বৈচিত্র্য বনাম বোরডম
সম্পর্ক তরতাজা রাখার প্রথম দশ, প্রথম সাত, প্রথম তিন তালিকাতেও এই টিপটা থাকে। একে অপরকে চমকে দেওয়ার টিপ। ব্যভিচারেও নাকি
বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ততখানি জোর থাকে না, যতখানি থাকে বোরডমে। কিছুতেই যাতে সম্পর্কে বোরডম সেট না করে সে বিষয়ে
সর্বদা তক্কে তক্কে থাকুন, আজ সকালে উঠে রোম্যান্টিকপ্রবর হোন, আগামীকাল সন্ধ্যেয় পার্টিপ্রেমিক, পরশু দুপুরে ভাবুক এবং
কবিতাপাঠক, তরশু সকালে সেনসিটিভ এবং কেয়ারিং। আর দোহাই আপনার, যাই
হোন না কেন, সেন্স অফ হিউমারটা কনস্ট্যান্ট রাখুন, ওটা বাড়ন্ত হলেই বিপদ। একদিন মিনিস্কার্ট পরুন, একদিন কপালে টি দিয়ে ধ্রুপদী সাজুন, ভাতের পাতে একদিন
চিংড়ি রাখুন তো একদিন চিলিচিকেন। পারিবারিক পত্রিকা হলে এখানেই ক্ষান্ত দেয়, প্রগতিশীল হলে দাম্পত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যের পরামর্শ দিতে আগে বাঢ়ে।
আমি অবশ্য এই টিপ কাজে লাগানোর পক্ষপাতী নই। এক
তো কুঁড়েমির ব্যাপার আছে। প্রতিদিন নিজের নতুন নতুন চেহারা বার করা অত্যন্ত
পরিশ্রমের কাজ। দু’নম্বর আপত্তিটা আসে
বিশ্বাসের জায়গা থেকে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের
থেকে বোরডম অনেক বেশি জরুরি। আমার মতে সম্পর্ক সফল রাখার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে একে অপরকে নিজেদের যে চেহারা দিয়ে ইমপ্রেস করেছিলাম, সেই চেহারাতেই এ জীবনের
মতো থিতু হওয়া। আমি অর্চিষ্মানের সঙ্গে আর অর্চিষ্মান আমার সঙ্গে
প্রথম দেখা করতে গিয়েছিলাম রোজকার জিনস আর রোজকার টি শার্ট পরে। এখন হঠাৎ একজন আদিবাসী
জুয়েলারি পরতে শুরু করলে কিংবা ঘাড়ে ট্যাটু আঁকলে, অন্যজন ভয় পেয়ে যাবে। সম্পর্কের
শুরুতে লীলা মজুমদার আর পাগলা দাশুর মিল আবিষ্কার করে আমরা পাগলের মতো খুশি
হয়েছিলাম, এখন একজন লাইব্রেরি থেকে ক্রমাগত বার্থেজ আর কোয়েলহো তুলতে শুরু করলে
অন্যজনের মহা বিপদ।
রোম্যান্টিক সম্পর্ক বাদ দিয়ে অন্য সম্পর্কের
উপমা দিলে ব্যাপারটা আরও সহজে বোঝা যাবে। আমার মা যদি হঠাৎ এখন আমাকে বকাঝকা
বন্ধ করে দেন, কিংবা আমিও কথায় কথায় মায়ের মুখে মুখে “বেশ করেছি” ইত্যাদি চোপা
করতে শুরু করি তাহলে বৈচিত্র্য আসবে ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কটা মাঠে মারা যাবে। কাজেই যে যেমন ছিল, তেমন থাকাটাই সম্পর্কের স্বাস্থ্যের পক্ষে সবথেকে ভালো। সারপ্রাইজ ব্যাপারটা জন্মদিন আর বার্ষিকীর
সন্ধ্যেবেলার জন্যই তোলা থাক।
অন্তত এতদিন আমি সেইরকমই ভাবতাম। খুব সম্প্রতি এই বিশ্বাস টলে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটল। দিনটা ঠিক মনে নেই, গত সপ্তাহের গোড়ার
দিকেই হবে, তবে ক্ষণটা আছে। চোখ খুলে দেখলাম পাশে অর্চিষ্মান অঘোরে ঘুমোচ্ছে, অন্ধকার ঘরে ল্যাপটপের নীল আলো, সেদিক থেকেই মৃদু পুরুষকণ্ঠে কথোপকথন ভেসে আসছে। ভয়
পেলাম না। গলার মালিকদের আমি চিনি। ডার্টমুরের রুক্ষ প্রান্তরে প্রস্তরযুগের মানুষদের
বানানো গুহার সামনে দেখা হয়ে গেছে শার্লক হোমস আর ওয়াটসনের। তাঁরা কথাবার্তা
বলছেন।
অর্থাৎ, মাঝরাত। কিন্তু আমার ঘুমটা ভাঙল কীসে? ঠিক সেই মুহূর্তে হোমস আর ওয়াটসনের গলা ছাপিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে বাস্কারভিলের হাউন্ডের গগনবিদারী আর্তনাদ ভেসে এল। ওতেই কি? উঁহু। হাউন্ডের চিৎকার যতই গায়ে কাঁটা
দেওয়া হোক, ঘুম ভাঙায় না। উল্টে ঘুম পাড়ায়। তাই আমরা রোজ ওটা চালিয়ে ঘুমোতে যাই। শুয়ে শুয়ে বিরক্ত মনে ঘুম ভাঙার কারণ
আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি এমন সময় অন্য একটা আওয়াজ কানে এল। গুড়গুড় গুড়গুড়। ওহ্। এই ব্যাপার। শব্দের উৎস আর আমার ঘুম ভাঙার কারণটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আর বিরক্তিটাও
ঝড়াক করে বেড়ে গেল।
এ তল্লাটে একটি বাইকার বাহিনী আছে। তাদের আমি
চোখে দেখিনি, শুধু কানে শুনেছি। আমাদের বাড়ির পেছনের রাস্তায় গভীর রাতে সাইলেন্সারহীন
বাইক চালিয়ে তারা ঘোরাঘুরি করে। পাশ ফিরে আবার ঘুমোনোর উপক্রম
করছি, এমন সময় শব্দটা আবার হল। গুড়গুড় গুড়গুড়।
আর আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বাইক নয়! মেঘ! মেঘ ডাকছে। এবং ল্যাপটপে নয়। পাঠকের গায়ে কাঁটা দেওয়ানোর জন্য ডার্টমুরের চোরাবালিময় প্রান্তর, জেলপালানো
আসামি আর রাক্ষুসে হাউন্ডটাউন্ড নিয়ে একটা ভয়ানক ছবি এঁকেছেন বটে আর্থার কোনান ডয়েল,
কিন্তু তাতে মেঘের ডাক জোড়েননি। কাজেই আওয়াজটা আসছে অন্য জায়গা থেকে। আর সেটা একটি
জায়গাই হওয়া সম্ভব।
আমার ডানপাশে জানালা, জানালার বাইরে সজনে
ডাঁটার ডালপালামেলা গাছ, গাছের ওপারে সরু গলি, আর গলির মাথায় সরু একফালি আকাশ। আওয়াজটা আসছে সেই আকাশ থেকে।
ঠিক তার দু’দিন আগেই কথা
হচ্ছিল। জন্ডিসের পাল্লায় পড়ে আমাদের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি গত দু’মাসে, আগামী
দু’মাসেও হবে বলে মনে হয় না। এদিকে শীত চলে গেল, গরম আসছে। এই সময় দিল্লিতে
ছুটিহীন বন্দী হয়ে থাকাটা যে কী ভয়ানক হতে চলেছে, অফিস যেতে যেতে সেই নিয়ে হাহুতাশ
চলছিল। তাও যদি শহরটায় একটা বর্ষাকাল থাকত। জুনজুলাই মাসে যখন বাড়িতে ফোন করলে
মায়ের গলা ছাপিয়ে পেছনের মাঠের বলশালী ব্যাঙেদের গলা শুনতে পাব, তখন আমাদের দশ মিনিট
টানা জলের ছিটে পড়বে কি না সন্দেহ। ধুস্, চল অন্য কোথাও চলে যাই।
আমি দমবন্ধ করে শুয়ে রইলাম। এই বুঝি গুড়গুড়ানি
থেমে যায়। কিন্তু থামল না। বরং একটু পর আরেকটা শব্দ যোগ হল তাতে, টুপটাপ টুপটাপ।
জলের ফোঁটা নামছে আকাশ থেকে। সজনে পাতার ওপর, কংক্রিটের ওপর, মাটির ওপর। একেক
স্কেলে, একেক লয়ে।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম চারদিক ভেজা। অপদার্থ
মিস্তিরির হাতে বানানো অসমান বারান্দার এখানেওখানে ছোট ছোট লিলিপুট ডোবা। সেদিন
সারাদিন টুপটাপ চলল। মাঝে মাঝে রোদ্দুর উঠল, কিন্তু সে একেবারে আগমার্কা বর্ষার
রোদ। ভেজা এবং লাজুক।
শুধু যে সেদিন চলল তেমন নয়। সেই থেকে চলছে।
বৃষ্টি আর হয়নি বটে, কিন্তু গ্রিলের বাইরে মেঘলা আকাশ নিয়ে ঘুম থেকে উঠছি। রোজই ঠাণ্ডা
জল গায়ে ঢালা মাত্র শরীরের সব রোম খাড়া হয়ে উঠছে, রোজই রাতে ফ্যান চালালে গায়ের
ওপর একটা পাতলা চাদর থাকলে আরাম লাগছে।
দিল্লির সঙ্গে আমার গত সম্পর্ক প্রায় চোদ্দ বছরের
হতে চলল। এই চোদ্দ বছরে মার্চ মাসে শহরটাকে কোনওদিন এই চেহারায় দেখেছি বলে মনে পড়ছে
না। দিল্লি আমাকে চমকে দিয়েছে। অথচ চমকে গিয়ে আমি ভয় পাইনি একটুও, বরং মনের ভেতর
বেশ ভালোলাগা টের পাচ্ছি। বাড়ির বারান্দা থেকে, অটোর ফোকর গলে, অফিসের জানালা দিয়ে
নতুন চোখে শহরটাকে দেখছি। আর ভাবছি একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দোকান থেকে টেম্পোরারি
ট্যাটু কিনে এনে অর্চিষ্মানের মিহি বাইসেপে সেঁটে দেখব, কেমন লাগে।
Ekdom, ekdom! Dilli kintu e bochhor ekdom phatiye dichche. :)
ReplyDeleteসিরিয়াসলি, বিম্ববতী। এবার শীতটা ভালো পড়েনি বলে আমি বেশ মনমরা হয়ে ছিলাম, কিন্তু বসন্ত আমার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।
Deletedarun :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, তিন্নি।
Deletebhari mishti lekha...
ReplyDeleteprosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিত।
Deleteআপনারা হাউন্ড অফ বাস্কারভিল চালিয়ে ঘুমোতে যান? সব্বোনাশ ;)
ReplyDeleteওর থেকে শান্তিপূর্ণ কিছু চালালে ঘুম আসে না, অন্বেষা।
Deletelaptop chaliye ghumoccho? motei safe bepar noy.
ReplyDeleteসেরেছে।
Deleteআর সেফ আনসেফ যাই হোক না কেন, ল্যাপটপ চালিয়ে ঘুমনোর অভ্যাসটা আমারও আছে। দুঃখের বিষয় এখানে মেঘের ডাক বা বৃষ্টির শব্দ কোনওটাই শোনার সম্ভাবনা নেই, কারণ কাঁচের জানালা বন্ধ থাকে। জানালা খুলে শোওয়ার মতন গরম এখনও পড়েনি। তাই আপনার লেখা দিয়েই বসন্তের রাতের বৃষ্টির স্বাদ নিলাম।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সুগত।
DeleteKhub baanchiye diyeche Dilli. Amader ekhane 38 degrees already ... e bochor January / February r brishti ta o holona. E bochor kaandabe.
ReplyDeleteআহারে, শর্মিলা। তোমাদের পুনে তো শুনেছি চমৎকার আবহাওয়ার দেশ, তোমাদের নিশ্চয় বেশি কষ্ট হচ্ছে। আমি খানিকটা মেঘবৃষ্টি তোমাদের ওদিকে স্পিড পোস্ট করার ব্যবস্থা করছি, দাঁড়াও।
DeleteAmi February tei Delhi puropuri shift korechi.gorom porbe bole sobbai Khub bhoy dekhachee, tar modhye ei bristi.. Bhaloi lagche
ReplyDeleteআরে সুমনা, স্বাগতম, সুস্বাগতম। তুমিই তার মানে বৃষ্টি সঙ্গে করে এনেছ। থ্যাংক ইউ।
DeleteTomar lekha moto khawar jayga gulo jabo bhebechi.last week e andhra bhawan giye chilam.sumana
ReplyDeleteতাই নাকি? কেমন লাগল?
Deleteki bolbo 2hrs wait kore khete peyechi.khawar bypok,kintu amar chele arik er ektu kosto hoyeche.khub bhir chilo.tobe amra bus e kore gechi.bus stop theke neme oi andhra bhawan obdhi hete jawar rasta ta amar khub bhalo legeche..
Deleteএ বাবা, সরি গো সুমনা। অন্ধ্রভবনের ওই পাগলের মতো ভিড়টা আমরও না পসন্দ। কিন্তু আবার অনেকের (যেমন অর্চিষ্মান) মতে ওটার নাকি একটা চার্ম আছে।
Deleteebaba sorry keno,ami to jenesunei gechi..mane tomar lekha pore..amader dujoner khawa ta bypok legeche.ar sedin bodh hoy ektu beshi i bhir chilo..oi kisob world festival er prochur lok o giyechilo,sathe prochur vindeshio...
ReplyDeleteপ্রগতিশীল হলে দাম্পত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যের পরামর্শ দিতে আগে বাঢ়ে।
ReplyDeletetumi pragatishil potrika gulor bajar nashto korbe dekhchi...ei line ta miss kore geslam...just zata
prosenjit