রেডিওর গোয়েন্দা
আজকাল মাঝে মাঝে
চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে কলকাতা দূরদর্শনে থামি। বছরকয়েক আগেও এ জিনিস অভাবনীয়
ছিল। আসলে বয়স হচ্ছে তো, ইন্দ্রিয়ের জোর কমছে। ডিস্কো আলো, গলা
সপ্তমে তুলে চিৎকার, গা ভর্তি গয়না, টকটকে লালপাড় সাদা শাড়ি আর নাকের ডগা থেকে
সিঁদুর টেনে বাঙালিয়ানার বিজ্ঞাপন, রোডিও ষাঁড়ের পিঠে চেপে কুইজকুইজ খেলা, এসব
দেখলে আজকাল বুক ধড়ফড় করে। সে তুলনায় কলকাতা দূরদর্শনের মলিন ছায়াছায়া সেট, নিচু
গলায় ও স্পষ্ট বাংলায় কথাবার্তা আরাম দেয়। প্রতিযোগিতামূলক
অনুষ্ঠানগুলো দেখি না, ওগুলোর মধ্যে চকচকে চ্যানেলগুলোকে টোকার একটা চেষ্টা থাকে।
চেষ্টাটা সফল হয় না বলাই বাহুল্য, মাঝখান থেকে গোটা ব্যাপারটা দেখতে আরও করুণ
লাগে। বরং এমনি গানের অনুষ্ঠানে, যেখানে তক্তপোশের ওপর বসে গাইয়ে সাবেকি কায়দায়
হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন আর ঘিরে বসে বাজিয়েরা তাঁকে সঙ্গত দেন, সেই রকম
অনুষ্ঠান দেখতে থামি কখনওসখনও। চমৎকার দু’কলি কীর্তন কিংবা ছোটবেলায় শেখা দু’লাইন
নজরুলগীতি শোনা হয়ে যায়।
আর সাক্ষাৎকার দেখি
মাঝে মাঝে। তাও সব নয়। বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, সমাজসেবীর সাক্ষাৎকার দেখতে তেমন
উৎসাহ পাই না, সিনেমাথিয়েটারের চেনা মুখদের কথা শুনতেই বেশি ভালো লাগে। সেই
সাক্ষাৎকারগুলোও বেশ ম্যাড়মেড়ে হয়। সোজা পিঠওয়ালা কাঠের চেয়ারটেবিল, পেছনে কাঠের
জাফরিওয়ালা কেঠো পর্দা, সামনে গোলটেবিলের ফুলদানিতে তিনটে রোগা রজনীগন্ধা। তবু
দেখি। তার একটা কারণ হচ্ছে এ সব সাক্ষাৎকার দিতে যে সব বিখ্যাত লোকেরা আসেন তাঁরা
সকলেই বেশ প্রবীণ। রোডিও ষাঁড়ের পিঠে চড়ে কুইজ খেলেন যে সেলিব্রিটিরা
তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই বয়সে কাঁচা। আমার থেকে পাঁচ, দশ, পনেরো বছর কম বয়সেই গানে
নাচে কবিতায় সাহিত্যে বাংলা সংস্কৃতির তাঁরা একেকজন কেউকেটা হয়ে উঠেছেন এটা আমার
বুকে কাঁটার মতো বেঁধে।
তবে পুরোটাই
হিংসুটেপনার জায়গা থেকে নয়, ডিডি বাংলার সাক্ষাৎকার দেখতে এমনিও আমার ভালো লাগে।
শুনতেও। একমাত্র এই চ্যানেলটায় একটা বিরল বাংলা ভাষা শোনা যায়। বোঝা যায় বক্তারা
সবাই এই ভাষাটাতেই পড়েশুনে ভেবেচিন্তে গড়াগড়ি খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন। আআআম্, উমমম্, সো, বাট, আই মিন, ইউ নো, কেন
কি, ইয়া ইয়া, শিওর শিওর, মুভিটা খুব এনজয় করলাম - বর্জিত একটা সহজ সরল কথ্য বাংলা।
ওই ভাষাটায় এখন আর কেউ কথা বলতে পারে না। আমিও না। বিরল, তাই শুনতে ভালো লাগে। কান
জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া বয়স্ক অতিথিদের রেয়াত করেই হোক বা সপ্রতিভতার অভাবের জন্যই
হোক, “প্রথমবার কিস্ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন” গোছের প্রশ্ন এই সব সাক্ষাৎকারগুলোতে
করা হয় না। সেটা একটা বড় বাঁচোয়া।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে
দেখলাম পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার হচ্ছে। হাত থেকে রিমোট নামিয়ে চায়ের কাপ
তুলে নিলাম। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় আমার খুব ভালো লাগে। ভদ্রলোকের নামখানাও
চমৎকার। সাক্ষাৎকারটা শুনে ভদ্রলোককেও আমার পছন্দ হয়ে গেল। ভদ্রলোকের মধ্যে সত্যি সত্যি
তারিণীখুড়ো টাইপের একটা ব্যাপার আছে। দারুণ ভালো গল্প করতে পারেন। কেউ নিজের
কাজটাকে ভালোবাসে দেখলে তাকে আমার ভালো লেগে যায়। অভিনয়ের প্রতি পরান
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে ভালোবাসা কথাবার্তায় ফুটে বেরোচ্ছিল। শুধু শুকনো নিষ্ঠা না, মুগ্ধতা
আর উত্তেজনাও, এতদিন ধরে অভিনয় করার পরেও। নানা বিষয় নিয়ে গল্প চলছিল। নিজের গল্প,
নাটকের গল্প, পাড়ার নাটকের দলের আনাড়িপনার গল্প। অভিনয় করে প্রশংসা, পরিচিতি
পাওয়ার গল্প, অভিনয়ের চাপে ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণ দিতে না পারার
অপরাধবোধের গল্প। দর্শককর্তৃক ‘সিরিয়াস’ বা ‘হাসির’ অ্যাক্টর বলে চিহ্নিত হয়ে
যাওয়ার গল্প।
সাক্ষাৎকারের
এইখানটাতে এসে পরানকে আমার আরও ভালো লেগে গেল। এইসব জ্বালাময়ী বিষয় নিয়ে বলতে
বলতেও ভদ্রলোক আশ্চর্য প্রসন্নতা বজায় রেখেছিলেন। “আমি হলে এইসব সিরিয়াস-কমেডি
ভাগাভাগি করতাম না, কিন্তু যারা করে তারাও কিছু একটা ভেবেচিন্তেই করে নিশ্চয়” এই ছিল
ভদ্রলোকের ভঙ্গি। এই যে যার যার বিচারবুদ্ধির দায় নিঃশর্তে, নিশ্চিন্তে তার তার
ওপর ছেড়ে দেওয়া, “কেন কেউ এ’রকম করে ভাবার সাহস পাবে” ভেবে ভেবে নিজের
ব্লাডপ্রেশার না বাড়ানো – এইটা দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সঙ্গে সঙ্গেই একটু
দুঃখও হল। ইস, আমি কেন এ’রকম নই?
আর তক্ষুনি আলোচনা
রেডিও-র দিকে ঘুরল।
বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ
করার সুখঅসুখের র্যাংকিং করতে গিয়ে সকলেই যা বলে পরানও তাই বললেন। সব মাধ্যমেরই
নিজস্ব সুখ আছে। মঞ্চে হাতেগরম প্রতিক্রিয়ার সুখ, টিভিসিনেমায় ঘরে ঘরে পরিচিতি
পাওয়ার সুখ। আর রেডিও-য়?
রেডিওতে অভিনয় করার
সুখের কথা বলতে গিয়ে পরানের চোখ জ্বলে উঠল। রেডিওয় অভিনয় করা দারুণ মজা। একটা কিছু
সৃষ্টির মজা তো আছেই, আরও মজা হচ্ছে সে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটায় শ্রোতাদের সামিল করে
নেওয়ায়। উদাহরণ হিসেবে একটা সংলাপ বললেন পরান। “রাত বারোটার সময়, যখন চাঁদের আলো
ওই পাথরটার ওপর পড়বে . . .” তিনবার পরান সংলাপটা বললেন। তিনবার আমি তিনতিনটে আলাদা
আলাদা লোককে দেখতে পেলাম। প্রথমজনের চেহারা রীতিমত সন্দেহজনক। হয় গুণ্ডা
নয় তান্ত্রিক। কোনও একটা কুমতলব না থাকলে কেউ গলা ওইরকম উদারায় নামিয়ে কথা বলে না।*
দ্বিতীয়জন ছোকরা গোছের। নির্ঘাত প্রেমিকাকে অভিসারের স্থানকাল জানাচ্ছে।
রোম্যান্সে গলা ভরপুর। তিননম্বর ব্যক্তি কলকাতায় থাকেন না গ্যারান্টি। খুব সম্ভবত
শীর্ষেন্দুর গল্পের কোনও গঞ্জের বাসিন্দা। খোলা মাঠঘাটে চলাফেরা করা অভ্যেস বলে
আগেরবারের সন্দেহভাজন ব্যক্তি আর প্রেমিক দুজনের তুলনাতেই গলার আওয়াজ বেশ কয়েক
পর্দা ওপরে।
এই তিনজনকে আমার চোখ
দেখল না বলাই বাহুল্য। দেখল কান। আমার চোখ দেখল সেই পরানকে। সেই পরান। সেই পরানের
মাথায় ফ্ল্যাটক্যাপ টুপি, সেই টুপির পেছনে কাঠের জাফরি। এই যে কান দিয়ে দেখিয়ে
নেওয়ার ব্যাপারটা এটা পরানের মতে রেডিওর মজার জায়গা। নিজে অভিনয় করার সঙ্গে সঙ্গে
শ্রোতাকে দিয়ে খানিকটা কল্পনার খাটুনি খাটিয়ে নেওয়া, এ বড় আনন্দের।
শ্রোতার পক্ষেও সে
খাটুনি কত আনন্দের, এই বুড়ো বয়সে এসে আমি তা টের পাচ্ছি। ছোটবয়সে রেডিওর সঙ্গে
আমার তেমন পরিচয় ঘটেনি। এক সকালে সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত একঘণ্টা কলকাতা-ক শোনা ছাড়া। তবে সে সময়টুকু রেডিও যত না রেডিও তার থেকে অনেক বেশি ঘড়ির কাজ করত। ক্লাসিক্যাল সংগীতের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গানে গানে শুরু হল
মানে ন’টা বেজে গেছে, এবার চানে না ঢুকলে মায়ের রক্ষা নেই। গানে গানে-তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
সাতআটটা সিনেমারই গান শোনানো হত। লালকুঠুরি, একান্ত আপন আরও ছিল কয়েকটা। ও,
প্রতিশোধ। গানে গানে-তে কিশোরকুমারের গলায় প্রতিশোধ সিনেমার “হয়তো আমাকে কারও মনে
নেই” গানটা আমার ফেভারিট গানে পরিণত হয়েছিল। পরে তার চিত্রায়ন দেখে মনে হয়েছিল না
দেখলেই ভালো হত বোধহয়। গানে গানে-তে তিনটে গান হত, প্রথম গানটা শেষ হতে হতে মা
ছাদে কাপড় মেলে আসতেন, দু’নম্বর গান চলাকালীন আমি আর বাবা মাছের ঝোলে, মা সবে
উচ্ছে, তিন নম্বর গান শুরু হতে না হতে ডাল তরকারি পেরিয়ে মা আমাদের ছুঁয়ে ফেলেন
প্রায়। কী স্পিড বাপরে। তিন নম্বর গান শেষ হওয়া মাত্র গম্ভীর শাঁখের মতো একটা শব্দ
বেজে উঠত কোথাও। শাঁখ নয়, রবিকাকুর রিকশার হর্ন। সারা রিষড়ায় ও’রকম অভিজাত হর্ন আর
কোনও রিকশার ছিল না। বাড়িশুদ্ধু লোক “যা-আ-আ-আ-ই” বলে চেঁচিয়ে উঠত। যারা যাবে, যারা যাবে না সবাই। রিকশায় যাব আমি আর মা, আমরা
চেঁচাতাম। বাবা সাইকেলে যাবেন, বাবা চেঁচাতেন। ঠাকুরঘরের জানালার
সামনে বসে দুধমুড়ি চিবোনো ঠাকুমা, তিনিও চেঁচাতেন। থালাবাটি গুছিয়ে, শাড়ি পরে,
আমার ঝুঁটিতে লাল ফিতের ফুল বেঁধে, হাতে ঘড়ি, আংটি, হার মুঠো করে ধরে যখন মা সত্যি
সত্যি রিকশায় এসে উঠতেন তখন ন’টা পঁচিশ বেজে গেছে, খবর শেষ, জেলার খবর শুরু হয়েছে।
আমি টা টা করছি, পেয়ারা গাছের ডালপালা আর ঠাকুরঘরের জানালার উল্লম্ব শিকের ওপার
থেকে ঠাকুমাও টা টা করছেন। হরিপাল মিস হয়ে গেছে, কিন্তু তারকেশ্বর লোকাল আমরা পেয়ে
যাব, কেউ আটকাতে পারবে না।
এই রুদ্ধশ্বাস দৌড়োদৌড়ির
বাইরে রেডিওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশি দূর এগোয়নি। শনিরবি দুপুরেও হয়তো খেয়ে উঠে
আরাম করে নাটক শোনা যেত কিন্তু ততদিনে বাড়িতে টিভি এসে গেছে, বড়রা রেডিও ফেলে
সেদিকে চলে গেছেন। আমারও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু জননী বাম। ফটিকচাঁদ গোছের
সিনেমা হলে দেখার সম্ভাবনা থাকত নয়তো বাধ্যতামূলক ভাতঘুম। রাতে পড়াশোনার জন্য
শক্তিসঞ্চয়।
নিজের বিনোদনের
অধিকার যতদিনে নিজের হাতে এল তখন আমার রেডিও শোনার ইচ্ছে অন্তর্হিত হয়েছে।
মাধ্যমিকের পর লম্বা ছুটির সময় অফিস বেরোনোর আগে রোজ মা বলে যেতেন, “ঘুমোস, গল্পের
বই পড়িস, গান শুনিস, শুধু দয়া করে সারাদুপুর টিভি দেখিস না সোনা।” কিন্তু আমি ততদিনে লায়েক হয়ে গেছি। বুঝে গেছি বই
পড়া কিংবা গান শোনার থেকে অনেক সোজা হচ্ছে টিভি দেখা। কারণ তাতে পরিশ্রমটা একাধিক
ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। কোনও একটা অনুভূতির ওপর বিশেষ করে চাপ পড়ে না।
খানিকটা দেখলাম, খানিকটা শুনলাম। ভাবলাম না কিছুই। রেডিওর ক্ষেত্রে কান দিয়ে শোনা এবং দেখার যে খাটুনিটা
খাটিয়ে নিয়ে পরান তৃপ্তি পাচ্ছিলেন, সে খাটুনি নেই। এখন অবশ্য টিভিকেও হার মানানোর
জিনিস এসে গেছে। ইদানীং রাতে ঘুমোনোর সময় স্মার্টফোন নিয়ে খুটুরখাটুর করি। গান
শুনি, আঙুল দিয়ে পাতা উল্টে উল্টে ব্লগ পড়ি। এক সঙ্গে দর্শন, শ্রবণ ও স্পর্শেন্দ্রিয়
ব্যস্ত হয়ে থাকে, মাথাকে পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া যায়। কী আরাম, কী আরাম। সে সময় আমি মায়ের
ফোন এলে তুলি না, অর্চিষ্মানের কথায় সাড়া দিই না। ওটা আমার মি-টাইম। শবাসনেও অত
আরাম হয় না (অ্যাকচুয়ালি, জেগে জেগে শবাসন করা বেশ শক্ত ব্যাপার। কিচ্ছুটি না
ভেবে, আশেপাশের যাবতীয় ঘটমানতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মাটি কামড়ে শুয়ে থাকা,
আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।)
কিন্তু পরিশ্রমের এক
রকম আনন্দ আছে। সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় মনে থাকে না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনতিনখানা
ইন্দ্রিয়কে লিপ্ত করে ওই যে নেটসার্ফিং, তার আরাম পাঁচ মিনিট শবাসন করার কাছে
প্রত্যেকবার ম্লান হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়ভোগ দারুণ জিনিস, কিন্তু ইন্দ্রিয়মুক্তি যার
ঘটেছে সে জানে বাকিরা কী পেল না।
ইন্দ্রিয়মুক্তি আমার
এ জীবনে ঘটবে না, তবে তাদের ওপর নির্ভরতা খানিকটা কমাতে পারলে মন্দ হয় না। বিশেষ করে তাতে যখন
ভালোলাগা বাড়ে বই কমে না। পুরোটাই তো অভ্যেসের ব্যাপার। তাই আমি বিনোদনের দৃষ্টির ভাগ কমিয়ে শ্রবণের ওপর জোর দেওয়ার
চেষ্টা করছি।
আর এই কাজে আমাকে
প্রাণ দিয়ে সাহায্য করছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। কত রকমের ডকুমেন্টারি নাটক
নভেল ছোটগল্প বড়গল্প, বড়গল্পের বনসাই যে আছে ওই ভাঁড়ারে। সিরিয়াস লোকেদের জন্য
সিরিয়াস বিনোদন, আমার মতো লোকেদের জন্য হালকা, নির্ভার বিনোদন।
সে সবের মধ্যেও ক্রাইম
আর সুপারন্যাচারাল আমার প্রিয় ক্যাটেগরি। বিবিসি-র তুখোড় অভিনেতাদের গলায় রহস্য আর
ভূতের গল্প শুনে কতবার যে ঘোর দুপুরবেলায় আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। চেনা গল্প
নতুন করে চমকে দিয়েছে। লাভক্রাফটের শ্যাডো ওভার ইনসমাউথ পড়ে যা হয়েছিল, কানে শুনে
সে শিহরণ দ্বিগুণ। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের নিচ থেক দলে দলে উঠে
আসছে বীভৎসদর্শন আধা মাছ আধা মানুষদের দল। আবার একেবারে নতুন গল্প, নতুন লেখককেও
আবিষ্কার করে অন্য আরেকরকম চমক লেগেছে। শেরিডন লা ফানু-র মতো ভূতের
গল্পের স্রষ্টার নাম না জানা সত্ত্বেও যে আমি নিজেকে এতদিন ভূতের গল্প-বিশেষজ্ঞ বলে
মনে করতাম ভেবে লজ্জায় মাটিতে মিশে গেছি! আবার চাক্ষুষ আলাপ ছাড়াই যে সব গল্পের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে গেছে
বহুদিন, (ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের গল্প) সমস্ত উত্থানপতন,
খাঁজভাঁজ, অবতরণিকা-উপসংহারসহ সে গল্পগুলো শুনেও দারুণ মজা লেগেছে।
কিন্তু সবথেকে যেটা
ভালো হয়েছে সেটা হয়েছে দেশবিদেশের প্রচুর গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচিতি। এঁরা কেউ
হোমসের মতো বিখ্যাত নন। পোয়্যারো, মার্পল, লর্ড উইমসির মতো পরিচিতিও এঁদের নেই,
কাজেই খুঁজে খুঁজে এঁদের বই পড়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভবই ছিল। বিবিসি শুনতে গিয়ে
আমি বারোশো শতাব্দীর বেনেডিকটাইন সন্ন্যাসী ক্যাডফায়েল-এর কথা
জেনেছি। শ্রুসবেরি অ্যাবিতে থাকেন, গাছগাছড়ার ভেষজ গুণ নিয়ে গবেষণা করেন আর রহস্য
সমাধান করে বেড়ান। ব্রিটেনের ইতিহাসে সেই সময়টা ‘দ্য অ্যানার্কি’ নামে খ্যাত,
কাজেই রহস্যের অভাব হয় না।
তারপর ধরা যাক সুইডিশ পুলিশ অফিসার মার্টিন বেক-এর কথা। যোগ্যতার জোরে টকাটক
প্রোমোশন পেয়ে সুইডেনের পুলিশবিভাগের প্রায় টঙে চড়েছেন, কিন্তু মনে শান্তি পাননি।
সেটা অবশ্য ওদিককার সূর্যালোকহীন জলবায়ুর দোষ হতে পারে। অফিসে শান্তি নেই, বাড়িতে
শান্তি নেই। এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো স্টকহোমের অলিতেগলিতে যখনতখন মৃতদেহ
আবিষ্কার হচ্ছে।
মার্টিন বেক-এর গল্পগুলোর আর একটা বিশেষত্ব হচ্ছে যে পালা করে একেকটি অনুচ্ছেদ
একজন মহিলা ও একজন পুরুষ পালা করে পড়েন। কী ভালোই না পড়েন। ইন্টারনেটে অডিওবুক
শোনার ব্যবস্থা কিছু কম নেই। কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগই টানা রিডিং পড়ে যাওয়া। সে
জায়গায় বিবিসির অভিনেতারা সকলেই দক্ষ, পেশাদার অভিনেতা। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে
সেলিব্রিটিও। মাঝে মাঝেই কোনও এক চরিত্রের গলা চেনা চেনা ঠেকে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়,
আরে এ তো ডেভিড সুশে! কিংবা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ! অসমসাহসী ডি এস আই জুলি
এনফিল্ডের গলা শুনে চিনতে পারিনি, উইকি সার্চ করে দেখি ও হরি, ইনিই তো সিনেমায় কোলাব্যাংমুখো
দিদিমণি উমব্রিজ-এর পার্ট করেছেন। তারপর
থেকে যতবার জুলি এনফিল্ডের গল্প শুনেছি ততবার কোলাব্যাঙের মতো উমব্রিজ ভেসে উঠেছে
চোখের সামনে। লন্ডনের মাটির নিচের পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে সিরিয়াল কিলারের পেছনে
ছুটছেন জুলি আর আমি স্পষ্ট দেখছি তাঁর গায়ে গোলাপি ফ্রিল দেওয়া ফ্রক, কলারওয়ালা
গোলাপি জ্যাকেট, হাতে বন্দুকের বদলে উঁচোনো ওয়ান্ড।
কিন্তু এঁদের সবার মধ্যে আমার যে দু’জন গোয়েন্দাকে আমার সবথেকে মনে ধরেছে
তাঁরা হলেন পল টেম্পল আর চার্লস প্যারিস। কিন্তু আজ আর লেখার ধৈর্য নেই। তাঁদের কথা
খুব শিগগিরই কোনও একদিন বিস্তারে বলব।
*****
বিবিসি ক্রাইম ড্রামার লিংকঃ http://www.bbc.co.uk/radio/programmes/genres/drama/crime/player
বিবিসি হরর অ্যান্ড সুপারন্যাচারাল ড্রামার লিংকঃ http://www.bbc.co.uk/radio/programmes/genres/drama/horrorandsupernatural/player
Khub bhalo laglo lekhata pore. Apatoto dokane esechhi, Poulami jamakapor pachhondo korchhe ar ami phone theke blog porchhi, tai er beshi likhcchina, pore ei bishoyta niye aro kichhu lekhar ichchhe roilo.
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুগত। আশা করি কেনাকাটা ভালো হয়েছে।
Deleteরেডিও নিয়ে অনেককাল আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। টিভি বড় না রেডিও সেই নিয়ে তর্কের উত্তরে বিখ্যাত কন্ঠ-অভিনেতা স্ট্যান ফ্রিবার্গ এইটা বলেছিলেন। আমি অবশ্য গল্পটা ছাপার অক্ষরে পড়েছিলাম, আজ এখানে লিখব বলে আরেকবার খুঁজতে গিয়ে রেকর্ডিংটা খুঁজে পেলাম (আর সেই সঙ্গে এটাও জানলাম যে ফ্রিবার্গ গত মাসেই মারা গেছেন)। কিন্তু সত্যিই, রেডিওতে শ্রুতিনাটক শুনতে শুনতে যেভাবে জিনিস দেখতে পাই সেটা আশ্চর্য্য। আমিও সেজন্য সান্ডে সাসপেন্স আর বিবিসির গোয়েন্দা নাটক শুনতে ভীষণ ভালোবাসি। আপনি যে নামগুলো জানালেন সেগুলোর জন্য ধন্যবাদ, শুনে দেখতে হবে। আমি পোয়ারো শুনেছি অনেকগুলো, যেগুলোতে পোয়ারো, হেস্টিংস আর ইন্সপেক্টর জ্যাপ এর অভিনয় করেন বিবিসির টিভি সিরিজের অভিনেতারাই। আমিও শুনতে শুনতে তাঁদের মুখগুলোই দেখতে পাই।
Deleteসুন্দর একটা ভিডিওর লিংক পাঠানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, সুগত। সানডে সাসপেন্স সব পুরোনোগুলো ঘুরিয়েফিরিয়ে শুনতে শুনতে আরও পুরোনো হয়ে গেছে, এবার কিছু নতুন অডিও পেলে মন্দ হয় না।
Deleteeta amar jonyo shikkhamulok post.
ReplyDeleteকী সর্বনাশ, কেন?
DeleteBBC ta sunchen kotha theke? Internet? Link ta dile badhito hobo. Iti, Ajnatonama atatayi.
ReplyDeletePunoscho: chomotkar likhchen ajkal. Bonn r golpo ar ektu sunle bhalo hoto. Bhabchilam tari ekta post asbe, tar bodole elo ne r khabar r ad.
এই দেখুন, বনের একটুখানি গল্প তো পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে এখনও। ভাবলাম সবাই এতদিনে ভুলেই গেছে, এখন আবার "শুনুন শুনুন বনের গল্প শুনুন" বললে যদি বিরক্ত হয়? আপনি শুনতে চাইছেন জেনে বর্তে গেলাম। থ্যাংক ইউ। সেমিনারের শেষে কী হল সেটা লিখে ফেলব আজকালের মধ্যেই।
Deleteলিংক না দেওয়াটা আমার খুবই বোকামি হয়েছে। এখন একটু বেড়াতে বেরোচ্ছি, ফিরে এসেই পোস্টের নিচে একটা লিংক জুড়ে দেব।
আপনার নামটা কিন্তু দারুণ।
Deleteবেশ ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে। পরাণ আমারও খুব প্রিয় একজন অভিনেতা বটে। :)
ReplyDeleteহাই ফাইভ, অরিজিত।
Deletedurdarshan diye suru kore interview, bangla bhasha, paran bandyopadhyay, radio, school er jonno ready howa, tarpor goenda ei step by step transformation ta khub bhalo laglo... sotti ekhonkar dine DD bangla kaaner aram bote.. news o sobar theke authentic dey.. duto bhalo link o pelam.. shune dekhbo... ar Paran bandyopadhyay khub boro actor ... Sandip ray k uni acting diye bachiye den sob film e..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঊর্মি। আমার তো ডিডি বাংলা ছাড়া অন্য কোনও চ্যানেলের খবর শুনতে গেলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়।
Deleteami oi jonya majhe majhe bangladeshi channel er natok dekhi.. somoy pele kohkono dekho humayun ahmed er direct koragulo besh bhalo.
Deletedarun hoyeche, nostalgia theke ghotoman bortomaner emon chomotkar mishel apnar lekhaguloy hoy :) , obshyo link gulo amar shona hobe na, amar dhoirjo oti kom, ami golpo porbe keu ar chupti kore shunbo e ekebarei pari na
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রদীপ্তা। খুব ভালো লাগল।
Deleteপরান বন্দ্যোপাধ্যায় আমারও প্রিয় অভিনেতা । ভাল লাগল লেখাটা ।
ReplyDeleteমিঠু
ধন্যবাদ, মিঠু।
DeleteRadio r songe amar kintu besh bhab chhilo, amar didar songe mon die robibarer natok shuntam, dida chole jabar por, ma abiskar koren je amar ekta sangahtik neshai dnarie gachhe ... onek koste sei nesha chharie diechhilen.. ei post pore sei purono kotha mone pore galo... link gulo jomi erakhlam... somoimoton shuntei hobe
ReplyDeleteএটা একদম ঠিক বলেছেন, ইছাডানা। সাংঘাতিক নেশার জিনিস রেডিও। আমারও ধরেছে, তবে আমি নেশাটাকে দুধকলা দিয়ে পুষব ঠিক করেছি। লিংকগুলো শুনে দেখতে পারেন। অনেকগুলো গল্প বড় বড় হয়, প'নে এক ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টার, সেগুলো হয়তো শুনতে অসুবিধে হবে, কিন্তু অনেক সময় আধঘণ্টারও গল্প থাকে। বা পনেরো মিনিটের এপিসোড হিসেবে ভেঙে ভেঙে প্রচারিত হয়। সেগুলো শুনে দেখতে পারেন।
Deleteআমার থেকে পাঁচ, দশ, পনেরো বছর কম বয়সেই গানে নাচে কবিতায় সাহিত্যে বাংলা সংস্কৃতির তাঁরা একেকজন কেউকেটা হয়ে উঠেছেন এটা আমার বুকে কাঁটার মতো বেঁধে।
ReplyDeleteপরে তার চিত্রায়ন দেখে মনে হয়েছিল না দেখলেই ভালো হত বোধহয়।
“প্রথমবার কিস্ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন”
ei tinte line amar chomotkar laglo. gola chhere haslam. tomar sarcasm er akta alada level ache, tai tumi ato priyo. amar sukhen das ke dekhlei amar hasi peto/paye.
Poran Bondyo akjon genius actor. hollywood e jonmale academy na hok, ak adhta golden globe to badhai chilo.
bibidho bharoti, air fm rainbow ami prochur shunechi, courtesy amar baba. ami student life e kane headphone guje radio shunte shunte onko kortam, tobe jeta shuntam seta nehati chotul hindi ba bangla band er gaan. akhon ar fm shuni na, rj gulo ke barabari rokomer gadha lage. tobe sunday suspense shunte bejaye bhalo lagto.
last part ta porte porte nijeke abar daha oshikkhito mone hocchilo. ami konodin BBC r drama shunini. tumi link diyecho tai shune dekhbo.
বিবিসির অডিও ড্রামা তুমি ইউটিউবেও অনেক শুনতে পাবে, কুহেলি। খুঁজে দেখতে পার। শার্লক, পোয়্যারো, মার্পল, সব। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Deletelekhata pore chomotkar laglo... radio konodin e khub ekta sunini chhotebelay ek mohishaurmordini chhara.. r pore FM channel asha r por majhe majhe kane diye onko kortam.. onko ki hoto janina tobe prochur gan sekha hoye jeto oi sutre...tarpor r kono din e serom kore radio shona hoyni... paran bandopadhyay ke abhineta hisebe besh bhalo lage... echhara uni mirakkel bole ekta show te judge hisebe ashen.. sekhane or kothabarta ba golpo gulo sunle mone ekta ongoing interview dekhchhi.. sekhan theke onar somporke je ideata hoyechhilo setai dekhlam tumi likhechho... Goenda golpo amar o khub bhalo lage.. motamuti porichitoder agei porechhilam.. lord wimsey sodyo mas dui abishkar korechhi.. goodreads er khoncha kheye kheye.. ekhon por por pore jachhi.. 11 nombor sesh kore 12 te pouchhechhi.. erpor tomar benedictine sonnyashi ba paul temple ederke dhorar ichhey roilo... :)
ReplyDeleteekebare mon bhalo kore dewa lekha.. paran bandyopadhyay er obhinoy satyi khub bhalo,lage, sunday suspense er goppo gulo to amar otipriyo..
ReplyDeleteBratati.
পরান বন্দ্যোপাধ্যায় আর সানডে সাসপেন্স হাই ফাইভ, ব্রততী।
Delete