আসাম ১/ কাজিরাঙ্গার পথে



একদিন তরুণ ঔপন্যাসিক সুব্রত সেনগুপ্ত এই পত্রিকার দপ্তরে এসে খুব উৎকণ্ঠিত ও চিন্তিত ভাবে বললেন, একটু আগে শিবরাম চক্রবর্তীকে দেখলুম, ফুটপাথে শুয়ে আছেন, বোধহয় খুবই অসুস্থ, তারপর আস্তে আস্তে এখানেই এলেন...। আমি খোঁজাখুঁজি করে দেখলুম, তিনি চারতলায় ক্যাশিয়ারবাবুর কাছে একটা টুলে বসে আছেন। আমি প্রথমে সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করলুম, শিবরামদা, আপনি কেমন আছেন? উনি বললেন, এই তো, খুব ভাল আছি, এই মহীর পাশে বসলে শীত করে না। চারদিকে টাকার গরম তো! এরপর জিজ্ঞেস করলুম, আপনি নাকি ফুটপাথে শুয়ে পড়েছিলেন? উনি অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? যেন বিকেলবেলা ফুটপাথে শুয়ে পড়া একজন বিখ্যাত লেখকের পক্ষে অতি সাধারণ ঘটনা! ফের জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ রাস্তায় শুতে গেলেন কেন! উনি বললেন, বুঝলে চাঙ্গোয়ার সামনে ইচ্ছে হলো রাস্তায় একটু বসি, বেশ ভালো গন্ধ তো! তারপর বসে থাকতে থাকতে শুয়ে পড়লুম, বেশ ভালো লাগে, শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা যায়, আগে কোনওদিন দেখিনি...তারপর একটি ছেলে বুঝলে, লেখে-টেখে বোধহয়, আমার হাত ধরে তুলল, তারপর আমার হাত ধরে ধরে আসতে লাগল…বুঝলে, ছেলেটির বোধহয় স্বাস্থ্য খারাপ, নিজে হাঁটতে পারছিল না, তাই আমাকে ধরে ধরে...।

এবারের জন্মদিনে অর্চিষ্মান আমাকে যে তিনটে বই উপহার দিয়েছে তার মধ্যে একটা হচ্ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য’। বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিকের সম্পর্কে লেখকের স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধের সংকলন। সেটা পড়তে পড়তে ‘মা লক্ষ্মী’ নামের বাসে চেপে কাজিরাঙ্গার দিকে চলেছিলাম। আসার পথে বলার মতো কিছু ঘটেনি। আমাদের প্লেন মোটামুটি ঠিক সময়েই ছেড়েছিল, গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছিল সকাল আটটা নাগাদ। সুন্দর সাজানো গোছানো এয়ারপোর্ট অ্যারাইভালের গেট দিয়ে ঢুকেই দেখি একটা পেল্লায় কেঁদো গণ্ডার তার ছানাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য। আমরা গাড়ি ভাড়া করে কাজিরাঙ্গা যেতে পারতাম। সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া পড়ত, টাইম লাগত সাড়ে তিন ঘণ্টা। বাসে গেলে ভাড়া পাঁচশো, সময়ের ব্যাপারটা পরে বলছি। আমরা ঠিক করেছিলাম, শুরুর দিকে যখন শরীর মন চাঙ্গা আছে তখন যত পারা যায় কম খরচে ঘুরব যাতে পরে ক্লান্ত দেহে মনে একটু বিলাসিতা করার সুযোগ থাকে। কাজেই বাস। কিন্তু বাস ধরতে আমাদের যেতে হবে এয়ারপোর্ট থেকে খানিক দূরের ইন্টারস্টেট বাস টার্মিনাসে। প্রি পেড ট্যাক্সির খোপে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম আই এস বি টি পর্যন্ত ট্যাক্সিভাড়া পাঁচশো। শুনেই আমাদের গায়ে ছ্যাঁকা লেগে গেল। আমি এদিকওদিক দেখে সিকিউরিটির খাকি পোশাক পরা একজন মহিলাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এখান থেকে অটো নিলে আই এস বি টি পৌঁছতে কত টাকা লাগার কথা? মহিলা খুব দুঃখী মুখ করে বললেন, অটো পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে এই সাতসকালে। আপ বচ্চে কো বাহার ভেজ দিজিয়ে, ট্যাক্সিসে বাত করকে দেখে অগর পাঁচশো সে কম মে রাজি হোতা হ্যায়...

বাচ্চা? বাচ্চা উনি দেখলেন কোথায়? এদিকওদিক তাকাচ্ছি, তারপর বুঝলাম উনি অর্চিষ্মানকে বাচ্চা বলে অভিহিত করছেন।

আমি মোটা গলায় অর্চিষ্মানকে করলাম, “বচ্চা, যাও ট্যাক্সি পকড়কে লাও”, বাচ্চা বাধ্যমুখে আদেশ পালন করতে চলে গেল।

বাইরের ট্যাক্সি নিয়ে খুব যে সুরাহা কিছু হল তা নয়, পাঁচশোর বদলে চারশো, কিন্তু তাও তো হল? তাছাড়া চালক ভদ্রলোক বেশ ভালো ছিলেন, আমরা টুরিস্ট বুঝতে পেরে আমাদের চারদিক দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলছিলেন। আই এস বি টি এয়ারপোর্ট থেকে সামান্য দূরে। শহরের রাস্তা ছেড়ে আসতেই চোখের সামনে প্রকাণ্ড সব কলাগাছ আর সুপুরিগাছেরা মাথা তুলে দাঁড়াল। একটু পর বাঁ পাশে একটা মস্ত দিঘি দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন এই হচ্ছে দীপর বিল। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। এই বিলের কথা আমি একজন অসমিয়া ব্লগারের ব্লগে পড়েছি। শান্ত স্থির আদিগন্ত বিলের জলের ওপর নানারকম পাখি উড়ে বেড়াচ্ছেডানদিকে তাকালাম। ছোট স্রোতের ওপর একটা জং ধরা সেতু। সেতু পেরিয়ে ফসল কেটে নিয়ে চলে যাওয়া ক্ষেত, ক্ষেতের পেছনে জঙ্গল, সেখান থেকে নাকি মাঝে মাঝেই পঞ্চাশষাটটা হাতির দল বেরিয়ে আসে।

অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভালো লাগছে?”

আসাম বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনাও আমার যেমন ছিল, একটা ভয়ও ছিল। আসাম আমি আগেও গেছি। বেড়াতে, আলাদা আলাদা সময়ে মা বাবা যখন পোস্টেড ছিলেন তখন ছুটিতে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে। এবং প্রেমে পড়ে গেছি। আসামের প্রকৃতির, মানুষের, ভাষার, ব্রহ্মপুত্রের। সে প্রেমের কথা ব্যাখ্যান করে অর্চিষ্মানকে বলেছিঅর্চিষ্মানের এটাই প্রথম আসামদর্শন। মনে একটা হালকা ভয় ছিল, যদি অর্চিষ্মানের আসাম ভালো না লাগে? যদি মনে হয় ওভারহাইপড? আমার এত সাধের আসাম যদি অর্চিষ্মানকে একই রকম মুগ্ধ করতে না পারে তাহলে যেন কোথাও একটা পরীক্ষায় ফেলের অনুভূতি হবে।

কিন্তু আমি পাশ করে গেছি। উইথ ডিস্টিংশন। অর্চিষ্মানের সেই মুহূর্তের মুখটা দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম। বিলের ওপর উড়ন্ত পাখি, জং ধরা সেতু, চারদিকের ঠাণ্ডা সবুজ অর্চিষ্মানের ওপরেও একই রকম ম্যাজিক করেছে, যেমন আমার ওপর করেছিল। যেমন পৃথিবীর যে কোনও মানুষের ওপর করবে।

এমন সময় শান্তি ভঙ্গ করে আমাদের গাড়ির ভোঁ বেজে উঠল। দেখি ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। আমি ভাবলাম হাতি বেরোল নাকি? তারপর দেখি হাতিটাতি কিছু নয়, সামনে একটা টকটকে লাল রঙের বাস, প্রায় হাতির মতোই দুলকি চালে চলেছে

ওটা জোরহাটের বাস। ওটা কাজিরাঙ্গার ওপর দিয়ে যাবে।

আমাদের ড্রাইভারের “রও রও” চিৎকারে বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে ট্রাংক খুলে আমাদের লাগেজ নামিয়ে দিয়েছেন একটা বাচ্চা ছেলে বাস থেকে নেমে তীরের মতো ছুটে এসে আমাদের ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠিয়ে দিল। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে না পেরে আমরাও বাসে উঠ পড়লাম। তারপর একেতাকে জিজ্ঞাসা করে আশ্বস্ত হওয়া গেল যে এটা জোড়হাটেরই বাস, এটা কাজিরাঙ্গার ওপর দিয়েই যাবে। তখন রোদ এসে পড়া দুটো পাশাপাশি সিট দেখে বসে ব্যাগ থেকে বই বার করে বুকমার্ক করা পাতাটা খুলে আরাম করে বসলাম। এইবার বই পড়তে পড়তে, জানালা দিয়ে আসাম দেখতে দেখতে যাব। স্বর্গ।

আবহাওয়ার দিক থেকে দেখতে গেলে চমৎকার, কিন্তু আর সমস্ত দিক থেকে দেখতে গেলেই বেড়ানোর সময়নির্বাচনটা আমাদের বোকার মতো হয়েছে। কাজিরাঙ্গার মতো টুরিস্ট হটস্পটে বড়দিনের লং উইকএন্ডে ভিড় হবে সেটা আন্দাজ ছিল। কিন্তু আমাদেরও ছুটির ব্যাপার আছে। তাছাড়া আসাম যাব আর এ বছরেই যাব এই জেদও ছিল। অগত্যা ক্রিসমাসের ছুটিই সইআমরা থাকব আসাম টুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এ টি ডি সি)-র অরণ্য গেস্ট হাউসে। ইন্টারনেট থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যেদিন অরণ্য গেস্টহাউসে ফোন করেছিলাম সেদিনই ওপারের ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন যে ডিসেম্বর মাসের শেষ দশদিনে মাত্র একটি রাতে তাঁরা আমাদের জায়গা দিতে পারেন। বাইশে। অবশ্য উনি কাছের আরও দুটো সরকারি গেস্টহাউস বনানী আর বনশ্রীতেও ফোন করে খোঁজ নিতে বলেছিলেন, কিন্তু ছবিটবি দেখে আমাদের অরণ্যই পছন্দ হয়ে গেল আর আমরা বললাম বাইশ তারিখ আমরা আপনাদের হোটেলে থাকছি। ইন ফ্যাক্ট এই গোটা আসামভ্রমণটার নকশা হয়েছে ওই বাইশ তারিখে কাজিরাঙ্গায় এক রাতের বুকিংকে ঘিরে। সেটাও খুব একটা বুদ্ধিমানের মতো হয়নি হয়তো ছোটাছুটি বেশি হয়েছে, দুয়েকটা জায়গায় আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারলে হয়তো ভালো লাগত, কিন্তু কী আর করা।

দুপুর দুটো নাগাদ আমরা খেতে থামলাম। পথের পাশে ধাবা। চারপাঁচটা বাস, সাতআটটা গাড়ির খদ্দেরের ভিড়ে একেবারে গমগম করছে। আমি নিলাম নিরামিষ রুটির থালি আর অর্চিষ্মান নিল মাছ ভাত থালি। রুটি ভাত মাছ বাদ দিলে কমন আইটেম ছিল ডাল, আলু পেঁয়াজকলির শুকনো তরকারি, সয়াবিনের তরকারি, চাটনি, পায়েস। সাধারণ রান্না, কিন্তু খিদের মুখে আর ওই জমজমাট পরিবেশে অমৃতের মতো লাগছিল।

খেয়ে উঠে আবার বাস চলল। বাসটা কাজিরাঙ্গা কখন পৌছবে সে নিয়ে আমাদের দুজনের কারওরই কোনও ধারণা ছিল না। ইন্টারনেটে লেখা ছিল পাঁচ ঘণ্টা, অরণ্য-র ভদ্রলোক আভাস দিয়েছিলেন ঘণ্টা চারেক, আর গুয়াহাটি থেকে যে ভদ্রলোকের গাড়িতে এলাম তিনি বলেছিলেন দুআড়াই ঘণ্টা। এদিকে আমাদের ঘড়িতে তখন বাজে তিনটে। সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা বাসে চড়েছি, অর্থাৎ অলরেডি সাড়ে পাঁচঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। হাতে ধরা গুগল ম্যাপ বলছে এখনও একঘণ্টার মতো রাস্তা বাকি। কিন্তু সে একঘণ্টার রাস্তাটা ঠিক কতক্ষণে ফুরোবে সেটা আন্দাজ করা ভগবানের বাবারও সাধ্য নয় কারণ বাসটা আদৌ চলছে না। মানে চলছে, কিন্তু দশমিনিট চলে পনেরো মিনিট দাঁড়াচ্ছে। কন্ডাকটর দরজায় ঝুলে আছেন, রাস্তা দিয়ে যে-ই যাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন সে কোথায় যাবে, বাসে লিফট চাই কি না। অবশ্যই ভাড়ার বিনিময়ে। ইঞ্জিনের আওয়াজে একপক্ষ অন্যপক্ষের গলার আওয়াজ শুনতে না পেলে ড্রাইভার কনসিডারেটলি বাস থামাচ্ছেন, তখন কথোপকথন শান্তিতে সম্পূর্ণ হচ্ছে। কোনও একটা মোড়ের কাছাকাছি এসে বাস একেবারেই থেমে যাচ্ছে। কন্ডাকটর নেমে কোথায় চলে যাচ্ছেন, বেশ কিছুক্ষণ পর কখনও খালি হাতে, কখনও দুচারজন নিরীহ যাত্রীকে বগলদাবা করে ফিরছেন। বাসশুদ্ধু লোক নিশ্চিন্ত মুখে বসে আছে।

আমার অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল। খুব সম্ভবত ধুবড়ি কিংবা অন্য কোন ছোট শহর থেকে আমি আর মা বাড়ি ফিরছিলাম। সেই শহর থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত একটা প্লেনে যাব আমরা, গুয়াহাটি থেকে দমদম আরেকটা প্লেনপ্রথম প্লেনটা ধরার জন্য সকাল সকাল এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। খুবই ছোট এয়ারপোর্ট, প্রায় হেলিপ্যাড গোছের চেহারা। আরও কিছু লোক ছড়িয়েছিটিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা প্লেনের অপেক্ষা করে করে, চা খেয়ে খেয়ে বোরের হদ্দ হয়ে গেলাম। খবর এল, প্লেন আসবে না।

একজন কর্তৃপক্ষের লোক ভয়ানক ক্ষমাটমা চেয়ে আমাদের জানালেন যে চিন্তার কোনও কারণ নেই। বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে আমাদের গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এন্তার সময় আছে, চিন্তার কোনও কারণ নেই। বাস এল। আমরা সবাই বাসে উঠে সিট বেছে বসে পড়লাম। বাস ছেড়ে দিল।

মনে রাখতে হবে যে সেটা গুগল ম্যাপের জমানা নয়। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা গুয়াহাটি শহরে ঢুকলাম। প্লেনের সময় এদিকে ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এয়ারপোর্টের দেখা নেই। বাস শহর ছাড়িয়ে কাঁচা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। দুপাশে ক্ষেত। সবাই চুপ করে বসে আছে। আমিও বসে আছি। ভাবছি এয়ারপোর্ট তো শহর থেকে দূরেই হয়। এমন সময় পাশ থেকে আমার মা সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন, “রাস্তা চেনেন?” ড্রাইভার আমতা আমতা করে জানালেন যে তিনি এর আগে কোনওদিন গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে আসেননি বটে, কিন্তু রাস্তা যখন এদিকে যাচ্ছে তখন এয়ারপোর্টও নিশ্চয় এদিকেই হবে। তাই না?

আমার মা চিৎকার করে ড্রাইভারকে বকতে শুরু করলেন। হিন্দি, বাংলা, অসমিয়া মেশানো একটা হাস্যকর জগাখিচুড়ি ভাষায়। বাসশুদ্ধু লোক চুপটি করে বসে দেখতে লাগল। আমি লজ্জায় বাসের মেঝেতে মিশে যেতে লাগলাম। কিন্তু মায়ের তাপউত্তাপ নেই। মা ড্রাইভারকে আদেশ করলেন, এইমুহূর্তে এইখানে গাড়ি দাঁড় করান। খাঁ খাঁ রাস্তা, কেউ কোথাও নেই। ড্রাইভার একবার বলার চেষ্টা করল যে আরেকটুক্ষণ এই পথেই চালানো যাক, যদি কাউকে পাওয়া যায় তাহলে তার থেকে ডিরেকশন নিয়ে নেওয়া যাবেখন। তাতে মা তার দিকে সেই লুকটা দিলেন যে লুকের উত্তরে হাঁ করা যায় কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বার করা যায় না। এমন সময় দূর থেকে একটা লোককে সাইকেল করে আসতে দেখা গেল। মা বললেন, “শিগগিরি এরে জিগান।” বলে আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে নিজেই ড্রাইভারের সিটের পেছন দিয়ে জানালা গলিয়ে মাথা বার করে চিৎকার করলেন, “হ্যাঁ ভাই, এয়ারপোর্ট কোন ফালে?” বাসশুদ্ধু লোক চুপ করে বসে রইল। কেউ কেউ আমার দিকে খুব করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমার জীবনের স্ট্রাগলটা অন্তত এরা কল্পনা করতে পারছে, এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সাইকেলওয়ালা বললেন, এয়ারপোর্ট? বেশিদূর নয়, যে পথ দিয়ে আমরা এসেছি সে পথে মিনিট পঁয়তাল্লিশ ফিরে গেলেই এয়ারপোর্ট পাওয়া যাবে।

বাস পেছন ফিরে চলল। বাসশুদ্ধু লোক চুপ করে বসে রইল। গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে যখন নামলাম তখন প্লেন ছাড়তে এক্স্যাক্টলি পনেরো মিনিট বাকি। কর্তৃপক্ষর লোক উদ্বিগ্ন মুখে এয়ারপোর্টের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। গোটা এক বাস যাত্রী হাইজ্যাক হয়ে গেল কি না সেটাই ভাবছিলেন বোধহয়। আমরা যেতেই আমাদের প্রায় পাঁজাকোলা করে নামিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বোর্ডিং পাস আর সিকিউরিটির লাইন পার করিয়ে দেওয়া হল।

আমার মা না থাকলে সেদিন কিছুতেই ওই প্লেনটা ধরা যেত না এটা সম্পূর্ণ বুঝতে পারার পরেও আমার লজ্জা করছিল মনে আছে। মনে হয়েছিল আমার মায়ের রমণীয়, মৃদুভাষী হওয়াটা প্লেন মিস হয়ে যাওয়ার থেকেও অনেক বেশি জরুরি।

অর্চিষ্মান বলল, আজ কপালে দুঃখ আছে।

আমি বললাম, নাও থাকতে পারে। দাঁড়াও।

আমি সিট ছেড়ে উঠে গেলাম। ড্রাইভারের কেবিনের সামনে গিয়ে গলা যতটা সম্ভব আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে (মায়ের মতো হল না, তবু চেষ্টা তো করতে হবে) জানতে চাইলাম, সমস্যাটা কী? বাসটা দাঁড়িয়ে আছে কেন? ড্রাইভার, কন্ডাকটর এবং বাসশুদ্ধু লোক চুপ করে রইল। আমি ফেরত চলে এলাম। পত্রপাঠ বাস ছেড়ে দিল।

আমার কিংবা আমার মায়ের অভদ্রতার কথা ফলাও করার জন্য নয়, এই ঘটনাদুটো আমি বললাম অসমের লোকদের চুপ করে থাকার অসীম ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার জন্য। বাস তো ছেড়েই দিলাম, আমি নিশ্চিত পনেরো বছর আগের সেই দিনে প্লেন মিস হয়ে গেলেও তাঁরা কিছুই বলতেন না। চুপ করে পরের প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতেন। এর পরের পাঁচদিন ধরে যে ক’বার বাস, ব্যাটারি অটো, ম্যাজিক টেম্পোতে উঠেছি, দেখেছি একই ব্যাপার। পাঁচজনের জায়গায় গাড়িতে পনেরোজন উঠছে, কারও মুখে রা নেই। একটা সিট খালি রয়ে গেছে বলে গাড়ি আধঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির ভেতর পাঁচজন চুপটি করে বসে আছে। রাগ নেই, তাপউত্তাপ নেই। কোথাও যাওয়ার কোনও তাড়া নেই। সময়ের বাঁধাবাঁধি নেই।

আমি এটা নিন্দে করার মতো করে বলছি না। কারণ অসমিয়াদের এই অনন্ত ধৈর্য আর অসামান্য ক্ষমা আমাকে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অকারণ প্রশ্রয় দিয়েছে। কাজেই আমার অভিযোগের কোনও জায়গাই নেই।

কাজিরাঙ্গার স্টপেজটার নাম কোহোরা মোড়। সেখানে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে প্রায় চারটে। রাস্তার দুদিকে দুটো বড় বড় গেট। বাঁদিকে ঢুকে গেলে জঙ্গল, ডানদিকে গেলে গেস্টহাউস। আমরা গেস্টহাউসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। দুপাশে হাতিকুলি চা বাগান। মাঝখান দিয়ে ঢেউখেলানো পাথরের ইটগাথা রাস্তা। রাস্তার ওপর দিয়ে ঘরঘরিয়ে আমাদের ক্যারি-অন সুটকেসের চাকা চলল। অনেকটা পুবদিকে চলে এসেছি বোঝা যাচ্ছিল। মোটে চারটে বাজে অথচ রোদ মরে এসেছে। সেই কত ভোরে বেরিয়েছি। আমি তো তাও কয়েকঘণ্টা ঘুমিয়েছি, অর্চিষ্মান তো রাতভর জাগা। অত ক্লান্তির মধ্যেও বুঝতে পারছিলাম দুপাশের দৃশ্য কী অদ্ভুত সুন্দর। ভোরবেলা দিল্লির এয়ারপোর্টে বসে থাকার সঙ্গে বিকেলবেলায় চা বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পটবদলের অবিশ্বাস্যতা, ওই রাতজাগা মগজেও ধরা পড়ছিল। প্রায় সাত মিনিট সোজা হেঁটে, ডানদিকে তারপর বাঁদিকে বেঁকে তিন মিনিটের একটা ছোটো চড়াই ভেঙে আমরা অরণ্য টুরিস্ট লজের গেটে এসে পৌঁছলাম। চায়ের তেষ্টায় তখন বুক ফেটে যাচ্ছে।

                                                                                                                                                                  
                                                                                                   (চলবে)    
আসাম ২/ পবনের পিঠে


Comments

  1. Eyi toh pakoda!
    Amra ek trip e Udaipur theke Jodhpur jabo bole hotel er lok ke bolechilam bus er ticket kore dite. Byata local bus e kore diyechilo. Koto je gram gonjo diye hele dule shey bus pounchechilo ki bolbo.
    Eto deri kore pounche matro ekta raat thakar byabostha e ki korle? Waiting.

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদিন থাকাটা সত্যিই আফসোসের, শর্মিলা। যখন প্ল্যান করেছিলাম তখন মনে হয়েছিল যথেষ্ট, অত কাণ্ড করে পৌঁছে মনে হল আরেকরাত থাকলে হত। কিন্তু তখন আর ভুল সারানোর উপায় ছিল না।

      Delete
  2. Darun darun, sudhu ei abhigyatar janyai Assam jete hobe mone hocche!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আসাম অসাধারণ। শিগগিরি প্ল্যান করে চলে যা, তিন্নি।

      Delete
  3. তোমার মাএর অভদ্রতা নয় বীরাঙ্গনার কাজ। আর তোমার মার জন্য বাকিদের কত সুবিধা হল। হ্যাটস্‌ অফ টু হার। আর এত ঘনঘটার পর পকৌড়াটা সিম্পলি ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস্‌।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, মাকে বীরাঙ্গনা বললে মা কাঁদবেন, মালবিকা। চেঁচানোর দরকার থাকলে মা চেঁচাতে লজ্জা বা ভয় পান না, এটুকুই। সারাদিন জার্নি করে কোথাও পৌঁছে চা আর পকোড়া যে কী ভালো লাগে খেতে, হাজার পোলাও কালিয়ার থেকে স্বাদু।

      Delete
  4. কন্ডাকটর নেমে কোথায় চলে যাচ্ছেন, বেশ কিছুক্ষণ পর কখনও খালি হাতে, কখনও দুচারজন নিরীহ যাত্রীকে বগলদাবা করে ফিরছেন। বাসশুদ্ধু লোক নিশ্চিন্ত মুখে বসে আছে। - eta just osadharon. amader kolkata r driver, conductor ra assam giye bus chalate parle khub khushi hobe. ekhane bechara der choddo purush uddhar hoye jaye gali kheye kheye.
    tomar mayer ghotona ta darun mojar. jodio sei muhurte ota nischoi mojar chilo na.
    next part er jonno wait kore roilam.
    ar shurur quote ta pore kichukhon speechless hoye gechilam. kon map er manush tai na chilen bhodrolok.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যক্তি শিবরামের কথা বেশি পাওয়া যায় না, (কারণ উনি প্রাণপণে নিজের কথা বলা পরিহার করেছেন সারাজীবন), কিন্তু যেটুকু পড়েছি বা লোকের মুখে শুনেছি, তাতে বোঝা যায় লোকটি বাকিদের থেকে কতখানি আলাদা ছিলেন। সুনীল এই বইয়েও লিখেছেন, শিবরামের সামনে তাঁর লেখার প্রশংসা করতে শুরু করলেই শিবরাম তড়িঘড়ি কথা ঘুরিয়ে অন্য লেখকরা কত ভালো সেই প্রসঙ্গে চলে যেতেন। আমার শ্বশুরমশাই একবার অটোগ্রাফ নিতে শিবরামের মেসে গিয়েছিলেন। শিবরাম সই দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু যা কথা বলেছিলেন সবই অন্যদের নিয়ে। বাবাকে বলেছিলেন, নীললোহিত বলে একজন খুব ভালো লিখছে, পড়েছ? আমার হাততালির জন্য হন্যে হয়ে থাকা মগজ দিয়ে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না এতখানি নির্মোহ কী করে কেউ হতে পারে।

      কলকাতার কন্ডাকটর নিয়ে তোমার মন্তব্যটাও একেবারে স্পট অন। কাল তিন্নির সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় এই সব গল্পগুলো বলছিলাম, তিন্নি জানতে চাইছিল, যখন বাস ওইরকম দাঁড়িয়ে থাকে কেউ বাসের দেওয়ালে ধাঁই ধাঁই করে থাবড়া মারে না, যেমন আমাদের কলকাতায় মারে? সিরিয়াসলি, কলকাতার যাত্রীদের পাল্লায় পড়লে আসামের প্রতিটি বাস এতদিনে ফুটিফাটা হয়ে যেত।

      Delete
  5. Swosorir e to ghora hocche na. Apnar lekha pore manosbhromon hoe jachhe.
    Lekhata khub valo lagche, ei j bhromon kahinir sathe choto choto flashback r golpo, just darun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সুহানি।

      Delete
  6. sei prothom abantor pore jemon tomar humor gulo osadharon legechilo.. sei rokom bhalo lagar moto lagche.. hese kul pacchina.. mon bhalo korar obyortho oshudh... jome geche Assam.. uff aro moja hobe mone hocche.. besi deri korio na Kuntala di.. prothom er boi tar sondhan peyeo khub bhalo laglo.. chai chai mone hocche..

    ReplyDelete
    Replies
    1. লোকজনের বাসট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছে আর তোর হাসি পাচ্ছে, ঊর্মি? আমারও ঘটনাটা ঘটার অনেকদিন পর হাসিই পেয়েছিল কিন্তু তখন একটুও পায়নি। আর আমি নিশ্চিত তখন হাসলে মা আমাকে ওইখানেই বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে একা একা বাড়ি চলে আসত।

      Delete
  7. Purota lekha cha pakorar jonyo opekkha kore, last er chhobita dekhe ashwosto holam je sei tradition somane cholitechhe!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এমন ভালো ট্র্যাডিশন তুলে দিই কী করে, বিম্ববতী?

      Delete
  8. গুরু, আরো ছবি দেখাও, আসাম যাওয়ার খুব ইচ্ছে আমারও। নতুন বছর খুব ভাল কাটুক তোমাদের :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাও যাও, আসাম যাও প্রিয়াঙ্কা। চমৎকার জায়গা। তোমারও নতুন বছর খুব খুব আনন্দে কাটুক।

      Delete
  9. Apni jei bus e giyechen, ota long journey bus i.e Guwahati to Jorhat, 6-7 hours journey. Tai jatri der behaviour oirokom chilo. Kintu jodi kokhono Guwahati Shohorer bhetor city bus gulo choren tahole dekhben kolkatar jatri der songe khub ekta tofat nei. Mane Dhai-Dhai kore bus er body te petano theke shuru kore driver-conductor ke galagali deoa, shob i ache. BTW, aamar rajyo ta ghure gechen jene bhalo lagche. Apnar chokhe nijer jaygake dekhar ashay next post er jonno opekkhay roilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ও আচ্ছা, তাই বুঝি? আপনার রাজ্য আমার নিজের রাজ্যের থেকেও বেশি প্রিয়, প্রসূর্য। কাজেই আরও অনেক বার যাব।

      Delete
  10. খুব সুন্দর লেখা। আপনার গল্প পড়ে দুটো দৃশ্য মনে পড়ল। ট্যাক্সি ড্রাইভারের "রও রও" বলে বাস থামানোর গল্প শুনে সোনার কেল্লায় সিংজির উট থামানোর দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। আর আপনার মায়ের বাস ড্রাইভারকে বকার গল্পটায় আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনার মুখটা চেম্বার অফ সিক্রেটস-এ খাওয়ার টেবিলে মায়ের হাউলার পাওয়ার পর রনের মুখের মতন হয়ে গেছে।হাতিকুলি নামটা ভীষণ সুন্দর। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Hatikuli mane jekhane Hati khub frequently aashe. Hatikuli Cha Bagan er cha khub famous. very old tea garden. Ei cha bagan e Salil Choudhary chotobelay koek bochor chilen.

      Delete
    2. সুগত, অনেক ধন্যবাদ। আশা করছি আপনি দেশে খুব ভালো ঘুরছেন।

      প্রসূর্য, সলিল চৌধুরীর ব্যাপারটা জানতাম না। হাতিকুলির নাম যেমন সুন্দর, চেহারাও ততোধিক। চা-টা এখনও টেস্ট করা হয়নি। নিশ্চয় ভালোই হবে। আমাদের যিনি হাতিকুলির রেকো দিয়েছিলেন তিনি ওখানকার গোলমরিচও আনতে বলেছিলেন, কিন্তু দোকান থেকে বলা হল যে এখনও গোলমরিচের হারভেস্টিং চলছে, কাজেই পাওয়া গেল না।

      Delete
  11. notun bachhorer subhechha !!!

    " মনে হয়েছিল আমার মায়ের রমণীয়, মৃদুভাষী হওয়াটা প্লেন মিস হয়ে যাওয়ার থেকেও অনেক বেশি জরুরি "... eirakom poristhiti amar chhotobelateo asto ar ekhon amar meyer ashe... ami majhe majhe bhabi eirakom poribarton amar holo ki kore :-) .

    Darun beranor plan to.beranor aro galper opekhai roilam ... sesher chhobita beranor galpe ekkebare must

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও নিজের পরিবর্তন দেখে চমকে যাই, ইচ্ছাডানা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ছোটবেলায় যে মায়ের যে জিনিসগুলো দেখে কুণ্ঠিত হতাম, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মা সেই সেই জিনিসগুলো আমার ভেতর চালান করেছেন। লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  12. darun, chobir moto dekhte pachhilam ghotona gulo . -Pradipta

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রদীপ্তা।

      Delete
  13. khub jompesh kore assam kahini shuru korechhe.. ami besh kichhudin abantor mukho hote parini- ebar gopgop kore baki part gulo pore felbo :)
    tomar lekha pore amio assam er proti mugdho hoe jachhi, tao to konodin jaini, jawar plan jodio anekdiner. Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেশে এসে এদিকওদিক বেড়াতে যাওয়া অবশ্য বেশ ঝকমারি, তবু যদি সময় করতে পার, আসামটা একবার ঘুরে আসতে পার, ব্রততী।

      Delete

Post a Comment