পাড়ার প্রেম
সকাল প’নে আটটা নাগাদ, আমার দু’নম্বর আর অর্চিষ্মানের এক নম্বর চা খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ক্বচিৎ কদাচিৎ আমাদের বাড়িতে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। সেদিনও ঘটল। আমাদের পশ্চিমের দেওয়ালে ল্যাম্পশেডের নিচে গোল মুখের যে ঘড়িটা ঝোলানো আছে সেটায় প্রাণসঞ্চার হল। কাঁটা দুটো জ্যান্ত হয়ে প্রচণ্ড জোরে দৌড়তে শুরু করল। বারোটা কালো অক্ষরের খোঁদল হয়ে গেল বারো খানা ধকধকে চোখ। আর ঘড়ির ঠিক মাঝখানটা ধ্বসে গিয়ে একটা খাদের মতো হয়ে গেল, আর সেই খাদের চারধার থেকে অমসৃণ শ্বদন্তের মতো ধারালো দাঁত ঠিকরে বেরোল। ঠিক যেন ভূগোল বইয়ের পাতার ছবি। অন্ধকার, ভয়াল বোরা গুহার মুখে ঝুলে আছে স্ট্যালাগটাইট স্ট্যালাগমাইট। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আর ঠিক তক্ষুনি…
‘অ্যান্ড ইয়োর টাইম স্টার্টস নাউ!’
কীসের টাইম? আর গলাটাই বা কার? ঘড়ি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখি ঘরটা হয়ে গেছে একটা সার্কাসের তাঁবু, লালনীল দেওয়াল, মেঝে জুড়ে রঙিন আলো জ্বলছে নিভছে, এক সেকেন্ডের বেশি তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আবার একজন রিং লিডারও এসে জুটেছেন। ইনিই চেঁচাচ্ছিলেন নাকি? চেনা চেনা, কোথায় যেন দেখেছি, এক মহিলা, মেয়ে বলাই উচিত, পঁচিশের কাছাকাছি বয়স, মেকআপে মুখে অকালপক্কতার প্রলেপ পড়েছে। তাঁর হাতের দিকে তাকাই, না চাবুক নেই, তার বদলে মাইক।
মহিলা সেটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে আবার চেঁচালেন, অ্যান্ড ইয়োর টাইম স্টার্টস নাউ। উত্তেজনায় তাঁর কপালের রগ আর গলার শিরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আর অমনি মনে পড়ে গেল। এটা সার্কাস নয়, গেম শো। এঁকে আমি টিভিতে দেখেছি।
কাম অন!
আমাকে উদ্দেশ্য করেই চেঁচাচ্ছেন মহিলা। চেঁচাচ্ছেন আর ভুরু নাচিয়ে জ্যান্ত হয়ে যাওয়া ঘড়িটার দিকে ইঙ্গিত করছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি স্ট্যালাগটাইট স্ট্যালাগমাইটের সারির মধ্যে ফাঁকটা ক্রমে বুজে আসছে। আর এর মধ্যে আমার পায়ের কাছে লাল নীল হলুদ সবুজ প্লাস্টিকের বল রেখে গেছে কে, তাদের একটার গায়ে লেখা ‘টিফিন গোছানো’, একটার গায়ে 'গাছে জল দেওয়া’, একটার গায়ে 'ওষুধ খাওয়া’, একটার গায়ে ‘বিছানা তোলা’, আরেকটার গায়ে ‘চান’।
টেন…নাইন…এইট…
আমি কালক্ষেপ না করে একটা একটা বল তুলে ঘড়ির বীভৎস হাঁ-এর মধ্যে ফেলতে থাকলাম, দাঁতের সারি ধার দেওয়া ছুরির মতো চকচক করছে, 'টিফিন গোছানো' হয়ে গেছে, 'ওষুধ খাওয়া’ ডান...
সেভেন…সিক্স…ফাইভ…
দাঁতগুলো ভীষণ কাছাকাছি চলে এসেছে, মাগো। আমার মগজের মধ্যে কেউ বলল, ডেলিগেট! আমি চেঁচিয়ে অর্চিষ্মানকে 'বিছানা তোলা' আর 'গাছে জল দেওয়া’ বলগুলোর ব্যবস্থা করতে বললাম। বলে ‘চান' লেখা বলটা তুলে মুখের ভেতর ফেলতে যাব, এমন সময় টের পেলাম আমার চারপাশটা আবার দ্রুত বদলে যাচ্ছে, সার্কাসের তাঁবু বদলে ক্লাস থ্রি, এ সেকশনের ক্লাসরুমটার মতো হয়ে গেছে, তিন দেওয়ালে লোহার শিক লাগানো বড় বড় জানালা দিয়ে উদাত্ত আলো আর পেছনের পুকুরের হাওয়া আসছে, আর আমাদের ক্লাসের ‘ঊ’ আমার দুহাত দিয়ে মুখ আড়াল করে ঠোঁট প্রায় আমার কানে ঠেকিয়ে বলছে, “প্রেম কাকে বলে জানিস?”
*****
ন’মাসে ছ’মাসে এরকম ঘটে। বেমক্কা সময়ে গল্প পায়। শনিরবি সকালবেলা বা বাকি পাঁচ দিন সন্ধ্যেবেলা যখন বাড়ি ফিরে দুজনে চার কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকি তখন পেলে কোনও ঝামেলা হয় না, কিন্তু সপ্তাহের মাঝখানে সকালবেলা গল্প পেলে মহা সমস্যা। অফিস লেট।
অর্চিষ্মান বলল, ‘তুমি কী বললে?’
আমি বললাম, ‘যা সত্যি তাই বললাম। জানি না।’
ঊ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে আমার মাথায় যেটুকু ঢুকেছিল তাতে বুঝেছিলাম প্রেম মানে ভালোবাসা। ওহ, তার মানে আমি আমার ঠাকুমার সঙ্গে প্রেম করি? উঁহু। পিসির সঙ্গে? না। বাবার সঙ্গে? না রে বাবা না। তাহলে মায়ের সঙ্গে যেটা করি সেটা নির্ঘাত প্রেম? ঊ ক্ষান্ত দিয়েছিল। বলেছিল, 'আপাতত শুধু শব্দটা জেনে রাখ, কাকে বলে জানতে হবে না। ও জিনিস দেখলেই চিনতে পারবি।’
আমার সন্দেহ ছিল। স্তরীভূত শিলা কাকে বলে না জানলে স্তরীভূত শিলা দেখে চেনা যায় নাকি? বা সরলবর্গীয় বন? (ক্লাস থ্রি-তে অবশ্য আমি স্তরীভূত শিলা বা সরলবর্গীয় বন কোনওটাই শিখিনি, কিন্তু ক্লাস থ্রি-তে কী শিখেছিলাম অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না তাই এই উদাহরণই দিলাম।)
এখন সন্দেহ ঘুচেছে। ইন ফ্যাক্ট, এখন আমি এ দাবিও করতে রাজি যে পৃথিবীতে এমন যদি কোনও জিনিস থাকে যার কোনও সংজ্ঞা নেই, শুধুমাত্র উপসর্গ আছে, যা দেখে তাকে নির্ভুল চেনা যায়, তা হচ্ছে প্রেম। কত রকমের প্রেম দেখলাম, একতরফা, দু’তরফা, সফল, ব্যর্থ, হিসেব-কষা চালাক প্রেম, ভেসে যাওয়া বোকা প্রেম, নিয়ম-মানা প্রেম, নিয়ম-ভাঙা প্রেম, বৈধ প্রেম, অবৈধ প্রেম - সংজ্ঞা দিয়ে তাদের এক ছাতার তলায় আনে কার সাধ্য। কিন্তু উপসর্গ মেলালে? সব আগাপাশতলা এক ও অবিকল।
ঊ-এর এপিসোডের কিছুদিনের মধ্যেই আমার চারপাশে সে সব উপসর্গের বান ডাকল। আমার জীবনে নয়, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, আমার বন্ধুদের জীবনে। আমার পাড়ার বন্ধুরা ছিল আমার থেকে চারপাঁচ বছরের বড়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে (আসলে পেছন পেছন) আমি রোজ বিকেলে সাইকেল চালিয়ে এ গলি ও গলি ঘুরতাম, পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, ছাদে বসে তাদের জীবনের সংকটের গল্প শুনতাম। আর শুনে শুনে বুঝে গেলাম যে জীবনে সংকট বলে যদি কিছু থাকে তা হল প্রেম।
শুধু শুনলাম না অবশ্য, চোখেও পড়ল। দিদিদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরোলেই পেছন থেকে গুটি গুটি আরও কটি সাইকেল এসে জুটত। ঘুড়ি আর ঘুড়ির ল্যাজের মতো সাইকেলের মিছিল এঁকেবেঁকে চলত আমাদের পাড়ার গলি জুড়ে। দোল, সরস্বতীপুজো, পুজোয় উপসর্গ জোরদার হত।। সারাবছর যারা ধৈর্য ধরে সাইকেলে চেপে পিছু নিয়েছে, কিংবা স্কুল থেকে ফেরার সময় ঘড়ি দেখে রোদ বৃষ্টি ঝড় তুচ্ছ করে মোড়ের মাথায় উপস্থিত দিয়েছে, তাদের প্রতি দিদিদের মুখের অসীম তাচ্ছিল্যের পর্দা ভেদ করে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি ফুটত।
দেখেশুনে আমার ধারণা হয়েছিল প্রেম আসলে শিকার। ব্যাধের মতো জাল ফেলে ঘাপটি মেরে বসে থাক, আজ নয়তো কাল চিড়িয়া জালে পড়বেই। হান্ড্রেড পার সেন্ট কেসে ব্যাধ হবে ছেলেরা। তারা প্রথমে প্রেমে পড়বে , তারপর যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে তার পেছনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না মেয়েটিও উল্টে প্রেমে পড়ছে। হিন্দি সিনেমার গান দেখে এই ধারণা আরও জোরদার হয়েছিল। তবে সেটা সিনেমা তাই লার্জার দ্যান লাইফ, পাড়ার চারপাঁচজন বন্ধুর বদলে কলেজের পাঁচশো ছেলে ছেলেটির বন্ধু, এবং পাঁচশো জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে একটি মেয়েকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে প্রেমের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। মেয়েটির মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে না যে সে ছেলেটির প্রেমে পড়েছে, উল্টে ভয়ের চিহ্নই প্রকট, কিন্তু ঘাবড়াও মৎ, ভয় উড়ে গিয়ে প্রেম জাগা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এইরকম শিকারের কায়দায় প্রেমের বহু নমুনা দেখেছি পরবর্তী জীবনে, কিন্তু প্রথম যেটা দেখেছিলাম সেটা সবথেকে বেশি মনে আছে। আমি তখন ফাইভ কিংবা সিক্স। অষ্টমী কি নবমীর রাত। যাঁরা ম্যাডক্স স্কোয়্যার কিংবা একডালিয়ার প্যান্ডেলে ঘুরে বড় হয়েছেন, তাঁদের চোখে অষ্টমী নবমীর রাতের যে ছবিটা আছে, আমার ছোটবেলার অষ্টমীনবমীর রাতের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। আলো বলতে প্যান্ডেলের টিউবলাইট। একশো গজ দূরে তার আলো পৌঁছয় না। বাকি সারা পাড়া অন্ধকারে ঢাকা। স্ট্রিটলাইটের ঝামেলা নেই, মাঝে মাঝে কোনও বাড়ির টিভির পুজো পরিক্রমার যেটুকু নীল আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে, শুধু সেইটুকু।
ঘটনার সময় আমি আরও দু’চারজন দিদির সঙ্গে পাড়ার দাদাদের দেওয়া স্টলে কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে অমলেট খাচ্ছিলাম। এমন সময় আরেকজন দিদি, ধরা যাক তার নাম ম, ছুটতে ছুটতে এসে বলল, জানিস, ওরা স কে ধরেছে।
ওরা কারা? ত আর ত-এর দলবল। ত কে আমরা সকলেই চিনতাম। এই স দিদির পেছনে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে ঘোরাঘুরি করছিলেন, অবশেষে এই অষ্টমীর রাতে অ্যাকশন নিয়েছেন।
ধরল কোথায়? মোড়ের মাথায়। কোন মোড়? সরকারবাড়ির মোড়। স আর ম ওপাড়ার ঠাকুর দেখে ফিরছিল, ওদের পুজোর বাজেটেরও আমাদেরই দশা, টিউবলাইট সম্বল। সরকারবাড়ির মোড় হচ্ছে একটা তেমাথা, তার একদিকে পরিত্যক্ত জঙ্গল, অন্যদিকে একটা কাঁচা গলির মুখে বন্ধ হওয়া মুদির দোকান আর অন্যদিকে সরকারবাড়ি। সে বাড়ির লোক সেজেগুজে খানিকক্ষণ আগেই শ্রীরামপুরে ঠাকুর দেখতে গেছে আমরা সবাই দেখেছি, কাজেই কেউ টিভিতে পুজো পরিক্রমা দেখছে না। অর্থাৎ মোড় নিকষ অন্ধকার।
এই মুহূর্তে অন্ধকার মোড়ের মাথায় একটি মেয়েকে চারপাঁচটি ছেলে ঘিরে ধরার খবর পেলে আমি চেঁচিয়ে লোক জোগাড় করে লাঠিসোঁটা সহ সেদিকে ছুটে যেতাম, কিন্তু তখন কোনওরকম মনে হেলদোল জেগেছিল বলে মনে পড়ে না। আমি নির্বিকার মুখে অমলেট খেতে লাগলাম, সঙ্গী দিদিরা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বিপদের আশংকায় নয়, আসন্ন প্রেমের গন্ধ পেয়ে। ম ততক্ষণে একটু শান্ত হয়েছে। তার কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা শোনা গেল। ওরা নাকি ওপাড়ার প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে মোড় ঘুরেছে, আর অমনি তিনচারটে সাইকেল চেপে পাঁচছ’টা ছেলে এসে ঘিরে ধরেছে। অন্ধকারে প্রথমটা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু গলা শুনে বোঝা গেল তারা ত-এর দলবল। সাইকেল থেকে নেমে তারা ম আর স-কে ঘিরে দাঁড়াল, গম্ভীর গলায় বলল, 'দাঁড়াও, কথা আছে।' তারপর ত-এর একজন স্যাঙাৎ ম-কে বলল, 'তোমার সঙ্গে কথা নেই, তুমি যাও।'
এখন মনে হয়, ম-দিদির কি আঁতে লেগেছিল? হয়তো। হয়তো নয়। আমাকেও দুয়েকবার আমার থেকে আকর্ষণীয় এবং সুন্দরী বন্ধুদের প্রেমের দূতীগিরি করতে হয়েছে, কিন্তু আমি তাতে খুব একটা ক্ষুণ্ণ হয়েছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো হতাম, যদি সেই প্রেমিকদের প্রতি আমার কোনও টান থাকত। কপালগুণে সেরকম প্যাঁচালো পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি।
পাড়ার প্রেমের বাজারে একটা কমন ঘটনা ছিল গৃহশিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেম। গানের মাস্টারমশাই, নাচের মাস্টারমশাইরাও এ ব্যাপারে কিছু কম যেতেন না। আর একদলের বাজার এই দু’দলের থেকেই তেজী ছিল। যদিও তাঁরা টেকনিক্যালি মাস্টারমশাই ছিলেন না। আর সেজন্যই বোধহয় কেউ তাঁদের কেউ মাস্টারমশাইদের প্রাপ্য সৌজন্য দেখাত না। গ্রিলের গেটে আওয়াজ হলে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলত, 'অ্যাই বুড়ি, তোর তবলচি এসেচে, দরজা খুলে দে।’
এই তবলার মাস্টারমশাই-ছাত্রীর প্রেমসংক্রান্ত একটি রোমহর্ষক প্রেমের ঘটনা আমাদের পাড়ায় ঘটেছিল। আমার এক চেনা মেয়ের গানের সঙ্গে সঙ্গত করতে তবলার মাস্টারমশাই আসতেন। স্যান্ডো গেঞ্জির লেবেলটা পর্যন্ত পড়া যায় এমন ফাইন আদ্দির পাঞ্জাবি পরে, ঘাড়ে নাইসিল ছিটিয়ে। পরিণতি যা হওয়ার হল। স্কুলে যাতায়াতের পথে, বিকেলবেলা লাইব্রেরির রাস্তায় আচম্বিতে তবলার দাদার সঙ্গে মেয়েটির দেখা হয়ে যেতে লাগল। নিজের প্রেম বাছার ব্যাপারে আমি একটি আস্ত পাঁঠা হলেও অন্যের প্রেমের গুণবিচারে আমি চিরকালই নিখুঁত। তবলাদাদাকে আমার মোটেও সুবিধের লাগত না। বলাই বাহুল্য, আমার মত আমি নিজের মনেই রেখেছিলাম, মেয়েটিকে বলিনি। বললেও কাজে দিত না, মাঝখান থেকে বন্ধুত্বটি মাটি হত। বেশ ক’দিন পর প্রেমের চোটে যখন আমার বন্ধুর নাওয়াখাওয়া পড়াশুনো মাথায় উঠেছে, একদিন স্কুল থেকে ফিরে সিঁড়ির তলায় সাইকেল রেখে 'মা খেতে দাও', বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে সে থমকে গেল। বসার ঘরে লোক থই থই, সলজ্জ মুখে তবলাদাদা দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই সবাই হই হই করে উঠল। মেয়েটির বুক ধক করে উঠল, তাহলে কি সবাই জেনে গেছে? তারপর চোখে পড়ল দাদার পাশে দাঁড়ানো ছোটমাসির লজ্জারাঙা মুখ। মেয়েটির মনে পড়ে গেল, ছোটমাসির রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে সঙ্গত করতেও তো আসেন দাদা। সকালে ছোটমাসির রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে, বিকেলে বোনঝির ক্ল্যাসিক্যালের সঙ্গে সঙ্গত করার এমন ভার্সেটাইল তবলচি পেয়ে বাড়ির লোক তো বর্তেই গিয়েছিল। জানা গেল, সঙ্গতের তলে তলে সম্পর্ক অনেকদূর গড়িয়েছে, এখন দাদা এসেছেন বাড়ির বড়দের কাছে ‘মেসো’ হওয়ার অনুমতি চাইতে। অনুমতি পেতে কোনও অসুবিধেই হল না। আমি যদ্দূর জানি, এখনও আমার বন্ধুটি ফি বিজয়ায় লোকটাকে ‘ছোটমেসো’ ডেকে প্রণাম করে।
সব প্রেমের অবশ্য এরকম করুণ পরিণতি হত না। বেশিরভাগ গুরুতর হতে না হতেই মিলিয়ে যেত, যেগুলো যেত না সেগুলো বিয়েতে পর্যবসিত হত। অল ইজ ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল। যেমন ওপরের ত আর স-এর প্রেম। আগের বার বাড়ি গিয়ে দেখলাম মেয়ের হাত ধরে স-দিদি ঊর্ধ্বশ্বাসে টিউটরের বাড়ি ছুটছেন। মেয়েটির মুখ একেবারে ত দাদার মুখ কেটে বসানো। তাই গার্জেনরা এগুলো নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন না। ক্বচিৎ কদাচিৎ গৃহত্যাগের ঘটনা ঘটত, সে নিয়ে কিছুদিন পাড়ার মোড়, রক সরগরম থাকত, তারপর দিন দশেক বাদে পাত্রপাত্রী ফিরে এলে সবাই সবকিছু ভুলে তাদের মহাসমারোহে বরণ করে নিত। পরে যে শ্বশুরশাশুড়ি নিজের নিজের পুত্রবধূ/ জামাইয়ের গুষ্টির তুষ্টি করেছিলেন, তাঁরাই বলে বেড়াতেন অমন ভালো বউ/জামাই আর কারও হয় না।
বড়দের প্রেমের বেলা অবশ্য এত সহজে ছাড় হত না। কারণ বেশির ভাগ বড়দের কাছেই একটিমাত্র রকমের প্রেমের রাস্তা খোলা থাকে, অবৈধ প্রেম। যেহেতু নিজের ক্ষুদ্র বৃত্তে ঘটতে দেখিনি তাই অনেকদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল যে অবৈধ প্রেম ব্যাপারটা শুধু নাটকনভেলেই হয় আর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা মদ খায় না। দুটো ভুলই ভেঙেছে, কিন্তু প্রথমটা ছোট থাকতে থাকতেই ভেঙেছে। পাড়ায় দু’জন দিব্যি গোলগাল, নাদুসনুদুস, নাড়ুগোপালের মতো দেখতে প্রতিবেশী ছিলেন, তাদের একজনকে আমি কাকু ডাকতাম অন্যজনকে জেঠু। তাদের দুজনেরই সুন্দর পাকা বাড়ি ছিল, সে সব বাড়ির দেওয়ালে বছর বছর হলুদ, গোলাপি, হলুদ রঙের পোঁচ পড়ত, ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে ক্লাসে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠত, কাকিমা আর জেঠিমা খোঁপায় গোড়ের মালা পেঁচিয়ে র-সু-ন জয়ন্তীতে 'দারুণ অগ্নিবাণে রে’ আর বিজয়া সম্মিলনীতে 'এবার নবীন মন্ত্রে হবে’ কোরাস গাইতেন। কাকু আর জেঠু ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে গান শুনতেন, ছেলেমেয়েরা রান-এ জিতে লাল গামলা উপহার পেলে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতেন। কারও জীবনে প্রেমের অভাব আছে বলে সন্দেহ হয়নি কখনও। তারপর জানা গেল, অভাব তো নেইই, বরং কিঞ্চিৎ বাহুল্য আছে। দুজনেরই নাকি দ্বিতীয় আরেকটি করে সংসার আছে অন্য কোথাও। সে সব সংসারে তাঁরা নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। শুনে আমাদের পাড়াটা কেমন থম মেরে গিয়েছিল ক’দিনের জন্য। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। অচিরেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল। কাকু এবং জেঠু আগের মতোই অফিসকাছারি করতে লাগলেন, ছেলেমেয়ের স্পোর্টসের লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিতে লাগলেন। কিছুদিন পর তাঁদের ঘিরে যে কোনও একটা স্ক্যান্ডাল হয়েছিল সেটা মনে করতেও স্মৃতিশক্তির ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হত।
যে স্ক্যান্ডালটা থিতোলো না তার কেন্দ্রে ছিলেন একজন কাকিমা। অনেক অনেক কাল আগে তাঁর ছোটছোট ছেলেমেয়েকে আমার পিসি পড়াতে যেতেন, সেই সূত্রে কাকিমাকে আমি মুখ চিনতাম। সেই ছেলেমেয়ে যখন বড় হয়ে গেল, একদিন খবর পাওয়া গেল, ছেলের কলেজে পড়া বন্ধুর সঙ্গে কাকিমা গৃহত্যাগ করেছেন। কাকুর বয়স সাতদিনে যেন সাতবছর বেড়ে গেল। শিক্ষিতভদ্রলোকমন্ডিত আমাদের পাড়ায় কেউ মুখের ওপর কিছু জিজ্ঞাসা করত না, খালি কাকু কিংবা কাকিমার ছেলেমেয়েরারাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চুপ করে যেত। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারত। বছর দুই বাদে কাকিমা বাড়ি ফিরে এলেন। কাকুর উদ্দেশ্যে সারা পাড়ায় ধন্য ধন্য রব উঠল। এত কিছুর পরেও তিনি কাকিমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছেন। কাকিমার ছেলের প্রতি সারা পাড়ার শ্রদ্ধায় সারা পাড়ার মাথা নিচু হয়ে এল। কাজের লোকে খবর এনেছে, সে মায়ের হাতের জল পর্যন্ত ছোঁয় না। কাকিমা আর কোনওদিন দেখিনি। তিনি বাড়ি থেকে বেরোতেন না। ক'বছর আগেকার সেই কাকিমা আর জেঠিমাকেও আর কোনওদিন পাড়ার ফাংশানে গান গাইতে দেখিনি।
*****
এত সব গল্পগাছা করে অফিস যেতে সেদিন ঝাড়া আধঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই আধঘণ্টায় যা মজা হয়েছিল আড়াইশো দিন টানা অফিস করলেও তার এককণা হয় না, কাজেই নো আফসোস।
ei lekhati khub mojar hoyechhe. aar chhotobelar dingulo hothat chokher samne bhese uthlo...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা।
Deleteদেখেশুনে আমার ধারণা হয়েছিল প্রেম আসলে শিকার। ব্যাধের মতো জাল ফেলে ঘাপটি মেরে বসে থাক, আজ নয়তো কাল চিড়িয়া জালে পড়বেই।
ReplyDeleteSadhu, sadhu. :D
ধারণাটা ঠিক কিনা বল, বিম্ববতী?
DeleteLekhata khub bhalo tobe pore tomar sei na-dekha kakima jethimader jonya khub kharap laglo.
ReplyDeleteআমারও খারাপ লাগে, চুপকথা।
Deletekhub bhalo laglo,chotobelar je kono lekhai porte baro bhalo lage..etao khub bhalo laglo..
ReplyDeletetumi aadh ghontay eto information die dile?..tarpor office late hoy ni..e hevy mosti lage na eisob holbol galpo korte..gujur gujur kore sotyi time hushus kore beriye jay..
prosenjit
বেমক্কা সময়ে গল্প পায়।
ReplyDeleteguru tumi guru..khide pay,ghum pay,serom kore kothata babohar korecho..aar information tao hok kotha ekkere..se galpo na bolle sei muhurte kirom kirom hote hote thake...jomiye acting kore se galpo gulo bolar majai alada..
prosenjit
prosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎ। ঠিকই বলেছ, প্রিয়জনের সঙ্গে ছোটবেলার গল্প করার মজাই আলাদা।
ReplyDeleteBah .....
ReplyDeleteধন্যবাদ।
DeleteEisob bepare ami akjon active participant chilam borabor. Perpetual okalpokko kina.
ReplyDeleteতাই নাকি? ভেরি গুড, কুহেলি। পাকতে যখন হবেই তখন খামোকা সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
Delete