গোয়া ২/২
রিট্জ্ হোটেল দু’খানা আছে পানজিমে। একটা ক্ল্যাসিক একটা আধুনিক। আধুনিকটি বাসস্ট্যান্ডের একেবারে গায়ে। কিন্তু আমাদের গন্তব্য অন্যটা। ওয়াগলে ভিশন বিল্ডিং যাব বলামাত্র অটো ভাইসাব জিজ্ঞাসা করলেন, রিট্জ্ ক্ল্যাসিক?
রিটজ হোটেলের রাস্তার নামখানা চমৎকার, আঠেরোই জুন রোড। বাইরে থেকে জাঁকজমক কিছু বোঝা যায় না। মাথা ঘুরে যায় তীরচিহ্ন ফলো করে দোতলায় ওঠার পর। গিজগিজ করছে ভিড়। ভিড়ের অধিকাংশ বাইরের বারান্দায়, খানিকটা উপচে ঢুকে গেছে রেস্টোর্যান্টের ভেতর যেখানে খাওয়া চলছে। আমরা ভেবেছিলাম ঘণ্টা তিনেক দাঁড়াতে হবে কিন্তু এ সব সিচুয়েশনে ছোট পরিবার নিঃসন্দেহে সুখী পরিবার। একটা চারজনের টেবিলে দু’জন বসে খাচ্ছিলেন, শেয়ার করতে চাই কি না জিজ্ঞাসা করাতে আমরা লাফ দিয়ে হ্যাঁ বললাম। তিনঘণ্টার গেসটিমেটেড অপেক্ষা হয়ে গেল তিন মিনিটের।
ক্ল্যাসিক রিটজের হাবভাব, চালচলন ক্ল্যাসিক। গদি আঁটা চেয়ার, সাদা কালো উর্দি পরা পরিবেশক। তিন্নি-সায়ক ফিশ থালির কথাই বলে দিয়েছিল, দ্রুত আড়চোখের সার্ভেতে বুঝলাম আশেপাশের নিরানব্বই শতাংশ লোক ওটাই খাচ্ছে। আমরাও বলে দিলাম, ফিশ থালি প্লিজ। সঙ্গে অর্চিষ্মানের জন্য লাইম সোডা, আমার জন্য বাটারমিল্ক।
যে কোনও জিনিসের ক্ষেত্রেই দু’ভাবে লোককে ইমপ্রেস করা যায়, এক কোয়ানটিটি, দুই কোয়ালিটি দিয়ে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এ দুইয়ের যুগলবন্দী ঘটে (যেমন, রবীন্দ্রনাথ) তখন একেবারে ইমপ্রেশনের হদ্দমুদ্দ। ক্লাসিক রিটজের ফিশ থালির ইমপ্রেশনের খেলায় আরও একটি ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে, তা হল দাম।
এই গোটা থালার দাম হচ্ছে একশো একষট্টি টাকা। কাঁকড়ার ঝোল তো দেখতেই পাচ্ছেন, এছাড়াও এখানে আছে সজনেডাঁটা দেওয়া না-দেওয়া চিংড়ি ঝোল ঝাল চচ্চড়ি, ফিশ ফ্রাই, মাছের পেঁয়াজ দিয়ে ঝুরিভাজা, ঝিনুকের ঘণ্ট (সবের মধ্যে আমার বেস্ট লেগেছে) ইত্যাদি।
আবার কবে খাওয়া হয় না হয় তাই থালির বাইরে একটা প্রন রাওয়া ফ্রাইও নেওয়া হল। মচৎকার।
এরপর আমাদের টু ডু লিস্টে ছিল পায়ে হেঁটে পানজিম ভ্রমণ। পানজিম অতি সুন্দর শহর। পরিষ্কার, ফাঁকা ফাঁকা। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে যতগুলো রাস্তায় হাঁটলাম কোনওটায় সিগন্যাল দেখলাম না, অথচ গাড়িঘোড়া চলছে মসৃণ গতিতেই। কেউ হর্নে আঙুল চেপে ধরে রাগ দেখাচ্ছে না। পায়ে হেঁটে ভ্রমণ বটে, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন নয়। গুগল ম্যাপের সার্চে লিখে রেখেছি Fontainhas, ম্যাপের দেখানো পথে ধরে আমরা চলেছি সেই দিকেই।
পর্তুগিজ ডিকশনারিতে Fontainhas মানে ছোট ঝর্না। কিন্তু ব্যবহারিক মানে হচ্ছে কোয়ার্টার। বাংলা করে নিয়ে ‘পাড়া’ও বলা যায় বোধহয়। পানজিমের Fontainhas হল পুরোনো ল্যাটিন কোয়ার্টার। একসময়ের পর্তুগিজপ্রাধান্যের প্রমাণ। পা দেওয়ামাত্র বোঝা যায় জায়গাটা আলাদা। শহরেরই অংশ, কিন্তু স্বতন্ত্র। সরু আঁকাবাঁকা গলির দুপাশে সারি সারি গেটের গায়ে মার্বেল ফলকে পেঁচানো অক্ষরে লেখা ‘পেরেইরা’, ‘মেন্ডেস’, ‘ডিয়াজ’ ‘ফার্নান্দেজ’। এ পাড়ায় এখনও প্রধান কথ্য ভাষা পর্তুগিজ।
এ পাড়ায় আর্ট গ্যালারিরও বাড়বাড়ন্ত। সেরকমই একখানা গ্যালারি হচ্ছে গীতাঞ্জলি। গীতাঞ্জলী গ্যালারি থেকে বেরিয়েই চোখ পড়ল উল্টোদিকের গাছ, লাল ফুলের ঝাঁকের আড়াল দেওয়া একখানা বারান্দা। শুধু বারান্দা নয়, সেটা একটা রেস্টোর্যান্টও। দ্য ভেরান্ডা রেস্টোর্যান্ট। এর নামও তিন্নির কাছে শোনা ছিল। হেঁটে হেঁটে চায়ের দরকার হয়ে পড়েছিল, কালক্ষেপ না করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম। বাইরে থেকে বারান্দাখানা দেখতে যত সুন্দর, ভেতর থেকে ততোধিক। উঁচু, ঢালু সিলিং থেকে ছোট সাদা ফ্যান বনবন করে ঘুরছে। দেওয়াল আলমারির তালাহীন কাচের পাল্লার ওপারে নানা ভাষার বই। গাছের ঝাড়ের আড়াল থেকে দেখছি উল্টোদিকের বাড়ির ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে আছেন ফুলছাপ ফ্রকপরা ঠাকুমা।
এই হল বেবিংকা। নারকেল কেকের গোয়ান সংস্করণ। আমাদের পেটে একটুও জায়গা ছিল না, তবু শেষ করে ফেলেছি, কাজেই কেমন ভালো খেতে বুঝে দেখুন।
ইচ্ছে করছিল না, তবু উঠতে হল। আমাদের ফিরতে হবে বাস ধরে মাড়গাঁও। মাড়গাঁও পৌঁছে শুনলাম সেদিনের মতো পালোলেমের বাস শেষ, কানাকোনার বাসে উঠলাম, কন্ডাকটর আমাদের পালোলেমের কাছাকাছি চৌমাথায় নামিয়ে দিলেন, বাকি পথটুকু অটো।
আগের দু’দিন খুবই আনন্দে কেটেছিল, কিন্তু গোয়ায় কাটানো তিনদিনের মধ্যে আমি সবথেকে গর্বিত তৃতীয় দিন নিয়ে। কারণ এই দিন আমরা কিছুই করিনি। করিনি কিছু করার ছিল না বলে নয়, দুর্গ দেখতে যেতে পারতাম, কিংবা জঙ্গলের ভেতর সাফারি ঘুরতে পারতাম, এমনকি চাইলে কানে হেডফোন গুঁজে উদ্দাম পার্টি অ্যানিম্যাল হয়ে উঠলেও কেউ কিছু বলত না, কিন্তু আমরা সে সব দেখার, ঘোরার, করার লোভ জয় করে স্রেফ বসে ছিলাম। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। মাঝে একবার তার হাতছানি না এড়াতে পেরে নেমেও পড়লাম। পুরীর সমুদ্রের যে একটা উদ্দাম, রাগী ব্যাপার আছে, ঢেউয়ের লোফালুফি খেলায় নাস্তানাবুদ হওয়ার যে পরিতৃপ্তি আছে সেটা এখানে মিসিং। এখানে মোটামুটি বুক অবধি নামলেই ঠাণ্ডা শান্ত জল। ভেসে থাক। চাইলে সাঁতারও কাটতে পার। একটা জিনিস আবিষ্কার করে দারুণ খুশি হলাম, সাঁতার সত্যিই কেউ ভোলে না। সেই পাড়ার পুকুরে বাবার ট্রেনিং, গোয়ার সমুদ্রে দিব্যি কাজে লেগে গেল। উত্তেজিত হয়ে অর্চিষ্মানকে ক্র্যাশ কোর্সের অফার দিলাম, রাজি হল না।
স্নান সেরে ঘরের বাথরুমে যথাসম্ভব বালিমুক্ত হয়ে এসে আবার বারান্দায় বসলাম। সূর্যের রশ্মি ঘাড়ে, গলায় হাত বোলাতে লাগল। নারকেলপাতার পাখা দুলে দুলে চুল শুকোতে লাগল। ক্রমে ক্রমে শরীরের ভেতর টেনশনের গিঁটগুলো সব খুলে গেল, পুষে রাখা রাগগুলো সব ঢেউয়ের সঙ্গে বালির মতো ফিরে গেল যেখান থেকে এসেছিল। শরীরমনের সবটুকু মাধ্যাকর্ষণের নামে ছেড়ে দিয়ে, বেতের গদিআঁটা চেয়ারে বসে রইলাম দুজনে। যেন দুই ভোলানাথ, আরামের গাঁজায় দম দিয়েছি। মাঝে মাঝে সেই তুরীয় অবস্থা কাটিয়ে চেতনা ঘাই মারছিল, বিশেষ করে সামনের থালা থেকে গরম কুড়মুড়ে আলুভাজা তুলে মুখে পোরার সময়। মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি নাকি? অর্চিষ্মানকে খোঁচা দিয়ে জানতে চাইলাম, সত্যিই কি এত আরাম হচ্ছে? হওয়া সম্ভব? নাকি সবটাই আমার কল্পনা? ও যখন বলল ওরও এতখানিই আরাম হচ্ছে, তখন নিশ্চিত হলাম। কল্পনা নয়, ঘোর বাস্তব। দুজনে দুজনকে সাক্ষী মেনে ওই দুপুরটা মনে করে রেখেছি, দুঃখের সময় বার করে জাবর কাটব।
ব্যস, ছুটি শেষ। রবিবার অন্ধকার থাকতে থাকতে গাড়ি আসবে ডাবোলিম এয়ারপোর্ট নিয়ে যেতে, সেখান থেকে দিল্লি। প্রথমে আফসোস হচ্ছিল বিকেলের প্লেন নিইনি কেন, তারপর মনে হল ভালোই করেছি। এই আরামের সাগরে ভাসা আর সোমবারে দুঃখের পাথারে ডোবার মধ্যে একবেলার বাঁধটা জরুরি ছিল।
নিজেকে শুধু কথা দিয়ে রেখেছি, যে মুহূর্তে অসহ্য লাগবে, দু’বার ভাবব না, দৌড়ে চলে আসব গোয়া।
sob thik achhey, apurbo ghurechho ar tomar ghorar golpo pore ami udbastu obosthay naker jole chokher jole hote hoteo mone mone ghure felechhi, sudhu ekta dukkho roilo. Goa gele ar sarpotel khele na? tumi jano na tumi ki osadharon jinis miss koriyachho. :)
ReplyDeleteএহে। আসলে আমরা যে সব জায়গায় খাচ্ছিলাম সেগুলোর কোনওটার মেনুতেই এটা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, চুপকথা। কিংবা খেয়াল করিনি। পরে কখনও চান্স পেলে নিশ্চয় খাব। সাজেশনের জন্য থ্যাংক ইউ।
Deletehttp://www.goaholidayhomes.com/recipes/recipe-14-sorpotel.html
Deleteআরে থ্যাংকস, চুপকথা।
DeleteCoffinmaker bole film tate prothom khabartar ullekh peyechhilam. Tarpore ek Goan bondhuke dhore ei recipeta jogar kori. Cinemata dekhechho ki? Na dekhle try koro. Besh bhalo movie. Ar ekta kotha tomar ki FB id achhey?
Deleteসিনেমাটা হাতের কাছে পেলে নিশ্চয় দেখব, চুপকথা। আমার তো ফেসবুক আই ডি নেই গো।
Deletedarun laglo especially tritiyo din er bornona. Ami bhebe rekhechi goa jabo eibare seta kabe hoy dekhi...- Bratati.
ReplyDeleteoh han, completely out of context: tumi right 'silkworm' is much better than 'cuckoo'. oi ending ami kolpona o korte parini,
হ্যাঁ হ্যাঁ, গোয়া যাও আর গিয়ে খুব আরাম করো, ব্রততী। সিল্কওয়ার্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মত মিলে যাওয়ায় দারুণ খুশি হয়েছি।
Deletelekhata kirom valo legeche boli? porei ek bondhuke bolte gelaam se goa jabe kina :D , tobe somosya hoche erom shant hoye chuti katano amar hobe bole mone hoy na, kintu ami sotyii erom ekta chuti katate chai ,sob kichu dekhtei hobe se tension chara -- PB
ReplyDeleteআরে ঘোরাদেখাও ভালো, প্রদীপ্ত। যেমন করেই কাটাও না কেন, গোয়া ভালো লাগবে। বন্ধুকে বগলদাবা করে চলে যাও শিগগিরি।
DeleteAmi eto baar Goa giyechi tobuo tomar description porey mone hocche ekkhuni abar beriye pori. Oi ghum ghum dupur ar shanto somudrer araam ar kothao pawa jaye na. East ar West er beach gulor eyi difference ta amar khub bhalo lage ... west er beachgulo eto shanto je joley naamte bhoye korei na.
ReplyDeleteঠিক বলেছ, শর্মিলা। পশ্চিমের আর কোন বিচে যাওয়া যায় বলোতো?
DeletePuro Konkan coastline ta e dekhar moton. Ratnagiri te e darun shundor beaches ache .... Dapoli, Ganapatipule, Karde, Guhagar, etc khub shundor. Malvan er Tarkarli ache ... ekhane jol eto clean je snorkelling o hoye. Raigad er Harihareswar o khub shundor. Ar Bombay r theke shob chaite kache hobe Alibaug ... ferry te o jete paro ... ar Murud Janjira ar Kashid beach.
Deleteওরে বাবা, দারুণ সব রেকোমেন্ডেশন তো! থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, শর্মিলা। মনে রেখে দিলাম।
DeleteBombay r kache Sindhudurg o khub shundor. Ar shob beachguli te MTDC r property ache ... khub reasonable as well as well maintained. Oder restaurant gulo o bhalo hoye ... local khabar, especially sea food khub fresh ar bhalo deye.
DeleteAmi Tarkarli ar Sindhudurg chara ar praaye shob jayegaye giyechi.
এম টি ডি সি থাকলে তো কথাই নেই। থ্যাংক ইউ, শর্মিলা। খুব উপকার হল।
Deleteamar darun legechhilo Ganapatipule Beach, eto poriskar beach dekhe obak hoechhilam... ar MTDC r je cottage amra peyechhilam sekhan theke phirte mon chaichhilona
Deleteমহারাষ্ট্রের সমুদ্রসৈকতে যেতেই হবে মনে হচ্ছে এবার। থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।
Deleteআহাহাহা, মচৎকার, মচৎকার| লেখা, ছবি, সব! তবে চেহারাটা এমন ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে কেন? শরীরটরির সব ভালো তো ?
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অন্বেষা। চেহারা ভাঙার কথা আরও একজন বললেন সেদিন। কী জানি কী হয়েছে। বলার মতো তফাৎ জীবনে কিছু ঘটেছে বলে টের পাচ্ছি না।
Deleteমনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি নাকি? অর্চিষ্মানকে খোঁচা দিয়ে জানতে চাইলাম, সত্যিই কি এত আরাম হচ্ছে? হওয়া সম্ভব? নাকি সবটাই আমার কল্পনা? ও যখন বলল ওরও এতখানিই আরাম হচ্ছে, তখন নিশ্চিত হলাম। কল্পনা নয়, ঘোর বাস্তব। দুজনে দুজনকে সাক্ষী মেনে ওই দুপুরটা মনে করে রেখেছি, দুঃখের সময় বার করে জাবর কাটব।
ReplyDeleteuffffffffffffffffff.............total...just total paagllllaaaaaa....
chamatkar lekha...daarrrrrrrrrrruuuuuuuuuuuuuun
prosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎ।
DeleteDarun lekha. Goa amar khub priyo jaiga. Jotobar gechhi totobar aaro jete ichchhe kore.
ReplyDeleteAnyway, Martin's Corner e seafood ta next time try korben. Asadharon...south goa tei.
থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। মার্টিন'স কর্নারের নাম অফিসের একজন সাজেস্ট করেছিলেন। বলেছিলেন ওখানে নাকি তেন্ডুলকরও খান। আমরা আরাম করতে গিয়ে আর যেতে পারলাম না। পরের বার ঢুঁ মারব।
Deleteonekdin thikmoton asa hoechhena Abantor e , aj GOA dekeh puro post jhnapie pore gelam.. GOA amar darun priyo jaiga. r chhobi r berano r galpo mochotkar :-) ... amar ekhuni jete ichhe korchhe..
ReplyDeleteআরে ইচ্ছাডানা, কেমন চলছে সব? আমাদেরও গোয়া একেবারে মরমে প্রবেশ করেছে, আরও অনেকবার যেতে হবে মনে হয়।
Delete