নতুন টিভি
মাসতিনেক আগে স্ক্রিনের মাঝখান দিয়ে প্রথম সরলরেখাটা আবিষ্কারের সময় থেকেই মন শক্ত করেছিলাম। একমাসের মধ্যে দুটো, পনেরো দিনের মধ্যে আরও তিনটে, পরের ঠিক তেরোদিনের মাথায় সহস্র সরলরেখার বাণে আমার একযুগ পুরোনো টিভি চিরতরে অন্ধ হল।
আজকাল কেউ টিভি দেখে না। দেখবে কী করে, কারও বাড়িতে টিভিই নেই। ও রিপু সকলেই জয় করে ফেলেছে, আমি ছাড়া। টিভি ছাড়া জীবন আমার কল্পনার বাইরে। টিভি দেখি মানে ঠিক "টিভি" দেখি না, কারণ কেব্ল কানেকশন নেই যা কোনও মহৎ ভার্চুর সিগন্যালিং নয়। প্ল্যান রিনিউ করতে ভুলে যাওয়ার ভাইসের পরিণাম। তাতে একটাই অসুবিধে হয়েছে, নাপতোল দেখা যাচ্ছে না। আর নাপতোল ছাড়া টিভিতে কি সত্যিই কিছু দেখার থাকে?
ওয়েল, জ্যোতিষ আর রূপচর্চাও থাকে।
মনে থাকলে রিনিউ করিয়ে নেব'খন। তা বলে আমার টিভি অকেজো নয়। ক্রোমকাস্টের পুঁচকে যন্ত্রটা গুঁজে রেখেছি - ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই - হইহই করে বাজতে থাকে। সকাল থেকে রাত। ঝালাপালা হলে ঘরের আলো নিভিয়ে মিউটেড নীল আভায় শুয়ে থাকি। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সানডে সাসপেন্স চালাই। ল্যাপটপের থেকে টিভির কণ্ঠস্বর বেটার। টিভি আমার রেডিওর কাজও করে।
টিভিটা মা কিনিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। দিল্লি ফিরেছিলাম সদ্য। প্রথম ভাড়াবাড়ি। সব গুছিয়েটুছিয়ে ফিরে যাওয়ার আগেরদিন বিকেলে শাড়ি বদলে বলেছিলেন, একটা টিভির দোকানে চল তো সোনা। চোখ কপালে তুলেছিলাম। টিভি? কারা দেখে?
তুই চোখ টিপে বন্ধ করে থাকিস, আমি যখন আসব, দেখব।
মিথ্যে কথা। কারণ মা টিভি দেখতেন না। বুনিয়াদ, হামলোগ, বিশ্বকাপ, বাংলা সিনেমা, চিত্রহার, চিচিংফাঁক কিচ্ছু না। সময় ছিল না টিল না নয়। বাকিরা এত বেশি টিভি দেখত যে প্রতিবাদস্বরূপ মা টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। টিভি দেখতে গিয়ে বাকিরা যে সব কাজ ফেলে রাখত প্রতিবাদস্বরূপ মা সেই কাজগুলো সব করে দিতেন।
মায়ের টিভি না দেখার দ্বিতীয় কারণ আপনি আচরি ধর্ম ইত্যাদি। লিড বাই এক্স্যামপল্ প্রভৃতি। আমার তবু রামায়ণ মহাভারত দেখার অনুমতি ছিল, ও জিনিস থেকে বঞ্চিত করা চাইল্ড অ্যাবিউজ গণ্য হত, মা সেগুলোও দেখতেন না। না দেখতে দেখতে মায়ের সিস্টেম থেকে টিভি দেখা বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে যখন প্রতিবাদের লক্ষ্যেরা অধিকাংশই গো ওয়েন্ট গন, কারও চরিত্রগঠনের দায়ও নেই, তখনও মা টিভি দেখতে বসে উশখুশ করতেন। রান্নাঘরে গিয়ে এটা টানতেন ওটা টানতেন, কাগজ পড়তেন, কিছু না পেলে শোওয়ার ঘরের খাটে বসে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে পা নাচাতেও দেখেছি।
সেই মা, কোনও আপত্তি না শুনে, একখানা টিভি মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে চলে গেলেন। বারো বছর ধরে যে টিভি মেয়েকে সঙ্গ দিল।
অনলাইন কেনা যেত, তবু দোকানে গেলাম। দিল্লির ইদানীংকার রোদ্দুর যতটুকু পারা যায় গায়ে মাখার আশায়। টিভির ব্র্যান্ড এবং বাজেট জানতাম। আর কিছু জানতাম না, জানার চেষ্টাও করিনি। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা ইত্যাদি বলে অনেকে, আমিও ভদ্রতার খাতিরে ঘাড় নাড়ি, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে জিনিসপত্র কেনার আগে রিসার্চের পেছনে করা সময়ের সিংহভাগ সম্পূর্ণ ফেলা গেছে। টোটাল ওয়েস্ট। হিটার থেকে গিজার, টিভি থেকে কফি পারকোলেটর, যোগা ম্যাট থেকে লাফদড়ি রিসার্চের পেছনে যে পরিমাণ সময় আমি নষ্ট করেছি, কোনও ক্ষমা হয় না। আর যে ক'টা দিন হাতে আছে তার মধ্যে একঘণ্টাও টিভি রিসার্চে দেওয়া মানে অপচয়।
দোকানে গিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হল। যদিও প্রত্যাশিত হওয়াই উচিত ছিল। সান্ধ্য পায়চারি করতে করতে পড়শিদের বাড়ির জানালা দিয়ে দেওয়ালে টাঙানো টিভি চলতে দেখেছি। দেখেছি মানে চোখ চলে গেছে। ইউটিউবে কিছু ভ্লগারদের বাড়ির টিভিও দেখেছি। লোকে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে পরিমাণ চর্চা করে, আমাদের সময় পাঁচটাকায় পনেরোটা ফুচকা পাওয়া যেত জাতীয়, টিভির সাইজের বৃদ্ধি নিয়ে কারও মধ্যে কোনও হেলদোল দেখি না।
দোকানে টাঙানো টিভিগুলোর আয়তনের সঙ্গে তুলনা কেবল আমার খাটের চলতে পারে। একটা ঘরের দ্বিতীয় বৃহত্তম জিনিস যদি টিভি হয়, বা একটা বাড়িতে ঢুকে যদি সব কিছু ছাপিয়ে টিভি চোখে পড়ে তাহলে আমার মতে বিপদ। আমি যত বলি আপনাদের দোকানে সবথেকে ছোট টিভি কী আছে বার করুন, ভদ্রলোক কেবলই বলেন, আরে ম্যাডাম, বিগার ইজ বেটার। এ যুদ্ধে হারব না ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমার বিচারে অ্যাকসেপ্টেবল সাইজের টিভি কিনে বাড়ি এলাম।
সেটাও আমার আগের টিভির থেকে বড়ই। আগের টিভির সঙ্গে এর আরও একটা অমিল হচ্ছে, আগেরটা আনস্মার্ট ছিল, এটা স্মার্ট। উনিশশো সালে লোকজনকে যখন কল্পনা করতে বলা হয়েছিল দু'হাজার সালে পৃথিবীটা কেমন হবে, একটা কমন কল্পনা ছিল ওড়া। মানে প্লেনে করে ওড়া নয়, এমনি এমনি ওড়া। বিরাট বিরাট গাউনপরা মহিলা, দুটো ডানার মতো কীসব কাঁধে সেঁটে প্রসন্ন মুখে উড়ে বেড়াচ্ছেন। উনিশশো সালে লোকে গাধা ছিল। আমিও ক্বচিৎকদাচিৎ নিজের ছাড়া দুনিয়ার ভবিষ্যৎ ভাবার চেষ্টা করি যখন, ভাবি আর কী কী প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্ভব, কল্পনা কেবল যোগাযোগের লাইনে ধায়। চিঠি হয়ে ল্যান্ডফোন হয়ে মোবাইল হয়ে ভিডিও কলের ক্রমোন্নতির পদাঙ্ক অনুসরণ করে মনে হয় একুশশো সালে লোকে ফোনের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে উল্টো দিকের লোকটাকে ছুঁয়ে দিতে পারবে। যদিও আমি শিওর এরকম কিছুই হবে না। তার থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনা ঘরের একটা দিকের দেওয়াল পুরো টিভি হয়ে যাওয়ার।
যদিও এতক্ষণ অন্যরকম গাইছিলেন, টিভি ফাইন্যালাইজ করে ফেলা মাত্র নাফিসজীর ভঙ্গিটা হয়ে গেল যে পৃথিবীর বেস্ট টিভিটাই আমি বেছেছি, উনিও গোড়া থেকেই এই টিভিটাই মনে মনে আমার জন্য বেছে রেখেছিলেন খালি দেখছিলেন আমি কী করি। গড়গড়িয়ে বলতে লাগলেন, হার্ডওয়্যার ইন্টারফেস আপকো ইউ এস বি, এইচ ডি এম আই অর কমপোজিট ভিডিও মিল যায়েগি, ব্লু টুথ প্রোফাইল সাপোর্ট . . . বললাম, কোন বোতামটা টিপে অন করতে হবে আর চ্যানেল খুঁজতে হবে যদি একটু দেখিয়ে দেন। ভলিউমেরটাও।
হয়ে গেল টিভি কেনা। আমি বাড়ি এলাম। ঘণ্টাখানেক পর টিভি এল। পরদিন সার্ভিস ডেমো দিতে লোক এলেন। বললেন, ভয়েস অ্যাকটিভেট কর লিজিয়ে। বললাম, না না দরকার নেই, কিন্তু ততক্ষণে উনি অ্যাকটিভেশন শুরু করে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক বিদায় নেওয়ার পর খানিকক্ষণ চেপেচুপে ছিলাম, তারপর রিমোট মুখের কাছে মাইকের মতো ধরে (যা আমি জানি অদরকারি, রিষড়ার বাড়িতে প্রথম রিমোটওয়ালা টিভি আসার পর বাড়ির লোকেদের হাত বাড়িয়ে টিভির যথাসম্ভব কাছে নিয়ে গিয়ে রিমোটের বোতাম টেপার মতোই) নির্দেশ দেওয়া শুরু করলাম। সেদিন সারাদিন আমার ঘরের পাশ দিয়ে যারাই গেল নির্ঘাত ক্ষণে ক্ষণে আমার চিৎকার শুনল। "পোয়্যারো ফুল এপিসোডস ইংলিশ", "শার্লক হোমস পিটার কুশিং", "বলিউড ওয়াইভ্স্", "লে পাগলু ডান্স"। টিভির মহিলাও নিমেষে আমার পছন্দসই প্রোগ্রামদের খুঁজে এনে ঘোষণা করতে লাগলেন। দুজনের মধ্যে একটি প্রফুল্ল আত্মীয়তার স্থাপনা হল। দিন ফুরোল। ঘরের আলো নিভিয়ে লেপের তলায় ঢুকে রিমোটমাইকে উচ্চারণ করলাম, "সানডে সাসপেন্স"। সেকেন্ডকয়েকের নীরবতা পেরিয়ে মহিলার ওভারঅ্যাচিভার কণ্ঠ ভেসে এল।
"ফালুডা, শামাডারারা শাবি।"
সেই থেকে, স্মার্ট আনস্মার্ট যে কোনও টিভির সঙ্গেই একমাত্র যে ট্রিটমেন্ট প্রযোজ্য, সেই সাইলেন্ট ট্রিটমেন্টে ফিরে গেছি।
এবাবা, এতো এক্কেবারে আমাদের গল্প।
ReplyDeleteক্রোমকাস্টের পুঁচকে রিমোটে ইংরেজিটাও অ্যাকসেন্ট মতো না বলতে পারলে নিজের মতো উল্টোপাল্টা বুঝে নেয়।
আর দেশী ভাষা তো একেবারেই বোঝেনা।
মনে হচ্ছে, ঘরে বিদেশী পেয়িং গেস্ট পুষে রেখেছি, অথচ ভাড়াটাও পাচ্ছিনা।
বিচ্ছিরি ব্যাপার।
এইটা চমৎকার মেটাফর, বৈজয়ন্তী।
DeleteTinni : :) etate mone holo amader TV ta akhon antique furniture hoye geche ! subidhe holo loke ghore dhuke agochalo bari dekhena, TV r dike haan kore takiye thake .
ReplyDeleteঅ্যান্টিক এবং আধুনিক, দুই টিভিরই সেম উপযোগিতা, ঠিকই বলেছিস। মনোযোগের টুঁটি টিপে ধরা।
Deleteহাহা, ঘরের একটা দেয়াল টিভি হয়ে যাবার সম্ভবনাটা দারুন বলেছেন, এবং হয়ে যেতেও পারে।
ReplyDeleteতবে বিশাল স্ক্রিনে সিনেমার এফেক্ট দেখার ইচ্ছে আমার আছে। বহু ভালো ভালো সিনেমা বড় স্ক্রিনে দেখার ইমমের্সিভ এক্সপেরিয়েন্সটা অন্যরকম হবে। কিন্তু অত বড় ফাঁকা দেয়াল নেই, এবং অত বাজেটও নেই বলে ঠিক করে রেখেছি প্রজেক্টর কিনবো একদিন। এখনো কেনা হয়ে ওঠেনি।
সেটা আমি মানি, রাজর্ষি। হলে সিনেমা দেখা ওইজন্য অত ভালোলাগার। টিভিগুলো তো হলের মতোও নয়, তাই ওই পয়েন্টটা মাথায় আসেনি। বিদেশে অনেকের বাড়িতে হোম থিয়েটার থাকে শুনেছি, তাতে হয়তো ওই ফিলিংটা আসে।
Deleteফারেনহাইট ৪৫১-এ, আমার যতদূর মনে পড়ছে, একটা নয়, ঘরের ছাড়তে দেওয়াল-ই টিভি হয়ে যাওয়ার কথা লেখা আছে। আর ওই "কল পুলআমি" বলতে বিরক্ত লাগে বলেই গুগল-এ ভয়েস ব্যবহার করে গিন্নিকে পর্যন্ত ফোন করিনা। বড়জোর সকাল বিকেল ওয়েদার টা জানতে চাই।
ReplyDelete😄আপনি ফোনের সঙ্গেও সাহস করে কথা বলেন জেনে ইম্প্রেসড। ফারেনহাইটের ভবিষ্যদ্বাণীটা ফলবে মনে হচ্ছে।
Deleteটিভির মায়া বহুদিন কাটিয়েছি। তবে মা মাসিদের টিভি না হলে যে কী হবে, সেটাও ভাবার কথা! ও জিনিসটাকে নিয়ে আগে একটু আধটু নস্টালজিয়া ছিল, আজকাল একদম ঘুচে গেছে। বিশেষ করে যখন কেউ টিভিতে নিউজ চ্যানেল লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করে, আমি প্রথমে করুণার চোখে তাকাই, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পালানোর পথ খুঁজতে থাকি।
ReplyDeleteহ্যাঁ, খবর জিনিসটা আর দেখা, শোনা, বোঝা, কিছুই যায় না, সুদীপ। একমত।
Deleteএই কথা বলাটার চক্রে পড়োনি জেনে অভিনন্দন। এবার টুক করে মাইক্রোফোনের অ্যাক্সেসটা অফ করে দিও। জানি আমাদের চুরি করার মতো কিছু নেই, নিজেরাই ব্লগ ফেসবুকে সব কিছু বলি কিন্তু সেটা আমার চয়েস। এই অ্যাপগুলো তাদের চয়েসে আমাদের কথা শোনে, বিক্রিবাটা করে। অন্যের চয়েসের বিকোতে ভাল্লাগেনা বলে আমি যেগুলো না দিলেই নয় তা বাদে সবার মাইক্রোফোনের অ্যাক্সেস কেড়ে নিয়েছি।
ReplyDelete- প্রদীপ্ত
ওরে বাবা, তাই নাকি? তাহলে তো কথা না বলে ভালোই হয়েছে, প্রদীপ্ত।
Delete