খাটুশ্যামজীর ঠেলা


শনিবার সকালে উঠে মনে হয় ভালো কিছু করি। ভালো কিছু দেখি, শুনি, খাই। ভালো খাওয়ার সংজ্ঞা বাকি সমস্ত ভালো জিনিসের মতোই পরিবর্তনশীল। একদিন যা আমোর বিস্ত্রোর নিভুনিভু আলোয় পাঁচশো টাকার পাস্তা, অন্যদিন তা মাইসোর ক্যাফের ফ্যাটফেটে টিউবলাইটে খটখটে টেবিলচেয়ারে কুড়ি টাকার ফিল্টার কফি, দশ টাকার পানিয়ারম।

গত তেসরা সকালে সেটা হয়ে গেল খাটুশ্যামজীর ঠেলার পুরিসবজি। মেলাগ্রাউন্ডের গেটের সামনে ঠেলা, ঠেলা ঘিরে দুইচার, দিনের সময় বুঝে চারপাঁচ কি আরও বেশি লোক, একহাত কোমরে রেখে অন্য হাতে সবজির ঝোলে চুবোনো পুরি তুলে মুখে পোরে। চিবোয়। উদাস মুখে মেলা গ্রাউন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। খেলা হলে খেলা দেখে, না হলে ঘাসওঠা মাঠ। আকাশবাতাস। মুখচোখ দেখে সন্দেহ করার কারণ নেই যে গোটা ব্যাপারটা অখাদ্য লাগছে। আমারও লাগবে না জানি। লাগবেই বা কেন। খাওয়ার আগে রাঁধতে হবে না, খাওয়ার পরে বাসন মাজতে হবে না। আমোর আর মাইসোর ক্যাফের তুলনায় সবথেকে অ্যাডভান্টেজ - চুল না আঁচড়ে, চটি গলিয়ে চলে যাওয়া যাবে। এইটুকু তো রাস্তা, কে আর দেখবে।

তবু খাটুশ্যামজীর ঠেলায় আমার যাওয়া হয় না। আরও কত ভালোলাগা গ্যারান্টি জায়গার মতোই। শনিবার যে হল তার ক্রেডিট বারান্দায় এসে পরা ডিসেম্বর শুরুর রোদ্দুরটার। যে রোদ্দুরে ধুলোধূসরিত, দুর্বিনীত দিল্লি অপ্রতিরোধ্য। বাড়ির জামার ওপর সোয়েটশার্ট চড়িয়ে হাঁটা দিলাম। কে আর দেখছে।

ঠেলার মাথায় বড় বড় করে খাটুশ্যামজীর নাম লেখা থাকলেও প্রোপ্রাইটর কিন্তু খাটুশ্যামজী নন। উনি সাক্ষাৎ শ্যামের অবতার, মূলত রাজস্থানে রাজত্ব করেন, পুরিসবজি জাতীয় পার্থিব ব্যাপারে থাকেন না। যিনি থাকেন, পুরি ভাজেন, হাতায় করে কাগজের বাটিতে সবজি ঢেলে খদ্দেরদের পরিবেশন করেন, তিনি নাকি বিহারের। পুরিসবজিটা বিহারী স্টাইলের না রাজস্থানী ভাবতে ভাবতে মাঠ পেরোলাম। দুই রাজ্যের রান্নাবান্নার প্রতিই আমার শ্রদ্ধা অসীম, যে রকমই হোক না কেন উমদা হবে। যদি দুটোর একটার মতোও না হয়ে ভারতবর্ষের সহস্র রেলস্টেশনের যে কোনও একটার পুরিসবজির মতো হয়, তাহলেও মচৎকার।

খাটুশ্যামজীর ঠেলার তিন নম্বর সুবিধে হল অপশনের অভাব। ছ'পিস পুরি, একবাটি আলুর তরকারি (ফুরোনোর উপক্রম হলে আরও একবাটি) অল্প পেঁয়াজ, মশলামাখানো একটি চেরা কাঁচালংকা এবং আরেকটি আনআইডেন্টিফায়েড আনাজের আচার। ভালো লাগলে খান, না হলে আসুন। যদি খান, খাওয়া অন্তে তিরিশটাকা ক্যাশে কিংবা ফোন পে/গুগল পে/পে টি এম করে দেবেন। কিউ আর কোড সাঁটা বোর্ড আচারের বয়ামের গায়ে ঠেসান দিয়ে আছে।

পুরিসবজি খেতে খেতে খাটুশ্যামজীর ঠেলার শেষতম এবং হয়তো গুরুত্বপূর্ণতম সুবিধে আবিষ্কার করলাম। একা খেতে হয় না। ফাঁকা ঠেলায় গিয়ে দাঁড়ালাম, আমার হক্কের পুরি ভাজা হতে না হতে আরও চারজন ঘিরে দাঁড়ালেন। একজনের মাথায় রুমাল, একজনের কবজিতে বালা, একজন ছয় তিন, একজন পাঁচ দুই, একজন উদ্ধত, একজন নিড়বিড়ে, একজন বাইকে, একজন পদব্রজে। কেউ কারও সঙ্গে আলাপ করার উদ্যোগ দেখাল না, সকলেই মেলা গ্রাউন্ডের দিকে উদাসমুখে তাকিয়ে পুরি চিবোতে লাগল।

যতক্ষণ না হুলোটা আবির্ভূত হল। ফুসফুসের কী দাপট। আকাশবাতাস কাঁপানো সে কী ম্যাও ম্যাও ম্যাও।  আলতো "হেই হ্যাট হুশ"-এর ওর সঙ্গে পেরে ওঠার কথাও ছিল না। হুলো জিতল, সবাই হারল। হারের ট্যাক্স একটি করে পুরি (পাঁচটা পুরি একটা মানুষের একবেলার ক্ষুন্নিবৃত্তির পক্ষে মোর দ্যান এনাফ, হুলোর সঙ্গে আমরা একমত)। কর চুকিয়ে, দাম মিটিয়ে আমরা চলে এলাম। খাটুশ্যামজীর ঠেলা একলা দখল করে, অমলতাসের পাতা গলা রোদ্দুরে বসে হুলো আরাম করে পুরি খেতে লাগল।

Comments

  1. Unidentified anaj :D :D
    Dekhi r maath guli kintu dekhar moto. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. একমত, শর্মিলা। মাঠ, পার্কের বাহার আছে এ শহরে। অনেক ভালোলাগার মধ্যে এটা একটা পয়েন্ট।

      Delete
  2. Daarun laglo.. khub bhalo korechen.. ebaar aamaaro khub puri sabji khete icche korche.. amar baRir lok jan kichutei atar luchi khete chaay na, tai amar aar khub ekta bairer puri sabji khawa hoyna..
    office paRay pawa puri sabji r tulona nei. kintu work from home je..
    jai hok.. bhalo thakben. asha kori dillir winter bhalo kaatbe (maane pollution ta chara)

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আটার লুচি বলতে মনে পড়ল। বাঙালিদের সামনে চট করে স্বীকার করি না, আমি অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ময়দার লুচি খাইনি। বাড়িতে আটা চেলে লুচিপরোটা বানানো হত। আমার বাড়ির লোক অ্যাহেড অফ টাইমস ছিলেন, ময়দাকে সাক্ষাৎ শয়তানের অবতার মনে করতেন (যদিও স্বাস্থ্যবাতিক ছিল না কারণ শিঙাড়া এগরোল ইত্যাদি হুলিয়ে খাওয়া হত, খালি বাড়িতে ময়দার বেলা যত সাবধানতা)। বাইরের লোক এলে ময়দার লুচি হত। নিজেরা খাওয়া হত না, কারণ শরীর খারাপ হলে লোকের হবে, আমাদের না। নিজেদের লুচি আলাদা করে আটার বানানো হত। পুরো ময়দার লুচি আমি খেয়েছি বেশ বড় বয়সে, স্কুলের সেভেন এইট। এখনও মুহূর্তটা মনে আছে। কিছু একটা মহৎ উদ্দেশ্যে মানবশৃঙ্খল রচনার ব্যাপার হয়েছিল, আশেপাশের সমস্ত স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সকাল থেকে ঠা ঠা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুর দুটোর সময় বাক্সে করে খাবার দেওয়া হল, ভেতরে লুচি তরকারি শিঙাড়া আরও যা যা থাকে। সেই প্রথম ময়দার লুচির সঙ্গে দেখা। ঠাণ্ডা, কামড়ে ছেঁড়া যায় না, অন্তত ছত্রিশবার চিবিয়ে শেষমেশ হাল ছেড়ে গিলে ফেলতে হয়।

      পরে প্রপার ময়দার লুচি খেয়েছি, ভালোও লেগেছে। কিন্তু সেই প্রথম শক এখনও ভুলিনি।

      Delete
    2. aamaar atar luchi khub bhalo laage.. amader baRite matro koyekbaar e hoyeche oboshyo. Moydar luchi o bhaloi laage, tobe aapni jeta bollen setao mokkhom sotti..

      bhalo thakben

      Delete
    3. Bairer loker shorir kharap hoe hok - haha
      Amar golpo ta ulto- chotobela theke maida r luchi kheye kheye shoshurbari ( U.P.) te eshe aata r luchi r shock peyechilam - tarpor theke aata te obhosto hoe gechi - maida r luchi bohukaal khaini- ekhon to kore khawanor keu nei - hotel e gie khete hobe 😶

      Delete
    4. হ্যাঁ, সবই কন্ডিশনিং, পরমা।

      Delete
  3. Byapar ta chokher shamne bheshe uthlo.
    Oi achaar aar chera lonkata nishchoi jeta chole baturer thelae deye, shetai?

    Aar hulor shonge torke giye laabh nei, aaj obdhi keu jeteo ni

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইটা একটা সারসত্য মনে করিয়েছ বটে, হুলোর সঙ্গে তর্কে যাওয়ার ফিউটিলিটি। ছোলে ভাটুরের অ্যাকম্পানিমেন্টই বটে, অন্তত কাঁচালংকাটা। সঙ্গের সবজিটা আমি এখনও প্লেস করতে পারছি না। পরদিন লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসাই করে ফেলব।

      Delete
  4. রানীগঞ্জে গেলে আমরাও খুব কচুরি তরকারি খাই। সাথে জিলিপি। ওদের কচুরি গুলো বেশ অন্যরকম আর চমৎকার হয়।
    লেখাটা ভালো হয়েছে বেশ।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ওইদিককার রাস্তার খাবার দুর্দান্ত।

      Delete
  5. আটার লুচি আমার এখনো খাওয়া হয়ে ওঠেনি। যদিও লুচি খাবার আগে কখনো খোঁজ নিইনি যে সেটা আটার না ময়দার, তবুও বাড়িতে ময়দার লুচিই হয় জানি, এবং ছোটবেলা থেকেই ময়দার লুচিই খাচ্ছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আটার লুচি কখনো পেলে নিশ্চয় অন্যরকম লাগতো, এবং বুঝতে পারতম।

    ঠেলার পাশে নানারকম মানুষের সমষ্টির যে কথা লিখেছেন, সুন্দর লাগলো পরে। সত্যি, এরম কিছু কিছু জায়গায়, মানুষের ভেদ বৈচিত্রের মধ্যেও একটা সমতা দেখা দেয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার ধারণা আটার লুচি খুব একটা সুবিধের লাগবে না, রাজর্ষি, ময়দার লুচিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর। রাস্তার খাওয়া ভালো লাগার এইটা একটা বিরাট কারণ আমার মতে। এই গণভোজনের ফিলিংটা।

      Delete

Post a Comment