পুজো ২০১৪/ নবমী দশমী



নবমী

আজ মাসোনার স্বামীসহযোগে পিতৃগৃহে যাওয়ার দিন। তিনি নিজে সাতসকালে উঠে ক্ষান্ত হননি, তাড়া দিয়ে বাড়িশুদ্ধু লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ করছেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির সবাই তাঁকে ছেড়ে আসবেন।

গাড়ি রুবি পেরোতে না পেরোতে উইন্ডস্ক্রিনে বড় বড় জলের ফোঁটা। এখন আমরা যাচ্ছি বেলেঘাটার ফ্ল্যাটে। সেখানে খাওয়াদাওয়া করে বাকি সবাই এদিকে ফিরে আসবেন, অর্চিষ্মান আমি আর আমার মাবাবা চলে যাব রিষড়ায়। গল্প হল, খাওয়াদাওয়া হল, ‘টাটা বাই বাই/ আবার যেন দেখা পাই’ হল, আমরাও রেডি হতে শুরু করলাম। এইবার আমার সত্যিকারের বাপের বাড়ি, এইবার রিষড়া।

বৃষ্টি বেশি হয়নি। রাস্তায় দশমীর ভিড়। তেলেঙ্গাবাগানের পুজোর জ্যামে ধরল আমাদের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম গাইয়ে ইনিয়েবিনিয়ে গাইছেন, ‘অধরামাধুরী, ধরেছি ছন্দবন্ধনে।’ দক্ষিণেশ্বর পেরিয়ে, বালি ব্রিজ পেরিয়ে, ফ্লাইঅভারের নিচ দিয়ে যেই ডানদিকে মোচড় দিল তপাকাকুর স্টিয়ারিং, অমনি শহর ফুরিয়ে মফস্বল শুরু হয়ে গেল।

আর বদলে গেল আমার হাবভাব, কনফিডেন্স। এতদিনে নিজের রাজত্বে এসে পড়েছি আমি। এই দেখ জি. টি. রোড, শেরশাহের রাস্তা। এই দেখ রাস্তার পাশে পাশে শতাব্দীপ্রাচীন জনপদ, গঙ্গার ধারে প্রকাণ্ড মাঠওয়ালা বিদ্যালয়, এই দেখ প্রত্যেক মোড়ে একটা করে পাঠাগার। এই সব যখন তৈরি হয়েছিল তখন তোমাদের সাউথে শেয়াল ডাকত। এই দেখ আমাদের জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি। এখানে বিদ্যাসাগর এসেছিলেন, এসেছিলেন মাইকেল। ওই দেখ সামনে হেলেদুলে চলেছে বিশ্ববিখ্যাত তিন নম্বর বাস। বাসের পেছনে কী লেখা দেখেছ? ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। আর তোমাদের বৈষ্ণবঘাটা মিনির পেছনে? খালি হর্ন প্লিজ, টা টা বাই বাই। ছোঃ।

বাড়ি এসে সোজা ঠাকুমার ঘর। সারা শরীরে নল গুঁজে শুয়ে থাকা একটা মানুষের মুখে যে এক নিমেষে অত আলো জ্বলে উঠতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। শুয়ে শুয়েই মাথায় হাত বুলোলেন ঠাকুমা, গালে চুমু খেলেন। ঠাকুমার চুমু এখন ভারি মজার, খালি নাক আর চিবুক ঠেকে গালে। এবাড়ি থেকে যে সব লুটের মাল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ঠাকুমার গায়ের ওপরই মেলে ধরে সে সব দেখাদেখি হল। ঠাকুমা বার বার তাঁর সঙ্গীসাথীদের বলতে লাগলেন, ‘দ্যাখসো আমার নাতিনরে? দ্যাখসো আমার নাতিনজামাইরে? আমারে, আমার ছেলেরে, সব্বাইরে লম্বায় ফ্যাল ফ্যালাইছে আমার নাতিনজামাই।’

ঠাকুমা। দশমীর সকালে নতুন শাড়ি পরে।

আমাদের কারও শরীরেই আর এনার্জি ছিল না বিশেষ। খানিকক্ষণ পর ঠাকুমার গলা জড়িয়ে বললাম, ‘এখন যাই ঠাকুমা, কাল আবার এসে তোমার সঙ্গে গল্প করব।’

ঠাকুমা রসিকতা রেডি করেই রেখেছিলেন। বললেন, ‘যাও যাও, গিয়া গালে গাল ঠ্যাকাইয়া বইয়া থাক।’


দশমী


যদিও সকাল সাতটার পর আর দশমী নেই আজ, তবু গুনতির সুবিধের জন্য আজকের গোটা দিনটাকেই আমরা দশমী বলে ধরব। রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ আসছে। মীরামাসির বানানো ডিম, গাজর, কড়াইশুঁটি দেওয়া চাউমিন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আজ আমরা যাব বেলুড়মঠ আর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। এ তল্লাটের লোকদের কাছে এই দুটি জায়গার গুরুত্ব অসীম। ভক্তিশ্রদ্ধা তো আছেই, যাতায়াতের সুবিধের ব্যাপারটাও আছে। রবিবার কোথাও যাওয়ার নেই? জেঠুরা সিমলামানালি বেড়াতে গেছেন? বেলুড়মঠ দক্ষিণেশ্বর তো আছে।

যেতে যেতে রাস্তার দু’পাশে প্যান্ডেল আর প্রতিমা দেখতে দেখতে চললাম। কোনও কোনও ঠাকুরের মুখ দেখা গেল, কারও কারও গেল না। ছোটবেলায় এগুলোকেও গুনতির মধ্যে ধরতাম। ওই আকাশের গায়ে একটা প্যান্ডেলের চুড়ো দেখা যাচ্ছে, তিনশো একাত্তর! গলির মুখে লাইটিং? তিনশো বাহাত্তর! যেতে যেতে লোটাস টেম্পলের আদলে বানানো দুধসাদা প্যান্ডেল দেখলাম। রোজ কৈলাশ কলোনি ছাড়ালেই মেট্রোর কাঁচের দরজা দিয়ে যে সত্যিকারের লোটাস টেম্পল চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এ যেন তার থেকেও সুন্দর।

আমি অবশ্য অত মন দিয়ে লোটাস টেম্পল দেখছিলাম না, আমার মন পড়ে ছিল অন্যদিকে। তপাকাকু আমাকে অনেক দিন ধরে চেনেন, আমার চুপ করে যাওয়া আর বাঁদিকের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারা দেখেই বুঝতে পেরে গেছেন। বললেন, ‘চিন্তা নেই সোনা, আমি দেখিয়ে দেব।’ দু’মিনিট পরেই কাকু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এইবার এইবার! বাঁদিকে! ল্যাম্পপোস্টের পাশে!’ আমি লাফিয়ে উঠে অর্চিষ্মানকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে বললাম, ‘নম করো, নম করো’, আশেপাশে কোথাও প্যান্ডেল দেখতে না পেয়ে অর্চিষ্মান ভেবলে গেল, আর মা ধমক দিয়ে বললেন, ‘আঃ সোনা, কী ফাজলামি হচ্ছে।’

ফাজলামি কীসের? ল্যাম্পপোস্টের পাশে এই রংচটা দোতলা বাড়িটা, যার গায়ে বড় বড় ম্লান অক্ষরে লেখা ‘বালি নার্সিংহোম’, এই বাড়িটায় যদি কোটি কোটি বছর আগে আমি না জন্মাতাম, যদি বাবামাঠাকুমাপিসির হাড়মাস জ্বালিয়ে ভাজাভাজা না করতাম, যদি মায়ের সতর্কবাণী এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার না করে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত না নিতাম, যদি নাককান মুলে ‘আর কোনওদিন প্রেমের ছায়া পাড়াব না’ শপথ না নিতাম, যদি বান্টির ওপর ‘চল তোকে নিউ ইয়র্ক সিটি দেখিয়ে আনি’ সর্দারি না ফলাতাম, যদি টাইমস স্কোয়্যারের হুক্কাহুয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বান্টির বন্ধুর সঙ্গে আমার আলাপ না হত আর অমনি আমার শপথটপথ সব উড়ে না যেত, তবে আজ কোথায় থাকত অর্চিষ্মান, কোথায় থাকতাম আমি আর কোথায়ই বা থাকত আমাদের বেলুড়মঠ যাওয়া?

ডি এস এল আরের বোম্বাই ব্যাগ যদিও আমাদের সঙ্গেই ছিল, বেলুড়মঠের গেটে পৌঁছে আমাদের কেমন যেন সন্দেহ হল যে ছবি তোলা নিষেধ নয় তো? গেটের সামনে দু’জন রক্ষী হাতে তেলচুকচুকে পাকানো বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমরা তাঁদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা হাতের তেলো দিয়ে মুখ আড়াল করে এদিকওদিক তাকিয়ে চোখ মটকে বললেন, ‘আরে নিষেধ থাকলেই যে মানতে হবে এমন মাথার দিব্যি তো কেউ আর দেয়নি।’ আমরা আঁতকে উঠে তপাকাকুর জিম্মায় ক্যামেরা রেখে মঠের ভেতর ঢুকে পড়লাম।

বেলুড়মঠ বলতেই আমার মনে হয় ভীষণ চুপ, ভীষণ শান্ত, ভীষণ গম্ভীর একটা জায়গা। কথা বললেই কেউ বকে উঠবে। পুজোর সময় সে শান্তি খানিক বিঘ্নিত হয় বোঝা গেল। শুধু বাঙালি নন, বাংলার বাইরে থেকেও প্রচুর দর্শনার্থী এসেছেন। চারদিকে বড় বড় প্যান্ডেল খাটিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা বসে আছেন। এখানে জুতো খুলুন, এখানে প্রণামী দিন।

মূল মন্দিরে ঢোকার আগে জুতো খুলতে যাব, মা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। ‘এই দেখ, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’ আমি হাঁ করে রইলাম। জুতো খোলা তুমি আবার দেখাবে কী? এই পা ঝাঁকাব, চটি এদিকে ছিটকে যাবে, ওই পা ঝাঁকাব, চটি ওদিকে ছিটকে যাবে। এর মধ্যে আবার দেখাদেখির কী আছে? মা ভয়ানক রহস্য করে মুচকি হেসে বললেন, ‘ওরে, দেখার কি আর শেষ আছে রে?’ এই না বলে মা বাঁ পায়ের চটি খুলে রাখলেন, তারপর তিনগজ হেঁটে গিয়ে সেখানে ডানপায়ের চটি খুলে রাখলেন।

আমি আর অর্চিষ্মান হাঁ করে রইলাম।

মা বুঝিয়ে দিলেন। এবার সপ্তমী না অষ্টমীতে বাবামা গিয়েছিলেন তমলুকের পুজো দেখতে। সেখানে বর্গভীমা মন্দির, মন্দিরে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। মন্দিরের জুতো-তত্ত্বাবধায়ক ছোকরা ভয়ানক চালাকচতুর, একেবারে মুখেচোখে কথা বলে। সে মায়েদের দু’জোড়া চটি নিয়েই ভাগাভাগি করে ফেলল। ডানপায়ের চটি দুটো রাখল এক জায়গায়, বাঁপায়ের চটিদুটো রাখল আরেক জায়গায়। বলল, ‘বুঝলেন না, আমি যদি একটু কাজ থেকে বিশ্রাম নিতে এদিক ওদিক যাই-ই, আর সেই সময় যদি জুতো চোর এদিকে এসেই পড়ে, তবে তাকে হয় দু’খানা ডানপায়ের চটি নিতে হবে, নয় দু’খানা বাঁ পায়ের।’

সদ্য শেখা কায়দায় জুতো খুলে আমরা মন্দিরের মধ্যে ঢুকলাম। যাঁরা অনেকক্ষণের জন্য এসেছেন তাঁরা মাঝখানের চত্বরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেনআমরা হুশ করে এসেছি হুশ করে চলে যাব কাজেই বসলাম না। মঠের পাশে প্যান্ডেল বেঁধে পুজো হচ্ছে। প্রতিমার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। আমার দেখা এ বছরের বেস্ট ঠাকুর।

বেলুড়মঠে দেখার আরও জিনিস আছে, মিউজিয়াম ইত্যাদি, কিন্তু আমরা ও সব দেখব না। আমরা শুধু বিবেকানন্দের নামে বানানো সৌধটা দেখব। পাকানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলা। সেখানে কোল্যাপসিবল গেটের ওপারে বিবেকানন্দের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বিছানা, বই। আবার পাকানো সিঁড়ি বেয়ে নামা। দশ হাত দূর দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়াব মিনিট দুয়েক। শান্ত নদীর বুকে দুলছে নৌকো। ওপারে প্রকাণ্ড শহরের সিল্যুয়েট। বর্শার ফলার মতো উঁচু হয়ে আছে কারখানার ছাদ, পোড়া চিমনির মাথা।

আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। পথে পড়ল উদ্বোধন কার্যালয়ের অফিস, সেখানে ঢুকে মা কর্মযোগ ভক্তিযোগ আরও কী সব কিনলেন, আমার আর অর্চিষ্মানের ‘দেবশিশুদের গল্প শোন’ বলে একটা বই খুব পছন্দ হল। পাতায় পাতায় ছবি, পাতায় পাতায় গল্প। বামন অবতার, প্রহ্লাদ অবতার। কিনে ফেললাম।

দক্ষিণেশ্বর পৌঁছে বুঝলাম কী ভুল করেছি। একে শনিবার, তায় সবে দশমী ছেড়েছে। গিজগিজ করছে লোক। পুজো দেওয়ার লাইনের বহর দেখে আমরা হাঁফ ছাড়লাম। ভাগ্যিস পুজো দেওয়ার প্ল্যান নেই আমাদের। কিন্তু তাই বলে কি মন্দিরেও ঢুকতে পারব না? রকমসকম দেখে আমার তাই মনে হচ্ছিল। মা বললেন, ‘ধুর পাগল, সে আবার হয় নাকি?’ দেখলাম মায়ের কথাই ঠিক, পুজো দেওয়ার লাইনও যেমন আছে, সাধারণ দর্শনার্থীদের লাইনও তেমন আছে। অবশ্য সেটাকে লাইন বলা ভুল। কোটিকোটি লোক একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে, আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে গলায় রক্ত তুলে ফেলছেন এক বেচারা সিকিউরিটি গার্ড। আমি বললাম, ‘মা, শিগগিরি ফিরে চল।’ অর্চিষ্মান বলল, ‘একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক না।’ মা বললেন, ‘ইস্‌, অ্যাদ্দূর এসে ফিরে যাব বললেই হল?’ আমার পেছনে দাঁড়ানো এক ভয়ানক স্মার্ট মহিলা বললেন, ‘ভয় পেলি হবে? জোরে ঠেলতি হবে।‘ এই না বলে তিনি আমার পিঠের ওপর তাঁর উপদেশ হাতেকলমে প্রয়োগ করলেন আর আমি নিমেষে ভিড়ের পেট ফুঁড়ে মন্দিরের ভেতর এসে পড়লাম।

পায়ের তলাটা ঝলসে গেল। রোদ্দুরে মন্দিরের চাতালের চৌকো পাথর একেবারে তেতে রয়েছ। তপাকাকু যে বলেছিলেন, ‘যাও না, দেখবে পায়ের তলায় বিনা পয়সায় আকুপাংচার হয়ে যাবে’, কিচ্ছু ভুল বলেননি। কোনওমতে শুধু গোড়ালি দিয়ে চলতে চলতে মা অর্চিষ্মানকে বললেন, ‘ছোটবেলায় সোনা এই চৌকোগুলোতে কিতকিত খেলত।’

জানা গেল, পুজো না দিলে মন্দিরে ওঠা যাবে না, নাটমন্দির থেকে প্রতিমা দেখতে হবে। নাটমন্দির থেকে প্রতিমা দেখতে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, কারণ সামনে অন্তত হাজারখানেক লোক ভিড় করে রয়েছে। আমরা মিনিটদুয়েক মিছিমিছি চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিলাম। তারপর বারোমন্দির, তারপর রাধামাধবের মন্দির, তারপর রামকৃষ্ণের ঘর। ঘরের বাইরে বারান্দায় বাঁধানো লিস্ট। মানুষের জীবনে কী কী নিত্য, কী কী অনিত্য, কী কী আদরের, কী কী বর্জনীয়। রঙ্গরস চাপল্য। প্রত্যেকবার লিস্ট পড়ে এসে মা প্রতিজ্ঞা করেন এইবার তিনি ঠাট্টাইয়ার্কি হাহাহিহি জীবন থেকে বর্জন করবেন। কী ভাগ্যিস, এখনও সফল হননি।

আমাদের দশমীর ঘোরা শেষ হল। ফেরার পথে মিষ্টির দোকানে থামলাম। বিকেলের জন্য স্টক ভর্তি করে রাখতে হবে। মিষ্টির দোকানের বিচ্ছু বোলতা আমার হাতে কামড়ে দিল, সে আঙুল এখনও ফুলে রয়েছে। বাড়ি ফিরে এসে আমরা খেয়েদেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম, অ্যালবাম খুলে লক্ষবার দেখা ছবি আবার দেখলাম।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে এল। দিনের কলরব নিভে এল। মণ্ডপের ঢাকের আওয়াজ এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নাচের দলের হুংকারও। খুব নাচ হচ্ছে এখন। ধুনুচি নিয়ে, খালি হাতে, সজ্ঞানে, সিদ্ধিতে চুর হয়ে। একসময় এই নাচ দেখার খুব উৎসাহ ছিল আমার, এখন আর নেই। এখন যত উৎসাহ বাড়ির ঠাণ্ডা, ছড়ানো খাটটার ওপর বসে থাকার। আরও যতক্ষণ পারা যায়। আরও যতক্ষণ মায়ের গায়ে ঘেঁষটে থাকা যায়। খাটে বসে বসে মণ্ডপের দৃশ্য কল্পনা করে নিই। এইবার নাচ থামল, সব অজুহাত শেষ, এইবার বিসর্জনের পালা। ঘর্মাক্ত নাচিয়েরা গোল হয়ে মাদুর্গাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। এইবার সবাই একসঙ্গে ঝুঁকল। দেখলে মনে হবে গণপ্রণাম হবে বুঝি। হঠাৎ একটা মিলিত ‘হেঁইও’ শব্দের সঙ্গে এক ঝটকায় প্রতিমা আকাশে। টলমল করছে। একটা মাটির পুতুলের চোখের দৃষ্টি, এত জ্যান্ত কি আর লেগেছে কখনও? ভিড় চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘সামলে সামলে!’ কোনও চিন্তা নেই। সিদ্ধিতে মাথা টং, কিন্তু হাত স্টেডি। মাদুর্গা পড়বেন না। এইবার ওই প্রকাণ্ড বোঝা নিয়ে এক পা এক পা করে হাঁটো। বেশি নয়, এই মাঠটুকু। মাঠ পেরিয়ে পুকুরঘাট। থামো। মাকে, মায়ের ছেলেমেয়েদের সাতপাক ঘোরাও। কষ্ট হবে, তবু নিয়ম নিয়মই। আমার বাবাকে এই কষ্টের কাজটা করতে দেখেছি আমি বছরের পর বছর। মাকে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। উদ্বেগটা যত না মাদুর্গার জন্য তার থেকে অনেক বেশি বাবার জন্য। বাবা এখন আর প্রতিমা তোলেন না, তাঁর সঙ্গে যাঁরা একসময় প্রতিমা তুলতেন, সেই অমিতকাকু, শ্যামলকাকুদের সঙ্গে একপাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখেন। হয়তো অবাক হয়ে ভাবেন, এক সময় এত জোর তাঁর গায়েও ছিল?

বিসর্জন শেষ। ঠাকুরের শেষ চিহ্ন তলিয়ে গেছে আমাদের কালো পুকুরের গভীর জলে। গেটে আওয়াজ হল। বাবা ফিরে এসেছেন। ঠাকুমার ঘরে ঢুকে খবর দিচ্ছেন, ‘হয়ে গেল, মা।’ সামনের ঘরে টাঙানো দাদুর ছবির নিচে ঘট পেতে রেখেছেন মা। এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক ঘাট থেকে অন্য ঘাট ঘুরতে ঘুরতে ট্র্যাডিশন আর বেশি বেঁচে নেই। সরস্বতীপুজোয় বড় বড় করে কাটা আলুফুলকপির তরকারি দিয়ে চৌকো পরোটা, দশমীতে লালশাকভাজা আর বিজয়ায় এই ঘট। চকচকে করে মাজা কাঁসার ঘটের জলে আমের পল্লব ভাসছে। পাশে কাঁসার প্লেটে জড়ো করে রাখা ধান আর বাগান থেকে তুলে আনা দূর্বাঘাস। আর একটু পরেই আশীর্বাদ সহযোগে এরা মাথায় উঠবে আমাদের। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে আঁকা নৃত্যরত পুতুল। ঘটের নিহিত দেবত্বকে আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যই বোধহয়। এই ঘটকে প্রণাম করে তবে গুরুজনদের প্রণাম, তবে নাড়ু নিমকি ঘুগনি।

ঘটের সামনে মাথা পাতলাম। বিশ্বাসঅবিশ্বাসের ব্যাপার নেই আর। এখন শুধু আজন্মের শিক্ষা। প্রজন্মের সংস্কার। আস্ক, ইউ শ্যাল রিসিভ। চাইলাম। বললাম, ‘অর্চিষ্মানের যেন সব ভালো হয়, ঘট। ওর মনের সঅঅঅঅব ইচ্ছে যেন পূর্ণ হয়। আমার মাবাবার শরীরে, মনে যেন কোনও কষ্ট না থাকে। আমার ঠাকুমার ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসা দুই পায়ে যেন আবার শক্তি ফিরে আসে। অবান্তরের কপালে যেন ভালো লেখা জোটে।’

সবার জন্য চাওয়া শেষ। এবার নিজের পালা। দিনে কি এক্সট্রা দু’ঘণ্টা পাওয়া যাবে, ঘট? যাবে না? আচ্ছা তবে এই চব্বিশঘণ্টাটাকেই গুছিয়েটুছিয়ে একঘণ্টা বার করে দাও, প্লিজ। কথা দিচ্ছি সে একঘণ্টা ইউটিউব না দেখে রেওয়াজ করব। রাগ নিয়ে নাও, বদলে গায়ে বল দাও বেশি বেশি। যাতে অফিস থেকে ফিরে এলিয়ে না পড়ে কাজে বসতে পারি। মনেও জোর দিও অনেক, আর দিও ধৈর্য, নিজের স্বপ্নের পেছনে আদানুন খেয়ে লেগে থাকার।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আমি চোখ খুললাম। পুজো শেষ হয়ে গেল।

    

Comments

  1. Asaaaadharon!!
    Shesh sentence ta porey amio deerghoshwas phellam. Pujo shesh hoye gelo.
    -Ramyani.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ, রম্যাণি। দুঃখ পেও না, মোটে তিনশো ষাট পঁয়ষট্টি দিন বাদেই আবার হবে।

      Delete
  2. Osadharon likhechho. Especially last line duto. Aschhe bochhor, abar hobe. *Deerghoshwas* :(

    Amar pujor jonyo mon kamon korlei ami ei video ta dekhi. Chhottobelar nostalgia.

    http://www.youtube.com/watch?v=VaMHtA8Lpnk

    Shubho bijoya tomader sobbaike. :-)

    p.s. Tomar ar Archishmaner alaap ta niye ekta jompesh typer lekhar asha ki korte pari kokhono?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভিডিওখানা বেশ সরেস। দেখে মজা পেলাম। ধন্যবাদ।

      Delete
    2. আমি এই ভিডিওটার কথাই ভাবছিলাম আজ সকালে। ওই ন্যাপকিনে লেখা শুভ বিজয়া-র ব্যাপারটা কেন জানি মাথায় ঘুরছিল।

      Delete
  3. ato kache eli re kuntala...Rishra--- Ami uttarpara tei chilam.. pujo sesh,, abantor toh khub e bhalo,aro anek bhalo hok.. Samner bochor pujo 7 diner..-- Mousumi Bhattacharya.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, ভট্টা, তুই এখনই সামনের বছর পুজোর খবর নিয়ে নিয়েছিস? গুড গুড। আমার শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শুভেচ্ছা নিস।

      Delete
  4. লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে গেলে নাকি শুভ বিজয়া বলা যায় না? জানি না কেন, নিয়ম।
    অবান্তরের সমগ্র পাঠককুল, লেখিকা এবং লেখিকার প্রিয়জনদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।

    ঈদ মুবারক, হ্যাপি দিওয়ালি, হ্যাপি হ্যালোউইন, হ্যাপি থ্যাঙ্কসগিভিং, মেরি ক্রিসমাস, হ্যাপি নিউ ইয়ার - যার যেটা পছন্দ নিয়ে নিন। যতগুলো খুশি নিতে পারেন, যতবার চাই নিতে পারেন। আমাদের শুভেচ্ছার ঝুলি ফুরোবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী ভালো শুভেচ্ছা ব্যবস্থা! যতগুলো খুশি, যতবার খুশি। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, দেবাশিস। অবান্তরের পক্ষ থেকে, অবান্তরের মালকিন, মালকিনের প্রিয়জন ও পাঠকদের তরফ থেকে আপনাকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানালাম।

      Delete
  5. হনুমান। সে একটি বার হনুমান বলে ডেকে, মিচকি হেসে, আঁচল ভাসিয়ে, মণ্ডপ আলো করে চলে যাবে। এ আশায় জিন্দেগী বয়ে গেল।... #Copied ... kintu moner ichhe etai... Pujo ses...

    ReplyDelete
  6. Ek kothai osadharon. Bidesh bibhui e pore achi eka eka. Lekhata pore mone holo sei chotobelakar pujor din guloi fire gechi. Onek dhonyobad :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. Uporer jon amar moner kothatai boleche ...r kichhu bolar nei..Onek Dhonyobad

      Delete
    2. আপনাদের দুজনকে আমার তরফ থেকেও অনেক ধন্যবাদ। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  7. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ঘনাদা।

      Delete
  8. এই লেখাটা, স্বাভাবিক কারণেই, আগেরটার থেকেও বেশি ভালো লাগলো। জানেন, আমার মা বাবাও ঐরকম হঠাৎ ইচ্ছে হলেই যে কোনও দিন বেলুড় মঠ আর দক্ষিনেশ্বর ঘুরে আসে। অবশ্য আপনাদের বাড়িটা আরও কাছে। আমাদের বাড়ি শুদ্ধু সবাই ঐরকম ভাবে দু জায়গায় দু পাটি চটি খোলে। ভিড়ের দিন আমরাও এড়িয়ে চলি। ইদানিং তো দেখি ভিড়ের দিনে দক্ষিনেশ্বরের পুজোর লাইন বালি ব্রিজে উঠে পড়ে।রোদে গরম হয়ে থাকা উঠোনের বর্ণনাটা মোক্ষম দিয়েছেন। ওই উঠোনে আরেকটা মজার জিনিস আছে - কুকুরের পায়ের ছাপ। মানে পোড়ামাটির টালি যখন কাঁচামাটির ছিল, তখন তার ওপর দিয়ে কুকুর হেঁটে গেছিল, গভীর ছাপ ফেলে ফেলে। সেগুলো ওই টালিতে এখনও আছে। আর আপনার ঠাকুর গোনার পদ্ধতিটাও আমার সঙ্গে মিলে গেছে। গলির মধ্যে ঠাকুর আছে জানা গেলেই তো গোনা চলে, তাই না?

    আমি যে নার্সিং হোমে জন্মেছিলাম তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমিও গলা বাড়িয়ে দেখতে দেখতে যাই, তবে সেটা হুগলীতে নয়, কলকাতায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইশ, দেখেছেন? এইটাই লিখতে ভুলে গেছি! আপনার ঠাকুমা তো ভয়ানক 'কুল' মানুষ দেখছি! ঠাকুমাকে আমার প্রণাম রইল।

      Delete
    2. ওহ্‌ জুতো খোলার এই কায়দাটা আপনারা আগে জানতেন? আমি ভেবেছি দারুণ নভেল আইডিয়া কিছু। কুকুরের পায়ের ছাপ তো খেয়াল করিনি কখনও। পরের বার গেলে দেখব। আমার ঠাকুমা ভয়ানক কুল, সেটা ঠিকই। ঠাকুমাকে আপনার প্রণাম অবশ্য পৌঁছে দেব।

      Delete
  9. শুভ বিজয়া - বিজয়ার উপহার হিসেবে উপযুক্ত এরকম কিছু লিখে উঠতাে পারবো বলে মনে হয় না। সৌভাগ্যবশত আরো অনেকে এটা পারেন, এখনও পারেন। উপহার হিসেবে সেইটেই রইলো -http://shadashidhekothaarchive.wordpress.com/2014/10/10/একজন-সাধাসিধে-মা-মুহম্মদ/

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভ বিজয়া জানাই তোমাকেও, অনির্বাণ। লেখাটা পাঠানোর জন্য সঙ্গে ফাউ ধন্যবাদ।

      Delete
  10. A aro mon bhore gelo....et bhalo lage amar tomar lekha Je stressed feel korlei. Tomar Kachei chole ashi abantor

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রণিতা। অবান্তর শুনে খুব খুশি হবে।

      Delete
  11. Khub valo laglo re.....emon moner moto pujo porikrma kom I korechi.Shubho Bijoya.

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভ বিজয়া, সাহানা। কোলাকুলিটা তোলা রইল।

      Delete
  12. Shubho Bijoya K. Duto post plus pratyek ta chobi bhalo laglo. Tomar thakurma ki sweet....khub bhalo laglo chobi ta dekhe. Tinni ar tomar chobi tao khub shundor along with the sarees! Tinni'r sari ta bhishon pochhondo hoyechey!

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমাকেও শুভ বিজয়ার অনেক প্রীতি শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা, শম্পা। তিন্নির শাড়িটা সত্যি ভালো।

      Delete
  13. tumio bethune e porte. hat melao. shubho bijoya r pronam o bhalobasa to u n ur entire family. ar thakumar gal e akta hami, from me. btw, amar bari tin nombor bus route er modhye pore. saree ta sundor.
    duto post er aksathe comment korlam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বেথুন কলেজ হাই ফাইভ, কুহেলি। হাহা, ঠাকুমা তোমার আদর পেয়ে খুব খুশি হবে।

      Delete
  14. আগের টার থেকেও ভালো লাগলো.. একটু বেশি ই ভালো। .. আর বেলুর মঠ এর ঠাকুরের মুখ বেস্ট.. একদম। ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ঊর্মি।

      Delete
  15. are guru tumi bali nursing home e hoecho..are oi elakay chotobelay kato maja korechi,badamtola belur mather just pashei..amar babar mamabari..prachur masti korechi chotobelay..jawa hoy na pray 8 bachar..bali elaka full chena..thik e,okhane ek kale library r besh chal chilo..ajkal geche..sob nesha e smartphone e converted.

    prosenjit

    ReplyDelete

Post a Comment