দে কেয়ার। দে ডোন্ট কেয়ার। দে কেয়ার। দে ডোন্ট...



আমার অফিসচত্বরে কী যেন একটা মেলা বসেছে। মাটির তৈরি হাঁড়িকুড়ি থালাবাটি কাপপ্লেট জলের বোতল থেকে শুরু করে তিনহাত উঁচু ফুলদানি হাতি ঘোড়া সিংহ। অফিসের একজন ও রকম একটা সিংহের দর করতে গিয়েছিল, ফিরে এসে চোখ কপালে তুলে বলছে, কিতনে কা পতা হ্যায়? বারা হাজার। সামনে আমিও চোখ কপালে তুললাম, কিন্তু মনে মনে ভাবলাম এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে। অত্যন্ত ভালো হাতের কাজ। ওই রকম দামই হওয়ার কথা। 

আমি, বলা বাহুল্য, দাম জানতে যাইনি কারণ অ্যাফর্ড করতে পারব না, তাছাড়া আমার দরজার একদিকে পার্টিকল বোর্ডের জুতোর বাক্স অন্যদিকে হাঁ করা সিংহমূর্তি ভয়ানক বেমানান দেখাবে। 

সত্যি বলতে আমার কিছুরই দাম জিজ্ঞাসা করার কথা নয় কারণ আমার কিছুই কেনার নেই। কারণ যা যা বিক্রি হচ্ছে তার কোনওটারই আমার দরকার নেই। কিন্তু কনজিউমারিজম কি না রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশেছে, একটা কিছু না কিনলে মন খারাপ হয়। আমার বাজেটে কুলোবে খালি হাঁড়িকুড়ি, জলের গ্লাস, চায়ের কাপ, পেনদানি আর সুন্দর জালিকাটা ডিফিউজার। যার ভেতর ছোট্ট মোমবাতি জ্বেলে দিলে একে তো আলোর ছটায় মায়াময় অ্যাম্বিয়েন্স গ্যারান্টিড, এর ওপর পাত্রের ওপরের গর্তে সুগন্ধী ঢেলে দিলে, আপনার রুচিপছন্দ বুঝে ল্যাভেন্ডার অয়েল কিংবা কর্পূর, বাড়ি ম-ম। ভারি বাহারের জিনিস কিন্তু আমার আর অর্চিষ্মানের মতো দুই ভীতুর বাড়িতে ফায়ার হ্যাজার্ড। কাত হয়ে বেডকভারের ওপর পড়লেই গেছি। কাজেই বাদ।

পেনদানিও বাদ। অফিসের ডেস্কে অলরেডি দু’খানা পেনদানি আর বাড়ির টেবিলে জঞ্জাল কম রাখার জন্য অন প্রিন্সিপল পেনদানি রাখি না। এখন ননস্টিক ফেলে মাটির হাঁড়িকুড়িতে রান্না শুরু করলে বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে, কাজেই কিনতে হলে একমাত্র চায়ের কাপই কিনতে হবে। তাই কিনতে গেলাম। নৃত্যরত আদিবাসীর রংবেরঙের মোটিফ আঁকা আর্টিস্টিক কাপও আছে, কিন্তু আমার চোখে লেগেছে প্লেনটাই। প্লেনেরও আবার দুটো ভ্যারাইটি। হ্যান্ডেলওয়ালা এবং হ্যান্ডেলহীন। আমি যখন গেছি তখন দোকানে আর একজনই খদ্দের ছিলেন, তাঁর কেনাকাটি তখন শেষ। টাকাকড়ির ব্যাপার মিটছে। আমি একটা হ্যান্ডেলওয়ালা কাপ ধরে নেড়েচেড়ে দেখলাম। এরপর হ্যান্ডেলছাড়া কাপ তুলে দুইহাতের কোঁচড়ে ধরে দেখছি, পাশ থেকে একটা হাত এগিয়ে এসে আরেকটি হ্যান্ডেলছাড়া কাপ তুলে নিল। আমি চোখ তুললাম এবং দ্রুত পরিস্থিতি পড়ে নিলাম।

ভদ্রমহিলা একটা হ্যান্ডেলওয়ালা কাপ কিনেছেন, কিনে ভাইসাবকে প্যাকও করতে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে তুল্যমূল্য বিচার করতে দেখে ওঁর দ্বিধা হয়েছে। নতুন করে ভাবতে বসেছেন কোনটা নেওয়া উচিত হবে। হ্যান্ডেলওয়ালা না হ্যান্ডেলহীন।

চুপ করেও থাকা যেত, কিন্তু একে বিষয়টা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নয় তায় সুন্দর রোদ্দুর উঠেছে, শুক্রবার লাঞ্চটাইম, তিনদিনের লং উইকেন্ড সামনে চিৎপাত পড়ে আছে। গায়ে পড়ে বলে উঠলাম, শীতে দুই হাতে গরম কাপ জড়িয়ে ধরে খেতে ভালো লাগবে মনে হয়। 

মহিলা জানালেন আমাকে দেখে ওঁরও সেই কথাটাই মনে হয়েছে। এতক্ষণ উনি হ্যান্ডেল থাকাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন কিন্তু আমাকে কাপ জড়িয়ে ধরতে দেখে দ্বিধায় পড়েছেন। আমি ওঁর পছন্দের পালে হাওয়া দেওয়ার জন্য যুক্তি দিলাম, কিন্তু এখন তো গরম আসছে, হ্যান্ডেল ধরে খেতেই সুবিধে হবে মনে হয়। উনি হাতে কাপ ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করলেন আমি ওই চত্বরে কী করছি। বললাম, পেটের ভাত জোগাড়। উনি অফিসের নাম ইত্যাদি জানতে চাইলেন। ভদ্রতাবশতঃ আমাকেও জিজ্ঞাসা করতে হল, আপনি এদিকে কী সূত্রে? 

ভদ্রমহিলা জানালেন উনি দশটা পাঁচটায় নেই, উনি হচ্ছেন শিল্পী। আর্টটার্ট ইন্সটলেশন করেন। এক্সিবিশনটিবিশন। আমাদের ওই চত্বরেও নাকি করেছেন। আমি ন্যায্যতই মুগ্ধ এবং মুহ্যমান হলাম। বললাম, দারুণ ব্যাপার তো। আমার চাকরিটার থেকে ঢের ভালো কাজ। উনি ভদ্রতা করে সান্ত্বনা দিলেন। আরে জানেন না, এ লাইনেও হেবি ঝামেলা।

আমাদের মনোযোগ আবার কাপের দিকে ঘুরল। ভদ্রমহিলা তখনও মনস্থির করতে পারছেন না দেখে আবারও হেল্পফুল হলাম। বললাম, দেখুন এই বিষয়গুলোতে ভালোমন্দ ঠিক করা মহা শক্ত। দুই ডিজাইনেরই সুবিধে অসুবিধে আছে, আপনি যা মনস্থির করেছেন তাই নিন। ভদ্রমহিলা সায় দিয়ে মাথা নাড়ছেন, কী দুর্বুদ্ধি হল বলে বসলাম, আর যদি নেহাতই মনস্থির না করতে পারেন একটা হ্যান্ডেলওয়ালা নিন, আরেকটা হ্যান্ডেলছাড়া। 

আগুনে ঘি পড়ল। 

আমি কিন্তু মহিলার নিজের জন্যই নিতে বলেছিলাম কারণ ওঁর বাড়িতে দ্বিতীয় কাপে চা খাওয়ার মতো কে আছেন না আছেন সে নিয়ে কোনওরকম আন্দাজ আমার থাকার কথাও না ছিলও না, কিন্তু ভদ্রমহিলা একেবারে জ্বলে উঠলেন।

নোপ। নিলে একটাই নেব। নিজের জন্য, ব্যস। নিজের জন্য ছাড়া আর কারও জন্য কিছু নেওয়ার নীতি আমি বিসর্জন দিয়েছি। এবার থেকে একলা চল। বাকিদের ব্যবস্থা বাকিরা বুঝে নেবে। 

মহিলার সঙ্গে এতক্ষণ এমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে এই বেলা তো সুতো গুটিয়ে নেওয়াটা ভালো দেখায় না। ‘না মানে দেখুন, হয়তো রাগ হয়েছে, হয়তো এবার আপনি কাপ নিয়ে গেলে রাগ ভেঙে যাবে’ ইত্যাদি বলার পরিস্থিতিও নয়, ঘনিষ্ঠতাও নেই। এমন ভাব দেখালাম যেন এতদিনে ভদ্রমহিলা একটা কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চলতে হলে একলাই চলা উচিত। আমিও তাই চলি।

মহিলা তখনও বলে চলেছেন। জানেন, আমি যেখানে যেতাম, যা পছন্দ হত কিনে আনতাম, সর্বদা দুটো করে। অনেক সময় নিজের জন্য না কিনেও। তার উত্তরে খালি এটা কেন কিনলে এটা তো পয়সা নষ্ট, এর তো দরকার ছিল না, এটার তো এই জায়গাটা কেমন যেন, এটা তো ফিট করছে না এই সব। অবশেষে আমি বুঝে গেছি কেবল আমিই কেয়ার করি…

আমি আমার সহমর্মিতা বোঝানোর জন্য এবং যাতে নকল মনে না হয় অত্যন্ত ম্রিয়মাণ মুখে মাথা নেড়ে বললাম,

দে ডোন্ট কেয়ার।

মহিলা থমকে গেলেন। যেন এত দিন ধরে, এত দাম চুকিয়ে উপলব্ধি করা ওঁর জীবনের সারসত্যটুকু আমি তিনটি শব্দে প্রকাশ করেছি।

হাত বাড়িয়ে আমার হাতখানা ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন মহিলা। সেকেন্ড পাঁচেক পর সামলে নিয়ে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, নিজের নাম বললেন, ভাইসাবের হাত থেকে প্যাক করা কাপখানা নিয়ে যেতে যেতে বলে গেলেন, আই উইল রিমেমবার দিস কাপ অ্যান্ড আই উইল রিমেমবার ইউ।

ভাইসাবের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমার কি কিছু কেনার মতলব আছে নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি গপ্পই মারব? ভাইসাবের চোখ এড়িয়ে আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, এটাসেটা তুলে দেখতে লাগলাম। মহিলা ঠিক পাশের স্টলটাতে দাঁড়িয়ে কী সব যেন নেড়েচেড়ে দেখছেন। আড়চোখে নজর রাখলাম। কিছুক্ষণ পর উনি সরে যেতে একখানা কাপ তুলে ভাইসাবের হাতে দিয়ে বললাম, মুঝে দো লেনা হ্যায়। প্যাক করকে দেনা প্লিজ।






Comments

  1. Replies
    1. হাই ফাইভ, চুপকথা।

      Delete
  2. Replies
    1. হাহা, এইটা ভালো কর, শম্পা।

      Delete
  3. Bhari sundor lekhata. Cup duto-o darun!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সায়ন। আপনার নয়-এর পাঠপ্রতিক্রিয়ার জন্যও ধন্যবাদ জানানোর আছে আমার, সেটাও এখানে জানিয়ে দিলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. এই কাপ আমার আছে, এবং যেহেতু আমি চা কফি কিছুতেই নেই তাই এর একটাতে খুচরো পয়সা আরেকটাতে সেফটিপিন চুলের ক্লিপ ইত্যাদি ভীষণ দরকারি জিনিসপত্র থাকে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, এ রকম নেশামুক্ত জীবনযাপন দেখলেই আমার হিংসে হয়। সেফটিপিন রাখার আইডিয়াটা ভালো। আমারগুলো কোথায় যে যায়, প্রতি ছ'মাস অন্তর শাড়ি পরার সময় নতুন করে একপাতা কিনতে হয়।

      Delete
    2. আমি একটা খুব ভালো সমাধান করেছি এই সমস্যার। আমাজন থেকে একটা ম্যাগনেটিক চৌকো মতন পাত (ম্যাগনেটিক প্লেট বলে সার্চ কোরো) কিনে দেওয়ালে লাগিয়ে দিয়েছি আঠা দিয়ে। এখন সব সেফটিপিন ওটায় ঝোলাই।

      Delete
    3. এইটা দারুণ সমাধান তো, আমিও তাই করব এবার থেকে। থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete
  5. আমরা কাপ কিনি প্রচুর, ভাঙি তার চেয়েও বেশি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, ভালোই কর, তিলকমামা, না হলে রাখার জায়গা থাকত না।

      Delete
  6. আমিও বেশ কয়েক বছর আগে গ্রামের মেলা থেকে এরকম কাপ দশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম এবং আমিও এতে খুচরো পয়সা রাখি। গ্রামের ভাষায় একে বলতো কটোরি। আপনার টা কত দাম নিল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, আপনার দামটা জানার পর আমারটা বলতে মরমে মরছি। মাত্র দেড়শো।

      Delete
  7. আমার মনে হয়, দে কেয়ার বাট দে ওন্ট শো ইট :) অসাধারণ লেখা এবং টাইটেল !

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, কাকলি। সেটাও হতে পারে।

      Delete
  8. Bah.. darun.. amar o ache onek bochor age kena.. ektai ache.. boimelay age dekhechi er opor chobi enke bikri hoto...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ এই কাপগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়, আমি অনেকদিন ধরেই কিনব কিনব ভাবছি, কেনা আর হচ্ছিল না, হাতের কাছে পেয়ে নিয়ে নিলাম।

      Delete

Post a Comment