এ মাসের বই/ মার্চ ২০১৬
যতীন বাংলাদেশের আর পাঁচজন ছোট ছেলের মধ্যে একজন। আর পাঁচজন ছোট
ছেলের মতোই যতীনের অন্যতম প্রধান দোষ নিজের
জিনিসপত্রের যত্ন না নেওয়া।
“ধুতি
তার দুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। কোনো জিনিসে তার যত্ন নেই। বইগুলো সব মলাট
ছেঁড়া, কোণ দুমড়ান, শ্লেটটা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফাটা। শ্লেটের পেন্সিলগুলি সর্বদাই
তার হাত থেকে পড়ে যায়, কাজেই ছোট ছোট টুক্রো টুকরো।“
এমন সময় একদিন যখন যতীন সিঁড়ির শেষ তিনটে ধাপ একলাফে নামতে গেল তখন তার
অলরেডি সেলাই খুলে যাওয়া নতুন চটির সহ্যের সীমা ছাড়াল। তাকে নিয়ে উড়তে উড়তে নিয়ে গিয়ে
ফেলল অদ্ভুত এক দেশে। সেখানে গিয়ে যতীনের যা দুর্দশা হল সে আর কহতব্য নয়। প্রথমেই কিছু
দুর্দান্ত মুচি তাকে নিয়ে নিজের জুতো নিজে সেলাই করাল, তারপর পাঁচতলা সিঁড়ি ভাঙিয়ে সাবধানে হাঁটার পরীক্ষা নিল, তারপর
একদল দুষ্টু দরজি তাকে দিয়ে ছেঁড়া ধুতি সেলাই করাল। খিদে পেলে কতগুলো পেনসিল এনে দিয়ে
বলল "তুমি তো পেন্সিল চিবোতে ভালোবাস, এইগুলো চিবিয়ে খাও, আর কিছু আমাদের কাছে
নেই।"
কিন্তু সবথেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা ঘটল এর পর। ক্লান্ত, অপমানিত হয়ে যখন যতীন
ঘুমিয়ে পড়েছে, আর উদ্ধারের কোনও পথই দেখতে পাচ্ছে না, তখন আকাশে বোঁ বোঁ শব্দ তুলে
যতীনের ঘুড়ি তার কোলের ওপর এসে পড়ল। সেই ঘুড়ি, পৃথিবীর একমাত্র জিনিস যতীন যার যত্ন
করত। নাওয়াখাওয়া ভুলে, অন্য খেলাদের ভুলে যাকে নিয়ে যতীন পড়ে থাকত, ছিঁড়ে যাওয়া মাত্র
তাপ্পি মারতে বসত, সেই ঘুড়ি। ঘুড়ি এসে বলল "তুমি আমাকে যত্ন করেছ, তাই আমি তোমাকে
সাহায্য করতে এসেছি। শিগ্গির আমার লেজটা ধর।"
লেজ ধরতেই ঘুড়ি যতীনকে উড়িয়ে তার নিজের বাড়িতে এনে ফেলল। সে যাত্রা যতীন রক্ষা
পেল।
*****
কত গল্পই তো আমরা পড়ি। তাদের কোনও কোনওটা মনে থেকে যায়, কোনওটা হাওয়া হয়ে যায়। কোন গল্পটা
আমার মনে থাকবে আর কোনটা থাকবে না, গল্পের ভালোমন্দের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
কোন গল্পটা আমাকে ছুঁয়ে গেছে, সেটাই হচ্ছে কথা।
যেমন ওপরের যতীনের গল্পটা। গল্প হিসেবে চমৎকার। সে তো হবেই। সুকুমার রায় লিখেছেন যখন।
কিন্তু সে তো সুকুমার রায়ের লেখা সব গল্পই চমৎকার। এমনকি অনেকগুলো গল্প যতীনের জুতো-র
থেকে অনেক বেশি চমৎকার। যেমন সেই যে হরিপদর নাড়ু খাওয়ার গল্পটা, কিংবা বাড়ির ছাদে ভাইবোনেদের সামনে
চালিয়াতি করে দাদার রকেটবাজি ফাটানোর গল্পটা। তবু এইসব গল্পগুলো আমার কাছে হাসির গল্প
হয়েই রয়ে গেছে, আর যতীনকে আমি
ভুলতে পারিনি।
তার কারণ যতীনের সঙ্গে আমার ভয়ানক মিল। জীবনের যা যা জরুরি জিনিস, সম্পর্ক, কেরিয়ার
- কোনওটার প্রতিই আমি যত্ন নিইনি, এখনও নিচ্ছি না, ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে, ইন্টারনেট
দেখে সময় নষ্ট করে বেড়াচ্ছি। তাই যতীনের পরিণতি একদিন আমার হবে সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। একদিন মুচি আর দরজির দলের হাতে আমার হেনস্থা লেখা আছে। অলরেডি অনেক হেনস্থা হয়েছেও। সে নিয়ে নিয়মিত আফসোসও হয়। যদি
যতীনের মতো না হতাম তাহলে এসব হত না।
আফসোস হয়, কিন্তু ভয় লাগে না। ভয়হীনতার কারণও ওই যতীন। বা যতীনের ঘুড়ি। যেসব অকাজের জন্য কাজ ফাঁকি দিলাম, চরম মুহূর্তে তারা কি আমাকে বাঁচাতে আসবে না? ফুচকা, অবান্তর, ক্যান্ডি ক্রাশের রংচঙে ডুরিকাটা ক্যান্ডিরা? একদিন যখন আখেরে টান পড়বে, ইন্টারনেট এসে কি কানে কানে চুপি চুপি বলবে না, "শিগগিরি আমার পিঠে উঠে বস, একদিন তুমি আমার মুখ চেয়ে নিজের অনেক ক্ষতি করেছিলে, আজ আমার প্রতিদানের পালা এসেছে?"
আফসোস হয়, কিন্তু ভয় লাগে না। ভয়হীনতার কারণও ওই যতীন। বা যতীনের ঘুড়ি। যেসব অকাজের জন্য কাজ ফাঁকি দিলাম, চরম মুহূর্তে তারা কি আমাকে বাঁচাতে আসবে না? ফুচকা, অবান্তর, ক্যান্ডি ক্রাশের রংচঙে ডুরিকাটা ক্যান্ডিরা? একদিন যখন আখেরে টান পড়বে, ইন্টারনেট এসে কি কানে কানে চুপি চুপি বলবে না, "শিগগিরি আমার পিঠে উঠে বস, একদিন তুমি আমার মুখ চেয়ে নিজের অনেক ক্ষতি করেছিলে, আজ আমার প্রতিদানের পালা এসেছে?"
বলবে যে তার হাতেনাতে প্রমাণ গতমাসেই পাওয়া গেল। মার্চ মাসের গোড়ার দিকে যখন আমার একটা বিটকেল, বিশ্রী অসুখ হল। বাংলায় সে অসুখকে কী বলে আমি জানি না, তবে ইংরিজি বুক-ব্লগারদের তাকে ‘রিডিং স্লাম্প’ বলে ডাকতে শুনেছি।
reading slump
a reader’s worst
nightmare.
not being able to
pick up a book and read because you just can't, you just can't read.
বাংলা ফেলে ইংরিজি নিলাম,
ইংরিজি ফেলে ফের বাংলা, ক্ল্যাসিক ছেড়ে
মিস্ট্রি, মিস্ট্রি ফেলে সাই-ফাই, পুলিৎজার পালটে ওপরা উইনফ্রি-র
বুকক্লাবের রেকো, পেপারব্যাক হার্ডকভার - কেউ আমাকে বাঁচাতে এল না। ঠাণ্ডা বইয়ের পাতা
আমার আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে আরও ঠাণ্ডা মেরে
গেল। বলল, "এখন কেন? আমাদের ফেলে ফোন নিয়ে খেলার সময় মনে ছিল না, ইউটিউবে লক্ষ বার দেখা
ভিডিও আরও হাজার বার দেখার সময়?"
হাল ছেড়ে যখন ভাবছি
হয়ে গেল, আমার এ বছর বেশি বেশি বই পড়ার রেসলিউশনের কফিনে পেরেক পড়ল, এমন সময় আকাশে
বোঁ বোঁ করে কীসের শব্দ হল। চমকে তাকিয়ে দেখি, প্যারাশুটের মতো কী একটা জিনিস, ফানুসও
হতে পারে, গায়ে উল্টোনো কড়াইয়ের মতো ডিজাইন, এসে আমার কোলের
ওপর পড়ল। পড়ে নিজের ছাতার মতো মুণ্ডুটা আমার কানের কাছে নিয়ে সবে বলতে যাবে, “আমাকে
চিনতে পেরেছ তো, আমি হচ্ছি…” আমি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওয়াই ফাই, তোমার জন্যই তো আমি…”
সে বলল, “জানি, বইদের অবহেলা করেছ, তাই তারা তোমার থেকে মুখ ঘুরিয়েছে। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই, আমার লাইব্রেরিতেও অনেক বই জমেছে, যদি
চাও তো সেগুলো ট্রাই করে…”, আমি বললাম, “ইন্টারনেটের বই…পাইরেটেড নাকি?”
ফানুস সামান্য সরে গেল। আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, “সরি সরি, ভুল হয়ে গেছে, পাইরেটেড ননপাইরেটেড, কপিরাইট নো কপিরাইট, হু কেয়ারস, বই ইজ বই।”
ফানুস বলল, “তবে আমার লেজ চেপে ধর।“ধরলাম।
তারপর
বনবন শনশন ঝনঝন কী সব হল, আমি চোখনাকমুখ সব চেপে বন্ধ করে রইলাম। ঝড় থেমে গেলে দেখি আমি আমার খাটের ওপর শুয়ে আছি,
চারপাশে সব যেমনকে ছিল তেমনি আছে। আর স্লাম্প? সে আছে না গেছে? পরীক্ষা
করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বুককেস থেকে বেছে বেছে একটা
আদ্যোপান্ত ফিল-ব্যাড বই হাতে তুলে নিলাম, ক’দিন আগে যেটার দিকে তাকালেও মাথা ধরে যাচ্ছিল। পড়তে শুরু করলাম। খানিকক্ষণ পর মুখ তুললাম যখন দেখলাম ঘড়ির কাঁটা একঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, আমার বইয়ের ওয়ান-থার্ড শেষ।
দুর্গা দুর্গা।
আজ অবশ্য সেই ফিল ব্যাড বইটার কথা বলছি না। সেটা থাকবে এপ্রিল মাসের বইয়ের
লিস্টে। আজ বলব সেই দুটো ইন্টারনেট বইয়ের কথা যারা আমাকে
ওই খতরনাক রিডিং স্লাম্পের অতল থেকে তুলে এনেছিল।
*****
Mr. Mercedes/ Stephen King
উৎস গুগল ইমেজেস
“I think a
writer’s notebook is the best way in the world to immortalize bad ideas.”
লেখক
হওয়ার হাউ টু লিস্টে যে উপদেশটা সর্বক্ষণ থাকে সেটা হল ট্যাঁকে সর্বক্ষণ একখানা নোটবই নিয়ে ঘোরার উপদেশ। যাতে একটিও আইডিয়া মাঠে না মারা যায়। মাথায় এল, টুকে ফেললাম। ট্রেনে বাসে দোকানে বাজারে রেস্টোর্যান্টে। আমার এক ঘনিষ্ঠ পাত্র
একবার এক ঘরোয়া কবিসম্মেলনে গিয়েছিল, সেখানে কবিরা আলোচনা করেছিলেন, তাঁরা নাকি সবাই বালিশের তলায় খাতাপেন
নিয়ে শোন, যাতে দুঃস্বপ্নে কবিতা এলেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সেটা লিখে ফেলতে পারেন। শুনেটুনে
আমিও ব্যাগে একখানা নোটবই রাখা শুরু করেছিলাম। মাসখানেক পর আইডিয়ার খোঁজে খাতা খুলে দেখি তাতে স্রেফ বাজারের ফর্দ লেখা। মাশরুম, মেথি, মৌরি, জোয়ান (সেদিন
রাতে মেনুতে নির্ঘাত আচারি মেথি ছিল)। যখন যখন মাথায় এসেছে চট করে টুকে রেখেছি।
বুঝলাম আইডিয়ার খাতা আমার চলবে না। লেখক হওয়াও হল না ভেবে মুহ্যমান হয়ে আছে
এমন সময় স্টিফেন কিং-এর একটা বক্তৃতায় শুনলাম উনি ওপরের লাইনটা বলছেন।
“I think a
writer’s notebook is the best way in the world to immortalize bad ideas.” হুট করে একখানা আইডিয়া
মাথায় এল আর সেটা
থেকে আমি
একখানা মাস্টারপিস নামিয়ে ফেললাম, ও হয় না। A good idea, কিং বললেন, is one that “sticks around,
sticks around, sticks around.”
দুহাজার
এগারো সালের বিশে এপ্রিল টিভিতে
একটা খবর শুনেছিলেন স্টিফেন কিং। সকলেই শুনেছিল। ম্যাকডোনাল্ডের ন্যাশনাল
হায়ারিং ডে ছিল সেদিন।
ক্লিভল্যান্ডের এক ম্যাকডি-র সামনে জনতা জড়ো হয়েছিল চাকরির আশায়। রিসেশনের বাজারে ভিড় হয়েছিল খুব। এমন সময়
একটা গাড়ি, গ্রে সেডান,
তাদের মধ্যে চারজনকে পিষে দিয়ে চলে যায়।
স্টিফেন
কিং-এর মাথায় ঘটনাটা গেঁথে গেল। এবং গেঁথে রইল। আর সেই ঘটনাটাকে ভিত্তি করে সাতষট্টি
বছর বয়সী কিং লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের প্রথম গোয়েন্দাগল্পখানা। গ্রে সেডান হয়ে গেল মার্সিডিজ, সত্যি ঘটনা হয়ে গেল মিঃ মার্সিডিজ নামের চারশো
ছত্রিশ পাতার জমজমাট একখানা বই।
বিল হজেস
একজন প্রাক্তন পুলিশ
ডিটেকটিভ। ডিভোর্সি। একমাত্র
সন্তানের সঙ্গে সংযোগ নেই বেশ কিছু দিন। ছ’মাস আগে অবসর নেওয়ার পর থেকে সারাদিন
শুধু টিভি দেখেন, একের পর এক রিয়্যালিটি শো। দেখতে দেখতে নিতান্ত বিতৃষ্ণাসহকারে
মদ খান, সোফার হাতলে রাখা
মদের গেলাসের পাশে একটা পুরোনো রিভলভার রাখা থাকে, সেটায় হাত বোলান।
ভাবেন, আর দেরি কেন, এবার নিজের কপালের দিকে ফিরিয়ে ট্রিগার টিপে দিলেই তো হয়।
এমন সময়
হজেস-এর নাম লেখা একটা চিঠি এল নীল খামের। চিঠিটা খুলতেও হল না, হজেস বুঝে গেলেন কে লিখেছে। তাঁর
উজ্জ্বল কেরিয়ারে একটিমাত্র
উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতার নায়ক। বেশ ক’বছর আগে শহরের মাঝখানে জব ফেয়ারের
জন্য জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্য দিয়ে মহার্ঘ মার্সিডিজের চাকার তলায় পিষে আট জনকে মেরে ফেলা মিঃ মার্সিডিজ।
মিঃ মার্সিডিজ-এর চিঠি পেয়ে মৃত্যুচিন্তা সরে গিয়ে বিলের মাথা সাফ হয়ে গেল, রক্তের মধ্যে মিশে
যাওয়া অপরাধ এবং অপরাধীকে ধাওয়া করার প্রবৃত্তিগুলো, যারা এতদিন রিয়্যালিটি টিভির
দমবন্ধ কুয়াশায় চাপা পড়ে ছিল, তারা জেগে উঠল একে একে। টিভি বন্ধ হল। পুরোনো রিভলভার, যা আরেকটু হলেই হজেসের ঘিলু উড়িয়ে দিত, ফিরে
গেল যেখানে যাওয়ার। তালাবন্ধ ক্যাবিনেটের ভেতর।
হজেসকে খুঁজে বার করতে হবে, কিন্তু গল্প শুরু হওয়ার
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জেনে গেলাম মিঃ মার্সিডিজ আসলে কে। ব্র্যাডি হার্টসফিল্ড নামের
একজন সাইকোপ্যাথ। বিল হজেস এবং ব্র্যাড হার্টসফিল্ড, দুটি মুখ্য চরিত্রকেই অসামান্য
করে ফুটিয়ে তুলেছেন স্টিফেন কিং।
সামাজিক নৈতিকতার স্কেলের দুই প্রান্তে দুজনের অবস্থান। কিন্তু আসলে দুজনে কত বেশি দুজনের মতো দেখলে অবাক হতে হয়। দুজনেই একলা, দুজনেই
অবসাদগ্রস্ত। দুজনেই যে যার কাজে অসম্ভব দক্ষ। দুজনেরই জীবনের থেকে আর কিছু পাওয়ার আশা
নেই।
চারশো
ছত্রিশ পাতা, কিন্তু পড়া শেষ হলে মনে হয় গোটা গল্পটা দু’শো
পাতার বেশি হতেই পারে না। কিং-এর হাতের তার এমনই। তবে শুরুর দিকের কিছু কিছু জায়গায়
অল্প অল্প হোঁচট লাগে, যখন কিং নিজেই নিজের ‘অন রাইটিং’-এর বলে দেওয়া নিয়ম ভাঙতে থাকেন।
বেশ কিছু জায়গায় ‘said’ ক্রিয়াপদের আগে অপ্রয়োজনীয় (আমার মতে) অ্যাডভার্ব জুড়েছেন, তাছাড়াও
কয়েকটা জায়গায় চরিত্রদের মুখে এমন সব
সংলাপ বসিয়েছেন যেগুলো পড়লেই বোঝা যায় সেগুলো স্টিফেন কিং-এর মাথা থেকে বেরিয়েছে।
নিজের মতো ছেড়ে দিলে ওই
সব পরিস্থিতিতে ওই সব লোক অত চালাক কথা বলতে পারত না।
মিঃ মার্সিডিজ নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার লিস্টে ছিল
দীর্ঘদিন, তাছাড়াও দু’হাজার পনেরো অ্যামেরিকার Mystery Writers of America (MWA)র
তরফ থেকে দেওয়া দু’হাজার পনেরোর এডগার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আমার শুরুতে সন্দেহ ছিল
যে এত পুরস্কার আর স্বীকৃতির কতটুকু মিঃ মার্সিডিজ-এর উদ্দেশ্য আর কতটুকু স্টিফেন
কিং-এর উদ্দেশ্যে, কিন্তু বইটা পড়ার পর সন্দেহ অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। তাছাড়া মিঃ
মার্সিডিজ আমাকে রিডিং স্লাম্প থেকে উদ্ধার করেছেন, বইটা যদি খুব খারাপও হত (যেটা
একেবারেই নয়) তাহলেও এর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা সমানই হত। শুনছি মিঃ মার্সিডিজ একটা
ট্রিলজির প্রথম বই, বাকি দুটো বই পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকলাম।
*****
The Alienist/ Caleb
Carr
উৎস গুগল ইমেজেস
মিঃ মার্সিডিজ-এর মাথার
ডানদিকের ছোট্ট ক্রসটায় ক্লিক
করলাম যখন তখন মার্চ মাসের একত্রিশ তারিখের সূর্যোদয় হতে
মাত্র কয়েকঘণ্টা বাকি। কিন্তু সদ্য
রোগমুক্তির আনন্দে আমি তখন চনমনে, কাজেই সময় নষ্ট না করে আমি পরের বইটা খুলে
ফেললাম। সেটা যখন শেষ হল তখন এপ্রিল মাসের তিন তারিখ হয়ে গেছে, কাজেই টেকনিক্যালি
আমার এটাকে এপ্রিল মাসের
বইয়ের মধ্যে ধরা উচিত ছিল, কিন্তু উচিত
কাজে মজা নেই।
উনিশশো চুরানবই সালে প্রকাশিত ক্যালেব কার-এর ঐতিহাসিক
রহস্য উপন্যাস দ্য এলিয়েনিস্ট-এর ঘটনাস্থল আঠেরোশো ছিয়ানব্বই
সালের নিউ ইয়র্ক শহর। সে এন ওয়াই সি-ও আজকের এন ওয়াই সি-র থেকে দেখতে অনেক আলাদা।
একদিকে চার্চ অন্যদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের সাঁড়াশি আক্রমণে শহরের নাভিশ্বাস উঠেছে। সবথেকে
বেশি ভুগছে যারা গরিব এবং বহিরাগত। ইমিগ্র্যান্টস। তাদের জীবনযাত্রা
অকথ্য। তাদের শিশুদের দেহব্যবসায় শহরের রাত জমজম করছে। পোকার মতো মরছে তারা, যখন
সুযোগ পাচ্ছে মারছেও। তাদের কথা কেউ বলছে না, সংবাদপত্রের ওপর কড়া আদেশ
রয়েছে, কোন খবর ছাপা যাবে, কোন খবর যাবে না। কেউ শিউরোচ্ছে না, কেউ চমকাচ্ছে না।
তবে একেবারেই কি চমকাচ্ছে না? চমকানোর মতো খবর হলে আলবত চমকাচ্ছে। সেরকম খবরেরও অভাব
নেই বাজারে। শহরের পুলিশ কমিশনার বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়ে এসেছে কে একজন থিওডোর রুজভেল্ট। তার আদর্শের ব্যামো রয়েছে। ডিপার্টমেন্টে দুর্নীতিদমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যার ফলে দুঁদে অফিসাররা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, পাছে তদন্তে তাঁদের ঘোটালা বেরিয়ে পড়ে। ডিপার্টমেন্ট
চলছে সব নতুন “Googoos”দের দিয়ে। শহরের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা তো খারাপ হবেই। নিন্দায় মুখর চারধার। এই হট্টগোলে আরও ভয়ানক একটা কাণ্ড
ঘটেছে, মেয়েরা ঢুকে
পড়েছে পুলিশে। সারা হাওয়ার্ড, আমাদের
বর্তমান উপন্যাসের মুখ্য মহিলা চরিত্র যেমন। সারাকে সেক্রেটারির চাকরি দিতেই রুজভেল্টকে যে ঝড়ের মুখে পড়তে
হয়েছে, সারা সত্যিকারের পুলিশ হলে যে কী হত ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে আর কেউ
জানে না, সারা নিজে জানে, ও একদিন পুলিশ হয়েই ছাড়বে। তার গোপনে প্রস্তুতিও চলছে। স্কার্টের
ভেতর সর্বক্ষণ লুকোনো থাকে সারার বন্দুক। আমাদের উপন্যাসের দুই মুখ্য পুরুষ চরিত্রের থেকে তো বটেই, নিউ ইয়র্কের পুলিশ ফোর্সের অনেক পুলিশের থেকে বেটার বন্দুক চালাতে পারে সারা।
তবে এ সবের থেকে বেশি চমকপ্রদ যিনি, তিনি আমাদের উপন্যাসের নাম চরিত্র। দ্য এলিয়েনিস্ট। ডাক্তার ক্রাইৎজলার লাজলো।
Prior to the twentieth century, persons suffering from mental illness
were thought to be “alienated,” not only from the rest of society but from
their own true natures. Those experts who studied mental pathologies were
therefore known as alienists.
লাজলো তখন সেই অদ্ভুত,
অত্যাশ্চর্য কথা বলছেন যে কথা এর আগে কেউ কখনও শোনেনি, তাই ভবিষ্যতেও শুনতে চায় না।
লাজলো বলছেন, নেচার নয়, নারচারই সব। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আচরণ, সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নাকি তার
নয়, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। ফ্রি উইল-এর সংজ্ঞায় কোপ পড়ছ, চার্চ
ক্ষেপছে। পুলিশও রাগছে, কারণ লাজলো বলছেন অপরাধীদের অত্যাচার নয়,
সংশোধনের মধ্যে রাখা উচিত। কথা কাজে পরিণত করতে নিজে সংশোধনী ইন্সটিটিউট খুলেছেন
তিনি শহরে। সেখানে বিপথে যাওয়া ছেলেমেয়েদের রাস্তা থেকে তুলে এনে রাখছেন তিনি। এবং
কী আশ্চর্য, টাকা চুরি করে ধরা পড়ে কড়িকাঠ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে বাবার বেল্টের
মার খেয়ে যাদের বিন্দুমাত্র চৈতন্য হয়নি, সেইসব অনুতাপহীন বন্য বালকবালিকার দল লাজলোর
মারহীন, ভয়হীন অভিভাবকত্বের কাছে দিব্যি পোষ মানছে। পরিবারের পবিত্র ইমেজ ছারখার
করে দিচ্ছেন এই হিদেন এলিয়েনিস্ট। ক্রিমিল্যাল ভিকটিমের সংজ্ঞা গুলিয়ে দিচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করছেন, খাটের ছত্রীতে মদের নেশায় বুঁদ
বাবার হাত পা বেঁধে খাটে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অপরাধী কে, সেই মানসিক ভারসাম্যহীন
মেয়ে, নাকি মানসিক ভারসাম্যহীনতার সুযোগ নিয়ে সেই মেয়েকে ক্রমাগত যৌনঅত্যাচার করে
যাওয়া বাবা?
এই যখন পরিস্থিতি, তখন একদিন রাত দুটো নাগাদ নিউ ইয়র্ক
টাইমস-এর সাংবাদিক জন মুরের বাড়ির দরজায় ঘা পড়ল। এই জন মুরই আমাদের গোটা গল্পটা
বলবেন। হার্ভার্ডে পড়ার সূত্রে লাজলো এবং রুজভেল্ট দুজনের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব
ছিল। দরজা খুলে মুর দেখলেন লাজলোর এক চ্যালা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক্ষুনি
জনকে সে গাড়িতে চড়ে যেতে হবে। বন্ধুর অনুরোধ নয়, আদেশ। জন গেলেন। গাড়ি তাঁকে শহরের
অন্যপ্রান্তে নিয়ে গেল। সেখানে তখন অলরেডি পুলিশ থিকথিক করছে, চিন্তিত মুখে
দাঁড়িয়ে আছেন কমিশনার রুজভেল্ট স্বয়ং। জনকে দেখে রুজভেল্ট এগিয়ে এলেন। বললেন, "দেখ কী অবস্থা।" জন দেখলেন। জনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দেখলাম।
The face did not
seem heavily beaten or bruised—the paint and powder were still intact—but where
once there had been eyes there were now only bloody, cavernous sockets. A
puzzling piece of flesh protruded from the mouth. A wide gash stretched across
the throat, though there was little blood near the opening. Large cuts
crisscrossed the abdomen, revealing the mass of the inner organs. The right
hand had been chopped neatly off. At the groin there was another gaping wound,
one that explained the mouth—the
genitals had been cut away and stuffed between the jaws. The buttocks, too, had
been shorn off, in what appeared
large…one could only call them carving strokes.
এই সবে শুরু। এর পর আরও অনেক এ’রকম মৃতদেহ বেরোবে
শহরের এখানে ওখানে। তারা সবাই বালক, তারা সকলেই দেহব্যবসায় লিপ্ত ছিল। তাদের
মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য কেউ রাজি নয়। সকলেই বলছে, "ওদের এই পরিণতি হওয়াই দরকার।
তবে যদি শিক্ষা হয়।" রুজভেল্টের হাত পা বাঁধা, সরকারি পদে থেকে এই হত্যালীলার তদন্ত
চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এটাও স্পষ্ট যে এই রহস্যের কিনারা করা নিউ
ইয়র্কের পুলিশের কর্ম নয়। চেনা গতের চিন্তা, পদ্ধতি দিয়ে এই অপরাধীকে ধরা যাবে না,
যে স্পষ্টতই বুদ্ধিমান এবং উন্মাদ। এর মোকাবিলা করতে পারেন শুধু একজন এলিয়েনিস্ট।
টিম তৈরি হল। লাজলো, জন মুর, সারা হাওয়ার্ড। আর ফরেনসিক এক্সপার্টাইজ নিয়ে এলেন
দুই পুলিশ গোয়েন্দা সহোদর মার্কাস আর লুসিয়াস আইজ্যাকসন। এঁরাও পুলিশফোর্সে অলরেডি
কোণঠাসা, বেমানান। কোথায় কে এক বিজ্ঞানী দাবি করেছে প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ
আলাদা, সেই শুনে এঁরা দাবি করছেন আঙুলের চিহ্ন নিয়ে চোরডাকাতখুনী ধরার একটা উপক্রম
করে দেখা যেতে পারে। লোকে শুধু এঁদের পাগল বলতে বাকি রেখেছে।
রুদ্ধশ্বাস তদন্তের ফল কী হল সেটা জানার ইচ্ছে থাকলে তো পড়তেই
পারেন, তাছাড়াও আঠেরোশো ছাপ্পান্ন সালে নিউ ইয়র্ক শহর কেমন ছিল সেটা জানার ইচ্ছে
থাকলেও দ্য এলিয়েনিস্ট আপনার ভালো লাগবে। আগের পোস্টেই ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর কথা
বলছিলাম, সে জিনিস কী ভাবে করতে হয় হাতে কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন ক্যালেব কার।
bes valo laglo.. apnar doulote boi na poreo bes interesting kichu golpoer khanikta kore uki mere dekha hoe jai. Duto boi e porar ecche hocche khub. bisesh kore dwitiyo boi ta.
ReplyDeleteদুটো বইই কিন্তু ইন্টারনেটে আছে, সুহানি। আপনি খুঁজে পড়তে পারেন।
DeleteEkkhuni Alienist ta Kindle ey namalam boley.
ReplyDeleteনামিয়ে ফেল, বিম্ববতী। ঠকবে না।
Deleteepub version namiye fele phone e tola hoye gechhey. Pore fellei update debo. :)
ReplyDeleteভেরি গুড, চুপকথা।
Deletechomotkar lekha hoyeche as usual , nah ei okaj tomay charbe na , oi ghurir motoi ...duikhan boktobyo ache ,
ReplyDelete1> Engriji boier eto naam dao , porar echhao hoy karon basically banglay serokom bhalo thriller nei (jkdin age chainoyodev er mrityu rohosyo niye ekta boi thriller vebe porte giye ki kharap obhighyotai na hoyeche) ...ei osukh er kono upay ache naki?
2. tumi ki Kindle byabohar koro? koto inch ar kon model?
-PB
ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত। বাংলায় ভালো থ্রিলার নেই, এই কথাটা আমারও বলতে বাধে, কিন্তু না বলে সত্যিই উপায় নেই। আমার মনে হয় লেখা হয়েইছে বড় কম। আরেকটু বেশি লিখলে বোধহয় হাত খুলে যেত। উপায় কি তো জানি না।
Deleteআমি কিন্ডল এখনও ব্যবহার করা শুরু করিনি, কিন্তু ব্যবহারের ইচ্ছেটা মনে ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। আমার খুব ইচ্ছে ওই পেপারহোয়াইটটা কেনার। এ বিষয়ে অবান্তরের অন্য বন্ধুদের যদি কোনও পরামর্শ থাকে তো দিতে পারেন। আমার আর প্রদীপ্ত, দুজনেরই উপকার হবে।
Second boi tar link dao na please. Jotin er juto r sathe reading slump r connection - ingenious.
ReplyDeleteerom period piece cum thriller r jodi die hard fan hao tale The Interpretation Of Murder by Jed Rubenfeld boi ta pore dekhte paro, na pore thakle.
Shubho Nobo Borsho by the way. Notun bangla bochhor bhalo katuk. :)
তোমারও নতুন বছর খুব ভালো কাটুক, কুহেলি। বইটার নাম টুকে নিলাম, থ্যাংক ইউ।
Deleteআমি আসলে লিংক দেওয়ার ব্যাপারে একটু ভীতু, কুহেলি। যদি কেউ এসে ধরে...তুমি দ্য এলিয়েনিস্ট ক্যালেব কার পিডিএফ অনলাইন ইত্যাদি লিখে গুগল করলেই পেয়ে যাবে।