ম্যাগি ও ডিভোর্স



অর্চিষ্মান আবারও তিতিবিরক্ত। ঠিক বিরক্ত নয়, হতাশ। বেশি হতাশ নয়, অল্প হতাশ। যতটা অল্প হলে হতাশা প্রকাশ করার সময় মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকে, ততটা।

জীবনের অধিকাংশ হতাশাই আজকাল অন্যায্য ঠেকে। এই যেমন নিজেকে একচল্লিশে যেখানে দেখব ভেবেছিলাম সেখানে দেখতে না পাওয়ার হতাশা। অযৌক্তিক, কারণ ভুল হয়েছিল দেখার। বোঝার। মাপার। এবং ভুল যে হয়েছে সেটা টের পেয়েও মেনে না নেওয়ার। মনে না নেওয়ার।

যে হতাশাগুলোয় নিজে লেপ্টে থাকি না সেগুলো অবশ্য মেনে মনে সবই নিই। যেমন ধরা যাক হইচইতে ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’ দেখাজনিত হতাশা। রুদ্রবীণা হল ‘তানসেনের তানপুরা’-র সিকোয়েল। সেম চরিত্র, সেম সেট আপ, যেটুকু মনে আছে সমস্যাটাও সেম, খালি তানপুরার জায়গায় বীণা। তানসেনের জায়গায় কে, ভুলে গেছি। সরি।

হতে পারে হতাশা আদৌ হয়ইনি। গোটাটাই ভড়ং। তানসেনের তানপুরা-র স্মৃতি ফিকে হওয়ার আগেই রুদ্রবীণা খুলে বসেছি তো? বসে নিজের প্রেফারেন্স রিভিল করেছি। প্রেফারেন্সটা একটি বিশেষ মানের ওয়েব সিরিজের প্রতি হতে পারে কিংবা একটি বিশেষ ধরণের মর্ষকামের। যাই হোক না কেন, অসুবিধেটা আমার তরফের, রুদ্রবীণার নয়। এখানে ভিকটিম রুদ্রবীণা, আমি নই। ঠিক যেমন নন ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত বিজ্ঞান বিষয়সমুহে বাহান্নর বেশি না পাওয়া মেয়েকে সায়েন্সে ঠেলে জয়েন্টে আঠেরোশো র‍্যাংকিং করার পর মর্মাহত মুখ করা অভিভাবকেরা। ও গৌরব স্রেফ, এবং স্রেফ মেয়েটির জন্য সুসংরক্ষিত।

কাজেই আমি রুদ্রবীণাকে বকছি না। হইচইকেও না। বলছি, কে কী বলছে কান দিয়ো না। মনে রেখ, ভালোমন্দ, সাফল্য ব্যর্থতা সবই আপেক্ষিক। একমাত্র তুমি স্থির করবে তোমার সাফল্য, তোমার ব্যর্থতা, তোমার মাপকাঠি। তোমার যদি মনে হয় দারুণ হয়েছে, কী এল গেল একচল্লিশ বছরের একজন আগাপাশতলা ফেলিওরের পাতে দেওয়ার অযোগ্য মনে হয়েছে কি না।

যাই হোক, অর্চিষ্মানের হতাশার কারণে ফিরে আসা যাক। সার্থক দাম্পত্যের মেড ইজি ম্যাগাজিনের মোমঘষা পাতায় একে অপরের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করার এবং প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় “হাউ ওয়াজ ইয়োর ডে/নাইট?” খবর নেওয়ার যে নিদান দেওয়া থাকে, সেই মেনে আমিও নিচ্ছিলাম খবর। কী করলে, কী দেখলে, কী খেলে এবং কী খাবের উত্তরে অর্চিষ্মান জানাল, ভাবছে আজ রাতে ম্যাগি খেয়েই শুয়ে পড়বে।

একটা লোককে বর্ণনা করতে আমরা কত কী লিখি। লোকটা মিটমিটে, মিচকে, দুনিয়াদার। লোকটার পেটে পেটে বুদ্ধি। লোকটা পাতায় পাতায় চলে। এপারে পুঁতলে ওপারে গাছ হয়ে বেরোয়। এ হাটে বেচে ও বাজারে কিনে আনে। বদনে সর্বদাই তেলতেলে মুচকি হাসি, যার মুখোমুখি পড়লেই আত্মবিশ্বাস অর্ধেক।

শীর্ষেন্দু লেখেন, লোকটার আছে একটা চতুর গোঁফ।

রাতের বর্ণনাটা অর্চিষ্মান প্রায় শীর্ষেন্দুর মুন্সিয়ানায় দিল। যে সব রাতে স্রেফ ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, তার চলনগমন বৈশিষ্ট্য তাৎপর্য নিয়ে কোনও ধন্দ থাকে না কারও। সম্পর্কের সমস্যা কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতা নিয়ে বিচলিত হওয়ার রাত নয় সেটা। সে রাত যাবতীয় জাগতিক জটিলতাকে কান ধরে মগজের, পারলে বাড়িরও বাইরে বার করে দেওয়ার। সে রাতে আমরা নেটফ্লিক্সে 'ম্যারেজ স্টোরি' দেখছি না কিংবা 'ডোন্ট লুক আপ'। 'মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া'-র নবম সিরিজ একধারসে শেষ করছি। নিজেকে ছাড় দিচ্ছি। ভালো হওয়ার চেষ্টা করছি না। নিজের যাবতীয় খুঁত, আলস্য, দম্ভ, আত্মপ্রতারণা নিয়ে নিজের মধ্যে ডুবে থাকছি।

প ম্যাগি করে চলে গেল। অর্চিষ্মান যথাসময়ে রান্নাঘরে ঢুকে কড়াইয়ের ঢাকনা তুলল।

ঝুরিঝুরি বাঁধাকপি, ঝিরিঝিরি গাজর, কুচিকুচি বিন, কড়াইশুঁটি, সয়া সস, আদারসুন, আজিনামোটো, অন্তে স্প্রিং অনিয়ন বিহনে ধনেপাতামণ্ডিত ম্যাগি।

কল্পনায় অর্চিষ্মানের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করালাম। বাঁ হাতে ঢাকনা, চোখ কড়াইতে।

ঘটনা দুদিকে ঘুরতে পারত। রান্নাঘরে ঢুকে ঢাকনা তোলার আগের আধঘণ্টা কীভাবে অতিবাহিত করছিলাম তার ওপর নির্ভর করে।

আনন্দবাজার অনলাইনের এই সাক্ষাৎকারটি শুনে? যেখানে অনিন্দ্য জানার সংগতে বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়? ‘যাকগে মরুকগে’ আর ‘গেল গেল’ এই দুই সরল মেরুর মাঝামাঝি একটা সুচিন্তিত, পরিশীলিত ও ক্রমশ বিরল অবস্থান থেকে?

নাকি সেই ইন্টারভিউটা দেখে, যেখানে সেলিব্রিটির বাড়ি ঘুরতে গেছেন ইন্টারভিউয়ার। এটা নতুন ট্রেন্ড। হলে, মঞ্চে, বিতর্কসভায় সেলিব্রিটিদের দেখে আর কারও মন না ভরছে না। তাঁরা কী খান, কী পরেন, রুটি গোল বেলতে পারেন কি না, সকালে উঠে কোন চামচ দিয়ে চায়ে চিনি গোলেন, গুলতে গুলতে ক্লকওয়াইজ না অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘোরেন, গোলা ফুরোলে চামচে লেগে থাকা চায়ের বিন্দু ধুয়ে ফেলেন না চেটে নেন, সব জানতে হবে। না জানলে অন্নপ্রাশনের পায়েস হজম হবে না।

বাড়িফাড়ি অবশ্য ছুতো, আসল উদ্দেশ্য কেচ্ছা। স্পেসিফিক্যালি, যৌন কেচ্ছা। এইটা একটা রহস্য । প্রাপ্তবয়স্ক লোক রোজ অফিসে যায় এবং ধরে নেওয়া যায় যৌনতা ব্যাপারটার সঙ্গেও মোটামুটি নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ আছে, তবু অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্কের যৌনতার প্রতি উদগ্র কৌতূহল ও খিদের এক শতাংশ অফিস যাওয়ার প্রতি থাকে না কেন।

বাড়ি দেখতে দেখতে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মহিলা ক্রমাগত হেসে হেসে (চোখ মটকানি আর কনুইয়ের গুঁতোই যা বাকি ছিল) বলে চলেছিলেন, এত সুন্দর বাড়ি নির্ঘাত বিশেষ কেউ সাজিয়ে দিয়েছেন। শুনি শুনি? কে কে?

(সেলিব্রিটি অবিবাহিত পুরুষ, কাজেই ফেয়ার গেম। বিবাহিত/+মহিলা সেলেব্রিটিকেও যদি একই অবলীলায় একই প্রশ্নের মুখোমুখি ফেলতে পারেন কোনও ইন্টারভিউয়ার, তাঁর উদ্দেশ্যে আগাম টুপি খুলে রাখলাম)।

চ্যানেলের একাধিক ইন্টারভিউ দেখে যা বোঝা গেল (এমন মচৎকার খনি না নেড়েঘেঁটে থাকা অসম্ভব) ভদ্রমহিলার মগজে ধ্যানধারণার যে ভারাটা বাঁধা তাতে একা পুরুষ নিজ দায়িত্বে বাড়ি সাজাতে পারে না এবং বয়স যাই হোক না কেন অমলেট ভাজতে জানলে তাকে মেডেল ও মুগ্ধতা অর্পণ করতে হয়।

মায়াই হচ্ছিল ভদ্রলোকের প্রতি। আহারে। বেচারা। ইন্টারনেটে নরম আবেগের আঁচ পোয়ানোর সুযোগ বেশি পাই না, পেলে উপভোগ করি। নিজের সহানুভূতিশীল মনের মুগ্ধ সান্নিধ্য শুষে নিচ্ছিলাম যতক্ষণ না “বিয়ে কবে করছেন?”-এর (এত সোজাসাপটা প্রশ্নটা করা হয়নি, “সুখবরটা কবে পাচ্ছি?” গোছের কিছু একটা বলা হয়েছিল) উত্তরে সেলেব্রিটি তেড়ে উঠলেন, নির্ঘাত রসিকতা করেই ---

আর ভাই দেখেশুনে বিয়েফিয়ে থেকে মন উঠে গেছে। বিয়ে করব, তারপর বউ ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে, রক্তজল করে জমানো অর্ধেক সম্পত্তি হাওয়া, এত বড় বাড়ি ফুস্‌, জীবনভরের খোরপোষ। পাগল নাকি?

ইন্টারভিউয়ারের মগজের ভারাটাতে ছেলেরা পুরুষকার আর মেয়েরা পকেটমার, কাজেই তিনি, 'সত্যি আজকাল ডিভোর্স এত বেড়েছে,' মর্মে খেদ প্রকাশ করবেন বলে লাফিয়ে উঠেছিলেন কিন্তু চান্স পেলেন না। উলটোদিকের পাঁচ আঙুল দাঁড়িয়ে উঠে থামিয়ে দিল। চার আঙুল জটলা করে তর্জনীকে মুখপাত্র নির্বাচিত করে বাবু হয়ে বসল।

ডিভোর্স কেন বাড়ছে সে বিষয়ে এখন সময় ওঁর মতামত শোনার। বাকিদের চুপ করে বসার।

শুনুন। সেলিব্রিটি নড়েচড়ে, গলা ঝেড়ে রেডি হলেন এবং নিজের কণ্ঠস্বরের প্রেমে ভেসে গেলেন।

আমাদের সোসাইটিতে আগে ডিভোর্স ছিল না। এখন আছে। কারণ? কারণ সমাজের, বা বলা উচিত সংসারের, ডায়নামিক্স বদলে গেছে। প্রাইমারিলি, মেয়েরা অনেকটা স্বাধীনতা পেয়েছে (অফ কোর্স, উনি মানেন অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল), তাদের ভয়েস হয়েছে (উনি কিন্তু একবারও বলছেন না যে না হলেই ভালো হত), কিন্তু এর ফলে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে যে কেউ আর কারও কথা শুনছে না (উঁহু, কথা শোনার জায়গায় মেয়েদেরই থাকতে হবে তেমন একইঞ্চি দাবিও ওঁর নেই) সকলেই জানত যে একজন ভেতরে থাকবে আরেকজন বাইরে সামলাবে (কার কোন অবস্থানে থাকা উচিত সে নিয়েও নেই বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা) এবং সে নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে চলবে না।

তবে রাষ্ট্রই বলুন, রাজ্যই বলুন, সংসারই বলুন, শান্তিরক্ষার জন্য কাউকে একটু বেশি ছাড়তেই হয় (নিশ্চয়, কেউ দাবি করেনি যে ছেলেরা ছাড়ার জায়গাটায় থাকতে পারবে না), একপক্ষকে অন্যপক্ষের কথা শুনতে হয় (বালাই ষাট, মেয়েরা একা শুনবে কেন, অন্তত উনি তেমন হিন্ট দিচ্ছেন না), সেটাই জগতের, আচ্ছা জগতের যদি ছেড়েও দিই, আমাদের সোসাইটির ট্র্যাডিশন (না না,  ট্র্যাডিশন মানেই ভালো কেউ বলছে না), কিন্তু ফ্যাক্ট অফ দা ম্যাটার হল যে মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে, কারও কথা শুনছে না, সহ্যশক্তি ইত্যাদি ভালো ভালো গুণাবলির চর্চা করছে না, জমি ছেড়ে দেওয়ার ঔদার্য দেখাচ্ছে না, মুখে মুখে চোপা করছে, বিয়ে করে ডিভোর্স দিচ্ছে, এত পুরুষকার খরচ করে কেনা ফ্ল্যাটের অর্ধেক দাম চাইছে প্লাস জীবনভরের খোরপোষ, যার ফলে সেলিব্রিটির বিয়ে করা হচ্ছে না, চ্যানেলের টি আর পি হুড়হুড়িয়ে নামছে।

ফুরফুরে অনুষ্ঠান মুহ্যমান হয়ে গেল। ক্যামেরাধারক এতক্ষণ চনমন ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছিলেন, বাথরুমও বাদ রাখেননি, এখন ক্যামেরা ঘাড় থেকে নামিয়ে চুপটি করে বসে পড়লেন। নেপথ্যবাজনা ঝালা থেকে আলাপে পর্যবসিত হল। খুন না, রাহাজানি না, রেপ না, দুর্নীতি না, চারশো বিশ না, লিঞ্চিং না, পথদুর্ঘটনা না, গ্লোবাল ওয়ার্মিং না। জগতের মারাত্মকতম অভিশাপ, ধারালোতম খাঁড়া -  ডিভোর্স - মানবসভ্যতার, অন্তত আমাদের সোসাইটির, মাথার ওপর অট্টহাস্য সহযোগে নাচতে লাগল।

একেক সময় মনে হয় বিয়ে না করেই যদি ডিভোর্স দেওয়ার (খোরপোষ চাইব না, ভয় নেই) প্রচলন থাকত, কিছু কিছু লোককে আমি দিতাম ডিভোর্স। আপনাকে বিয়ে যে করছি না, বিয়ে করার সম্ভাবনার পুলেও রাখছি না, আপনার পাঁচ মাইলের মধ্যে পাঁচ সেকেন্ড কাটানোর রিস্কও নিচ্ছি না, শুধু সেই সত্যিটা গলা খুলে জানিয়ে দেওয়ার জন্য।

পাঠানো গেলে এই মহিলা, ওই পুরুষ, দুজনকেই পাঠাতাম আমি। ডিভোর্স পেপার।

কোথায় ছিলাম? রাইট, রান্নাঘরে। বাঁ হাতে ঢাকনা, চোখ কড়াইভর্তি ক্রাইম সিনে।

প্রথম কেসে ঢাকনা নামিয়ে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতাম, একশো থেকে এক গুনতাম, চন্দ্রবিন্দু থেকে ক, মারি বিস্কুটের অর্ধেক বয়াম সাবাড় করে ফেলতাম, তারপর পাশের বয়ামে চোখ পড়ত, যা কিনা চানাচুরের এবং যা কি না অর্চিষ্মান বাড়ি এসেই খোঁজ নেবে আছে কি না, থাকলে চায়ের সঙ্গে মুড়ি দিয়ে খাওয়া যায় বেশ। আজ তো নেবেই গ্যারান্টি কারণ আজ আমি চানাচুর শেষ করে রাখব। তারপর ভাবতাম, ফোন করে বলি, যদিও কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু যদি সিঙাড়া খেতে ইচ্ছে করে চায়ের সঙ্গে, যদি বাজার হয়ে আসো, যদি সৌরভ স্টোর্সের পাশ দিয়ে পাস কর, তাহলে এক প্যাকেট…

সব চানাচুর খেয়ে ফেলেছ! কালই তো কেনা হল!

বলে বাজার ঘুরে সিঙাড়া, চানাচুর এবং বুদ্ধি করে ইনোও নিয়ে ফিরত।

আর যদি দ্বিতীয় ভিডিওটা দেখতাম, পাঁচ সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থাকতাম, তারপর কড়াইশুদ্ধু আছড়ে ফেলতাম, সারা রান্নাঘরে ম্যাগি ছিটকে পড়ত, ঘরে ফিরে কিং সাইজ বিছানার এককোণে গুটিশুটি শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকতাম, মা গো, কোথায় গেলে মা, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা ফেলে, যেখানে কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ বোঝে না, কিছুই তো চাইনি, শুধু একটুখানি ম্যাগি…

চানাচুর বেঁচে যেত। কাজ বাড়ত অবশ্য। হাহাকার থামিয়ে উঠে রান্নাঘর ম্যাগিমুক্ত করে গোটা এপিসোডের প্রমাণ লোপাট করতে হত। পরে কখনও রান্নাঘরে চা করতে ঢুকে সুইচ মেরে, স্টার্টার ঘুরিয়ে টিউবের দপদপানি থামাতে গিয়ে টিউবের গায়ে লেগে থাকা ন্যাতানো ক্যাপসিকামের টুকরো আবিষ্কার করে অর্চিষ্মান খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে থাকত, তারপর স্থির করত, জীবনের কিছু কিছু রহস্যের সমাধান না হলেও ক্ষতি নেই।

এতসব ভাবতে ভাবতে, আমারও রাতটা ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ার মতো হয়ে গেল। যে সব রাতে স্ট্রাগলের গরিমা হেলায় পায়ে ঠেলা যায়, নিশ্চেষ্ট আরাম হয়ে ওঠে ওয়ার্ড অফ দ্য নাইট।

পোস্ট পাবলিশ করেই রওনা দেব রান্নাঘরের দিকে। ফ্রিজে গাজর, বাঁধাকপি, বিন, ক্যাপসিকাম, প্যান্ট্রিতে সয়াসস, চিলি গারলিক অয়েল থাকা সত্ত্বেও দৃকপাত করব না, জল ফুটিয়ে, ম্যাগি ঢেলে, টেস্টমেকার গুলে খেল খতম করব। কারণ ও সব করেও সুবিধে কিছু হবে না। ম্যাগি দু’মিনিট (ওকে, সাড়ে তিন মিনিট) জলে ফুটিয়ে নামালেও যেমন খেতে হবে, গ্রাস ফেড চিকেন, ফ্রি রেঞ্জ ডিম মিশিয়ে,  সবশেষে অরগ্যানিক ট্রুফল অয়েল ছেটালেও অবিকল একই রকম খেতে থাকবে।

ম্যাগির মতো।

পরের উপকারের জন্য বিন্দুমাত্র গতর নাড়ায় না যেমন, নিজের উন্নতিসাধনের নিমিত্তে হিতৈষীদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ম্যাগি একই নির্মমতায় বানচাল করে।

ম্যাগি মানুষ হলে আমি বিয়ে করে ফেলতাম। এবং মরে গেলেও ডিভোর্স দিতাম না।

Comments

  1. Ei to sei Maggi, same team hoye gelam to. Maggi ke ja korbe, Maggi r moton i khete hobe, ekdom thik. Amar meye ra kono rokom pollution pochondo kore na Maggi te. Btw tumi kothay bujchi na, kintu ajkal eikhane Shin Ramen bole korean instant noodles khub popular hoyeche, amar meye ra Maggi baad diye Shin Ramen ar ki shob Buldok na ki seita khache. On the aised, ei celebrity video ki youtube e bangali? amu khub lag e tai jigaichi

    ReplyDelete
    Replies
    1. Onek typo -- * aside, * Ami

      Delete
    2. আপনার মেয়েদের প্রতি আমার ভক্তিশ্রদ্ধা চতুর্গুণ হয়ে গেল, বং মম। আর আপনার পলুউশনের কনসেপ্টটাও চুরি করলাম। ম্যাগিদূষণ, পৃথিবীর সেরা দূষণ। ঝাণ্ডা উড়িয়ে একমত।

      বাঙালি ছাড়া আর কী। তবে এর বেশি কিছু বলছি না প্রকাশ্যে।

      Delete
  2. Eyi dhoron er ekta interview dekhechilam onek agey surf korte korte ... sharakkhon interviewer mohila John Abraham ke khunchiye e chollen ... eyi single bed ta dujoner jonne ki kore enough , keno uni ekta single bed rekhechen etc etc . Khub e oruchikor legechilo amar.
    Ami abar Maggi ektu beshi jole lonka kuchi, dhonepata kuchi diye phutiye ektu lebur rosh ar noon diye besh ekta soupy soupy jhaal jhaal byapar kori ... besh lagey kintu. :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. অরুচিকর তো বটেই। কান ধরে বার করে দেওয়া উচিত বাড়ি থেকে এসব করলে। তাহলে অবশ্য যা তা লিখবে কাগজে, কাজেই মুখ বুজে সহ্য করতে হয় আই গেস।

      আরে তোমার ম্যাগির রেসিপিটা দুর্দান্ত তো। কালকেই ট্রাই করব। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. আপনার পোস্ট এর দ্বিতীয় hero কিন্তু ম্যাগীর সাথে দিব্যি compatible। চানাচুর| ম্যাগীর ওপর চানাচুর ছিল হোস্টেল জীবনের masterchef কে ফেল মারা রেসিপি (?)। চাকরি তে ঢুকলাম, কুলীন হলাম আর কী। ম্যাগির ওপর উঠল কুচোন পিয়াজ আর চিনেবাদাম|

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি যে এত সুন্দর করে বললেন চানাচুর আমার পোস্টের দ্বিতীয় হিরো, সে জন্য আপনাকে ছাদসমান একটা হাই ফাইভ দিতে গিয়ে মাঝপথে থেমে যেতে হল। ম্যাগির সঙ্গে চানাচুর!!!! আমি সরি, কিন্তু এটা অত্যন্ত সন্দেহজনক কম্বিনেশন ঠেকছে আমার। প্রায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মতো সন্দেহজনক। নিষিদ্ধ বলেই ট্রাই করে দেখারও অদম্য কৌতূহল জাগছে, যদিও কথা দিতে পারছি না। তার থেকে বরং পেঁয়াজ আর চিনেবাদামটা কম ব্লাসফেমাস।

      বসে বসে হাই তুলছিলাম, আপনার মন্তব্য সব ঘুম উড়িয়ে দিল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. সিনেমা দেখতে গেলে ইউটিউবে বা ott প্ল্যাটফর্ম গুলো আছে , যেটুকু বা খবর দেখার জন্য টিভি চালাতাম , সেটাও বন্ধ হওয়ার জোগাড় । সাংবাদিকতার নামে তো প্রহসন লাগে । একটাই লক্ষ্য সবার - TRP .

    আর চানাচুরও কিন্তু একরকমের টেস্টমেকার , মুড়ি হোক বা পান্তাভাত ! আবার শুধু মুখেও দিব্যি চলে । এই শীতে পান্তাভাত থাক , বরং নলেন গুড়ে কন্সেন্ট্রেট করা যাক ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তাই ভালো, হংসরাজ। টিভি দেখা, বলা ভালো খবর দেখা, সে যে কোনও ফর্মে, বন্ধ করেছি অনেকদিন। যেটুকু কানে এসে যায়, সেটুকু।

      Delete
  5. Acha sikkim er dike pahare je maggir songe kacha peyaj, tometo ar lonka kuchi dey bhaloi lage , Nathang Valley ar Aritar er dike ekta gram er barite kore diyechilo, darun chilo, jodio janina oi thanday pahare bole bhalo lage kina. Paharer gram e simple ruti torkari o ki bhalo lage.. haha..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওগুলো ব্যতিক্রম, ঊর্মি। এবং তুই যা বললি, পাহাড়, বেড়াতে যাওয়া, ঠাণ্ডা --সবের মিলিত এফেক্ট। বাড়িতে আমি ম্যাগি খাই আলসেমি করব বলে, তখন পেঁয়াজ কুচোতে বসার থেকে অদ্ভুত কিছু হবে না।

      Delete
  6. বিয়ে না করেই ডিভোর্স করতে পাড়ার বেপারটা বেশ বলেছেন।

    বিয়ে / ডিভোর্স অতি গোলমেলে বেপার। ইদানিং মনে হচ্ছে যে এরম কেন নয় - যে সব বিয়ে ৩ বছর পর অটোমেটিক ল্যাপ্স করবে (ছেলে / মেয়ে না থাকলে। যদি থাকে তাহলে কি হবে এখনো ভেবে দেখিনি), তারপর বিবাহিত থাকতে চাইলে, বাধ্যতামূলক ১ মাস আলাদা থাকার পর আবার রিনিউ (বিয়ে) করে নিতে হবে (এটা হতে থাকবে প্রত্যেক ৩ বছর পর পর)।

    আর ম্যাগি আমার ভারী প্রিয়। এবং প্রচন্ড কাজের জিনিস। ট্রেক (এক জেনারেশন আগে দু-তিনটে ট্রেক করেছিলাম) করতে নেওয়া খাবারের মধ্যে ওটা থাকতো। মনে আছে আমার, একবার ট্রেকে গিয়ে বরফ ঠান্ডা পরিবেশের মধ্যে ম্যাগি খেয়ে, একজন ঘোর অ্যান্টি-ম্যাগি সঙ্গীও মন্তব্ব্য করেছিল যে বাড়িতে ম্যাগিতে কত অরুচি, আর সেখানে কি দারুন তৃপ্তিতে খাচ্ছে !

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যান্টি ম্যাগি লোককে আপনার সঙ্গী হতে অ্যালাউ করলেন কী করে? যাই হোক, সে যখন পাহাড়ি ম্যাগির মহিমা অন্তত স্বীকার করেছে, ক্ষমা করে ভালোই করেছেন।

      বিয়ের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং বলেছেন। খুঁটিনাটি ট্রায়াল অ্যান্ড এরর-এ ঠিক করতে হবে কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, বরবউয়ের হাতে ব্যাপারটা ডিল করার জন্য ছেড়ে রাখলে হবে না, তাহলে মাটি হতে বাধ্য। একটা বাঁধাবাঁধি কিছু থাকতে হবে, এক্সটারনাল।

      Delete
  7. খোরপোশ,ডিভোর্স এর মতো এত জটিল দিকে যাচ্ছি না আপাতত, সদ্য স্পাইস জেটের জন্য আড়াইগুন টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সব জটিলতার কারন সভ্যতা বলে মেনে নিয়েছি কিনা!
    চানাচুর আহা, চানাচুরের কতরকম ভাব। টকঝালমিষ্টি, আবার মিষ্টিও না ঝালও না কম পাপড়ি ওইটা। ম্যাগি আমি অবশ্য গাজর ইত্যাদি কুচিয়ে দিয়ে থাকি। দিব্যি লাগে। আহা একই সাইজ হবারও দরকার নেই, জলে ফুটতে দিয়ে ইউটিউব ঘাঁটো, নিজের মনে সেদ্ধ হবে বাকিটা তো সেই সাড়ে তিন মিনিট।
    আর হ্যাঁ ওই ক্যাপ্সিকাম কেন আছে তা টিউবের গায়ে ওইটা জেনেও কিচ্ছু না বলার মতো লোক বা মহিলা মেলে না বলেই এদের এত এরকম ইন্টারভিউ নিতে বা দিতে হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা ঠিকই বলেছ, প্রদীপ্ত। প্রশ্ন না করা-র সুঅভ্যেসটা যোগ্য দর পায় না আমাদের জীবনে।

      Delete

Post a Comment