গুলাটি, পাণ্ডারা রোড
প্রায়ই অফিস যাওয়ার পথে বলে, কখনও সখনও অফিসে পৌঁছে চ্যাটবাক্সে বলে, মাঝে মাঝে চা খেতে খেতে আর টিভি দেখতে দেখতে বলে, আর যে সব রাতে বাদশাহী আংটি চালিয়ে ঘুমোতে যাওয়া হয় সে সব রাতে তো উইদাউট ফেল অর্চিষ্মান কথাটা বলে।
বলে, ওর নাকি লখনৌ যেতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ, মারাত্মক ইচ্ছে।
আমি শুনি। ওর ইচ্ছেপূরণের উপায় ভাবি। কিন্তু পূরণের আগে চাই বিশ্লেষণ। কারণ একেকটা ইচ্ছের একশোখানা করে পরত। একেবারে মূলের ইচ্ছেটা খুঁড়ে না বার করলে ওপর ওপর যত ইচ্ছেই পূরণ হোক না কেন, মন ভরবে না। এক শনিবার সকালে অর্চিষ্মানের ইচ্ছেটাকে নিয়ে বসি।
লখনৌ যাওয়ার ইচ্ছেটার মানে ঠিক কী? ভোরবেলা শতাব্দীর চেয়ার কারে জানালার ধারে বসে আকাশবাতাস দেখার ইচ্ছে? ইমামবাড়ার প্রকাণ্ড হলঘরের ওই দেওয়ালে দেশলাই ঘষে জ্বালালে এই দেওয়ালে কান পেতে তার প্রতিধ্বনি শোনার ইচ্ছে? সূর্য ওঠার আগে রেসিডেন্সির মাঠে কুয়াশার সমুদ্র থেকে অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ জাগানো গাছেদের মধ্যে ঘোরাঘুরির ইচ্ছে? ভাঙাচোরা ইমারতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেওয়াল টপকে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ে প্রেমিকপ্রেমিকাদের ভ্রূকুটির মুখে পড়ার ইচ্ছে?
এসব ইচ্ছে মেটাতে হলে ছুটির ব্যবস্থা করতে হয়। ট্রেন, হোটেল বুক করতে হয়। ব্যাকপ্যাক গোছাতে হয়।
আর যদি ইচ্ছেটা অন্য কিছু হয় তাহলে এত হাঙ্গামা না করলেও চলে। আমি আমার সন্দেহটাকে প্রকাশ্যে আনি।
লখনৌ যেতে ইচ্ছে করছে কি কাবাব খেতে ইচ্ছে করছে বলে?
অমনি সব অবান্তর আভরণ খসে পড়ে। লখনৌ নয়, অর্চিষ্মানকে ডাকছে আসলে কাবাব। মিহি বাটা কচি পাঁঠা/ভেড়ার মাংসে একশো আট রকম মশলা মিশিয়ে হাতের আলতো চাপে গড়া ছোট ছোট গলৌটি কাবাব, দন্তহীন নবাবের মাড়ির চাপে যা নিমেষে গলে যাবে, সেই কাবাব শয়নে স্বপনে ওকে নিশিডাক ডাকছে।
প্রায় পৌঁছে গেছি, কিন্তু আমার মন বলছে পথ আরও খানিকটা বাকি আছে, আমি জেরা থামাই না।
লখনৌয়র কাবাব মানে কি লখনৌয়েরই কাবাব? সেই গলির ভেতর গলি, সেই দেওয়ালে টুন্ডের ফ্রেমবাঁধানো ছবি, সেই মেঝেতে জমা জলে ভাসন্ত কুরকুরের প্যাকেট, ঝাঁটানো মুলতুবি রেখে সেই হাতেই এনে দেওয়া রুমালি রুটি? নাকি যে কোনও কাবাব, ভালো কাবাব? তাহলে সে রকম কাবাব আমাদের দিল্লিতেই পাওয়া যাবে। অবশ্য লখনৌয়ের গলির ভেতর বসে কাবাব খাওয়ার থ্রিল থাকবে না, লখনৌয়ি রাঁধুনিদের থেকে হাতের তারও আলাদা হবে। চলবে?
দৌড়বে।
ভাবুন একবার। আরেকটু হলেই আমরা কাজ ফেলে, বসের ভ্রূকুটি মাথায় নিয়ে, ছুটির স্টক কমিয়ে, ব্যাংক ব্যালেন্স হালকা করে লখনৌতে হাজির হচ্ছিলাম। যখন ইচ্ছেপূরণ হতে পারে এক বেলাতেই। একটি মাত্র অটো চড়েই।
এবার শুধু ঠিক করতে হবে ইচ্ছেপূরণের ভেনু। রাস্তার ধারে প্লাইউডের টেবিলে স্টিলের প্লেট থেকে ফাইভ স্টার, বিকল্প অগাধ। যেখানে খুশি আপনি কাবাব খেতে পারেন। তর্ক করতে পারেন কোনটা অথেনটিক, কোনটা মেল্ট ইন মাউথ। মত মেলার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
আমরা বাছলাম গুলাটি। পাণ্ডারা রোড মার্কেটে উনিশশো ঊনষাট থেকে চলছে গুলাটি। ছেলেমেয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট উদযাপন করতে লোকে যখন বছরে একবার বাইরে খেতে যেত তখনও গুলাটি ছিল, এখন যখন সপ্তাহে সাতদিন আলাদা আলাদা দোকানে খেয়েও জোম্যাটোর লিস্ট ফুরোয় না, এখনও গুলাটি আছে।
সাড়ে বারোটা নাগাদা দোকানে ঢুকে কোণার দিকের একটা টেবিল ফর টু দখল করলাম। চারপাশের আবহাওয়া সাবেকি ও গম্ভীর। লাল চামড়ার নিচু সোফা। বেজ রঙের দেওয়াল। আড়ালে আবডালে রাষ্ট্রপতি ভবনের এবং দেওয়ালের ছবি। ইন্সট্রুমেন্টে নিচুগ্রামে বাজছে পুরোনো দিনের হিন্দি গানের সুর।
গুলাটির আসল অলংকরণ। গত প্রায় ষাট বছর ধরে জোগাড় করা সার্টিফিকেটস।
আমরা ঠিক করলাম সব খাব। শোরবা থেকে ডেজার্ট। শোরবা ব্যাপারটা অনেকেরই ব্ল্যান্ড লাগে। আমরা দুজনেই ভালোবাসি।
চাট মশলা দেওয়া ভার্জিন মোহিতো আর কোকা কোলা নিয়ে আমরা আসর সাজিয়ে বসেছি। এবার শুধু তাঁর আসার অপেক্ষা।
তিনি এলেন। গলৌটি কাবাব। এত নরম যে প্লেটে অখণ্ড তোলা যায় না। গলৌটি কাবাব বানানো হয়েছিল দাঁত পড়ে যাওয়া নবাবের ভোগস্পৃহা মেটানোর জন্য। জিনিসটা বেসিক্যালি মাংসের পেস্ট। অর্চিষ্মানের দারুণ পছন্দের।
কাবাব খেতে গেছি বটে কিন্তু গুলাটির বিখ্যাততম খাবার হচ্ছে বাটার চিকেন। সাধারণত বাটার চিকেনকে আমরা ভয়ংকর নিচু চোখে দেখি। কখনও কোথাও অর্ডার করি না। কিন্তু গুলাটির অর্ধেক অ্যাওয়ার্ডের আসল হকদার হচ্ছে গুলাটির বাটার চিকেন। সেটা হাফ সাইজ অর্ডার করা হল। সঙ্গে মিরচ কা পরাঠা।
ভুল করিনি। গুলাটির মুর্গ মাখানি আমার খাওয়া অন্যতম সেরা বাটার চিকেন। চিকেন তো ভালোই, দেখার মতো হচ্ছে ঝোলখানা। সার্থকনামা। মাখনের মতো মসৃণ। মুখে দিলে বোঝা যায় ব্যাপার অতি জটিল। টক ঝাল মিষ্টি উমামির প্যাঁচের ওপর প্যাঁচ, কিন্তু সে প্যাঁচ এত মিহি যে কোনওখানটা জেগে থাকে না।
গুলাটির পোর্শন সাইজ আমাদের পক্ষে বাড়াবাড়ি রকম বেশি। শোরবা আর বোম্বাই সাইজের গলৌটি কাবাবেই থেমে গেলেই যথেষ্ট হত, তার ওপর লংকার পরোটা আর বাটার চিকেন। খেতে খেতেই বোঝা গিয়েছিল যে এর পর ডেজার্ট খাওয়া অসম্ভব। মনস্থির করে মশলা মুখে ফেলে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়েই দেখলাম গুলাটির গা ঘেঁষে দাঁড়ানো কৃষ্ণা দি কুলফি। মুখচোরা ছোটখাটো চেহারা, হাতে লেখা মেনু দেওয়ালে সাঁটা, আলো আঁধারি অভ্যন্তরে সারি সারি বড় বড় স্টিলের কুলার। দেখলেই সন্দেহ হয় ভেতরে ভালো জিনিস লুকোনো আছে।
কিনতেই হল একটা কেসর পিস্তা কুলফি। কম মিষ্টি, মিহি ঘন দুধের জমাটবাঁধা গায়ে গাঁথা অসংখ্য পেস্তাকুচি। যে কোনও ভালো জিনিসের, গান, বই, কাবাব কিংবা কুলফি, যাই হোক না কেন, একটা প্রধান প্রমাণ হচ্ছে সেটা আপনার ভেতরটাকে পরিষ্কার করে দিল কি না। একটা ভালো বই পড়ে, একটা ভালো গান শুনে আপনি পরের আধঘণ্টা অন্তত কারও খারাপ চাইতে পারবেন না, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনার দৃষ্টিটা অনেক বড় হয়ে যাবে। জীবনের ছোটখাটো হিসেবগুলো না মিললেও গায়ে লাগবে না। গুলাটির কাবাব আর কৃষ্ণা দি কুলফি সে পরীক্ষায় পাস। ভাইসাব মিটারের থেকে অন্তত তিরিশ টাকা বেশি চাইছেন জেনেও দরাদরি করতে ইচ্ছে করল না। ভালোই হল। ভাইসাব সারা রাস্তা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এলেন। শুনতে শুনতে আমাদেরও পথটা হুস করে ফুরিয়ে গেল, গরম গায়েই লাগল না।
haha besh besh bhalo legeche :)
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteAmar o Lucknow abar jawar icche ache ... oi khabar ar shopping er jonne. Ekhane bhalo butter chicken pawa jayena ... sesh Delhi te i kheyechilam def col e kono ek restaurant e.
ReplyDeleteদিল্লিতে আবার বড় বেশি বাটার চিকেন পাওয়া যায়, শর্মিলা। কোনওখানেই শান্তি নেই।
Deleteএই খবরগুলিই হল কুন্তলা সুন্দরীর আসল সিগ্নেচার। সঙ্গে আছে ভ্রমণ কাহিনী এবং ইতিহাসের গল্প পরিবেশনের অনবদ্য ভঙ্গী। বাকি সব গুরুগম্ভীর গদ্য-পদ্য কাহিনী? আমার গলা শুকিয়ে যায়। আজ মনে হল, বারিধারায় স্নাত হলাম।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, মালবিকা। অনেকদিন পর কথা হল, ভালো আছেন আশা করি।
DeleteEta darun lekha. Porei kemon jani khidhe khidhe peye gelo. Amaro Lukhnow jaoar sadh Kebab er karoneo.
ReplyDeleteলখনৌ কি গেছেন কখনও, সায়ন? না হলে টু গো লিস্টের প্রথমে রাখুন।
Deleteলেখাটা খুব ভালো লাগলো,এই অংশটা তো দুর্দান্ত - 'যে কোনও ভালো জিনিসের, গান, বই, কাবাব কিংবা কুলফি, যাই হোক না কেন, একটা প্রধান প্রমাণ হচ্ছে সেটা আপনার ভেতরটাকে পরিষ্কার করে দিল কি না। একটা ভালো বই পড়ে, একটা ভালো গান শুনে আপনি পরের আধঘণ্টা অন্তত কারও খারাপ চাইতে পারবেন না, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনার দৃষ্টিটা অনেক বড় হয়ে যাবে। জীবনের ছোটখাটো হিসেবগুলো না মিললেও গায়ে লাগবে না।'
ReplyDeleteহক কথা একেবারে।
ধন্যবাদ, আরাফ।
DeleteEtai likhte jachhilam! Ki bhalo!
Deleteধন্যবাদ, কোয়েল।
DeleteEkdom khandani biboron. Sudhu kulfi r chobitao jodi petum.
ReplyDeleteTomar eii signature specimen gulo niye ii j bund hoye thaki.
ধন্যবাদ। কুলফিটা এত দ্রুত গলে যাচ্ছিল যে ছবি তোলার থেকে খাওয়ার দিকেই মন দিতে হল বেশি।
DeleteUff tomar lekhagulo porle mone nijei samne bose achhi. chokher samne ekdom dibbyi dekhte pelam Gulatir certificate bhora dewal, halka ganer sur r butter chicken, gulati, sorba, parota melano meshano gondho..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, চুপকথা।
Deleteguru tomar na jaundice hoechilo
ReplyDeleteekta tarapodo ray er quote dichchi
Deletedakh mahima mad er bishoye ami daktar er kono poramorsho nebo na,kakhano bhebe dekhechis prithibite jato buro daktar ache,tar chaite onek beshi buro matal ache...
dui mataler galpo...btw ei boita suggest korchi..zata boi zata..metal samagra ta better,ei galpo gulo all included
hooh..ar toamke to daktar char dieche..to..
besh korecho kheyecho...are amar e mone hochche monitor ta kheye feli..lucknow ami jai ni knodin..kintu jaboi..ei galouti kabab na khele jibon tai britha..
prosenjit
Kolkata asle oudh 1590 te obossoi kheyo..eto valo lucknowee khana kothao khaini..gele galauti kebab r runn biriyani obossoi kheyo
ReplyDeleteএই দোকানটার নাম শুনেছি, অঙ্কনা। সাজেশনের জন্য ধন্যবাদ। পরের বার কলকাতা গেলে টু ডু লিস্টে থাকবে।
DeleteOhh pore jibe jol ese gelo.
ReplyDeleteAmi tomake Oudh 1590'r suggestion ditei jacchilam.