বিয়ে বনাম পাসওয়ার্ড



প্রতিটি মেল লেখা, প্রতিবার মুখ খোলা, চব্বিশঘণ্টার প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এত ভাবতে হয় যে ঠিক করেছিলাম জীবনে অন্ততঃ দুটো বিষয় নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করব না। 

এক, অবান্তর লিখে আমার আখেরে কিছু লাভ হচ্ছে কি না।

দুই, আমার কোন মেল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড কী। 

পাসওয়ার্ডের ব্যাপারটা আগেও অবান্তরে লিখেছিলাম। না লিখে উপায় ছিল না কারণ একসময় ক্যান্ডি ক্রাশ খেলার পর আমার সারাদিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম সময় খরচ হত খান কুড়ি জিমেল অ্যাকাউন্ট, অ্যামাজন অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, জোম্যাটো অ্যাকাউন্ট, ফ্লিপকার্ট অ্যাকাউন্ট, আই আর সি টি সি এবং আরও কোটিকোটি এই মুহূর্তে নাম না মনে পড়া অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ভুলতে, রিসেট করতে এবং আবার ভুলতে।

একদিন জল মাথার ওপর গেল। যেগুলো বন্ধ করা যায় করে; বাকি সব অ্যাকাউন্টে একটাই পাসওয়ার্ড বসালাম। যে সব অ্যাকাউন্টে আলফা-নিউমেরিক পাসওয়ার্ড চাওয়ার ছ্যাঁচড়ামি করে তাদের জন্য ওই পাসওয়ার্ডের বাঁধা লোকেশনে একটি সিম্বল এবং একটি সংখ্যা, দুটিই বাঁধা, গুঁজে রেখেছি - চালিয়ে দিই। ওটা ভুলে গেলে একটা অ্যাকাউন্টেও ঢুকতে পারব না কিন্তু ভুলব না কারণ একটাই মনে রাখতে হবে।

ঠিক করেছিলাম বাকি জীবনটা ওই দুটো পাসওয়ার্ড দিয়েই চালিয়ে দেব। দিতামও, যদি না মাঝপথে বিয়ে হয়ে যেত। 

বিয়ে হল, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট হল, তার পাসওয়ার্ড রাখার প্রশ্ন উঠল। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট নিয়ে মহাভারত লেখা যায় কারণ আমার সন্দেহ সম্পর্কের প্রাণভোমরা থাকে ওই অ্যাকাউন্টেই, কিন্তু আপাতত পাসওয়ার্ড নিয়েই কথা বলা যাক। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড জয়েন্টলি সেট করাই উচিত। আর্থসামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড, সত্যজিৎ ঋত্বিক, সুমন-নচিকেতা, ডান বাম, বাংলা মিডিয়াম - ইংরিজি মিডিয়াম, ডোভার লেন - কোক স্টুডিও যদি সব মিলেও যায়, পাসওয়ার্ড সেট করার ফর্মুলা মেলানো অসম্ভব। কেউ ফুলের নাম, কেউ ফুলের নাম, কেউ শুরুতে কেউ লাস্টে কেউ যেখানেসেখানে ক্যাপস, কেউ প্রিয়জনের নাম। 

কার প্রিয়জনের নাম? কার জন্মদিন? কোন অ্যানিভার্সারি?

এস বি আই-তে আবার প্রোফাইল পাসওয়ার্ড বলে একটা মরণফাঁদ থাকে। পাসওয়ার্ড পেরিয়ে সেটা নিয়ে লড়ার শক্তি কারওরই ছিল না, পাসওয়ার্ডটাকেই এদিকওদিক করে প্রোফাইল পাসওয়ার্ড হিসেবে চালানো হয়েছে।

ভগবানের দয়ায় আমাদের সে সব স্ট্রাগল অতীত। এখন স্ট্রাগল অত কষ্টে সেট করা পাসওয়ার্ড আর প্রোফাইল পাসওয়ার্ড মনে রাখার। এ ব্যাপারে অবশ্য জয়েন্ট পাসওয়ার্ডের একটা সুবিধে আছে। একজন ভুলে গেলে অন্যজনের থেকে জেনে নেওয়া যায়। দুজনেই একসঙ্গে ভুলে যাওয়ার চান্স কম।

*****

বিয়ের পর আরও একটা স্ট্রাগল হচ্ছে ব্যক্তিগত পাসওয়ার্ড শেয়ার করার বা না করার। বিয়ে করলেই যে পাসওয়ার্ড শেয়ার করতে হবে সে রকম বাধ্যবাধকতা নেই। না করার টিপস্‌ই দেন কেউ কেউ। বিয়ের পর কী কী করতে হবে সে নিয়ে অবশ্য সকলেই টিপস দেন, ডিভোর্স ল-ইযাররা পর্যন্ত। নিয়মিত কাউন্সেলিং-এ যান। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একে অপরকে একটি করে কমপ্লিমেন্ট দিন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে একসঙ্গে বসে ‘গ্র্যাটিচিউড জার্নাল’-এ পাঁচটি পয়েন্ট লিখুন। তার মধ্যে একটা 'ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল' রাখতে পারলে ভালো। সপ্তাহে একবার করে সেফটি ভালভ মিটিং ডাকুন। গত সাতদিনে কে ক'বার শব্দ করে ঢেঁকুর তুলেছিল আর কে লাইটফ্যান না নিভিয়ে রেগুলার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সে সব অভিযোগ কাটাকুটি করে নিন। 

সর্বোপরি, সার্থক এবং সফল দাম্পত্যের জন্য জোরে জোরে দুলে দুলে বলুন সকালবিকেল - হেলদি বাউন্ডারিজ আর পার্সোনাল স্পেস। 

হেলদি আর পার্সোন্যালের মধ্যে কী কী পড়বে কমন সেন্স দিয়ে আন্দাজ করতে যাবেন না। নিজস্ব গামছা, নিজস্ব থালাবাটি, চিরুনি এসবের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। অনেক তো বলেন একে অপরের এঁটো খাবার খেলে প্রেম বাড়ে। খালি অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড জেনে ফেললে পার্সোন্যাল স্পেস নিয়ে হাহাকার পড়ে যায়। 

আমরাও পার্সোন্যাল স্পেসের ওই সংজ্ঞা পড়েশুনেই বড় হয়েছি, বিয়ের আগে একে অপরের ফেভারিট ফুল, ফেভারিট ফল, কে ক'টা প্রেম করেছি পর্যন্ত জিজ্ঞাসা  করিনি। পাসওয়ার্ড তো দূর অস্ত। 

কিন্তু ইন্টারনেটের সঙ্গে বাস্তব জীবনের তফাৎ আছে। কোনও টিপ-বইয়ের কোথাও লেখা নেই নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে তৈরি হলে কী করতে হবে। ধরা যাক, একজন চলন্ত অটোয়। ফোনের ডেটা শেষ অথচ একটা ইনফরমেশন চাই এক্ষুনি। যেটা আছে ইমেলে। না না তোমার ইমেলে না, তোমারটায় থাকলে তো হয়েই যেত, আমারটায়। কী আর করবে। পাসওয়ার্ড বলে দিচ্ছি নাও, হেলদি বাউন্ডারির তোয়াক্কা না করে ঢোকো আমার ইনবক্সে। মত্তহস্তীর মতো তছনছ কর আমার পার্সোন্যাল স্পেস। 

আমার পাসওয়ার্ড অর্চিষ্মানের গোচরে যাওয়ার এক্স্যাক্ট মুহূর্তটা আমার মনে নেই, গত পাঁচ-ছ বছরে যে একাধিকবার ল্যাপটপ-ভেঙে-গেছে, ফোন-হারিয়ে-গেছে, কখনওসখনও দুটোই-একসঙ্গে-ঘটেছে পরিস্থিতির উদয় হয়েছিল, সে রকম কোনও একটা সময়েই হবে। মেল চেক করতে (আসলে অবান্তরে কমেন্ট পড়ল কিনা দেখতে) ওর ল্যাপটপ বা ফোন ধার করেছিলাম। কতবার আর ওর জিমেল থেকে লগ আউট করে নিজেরটায় লগ ইন করব? ক্ষান্ত দিয়ে 'অ্যাড অ্যাকাউন্ট' করে রেখেছি। যদি কখনও কৌতূহল চাপতে না পেরে ঢুকেই পড়ে, কীই বা দেখবে, পেপারফ্রাই আর শাদি ডট কম-এর স্প্যাম। 

পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় খারাপ ব্যাপার এটাই। লুকোনোর মতো একটা ভদ্রস্থ সিক্রেট জীবনে না থাকার লজ্জাটা উন্মুক্ত হয়ে পড়া। 

আর প্রথম খারাপ হচ্ছে, পাসওয়ার্ডটার নিজের উন্মুক্ত হয়ে পড়া। 

আমি মনে করি, পাসওয়ার্ডের ওপাশে গোপন কথা থাকুক না থাকুক, আসল কথাটি রয়েছে পাসওয়ার্ডে। যে রাগী লিবারাল 'পনীর খায় ব্যাটাদের বিষক্রিয়ায় মরাই উচিত' টুইট বাহবা কুড়োচ্ছেন সকালবিকেল, দেখুন গিয়ে তিনি টুইটারে প্রতিবার ঢুকছেন 'থাকবরং' টাইপ করে। টিন্ডারে লোকে প্রিয় লেখকের খোপে চিমামান্ডা আদিচি লিখে রাখেই, না লেখাই আশ্চর্যের, কিন্তু পাসওয়ার্ডের পাহারায় সত্যিকারের নিজেকে বসিয়ে রাখে। 'ফাইভপয়েন্টসামওয়ান'। 

একে অপরের পাসওয়ার্ড জানার পর একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়া ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারিনি আমি বা অর্চিষ্মান কেউই। মাঝখান থেকে একটা পর্দা সরে গিয়েছিল। পাসওয়ার্ডটা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল সেটা একটা ক্ষতি, কিন্তু একে অপরকে আরেকটু বেশি চেনা গিয়েছিল সেইটা লাভ।


Comments

  1. last point ta akdom sotti kotha.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাই ফাইভ, কুহেলি।

      Delete
  2. স্রেফ এই জেনে গেলে কেমন লজ্জার ব্যাপার বলে আমি কত কিছু বাড়িতে বলিনা, মান্স না বলার কারন নেই কিন্তু তাও...

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যি বলতে কী, এই লজ্জাটা এত দ্রুত অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যে তোমার যে আছে সেটাকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছি না, প্রদীপ্ত। খুব একটা খারাপ না কিন্তু অল্প একটু থাকাটা।

      Delete
  3. Darun laglo eyi post ta pore Kuntala. Password share kora niye kokhono bhabini :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. না ভাবাই ভালো, শর্মিলা।

      Delete
  4. Eke aparer ento khabarer poramorshota sanghatik!!:):):)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা অবশ্য আমি একটু বাড়িয়ে বলেছি, কারণ বরবউ একে অপরের এঁটো খেলে প্রেম বাড়ে সেটা কেউ বলেনি আমাকে, কিন্তু মা শিশুর ক্ষেত্রে ডেফিনিটলি শুনেছি। তবে পার্সোনাল স্পেস নিয়ে খুব মাথা ঘামানো লোকজন যে অম্লানবদনে শুধু পার্টনারের না, বন্ধু, সহকর্মী, পরিচিত, অর্ধপরিচিত সবার এঁটো খেয়ে ফেলে এটা আমাকে চিরদিনই বিস্মিত করেছে।

      Delete
  5. ento to khetei hoy..prem o bare..ar khabar nasto na korar paap theke mon ta mukto hoy
    eksathe youtube dekhte dekhte kheleo prem sure bare

    password diyei manush chena jay..darun bolecho

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  6. "ধরা যাক, একজন চলন্ত অটোয়। ফোনের ডেটা শেষ অথচ একটা ইনফরমেশন চাই এক্ষুনি। যেটা আছে ইমেলে। না না তোমার ইমেলে না, তোমারটায় থাকলে তো হয়েই যেত, আমারটায়। কী আর করবে। পাসওয়ার্ড বলে দিচ্ছি নাও, হেলদি বাউন্ডারির তোয়াক্কা না করে ঢোকো আমার ইনবক্সে। মত্তহস্তীর মতো তছনছ কর আমার পার্সোন্যাল স্পেস। " দুরন্ত||

    ReplyDelete
  7. Bank account, iPad, phone, IRCTC, credit card -- sobkichur password chhanamakha hoye gachhe. Shudhu GMail er password ta dujonei "personal space" er last stand bole bachiye rekhechhi apraan. Kodin pari setai dekhar. :/

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের ফোনের কন্ট্যাক্ট কপি হয়ে গেছে। কী করে হল ভগবানই জানেন। এর আগে এই ঘটনা আমার আর মায়ের সঙ্গে ঘটেছিল। এখন টেলিফোন ভবনের যত ডিপার্টমেন্টের নম্বর আমার এবং অর্চিষ্মানের ফোনে। এর পরেও যদি আমার ভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস না করে কিছু বলার নেই।

      Delete
  8. Password share korata embarrassing, karon onek somoy seta jeeboner 'First' set kora password eri ektu modification (Onekei ekta password i continue korte chan). Tai 'MuscleStud1986' ba ei jatiyo kichhu password karur sathe share kora ... bhison :( :( dukhher..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো, রণদীপ। নিজেদের পাসওয়ার্ড জানার পর একটা শিক্ষা আমরা পেয়েছি, যে পাসওয়ার্ড স্ট্রং ইত্যাদি হওয়ার সঙ্গে ভদ্রসভ্যও হওয়া দরকার যাতে লোককে বলতে লজ্জা না হয়।

      Delete

Post a Comment