R. I. P./ দ্বিতীয় পর্ব
অবিরাম ভট্টাচার্য,
আপাদমস্তক ব্যর্থ একজন মানুষ, মরে গিয়ে স্বর্গে এসে উপস্থিত হয়েছেন। মর্ত্যের মতোই
স্বর্গেও তিনি আমল পাননি, তাঁর ঠাঁই হয়েছে মধ্যমেধা হোস্টেলের একতলার ঘরে। বেঁচে
থাকতে অবিরামের যে দুটো কাজ করতে ভালো লাগত তার একটা হচ্ছে বাগান করা আর একটা
কবিতা লেখা। বাগান তাঁর হাতে বাগ মেনেছিল, কবিতা মানেনি। অন্তত পাঠকসংখ্যা,
পরিচিতি ইত্যাদি দিয়ে যদি বিচার করতে হয় তবে।
জীবনে কেউ না পুঁছলেও
অবিরামের মৃত্যুর খবরটা কে যেন ফেসবুকে আপলোড করে দিল। তাঁর ভোটার আই ডি-র
ছবির তলায় পরিচয়ের জায়গায় লিখে দিল ‘কবি’।
বেঁচে থাকতে অবিরাম এক
ঘরোয়া সাহিত্য আড্ডায় নিয়মিত হাজিরা দিতে যেতেন। কীসের আশায় ভগবানই জানেন। কারণ সে
আড্ডার হোতা, বরাভয় বাগচী, অবিরামকে একচুলও পাত্তা দিতেন না। অবশ্য বরাভয়বাবুর
স্বভাবটাই পাত্তা দেওয়ার নয়। কিছু কিছু লোক থাকে পৃথিবীতে, যারা দুনিয়ার কাউকে
পাত্তা দেয় না, কেবলই নিজের জন্য পাত্তা চায় (এবং পায়ও), বরাভয় হচ্ছেন সেই জাতের
মানুষ। এই পর্বের গল্প তাঁকে দিয়েই শুরু হচ্ছে।
*****
ডাঁই করা নোংরা বাসনের ওপর
ছড়ছড়িয়ে পরা কলের জলের শব্দে বরাভয়ের ঘুম ভাঙল। খানিকক্ষণ শুয়ে রইলেন তিনি। শুয়ে
শুয়ে জলের শব্দ, কাকের ডাক, ভুঁড়ির ওপর এসে পড়া রোদ্দুরের ওম শুষে নিতে লাগলেন।
দক্ষিণ-পূর্বের এই ঘরটার
দখল না ছাড়ার সিদ্ধান্তটায় নিজের পিঠ নিজেই আর একবার চাপড়ে দিলেন বরাভয়। হাঁটুর
ব্যথায় গিন্নি একতলা ছেড়ে উঠতে পারেন না। ছেলে ছেলের বউয়ের ইচ্ছে ছিল বরাভয়কেও
একতলায় চালান করে দিয়ে নিজেরা দোতলার দু’খানা ঘর জুড়ে হাত পা খেলিয়ে থাকবে।
‘রাতবিরেতে মা’র একা
অসুবিধে হয় যদি, সেই জন্যই বলছিলাম বাবা। না হলে থাকুন না আপনি আমাদের কাছে কাছে।"
ঘোমটায় ঘাড় ঢেকে বলেছিল
ছোটবউ। শান্তিপুরের মেয়ে ঘরে এনেছেন, গোড়া থেকেই সতর্ক ছিলেন বরাভয়। ওদিককার লোক মিষ্টি
কথা বলতে বলতে গলায় ছুরি বসাতে পারে।
‘আরে মায়ের শরীরটাই দেখলে
বৌমা? বাবার দিকটা একটু ভাবলে না? একতলায় থাকলে আমি দমবন্ধ হয়েই মারা যাব। তখন
আবার তোমাদেরই বেশি ঝামেলা হবে।’
‘তার থেকে আমি বরং এই কোণার
ঘরটাতেই পড়ে থাকব’খন।. . . হা হা হা, আরে কী যে বল বৌমা। আমরা মাঠেঘাটে খেটে
খাওয়া মানুষ, অ্যাটাচ বাথ আমাদের লাগে না।’
প্রসন্ন মনে শুয়ে শুয়ে
বরাভয় ভাবতে লাগলেন আজ সারাদিন তাঁর কী কী করার আছে। ফেসবুক, বাজার, ফেসবুক।
ইদানীং স্নিগ্ধচ্ছন্দা দেবীর লেখা সাম্যসিদ্ধান্ত বইটি পড়ছেন বরাভয়। পড়া হয়ে গেলেই
সাধারণের বোধগম্য ভাষায় লিখে ফেলবেন। সারাজীবন সেলসম্যানের চাকরি করলে কী হবে,
মাস্টারি তাঁর রক্তে। রিটায়ার করার পর লোককে জ্ঞান দিতেই তাঁর সময় কেটে যায়। তাঁদের মতো পড়াশোনা জানা লোকেরা যদি এইটুকু না
করতে পারেন তাহলে সাধারণ লোকদের জ্ঞানতৃষ্ণা মিটবে কী করে।
সাধারণ মানুষের জন্য নিজের
আত্মত্যাগের কথাটা মাথায় আসতেই বরাভয়ের হাতে পায়ে অভূতপূর্ব এনার্জির সঞ্চার হল।
‘মা মাগো, তুলে নে মা’ হুঙ্কার ছেড়ে তিনি বিছানা থেকে উঠে পড়লেন।
সাম্যসিদ্ধান্ত তো আছেই,
কিন্তু তার আগে ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা পৃথিবীকে জানানো দরকার। যৌবনে থিয়েটার দল
খুলেছিলেন বরাভয়, লাগসই এন্ট্রির মর্ম তিনি জানেন। দিনের প্রথম স্টেটাস মেসেজটির
গুরুত্ব অসীম। ওটাই বাকি দিনটার সুর বেঁধে দেবে। দাঁত মাজতে মাজতে বরাভয় ঠিক করে
ফেললেন আজ তিনি কী লিখবেন।
'আজকের মতো সুন্দর
সকালগুলোতে ঘুম ভেঙেই মনে হয়, জীবনে কিছুই কি করতে পারলাম? কিছুই কি দিয়ে যেতে
পারলাম পৃথিবীকে? নাকি শুধু নিয়েই গেলাম? আপনারও কি এমন মনে হয় বন্ধু? নাকি
আপনি নিজের ক্ষুদ্র সুখদুঃখ, তুচ্ছ দৈনন্দিনতায় মগ্ন থাকতে পারেন? যদি পারেন তবে
আপনাকে আমি হিংসে করি।'
বাঃ। ছোট্টর মধ্যে বেশ
ফুটেছে মনের ভাবটা। বিনয়, সারকাজম্, প্রজ্ঞা – তিনটিই যথাযথ প্রকাশ পেয়েছে।
ফুরফুরে মেজাজে কম্পিউটারে
এসে বসলেন বরাভয়। নিজের কথাক’টি টাইপ করার জন্য তাঁর আঙুল নিশপিশ করছিল। স্ট্যাটাস
মেসেজের নিচে লাইক ও গুণমুগ্ধ কমেন্টের সংখ্যা কল্পনা করে তিনি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে
উঠছিলেন।
দুর্গা বলে লগ ইন করলেন
বরাভয়। করেই তাঁর বাক্যবন্ধ হয়ে গেল।
এ
কী? সকাল মোটে আটটাও বাজেনি, এর মধ্যে এত লোক এত কথা বলে ফেলেছে কী করে? সারারাত কেউ
ঘুমোয়নি নাকি? আর এ সব কী কথা? RIP, স্যালুট, সেলাম, সশ্রদ্ধ, অপরিসীম, ক্ষতি, বিপ্লবী,
চিরন্তন . . .
কেউ
একটা ফুটে গেছে। এখন সুখদুঃখ নিয়ে ভ্যানতাড়া করলে বেশি লাইক পড়ার চান্স নেই।
বরাভয়ের মাথা দ্রুত চলতে লাগল। ভাগ্যিস ছোটবেলায় গীতার ইম্পরট্যান্ট কয়েকটা মন্ত্র
মুখস্থ করে রেখেছিলেন, এখন এই সব ক্রাইসিসে কাজে দিচ্ছে। এই সব সিচুয়েশনে বাসাংসি জীর্ণানি-র
কথাটাই প্রথম মাথায় আসে, কিন্তু ওটা এখন এলিতেলিও জেনে গেছে। চলবে না। আনকমন শ্লোক চাই। আর
একটা যেন কী ছিল . . . জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ/ তস্মাদ . .
. তস্মাদ . . . এই কেলো করেছে। যাকগে মরুকগে। এ ব্যাটাদের জন্য এক
লাইনই যথেষ্ট, বাকিটুকু ডট ডট দিয়ে ম্যানেজ করে দেবেন এখন।
ভাবতে ভাবতেই স্ক্রিনে
পরিমল পাণ্ডার মেসেজ ভেসে উঠল।
'বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
. . .'
হুইশ্শালা। কালক্ষয় না করে
বরাভয় টাইপ করতে শুরু করলেন। যারা সংস্কৃত বুঝবে না তাদের জন্য জীবনের অনিত্যতাটিত্যতা
নিয়ে বাংলাতেই দুয়েকটা দামি কথা লেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সে সব ভাবার এখন টাইম নেই।
ততক্ষণে ডট ডটের নিচে
পরিমলের বাকি মেসেজটা ভেসে উঠেছে।
'মেরুদণ্ডহীন বাঙালি জাতি কী হারাল তা সে নিজেও জানল
না। আমাদের মনে আপনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন কমরেড অবিরাম। RIP।'
তারপর এল একটা ঝাপসা ছবি। একটা মুখ। পেতে চুল আঁচড়ানো, চিবুকহীন। টাইপ করতে করতেই বরাভয় একবার চোখ তুলে ছবির দিকে তাকালেন। তাঁর আঙুল থেমে গেল। তাঁর মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল, শরীরের ভেতর আনচান করতে লাগল। চারদিকে হাট করে খোলা বড় বড় জানালার মাঝে আর পাঁচে ঘুরতে থাকা ফ্যানের তলায় বসে বরাভয় টের পেলেন তাঁর টাক বেয়ে ঘামের ফোঁটা নামতে শুরু করেছে।
তারপর এল একটা ঝাপসা ছবি। একটা মুখ। পেতে চুল আঁচড়ানো, চিবুকহীন। টাইপ করতে করতেই বরাভয় একবার চোখ তুলে ছবির দিকে তাকালেন। তাঁর আঙুল থেমে গেল। তাঁর মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল, শরীরের ভেতর আনচান করতে লাগল। চারদিকে হাট করে খোলা বড় বড় জানালার মাঝে আর পাঁচে ঘুরতে থাকা ফ্যানের তলায় বসে বরাভয় টের পেলেন তাঁর টাক বেয়ে ঘামের ফোঁটা নামতে শুরু করেছে।
কোনও
দিন যা করেননি তাই করলেন বরাভয়। পৃথিবীকে নিজের উপস্থিতির কথা জানান না দিয়ে
বেরিয়ে এলেন।
তিন
দিন আগেও তাঁর বাড়ি এসেছিল লোকটা। দেওয়ালের কোণাটায় বসে ছিল। গত তিন
বছর ধরে আসছে। দেওয়ালের কোণাটায় বসে থেকেছে। আড়াই, তিন, সাড়ে তিন ঘণ্টা। বাকিরা যে
যার কবিতা পড়া হয়ে গেলে সটকেছে, লোকটা বসে থেকেছে মুখে তালা মেরে। কোনও দিন নিজের
একটি কবিতার বই খুলে পড়েনি, একটি বারও অন্যের লেখা সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ
করেনি। আড্ডা ভেঙ্গে গেলে নিজের ঝোলাটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেছে। শুধু
গত শনিবার . . .
বরাভয়
থেমে গেলেন। গত শনিবার এমন একটা কিছু ঘটেছিল যা গত তিন বছরে ঘটেনি। বরাভয় মনঃসংযোগ
করলেন। রাত ন’টা নাগাদ সবাইকে হাঁকিয়ে তিনি ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, সিরিয়ালের একটা
ভালো জায়গা চলছে এখন, এমন সময় কে যেন অসম্ভব মিহি গলায় তাঁর নাম ধরে ডেকেছিল। মিহি, নড়বড়ে গলায়।
একটু
শুনবেন? বরাভয়দা?
পেছন
ফিরে অবিরামকে দেখে বিরক্তই হয়েছিলেন বরাভয়।
কী
চাই?
এ-একটা
কথা ছিল।
লোকটা
এ রকম কুঁচকে রয়েছে কেন? যারা শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়াতে পারে না তাঁদের মনের ভেতর
থেকে অপছন্দ করেন বরাভয়। না চাইতেও গলাটা খ্যানখেনে হয়ে গেল।
কী
কথা? এতক্ষণ বলনি কেন?
উত্তর
নেই। বরাভয়ের চোখ লোকটার মুখ থেকে নিচের দিকে নামল। লোকটার নুলোর মতো হাতদুটো
বরাভয়ের দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে একতাড়া সাদা কাগজ।
এটা
. . . একটু দেখবেন?
অ।
বরাভয়ের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। হুঁ হুঁ বাবা, পথে এস। অ্যাদ্দিনে ঝুলি
থেকে ম্যানুস্ক্রিপ্ট বেরিয়েছে। লিখবে, অথচ লোককে সে লেখা পড়ানোর জন্য ছোঁক ছোঁক
করবে না সে আবার হয় নাকি? পেটের মধ্যে একটা বাঁকা হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠছিল বরাভয়ের।
সেটাকে যথাসম্ভব চাপা দিয়ে তিনি আবার হুঙ্কার ছাড়লেন।
এটা
কী?
শিরদাঁড়া
আরও বেঁকে গেল। কাগজের তাড়াটা এখন থরথর করে কাঁপছে।
আজ্ঞে,
একটু লেখার চেষ্টা করেছিলাম। যদি একটু . . .
কী
লেখা?
আজ্ঞে,
কবিতা।
জানতেন
বরাভয়। বাঙালির বাচ্চা, কোবতে ছাড়া আর
লিখবেটাই বা কী?
ওরে
বাবা, এ তো অনেক কবিতা। কদ্দিন ধরে লিখছ?
উত্তর
নেই।
রেখে
যাও। দেখব’খন পড়ে। কবে ফেরত পাবে কথা দিতে পারছি না। তুমি একা তো নয়, লাখে লাখে
কবি তাড়া তাড়া কবিতা রেখে গেছে পড়ার জন্য।
অবিরামের
হাত থেকে কাগজগুলো একরকম কেড়েই নিয়েছিলেন বরাভয়।
আর
কিছু বলবে?
আজ্ঞে
না। শিরদাঁড়া আরও নুইল। হাত দুটো জড়ো হল বুকের কাছে।
এবার
আস তবে। দেহের গতিমুখ ঘরের দিকে ফেরালেন বরাভয়।
আপনাকে
যে কী বলে . . .
কিচ্ছু
বলতে হবে না। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন বরাভয়।
লাফ
মেরে উঠে টেবিলের জঞ্জাল ঘেঁটে অবিরাম ভট্টাচার্যের জমা রেখে যাওয়া
ম্যানুস্ক্রিপ্ট খুঁজে বার করে আবার কম্পিউটারের সামনে ফিরে আসতে বরাভয়ের লাগল ঠিক
সাড়ে তিন মিনিট। এঃ, কতবার বলেছেন ঢাকনা না দিয়ে চা না রাখতে, জুড়িয়ে একেবারে জল।
‘এক কাপ চা-আ-আ’ চেঁচিয়ে হাতের তালুতে এদিক ওদিক চাপড়ে আলগা ধুলো উড়িয়ে দিয়ে
ম্যানুস্ক্রিপটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন বরাভয়। মসৃণ, সাদা পাতার ঠিক মাঝখানে মুক্তোর
মতো হাতের লেখায় লেখা কবিতা সংকলনের নাম। ‘ঝরে গেছে যে দিনগুলি’। নিচে লেখকের নাম। অবিরাম
ভট্টাচার্য। বুড়ো আঙুল দিয়ে তাস শাফল করার ভঙ্গিতে পাতা উল্টে দেখলেন বরাভয়। পরিপাটি
মুক্তোর সারি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট জুড়ে।
একে বলে কপাল, অ্যাঁ? শালাদের কারও কাছে যা নেই,
সেই সোনার খনি আছে বরাভয়ের কাছে। মেরুদণ্ড টান করে বসলেন বরাভয়। এবার তিনি এটা
পড়তে শুরু করবেন। অনেক বই পড়ে তবে বই পড়ার দক্ষ এবং ফুলপ্রুফ পদ্ধতি বার করেছেন
বরাভয়। চোখ বন্ধ করে ডিপ ব্রেথ নিলেন বরাভয়।
মা,
মাগো, ফার্স্ট বলে আউট কোর না মা।
হ্যাঁচকা
টানে ম্যানুস্ক্রিপ্ট মাঝখান থেকে খুলে ফেললেন বরাভয়। অভ্যস্ত চোখ দ্রুত চলে গেল
বাঁদিকের পাতার নিচে। ছেষট্টি! ছক্কা! জয় মা! জানতেন, বরাভয় জানতেন! আজ চোখ খুলেই
দু’শালিখ দেখেছেন তিনি। আজ শালা তাঁর দিন ভালো না গিয়ে পারে না।
বাকিটুকু
বাঁয় হাত কা খেল। টেবিল থেকে একটা পেনসিল তুলে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে খানিকটা ওপর
থেকে পেনসিলটা ছেষট্টি নম্বর পাতার ওপর ফেললেন বরাভয়। ব্যস। কাজ শেষ, এবার দিনের
প্রথম স্ট্যাটাস মেসেজটি টাইপ করবেন বরাভয়। মেসেজ তো নয়, বোমা। বাতাসের বেগে
কি-বোর্ডের ওপর টাইপ করতে শুরু করলেন বরাভয় বাগচী।
'গুণীর
যথার্থ সম্মান করা তো দূরের কথা, গুণীকে চিনতেও সবাই পারে না। আমি পারি। অবিও
পারত। অবি, অর্থাৎ আপনাদের অবিরাম ভট্টাচার্য। আমি তাকে চিনেছিলাম, সেও আমাকে
চিনেছিল। যখনই কিছু লিখত, কবিতা, ছড়া, লিমেরিক, মনের কথা – এসে বলত বরাভয়দা একটু
দেখেটেখে শুধরেটুধরে দিন। কী বিনয়, কী শ্রদ্ধা, কী আমি ওকে বলতাম, ভাবিস না অবি,
জীবনে যদি তোকে কেউ না চেনে, মরণে চিনবে। আজ অবি নেই কিন্তু অবির কবিতা আছে। অবির
লেখা দুটো লাইন বড় মনে পড়ছে আজ।'
কোলের
ওপর খোলা ছেষট্টি নম্বর পাতাটা একবার চকিত দেখে নিলেন বরাভয়। আঙুল থামল না। পেনসিলের
দাগটা যেখানে পড়েছে তার পাশের লাইন দেখে দেখে টাইপ করতে লাগলেন।
‘কারা
যেন কথা কয়, হিসহিস ফিসফিস, হিসহিস ফিসফিস।’
'অবির
কবিতাও আমাদের বুকের ভেতর, চেতনার ভেতর চিরদিন ফিসফিস করে কথা বলে যাবে। কোনও
প্রতিষ্ঠানের বাবার সাধ্য নেই সে ফিসফিসের কণ্ঠরোধ করে।'
ক্লিক
করতে গিয়েও থেমে গেলেন বরাভয়।
'মনটা
বড় খারাপ লাগছে রে অবি। ওয়েভ লেংথ মেলা মানুষের সংখ্যা তো বড় কম, তুইও চলে গেলি।'
এবার
সত্যিই ক্লিক। ব্যস। তাঁর খেলা শেষ। এবার বাকিরা কে কত খেলবে খেলুক। হাতে হাত ঘষে
পাশে রেখে যাওয়া চায়ের কাপ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন বরাভয়। বুকের ভেতর থেকে একটা
আরামের ‘আঃ’ বেরিয়ে এল।
*****
দরজায়
খটখট শব্দটা যখন হল তখন অবিরাম একটা স্বপ্নের মাঝখানে ছিলেন। ভোররাতে স্বপ্ন দেখা
তাঁর আজীবনের অভ্যেস। মরণের পরেও সে অভ্যেস যায়নি দেখে অবাকই হলেন অবিরাম। এই স্বপ্নগুলোর
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ স্বপ্নের মতো এগুলো পুরোটাই অবচেতনের কারিকুরি নয়। এই সব
শেষরাতের স্বপ্নে অবচেতনের সঙ্গে সঙ্গে অবিরামেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। স্বপ্নের
মূল কাঠামোটা দেয় অবচেতন, তার ওপর খড়মাটি চাপায় অবিরামের আধাজাগ্রত মন। এই যেমন আজ
ভোরের স্বপ্নটায় অবচেতন দেখাল বরাভয়দার বসার ঘর, অবিরাম দেখলেন সেই ঘরে বসে তিনি
কবিতা পড়ছেন, কবিতা শেষ হতে মুহুর্মুহু হাততালি পড়ছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে
অবচেতনের প্রভাবে বরাভয়ের দেওয়ালের মুখোশটা খটখট করে বীভৎস হেসে উঠল আর অবিরাম
ধড়মড় করে উঠে বসে শুনলেন তাঁর দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে।
পাঞ্জাবি
চাপিয়ে এসে অবিরাম যখন দরজা খুললেন তখনও তাঁর ঘুম পুরো কাটেনি। কাজেই দরজার বাইরে
স্যালুটরত ষণ্ডাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য অবিরামের ধাঁধা লেগে গেল।
তিনি কি সত্যি সত্যি ঘুম থেকে উঠেছেন না স্বপ্নটা তখনও চলছে?
স্যার
আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন স্যার।
ষণ্ডার
মুখ থেকে বিনয় গড়িয়ে পড়ছে।
স্যার?
ইয়েস
স্যার।
অবিরামের
হাত পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেল। এক রাতেই তিনি হোস্টেলের কী নিয়ম ভঙ্গ করে ফেললেন
কে জানে। স্যালুট যথাস্থানে রেখে ষণ্ডা বলে চলল,
স্যার
আপনাকে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিতে বলেছেন স্যার। স্যারের অফিস থেকে আপনাকে উচ্চে
পৌঁছে দেওয়া হবে স্যার।
উচ্চ?
উচ্চমেধা
হোস্টেল স্যার। টপ ফ্লোর, সাউথ ফেসিং। টু বেডরুম, ব্যালকনি, কিচেন, বাথরুম। বাথরুমে জাকুজি, কিচেনে মাইক্রোওয়েভ,
চিমনি, অটো ক্লিন টেকনোলজিসমৃদ্ধ।
অবিরাম
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, সেই সুযোগে ষণ্ডা ‘আপনি কিছু ভাববেন না স্যার, আমি
সব গুছিয়ে দিচ্ছি’ বলে সুড়ুৎ করে ঘরে মধ্যে ঢুকে অবিরামের সুটকেস গোছাতে লেগে গেল।
পনেরো
মিনিট পর সুটকেসবাহী ষণ্ডার পিছু পিছু অবিরামকে আবার বনের পথ দিয়ে হাঁটতে দেখা গেল।
কিন্তু যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিকে নয়, এবার তাঁরা চললেন অন্য দিকে। সুটকেসমুক্ত
হয়ে অবিরামের আত্মবিশ্বাস সামান্য বেড়েছে, তিনি চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন,
ও
ভাই, রাস্তা তো এদিকে না?
এদিকেই,
স্যার।
কাল
তো এদিক দিয়ে আসিনি?
কালকের
অফিসে যাচ্ছি না স্যার। কাল আপনি রিসেপশনে গিয়েছিলেন, আজ একেবারে হেড অফিস।
অবিরাম
আর কথা বাড়ালেন না। খানিকক্ষণ হাঁটার পর দূর থেকে আবার বনের মধ্যে একটা সাদা বাড়ি
দেখা গেল।
হেড
অফিস এসে গেছে, স্যার।
হেড
অফিস দেখে অবিরামের দুই চোখ জুড়িয়ে গেল। ছড়ানো একতলা বাড়িটা যেন চারপাশের নীল
আকাশ, সবুজ বন, সোনালি রোদের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। বাড়ির সামনের বাগান আলো করে
ফুটেছে লালনীল ফুল। গেট খুলে ঢুকতে মিষ্টি চেনা গন্ধটা
ঝাপটা মারল অবিরামের নাকে। আঃ, জুঁই। কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝের বর্ডার পেরিয়ে ঘরের
ভেতর ঢুকলেন অবিরাম। ঘরে আলো খুবই কম। বাইরের আলো থেকে ভেতরে ঢুকে প্রথমটা
অবিরামের কিছুই চোখে পড়ল না। একটা ফরফর আওয়াজ আসছে কোথাও থেকে। আওয়াজটা চেনেন
অবিরাম। ঘোষসাহেবের কম্পিউটার থেকে এই আওয়াজটা আসত। বিশেষ করে লাঞ্চের ঠিক আগে আর
পরে। সাহেব তখন ভুরু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, নিতান্ত কাজের কথা না
থাকলে কেউ গেলে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। অবিরামবাবু কম্পিউটার বোঝেন না। তিনি ভাবতেন
মেশিন বড় বড় যোগবিয়োগগুণভাগ কষছে বুঝি। তারপর একদিন পাশের টেবিলের অনুপম বলল
যোগবিয়োগ না ছাই। সাহেব আসলে তাস খেলছেন।
আবার
সেই ফরফর আওয়াজটা হল আর সঙ্গে সঙ্গে অবিরামের চোখ চলে গেল আওয়াজের উৎসের দিকে।
ছায়াছায়া ঘরটার এক কোণে একটা নরম নীল আলো। ল্যাপটপ স্ক্রিনের। সে আলোটা যে মুখটার
ওপর পড়েছে সেটা একজন গোলগাল মানুষের মুখ। ভালোমানুশ, নির্বিরোধী, হাসিখুশি।
মুখটাও
একই সঙ্গে অবিরামের দিকে চোখ তুলে তাকাল। একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখটায়।
আরে
অবিরামবাবু, আসুন আসুন।
গোলগাল
লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। ষণ্ডা পর্দা সরিয়ে দিয়েছে, আলোয় ভেসে গেছে ঘর। সে আলোয়
লোকটাকে ভালো করে দেখলেন অবিরাম। তিনি যাঁর কথা ভাবছেন ইনি কি সত্যিই তিনি?
আপাদমস্তক সাধারণ, নিরীহ ভালোমানুষ চেহারা। কিন্তু অবিরামের ভালোমানুষির সঙ্গে
লোকটার ভালোমানুষির একটা তফাৎ আছে। অবিরামের ভালোমানুষির মধ্যে একটা অসহায়তা আছে,
যেটা লোককে অবিরামের চারপাশে দুর্বিনীত, শক্তিশালী করে তোলে। এই ভদ্রলোকের
ভালোমানুষির জাত আলাদা। এ ভালোমানুষির সামনে পড়লে মানুষ আপনা থেকে নরম হয়ে যায়।
যমরাজ
হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন অবিরামের দিকে।
ছি
ছি ছি ছি, কী কাণ্ড বলুন দেখি, আপনাকে কিনা মধ্যমেধা অ্যালট করেছে? তাও আবার
গ্রাউন্ড ফ্লোর? ছি ছি ছি ছি।
উনি
যে বায়োডেটা দিলেন . . . কোনও
পুরস্কার নেই, সংবর্ধনা নেই, ওয়েবজিন পাবলিকেশন পর্যন্ত নেই।
কালকের
রিসেপশনিস্টটাও ঘরে আছে দেখছি, অবিরাম এতক্ষণ খেয়ালই করেননি। জলের বালতিতে পড়ে
যাওয়া হুলো বেড়ালের মতো চেহারা করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। কালকের অত দাপট, কোথায়
কী?
অবিরামের
মায়া হল। কোথাও একটা কিছু গোলমাল হয়েছে।
উনি
ঠিকই বলছেন। আমি কোনওদিনও কিছু পুরস্কারটুরস্কার পাইনি, কখনও কোনও পত্রিকায় আমার
লেখা ছাপা হয়নি।
যমরাজ
অবিরামের স্বীকারোক্তি উড়িয়ে দিলেন।
আরে
মশাই পুরস্কারের সঙ্গে খ্যাতির সম্পর্ক নেই সে তো দেখাই যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আপনি
বাংলার সংস্কৃতিজগতে সব থেকে বিখ্যাত মানুষ। নেক্সট সাতদিন অন্তত থাকবেন। তারপর
অবশ্য কথা দিতে পারছি না।
যমরাজের
গলা নেমে গেল।
অবিরামের
মাথায় কিচ্ছু ধুকছিল না। সংস্কৃতি, বিখ্যাত . . . কার কথা বলছে এরা?
আমি
. . . আমাকে তো কেউ চেনে না?
যমরাজ
তাঁর গোল মুখ হাঁ করলেন।
চেনে
না কী বলছেন মশাই? আপনার জন্য কত বড় RIP পার্টি হচ্ছে ফেসবুকে সে খবর রাখেন? কত ভক্ত, কত অনুরাগী, কত
হাততালি, কত হাহুতাশ।
অবিরামের
ধন্দ কমার বদলে আরও বেড়ে গেল। ভিজে বেড়াল রিসেপশনিস্ট তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে
এলেন।
কোনও
বিখ্যাত লোক মারা গেলে ফেসবুকে আজকাল RIP পার্টি হয় জানেন না? সবাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে, লেখকের রচনা
থেকে কোটেশনটোটেশন দেয় . . .
মানে
শ্রাদ্ধজাতীয় ব্যাপার?
একরকম
শ্রাদ্ধই বলতে পারেন। তবে আন্তর্জালের ব্যাপার তো, ঝামেলা কম। প্যান্ডেল, পুরোহিত,
কাঞ্চনমূল্য, কেটারার – ও সব হ্যাপা নেই, সবটাই বৈদ্যুতিন। যে যার নিজের ওয়ালে
পোস্ট করে, সেই সব পোস্টে আবার লোকে এসে লাইক করে, কমেন্ট লেখে। জমজমাট ব্যাপার।
ষণ্ডার
এতক্ষণ চুপ করে থেকে অভ্যেস নেই। সে আর না থাকতে পেরে আলোচনায় নাক গলাল।
ওঁকে
একবার নিজের চোখে দেখিয়েই দিন না স্যার।
সেই
ভালো। যমরাজ অবিরামের পিঠে আলতো হাত রেখে ল্যাপটপের দিকে চালিত করলেন। পেছন পেছন
ষণ্ডা বুদ্ধি করে একটা এক্সট্রা চেয়ার জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল, যমরাজ নিজের চেয়ারে
বসে পড়ার পর অবিরাম সেই চেয়ারে বসলেন। কাঁধের কাছে ষণ্ডা আর রিসেপশনিস্ট ঘনিয়ে এল।
যমরাজ
মাউসে হাত রাখলেন।
এই
দেখুন।
দেখলেন
অবিরাম। যা দেখলেন তা সামনের সাতজন্মের মতো তাঁর মগজে গিঁথে গেল।
সকাশঃ
যুদ্ধ আচ্ছে। শান্তি নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র আছে। প্রতিবাদ নেই। বাঙালি আছে। মেরুদণ্ড
নেই। দুঃসময় আছে। অবিরাম নেই।
প্রকাশঃ
অবিরাম আর নেই। অবিরাম আর লিখবেন না। কথাটা মনে করে বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছি। শীত
করছে। রাগ হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। শেষের সে দিন কি সত্যিই ঘনিয়ে এল? আমার যে বড্ড ভয়
করছে। RIP অবিরাম।
বিকাশঃ
হিসহিস ফিসফিস। হিসহিস ফিসফিস। হিসহিস ফিসফিস। উঃ, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এমন
লাইন বাংলা সাহিত্যে আর লেখা হবে না। আমাদের কাঙাল করে চলে গেলে তুমি কবি। RIP।
বরাভয়ঃ
অবি আমাকে বড় ভালোবাসত। ওর সব লেখার তো আমিই প্রুফ রিড করে দিতাম।
হতাশঃ
সবথেকে ক্ষতি যেটা হল সেটা হচ্ছে মধ্যমেধার রাস্তাটা আরও নিরঙ্কুশ হল। নেকুপুষু
বাঙালির ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেওয়া মতো তেজস্ক্রিয় বুদ্ধিজীবী আর কেউ রইল না। আমাদের
মতো গুটিকয়েক সাবঅল্টার্নের সাবভার্সিভ কণ্ঠ আরও মিনমিনে হয়ে গেল। হিসহিস ফিসফিস
হিসহিস ফিসফিস হিসহিস ফিসফিস। সেলাম কমরেড।
প্রবীণঃ
আমি জানি এটা এখানে পপুলার ওপিনিয়ন হবে না, কিন্তু আমি তাও না বলে পারছি না। আমি
বাংলা সাহিত্য গুলে খেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ। আমার
মতে বাংলায় শেষ পাতে দেওয়ার মতো গল্প পথের পাঁচালী। ব্যস। তারপর সব জঞ্জাল, আবর্জনা।
অবিরাম ভট্টাচার্যের লেখা আমি পড়িনি, কিন্তু এইখানেই যা শুনলাম তাতে আর পড়ার
প্রবৃত্তিও নেই। হিসহিস ফিসফিস হিসহিস ফিসফিস – এ সব কী ভাষা! এই নাকি সাহিত্য?
নবীনঃ
দাদু, আর কিছু যখন পড়েননি তখন মুখটা বন্ধ রাখুন। খুললে আপনার ইন্টেলেকচুয়াল
প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে। পথের পাঁচালীর পর নাকি আর বাংলা গল্প লেখা হয়নি? এরা
সব কারা? কেন?
বিকাশঃ
আরে ছেড়ে দাও ভায়া, পড়াশোনা নেই। কী আর করা যাবে।
নবীনঃ
নেই কেন? পড়াশোনা নেই দেখলে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। অবিরাম এঁদের দেখেই নির্ঘাত
রেগে গিয়ে হিস হিস করেছিলেন। হিস হিস ফিস ফিস। হিস হিস ফিস ফিস।
বরাভয়ঃ
এই লাইনটা যেদিন লিখে এনে দেখিয়েছিল, সেদিনই আমি বলেছিলাম, তুমি নিজেও জানলে না
অবি, তুমি কী সৃষ্টি করলে। লোকে যদি তোমার আর কিছুই না পড়ে, এই লাইনটা পড়বে। তোমার
নশ্বর দেহ মরে যাবে, ‘হিসহিস ফিসফিস’ লোকের মুখে মুখে অমরত্ব পাবে।
অবিরামের কানের কাছে টাইপ করার খটাখট শব্দ হল।
চিরসখাঃ
RIP।
অবিরাম
চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। ষণ্ডা বলে উঠল,
আমাদের
স্যারের একটা অ্যাকাউন্ট আছে ফেসবুকে। বেনামি। আপনার খবরটা তো স্যারই বাজারে
ছেড়েছিলেন।
আসলে
এখানে কিছু করার নেই তো। বোর লাগে খুব। তাই ফেসবুক করি। কেমন হয়েছে প্রোফাইল
নেমটা? চিরসখা? আপনারা সাহিত্যের লোক, ভালো বলতে পারবেন।
লজ্জিত
মুখে অবিরামের দিকে তাকিয়ে হাসলেন যমরাজ। চিরসখা। মনে মনে একবার উচ্চারণ করলেন অবিরাম। একটা
অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ল বুকের ভেতর। কে জানে কত লক্ষ বছর পর হাসি ফুটল অবিরামের মুখেও।
খুব
ভালো হয়েছে। ভীষণ ভালো।
যমরাজ
খুশি হলেন। অবিরামকে বললেন, দেখুন দেখুন, আরও কত লোক এসেছে আপনার পার্টিতে। সবার
মনোযোগ আবার ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে ধাবিত হল।
কঃ
RIP।
খঃ
RIP।
গঃ
RIP।
অন্যরকমঃ
এরা সব কারা বস্? RIP
RIP করে মাথা খারাপ করে দিলে? এদের শরীরে কি একটুও লজ্জাঘেন্না নেই গো? অবিরাম বেঁচে
থাকলে তোদের কতখানি ঘেন্না করতেন সে কথা মনে করে অন্তত আজকের দিনটাতে একটু চুপ করে
থাক?
আমিও
অন্যরকমঃ অ্যাই। অ্যাই। ঠিক অ্যাই কথাটা আমি যে কতক্ষণ বলব বলব করেও বলছি না। অবিরামদাকে
কি আমি চিনতাম না? কতবার বাড়ি গেছি ওনার। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে মানুষের
দুঃখদুর্দশা নিয়ে কত ডিসকোর্স করেছি। আড্ডায় কত বার তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়েছি। আমার
মতো করে খুব কম লোকই অবিরামদাকে চিনেছিলেন। আর চিনেছিলাম বলেই আমি কক্ষনও তাঁকে RIP বলব না।
কঃ আমিও না।
খঃ আমিও না।
গঃ আমিও না।
বরাভয়ঃ
অবিরামের এখন এত চেনা লোক বেরোচ্ছে কী করে কে জানে বস্। কই, এদের কথা তো অবি
আমাকে কখনও বলেনি।
প্রকাশঃ অন্যরকমদি, এই ভদ্রলোককে আমি আগেও দেখেছি। কোনও মিনিংফুল কনভারসেশনে যান না। খালি RIP RIP করে ফোড়ন কাটেন।
চিরসখাঃ RIP.
হতাশঃ
বেঁচে থাকতে লোকটাকে সম্মান দিল না, এখন RIP মাড়াতে এসেছে। শালা দেখে দেখে মাথা
গরম হয়ে যায়। শালাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা উচিত। এ মালটা আমার
ফ্রেন্ডলিস্টেও আছে।
বিকাশঃ
আমারও।
কঃ
আমারও।
খঃ
আমারও।
গঃ
আমারও।
বরাভয়ঃ
আরে এ তো দেখছি আমারও ফ্রেন্ড। কিন্তু আমি এর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম বলে
মনে পড়ছে না তো। দাঁড়াও, এক্ষুনি শালাকে আনফ্রেন্ড করছি . . . ই কী, এ আনফ্রেন্ড
হয় না কেন?
চিরসখাঃ
RIP RIPA RIP।
প্রকাশঃ
আমিও চেষ্টা করেছি স্যার। কিছু একটা যান্ত্রিক গোলযোগ হচ্ছে। কিছুতেই চিরসখাকে
আনফ্রেন্ড করা যাচ্ছে না।
সকাশঃ
ব্লক করার চেষ্টা করে দেখেছ?
বিকাশঃ
দেখছি, হচ্ছে না।
হতাশঃ
হবে না, হবে না, রাষ্ট্রযন্ত্র এ সব খোচর ঢুকিয়ে দিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে।
আপনারা এখানে RIP RIP করুন
আর ওদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র আপনাদের গাঁড় মেরে চলে যাক।
প্রবীণঃ
ছি ছি ছি, এ সব কী ভাষা?
নবীনঃ
আরে এ মালটাকে কেউ হাটাও বস্। ভাষা ভাষা করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলে।
চিরসখাঃ
RIP RIPPITY RIP DIP
DIPPITY DIP.
তারপর
কী হল অবিরাম ভালো বুঝতে পারলেন না। RIP, প্রতিবাদ, কান্না, বুকচাপড়ানি,
গালিগালাজ, হিসহিসফিসফিসের একটা বোমা ফাটল সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। তার ধাক্কায় অবিরাম
মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
(চলবে)
Hmm. Ekhono porjonto predictable. Er por tai ashol. Dyakha jaak golpo kothai jai.
ReplyDeleteWelcome back. Asha kori shob kushol.
Shuteertho
ধন্যবাদ সুতীর্থ।
DeleteWelcome back and very nice story! I have started 'Neil Gaiman' very recently. Did you like 'Inferno'?
ReplyDeleteআরে রণদীপ যে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। দুঃখের বিষয়, আমার ইনফার্নো একেবারেই ভালো লাগেনি। সত্যি বলতে কি আমি মাঝপথে বইটা ছেড়ে দিয়েছি।
Deletehahaha ..molayem mukher jamraj ke khub pachanda hoyeche.- tinni
ReplyDeleteআমারও তিন্নি।
Deleteএটার জন্যই হাপিত্যেশ করে বসেছিলাম। দারুণ এগোচ্ছে। রাকা।
ReplyDeleteতোমার অনুমতি না নিয়েই লিঙ্ক টা ফেসবুকে রাখলাম বন্ধুদের পড়াব বলে। আগেও কিছু পোস্ট অমন শেয়ার করেছি। এক্ষেত্রে অবশ্য পোস্টটা করার পর আয়রনি টা খেয়াল হলো। আশা করি রাগ করবে না। রাকা।
ReplyDeleteরাগের প্রশ্নই নেই রাকা। থ্যাংক ইউ।
Deleteuff ... porar agei comment korlam.. dwitiyo porbo dekhei anondo pelam.. ebar porbo.. :) asha kori bhalo acho..
ReplyDeleteধন্যবাদ ঊর্মি। হ্যাঁ, এখন একেবারে ভালো।
Deleteapnar sonar dowat-kolom (thuri keyboard) houk.
ReplyDeleteআপনার মুখে চপ কাটলেট পড়ুক ঘনাদা।
Deleteব্যাপারটা হয়েছে বেশ RIPe
ReplyDeleteইতি - AtmoDIP
হাহাহা, থ্যাংক ইউ আত্মদীপ।
Deleteবেশ বেশ তাহলে এটা রম্যরচনা থেকে satire এর দিকে মোড় নিলো !
ReplyDeleteহুম্, কাকলি।
Deleteঅ্যাই! শান্তিপুরের নামে বাজে কথা হবে না কিন্তু। হেব্বি রেগে যাব।
ReplyDeleteআরে না না, এটা কাল্পনিক শান্তিপুর, আসল শান্তিপুরের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।
Deleteএই রে, আমার ফ্রেন্ডলিস্টটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে তো, এরকম কেউ আছে কিনা!
ReplyDeleteহ্যাঁ, দেখবেন তো। পেলে জানাবেন।
Deleteএকই লেখার দুটি জায়গায় দুরকম পদবী - ডবল রোল নাকি ?
ReplyDelete"কারণ সে আড্ডার হোতা, বরাভয় ঘোষ, অবিরামকে একচুলও পাত্তা দিতেন না।"
সঙ্গে
"তাসের বেগে কি-বোর্ডের ওপর টাইপ করতে শুরু করলেন বরাভয় বাগচী।"
ইস, খুব ভুল হয়ে গেছে। ভুল ধরে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। থ্যাংক ইউ।
Deletewelcome
Deleteha ha ha , darun, FB te ato loker sathe relate kora jachhe :D , eta share kore ki kore?
ReplyDeleteতা তো জানি না, প্রদীপ্তা। তোমার লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Delete