সাত থেকে এগারো
৭ই অক্টোবর, ২০১৬
আড্ডা। ফিশ ফ্রাই, ভাত, নারকেল দিয়ে ডাল, তরকারি, পাঁঠার মাংস এবং উমদা পায়েস। সৌজন্যে, সহৃদয় বন্ধু। সামনে চার-চারটে ছুটির দিন গা এলিয়ে পড়ে আছে। আজ রাতে যেমন ঘুম হবে তেমন অনেকদিন হয় না।
৮ই অক্টোবর, ২০১৬
সি আর পার্কের বাইরের পুজোর কোটা পূরণ করতে আগের বার গিয়েছিলাম কাশ্মীরী গেট, এ বার ফরিদাবাদের চার্মউড ভিলেজ। ভেতরে তখন উলুধ্বনি আর শঙ্খ প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। এই যে নাম দিতে চাওয়া অথচ লজ্জা পাওয়া প্রতিযোগীদের মাইকে চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, তারা বলছেন, তুমি যদি যাও তো আমি যেতে পারি, সেক্রেটারি আর প্রেসিডেন্ট হলে জীবনে শাঁখে ফুঁ দাও আর না দাও নাম দিতেই হবে, চাঁদা তোলা আর ডেকরেটর ডাকার দায়িত্বের সঙ্গে এটাও একটা দায়িত্ব, তবে এক্সট্রা হাততালি গ্যারান্টিড, শেষমেশ যে পাড়ার নিরীহ আর মুখচোরাতম কাকিমা, হাসি ছাড়া যার গলা দিয়ে দ্বিতীয় শব্দ বেরোয়নি কখনও, তিনি "কী সোনা, রেজাল্ট কেমন হল?" বলে রাস্তার ওপার থেকে চেল্লানো কনফিডেন্ট কাকিমার সাত সেকেন্ডের মাথা মুড়িয়ে সতেরো সেকেন্ড শাঁখ বাজিয়ে প্যান্ডেল মাত করে যাবেন, এই সব দেখতে আমার দারুণ লাগে। এই যে মণ্ডপের ভেতরের লোকেরা একে অপরকে চেনে, এইটা আমি বড় পুজোয় মিস করি। ছোটবেলায় কলেজ স্কোয়্যার আর মহম্মদ আলি পার্ক দেখে এই প্রশ্নটা আমাকে চিন্তিত করত। এ পাড়ার লোকগুলো কোথায়? তারা চেয়ার পেতে বসে নেই কেন মণ্ডপে?
সি আর পার্কের পুজোর একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে একবার বেরোলে খানআষ্টেক দেখে ঢোকা যায়। এ সব দিকে সেটা অসুবিধে। শাড়িমাড়ি পরে ট্যাক্সি করে গিয়ে একটা ঠাকুর দেখে ফিরে আসা, মনের মধ্যে খোঁচা দিতে থাকে অকৃতজ্ঞের মতো। পরিশ্রম আর পয়সা উশুল হল তো? কিন্তু যদি ভাবি যে নতুন জামা পরে অর্চিষ্মানের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি, তাহলে আফসোসটা থাকে না। অচেনা রাস্তার ওপর ঝুঁকে পড়া অচেনা গাছ, গাছের ওপারেও গাছ, বাড়ি অফিস দোকান নয়। চলতে চলতে হঠাৎ তুঘলকাবাদ ফোর্টের প্রকাণ্ড ভাঙাচোরা দেওয়াল। এতদিন দিল্লিতে থেকে এখনও দেখা হয়নি। শিগগিরি এ ভুল শোধরাতে হবে।
৯ই অক্টোবর, ২০১৬
বাড়িতে ফোন করে ঠাকুমা হুইলচেয়ারে চেপে পাড়ার মণ্ডপে অঞ্জলি দিতে গেছেন শুনে নিজে যাওয়ার থেকেও ভালো লাগল। একটা সময়ের পর থেকে স্নেহ ঊর্ধ্বগামী।
সারা সকাল আরাম করে শেষ দুপুরে আমরা গেলাম জুলফিকর দেখতে। শ্রীজাত যদি অ্যাকটিংটা করবেন বলে ঠিক করেন, তাহলে জটায়ুর চরিত্রে অডিশন দিতে শুরু করতে পারেন। চেহারার দিক থেকে অন্তত কাস্টিংকে কেউ গালি দিতে পারবে না। সিনেমা দেখে বেরিয়ে ইরানি রেস্টোর্যান্টে স্যালাড অলিভিয়ে, চেলো কাবাব, চায়ের সঙ্গে খেজুর টা।
সারা সকাল আরাম করে শেষ দুপুরে আমরা গেলাম জুলফিকর দেখতে। শ্রীজাত যদি অ্যাকটিংটা করবেন বলে ঠিক করেন, তাহলে জটায়ুর চরিত্রে অডিশন দিতে শুরু করতে পারেন। চেহারার দিক থেকে অন্তত কাস্টিংকে কেউ গালি দিতে পারবে না। সিনেমা দেখে বেরিয়ে ইরানি রেস্টোর্যান্টে স্যালাড অলিভিয়ে, চেলো কাবাব, চায়ের সঙ্গে খেজুর টা।
পেটে যেটুকু জায়গা বাকি ছিল তাতে রাতে আরেকবার চা খাওয়া যেত। বিস্কুট দিয়ে খেলেও হয় কিন্তু অষ্টমী বলে কথা। অর্চিষ্মান গেল রাবড়ি আনতে। ফিরে বলল, রাস্তা জুড়ে থিকথিক করছে ভিড়। কে কী বিক্রি করবে ভেবে উঠতে পারছে না। চেনা ঝালমুড়িওয়ালা বিরিয়ানি বিক্রি করছে, বিরিয়ানিওয়ালা এগরোল, এগরোলওয়ালা ফুচকা, ফুচকাওয়ালা বিরিয়ানি। আমাদের সসেজসালামিহটডগ সাপ্লাই দেন যে সর্দারজী, তিনি দোকানের সামনে কড়াই পেতে মাংস ভাজতে লোক বসিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ওষুধের দোকানগুলোই সাইডে কিছু বেচছে না। কেন কে জানে। ওঁরা জেলুসিল ‘টু গো’ প্যাকেট নিয়ে দোকানের সামনে অস্থায়ী স্টল খুলতেই পারেন। বিরিয়ানি এগরোলের সমান বিকোবে।
১০ই অক্টোবর, ২০১৬
ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যেটা হল সেটা হল প্যানিক। চারদিনের ছুটির মধ্যে দু’দিন শেষ, যেটুকু পড়ে আছে সেটুকু শনিরবির ছুটির সমান। দুঃখে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। ভাগ্যিস নতুন জামা পরে বেরিয়ে পড়ার অপশন আছে।
আমার ব্লকের পুজো। আমার মতে সি আর পার্কের সবথেকে সুন্দর প্রতিমা। আমি অন্য ব্লকে চলে গেলেও মতামত একই থাকবে।
স্পনসর্ড প্রসাদ। ভেতরে আছে একটা পুঁচকে সন্দেশ, একটা পাঁচটাকা দামের নোনতার প্যাকেট আর একখানা শোনপাপড়ি। এমনি সময়ে আমি আমাদের-সময়-সব-ভালো-ছিল দলের আজীবন সদস্য, এই প্রসাদের ব্যাপারটা ছাড়া। আমাদের ওই সন্দেশের গুঁড়ো মাখানো গলা গলা কলা, কালো কালো পেয়ারা, বালি বালি আপেল - আমি একবার আক্ষরিক কাঁচকলা পেয়েছিলাম, চিবিয়ে খেয়েওছিলাম - তার থেকে এ প্রসাদ ঢের ভালো।
মেলা গ্রাউন্ড
কালীবাড়ি
আজ দু’বেলাই বেরিয়েছিলাম। দু’বেলার দু’রকম উপযোগিতা। সন্ধ্যেবেলায় মণ্ডপগুলোতে ঢোকা যায় না যদি না লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কা খাওয়ার রুচি থাকে, আর সকালে আলোর জাঁকজমকটা মিসিং। ফেরার পথে চাইনিজ খাওয়া হল। ডাইসড চিকেন উইথ গারলিক অ্যান্ড পেপার, নুডলস উইথ চিকেন অ্যান্ড প্রন, আর এই সব কিছু উইথ স্প্রাইট। যাওয়ার সময় হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে দেখতে আড়াই কিলোমিটার দূরের দোকানে পৌঁছেছিলাম। খেয়ে উঠে সে হাঁটা আম-পচে-বেল। অটো নিলাম। সি আর পার্কের সব রাস্তা বন্ধ, বিশ্ব ঘুরে আসতে হল। মিটার উঠল তিরিশের বদলে ষাট টাকা।
১১ই অক্টোবর, ২০১৬
রিষড়ার বাড়ির পুজোর বাসনপত্রের মধ্যে একটা ঘট আছে। কাঁসার গা, রোজ নারকেল ছোবড়ার ঘষা খেয়ে সোনার মতো চকচক করে। দৈর্ঘ্যে দেড় বিঘৎ, প্রস্থে প্রাপ্তবয়স্ক দুই তেলোর মাঝখান। বেজায় ভারি। ভেজা হাতে ধরলে যদি পিছলে যায়, আর গিয়ে যদি পায়েই পড়ে, তাহলে পা থেঁতলে যাওয়া নিশ্চিত।
ওই ঘটে ধরে রাখা জলে পুজো হয় বাড়িতে। গঙ্গাজলেই পুজোর নিয়ম, তাছাড়া গঙ্গা এমন কিছু দূরেও নয়, নিয়মিত ইন্টারভ্যালে কেরোসিনের জাম্বো জ্যারিকেনে ভরে সে জল আনাও হয়, কিন্তু আনা ঝামেলা বলে সে জল জমিয়ে রাখা হয় স্পেশাল ইভেন্টের জন্য। এমনি দিনে ঘটের কপালে কলের জল নাচে। সেই জল ভরা নিয়ে আবার নানারকম নিয়মকানুন আছে। নিজেদের অসুবিধের নিয়মগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে বলেই প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে এসব আলটপকা নিয়মের আমদানি বলে আমার সন্দেহ। কলের জলেই পুজো হবে কিন্তু কলের জল বালতিতে রেখে সেই বালতিতে ঘটি ডুবিয়ে জল তুলে নিলে চলবে না। ডিরেক্ট কল থেকে ভরতে হবে। তাও আবার বাড়ির যে সে কল থেকে ভরলে হবে না। যে সব কলের জলে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, স্নান করা হয় তাদের কাছে ঘট নিয়ে যাওয়া মহাপাপ। ঘটে জল ভরতে হবে বাগানের পবিত্র কল থেকে। যে ভরবে তার স্নান হয়ে যাওয়া মাস্ট।
এতসব নিয়ম আছে বলেই ঘটটার প্রতি আমার, এবং আমার ধারণা বাড়ির সকলেরই রাগরাগ ভাব। বাসনের ঝুড়ির মধ্যে ঘট হয়ে বসে থাকা ঘটটা যেন একটা ওয়ার্নিং, এই বুঝি জল চলে গেল। স্নানে যাওয়ার তাড়া দেওয়ার কল।
খালি আজ, বিজয়াদশমীর রাতে সে ঘটের অন্য মহিমা। তার ভেতর আজ সত্যি গঙ্গাজল, তার মুকুটে আজ বেছে তুলে আনা, গাঢ় সবুজ, কিনারায় ঢেউ তোলা, ফুটোহীন, নিটোল আমপল্লবের মুকুট, তার ঝকঝকে গায়ে টকটকে লাল সিক্ত সিঁদুরের স্বস্তিকাচিহ্ন। তবে আরও কিছু আছে বোধহয়। সম্মিলিত বিষাদধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের ছলাং করে ছিটকে আসা হিমজলের বিন্দু, মণ্ডপের খালি বেদীটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরের ধক করে ওঠাটা, এ সব তো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না, যেতে পারে না, সব এসে ওই ঘটের গায়ের জ্যোতি হয়ে যায়। আজ ঘটের দিকে তাকালে বিশ্বাস করা শক্ত নয় যে এর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ঠেকালে এ সত্যি সত্যি আমার চাওয়া পূরণ করার ক্ষমতা রাখে।
যদিও হোমওয়ার্ক করা না থাকলে ফস করে কিছু চাওয়া মুশকিল। গত পাঁচদিনের উত্তেজনায় হোমওয়ার্কের কথা মনেও পড়েনি, এই এখন হাঁটু মুড়তে মুড়তে, ঠাণ্ডা মেঝেতে দুহাতের পাতার টেম্পোরারি বালিশ পাততে পাততে, মাথা ঠেকাতে ঠেকাতে ব্রেনস্টর্মিং চালিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। বড়জোর 'সবার ভালো হোক' টাইপের ভাসাভাসা দাবি।
এখন পুজোর উত্তেজনা নেই, এখন আমার হোমওয়ার্ক সারা। এখন আমার চাওয়ার জিনিসের অভাবও নেই, কিন্তু এখন ঘটও নেই। রাগ করেই হোক, বিরক্তি দেখিয়েই হোক, তাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানের কলের দিকে আমি অগুন্তিবার হেঁটেছি। যদি সেসব কথা মনে রেখে, পুরোনো বন্ধুত্বের খাতিরে সে আমাকে মাত্র একখানা বরও দিতে রাজি থাকে, তাই একটা চেয়ে রাখলাম। আর কিচ্ছু চাই না, শুধু মনের, মগজের, লিভারের, হার্টের, লেখার, বলার, চিন্তার, ভালোবাসার, স্বপ্নের, সংকল্পের জোর দিও আমাকে, ঘট।
আপনাদের সবার জন্য আমার শুভেচ্ছা, কোলাকুলি আর অন্তরের ভালোবাসা রইল। শুভ বিজয়া।
শুভ বিজয়া
ReplyDeleteআপনাকেও শুভ বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা, অরিন্দম।
DeleteSubho bijaya kuntala Di.
ReplyDeleteতোমাকেও বিজয়ার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানাই, প্রিয়াঙ্কা।
DeleteShuvo Bijoya Kuntala !! .. bhalo katuk toder dingulo..
ReplyDeleteশুভ বিজয়া, বৈশালী।
DeleteSubho Bijoya Kuntala! Archismaan keo subhechha janai!
ReplyDeleteআমাদের তরফ থেকেও তোমাকেও বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা, রুণা।
DeleteShubho bijoya! Kolakuli. :)
ReplyDeleteকোলাকুলি কোলাকুলি, বিম্ববতী। বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা তোমাদের, আর পুঁটিকেও।
DeleteSubho Bijoya :)
ReplyDeletekhub bhalo thakben.
শুভ বিজয়া, অরিজিত, আপনারাও খুব ভালো থাকবেন।
DeleteShubho bijoya!! :)
ReplyDeleteশুভ বিজয়া, অপরাজিতা।
DeleteShubho Bijoya. Bhalo theko
ReplyDeleteআপনিও ভালো থাকবেন খুব, সবাইকে নিয়ে। শুভ বিজয়া।
DeleteShubho bijoya...khub bhalo theko
ReplyDeleteশুভ বিজয়া তোমাকেও, রণিতা।
DeleteShubho Bijoya Kuntala di :)
ReplyDeleteশুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা তোমাকেও, কুহেলি।
Deleteektu belated, kintu tomake subho bijoyar priti o subhechha, ar Archaismankeo. Bhalo theko dujone.
ReplyDeleteআমাদের তরফ থেকেও তোমার আর শীর্ষেন্দুর জন্য অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা রইল, চুপকথা।
Deleteshubo bijaya (jodio ektu beshi deri hoye geche )
ReplyDeleteআরে কালীপুজো অবধি নো দেরি। শুভ বিজয়া, প্রদীপ্ত।
Delete