চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ১



শুক্রবার অফিস থেকে বেরোতে দুজনেরই বাজে রকমের দেরি হল, নন্দাদেবী এক্সপ্রেসে ওয়েটিং লিস্ট টিকিট কনফার্ম হল না, তুলে রাখা কোটসোয়েটার নামিয়ে ব্যাগে পুরতে আন্দাজের তুলনায় বেশি সময় লাগল, ওলা টাইমে এল না। বাসের স্লিপার সিট ততক্ষণে সব শেষ। ভোর চারটের সময় হরিদ্বারে যে গাড়ি আমাদের তুলতে আসবে তার ডিটেলস, সারাদিনে তিনবার ফোন করে মনে করানো সত্ত্বেও, তখনও এসে পৌঁছয়নি।

অ্যাট লিস্ট বাসে প্রচুর লেগস্পেস আছে ভেবে খুশি হয়ে ব্যাগ রাখলাম সিটের নিচে, নামার সময় দেখি সামনের দিকের কে জল ফেলেছে, গড়িয়ে এসে ব্যাগের তলা চুপচুপে, ভেতরে সদ্য কেনা টাটকা গল্পের বই আর আমার তিন মাসের পুরোনো নীল ডায়রি নেতিয়ে কাদা। 

ঝাড়া দু’ঘণ্টা লেট করে ভোর সাড়ে ছ’টায় বাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। কাল রাতে যখন বাসে সিট-স্লিপারের অক্ষাংশদ্রাঘিমাংশ নিয়ে কুরুক্ষেত্র চলছিল তখনই অবশেষে ড্রাইভারজিকে ফোনে পেয়েছি এবং খবর দিয়েছি আমরা ট্রেনে আসছি না, আসছি বাসে। বহোৎ আচ্ছা বলে তিনি জানিয়েছেন বাস আড্ডাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। অথচ আমরা যেখানে নেমেছি চারপাশে আধখানা বাসও দেখা যাচ্ছে না। বোর্ডটোর্ডও নেই কোথাও কিছু। খালি একজন পাগল, একজন মাতাল, আর কী ভাগ্য তক্ষুনি অটো নিয়ে একজন ভাইসাব এলেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা হচ্ছে ঋষিকুণ্ডের মোড়।
  
পাঁচ মিনিট বাদে একটা গাড়ি আমাদের দিকে খুব ধীরে গড়িয়ে এল, আর ড্রাইভারের সিট থেকে যিনি নামলেন তাঁকে দেখে আমি আর অর্চিষ্মান দুজনেই থ। 

পাঁচফুট হাইট, চ্যাপ্টা শরীরে একফোঁটা চর্বি নেই, থ্যাবড়া নাক, কুতকুতে চোখ, আর মাথার প্রতিটি চুল, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো খাড়া হয়ে আছে। 

পেট্রোল পাম্পে তেল ভরিয়ে টাকা দিতে আশিস একটু দূরে গেলে অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পেরেছ?

না পারার কোনও কারণই নেই। আমাদের সারথি টপ টু বটম লীলার বইয়ের ছবি থেকে উঠে আসা চোর।  

*****

আমার হাতে থাকলে বেড়ানো হত গাড়িঘোড়া চড়ে পাহাড়ে পৌঁছনো, তারপর জঙ্গলের মধ্যে একটা নির্জন দেখে বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকা। পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত যার যার আমাকে দেখা দেওয়ার ইচ্ছে ওই বারান্দার আশেপাশে আসবে, না এলেও আমি কিচ্ছু মাইন্ড করব না। আমি খালি হাত পা এলিয়ে পড়ে থাকব। ঘুম পেলে ঘুমোব, খিদে পেলে খাব। বিকেলে হাঁটতে বেরোতে পারি, তবে কথা দিতে পারছি না।

বুদ্ধপূর্ণিমার লং উইকএন্ড কাজে লাগানোর জন্য সে রকম একটা জায়গা খুঁজছি, অর্চিষ্মান বলল, একটা জায়গাটায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে আমার।

আমি বললাম, কোন জায়গা?

চোপতা।

মাথায় কী ভূত চাপল আগুপিছু না ভেবে বলে বসলাম, আহা ইচ্ছে যখন আগে বলনি কেন, চোপতাই যাব। ফাইন্যাল।

অর্চিষ্মান বলল, আর চোপতা থেকে ঘণ্টা আড়াই পাহাড় বেয়ে উঠলেই তুঙ্গনাথ। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিবমন্দির।

আমি হাঁ করলাম, অর্চিষ্মান তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আর তুঙ্গনাথ থেকে একঘণ্টা ওপরদিকে হাঁটলেই চন্দ্রশীলা পিক। সেখান থেকে থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ভিউ। এই দেখো ছবি, চমৎকার কি না?

আমি বাক্যহারা হয়ে রইলাম, অর্চিষ্মান পত্রপাঠ সেটাকে সম্মতি বলে ধরে নিল।

*****

হরিদ্বার থেকে চোপতা গাড়িতে সাড়ে পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টার পথ। প্রায় গোটাটাই সঙ্গে সঙ্গে নদী চলে। দেবপ্রয়াগে গঙ্গা ভেঙে অলকনন্দা আর ভাগীরথী হয়, রুদ্রপ্রয়াগে অলকনন্দায় এসে জোটে মন্দাকিনী। এছাড়া পথে পড়ে শ্রীনগর, পৌরির মতো প্রাচীন শহর। রাস্তা জায়গায় জায়গায় খোঁড়া, চারধামের রাস্তা নাকি ডবল লেন অল ওয়েদার রোড হচ্ছে, খবর দিল আশিস। রাস্তার সৌন্দর্য আমরা যে খুব উপভোগ করেছিলাম তা নয়, গত রাতের না ঘুমোনোর ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসছিল। ব্যাসী বলে একটা জায়গায় ব্রেকফাস্টের জন্য থামা হল। ফিক্সড নাশতা থালি। মোটা মোটা দু’খানা করে আলুপরোটা, পেঁয়াজকুচি ছড়ানো ছোলে, আলুকুমড়োর শুকনো তরকারি, দই, আচার আর কীসের যেন একটা সবুজ চাটনি। রসুন আর আমাদা মেশানো টেস্ট। স্টিলের বাটিতে রাখা কাঁচালংকা ফ্রি।

চোপতায় আপনি এমনিও বেড়াতে যেতে পারেন, কিন্তু অর্চিষ্মানের মতোই যারা চোপতায় যায় বেশিরভাগই তুঙ্গনাথ এবং চন্দ্রশীলা চড়েই নামে। আপার চোপতা, যেখান থেকে হাঁটা শুরু হয় সেখানে থাকার প্রায় কিছুই নেই, দুএকটি গেস্ট হাঊস, তৎক্ষণাৎ অনেকেই জায়গা না পেয়েছেন শুনেছি। লোয়ার চোপতায় থাকার জায়গার সংখ্যা তুলনায় বেশি। যেখানেই থাকুন না কেন, ব্যবস্থাপত্র অত্যন্ত বেসিক। জেনারেটর সেটে কারেন্ট আসে সন্ধের ঘণ্টাচারেক, তখন আপনি শুধু ফোন/ল্যাপটপ/ক্যামেরা চার্জ করতে পারেন, হেয়ার স্ট্রেটনার কিংবা ইলেকট্রিক শেভারের শৌখিনতা চালাতে গেলে গোটা হোটেলের কারেন্ট উড়ে যাবে। গিজারের প্রশ্ন নেই, চাইলে কাঠের উনুনে করা গরম জল পাবেন। প্রপার ভেন্টিলেশনও অনেকসময় থাকে না। 

আর আছে ফরেস্ট, অরগ্যানিক, রয়্যাল, ভিউ, ইকো ইত্যাদি শব্দের পারমুটেশন কম্বিনেশনের নামওয়ালা বিবিধ নেচার ক্যাম্প। সে রকম একটি ক্যাম্পে থাকার রেকোমেন্ডেশনও পেয়েছিলাম আমরা। নিচের কয়েকটি কারণে নিইনি। 

এক, দাম। খাওয়াদাওয়া ইনক্লুডেড হলেও মাথাপিছু দাম দু’রাত থাকার পক্ষে আমাদের বেশি লাগছিল। 

দুই, কোন একটা ক্যাম্পের রিভিউতে একজন জানিয়েছেন রাতের বেলা তাঁকে ইঁদুরে কামড়ে দিয়েছে। শুনে থেকে অর্চিষ্মান অ্যান্টি-ক্যাম্প।

তিন নম্বর যে কারণটার জন্য আমাদের দুজনের কাছেই ক্যাম্প বাতিল হয়ে গেল, সেটা হল বেশিরভাগ ক্যাম্পের বিজ্ঞাপনে লেখা বিশেষ আকর্ষণ। সন্ধেবেলা প্রকৃতির কোলে বনফায়ার। বাধ্যতামূলক শব্দটা কোথাও লেখা নেই বটে, কিন্তু সারাদিন পাহাড় চড়ে ফেরার পর সহক্যাম্পারদের সঙ্গে আগুনের ধারে বসে বিয়ার খেতে খেতে অন্তাক্ষরী খেলতে চাইবে না কোন পাগলে?

অল্প খুঁজতেই বিকল্প বেরোলো। চোপতা থেকে বারো-তেরো কিলোমিটার দূরে হোটেল স্নো ভিউ। দূরত্বটা সমস্যা নয় কারণ ক্যাম্প বা লোয়ার চোপতাতে থাকলেও গাড়ি করেই ট্রেকিং-এর শুরু পর্যন্ত যেতে হবে। ভাড়া ক্যাম্পের তুলনায় অনেক কম। রিভিউও বেশ ভালো। ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। 


গোটা বেড়ানোতে ওটা আমাদের নেওয়া বেস্ট সিদ্ধান্ত। স্নো ভিউ-র রান্না অসাধারণ, সার্ভিস পত্রপাঠ, ভাড়া যুক্তিযুক্ত, লোকেশন চমৎকার। মেন রাস্তার ওপর ছোট্ট বাড়িখানা, আশেপাশে আর কিছু নেই। পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে উন্মুক্ত জঙ্গল, জঙ্গলের ওপারে থাকে থাকে উঠে গেছে পাহাড়। একটাই শুধু অসুবিধে, আমাদের ঘরখানা। স্নো ভিউতে যাঁরা একবার যান, বারবার যান। আর সে সব পুরোনো খদ্দেররা আগেভাগে বলে ভালো ঘর নিয়ে রাখেন। আপনারা গেলে পাঁচ, ছয়, নয় বা দশ নম্বর ঘর চাইতে পারেন। এদের লাগোয়া বারান্দা থেকে ভিউ চমৎকার। আমাদের পড়েছিল তিন নম্বর ঘর, একটু ভেতর দিকে।

খিদে পেয়েছিল, তার থেকেও বেশি ক্লান্ত লাগছিল। আমরা সারারাত বাসে ঢুলেছি আর আশিসও আমাদের পিক আপ করার জন্য ভোর চারটেয় উঠেছে। ল্যামিনেট করা একপাতার মেনু। দেখার দরকার নেই, আমরা জানি কী খাব। হাতে বানানো নরম রুটি আর গরম আলুজিরা। যে খেয়েছে, সে-ই এর মহিমা জানে। 

খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকলাম। অন্ধকার। আলো জ্বলবে ছ’টার পর। বেশ ঠাণ্ডা। তাড়াতাড়ি জামাটামা ছেড়ে লেপের তলায় সেঁধোলাম। 

ঘুম ভাঙতেই চায়ের তেষ্টা। স্নো ভিউর একটা ভীষণ ভালো ব্যাপার হচ্ছে দ্রুত সার্ভিস। বলা মাত্র চা, বলা মাত্র গরম জল, চাওয়া মাত্র পকোড়া। স্টিলের বড় কাপভর্তি চা নিয়ে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে নামতে শুরু করেছে।

ডানদিক থেকে দু’নম্বর চুড়োটাই নাকি চন্দ্রশীলা আর ওটাতেই নাকি আমরা কাল চড়ব। কোনও মানে হয়?
  

                                                                                                                (চলবে)


চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ শুরুর আগে
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ১
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ২
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ৩ (শেষ)


Comments

  1. Hmm. Interesting laagchhe. Dekha jaak kothay jay (I mean apnara kothay jaaben sheta to jaana, lekhata kothay jay shetar kotha bolchhhi!). Jokes apart, pahade jaoar kotha bhabte bhalo, pounchhonor por 2-3 din oshadharon (or beshi noy!), kintu jaoata ar ashata amar mote poshay na. Aar climb korte hole to kothai nei. Ar ekta bishom projati-r manush holo pokkhi-premik ra. Eder shonge jekono jaigate jaoai chaap, pahade gele to kothai nei: jeebon mohanisha kore chhede dyay. Jaakge, porer lekhar jonyo opekkhai roilam.

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও যাওয়াআসা অ্যাভোমিনের ভরসায় কাটাই, সুতীর্থ। এখানে প্রচুর পাখি আছে দেখলাম কিন্তু পাখি দেখিয়ে দেখলাম না।

      Delete
  2. Ki shundor shob jaayega khunje khunje ber koro tomra ... icche korche ekkhuni chole jayi. Landour e ekhono jawa holona. Baki golpor opekkhaye roilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, লোকে খুঁজে রাখে, আমরা টুকে টুকে যাই বলাই বেটার হবে, শর্মিলা। জায়গাটা সত্যি ভালো লেগেছে আমাদের। যদি কখনও সুযোগ হয় যেতে পার।

      Delete
  3. Boi bhije jawa part tai sudhu kharap. ato sundor offbeat destination. dekhei to jete icche korche. tumi khub lucky. bhalo theko, sarajeebon ebhabei theko.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, কুহেলি

      Delete
  4. Baah darun jaiga....apnar lekhar modhyo diyei ghure aasa jabe chopta...
    Ekta kotha boli aapnio feludar moto nil khata niye sab jaigai jan dekhchhi....byaparta intrresting.
    O

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, অত ইন্টারেস্টিং কিছু না, সুস্মিতা। আমাদের কী কী প্যাক করা হয়েছে সে সব লিখে রাখা হয় ওই খাতায়, যাতে ফেরার সময় আবার মিলিয়ে ঢোকানো যায়। চরম ছাপোষা ব্যাপারস্যাপার।

      Delete
    2. Apnara to sanghatik rokomer planner dekhchhi. Aami to edesh odesh...bari-bodol...kokhonoi esab korini. Ei Beijing e ese khali mone hochche eta ki korlam, ota ki korlam...

      Delete
    3. আপনারা বললে অর্চিষ্মান দুঃখ পাবে, সুস্মিতা। এইসব আঁটিসাঁটি আমি বাবার থেকে পেয়েছি। অর্চিষ্মানও প্রথমে কাণ্ড দেখে আঁতকে উঠেছিল, এখন অবশ্য মনে হয় সুবিধেটা বুঝছে ধীরে ধীরে।

      Delete
  5. আমার কমেন্টটা কই গেলো :O , যাকগে বেড়ে হচ্ছে ^_^

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, তোমার কমেন্ট ছিল বুঝি? স্প্যামেও তো দেখছি না। যাই হোক, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  6. "হাতে বানানো নরম রুটি আর গরম আলুজিরা। যে খেয়েছে, সে-ই এর মহিমা জানে। " <3

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই মতটা মিলেছে দেখে ভালো লাগল, অন্বেষা।

      Delete
    2. এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র ম্যাগি| প্রচণ্ড পরিশ্রম/ লম্বা জার্নির পর, একথালা ধোঁয়াওঠা ম্যাগি| সঙ্গে ডিমভাজা থাকলে ভালো, না থাকলে কোনো চাপ নেই|

      Delete
    3. এইটায় একেবারে ছাদের সমান উঁচু হাই ফাইভ, অন্বেষা।

      Delete
  7. Mon bolchilo tumi berate jabe ei week e.. khub bhalo.. ei prothom ektu hingse korlam.. kirtinagar e amar ek meso er bari ache.. thakar jayga thaka sotteo kichutei sujog kore uthte parini .. khub bhalo hobe mone hocche ei lekhata.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দিদি হয়ে একটাই উপদেশ আমি দিতে পারি তোকে ঊর্মি, শিগগিরই সুযোগ কর আর ঘুরে আয়। ভালোলাগা গ্যারান্টি।

      Delete

Post a Comment