রামগড় ৩/ শেষ পর্ব
শনিবার রাতে আধো ঘুমের মধ্যেই কানে আসছিল। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড়ানি,
গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার দড়াম, মিহিগলার চেঁচানি, মোটাগলার বকুনি, বুটের ধুপধাপ, কচি
পায়ের দুড়দাড়। রবিবার সকালবেলা ঘুম ভেঙে উঠে বারান্দা দিয়ে উঁকি মারতেই হাতেনাতে
প্রমাণ পাওয়া গেল। নিচের চাতাল গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। শনিবার সারাদিন ধরে
দূরদূরান্ত থেকে ড্রাইভ করে লোকজন রামগড়ে এসে পৌঁছেছেন, গেস্টহাউসে আমাদের একলার রাজত্ব
শেষ।
এঁরা এসেছেন, আমরা ফিরব। ফেরার দিন আমাদের ঘরে একটা মিশ্র অনুভূতি বিরাজ করে।
অর্চিষ্মানের সমস্যা কম। ওর বেড়াতে যেতেও ভালো লাগে, বাড়ি ফিরতেও ভালো লাগে। আমার
বাড়ি কেন, যে কোনও রকম ‘ফেরা’র কথা শুনলেই মনে হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে ভেউ ভেউ
কাঁদি। দুঃখ ঠেকিয়ে রাখার জন্য আমরা ব্রেকফাস্টে পাঁউরুটির বদলে আলুপরাঠা খেলাম।
সঙ্গে আচার আর দই। খেয়েদেয়ে হাঁটতে বেরোনো হবে।
ফেরার দিন সকালবেলায় হাঁটতে বেরোনোটা ক্রমশ আমাদের পারিবারিক ট্র্যাডিশনে
পরিণত হচ্ছে। এলোমেলো, দিকশূন্যহীন হাঁটা। জায়গাটাকে চলন্ত গাড়ির আর হোটেলের নেট
দেওয়া জানালার ভেতর থেকে না দেখে, চোখ কান নাক গলা হাত পা সারা গায়ের চামড়া দিয়ে
ছুঁয়ে দেখা।
একেবারেই যে জানা ছিল না কোথায় যাব সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে অবশ্য। এসে থেকে
দেখছি গেস্টহাউসের পেছনে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে ফলবাগানের সারি। আশপাশের সব
পাহাড়ের গায়েই আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়ের সবুজ চুলে কেউ যেন চিরুনি
চালিয়েছে। আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করলাম অরচার্ডে যাওয়া অ্যালাউড কি না। ঢুকে পড়লাম
তারপর ঠ্যাঙা নিয়ে মারতে এল, এই বয়সে সে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। রিসেপশনিস্ট অভয়
দিয়ে বললেন, আরে অ্যালাউড বলে অ্যালাউড? এ কি প্রাইভেট অরচার্ড পেয়েছেন নাকি,
খাঁটি সরকারি বাগান। ভুখ লাগলে হাত বাড়িয়ে পটাং করে আপেল ছিঁড়ে বেঝিঁঝক খাবেন।
বিছানা ঝেড়ে, ড্রয়ার টেনে, উবু হয়ে বসে খাটের তলা পরীক্ষা করে, ব্যাগ গুছিয়ে
খাটের ধারে পরিপাটি করে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। পাকা রাস্তা আমাদের পাশে পাশে চলল,
আমরা পাহাড়ের গায়ের সরু কাঁচা রাস্তা ধরে চললাম। গরমে সে রাস্তার চেহারা কেমন থাকে
জানি না, তবে ভরা বর্ষায় জঙ্গল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সাদা, বেগুনি, গোলাপি
ঘাসফুলে ছেয়ে গেছে মাটি। তার মধ্যেই চাষের কাজ চলছে। একফালি ছোট জমিতে ফুলকপি
লাগানো আছে দেখলাম। দেখে তো ফুলকপি বলেই মনে হল, অন্য কিছু হলেও জানি না।
শহরের বাইরে গেলেই গাছপালা সম্পর্কে জ্ঞানের বহর ক্ষণেক্ষণে বেরিয়ে পড়ে। ওই
জমজমাট আলুপরাঠার পর আমাদের বাঙালি পেটে নেক্সট আটঘণ্টার মধ্যে ভুখ লাগার কোনও
সম্ভাবনা ছিল না, তবে লাগলেও কিছু করার ছিল না। কারণ বাগানে আপেল আর কিছু বাকি
নেই। বেশিরভাগ গাছই খালি। সব কাঠের বাক্সে পুরে বাজারে চলে গেছে। তাতে আফসোস নেই,
তবে মুশকিল একটা আছে। জলজ্যান্ত আপেল প্রমাণ হিসেবে গায়ে সেঁটে না থাকলে আপেল গাছ
চেনা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। একটা গাছে গোল গোল মতো কী সব ঝুলে থাকতে দেখে ‘আপেল
গাছ! আপেল গাছ!’ বলে দৌড়ে গিয়ে দেখি সেটা আসলে একটা অতিপ্রসবিনী ন্যাসপাতি গাছ।
হতাশ হয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। গন্তব্যের বাঁধন নেই কিন্তু ঘড়ির বাঁধন তো আছেই। আবার
মেঠোপথে জমে থাকা বৃষ্টিজলের ছোট্ট পুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে নামছি এমন সময় একটা আওয়াজ হল।
বাপ রে বাপ সে কী আওয়াজ। কর্ণপটহ বেঁধানো, রক্ত জমানো, গলা খটখটানো। লাফিয়ে উঠে
আশেপাশের তিনটে ঘাসফুল পাড়িয়ে দিয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার। এবার আওয়াজটা
চিনতে পারলাম। গাড়ির হর্ন। ‘ধুম মচা দে ধুম মচা দে’ গানটার গোটা প্রথম লাইন। এদিকওদিক তাকিয়ে উৎস
নজরে পড়ল।
ভওয়ালির বাস।
আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। নিশ্চল, অপার্থিব, আদিগন্ত একটা দৃশ্যের ভেতর
খেলনার মতো বাসটা কেমন গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে। টল্লা থেকে ছেড়ে মল্লার দিকে আসছে। ভেতরে
গাদাগাদি করে বসে, দাঁড়িয়ে, ত্রিভঙ্গ হয়ে আছে লাখখানেক মানুষ। আজ রবিবার, নয়তো
ভারি ব্যাগ পিঠে নেওয়া হেসে গড়িয়ে পড়া কিশোরীর দলও নির্ঘাত থাকত। কাল আমরাও ছিলাম।
টেনশনে ঘামছিলাম। সে টেনশন আজ স্মৃতি হয়ে গেছে। সুখস্মৃতি।
গেস্টহাউসের বিল মিটিয়ে ঘরে এসে বসতে না বসতেই আরেকটা হর্ন কানে এল। এবার আর
চমকালাম না। এই হর্নটার জন্যই কানখাড়া করে রেখেছিলাম এতক্ষণ। বারান্দায় এসে উঁকি
মারতেই পবন সিং-এর হাসিঝলমল মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। ‘রেডি, সার?’ রেডি বইকি। ঘর
থেকে বেরোনোর আগে অর্চিষ্মান বিড়বিড় করে ব্যাগ গুনল। এক, দুই, তিন। আমার দিকে
তাকিয়ে বলল, ‘ইম্পরট্যান্ট জিনিসগুলো নিয়েছ তো মনে করে কুন্তলা? মানিব্যাগ? আই ডি?
বাড়ির চাবি?’
আমি ব্যাগের খোপ, জিনসের পকেট পরীক্ষা করলাম। সব নিয়েছি। কিন্তু আরও একটা
ইম্পরট্যান্ট জিনিস আছে। সেটা ভুললে চলবে না। বুকের মধ্যে উঁকি মেরে দেখলাম।
রামগড়ের পাহাড়ের মাথা থেকে চুরি করে নেওয়া কালো মেঘের টুকরোটা যথাস্থানে আছে কি না।
আছে। যাক, বাঁচা গেল। আমি অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে বললাম, '‘কিচ্ছু ভুলিনি। চল, এবার বেরোনো যাক।’
Last photota khub sundor Kuntlala di.. pelling e giye amder o oi ATM kando hoyechilo.. 2 to ATM out of order chilo.. ar paye he(n)te ghorar bapar tay tomar sathe mil pelam.. specially pahari elakay oi ghorata darun lage.. :)
ReplyDeleteধন্যবাদ ঊর্মি। এ টি এম আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এএমন ঢুকে গেছে যে হাতের কাছে না থাকলে বিপদ। পাহাড়ে ঘুরতে তোমারও ভালো লাগে জেনে খুশি হলাম।
Deleteki sundar ! - tinni
ReplyDeleteসত্যি ভীষণ সুন্দর, তিন্নি।
DeleteEto kichu dilen, alu porota er chobi ta jodi diten!!!
ReplyDeleteআরে অর্ণব, নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পকোড়ার প্লেট সামনে রেখে নানারকম কায়দা করে, হাঁটু গেড়ে, চেয়ারে চড়ে, তার ছবি তোলা যায়। প্রকাশ্য ক্যান্টিনে আলুপরোটার সঙ্গে ও সব করতে গেলে পাগল ভেবে আমাদের কান ধরে হোটেল থেকে বার করে দেবে। সেই ভয়ে ক্যামেরা নিয়ে খেতে যেতাম না।
Deleteশেষটা অসাধারণ হয়েছে। আর আপেল আর ন্যাসপাতির গাছ দেখতে অনেকটা একই রকম, কাজেই আপনার কোনও দোষ নেই।
ReplyDeleteবলছেন? যাক তাহলে আর বেশি লজ্জা পাচ্ছি না। থ্যাংক ইউ।
Delete"বুকের মধ্যে উঁকি মেরে দেখলাম। রামগড়ের পাহাড়ের মাথা থেকে চুরি করে নেওয়া কালো মেঘের টুকরোটা যথাস্থানে আছে কি না।" ... osadharon. ar last chhobita . darun laglo রামগড়ে berie aste... :-) .
ReplyDeleteধন্যবাদ ধন্যবাদ, ইচ্ছাডানা।
Deleteek kathay ashadharan....khub shundor hoyeche. r amar-o na phera-r name kanna pay. r eta amar konna-r moddheo bortiyeche. darun ghora holo Ramgarh. ebar onno kothao tomar shathe jaowar apekkhay roilam
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, দেবশ্রী। তোমার মেয়েকে আমাদের দলে পেয়ে খুশি হলাম। আমিও অলরেডি নেক্সট বেড়ানোর দিকে তাকিয়ে বসে আছি। দেখা যাক, কবে হয়, কোথায় হয়।
Deletelast line ta emon likhle..mane sesh bole chokka hakano holo...kintu jiteo moner bhitor ta byatha byatha korche..paro o bote!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, পারমিতা।
Deleteঅনেকদিন পর অফিসের কজের ব্যস্ততা কিছুটা কম থাকায় এ-ব্লগে ঢুকলাম - ঢুকে দেখলাম ভুল করিনি - খুব সুন্দর লেখা - এবার কারোর জমজ বাচ্চা হলে আর তাদের ডাক-নাম সাজেস্ট করতে হলে 'মল্লা-টল্লা'-র কথা ভাবা যাবে...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, কুন্তল। এক্স্যাক্টলি, মল্লাটল্লা নাম হিসেবেও চমৎকার। তার সঙ্গে বাচ্চার চরিত্রটা যদি একটু ষণ্ডাগোছের হয়, আর গালগুলো খুব ফুলোফুলো, আর মুখ সর্বদাই গম্ভীর, তাহলে দারুণ মানাবে।
Deleteতিনটে পর্ব একটানে পড়ে তবে কমেন্ট করা গেলো। ভাগ্যিস আমি এতদিন পড়ে পড়ছি না হলে ওই একটু পড়ে আবার অনেক অপেক্ষা সে বড় কঠিন ব্যাপার। এমন চমৎকার ভ্রমন কাহিনী লেখেন আর কাল খামোখাই আমি ভেবেছি আমার বেড়ানোর গল্প শোনাবো । জায়গাতা wishlist এ রইল দেশে ফিরে কত্ত কি যে দেখার আছে :)
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ। লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। সত্যি, দেশে দেখার জায়গার অভাব নেই।
Delete