi airport e ota face korar por, ami ota niye khub atonkito thaki!!!

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা সুতীর্থ, আপনাকে অভ্যর্থনা করতে ব্যান্ডপার্টি এসেছিল দিল্লি এয়ারপোর্টে?! আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ লোক মনে হচ্ছে।

      আপনার উপস্থিতি অবান্তরে এতদিন পরে পেয়ে খুশি হয়ে রসিকতা করে ফেললাম। আশা করি রাগ করবেন না। আমার মতের সঙ্গে আপনার মত মিলতে দেখে সবসময়েই ভালো লাগে। ভালো থাকবেন।

      Delete
    2. Arey amake welcome korte ele to ami ota koto important sheta niye bhashon diye ditaam. Onyor welcome chhilo bolei to associated oshubidhe gulo hade hade ter peyechhilam.

      iti
      Shuteertho

      Delete
    3. 😀আপনার সততায় মুগ্ধ।

      Delete
  2. bah. porei besh chhobi ta shamne bheshe elo. baki porbo gulor opekhyae roilam.
    aar iye, baaje experience keno? side-er diker ghor chhilo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. যে ঘরগুলো সবথেকে লোভনীয় হওয়ার কথা সেগুলোই নিয়েছিলাম, অর্পণ, একেবারে রাস্তার ওপরে, সমুদ্রের ভিউওয়ালা। প্রাণঘাতী অভিজ্ঞতা। পরের বার যদি পুরী হোটেলে থাকি আর ওই ভুল করছি না।

      Delete
  3. লেখার গুণে ভুবনেশ্বর পুরীর মত চেনা রাস্তাও মনে হচ্ছে নতুন জায়গার গল্প পড়ছি , তাড়াতাড়ি লিখো পরের গুলো। সদাশিব দিয়ে শুরু হয়ে সেই সদাশিবের গল্প গুলো মনে পড়ল, এরপর সদাশিবের দৌড়াদৌড়ি কাণ্ড হয়তো 😊

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ঊর্মি। আমার তো তাড়াতাড়ি লিখতেই ইচ্ছে করে, কিন্তু লোকটাই ঢিলে কি না।

      Delete
  4. আমার এই কথাটা খুব মনের মতো হয়েছে -কখন, কোথায়, কীভাবে রান্না করলে আনন্দ বেশি হবে, বা কী রান্না করলে ঝামেলা কম হবে (ভাতে ভাত বসিয়ে দাও, বেশি ঝামেলার দরকার নেই), বা রান্না সম্পর্কে যে কোনও তাত্ত্বিক বক্তব্য তাঁদেরকেই রাখতে দেখেছি, যাঁরা রোজকার রান্নাটা করেন না।
    আমার তো কোথাও বেড়াতে গিয়ে রান্না করার কথা ভাবতেই ইচ্ছে করেন| আমার বর তো জীবনেও ভাতে ভাত খায়নি, কখনো লম্বা জার্নি করে এসে যদি বলি আলু সেদ্দ ডিম সেদ্ধ করি, তখন বলে ডিম সেদ্ধ করে ঝোল করে ফেললে হয়না? ডিমের ঝোল যেন কত ঝামেলাবিহীন, এর চেয়ে তো ফ্রোজেন ফিলে দিয়ে মাছের ঝোল অনেক সোজা |
    খুব ভালো লাগলো পড়ে, পুরি হোটেল কেন এবার খারাপ লাগলো সেটা জানার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি|
    "এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে, সেই শেষরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, " ঠিক বুঝতে পারলাম না- এয়ারপোর্ট থেকে beriye টি3 তে কিভাবে কফি খেলে

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটা কপি পেস্ট করতে গিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে, অমিতা। পাবলিশ করার আগে এতবার দেখি, তবু ভুল থেকেই যায়। কেয়ারলেস মিস্টেকের সমস্যা আমার সেই ছোটবেলা থেকে। ঠিক করে দিলাম। থ্যাংক ইউ।

      বেড়াতে গিয়ে ছাড়ুন, আমার তো বাড়িতে রান্না করতেও কান্না পায়। আমাকে একবার দশটা ঢ্যাঁড়স ভেজে নেক্সট দশ ঘণ্টা রেস্ট নিতে হয়েছিল। বুঝুন অবস্থা।

      Delete
    2. আহা সে কথা বললে বিশ্বাস করবো? তুমি না পোর্ক ভিন্দালুর রেসিপি দিয়েছিলে আর আমি সেই রেসিপি দিয়ে কয়েকবার বানিয়েওছিলাম| হাহা কত বছর হয়ে গেল বলো?

      Delete
    3. দুদিন বাদে দিল্লির টিথ্রী তে আমিও নামছি| কার্নাটিক কাফে খুঁজে দেখবো|

      Delete
    4. অমিতা, ওটা অ্যারাইভালের কাছাকাছি পাবেন কি না আমি শিওর নই। যদি টি থ্রি দিয়েই ফেরত যান তাহলে সিকিউরিটির পর দোতলায় উঠে, যেখানে ম্যাকডিট্যাকডি আছে, একটু বাঁদিক ঘেঁষে কার্ণাটিক ক্যাফে পাবেন। ফিল্টার কফি খাবেন আর খেতে খেতে আমার কথা মনে করবেন অবশ্য করে।

      Delete
    5. আসলে টিথ্রিতে নেমেছি আর ওখান থেকে ডোমেস্টিক উইংয়ে গিয়ে আবার কলকাতার প্লেনে উঠেছি| ফুডকোর্টে গিয়ে কার্নাটিক ক্যাফে দেখে এসেছি| কফি আর খাইনি, বারো ঘন্টা ধরে চা কফি খেতে খেতে এসেছি ডিরেক্ট ফ্লাইটে| কিন্তু দেখে রাখলাম আর দিল্লী এয়ারপোর্টে একটা কুন্তলার কথা মনে করার জায়গা হয়ে থাকলো| ওই উইংয়ে আর কি ভালো পাওয়া যায়?

      Delete
  5. চমৎকার লাগছে। জানো আমারও সদাশিব পড়েই শরদিন্দুই মনে পড়েছে।
    আমাদের দুজনের এখনো পুরী যাওয়া হয়নি একসাথে। পুরী আজকাল বড্ড দামী জায়গা হয়ে গেছে। আর পুরীতে মেলা খরচ করতে গেলেই মনে হয় আহা এই টাকায় পাহাড় ঘুরতে যাই, পুরীর জন্যে তো সারাজীবন আছে। কিন্তু নাহ এবার পুরী যেতেই হবে।
    সরি তোমার পোস্টে বেজায় বকে নিলাম।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটুও বকোনি। পুরী বোধহয় একটু বুড়ো হলে যেতে হয়। হয় একেবারে গেঁড়ি বয়সে বুড়োদের সঙ্গে যাও, নয় বুড়ো বয়সে গেঁড়িদের সঙ্গে (বা গেঁড়িহীন) যাও। গনগনে যৌবনে কেউ পুরী যায় না। কাজেই তোমাদের অনেক টাইম আছে।

      Delete
  6. এই “সবাই মিলে” রান্নাবান্না করাটা একটা গ্রস আন্ডারস্টেটমেন্ট, বলাই বাহুল্য। যারা বাড়ির রান্নাঘরে রান্না করতেন, হলিডে হোমের রান্নাঘরেও রান্নাটা তাঁরাই করবেন, কিন্তু রান্নাঘরটা যেহেতু বদলে যাবে, সামহাউ তাঁদের দারুণ আনন্দ হবে। অ্যাকচুয়ালি আনন্দ হবে কি না সেটা তাঁদের থেকে কখনও ভেরিফাই করা হয়েছে বলে মনে পড়েনি। এটা আরেকটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। কখন, কোথায়, কীভাবে রান্না করলে আনন্দ বেশি হবে, বা কী রান্না করলে ঝামেলা কম হবে (ভাতে ভাত বসিয়ে দাও, বেশি ঝামেলার দরকার নেই), বা রান্না সম্পর্কে যে কোনও তাত্ত্বিক বক্তব্য তাঁদেরকেই রাখতে দেখেছি, যাঁরা রোজকার রান্নাটা করেন না।""
    on point !

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখে দেখে চোখ ব্যথা হয়ে গেল, অন্বেষা।

      Delete

Post a Comment