দোস্তজী


নেহরু প্লেসে শনিরবি বিকেলের শো-তে চলছিল 'দোস্তজী'। খ্যাতি কানে এসেছিল, গেলাম।

হল থেকে বেরিয়ে দোসার দোকান পর্যন্ত হেঁটে এসে, খেতে খেতে ভাবলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেসুরো চিৎকারের মাঝে আচমকা একটা সুরেলা গান শুনতে পাওয়ার স্বর্গানুভূতি কি গানটার গুণ নাকি চিৎকারগুলোর দোষ? 'দোস্তজী' দেখার ভালোলাগাটা কি 'দোস্তজী'-র কৃতিত্ব? নাকি অন্য ভাষার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এই রকমের সিনেমা হরেদরে? যা আমাদের বসে-দেখা-যায়-না, পাতে-দেওয়া-যায়-না র পাঁকে পঙ্কজ প্রতিভাত হচ্ছে? 

বাবরি মসজিদ ভাঙার ছ’মাস কেটেছে। মুর্শিদাবাদের গ্রামে টেনশন বুড়বুড়ি কাটছে। একটি মসজিদের খুনের বদলা আরেকটি মসজিদের জন্ম। আরেকটি মসজিদের জন্মের বদলা কলকাতা থেকে দল এনে রামরাবণের যাত্রাপালা। এর মধ্যে ক্লাস থ্রি-তে পড়া দুটি বালক, শফিকুল আর পলাশ, ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে, বচ্চনের কায়দায় দাঁড়ানো নিয়ে, টকটকি বাজানো নিয়ে মশগুল।

'দোস্তজী' ধীর। এবং একটুও বোরিং না। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারদুটো ইনকমপ্যাটিবল, কিন্তু আসলে নয়। একজন বিখ্যাত লেখক টিপস অ্যান্ড ট্রিকস দিতে গিয়ে বলেছিলেন গল্পের যে জায়গাটা বোরিং লাগছে সেই জায়গাটা স্পিড না বাড়িয়ে অ্যাকচুয়ালি "স্লো ইট ডাউন।" প্লটের গলিঘুঁজি দেখাও, চরিত্রের আঁতিপাঁতি মেলো। যাতে যে পাঠক চায়, সে ভেতরে ঢুকতে পারে। প্রথমার্ধ্ব জুড়ে এই আঁতিপাঁতি, গলিঘুঁজি স্থাপনা হয়েছে 'দোস্তজী'-র। পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানুষ, মানুষের ওপর পরিস্থিতির প্রকোপ। পলাশ ও শফিকুলের বন্ধুত্ব। ওই বয়সে বেস্ট ফ্রেন্ড যাদের ছিল, বা থাকার স্মৃতি আছে, তাঁরাই জানেন এ বন্ধুত্বের গভীরতা ও ম্যাজিক।

সময় নিয়ে সেট আপ করার সুবিধে আছে। ঠিক করে করতে পারলে ওই জায়গাটায় দর্শক পৌঁছে যাবে, ওই লোকগুলোর রকমসকমের সঙ্গে পরিচিত হবে। খুব বেশি ঠিক করে পারলে লোকগুলোর ভালোমন্দ সুখদুঃখে দর্শকের আসবে যাবে। ফার্স্ট হাফ শেষ হতে হতে আমরাও শফিকুল পলাশের গ্রামে পৌঁছই, আমরা চাই ওই সিক্ত শ্যামলিমায় মন্দিরমসজিদের বখেড়া খাড়া না হোক, আমরা চাই ওই ভ্যানগাড়ি টানা রোগা একলা ঘোড়াটাকে সারথি বেশি জোরে ছপটি না মারুক, আমরা চাই প্রতিবেশীদের মাঝে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে পলাশের মায়ের ভয় না লাগুক, পলাশরা নদীয়ার দিকে উঠে না যাক, শফিকুলকে পড়া না করার জন্য সবাই অত না ঠেঙাক। সবথেকে বড় কথা, যা হোক, যা খুশি হোক, মসজিদ বসুক, মন্দির গজাক, পলাশ শফিকুলের বন্ধুত্ব যেন না ফুরোয়।

'দোস্তজী' কখনও বিস্মৃত হয় না যে সিনেমাটার ভরকেন্দ্র রাজনৈতিক কমেন্টারি না, সাম্প্রদায়িকতা না, দারিদ্র্য, নারীশিক্ষার অভাব, আরও যা যা ইস্যুতে ছিন্নভিন্ন ওই অঞ্চলের সমাজ, কিছুই না। গল্পের ভরকেন্দ্র দুই বালকের বন্ধুত্ব। দুই বাড়ির মাঝখানে ওঠা পাঁচিলের দু'পাশে দাঁড়িয়ে শফিকুল আর পলাশের "বাই বাই" বলা, গাছের গায়ে হৃদয় এঁকে নাম লেখা, ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে ঝগড়া বাধা এবং মেটা।

দ্বিতীয়ার্ধ প্রায় এক্সক্লুসিভলি মনোযোগ দিয়েছে এই বন্ধুত্বের উদযাপনে। ব্যক্তিগত শোকের খননে। সেই শোক এত সংযত, এত নিঃশব্দ, যে পাথরের মতো বুকে চেপে বসে। প্রথমার্ধে যদি বা কিছু "রূপক" বা সত্য দর্শানোর লোভ থেকে থাকে, যেমন স্থানীয় পাগলার হাততালি দেওয়া, অ্যাজ ইফ, চারপাশের রকমসকম দেখে সে চমৎকৃত, বা যাত্রাপালার অস্থায়ী প্যান্ডেলের পেছনে রাম রাবণ ও সীতার একত্রে ধূমপান এবং পয়েন্ট আউট যে আসলে আমরা একে অপরের শত্রু নই, পেটের দায়ে শত্রু হওয়ার ভান করতে হয় ইত্যাদি, বছরভর রিলিজ করা হোমরাচোমরা "সামাজিক" সিনেমাদের তুলনায় এ স্খলন এত মৃদু যে অগ্রাহ্য করাই যায়।

ফেলুদাব্যোমকেশ দেখতে দেখতে সিনেমায় যে (ওপর)চালাক ডায়লগ ছাড়াও আরও কিছু থাকে দেখারশোনার, ভুলে মেরে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। 'দোস্তজী' চোখে পড়ারও আগে কানে বাজল। স্কুলের শব্দ। বাচ্চাদের শব্দ। বৃষ্টির শব্দ। গাড়ির চাকার শব্দ। টেম্পোর এঞ্জিনের শব্দ। চরকার শব্দ। সকাল দুপুর রাতের শব্দ। অন্ধকারের শব্দ। গ্রামবাংলার শব্দ। আর দৃশ্য। আহা। কী সুন্দর পশ্চিমবাংলার গ্রাম, গ্রামের পুকুর মাঠ জঙ্গল আকাশবাতাস। যারা দেখেছে সবাই বলেছে। আমিও দেখার আশা রাখি কোনওদিন।

একটা সিনেমা কেন ভালো কেন খারাপ বিচারের যোগ্যতা আমার নেই। গল্পের বই হলে তবু চেষ্টা করতে পারি। অন্যান্য আর্ট ফর্মের ক্ষেত্রে গোদা একটা দাঁড়িপাল্লার ওপর ভরসা রাখি। জিনিসটা অভিজ্ঞতা করার সময় কতখানি ডুবে থাকতে পারি, শেষ হয়ে যাওয়ার পর কতক্ষণ তার ঘোর লেগে থাকে। 'দোস্তজী' স্ক্রিনে চলার সময় কেঁদে ভাসিয়েছি। এখন কাঁদছি না, কিন্তু ভুলতেও পারছি না সিনেমাটার কথা। কাজেই, নিক্তি মেপে যদি দোষগুণ দেখাতে নাও পারি, 'দোস্তজী' আমার কাছে বারবার দেখার, ফিরে যাওয়ার।

Comments

  1. ট্রেলারটা বেশ মজা লেগেছিল। মানে বাচ্ছাদের কান্ডকারখানা দেখলে যেমন এক চিলতে হাসি মনে আসে সেরকম। কিন্তু নিজেদের মধ্যে তুমি তুমি করে কথা বলছিল বলে একটু খুঁতখুঁত করছিল। তুমি এত ভালো রিভিউ দিলে, দেখার ইচ্ছে রইল।
    ইয়ে, শেষটা খুব দুঃখের বুঝি?

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্লিজ দেখো, প্রদীপ্ত। তুমি যেকারণগুলো বললে সেগুলো উড়ে যাবে বলেই আমার ধারণা। তোমার আমার মতো অত ভালো নাও লাগতে পারে রিস্ক নিয়েই জোর করছি। পাশে যদি দাঁড়াতেই হয়, দোস্তজী-র মতো বাংলা সিনেমার পাশেই দাঁড়ানো উচিত।

      শেষ, শুরু ও রকম কিছু না গো। পুরোটা যে দুঃখের তাও না। তুমি যে বললে, চিলতে হাসির সুযোগও প্রচুর। দুঃখ, হাসি মিলিয়ে গোটা ব্যাপারটা ভীষণ মায়া। আর অত মায়া দেখলে আমার কান্না পেয়ে যায়, সেই জন্য আরকি।

      Delete
  2. Khub khub bhalo laglo review poRe.. sujog pele dekhar icche thaklo.. sunaam aamio khubi shunechi..

    aar ei cinemar doulote taratari aarekta post o pawa gelo.. thank you :)

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😀পোস্টের বর্ধিত গতি নোটিস করেছেন, ইন্দ্রাণী। দেখা যাক কদ্দিন পিক আপ থাকে। সিনেমাটা যাকে বলে একঘর। চান্স পেলেই দেখে ফেলুন।

      Delete
  3. Ami ar RAka dekhechhi. Amar khub bhalo legechhe Dostoji. Sesh hoyar poreo kichhukkhon bose chhilam hall e. Oi pakhir daak ta ki aschorjo na?

    Raka apnar motoi knedechhe. Ei cinema nijer bhitortake chiniye dey je...

    ReplyDelete
    Replies
    1. রাকাকে হাই ফাইভ, সায়ন। ওই বাগানের দৃশ্যটা, সিরিয়াসলি। আরও অনেক দৃশ্যের মতোই।

      Delete
  4. Ki sundor likhechho Kuntala di. Ebar dekhtei hochche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দৌড়ে গিয়ে দেখে ফেলো, বিম্ববতী।

      Delete
  5. ওরেব্বাস - কি দারুন রিভিউ লিখেছেন!! এবার তো না দেখলেই নয় ...!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. নির্দ্বিধায় দেখে ফেলুন, দেরি করবেন না।

      Delete
  6. Dekhbo bole icche korei review porini, aj dekha holo.. review ta ki bhalo likhecho.. director er eksomoyer bondhu abar amar ghorei thake :), ekhon jogajog kom kintu sune khub icche chilo dekhar.. Opekkha sarthok, Emonbhabe bondhutwer golpo bola .. boddo bhalo feeling holo

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী ভালো না সিনেমাটা?

      Delete
  7. দোস্তজি দেখার ইচ্ছে ছিল দেশে থাকতে কিন্তু হয়ে ওঠেনি| রিভিউ পড়ে মনে হচ্ছে দেখতে হবে কিন্তু এখন কোথায় দেখবো| কমেন্টে যে মায়া দেখলে কান্নার কথা বললে আমার ঠিক তাই হয়, মেরি পপিন্স দেখেও শেষের দিকে কাঁদতে হবেই| কলকাতায় সিঙ্গেল স্ক্রিনে বল্লভপুরের রূপকথা দেখলাম. খুব ভালো লাগলো, এত মজার| আর প্লেনে দেখলাম বরুণবাবুর বন্ধু, ভীষণ ভালো লাগলো|

    ReplyDelete
    Replies
    1. দোস্তজী মাথায় রাখবেন, সুযোগ মতো দেখে নেবেন, অমিতা। সত্যিই ভালো।

      Delete

Post a Comment