রিষড়ার খাওয়াদাওয়া
রিষড়ার স্পেশাল খাওয়াদাওয়া নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই যে খাবারদুটোর কথা মনে পড়ছে তারা আদৌ রিষড়ার নয়। শ্রীরামপুরের। একসময়ে সভ্যতার সন্ধান পেতে গেলে রিষড়ার লোকদের শ্রীরামপুর যেতে হত। কলকাতা গেলেও হত, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে গেলে ট্রেন বাস ধাক্কাধাক্কি,অনেক হাঙ্গামা। শ্রীরামপুর সে তুলনায় নাগালের মধ্যে। ভালো সোয়েটার কিনতে হলে আমরা শ্রীরামপুরে যেতাম। ভালো হলে বসে সিনেমা দেখতে হলে শ্রীরামপুরে যেতাম। খাদ্যরসিক বুড়োরা বলতেন আরে এখানে খেয়ে খামোকা পেট নষ্ট করছ কেন, ভালো তেলেভাজা যদি খেতে হয় শ্রীরামপুরে মদনের রেস্টোর্যান্টে যাও। আমার বাবা মাঝে মাঝে দিলীপের লেবু চা খেতে শনিরবিবার বিকেলে সাইকেল নিয়ে শ্রীরামপুরে যেতেন। বাবার সাইকেলের ডান্ডায় একটা মিনি সিট বসানো ছিল, তাতে চড়ে আমিও যেতাম। অত ভালো লেবু চা নাকি রিষড়ায় পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে দোকানে দিলীপের ছেলে থাকত। সে বাবার মতো অত ভালো বানাতে পারত না, তবুও যা বানাত তা রিষড়ার সব চাওয়ালার থেকে ভালো। খুব আত্মবিশ্বাস না থাকলে যে সব দোকানের বন্ধ দরজা ঠেলে ঢোকা যায় না, আর ঢুকলেই গলা আপসে তারা থেকে উদারায় নেমে আসে,সেরকম ভালো দোকানেও আমি জীবনে প্রথম খেয়েছিলাম শ্রীরামপুরেই। সম্রাট হোটেল। পিসির সঙ্গে ভালো কিছু কিনতে গিয়েছিলাম শ্রীরামপুর, কেনাকাটি সেরে সম্রাটে খাওয়া হয়েছিল। কী খেয়েছিলাম মনে নেই, নির্ঘাত ভালো কিছুই হবে।
কাজেই রিষড়ার খাবার বলতে যে আমার প্রথমে শ্রীরামপুরের খাবার মনে আসবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে খাবারদুটোর কথা আমার মনে পড়ছে সেটার একটা হচ্ছে জিলিপি আর দু’নম্বরটা হচ্ছে চিনেবাদাম। জিলিপির দোকানটা ছিল একেবারে মোড়ের মাথায়। আসলে ওটা জিলিপির দোকান ছিল না, ছিল পাপোশের দোকান। কিছু এক্সট্রা ইনকাম হবে ভেবে পাপোশওয়ালা বুদ্ধি করে দোকানের সামনে একটা উনুন আর কড়াই আর ছান্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষে ওটাই তাঁর মুখ্য ব্যবসা হয়ে গেল। পাপোশ দুয়েকটা যা বিক্রি হত, সবই জিলিপির সৌজন্যে। খেতে খেতে আর কিছু করার না পেয়ে লোকজন বোরড হয়ে শেষে একটা পাপোশ কিনে বাড়ি ফিরত। আমার মাও কিনেছিলেন একবার।
চিনেবাদামের দোকানটা ছিল শ্রীরামপুরের টিকিটঘরের একেবারে সামনে। দোকান মানে একটা ঝুড়ি, তার সামনে উবু হয়ে বসা ভদ্রমহিলা। ঝুড়িতে কুপি থাকত না, তাই উনি স্ট্র্যাটেজি করে টিকিটঘরের আলোটার ঠিক নিচে জায়গা নিতেন।
রিষড়ার না হয় নাই হল, ওগুলো কি শ্রীরামপুরের স্পেশাল জিলিপি আর শ্রীরামপুরের স্পেশাল চীনেবাদাম? উঁহু। আপনারা তো বটেই, আমিও ওর থেকে ভালো জিলিপি অনেক খেয়েছি। চিনেবাদাম যত জায়গায় খেয়েছি, তাদের সবাইকেই সমান রকম অসামান্য লেগেছে, কাজেই শ্রীরামপুরের টিকিটঘরের সামনের চিনেবাদামকে স্পেশাল বলার কোনও কারণ নেই।
তবু আমি স্পেশাল খাবারদাবারের পোস্টে এদের কথা বলছি কেন? কারণ বাকি সব জিলিপির স্বাদ আমি ভুলে গেছি, উদরস্থ হওয়া লাখখানেক চিনেবাদামের একটাকে অন্যটার থেকে আলাদা করার কোনও উপায় নেই, কিন্তু ওই জিলিপি আর ওই চিনেবাদামের স্বাদ চেহারা গন্ধ, তাদের বিক্রেতাদের মুখের ভঙ্গি, ব্যাকগ্রাউন্ডে পাপোশের থাক, টিকিটঘরের আলো, মুড়ি দিয়ে শোওয়া ভিখিরি, উদাসী কুকুর, মিস হয়ে যাওয়া ট্রেনের ভোঁ, খালি হয়ে আসা সাইকেল জমা রাখার দোকান, সব মাথার ভেতর একেবারে জ্বলজ্বল করছে।
জনাইয়ের যেমন মনোহরা আছে, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানা, রিষড়ার সে রকম কিছু স্পেশাল খাবার নেই। না থেকে ভালোই হয়েছে, কারণ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি এই সব লেজেন্ডারি খাবারগুলো বিশেষ সুবিধের হয় না। জনাইয়ের মনোহরা একবার খেয়ে আর খাওয়ার সাহস হয়নি। শক্তিগড়ের ল্যাংচা আমি খাইনি, যাঁরা খেয়েছেন টের পেয়েছেন। বর্ধমানে ট্রেনের জানালা দিয়ে কেনা সীতাভোগ মিহিদানা খেয়ে কিছুই মহিমা বুঝতে পারিনি বলায় কাকু বলেছিলেন, ধুস, ওগুলো আবার সীতাভোগ নাকি? বাবা বলেছিলেন, সে তো বটেই, সবাই জানে বর্ধমানের আসল সীতাভোগ পাওয়া যায় অমুক ময়রার দোকানে। কাকু বলেছিলেন, সবাই জানাটাই তো প্রবলেম। বর্ধমানের আসলি যে সীতাভোগমিহিদানা সেটা খেতে গেলে ও সব দোকানটোকান নয়, যেতে হবে স্টেশন থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে, কোনও গাড়ি সেখানে যায় না। সেখানে নামহীন একটা ঝুপড়িতে গত দেড়শো বছর ধরে সেম কোয়ালিটির সীতাভোগমিহিদানা বানানো হচ্ছে। বাবা দোকানের রাস্তা জানতে চাইলেন, কাকু রাজি হলেন না। বেশি লোক জানলেই চিত্তির। তোর খাওয়া নিয়ে কথা তো? আমার ওপর ছেড়ে দে। পরের রবিবার সীতাভোগ মিহিদানা নিয়ে এলেন কাকু। প্লেট থেকে চামচে করে মুখে পুরছি আর কাকু উজ্জ্বল চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সবাই স্বীকার করলাম যে এ জিনিস আগে কখনও খাইনি। পরেও খাওয়ার আশা নেই, কাকু শুধরে দিলেন। তার কিছুদিন পর খুব খিদের মুখে পাড়ার সিদ্ধেশ্বরীতে ঢূকে মাছিবসা সীতাভোগ খেয়েছিলাম, সত্যি বলছি কোনও তফাৎ টের পাইনি।
রিষড়ার উল্লেখযোগ্য খাবারের প্রসঙ্গে ফেলু ময়রার দোকানের কথা অবশ্য বলা দরকার। স্বয়ং অটলবিহারী এ দোকানের মিষ্টি খেয়েছিলেন। ফেলু ময়রার মেন দোকানটা হচ্ছে জি টি রোডের ধারে, রিষড়ার বনেদি পাড়ায়। আমি বেশ বড় হয়ে যাওয়ার পর স্টেশনের কাছে একটা শাখা খুলেছিল। সে দোকানেও দারুণ বিক্রি, তবে দোকানি ভদ্রলোক মহা খিটখিটে। আমি আর মা তাই মিষ্টি ভালো হওয়া সত্ত্বেও ওই দোকানে খেতাম না। মানুষের ব্যবহারটাই সব, সোনা। আমরা যেতাম‘খাবার ঘর’-এ। ওখানের কাকুরা সন্দেশের বাক্স কাউন্টারের ওপর দিয়ে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলত, গরমটা দেখেছেন, বৌদি?
‘খাবার ঘর’ বিরাট দোকান, আমার দিল্লির গোটা ভাড়াবাড়িটার থেকে বড় সাইজের। অত বড় দোকান আলোকিত করার ঝামেলায় যেতেন না মালিকেরা, কোণগুলো অন্ধকারই থাকত। সকলেই সামনের দিকের দুটো টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া সারত। দোকানের মালিক ছিলেন দুই ভাই, শুনেছি ওঁরা রিষড়ার লোক ছিলেন না। শেওড়াফুলি থেকে আসতেন। শেওড়াফুলিতেও নাকি একটা খাবার ঘর আছে। ওটাই আসল। আমাদেরটা ব্রাঞ্চ। রিষড়ার মানুষদের বোধহয় ওঁরা আপন বলে ভাবতে পারেননি, কারণ আমার বড় হওয়ার প্রায় কুড়িটা বছরে আমি একটি দিনও ওঁদের কোনও খদ্দেরের সঙ্গে হেসে কথা বলতে দেখিনি। লৌকিকতার ভার ছিল সহকারীদের ওপর। তবে আলাপী না হলেও ভদ্রলোকদের কখনও বদমেজাজি বা বাজে লোক বলে মনে হয়নি। অসম্ভব ঠাণ্ডা মুখচোখ ছিল দুজনেরই। তখন শব্দটা জানতাম না, এখন বুঝি দুজনেই ওবিজ ছিলেন। তারপর ওঁদেরই একজন উত্তরপুরুষ কাউন্টারে বসতে শুরু করলেন। ইনিও ঠাণ্ডা, ইনিও ওবিজ। খাবার ঘর-এর মিষ্টি হয়তো সাধারণই ছিল, কিন্তু আমার খুব ভালো লাগত। কাঠের টেবিল চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে স্টিলের প্লেটে করে পান্তুয়া, সিঙাড়া, কচুরি। খারাপ লাগার আছেই বা কী? একদিনের কথা বিশেষ করে মনে আছে। আমি আর মা একবার পাশাপাশি বসে মিষ্টি দই খাচ্ছি, মায়ের ভাঁড়ের ঠিক মাঝামাঝি পৌঁছে দইয়ের ভেতর একটা বাচ্চা আরশোলার মৃতদেহ বেরোল। পারফেক্টলি সংরক্ষিত।
মা যে দোকান থেকে টিপের পাতা কিনতেন তার সামনে একটা এগরোলের দোকান ছিল। আমার মতে রিষড়ার বেস্ট এগরোল। খাওয়ার থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং হচ্ছে বানানোটা দেখা। ফেটানো ডিম গরম চাটুতে পড়ে চিড়বিড়িয়ে উঠলেই আমার জিভে জল এসে যেত। আমি ভাবতাম যিনি ব্যাপারটা বানাচ্ছেন তার নিশ্চয় আমার থেকেও বেশি লোভ লাগছে? কাকুর মুখের দিকে তাকাতাম। দেখতাম তিনি ঢোঁক গিলছেন কি না। নাঃ। ময়দার রুটি ডিমের ওপর চাপা দিয়ে খুন্তি চেপে চেপে কাকু সেটাকে চাটুর ওপর ঘোরাতেন, চাপে পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের খুন্তি বেঁকে যেত আর তালে তালে কাকুর চোয়ালের হাড় ওঠানামা করত। আর ছিল সেবাসদন হাসপাতালের উল্টোদিকের ফুচকা। বিক্রেতার নাম মদন। মদনবাবুর ফুচকা ছিল রিষড়ার মহিলাদের হার্টথ্রব। মায়ের সঙ্গে বেরোলে সুবিধে হত না, পিসির সঙ্গে বেরিয়ে মদনের ফুচকা না খেয়ে ফিরেছি এমন হয়নি।
তবে পোস্টটা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে রিষড়ার সবথেকে স্পেশাল খাওয়া এগুলোর কোনওটাই নয়। রিষড়ার স্পেশাল খাওয়া হচ্ছে সেইটা যেটা আমি কোনওদিন খাইনি। রবিবার গান শিখে রিকশা করে ফিরতাম মায়ের সঙ্গে। ওই রাস্তাটুকু মায়ের পাশে চুপ করে চিন্তাভাবনাহীন বসে থাকতে খুব ভালো লাগত। এখন বুঝি, মায়ের মন জুড়ে নিশ্চয় থাকত কাল সকালে উঠে আবার অফিস ছোটার আতংক। কিন্তু সে আতংক তো এখনও একটা রাতের দূর, তার আগে তো মাকে গিয়ে তরকারি রাঁধতে হবে, রুটি বানাতে হবে। খাবার বাড়তে হবে, তুলতে হবে। নাইটক্যাপ দুধের কাপ হাতে হাতে পৌঁছতে হবে।
রিকশায় দুলতে দুলতে যেতে যেতে মা বলতেন, আচ্ছা সোনা, সপ্তাহে একদিন রসগোল্লা আর আইসক্রিম দিয়ে ডিনার সারলে হয় না? আমি বলতাম, হয় হয় হয়। প্লিজ মা, চল না আমি তুমি প্রতি রবিবার রসগোল্লা আর আইসক্রিম দিয়ে ডিনার করা শুরু করি? খেয়েদেয়ে বাড়ি গিয়ে বলব,আমাদের বাবা খাওয়া শেষ, তোমরা যে যা পার নিজে ব্যবস্থা করে খেয়ে নাওগে, এই আমরা ঘুমোতে গেলাম।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আজীবন কল্পনা হয়ে থেকে যাওয়া ওই খাওয়াটাই আমার রিষড়ার স্পেশালতম খাওয়া হতে পারত।
Kichu mone korben na, rishra giye apnar haat khuleche dekchi. Okhanei thake jan ar onek likhun.
ReplyDeleteহাহা ঘনাদা, হাত খোলার পন্থা এত সোজা হলে তো বর্তেই যেতাম, দুঃখের বিষয় আমি এগুলো দিল্লির ভাড়াবাড়ির বিছানায় বসেই লিখেছি। তবে রিষড়া থেকে ঝটিকাসফর সেরে আসাটা কাজে দিয়েছে, সেটা হতে পারে।
Deletebah bah chomotkar(doi e songrokkhito arsholar byaparta na) -PB
ReplyDeleteহাহা, মায়ের মুখটা সেই মুহূর্তে যা হয়েছিল, প্রদীপ্ত। আমার এখনও মনে আছে।
Deletetumi manush jon ke nostalgia te puro ashte prishte bedhe felcho to guru...
ReplyDeleteshaktigor er langcha ami kheyechi..ekkere bahe
'khabar ghor' naam ta ki misti na..ekta kotha mone porlo..onek purano cinema hall/restorant e banglay lekha thake 'kolghor'..besh lage
prosenjit
ঠিক বলছে, প্রসেনজিৎ। খাবার ঘর নামটা আমারও ভীষণ প্রিয়।
Deleteহ্যাঁ, ফিরে যাওয়া কোনও কাজের কথা না, অনিন্দ্য। তার থেকে যেখানে আছি সেখানেই ভালো।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো পড়ে। থ্যাংক ইউ।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ তো আমার দেওয়ার কথা,দেবাশিস।
DeleteSerampore er khabar gulo apnar lekha te jaiga peyeche dekhe khub anondo pelam. tobe ye..RMS math er onekgulo eggroll,chat,fuchka r dokan bosto , ekhono bose, okhane janni kokhono? Amar bor prothom bar RMS math e gie khub anondo peye gechilo.
ReplyDeleteএই রে, সুহানি, শ্রীরামপুরের সঙ্গে আমার যতখানি পরিচয় তাতে মাঠের নাম জানা বা সেটা মনে রাখা একটু অসুবিধে। আর এম এস মাঠ কোনটা? একটা বড় মাঠের কথা আমার মনে পড়ছে স্টেশনের পাশে, সেখানেও অনেক ফুচকাওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকতেন, সেটা কি?
DeleteHa otai.
DeleteAmar kintu Saktigarher lyangcha bhaloei lage. Sudhu boddo mishti! Sudhu banglatei "khabar ghar" naamta possible, onnyo language e erokom naam imagine kora jai! Sob sohorer ek (ba ekadhik) heartthrob puchkawala thake. Lekhata besh jibhe jol ene dei!
ReplyDeleteApnar ei lekhata khub bhalolaglo. Porte porte chhotobelatao ekjholok khunje pelam jeno! :-) Boro monkemon kora lekha.
ReplyDelete