৮, প্রিন্স আলব্রেশটস্ট্রাসে



উইলহেলমস্ট্রাসে আর স্ট্রেসেমানস্ট্রাসে। A অক্ষরের দুটো হাতের মতো এক বিন্দু থেকে দুদিকে বিস্তৃত। তফাৎ একটাই যে A-র পেট মোটে একবার কাটা থাকে, এখানে একাধিক। সবথেকে ওপরের পেটকাটা লাইনটার নাম আনহল্টারস্ট্রাসে। এই রাস্তা যেখানে স্ট্রেসেমানস্ট্রাসে গিয়ে জুড়েছে সেই বিন্দুতেই আমার হোটেল। আর দ্বিতীয় যে পেটকাটা রাস্তাটা, আনহল্টারের নিচে কাজেই আনহল্টারস্ট্রাসের থেকে লম্বা, উইলহেলম আর স্ট্রেসেমানকে জুড়েছে সেটার নাম হচ্ছে নিডারকিরশনারস্ট্রাসে। 

এই নিডারকিরশনারস্ট্রাসে আর উইলহেলমস্ট্রাসের মোড়ে একসময় একটা মস্ত প্রাসাদ ছিল। সেখানে থাকতেন প্রাশিয়ার রাজপুত্র প্রিন্স অ্যালবার্ট। তাঁর নামে এই রাস্তার নাম রাখা হয়েছিল প্রিন্স আলব্রেশটস্ট্রাসে। সেই রাস্তার নম্বর প্লটে উনিশশো পাঁচ সালে মিউজিয়াম অফ ডেকোরেটিভ আর্টসের বাড়ি বানানো হয়। উনিশশো তেত্রিশ থেকে মিউজিয়াম ব্যবহার হতে শুরু করে গেস্টাপো আর নাৎজি পার্টির সিক্রেট পুলিশের (শুৎজস্টাফেল বা এস এস) অফিস হিসেবে। উনিশশো চৌত্রিশে এই বাড়িতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইন্সপেক্টোরেট-এর হেডঅফিস খোলা হয়, যাদের কাজ হচ্ছে দেশের এবং অচিরেই বিদেশেরও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দেখাশোনা। উনিশশো ঊনচল্লিশে এ বাড়িতে রাইখ মেন সিকিউরিটি অফিস বসে। উনিশশো পঁয়তাল্লিশে মিত্রশক্তির বোমায় ৮ নম্বর প্রিন্স আলব্রেশটস্ট্রাসে উড়ে যায়। দুটো এরিয়াল ভিউ পাশাপাশি দেখা বেশ একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া ব্যাপার। এই ছবিতে অট্টালিকা গাছ রাস্তা জমজমাট, ওই ছবিতে ফাঁকা। 

এখন ওই জায়গাটা অবশ্য একেবারে ফাঁকা নেই। একপাশে খানিকটা বার্লিন দেওয়াল, যার দেওয়ালে লাল রং দিয়ে কেউ লিখে গেছে WHY আর পায়ের তলায় ৮, প্রিন্স আলব্রেশটস্ট্রাসের বেসমেন্ট (কিংবা একতলার) ভাঙাচোরা খানিকটা। বাকি জমিটায় একটা বাড়ি। গাইড ঠিকই বলেছিলেন, মডেস্ট বিল্ডিং। দেখলে সুপারমার্কেট বলে মনে হওয়া বিচিত্র নয়। বাড়িটা আসলে একটা ডকুমেন্টেশন সেন্টার। স্থায়ী, অস্থায়ী দু’রকমেরই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে। আমরা দেখলাম সেন্টারের সবথেকে পরিচিত এবং স্থায়ী প্রদর্শনীটা। যার নাম এই জায়গাটা, এই বাড়িটা, এই তিনকোণা প্লটের ফালিটার সঙ্গে আশ্চর্যজনক রকম খেটে যায়। 

টোপোগ্রাফি অফ টেরর। 

প্রদর্শনী মূলত তৈরি উনিশশো তিরিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত তোলা ছবি দিয়ে। বীজবপন থেকে ধ্বংস। চট করে ভাবলে মনে হতে পারে লেখার থেকে ছবি ইতিহাসের অনেক বেটার, অনেক বেশি ভরসাযোগ্য মাধ্যম, কিন্তু তা নয়। কারণ সবার হাতে ক্যামেরা থাকে না। আর কার হাতে ক্যামেরা থাকবে সেটা একটা বিরাট তফাৎ গড়ে দেয়। কে ছবি তোলে আর কার/কীসের ছবি তোলা হয় সেটা একটা মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতি।

শুরুর দিকের ছবিগুলো রীতিমত চনমনে। নাৎজি পার্টির পার্টি। বিয়ারের পিপের পাশে উল্লসিত জনতা। একজনের মাথার পেছনে অন্যজনের আঙুলের শিং। তারপর ইউনিফর্ম, পদমর্যাদা বুঝে আগুপিছু দাঁড়ানো। হাতে বিয়ারের গ্লাসের বদলে ব্যাটন। মুখে উল্লাসের বদলে কঠিন সংকল্প। পার্টি আর পুলিশ মিলেমিশে একাকার।

আরেকরকমের ছবিও পাশাপাশি চলে। ন্যায়ের ধারক হিসেবে নাৎজি পার্টির উত্থান। ভণ্ড, জালিয়াত ব্যবসাদারদের ধরে গরুর পিঠে চড়িয়ে রাস্তায় হাঁটানো হচ্ছে। গলায় ঝোলানো প্ল্যাকার্ডে কী লেখা আছে আমি পড়তে পারিনি, তবে প্রশংসাসূচক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। চারপাশে দল বেঁধে হাসতে হাসতে চলেছে সাধারণ মানুষ। মাবাবা ছেলেপুলে কাকাপিসে মাসিপিসি। গরুর পিঠে লাঞ্ছিত, অপমানিত শোষক দেখে তাদের উল্লাসের সীমা নেই। এরাই ময়দানে ভিড় করে এসেছে সভা দেখতে। হাতের প্ল্যাকার্ড উঁচু করে ধরেছে। ওয়েক আপ জার্মানি। 

ছবি বদলায়। সারা দেশ জুড়ে ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে, সেখানে সব অপোগণ্ডকে পোরা হবে। যারা বসে বসে খায় তাদের খেটে খেতে বাধ্য করা হবে। শুধরে গেলে ছেড়েও দেওয়া হবে। কী মহৎ প্রচেষ্টা। কিন্তু এত ক্যাম্প কেন? এত বড় বড় ক্যাম্পই বা কেন? এত অপোগণ্ড কি আছে দেশে? আরে রোসো। সাপ্লাই উইল ক্রিয়েট ইটস ওন ডিম্যান্ড। যারা অলস, যারা পাগল, যারা দুর্বল, যারা হোমোসেক্সুয়াল, যারা ইহুদি, যারা পুরুষ কিংবা নারী কিংবা শিশু . . .  

বেসিক্যালি, যারা আমরা নয় তারাই অপোগণ্ড। আমরা যাদের অপোগণ্ড বলে দাগিয়ে দেব তারাই অপোগণ্ড। 

আরেকটা ছবি। গর্তের নিচে জমা হয়েছে মৃতদেহ, গর্তের ধারে উবু হয়ে বসা একটা লোক, লোকটার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বীরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে উর্দিপরা যুবক। পেছনে, যথারীতি, একদল দর্শক। গর্তের মৃতদেহ আর যুবকটির এক্সপ্রেশন যথাযথ। পেছনের দর্শকদের মুখে তেমন কোনও, অন্তত শুরুর দিকে যেমন ছিল, উচ্ছ্বাস নেই। দেখে দেখে সয়ে এসেছে। যার মাথায় বন্দুক ঠেকানো হয়েছে তার অতীত আমরা জানি না। তার ভবিষ্যৎ জানি, সেও জানে, দু’হাত সামনে, গর্তের তলায়। ও রকম ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখতে কেমন লাগে আমার জানা নেই, তাই বোধহয় তার মুখে আমার চেনা কোনও অনুভূতি নেই। 

কোনও ছবিই ভোলার মতো নয়। কোনও মুখই ঝাপসা হওয়ার নয়। তবু সবথেকে বেশি মনে থেকে যায় ওই ভিড়ের চেহারাটা। নেতাদের পেছনে, মৃতদেহের চারপাশে। পঁয়তাল্লিশের পর যখন উল্টো মার শুরু হবে তখন যারা দু’হাত তুলে বলবে, আমরা একজন ইহুদিকেও মারিনি কাজেই আমরা নাৎজি নই। মারতে হলে ওদের মার, ফাঁসি দিতে হলে ওদের দাও। আমরা শুধু ন্যায়বিচারের সময় হাততালি দিতে দিতে পাশে হাঁটছিলাম, জাগো জার্মানি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মিছিলে যাচ্ছিলাম। আমাদের হাতে কোনও রক্ত নেই। আমাদের বিবেকে কোনও দাগ নেই। 

রাস্তায় নেমে হাততালি দেওয়ার দরকার নেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখে ফেনা তোলারও দরকার নেই। নিজের ঘরের নিরাপত্তায়, নিজের ইমেজ বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে, ঘরের জামা পরে, ঘরের কাপের চায়ে চুমুক দিতে দিতে, পা নাচাতে নাচাতে যদি কখনও বলি, ওরা ওইরকমই, ওদের বড় বাড় বেড়েছে, অনেক হয়েছে এবার পে ব্যাক টাইম, তাহলে আমিও ওই ছবিতে আছি।


Comments

  1. Last paragraph ta ajkal boddo beshi mone hochche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও, বিম্ববতী।

      Delete
  2. lekha ta facebook e kichu bondhu der poranor jonyo share korlam..oboshyoi apnar nam diye

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, ঋতম।

      Delete
  3. Amader barite Reader's Digest ashto tai school e thakte oder ekta book section e porechilam ekjon loker golpo je boro hoye shara prithibi ghure ekjon Nazi officer ke khunje ber korechilen khub chelebelar kono ottochar er revenge neyar jonne.
    Pore boro hoye Nazi der kotha jene o porey bujhlam keno.
    Kintu ashol kothata bujhi oi golper shesh ta ye ... jokhon oi officer ke khunje paan, tokhon tini dekhen uni ottonto rugno ar boyoshko ekjon manush chara ar kichu na .... tai praane marte parenni ... shudhu onar mukhe thutu felechilen ... sheta naki German der kache khub opomaanjonok.
    Sheyikhane e chilo difference oder ar shadharon manusher moddhe.
    Jotoi German history pori, totoi obaak hoi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, জার্মানদের ইতিহাস খুবই রোমহর্ষক, শর্মিলা।

      Delete
  4. Ei chabuk lekhata amader Chena ochena bohu loker pora dorkar.. Khomota thakle newspaper e publish korte chaitam...

    ReplyDelete
  5. Khub proyojoniyo ekta lekha. Sesh angshotar jonyo ekta onyomatra pelo. Amader ek shilpibandhu emoni ek samaye oi Germany r ekta chhobi firiye ene poster korechhilen, captio chhilo Fascist Nation! Temoni.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিপদটা হচ্ছে আমরা সবাই-ই, ইস্যুভেদে, ফ্যাশিস্ত হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখি। তাই সতর্কতা জরুরি।

      Delete
  6. শেষ দুটো প্যারাগ্রাফ বড্ড বেশি সত্যি, আজ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই। আজকালকার ব্যাপারস্যাপার দেখে কেমন যেন বুদ্ধুভুতুম হয়ে যাচ্ছি, অন্বেষা।

      Delete
  7. Genocide ba ethnic cleansing bepar ta manusher itihash er motoi purono. Genghis khan theke suru kore, 1971 e Bangladeshi genocide ba ajker ISIS ... sei tradition somane choliteche.

    ReplyDelete
  8. kakhano kakhano we need to choose sides,you are with us Or against us...sei rakam..ki ar kora jabe..

    prosenjit

    ReplyDelete

Post a Comment