বাড়ি যাওয়ার পথে



শনিমন্দির ছাড়িয়ে রিকশার চাকা পাঁচটা পাক পুরো ঘুরতে না ঘুরতেই অর্চিষ্মান বলল, সবাই তোমার দিকে তাকাচ্ছে কেন বল তো।

মনে মনে বললাম, কারণ আমিও ওঁদের দিকে তাকাচ্ছি। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি, এঁকে কি চিনি? আর এঁকে? আর ওঁকে?

চট করে আড়চোখে তাকিয়েই যে বুঝে যাব সেটা তো জো নেই।  রীতিমতো অস্ত্রোপচার চালাতে হবে লোকটার ওপর। গালের দুপাশ থেকে দেড় ইঞ্চি করে আর শরীরের মধ্যভাগ থেকে অন্তত ইঞ্চি মেদ বাদ দিতে হবে, মাথার সামনে পাতলা হয়ে যাওয়া চুলের জায়গাটা ভরাট করতে হবে, চোখ মুখ থেকে বছরদশেকের অভিজ্ঞতা, রাগ, বিরক্তি বাদ দিতে হবে। পুরুষ হলে শরীরের নিচের একশো পঁচিশ সিসির ঝকঝকে বাইক লজঝড়ে সাইকেল (তাও আবার বাবার) দিয়ে রিপ্লেস করতে হবে। মহিলা হলে মাথা থেকে সিঁদুর, কবজি থেকে শাঁখা পলা, ক্ষেত্রবিশেষে কবজির সঙ্গে লেপটে থাকা বেঁটে সাইজের গোটা গোটা মানুষদেরও নির্মম ভাবে হাওয়া করে দিতে হবে। তবে গিয়ে নিশ্চিত হলেও হতে পারি এঁদের আমি চিনতাম। আমি যতক্ষণে সব করব ততক্ষণে ওঁরাও উল্টে আমার দিকে তাকিয়ে ভাববেন, লোকটা কে? হাঁ করে তাকিয়ে আছে? মহা অভদ্র তো।

মুখে বললাম, কে জানে কেন তাকাচ্ছে, এই লাল রঙের জামাটায় আমাকে ভালো মানিয়েছে বলে বোধহয়।

গাছপালাদের নিয়ে সমস্যা নেই। দশ বছর আগেও তাঁরা যেমন ছিলেন এখনও তেমনি দাঁড়িয়ে আছেন। যদি উন্নয়নের কুনজর না পড়ে তাহলে নেক্সট দশ বছরও থাকবেন। শনিমন্দিরের বটগাছটা, একটু আগেই পেরিয়ে এলাম, সেই গাছটা এইরকম। একটু এগিয়ে এসে সাধনকাননে ঢোকার গলিটার মুখে আরেকটা জন্মাবধি দেখা গাছ। বট না অশ্বত্থ কে জানে, মোদ্দা কথা প্রকাণ্ড। যেমন ছিল তেমনি আছে। ডালে জড়ানো লালনীল সুতোগুলো বছর বছর ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে, গুঁড়ির ফোকরে গোঁজা হলুদ রঙের গাঁদাফুলের মালা পচে কালো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু গাছ টসকাচ্ছে না। এই গাছের তলায় বাঁধানো লাল রঙের বেদীতে রোজ সন্ধ্যেবেলা ঢাকঢোল নিয়ে মহোৎসাহে হনুমান চালিশা গাওয়া হত। গান হিসেবে খুব উচ্চমার্গের নয়, কিন্তু সম্মিলিত ভক্তিগীতির একটা মজা আছে, সে চার্চ সংগীতই হোক, দক্ষিণেশ্বরের নাটমন্দিরের শ্যামাসংগীতই হোক, কিংবা রিষড়া রেললাইনের পাশে গাছের তলার হনুমানের ভজন। এখনও সেরকম চনমনে গান হয় কি না জানতে হলে সকাল সাড়ে দশটার বদলে সন্ধ্যেবেলা ওই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। তবে আমার ধারণা গান হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি বাড়ে, কমে না।   

সব গাছের কপাল অবশ্য এত ভালো হয় না। আমাদের লক্ষ্মীনারায়ণ মিলের পাশের বিরাট বাগান উপড়ে ফেলে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট উঠেছে। খোদ এসপ্ল্যানেডের বুকে  আমি তাদের বিজ্ঞাপন দেখেছি আপনার পকেটের নাগালে একচিলতে নিজস্ব স্বর্গ, বারান্দায় দাঁড়ালে রেললাইনের ভিউ ফ্রি।

হনুমান মন্দির ছাড়িয়ে এগোতেই বুকের ভেতর একটা ঝটকা লাগল অর্চিষ্মানের হাত চেপে ধরে দেখেছ, দেখেছ!  বলতে গিয়েও  সামলে নিলাম।  কারণ আমি জানি দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে হাওয়া আর রোদ, আমি দেখছি পাশাপাশি দাঁড়ানো তিনটে সুপুরিগাছের ভূত।  ওই রাস্তা দিয়ে দিনে দুবার করে যেতাম আসতাম, কিন্তু রবিবার রাতে গান শিখে ফেরার সময় গাছ তিনটের দিকে না তাকিয়ে থাকা যেত না। মা বলতেন, ঠিক যেন দৈত্যদের স্কেল, না রে সোনা?  ল্যাম্পপোস্টহীন রাতের অন্ধকারে যাদের দিকে তাকাতে কোনওদিন ভয় করেনি, সাড়ে দশটায় তাদের  ফেলে যাওয়া জায়গাটা দেখে গা শিরশির করছিল। গেলই বা কীসে? তিনটে সুপুরি গাছের জমিতে তো বাড়ি তোলা যায় না।  প্রাকৃতিক উপায়েই মারা গেছে নির্ঘাত, বাজ পড়ে কিংবা পোকায় কেটে। খানিকটা সান্ত্বনা হল।

বাবা আগেই ফোন করে বলে রেখেছিলেন বাড়ির সামনের রাস্তায় কাজ হচ্ছে, সোজাদিক দিয়ে না এসে আমরা যেন উল্টোদিকের মোড়টা দিয়ে ঢুকি। দূর থেকে দেখতে পেলাম মোড়ে তিনটে লোক আর দুটো সাইকেল মিলে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের মধ্যে একজন আমার বাবা, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, কাছে গিয়ে দেখলাম দ্বিতীয়জন অশোককাকু, তৃতীয়জন রাজুদাদা। কাকু বললেন, ভালো আছ তো সোনামা, আর রাজুদাদা বলল, দেখেছিস সোনা, তুই আসবি বলে আমরা রাস্তা সারাচ্ছি।

পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি যখন প্রথমবার পাড়ায় ঢুকি, তখনও ওয়েলকাম কমিটিতে রাজুদাদা ছিল। কমিটি অবশ্য একটা ছিল না। মহিলা কমিটি ছিল, পুরুষ কমিটি ছিল। মহিলা কমিটির মেম্বাররা সোজা বাবামা (এবং তখন থেকে আমারও) শোওয়ার ঘরে ঢুকে আসতেন, পুরুষ কমিটির সুবিধের জন্য আমাকে বাইরের ঘরে আনা হত। আর দশ বছরের নিচের সদস্যদের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল তাতে পুরুষমহিলা বাছাবাছি ছিল না, সকলেরই যখন খুশি শোওয়ার ঘরে ঢোকা অনুমতি ছিল। ওই কমিটিতেই ছিল রাজুদাদা। আমাকে প্রথমবার দেখে নিশ্চয় ভক্তি হয়নি। কী একটা পোকার মতো ব্যাপার, চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে। তার থেকে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং লেগেছিল কাকিমা যে সন্দেশের প্লেটটা এনেছিলেন সেইটা। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল রাজু মিঠু বটুয়া পুকি বুচি মান্টি মিলি। মা খুব খুশি খুশি মুখে ঘোরাঘুরি করছিলেন, মাঝে মাঝে বড় কেউ আসছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ছোট কমিটির লোকজন সন্দেশ খেতে খেতে বড়দের কথা শুনছিল।

ঘটনাটার অবশ্য আমি সাক্ষী নই, পরে শুনেছি। বাড়িতে গিয়ে রাজুদাদা নাকি ছায়াপিসিকে বলেছিল, "মা, জানো তো, কাকিমা না হাসপাতাল কে হসপিটাল বলে।"


Comments

  1. উরিব্বাস, সপ্তাহের মাঝখানে বাড়ি? কি দারুণ ব্যাপার। ফিরছেন কবে? আপনার দৌলতে রিষড়া অনেকটাই চিনে ফেলেছি, শুধু রিষড়ার স্পেশাল খাবার কি, সেটা জানি না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফিরে এসেছি, দেবাশিস। আগের সপ্তাহে গেছিলাম। রিষড়ার স্পেশাল খাবার নিয়ে একটা পোস্ট লিখব'খন।

      Delete
  2. ree bah chomotkar barir gondho makha post . somobet bhoktigitir moja ache se ar bolte , nastikder kache ache :) -PB

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার তো শুনলেই গাইতে ইচ্ছে করে,প্রদীপ্ত।

      Delete
  3. gangar dhare berate jao ni?,khub bhalo lage gangar dhare.chup kore bose thakteo darun lage.chobi tobi thakle dio gangar.

    কী একটা পোকার মতো ব্যাপার, চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে।(eta zata)



    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. না প্রসেনজিৎ, খুব অল্প সময়ের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম, গঙ্গার ধারে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

      Delete
  4. বেঁটে সাইজের গোটা গোটা মানুষদেরও নির্মম ভাবে হাওয়া করে দিতে হবে।(ei line tao..ki ar bolbo)...tomar sense of humour dharalo hoe jachche dindin

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  5. Tomar bari jaoyar golpota pore bhalo laglo.. Amar ar ekhon bari nei. mane amader purono bari ta bikri kore ma bab rajarhat e chole gechhey. r purono jomite flat uthchhey. kintu bari bollei amar chokhe ekhono sei chhotobelar dotala barita r anekkhani chhorano jongla bagantai bhese othe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের বাড়িটারও একদিন ওইরকমই হবে নিশ্চয়, চুপকথা।

      Delete
  6. খুব সুন্দর হয়েছে। বাড়ি যাওয়ার পথে আর রিষড়ার খাওয়াদাওয়া দুটোই।

    এবার ফেব্রুয়ারি মাসে ছুটিতে কাটোয়া গেছিলাম ঠাকুমা কে দেখতে। কাটোয়া ছেড়ে এসেছি অনেককাল, প্রায় ২০ বছর। কিন্তু এখনো যখনি যাই ওই চেনা-অচেনা, নতুন-পুরানোর মিলমিশটা অনুভব করতে দারুন লাগে। ফেরার সময় রিষড়ার কাছে ট্রেনটা স্লো হয়েছিল, স্টেশনটা চোখে পরে যেতে আপনার কথা মনে এলো। স্টেশন এর কোন দিকটায় আপনার বাড়ি, হোর্ডিং-এ ঢাকা রেল লাইন - এর সমান্তরাল রাস্তা, তার দোকানপাট এগুলো হয়ত আপনার কতকালের চেনা এই সব ভাবলাম। লেখা দুটো ওই আগের বলা অনুভব আর এই কয়েক মুহুর্তের ভাবনা দুটোকেই উস্কে দিয়েছে।

    খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, আপনি কাটোয়ার লোক, চন্দ্রচূড়। লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।

      Delete
  7. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি বাড়ার ব্যাপারটা মোক্ষম বলেছেন। আমার ধারণা ছিল এই গাছ চেনার আর মনে রাখার স্বভাবটা শুধু আমারই আছে, আপনারও আছে শুনে ভাল লাগল। ইদানিং হুগলী গেলে আমারও ছোটবেলার চেনা গাছ খুঁজে না পেলে খুব খারাপ লাগে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাকচুয়ালি, পুরোনো বাড়ি হারিয়ে ফেলার থেকেও খারাপ হচ্ছে পুরোনো গাছ হারিয়ে ফেলা।

      Delete
  8. Boro bhalo lekha. Mon bhalo kora :)

    ReplyDelete

Post a Comment