R. I. P. / তৃতীয় ও শেষ পর্ব
বরাভয় বাগচী, সাহিত্যসভা আহ্বায়ক ও মানেবই লেখক, ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলেন
যে, যে অবিরাম ভট্টাচার্যকে তিনি গত তিন বছর ধরে পাত্তা দেননি, তিনি মৃত্যুর পর
হঠাৎ করে ভয়ানক বিখ্যাত হয়ে গেছেন। বরাভয়ের মনে পড়ল যে গত আড্ডায় অবিরাম তাঁর লেখা
একটি কবিতার ম্যানুস্ক্রিপ্ট জমা রেখে গিয়েছিলেন। বরাভয় সেখান থেকে একটি লাইন কোট
করে স্ট্যাটাস মেসেজ দিয়ে দিলেন।
অবিরামকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে ষণ্ডা গেল হেড অফিসে। সেখানে গিয়ে অবিরামের
যমরাজার সঙ্গে দেখা হল। যমরাজের কাছে অবিরাম খবর পেলেন যে যদিও বেঁচে থাকতে তাঁর
কবিতা এমনকি কোনও ওয়েবজিনে পর্যন্ত ছাপা হয়নি, তবু তিনি মর্ত্যে বিখ্যাত হয়ে
গেছেন। তিনি এটাও জানতে পারলেন যে বিখ্যাত লোকেরা মারা গেলে আজকাল তাঁদের অনলাইন
শ্রাদ্ধ হয়, যেটাকে ভালো ভাষায় RIP পার্টিও বলে। যমরাজের ফেক ফেসবুক প্রোফাইল ‘চিরসখা’র সাহায্যে অবিরাম সাক্ষী
হলেন তাঁর জন্য আয়োজিত RIP পার্টির।
*****
উচ্চমেধার টপ
ফ্লোরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিরাম। অত উঁচু থেকে চারপাশের বনটাকে সবুজ
সমুদ্রের মতো দেখাচ্ছে। গাছের মাথাগুলো যেন ফুলে ওঠা ঢেউ, শূন্যে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
অভিভূত ভাবটা কাটছিল না অবিরামের। কালকের অভিজ্ঞতাটা ভুলতে পারছিলেন না। কাল তিনি নিজে চোখে দেখেছেন মানুষ তাঁকে চিনেছে, সম্মান দিয়েছে, তাঁর লেখা
পড়েছে। পাটুলির ওই স্যাঁতসেঁতে এক কামরার ফ্ল্যাটে বসে
লুকিয়ে লুকিয়ে লেখা কবিতার লাইন মুখে মুখে ফিরেছে পাঠকের মুখে মুখে।
অবিরামের চোখ জ্বালা
করে এল। আজীবন বুকের ভেতর যে না-পাওয়ার শূন্যতাটা বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি, মরণের পর তা
কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। আর এই পূর্ণ করার কৃতিত্ব যে মানুষটার, তাঁর নাম
বরাভয় বাগচী। বরাভয়দার মুখটা কাল থেকে বড্ড মনে পড়ছে অবিরামের। সাহিত্যসভার ভিড়ের পেছনে বসে যে হামবাগ, দাম্ভিক মুখটা
দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন অবিরাম সে মুখটা নয়। অন্য একটা মুখ। দয়ামায়া সহানুভূতি শ্রদ্ধা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা মুখ।
একজন শিল্পীকে মৃত্যুর পর তার প্রাপ্য সম্মানের অধিকার দিতে উদ্যোগ নেওয়া একটা মুখ।
অবিরামের কোনওদিন
বলার মতো ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল না, গায়ে জোর ছিল না, চরিত্রে দৃঢ়তা ছিল না। কিন্তু
যে জিনিসটা চিরদিন তাঁর দরকারের থেকে অনেক বেশি ছিল, তা হল কৃতজ্ঞতাবোধ। ফতুয়ার
হাতায় চোখ মুছে নিলেন অবিরাম। বনের ও পারে, অদৃশ্য দেওয়ালের ও পারে, খাঁ খাঁ ধূসর মাঠের ও পারে, জীবনমৃত্যুর সীমানার ও পারে ফেলে
আসা একটা পৃথিবীর একটা শহরের কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগল অবিরামের।
*****
সিরিয়াল দেখতে দেখতে
ডিনার করার পরও খানিকটা জেগে থাকেন বরাভয়, এ গ্রুপে সে গ্রুপে ঘোরেন, টুকটাক গেম
খেলেন, ইচ্ছে হলে দুয়েকটা স্ট্যাটাস লেখেন। আজ আর কিছু করতে ইচ্ছে হল না। অবিরামকে
নিয়ে উন্মাদনাটা যে এই লেভেলে পৌঁছবে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। দিকে দিকে
অবিরাম ভট্টাচার্যকে নিয়ে অভূতপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে। সারাদিন দফায় দফায়
চ্যাটে, ফোনে লোকে অবিরাম ভট্টাচার্যের সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। সে কেমন ছিল, কী
খেতে ভালোবাসত, কোন পার্টি করত, কোন পার্টির গুষ্টির পিণ্ডি চটকাত, তার
বাবামাভাইবোনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, বৈধঅবৈধ প্রেম ছিল কি না – সব নিয়ে
লোকের কৌতূহলের আর সীমা নেই। বরাভয় যতখানি পেরেছেন বানিয়ে বানিয়ে কৌতূহল মেটানোর
চেষ্টা করেছেন। সারাদিন ধরে এতগুলো মিছে কথা বলার ধকলে বরাভয়ের এখন রীতিমত
ক্লান্তই লাগছে। ক্লান্তির সঙ্গে অবশ্য খুশিও মিশে আছে। সন্ধ্যেবেলা ‘বিপ্লবী
সাহিত্যিক ফোরাম’-এর সুপ্রকাশ ফোন করে জানিয়েছে আগামী শনিবার ‘অগত্যা অবিরাম’
শীর্ষক একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান বেশি দীর্ঘ নয়, উদ্বোধনী সংগীত,
দুটো লাইটওয়েট, একটা হেভিওয়েট বক্তৃতা। শুরুতে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ বিষয়ে বক্তব্য
রাখবেন প্রাবন্ধিক পরিমল পাণ্ডা এবং ‘সমকালীন মূল্যবোধের প্রসারে কবির দায়িত্ব’
বিষয়ে বলবেন ব্লগার বিনয় বসু। অনুষ্ঠানের মেন বক্তৃতাটার দায়িত্ব ওরা বরাভয় ছাড়া কাউকে
দিতে ভরসা পাচ্ছে না। হাজার হোক অবিরামকে ব্যক্তিগত স্তরে পরিচয়ের সুবিধে বরাভয়
ছাড়া আর কারও নেই। সব কিছু শুনেটুনে বরাভয় রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বক্তব্য
রাখবেন ‘কমরেড কবি অবিরাম ভট্টাচার্যঃ জীবন ও মরণোত্তর প্রভাব’ সম্পর্কে। বক্তৃতা দেওয়াটা এখন জলভাত বরাভয়ের কাছে। যাওয়ার আগে খালি আরও
ম্যানুস্ক্রিপ্টটা নিয়ে বসে বারকয়েক ক্রিকেট খেলে কোটেশনের স্টকটা একটু বাড়িয়ে
নিতে হবে। ব্যস।
দিনের শেষ মেসেজ
‘গুডনাইট, RIP অবিরাম’
লিখে ফেসবুকের দোকান বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন বরাভয়। নিয়ম মতো ইসবগুল খেয়ে শুয়ে
পড়লেন। বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে আজ। বালিশে মাথা ঠেকানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাঁর
দু’চোখে ঘুম ঘনিয়ে এল।
রাত প’নে বারোটা নাগাদ
স্বপ্নটা দেখতে শুরু করলেন বরাভয়। আশ্চর্য রিয়্যালিস্টিক স্বপ্ন। বরাভয় দেখলেন
তিনি দোতলার দক্ষিণপূর্বের ঘরটাতে আরাম করে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন, জানালা দিয়ে
চৈত্ররাতের হাওয়া ফুরফুরিয়ে ঘরে ঢুকছে। ঘুম ভেঙে যদি ঘড়ির দিকে তাকাতেন বরাভয়
তাহলে দেখতে পেতেন স্বপ্নের ঘড়িতেও তখন ঠিক বারোটা বাজতে পনেরো। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের বরাভয় পাশ ফিরলেন। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর ঘরে তিনি আর একা
নেই। আরেকটা লোক আছে।
চোখ খুললেন বরাভয়।
দক্ষিণের দেওয়ালের জানালাটা দিয়ে আসা চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে চৌকো একটা জ্যোৎস্নার
ফালি তৈরি করেছে। কিন্তু চৌকোটা এখন আর শুধু চৌকো নেই। তার মধ্যে ছায়া দিয়ে কেউ
একটা মাথা এঁকেছে, মাথার নিচে গলা, গলার নিচে বুক পেট – একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। হাত
দুটো মানুষটা বুকের কাছে জড়ো করে রেখেছে, শরীরের ছায়ার সঙ্গে তারা মিশে গেছে,
আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না।
ছায়াটা তাঁর চোখের
সামনে না চোখের ভেতর? রেটিনায় জমা জলীয় পদার্থরা নড়াচড়া করে নানারকম অবয়ব সৃষ্টি
করে, এই ছায়াটাও কি তাদেরই সৃষ্টি? চোখের পলক দু’বার ঝাপটালেন বরাভয়। জ্যোৎস্নার
ভেতর ছায়া যেমনকার তেমনটি রইল।
অবিরাম এসেছিলেন অনেকক্ষণ। উচ্চমেধা হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই যে তিনি মনস্থির করলেন, ‘আমি বরাভয়দার কাছে যাব’, করে যেই না এক পা বাড়ালেন, অমনি সোজা এই ঘরের ভেতর। দোতলায় ওঠা, জানালা গলে ঢোকা, এ সব কোনও সমস্যাই হল না। এসে পড়ে অবশ্য অবিরাম বুঝলেন টাইমিংটা একটু বেগড়বাই হয়ে গেছে। স্বর্গের বারান্দা থেকে যখন রওনা দিয়েছিলেন তখন সেখানে ছিল খটখটে সকাল, আর এখন এখানে এসে দেখছেন ঘুটঘুটে রাত। এই সময় বরাভয়দাকে ঘুম থেকে তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি না এই সব সাতপাঁচ ভাবতে লাগলেন অবিরাম। আসার আগে বুকের ভেতর যে জোরটা টের পাচ্ছিলেন সেটা এখন আর পাচ্ছেন না। পৃথিবীর হাওয়াবাতাসেই এমন একটা কিছু আছে যা অবিরামের নাগাল পাওয়ামাত্র তাঁর ভেতর থেকে সমস্ত সাহস, আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছে। বরাভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অবিরাম। ঘুমন্ত একজন লোককে যে এতখানি দাপুটে দেখাতে পারে অবিরাম কল্পনা করেননি।
অবিরাম এসেছিলেন অনেকক্ষণ। উচ্চমেধা হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই যে তিনি মনস্থির করলেন, ‘আমি বরাভয়দার কাছে যাব’, করে যেই না এক পা বাড়ালেন, অমনি সোজা এই ঘরের ভেতর। দোতলায় ওঠা, জানালা গলে ঢোকা, এ সব কোনও সমস্যাই হল না। এসে পড়ে অবশ্য অবিরাম বুঝলেন টাইমিংটা একটু বেগড়বাই হয়ে গেছে। স্বর্গের বারান্দা থেকে যখন রওনা দিয়েছিলেন তখন সেখানে ছিল খটখটে সকাল, আর এখন এখানে এসে দেখছেন ঘুটঘুটে রাত। এই সময় বরাভয়দাকে ঘুম থেকে তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি না এই সব সাতপাঁচ ভাবতে লাগলেন অবিরাম। আসার আগে বুকের ভেতর যে জোরটা টের পাচ্ছিলেন সেটা এখন আর পাচ্ছেন না। পৃথিবীর হাওয়াবাতাসেই এমন একটা কিছু আছে যা অবিরামের নাগাল পাওয়ামাত্র তাঁর ভেতর থেকে সমস্ত সাহস, আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছে। বরাভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অবিরাম। ঘুমন্ত একজন লোককে যে এতখানি দাপুটে দেখাতে পারে অবিরাম কল্পনা করেননি।
ঠিক সেই সময়ে বরাভয়ের
চোখ খুলে যাওয়ায় অবিরামের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। অবিরাম এক পা এগোলেন। বরাভয়দা
কি চিনতে পারবেন অবিরামকে? না পারার কথা নয়। গত চব্বিশঘণ্টায় তাঁর মুখ বাংলার
সংস্কৃতি জগতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য ছবির যা ছিরি। সে দেখে আসল মানুষ চেনার আশা না করাই ভালো।
নিজের পরিচয় দেওয়ার
জন্য মুখ খুললেন অবিরাম।
চিনতে পারছেন?
বরাভয়দা?
চিনতে আবার পারেননি? চিনতে বরাভয় খুবই পেরেছেন।
ছবির সঙ্গে আসল লোকের মিল থাকুক আর না থাকুক, ওই কুঁকড়ে দাঁড়ানো, বুকের কাছে জড়ো
করা নুলোর মতো হাত দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন তিনি। অবিরাম এসেছে। উঁহু, অবিরাম
নয়। অবিরামের প্রেতাত্মা। গত তিন বছরের অবহেলা আর
উপেক্ষার জবাব দিতে এসেছে। প্রেতাত্মারা সব জানতে পারে। ও জেনে ফেলেছে যে বরাভয় ওর
ম্যানুস্ক্রিপ্ট আসলে পড়েননি, স্রেফ বুক ক্রিকেট খেলে কোটেশন তুলে দিয়েছেন। সেই রাগে প্রেত
তাঁর ঘাড় মটকাতে এসেছে। বরাভয়ের গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। ক্ষমা চাওয়ার জন্য
হাত তুলে কান ধরার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্ত সাড় চলে
গেছে। কাটা কলাগাছের মতো বরাভয়ের বিশাল বপু খাটের ওপর পড়ে রইল।
উত্তর না পেয়ে
অবিরাম আরও এক পা এগোলেন। বরাভয়দা তাঁকে দেখতে পেয়েছেন। জানালা দিয়ে এসে
পড়া চাঁদের আবছা আলোয় বরাভয়ের খোলা চোখদুটো কাঁচের গুলির মতো দেখাচ্ছে। জাম্বো
সাইজের গুলি। বরাভয়দা চোখ এত গোল করেছেন কেন? মুখ এত বড় হাঁ? বরাভয়দা কি কিছু বলতে
চাইছেন?
অবিরাম বরাভয়ের
মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
বরাভয়দা, আমি কী বলে
আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আপনি আমার জন্য যা করলেন, আমি সাত জন্মেও সে ঋণ শোধ
করতে পারব না। আপনি . . .
অবিরামের প্রেতাত্মা
পায়ে পায়ে বরাভয়ের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখটা ঝুঁকে পড়ছে তাঁর মুখের ওপর। প্রেতাত্মার
বরফের মতো শীতল নিশ্বাস এখন তাঁর মুখে পড়ছে। প্রেতাত্মার চোখদুটো জ্বলছে। বরাভয় সে
চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছেন না। প্রেতাত্মাটা কী সব যেন বলছে। বরাভয় কিচ্ছু
শুনতে পাচ্ছেন না। তাঁর কানের ভেতর লাখখানেক ঝিঁঝিঁ পোকা চিৎকার করছে।
বুকের নিচে সরু
চিনচিনে একটা ব্যথা শুরু হল বরাভয়ের। একটা অসহ্য চাপ। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা ফেটে
যাবে এক্ষুনি। দমবন্ধ হয়ে আসছে। ব্যথাটা বাড়ছে। তাঁর বাবা, কাকা, শ্বশুরমশাই সবাই
হার্ট অ্যাটাকে গেছেন, তিনিও কি তবে . . . টেবিলের ওপর সরবিট্রেট রাখা আছে, হয়তো অবিরামের
ম্যানুস্ক্রিপ্টটার ওপরেই। বরাভয়ের বিস্ফারিত চোখের কোণে দু’ফোঁটা জল জমে এল।
এই প্রতিদান দিলি
অবিরাম? এত বছরের পরিচয় . . . মানছি তোর সঙ্গে অনেক অন্যায় হয়েছে, অনেক অবিচার,
তাই বলে পৃথিবীর এত বড় ক্ষতিটা তুই করতে পারলি? এখনও কত ভালো ভালো কথা বলার ছিল,
কত উপদেশ দেওয়ার ছিল, সবাইকে সাম্যসিদ্ধান্ত পড়ানো হল না . . .
বরাভয়ের মাথার পাশ
দিয়ে জলের ফোঁটাদুটো গড়িয়ে পড়ে গেল।
*****
রিংরিং রিংরিং রিংরিং।
হ্যালো?
স্যার, বরাভয় বাগচী? সেই যে স্যার সাহিত্যসভা? মানেবই?
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি।
ফুটে গেছে স্যার।
অ্যাঁ? কখন?
এই তো, আধঘণ্টা হল।
আআআধঘণ্টাআআ! এতক্ষণ কী করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে?
কেউ টের পায়নি স্যার।
টের পায়নি মানে! এই টেকনোলজির যুগে আধঘণ্টার মানে জানো? প্রায় অর্ধকল্প।
এতক্ষণে RIP পার্টি শুরু হয়ে গেল দেখ গিয়ে, ছি ছি ছি ছি।
চাপ নেবেন না, স্যার। যখন
হয়েছে তখন গোটা শহরের সার্ভার ডাউন ছিল। আপনিই ফার্স্ট জানলেন স্যার।
না জানলেই বা কী? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। ছি ছি ছি ছি। যাই হোক, অনেক করেছ,
এবার ফোন রাখ। আমাকে এক্ষুনি কাজে বসতে হবে। ছি ছি ছি ছি।
যমরাজের মেজাজ গরম হয়ে গেল। যত সব অকর্মাদের নিয়ে অফিস খুলে বসেছেন তিনি।
বরাভয় বাগচীর মৃত্যু একটা বিগ ডিল, খবরটা যদি তাঁর আগেই কেউ শেয়ার করে ফেলে তাহলে
আর লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না। চটি গলিয়ে তাড়াতাড়ি ল্যাপটপের কাছে পৌঁছলেন যমরাজ। ঢাকনা তুললেন। নরম নীল আলো ছড়িয়ে
পড়ল।
ধুকপুকোনো বুকে লগ ইন করলেন চিরসখা। বরাভয় বাগচীর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে কোনও পোস্ট
নেই। বুক থেকে পাথর নেমে গেল। আর জাস্ট পাঁচটা মিনিট চাই তাঁর। জাস্ট পাঁচ। দ্রুত উইন্ডো মিনিমাইজ
করে একটা ফোল্ডার খুললেন চিরসখা। সার্চ দিলেন। টর্চের আইকন ঘুরে ঘুরে ফাইল
খুঁজতে লাগল। এই তো। বরাভয় বাগচীর ভোটার আই কার্ড। এবার জাস্ট একটা কপি পেস্ট,
ব্যস।
ছবিটার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন চিরসখা। ভোটার আই কার্ডের ছবি যেমন
হয়, দুর্বোধ্য, ঝাপসা। অফিশিয়াল নিয়ম, সরকারি ছবিই ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোনও
ছবি চলবে না। পাসপোর্ট, ভোটার আই ডি, বড় জোর প্যান কার্ড। যত্তসব সেকেলেপনা। চিরসখার
হাতে যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে তিনি সব অ্যালাউ করতেন। ছবি নিয়ে কথা, সে অফিশিয়াল না
সেলফি সে নিয়ে বাছবিচার কীসের ভগবানই জানেন।
স্ক্রিনে বরাভয় বাগচীর ছবি জ্বলজ্বল করতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্য সব
তাড়া ভুলে গেলেন চিরসখা।
ভাবতে অবাক লাগে তাঁর, এত যুগ হয়ে গেল এই কাজ করতে করতে, তবু এই মুহূর্তটা এখনও
তাঁকে নাড়া দেয়, বিচলিত করে? ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন চিরসখা। তাঁর সে
দৃষ্টির সামনে ছবির মুখ থেকে ভয়, দুঃখ, সুখ, দম্ভ একে একে সব খসে পড়ে গেল। পড়ে রইল
শুধু একটা মানুষ। নির্দোষ, নির্গুণ।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস চাপলেন চিরসখা। আর দেরি করে লাভ নেই। শহরের লোকের ঘুম ভাঙল
বলে। মাউস ক্লিক করতে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকালেন চিরসখা। ছবির নিচে টাইপ করলেন, RIP।
(শেষ)
Bhalo laglo.
ReplyDeleteShuteertho.
ধন্যবাদ, সুতীর্থ।
DeleteDekhechen!!! Loke faltu vut tut ke ninde kore. Vut bole ki ora manus noi???
ReplyDeleteভূতেরা তো আমাদের থেকে অনেক বেশি মানুষ বলে আমার সন্দেহ হয়, অর্ণব।
DeleteKhub bhalo laglo lekha ar abantorke puro form e peye. Jomrajer byabosthapona kintu darun... Etodine tahole okhaneo sobai adhunik hoe gachhe bolchho... Osob teler korai torai nie ar na bhableo cholbe.... FB friendlist kebol majhe majhe check kore rakhte hobe
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। আরে আজকাল আধুনিক না হয়ে ঠাকুরদেবতাদেরও নিস্তার নেই।
Deleteবাব্বা, দু'দিন আসিনি আর তার মধ্যে গল্প শেষ করে দিয়েছো! অনেক দিন পর সোমবারটা ভালো কাটবে দেখছি| বড়ই আনন্দ|
ReplyDeleteএখনও শেষ না করতে পারলে আর শেষ হত না, অপরাজিতা।
DeleteSotti Katha bolte ki shuru shurute tamon bhalo laageni. Kintu sesh ta ja korechho na... Oi Nirgun r nirdosh shabdoduto khub powerful. Chirasakha-tao. Daarun legechhe.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ চন্দ্রচূড়। শেষরক্ষা হয়েছে জেনে শান্তি পেলাম।
Deleteকারা যেন কথা কয়, হিসহিস ফিসফিস, হিসহিস ফিসফিস।
ReplyDeleteযেমন গল্প জমেছিল, তেমনি হলো ফিনিশ।
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
DeleteKuntala-debi, prothome-i boli pore khub anando payechi. Kichu mone korben na, ektu somalochona kori ? Prothom porbo ta amar sobchaye bhalo lageche. Abiram babu ke niye suru hoye kirokom jano Borabhoy er dike g(n)hase galo ? Pathok der utkontha-r chape pore giyechilen ki ? Abiram-babu r bagan chorcha-r ar ektu porochoi pale bhalo lagto. Bivinoo jaiga te satyaji ray-er golper bornona-r probhab ache. Jamon Abiram-babu-r chaya-r bornona ta. Boro-i bhalo hoyeche. Abar prothom porbe kichu jaiga-te sirshendu-r chap ache. Bhuter golpo likhle sirshendu-r chap na thaka tai obak kando. Facebook er RIP post niye apnar age ekta saptahiki chilo na ?
ReplyDeleteEibar guchiye ekta dharabahik uponyash dhore felun.
আপনার সমালোচনা পড়ে আমিও খুব আনন্দ পেলাম ঘনাদা। প্রথম পর্বের সঙ্গে শেষের দুটো পর্বের 'মুড'-এর মিল থাকবে কি না, এ নিয়ে একজন (আমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বস্ত পাঠক) সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, আমার নিজের মনেও সে সন্দেহ ছিল। যথারীতি সে সন্দেহ সত্যি হয়েছে।
Deleteআপনি যে প্রভাবগুলোর কথা বলছিলেন সে বিষয়ে বলি। সত্যজিৎ রায়ের প্রভাবটা নিয়ে আমি সচেতন। কিন্তু লোভ সামলানো যায় না। অন্ধ ফ্যান হিসেবে নিজের এই দুর্বলতাটা নিজে ক্ষমা করে দিয়েছি। শীর্ষেন্দুর প্রভাবটা কেন এল কে জানে। এত লোকের প্রভাব পড়াটা কোনও কাজের কথা নয়।
আবারও বলি, আপনার মন্তব্য পড়ে খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ।
অনেকদিন পরে আপনার ব্লগে এলাম আর এরকম একটা দারুণ সারপ্রাইজ একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছে। আমার প্রথম পর্বটা সবথেকে ভাল লেগেছে, দ্বিতীয় পর্বটাও। ফেসবুকের কমেন্টগুলো অসাধারণ লিখেছেন। আর আপনি ‘নিষিদ্ধ’ শব্দও ব্যবহার (হতাশের কমেন্ট) করতে শুরু করেছেন দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। :-) চিরসখা নামটাও অত্যন্ত ’apt’।
ReplyDeleteওপরের কমেন্টে দেখলাম অন্য লেখকের প্রভাব নিয়ে কিছু বলা হয়েছে। ওসব নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোই ভাল। যতক্ষণ পাঠকের আপনার রচনাশৈলী পছন্দ হচ্ছে, ততক্ষণ প্রভাব আছে কি নেই তাতে কি এল গেল?
শেষে একটা ছোট্ট সমালোচনা (কিছু মনে করবেননা!) — শেষটা ঠিক যেন মনে ধরলনা। মানে ভাল হয়েছে নিঃসন্দেহে, তবে প্রথম আর দ্বিতীয় পর্বের তুলনায় একটা যেন খামতি রয়ে গেল। অনুভূতিটা একেবারেই ব্যক্তিগত এবং যুক্তিহীন। কেন মনে ধরলনা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবনা। :-)
ধন্যবাদ, তথাগত। আপনার মন্তব্য পড়ে খুব ভালো লাগল।
Deleteচিরসখার হোস্টেল আইডিয়া এই গল্পে বেস্ট.. ফেসবুক এর কমেন্টস নিয়ে পার্ট টা ও জব্বর ... :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঊর্মি। তোমার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।
DeleteGhonada je sawmalochonata korechhen,tar sathe amio anektai ekmawt. Durdanto shuru hoyechhilo golpota, sheshe chiching howa satweo phnak ta arektu holey bhalo hoto. :-)
ReplyDeleteমনে রাখলাম, স্যান বন্দ্যো। পরের গল্পে চেষ্টা করব। থ্যাংক ইউ।
DeleteAmar naam Sanmay. Naam dhorei dakun. :-)
ReplyDeleteওহ, সরি সরি। এবার থেকে তাই বলেই ডাকব। আশা করি স্যান বলেছি বলে রাগ করেননি।
DeleteEkebarei na. Sawtan naam dhorei dakun.Dada tada jurrbaro kono dorkar nei.
ReplyDeleteঅলরাইট ভেরি গুড, সন্ময়।
DeleteCha biscuit khai kina jiggasa korchhen? Albaat khai. :-)
ReplyDeleteবাঁচালেন। চাবিস্কুট খায় না লোক দেখলেই আমার সন্দেহ হয়।
Deletebhalo laglo,bhuter punch ta ache,plus facebook e lokder bhodami gulo keo dekhano hoeche..jeta amar khub e bhalo legche..sotyi bolte ki amar fb ta deactivate korechi ei bhodamir jalatei..ar neoa jachchilo na..bhalo galpo..tobe don't mind sei tension ta nei...se hotei pare tumi shilpi manush didibhai..sob lekha soman hobe na
ReplyDeleteআরে না না, ঠিকই বলেছেন, এই গল্পটা একেবারেই হয়নি।
Delete