ওষুধের বাক্স



বাড়ি বদলানোর অনেক খারাপের মধ্যে একটাই ভালো যে এই সুযোগে জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া যায়। কী কী ফেলব জানাই ছিল। দরকারের থেকে বিস্তর বেশি জামাকাপড় আছে, ফেলব। বিজনেস কার্ড প্রতিটিই অদরকারি, সব ফেলব। মাস্টার্সের খাতাপত্রও আর রাখব না। বইও প্রচুর বাড়তি। পড়ে-ফেলেছি-আর-পড়ব-না বই, কোনওদিনই-পড়ব-না বই। তা সত্ত্বেও বই ফেলব না জানা ছিল কারণ বাড়ি সাজানোর জন্য এক বুককেস বই যা করতে পারে কোনও বাঁকুড়ার ঘোড়া পারে না। 

মোদ্দা কথা, আমি প্রস্তুত ছিলাম, কোনও কিছু ফেলতে গিয়েই বিস্মিত হইনি। কেবল একটি ক্যাটেগরির জিনিস ছাড়া।

ওষুধের বাক্স। শিশি, পাতা, বাক্স। ট্যাবলেট, সিরাপ, স্প্রে। গেলার, মালিশের, কুলকুচি করার। পেটের, নাকের, মাথার। এক্সপায়ার্ড। এক্সপায়ার করে করে। এক্সপায়ারি ডেট দেখাই যায় না। 

এত অসুখ হয়েছিল আমাদের? 

ওষুধ জমার কারণ আছে অনেক। রোগ সেরে যায়, ওষুধ ফুরোয় না। তোবড়ানো রুপোলী পাতায় তিনটে গুলি শুয়ে থাকে। কখন আবার নাটক শুরু হবে, ত্রাতার রোলে নামবে। এই করে করে রয়ে গেছে কেটেরল ডি টি আর জেভিট আর মাহাফ্লক্স। কিছু কিছু ওষুধ রাখতে হয়। না রাখলে সংসার সংসার ফিলিং আসে না। ক্যালপল সিক্স ফিফটি। ইনো। ব্যান্ডেড। থার্মোমিটার। 

থার্মোমিটার আমাদের একটার বদলে দুটো আছে। প্রথমটা কেনা হয়েছিল সংসারে একটা থার্মোমিটারে রাখতে হয় বলে। কিন্তু দু'বার জ্বর মাপতে না মাপতে তিনি কোন খাঁজে লুকোলেন, দু'নম্বর থার্মোমিটার কেনার আগে বেরোলন না। মা অবশ্য খুশি হয়েছিলেন প্রথমটা হারিয়ে যাওয়ায়। বলেছিলেন, এবারেরটা হিক্স্‌ কোম্পানির কিনিস।মায়েদের ছোটবেলার জ্বর হিক্স কোম্পানির থার্মোমিটার দিয়ে মাপা হত। সেই থেকে মা অন্য কোনও থার্মোমিটারকে ভরসা করতে পারেন না।

কিছু কিছু ওষুধ থাকার কোনও কারণ নেই। আধপাতা অ্যাভোমিন। রোজ ওলায় বসে মাথা ঘোরে না, গা গোলায় না। তবু আছে। প্রতিবার ইনো হাঁটকানোর সময় হাতে উঠে এসে মনে পড়াচ্ছে আজকালপরশুর এই জেলখানাটাই সত্যি নয়। এর বাইরে পাইনের গন্ধওয়ালা বন আছে, স্টেট কর্পোরেশনের বাসের জানালা অগ্রাহ্য করে ঢুকে পড়া কুয়াশা আছে, আর আছে হেয়ারপিন মোড়ে বাসের বিপজ্জনক বেঁকে গিয়ে সারা শরীরের ভেতরের বেসামাল যন্ত্রপাতি।

কাজেই অ্যাভোমিন থাকছে। থাকাটা জরুরি। 

স্যারিডনের পাতাটাও জরুরি। স্যারিডনের বিজ্ঞাপন জন্মে থেকে দেখছি টিভিতে, ছোটবেলায় মাথাব্যথাও হত অনেক কিন্তু স্যারিডন খাওয়ার সুযোগ হয়নি কখনও। কারণ আমার ওই সময়ের মাথাব্যথাকে কেউ কোনওদিন সিরিয়াসলি নেয়নি।  রোজগারের চিন্তা নেই, ছেলেমেয়ে মানুষ করার ভাবনা নেই, মাথাব্যথা কেন হবে? অবশ্য ডিস্ক্রিমিনেশনটা বয়সভিত্তিক যত না, তার থেকে বেশি রোগভিত্তিক। আমাদের বাড়ির রোগবালাই  স্বাস্থ্যচর্চার ফোকাস ছিল পেট। বেড়ার ধার ঘেঁষে থানকুনি গাঁদালের জঙ্গল বানানো হয়েছিল। এক্সটার্নাল অ্যাপ্লিকেশনের জন্য বোরোলিন, আর চোখে দেখতে না পাওয়া অসুখ হলে থানকুনি/চিরতা/গাঁদাল/লিভ ফিফটি টু।  লিভ ফিফটি টু-র অলৌকিক ক্ষমতার কথা আমি শুনেছি। চিরতা গাঁদালে কাজ না দিলে ঠাকুমা লিভ ফিফটি টু-র বোতল বার করতেন।  আমার মায়ের তূণের সর্বরোগহর ব্রহ্মাস্ত্র হল কার্মোজাইম। ফোনে আমার গলা সি শার্পের বদলে বি ফ্ল্যাটে বাজলে বলেন, দু' চামচ কার্মোজাইম খেয়ে নিবি নাকি সোনা? 

মোদ্দা কথা, মাথা ব্যথা হলে ওষুধ খেতে হবে এ রকম অদ্ভুত যুক্তিতে আমাদের বাড়িতে কেউ বিশ্বাস করত না। সেরদরের মাথাব্যথা সারাতে ওষুধ খাওয়াকে চারিত্রিক দুর্বলতার লক্ষণ ধরা হত। কাজেই আমার কোনওদিন স্যারিডন খাওয়ার সুযোগ হয়নি। অম্রুতাঞ্জন মাখারও না। 

ব-দিদির বাড়ির লোকেরা আমাদের বাড়ির লোকজনের থেকে মুক্তমনা ছিলেন, রোগবালাই নিয়ে ভেদাভেদ করতেন না। তাঁদের বিছানার পাশের টেবিলে বুক ফুলিয়ে জেলুসিল, স্যারিডন, অম্রুতাঞ্জনের শিশি বাস করত, আর থাকত একটি অ্যামেরিকা থেকে ল্যান্ড করা একটি ব্র্যান্ডেড ওয়াকম্যান।

আমাদের বাড়িতে বাগরি মার্কেটের ওয়াকম্যানও ছিল না। কখনও থাকবে আশাও ছিল না। কারণ আমার বাড়ির বড়রা বিশ্বাস করতেন স্যারিডনের থেকেও চরিত্রগঠনের বেশি পরিপন্থী যদি কিছু এ পৃথিবীতে থেকে থাকে তবে সেটা ওয়াকম্যান।

আমি তাকিয়ে আছি দেখে ব-দিদি বলেছিল, নে না। 

সেই প্রথম আমার অম্রুতাঞ্জন মাখা। আঙুলে করে অল্প একটুখানি নিয়ে কপালের চামড়ায় ঠেকাতেই শোঁ শোঁ করে সব তাপ শুষে নিল। অল্প মিষ্টি মেশানো ঝাঁঝালো গন্ধ, মৃদু ঝিমঝিম। অনির্বচনীয়। 

স্যারিডনটা কিনেছিলাম ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে। মোড়ের মাথায় যে দোকানে পিয়ার্স ব্রসন্যান এলেই খেতে যান, সেটার কোণাকুণি লজঝড়ে বাড়িটার সামনে দপদপ করা যোগচিহ্নর নিচ দিয়ে নেমে যাওয়া সরু সিঁড়ি বেয়ে টিউবলাইটজ্বলা ওষুধের দোকান। মাথা ধরলে চলে যাও, পয়সা ফেলো, স্যারিডন কেনো, জল দিয়ে ঢক করে গিলে নাও। তোমার সহ্যশক্তির অভাব নিয়ে কারও কিছু বলার নেই, চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব নিয়ে কেউ জাজমেন্ট পাস করবে না। 

খিদে পেলে ম্যাগি, মাথা ধরলে স্যারিডন। আমার ডিকশনারিতে স্বাধীনতার মানে। 

আবার এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলোর থাকার এত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ নেই। যেমন চৌকো ছোট বেগুনি গোলাপি কাগজের দেড় ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি বাক্সখানা। ওর মধ্যে আছে গাঢ় বেগুনি এবড়োখেবড়ো মোটা চিনির দানার মতো ম্যাগনেশিয়াম। এই বয়সে মাম্পস হয়েছে দেখে অবাক হয়ে ডাক্তার লিখে দিয়েছিলেন। জলে মিশিয়ে কুলকুচি করবে সকালবিকেল। জ্বরটর নেমে গিয়েছিল মাঝপথেই কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ ছিল। মারাত্মক নাকি ছোঁয়াচে। গল্পের বই কিন্ডলে আনিয়ে নিয়েছিলাম খানকয়েক, অল্প ক্লান্ত দেহে শুয়ে শুয়ে সারাদিন পড়তাম। টানা সা-আ-আ-ত দিন। অসুখ সেরে গেল, গল্পের বই ফুরিয়ে গেল, গাল চুপসে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। বাক্সে ম্যাগনেশিয়ামের বেগুনি নুড়ি তখনও অর্ধেকের বেশি রয়ে গেল। তুচ্ছ জিনিস, পাঁচ না দশ টাকা। ফেলে দিলেই হত। কিন্তু ফেলিনি। ওই সাতটা দিন যে সত্যি সত্যি আমার জীবনে এসেছিল, তার প্রমাণ হিসেবে। 


Comments

  1. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিন্নি।

      Delete
  2. bhalo bhalo..
    chotobelay mumps hoechilo,jakhn daktarbabu bollo tana babul gum khabi,sotyi,ekta darun anondo hoechilo..

    amrutanajan mekhe ghumote jayar nesha kintu besh addictive,full mosti lage

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, এই গুণটার কথা জানা ছিল না।

      Delete
  3. Amar oi amrutanjan noyeto zandu balm er nesha ache ... ektu naake lagiye dilei besh ghum ashe :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ বাবা, এটা সবাই জানে আমিই জানি না। মায়ের ঘুমোতে অসুবিধে হয় আজকাল, সাজেস্ট করে দেখব।

      Delete
    2. Oi eucalyptus oil ar onno ki shob ache ja ghum ashte ar nerves calm down korte shahajjo kore. Kopale ar naake ektu lagalei chokh bondo hoye ashe.

      Delete
  4. kuntala kakima ke melatonin khete bolte paro. ota ghum er jonya besh bhalo

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ আচ্ছা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. school e porte akta somoy amar protyek bochor mumps hoto, season change er somoy. gaale sticker mere ghore shuye thaktam. porte boste hoto na, school jete hoto na. ki moja.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি বললে বলে স্বীকার করছি, কুহেলি, আমার খুব শখ ছিল গালে স্টিকার পরার। ডাক্তার সে কথা না তোলায় একটু হতাশই হয়েছিলাম। বড়বেলায় বোধহয় ও সব লাগে না।

      Delete
  6. আমি অবান্তরের নিয়মিত পাঠক। একটা আবদার। ব্রেক আপ নিয়ে একটা লেখা লিখবেন? আফটার ব্রেক আপ থেরাপি আরকি..

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা বেশ ভালো বিষয় বলেছেন। লিখব। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  7. "খিদে পেলে ম্যাগি, মাথা ধরলে স্যারিডন। আমার ডিকশনারিতে স্বাধীনতার মানে। " <3

    ReplyDelete

Post a Comment