একটি নিখুঁত খুন
মূল গল্পঃ Blackfriars Bridge
লেখকঃ Anthony Horowitz
বিবেকানন্দ? ওহহ্ বালি ব্রিজ। বালি ব্রিজের ঘটনাটা শুনতে চান? না না, আপত্তি কীসের। সেই রাতের আগে শুনতে চাইলে আপত্তি থাকত, ফর অবভিয়াস রিজন্স, কারণ তখন ওটা ছিল একটা টপ সিক্রেট প্ল্যান, কিন্তু এখন তো আর সে রকম কিছু নেই। এখন বললেও যা, না বললেও তাই। বরং বলাই ভালো।
ডিসেম্বর মাসের রাতে বালি ব্রিজের ওপর আমি যাকে খুন করেছিলাম তার নাম ছিল অগোছালো নীল, ব্র্যাকেটে বাপি। ওর মধ্যে একমাত্র বাপিটুকু পিতৃমাতৃদত্ত। স্কুলের নাম ছিল নীলকণ্ঠ, কবিতা লিখতে শুরু করার পর কণ্ঠ খসল, ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর অগোছালো জুড়ল। মুশকিল হল বিখ্যাত হওয়ার পর। ম্যাগাজিন থেকে লোক এসে “অগোছালো নীলবাবুর বাড়ি কোথায়” জিজ্ঞাসা করলে কেউ বলতে পারত না। কাজেই বাপিটা ব্র্যাকেটে রাখতে হল।
অগোছালো বাপিকে আমি কেন খুন করলাম? নাঃ, রোমহর্ষক কোনও কারণ আশা করলে পস্তাবেন। মানুষের খুনখারাপির ইতিহাসে যে দুটো মূল কারণ, সম্পত্তি আর সেক্স, তার একটার জন্য। অগোছালো বাপি আমার বউ সুনন্দার সঙ্গে সেক্স করছিল। তখন খুব রাগ হয়েছিল, এখন বুঝি, সুনন্দার দোষ ছিল না। আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল সুনন্দা সুন্দরী, সঙ্গীতজ্ঞা এবং স্নাতক, কবিতা পড়তে যে ভালোবাসে লেখা ছিল না। লিখবে কী, বাড়ির লোকেরা জানতই না। আমিও জানতাম না। জানলাম অগোছালো বাপির সঙ্গে সুনন্দার সম্পর্কটা আবিষ্কার করার পর। আবিষ্কার করলাম যদিও সুনন্দার বাড়ির লোকেরা আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনে বোল্ড লেটারে লিখে দিয়েছিলেন “ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন” কিন্তু সুনন্দার আসলে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার কোনওটাই পছন্দ নয়। সুনন্দা পছন্দ করে কবিদের। কাজেই আমি যখন চেম্বারে পেশেন্টের পোকা ধরা দাঁত তুলতাম, তখন সুনন্দা ফাঁকা বাড়িতে অগোছালো বাপির সঙ্গে প্রেম করত।
কী করে আবিষ্কার করলাম? নাঃ, এবারেও আপনাকে হতাশ হতে হবে। কোনও ভাগ্যের ফের নয়, সমাপতন নয়, দৈবদুর্বিপাকে নয়। যতখানি বোরিং ভাবে সম্ভব। এস এম এস থেকে। আগাথা ক্রিস্টি লিখে গিয়েছিলেন, মেয়েরা প্রেমিকের চিঠি ফেলতে পারে না। এখন চিঠি গিয়ে হয়েছে এস এম এস, এবং মেয়েরা প্রেমিকের এস এম এস-ও ডিলিট করতে পারে না। ক্রিস্টিকে এই জন্যই কালজয়ী বলে লোকে। সুনন্দাকে আমি সাধারণ মেয়েদের মধ্যে গণ্য করিনি কখনও। ওর চেহারা, ব্যক্তিত্ব, দরাদরি করার ক্ষমতা, সিরিয়ালের হিরোদের প্রতি সহমর্মিতা, কোনও কিছুই সাধারণ ছিল না, কিন্তু এই একটি ব্যাপারে সুনন্দা নিজেকে সাধারণ প্রমাণ করেছিল। অগোছালো বাপির রোম্যান্টিক এস এম এস-গুলো সব ফোনে জমিয়ে রেখে।
প্রথম থেকেই আমি জানতাম বাপিকে আমি খুন করব। সেই একই নিখুঁত প্রিসিশনে খুন করব যে প্রিসিশনে আমি অতি অবাধ্য, কন্সট্যান্টলি নড়তে থাকা পেশেন্টের থার্ড মোলারের গোড়ায় অ্যানাস্থেটিক পুশ করি। খুনটা হবে দ্রুত, পরিচ্ছন্ন এবং নির্ভুল। খুনের প্রতিটি অ্যাংগল, আগের ও পরের প্রতিটি পরিস্থিতি, কার্যকারণ, ঘটনা পরম্পরার প্রতিটি পারমুটেশন কম্বিনেশনের জন্য আমি তৈরি থাকব। শার্টের ছেঁড়া বোতাম, জুতোর পাটি, ফরেনসিক প্রমাণ ইত্যাদি আরও যা যা প্রমাণ পুলিশের চোখের সামনে সাজিয়ে রেখে যায় গোয়েন্দাগল্পের খুনিরা, বলতে গেলে প্রায় যেচেই হাতকড়ায় হাত গলিয়ে দেয়, ও সমস্ত কেয়ারলেস মিস্টেক থাকবে না আমার খুনে।
পুরো প্ল্যানটা ছকতে আমার লাগল মাসদুয়েক। বাপির এস এম এস আমি পড়লাম কালীপূজোর রাতে, খুনের দিন ধার্য করলাম বড়দিনের কাছাকাছি।
আমি আজীবন মেথডিক্যাল। এই প্রোজেক্টটার জন্য আমি একটা ফোল্ডার বানালাম। অফ কোর্স, আমার মগজের ভেতর। ফোল্ডারটার নাম দিলাম ‘দ্য মিষ্টিরিয়াস মার্ডার অফ আ মডার্ন পোয়েট’। পরের মাসকয়েক ধরে রোজ অল্প অল্প করে প্ল্যান ভাঁজতে লাগলাম, টুকটাক যখনই যা মনে আসত ফোল্ডারে গুঁজে রাখতাম। সম্ভাব্য খুনের সময়ের ওয়েদার, ট্র্যাফিক সিচুয়েশন, বাপির দৈনিক রুটিন, আমার দৈনিক রুটিন। সম্ভাব্য গোলযোগও বাদ দিতাম না। অনেক ঘষামাজার পর প্ল্যানটা এরকম দাঁড়াল।
রোজ রাতে দক্ষিণেশ্বরের কোনও একটা বাড়িতে টিউশন সেরে ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরত বাপি। ন’টায় টিউশন বাড়ি থেকে বেরোত, ন’টা দশে ব্রিজে চড়ত, ন’টা বত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে যে কোনও একটা সময় ব্রিজ থেকে নামত। রোজ ব্রিজ পেরোতে এক সময় না লাগার কারণ হচ্ছে মাঝে মাঝে বাপির ফোনে ফোন আসত। তখন ও থেমে রেলিং-এ ভর দিয়ে খুব হেসে হেসে কথা বলত। কে জানে হয়তো সুনন্দার সঙ্গেই।
আমি আজীবন মেথডিক্যাল। এই প্রোজেক্টটার জন্য আমি একটা ফোল্ডার বানালাম। অফ কোর্স, আমার মগজের ভেতর। ফোল্ডারটার নাম দিলাম ‘দ্য মিষ্টিরিয়াস মার্ডার অফ আ মডার্ন পোয়েট’। পরের মাসকয়েক ধরে রোজ অল্প অল্প করে প্ল্যান ভাঁজতে লাগলাম, টুকটাক যখনই যা মনে আসত ফোল্ডারে গুঁজে রাখতাম। সম্ভাব্য খুনের সময়ের ওয়েদার, ট্র্যাফিক সিচুয়েশন, বাপির দৈনিক রুটিন, আমার দৈনিক রুটিন। সম্ভাব্য গোলযোগও বাদ দিতাম না। অনেক ঘষামাজার পর প্ল্যানটা এরকম দাঁড়াল।
রোজ রাতে দক্ষিণেশ্বরের কোনও একটা বাড়িতে টিউশন সেরে ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরত বাপি। ন’টায় টিউশন বাড়ি থেকে বেরোত, ন’টা দশে ব্রিজে চড়ত, ন’টা বত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে যে কোনও একটা সময় ব্রিজ থেকে নামত। রোজ ব্রিজ পেরোতে এক সময় না লাগার কারণ হচ্ছে মাঝে মাঝে বাপির ফোনে ফোন আসত। তখন ও থেমে রেলিং-এ ভর দিয়ে খুব হেসে হেসে কথা বলত। কে জানে হয়তো সুনন্দার সঙ্গেই।
বাপি ব্রিজের ওপর থাকার ওই বাইশ কিংবা বত্রিশ মিনিটে আমি কাজ সারব। আমার পরনে থাকবে জিনসের প্যান্ট আর হুডি, আজকালকার ছেলেরা যা পরে। বাপি ব্রিজের ওদিক দিয়ে আসবে, আমি এদিক দিয়ে হাঁটব, সুবিধেজনক ডিসট্যান্সে এসে জিনসের পকেট থেকে ছুরি বার করে (যেটা আমি অলরেডি তারকেশ্বরের শালার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ওখানকার লোক্যাল বাজার থেকে কিনে রেখেছিলাম, যাতে আমার রান্নাঘরের ছুরিতে ফরেনসিক এভিডেন্স না থাকে) অগোছালো বাপির পেট ফাঁসাব, তারপর রেলিং টপকে বডি গঙ্গায় ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে আসব।
প্ল্যান কাঁচা মনে হচ্ছে? অনেক ফুটো? জানতাম। আচ্ছা শুনি কোন কোন জায়গায় ফুটো দেখতে পাচ্ছেন?
লোকে দেখবে? আপনি কলকাতার লোক মনে হচ্ছে? হুম্ম্। শুনুন মশাই, ডিসট্রিক্ট আলাদা হয়ে গেলে জলবায়ু বদলে যায়, মানুষের স্বভাবচরিত্র, পোশাকআশাক, ভাষা, সাইকোলজি সব বদলে যায়। ও সময় আমাদের ওদিকে আপনাদের থেকে অন্তত পাঁচ ডিগ্রি টেম্পারেচার কম থাকে। ডিসেম্বর মাসের রাত সাড়ে ন’টায় খুন হতে দেখবে বলে কেউ বালি ব্রিজে গঙ্গার হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকে না।
তবে আমি আপনার কথা একেবারে উড়িয়েও দিচ্ছি না। বালি ব্রিজ দিয়ে ট্রেন যায়, আজকাল গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। তাছাড়া, আরেকরকম সাক্ষীও আছে, যেটার কথা আপনি গোয়েন্দা গল্পের ঘাগু পাঠক হয়েও মিস করে গেছেন। তবে আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না, সবটা বই পড়া বিদ্যেতে হয় না, খানিকটা অরগ্যানিকালি আসতে লাগে।
গাড়ি যদি নাও চলত, ট্রেন যদি নাও আসত, তবু আমাদের বালি ব্রিজে, আপনাদের বিবেকানন্দ সেতুতে একধরণের সাক্ষী থাকত। তারা হচ্ছে প্রেমিকপ্রেমিকা। আমি আমার হোল লাইফ ওই ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত করেছি, দিনে রাতে বিভিন্ন সময়ে, একটিবারও বালি ব্রিজ প্রেমহীন দেখিনি। তারা আমাকে দেখত। ইন ফ্যাক্ট, আমি চেয়েছিলাম তারা আমাকে দেখুক।
কেন? বুঝতে পারছেন না? এই তো। বিদেশী গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে আপনাদের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে। তারা কী দেখত? দেখত হুডি পরা একটা ছোকরা আরেকটা ছোকরার পেটে ছুরি বসাচ্ছে। বালি ব্রিজে ঘটনার আগের ছ’মাসে অন্তত তেরোটা পকেটমারি হয়েছিল। সবাই জানত কারা করেছে। লেবুর ছেলেরা। কেউ কিচ্ছু বলেনি, বলার ক্ষমতাই নেই। খুন হতে দেখলে হয়তো বলত, কিন্তু বলত গিয়ে ওই লেবুকেই, পাড়ার রেসপেক্টেবল দাঁতের ডাক্তারবাবুকে না।
বাপির বডি ফেলে দিয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে ব্রিজ থেকে আমি নদীর পাড়ে নেমে আসব। কী বলছেন? ওই রাস্তায় দু’ফুট অন্তর অন্তর ত্রিফলা? ত্রিফলার আলোর রেঞ্জ দেখেছেন আপনি? তার পরেও এ কথা বলছেন? ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলে অ্যাট লিস্ট হুলোগুলো দেখতে পেত, ত্রিফলার ধোঁয়ায় ওদেরও আইসাইট ঘুলিয়ে গেছে। পাঁচ মিনিট হাঁটলে আমার বাড়ির বাগান। নিচু পাঁচিল টপকে বাগানে ঢুকে আসব, বাবা ছেলেমেয়েকে খাঁটি গরুর দুধ খাওয়াবেন বলে গোয়াল বানিয়েছিলেন, সেখানে ঢুকে হুডি জিনস পোড়াব, সঙ্গে সঙ্গে যত ফরেনসিক এভিডেন্সে টা টা বাই বাই।
কপাল যদি ভালো হয় তাহলে অগোছালো বাপি ভেসে ভেসে ডায়মন্ড হারবার দিয়ে সোজা বঙ্গোপসাগর চলে যাবে, তখন আর গল্পটা মিস্টিরিয়াস মার্ডার থাকবে না, হয়ে যাবে 'দ্য কিউরিয়াস কেস অফ ডিস্যাপিয়ারেন্স অফ আ মডার্ন পোয়েট'।
আমার বউ টের পাবে কি না? যাক। আমি আপনাকে এসব ব্যাপারে যত নভিস ভাবছিলাম আপনি ততটাও নন। অ্যাকচুয়ালি প্ল্যানের এই পার্টটা নিয়ে আমি একটু গর্বিত। কারণ এই পার্টটা যাকে বলে স্ট্রোক অফ জিনিয়াস।
সুনন্দা রোজ সন্ধ্যে সাতটা থেকে দশটা সিরিয়াল দেখে। ডিনারটিনার সব টিভির সামনে। দশটায় টিভি বন্ধ করে শোবার ঘরে ঢুকে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। আমি ততক্ষণ আমার লাইব্রেরিতে বসে আমার বিশ্ব গোয়েন্দাসাহিত্যের কালেকশন নাড়িচাড়ি। এইসব বাপিটাপির ঝামেলা যখন ছিল না তখন শোওয়ার আগে একবার দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে যেত, এখন সে সব পাট চুকেছে। যাই হোক, টিভিতে যখন পুণ্যিপুকুর বা মনসামঙ্গল বা ওইরকম কিছু একটা চলবে, আমি শোবার ঘরের জলের জগে একটুখানি অ্যানাস্থেটিক ফেলে দেব। খাটে গা ঠেকানোর একমিনিটের মধ্যে মাঝরাতের ঘুম। আমি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে, হুডির সৎকার সেরে গিয়ে টুক করে পাশে শুয়ে পড়ব। সুনন্দা এমন ঘুমে অচৈতন্য থাকবে যে আমার নড়াচড়া টের পাওয়া তো দূর অস্ত, অগোছালো বাপির সুখস্বপ্নও দেখতে পাবে না। ঘুম ভাঙবে একেবারে সেই কাজের মাসি এসে দরজা ধাক্কানোর পর। উঠে দেখবে আমি পাশে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছি। তখন রোজকার মতো ঠেলা দিয়ে বলবে, “খালি খাওয়া আর ঘুম, বাজার কে করবে? রোজ রোজ এই এক, আমার আর ভাল্লাগে না। কী গো উঠবে তো?”
মাস্টারস্ট্রোক কি না?
আপনি যে আমার প্ল্যনটাকে কাঁচা বললেন, ওই কাঁচাত্বটাই, ইন আদার ওয়ার্ডস, সিমপ্লিসিটিটাই আমার প্ল্যানের জিনিয়াস ছিল। হ্যাঁ, ক্রিস্টিসুলভ প্যাঁচ কিংবা শার্লকসুলভ ম্যাজিক ছিল না। কিন্তু আফটার অল, এটা রিয়েল লাইফ। গল্পের প্লট নয়। তাছাড়া, প্ল্যানটার এই যে ঘোর সোজাসাপটা চলন, এটা আমার মতে, আপনার মত আমার সঙ্গে মিলতেই হবে তার মানে নেই, আর্টের চূড়ান্ত পরিচয়। সে দিক থেকে দেখলে অগোছালো বাপির মার্ডার শুধু পারফেক্ট ছিল না, ইট ওয়াজ অলসো আর্টিস্টিক। ভাবুন একবার, মার্ডারারের আসল উদ্দেশ্য কী? ধরা না পড়া। লোকের চোখের আড়ালে থাকা। জ্যাক দ্য রিপার, মরিয়ার্টিদের নিয়ে লোকে লাফালাফি করে, আমি তো বলি ওরা মার্ডারার হিসেবে সবথেকে নিকৃষ্ট শ্রেণীর। ঢাক ঢোল পিটিয়ে, লোক জানিয়ে, এ কি মার্ডার হচ্ছে না মোচ্ছব? উল্টোদিকে অগোছালো বাপির মার্ডারের কথা ভাবুন। উন্মার্গগামী যুবসমাজের গালে আরেক পোঁচ চুনকালি, শহর তথা রাজ্যের ল অ্যান্ড অর্ডারের দুরবস্থার স্ট্যাটিস্টিকসে আরেকটা নম্বর, লেবুগুণ্ডার দলের কীর্তির মুকুটে আরেকটা পালক, ব্যস।
এ মার্ডারের শুধু যে সমাধান হবে না তাই নয়, লোকে ভুলেও যাবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে।
আমি বলছি আপনাকে। ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট মার্ডার। পারফেক্ট অ্যান্ড আর্টিস্টিক।
একটা কথা স্বীকার করতে হবে, মার্ডারের আগের সময়টা আমার দারুণ আনন্দে কেটেছিল। চনমনে বোধ করতাম। ওই অ্যানাস্থেশিয়ার মাস্টারস্ট্রোকটা যেদিন মাথায় এসেছিল সেদিন তো ভাত খেতে খেতে নিজের মনে হেসেই ফেলেছিলাম। সুনন্দা “হাসছ কেন?” বলে খেঁকিয়ে উঠেছিল। “কার কথা মনে পড়ে এত ফুর্তি?” ভাবুন একবার! নিজে পরকীয়া করছে, এদিকে সন্দেহ করছে আমাকে!
যাই হোক, ঘটনার দিন সন্ধ্যেবেলা চেম্বার থেকে ফিরে আমি লাইব্রেরিতে ঢুকে গেলাম। বন্ধ দরজার ওপার থেকে টিভির উচ্চকণ্ঠে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। আমি রেডি হলাম, পাজামাপাঞ্জাবী ছেড়ে বুককেসের পেছনে লুকিয়ে রাখা প্লাস্টিক থেকে বার করে জিনস আর হুডি পরে নিলাম। ছুরিটা পকেটে পুরলাম। তারপর ন’টা নাগাদ লাইব্রেরির দরজা খুলে বাগানে, বাগান থেকে রাস্তায় নেমে এলাম। এই রাস্তাটা ধরে মিনিট দশেক গেলেই ব্রিজের সিঁড়ি।
আমি হুডির পকেটে হাত গুঁজে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকলাম। আমরা বুড়োরা সবসময় আজকের যুগকে খারাপ খারাপ বলি, কিন্তু এ যুগের অনেক ভালো জিনিস আছে যা আমাদের সময় ছিল না। যেমন এই হুডি। কী চমৎকার পোশাক। ঠাণ্ডা এড়াতে চাইলে মাথায় দিয়ে হাঁটুন, মার্ডার করতে চাইলে কপালের ওপর দিয়ে টেনে নামিয়ে দিন। মাল্টিপারপাস। জিনিয়াস।
হাঁটতে হাঁটতে হুডির একটাই অসুবিধে আমি টের পাচ্ছিলাম। পোশাকটা যাদের ভুঁড়ি নেই তাদের জন্য বানানো। যেমন অগোছালো বাপি। বাবার পয়সায় খেয়েদেয়ে কবিতা লিখে ঘুরে বেড়ায়, অথচ সে খাওয়ার একটুও গায়ে লাগে না, হিলহিলে লম্বা, টিংটিঙে প্যাংলা। আমিও ছিলাম একদিন ও’রকম। আমার বাবা বলতেন, নেমকহারাম চেহারা। এত খাওয়াই তবু গায়ে লাগে না।
স্যাডলি, আমার চেহারা আর সেরকম নেমকহারাম নেই। বরং দরকারের তুলনায় বেশিই কৃতজ্ঞতাভাজনেষু হয়ে পড়েছে। যা খাই, সব তিনগুণ হয়ে শরীরে লেগে যায়। হুডিটা বাকি সব জায়গায় ফিট করেছিল, ভুঁড়িটা ছাড়া। এদিকে জিনসটা আবার ঢিলে। ঢিলেটাই ফ্যাশন। টাইট হুডি আর ঢিলে জিনসের মধ্যে ইঞ্চিখানেক পেট ফাঁকা রয়ে গিয়েছিল, সেখানে হু হু করে গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছিল।
সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে উঠে এলাম। আমার আজন্মের চেনা বালি ব্রিজ।
বেশিরভাগ লোকে দাঁতের পাটিকে যেরকম টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নেয়, বালি ব্রিজকেও আমি সারাজীবন সে রকমই নিয়েছিলাম, জানেন। একটা নদীর ওপর একটা গামবাট ব্রিজ। ঝমঝম করে ট্রেন যায়, গুমগুম করে লরি। কিন্তু সেই রাতে হুডি মাথায় ব্রিজের রেলিং-এর ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে যেন আমি সবকিছু নতুন চোখে দেখলাম। আমার ফার্স্ট, হোপফুলি ওনলি, অ্যান্ড পারফেক্ট অ্যান্ড আর্টিস্টিক মার্ডারের পটভূমিকা হিসেবে বালি ব্রিজ যেন আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হল। কী এলিগ্যান্ট চেহারা, কী রাজসিক আর্চ। আর চারপাশটা তো, আহা। কালো জলে ঝিকমিক করা কুচিকুচি আলো, গাছের আড়াল ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে ওঠা দক্ষিণেশ্বরের চুড়ো, ছায়াছায়া বারোমন্দির।
সে রাতে ব্রিজ যেন অন্য রাতের থেকেও বেশি ফাঁকা ছিল। আশেপাশে প্রেমিকপ্রেমিকাও চোখে পড়ছিল না তেমন। গাড়ি আসছিল একটা দুটো, তাও অনেক বাদে বাদে। ঠাণ্ডাটা আমাদের ওদিককার পক্ষেও একটু বেশিই ছিল। হুডিতে বিশেষ কাজ দিচ্ছিল না, আমি ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছিলাম, দাঁতে দাঁতে লেগে যাচ্ছিল। এমন সময় কী ভাগ্যিস, ব্রিজের অন্যদিক থেকে অগোছালো বাপির চেহারাটা উদ্ভাসিত হল। আমি পকেটের ভেতর ছুরির বাঁট শক্ত করে ধরলাম।
বাপিকে আমি কখনও পাঞ্জাবী আর ঝোলা ব্যাগ ছাড়া দেখিনি, কিন্তু সেদিন ও-ও হুডি পরে ছিল। প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম কিন্তু তারপর মনে পড়ল বাপি এখন কবিসম্মেলন থেকে ফিরছে না, ফিরছে টিউশনি বাড়ি থেকে। আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, বাপির একটা হাত আমার মতোই হুডির পকেটে ঢোকানো, অন্য হাতটা একদিকের চোয়াল চেপে আছে। এ ভঙ্গি আমার চেনা। আমার চেম্বারে ঢোকার সময় অধিকাংশ লোকেই এই ভঙ্গিতে ঢোকে।
বাপি দাঁতের ব্যথায় ভুগছে।
একমুহূর্তের জন্য আমি সব প্রতিহিংসাটিংসা ভুলে গেলাম জানেন, মনে হল বাপিকে বলি, কাল সকালে চেম্বারে এস, দেখে দেব। তারপরই চেতনা ফিরল। দাঁতের ব্যথা তো দূর অস্ত, বাপি নিজেই কাল সকাল পর্যন্ত থাকবে না।
অগোছালো বাপি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে এল। আমি ঝটিতি প্যান্টের পকেট থেকে ছুরি বার করলাম, নতুন ছুরির ফলা ঝকঝক করে উঠল, আমি চাপা গলায় যতখানি সম্ভব চেঁচিয়ে উঠলাম, “আমার বউয়ের সঙ্গে প্রেম করার শাস্তি এই নে, অগোছালো বাপি…”
“আমি অগোছালো নো-ও-ও-ই…” আর্তনাদটা শেষ হওয়ার আগেই ছুরির ফলা হুডি ফুঁড়ে বাপির পেটে ঢুকে গেল। আবেগ দরকারের থেকে বেশি হয়ে গিয়েছিল বোধহয়, ছুরিটা হাতল থেকে মুচড়ে আলগা হয়ে গেল। ফলাটা ঢুকে রইল শরীরের মধ্যে, হাতলটা রয়ে গেল আমার হাতে। চকচকে হলে কী হবে, কোয়ালিটি ভালো নয়। তারকেশ্বরের বদলে কাঞ্চননগর থেকে কিনলে বেটার হত। আমি ছুরিটা আমার সঙ্গে বাড়ি নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কারণ আমি চাই না বডিটার সঙ্গে ছুরিটাও আবিষ্কৃত হোক। প্ল্যানিংএর এই গ্লিচ কীভাবে সামলাব দ্রুত ভাবছি এমন সময় পরপর কতগুলো জিনিস আমার নজরে পড়ল।
এক, এ অগোছালো বাপি নয়। হাইট এবং বিল্ড অগোছালো বাপির মতো, কিন্তু বাপি না। ছুরির আঘাতে লোকটার মাথা থেকে হুডি খসে পড়েছিল, ব্রিজের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমি দেখলাম বাপির সঙ্গে লোকটার কোনও মিলই নেই। বাপির ঝাঁকড়া চুল, এর সামনে প্রায় টাক, বাপির মুখে দাড়ির জঙ্গল, এ লোকটা মাকুন্দ।
সর্বনাশ? উঁহু, সর্বনাশ কীসের? আফটার অল, কী ঘটেছে? আমি বাপির বদলে সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে খুনের অ্যাটেম্পট নিয়েছি, বা খুনই করেছি বলা ভালো (কিডনি তাক করে মেরেছি) কিন্তু সে ছাড়া আমাকে কেউ দেখেনি। আমি এই লোকটার সম্পূর্ণ অচেনা। লোক্যাল থানার ঘুষখোর অপদার্থগুলোর কথা ছেড়েই দিন, পৃথিবীর অতি বড় গোয়েন্দার পক্ষেও আমার পক্ষে একে খুন করার কোনও মোটিভ বার করা সম্ভব নয়।
রাইট?
রং।
কেন রং জানতে গেলে আমার পরের অবজার্ভেশনগুলো আপনার শুনতে হবে। ওই শীতের রাতে বালি ব্রিজের ওপর সম্পূর্ণ অচেনা একজন লোকের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়ার পর আমি রিয়েলাইজ করলাম লোকটার দাঁতে ব্যথা হয়নি। লোকটা নিজের চোয়াল চেপে হাঁটছিল না, লোকটা কানে একটা মোবাইল ফোন ধরে রেখেছিল। কারও সঙ্গে কথা বলছিল লোকটা।
ইন ফ্যাক্ট, তখনও বলছে।
“লেবুদাআআআ! আমাকে মাডার করছে, মাডার! বালি ব্রিজের ওপর। চিনি না, নির্ঘাত কাত্তিকের লোক! মালটার চোখে চশমা, বাঁকা নাক, ফোলা গাল, ফস্সা রং, চিবুক নেই, মালটা বুড়ো কিন্তু হুডি পরে এস্সেচে… লেবুদাআআ, পুলিস ডাকো, পুল্লিস্স্…মাগো… হেববি ব্লিডিং হচ্চে গো, ওরে ব- স-ন্-তি রে এ এ এ এ এ” বলে কে জানে কোন প্রেমিকা না স্ত্রীর নাম ধরে হাহাকার করতে করতে লোকটার গলা বুজে এল, হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল, লোকটা হাঁটু মুড়ে ব্রিজের ওপর বসে পড়ল, লোকটার হুড খোলা মাথাটা ঠকাস করে বালি ব্রিজের ফুটপাথে ঠুকে গেল।
এসব লাইনের লোকদের বোধহয় ট্রেনিং থাকে, আমার মুখটাকে যে এরকম কয়েকটা কিওয়ার্ডস-এ বেঁধে ফেলা যায় সেটা আমি আগে কখনও ভাবিনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজের মুখ দেখেছি রোজই, চোখে বুদ্ধির ঝিলিক, সঙ্গে সেবার একটা ভাবও চোখে পড়েছে। জীবনে প্রথমবার, ওই মুহূর্তে আমি বুঝলাম সেবটেবা, বুদ্ধিটুদ্ধির থেকেও লোকটার মৃত্যুকালীন বর্ণনাটা আমাকে ফিট করে অনেক বেশি। রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের দেহের ভেতর নিজের সঙ্গে সারাজীবন বাস করে আমি নিজেকে যেটুকু চিনেছিলাম, একটা লোক ছুরি খেয়ে মরতে মরতে ওই টিমটিমে আলোয় আমাকে তার থেকে বেশি চিনে এবং চিনিয়ে গেল।
ভাবতে পারেন?
ওয়েল, এসব কথা আমিও তখন ভাবতে পারিনি, কারণ লোকটা মাটিতে পড়ে যাওয়ায় আমার ভিশনটা ক্লিয়ার হয়ে গেল আর আমি টের পেলাম যে কেউ আমাকে দেখেনি কথাটা ঠিক নয়। আমি, অগোছালো বাপির প্রক্সি, ফোনের ওপারে লেবুগুণ্ডা - এই তিনজন ছাড়াও আরেকজন ঘটনাস্থলে আছে। লেবু তো শুধু বর্ণনা শুনেছে, কিন্তু এ একেবারে প্রত্যক্ষদর্শী।
একটা নেড়ি। বাদামি রঙের, আধপেটা খাওয়া, শীর্ণ একটা নেড়ি। লোকটার পেছন পেছন আসছিল। এখন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নেড়িটার চোখে চোখ পড়া মাত্র আরও একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। স্ত্রী না প্রেমিকা না বোন না বন্ধু না, এই নেড়ির নামই বাসন্তী। আর যেই না এই সত্যিটা রিয়েলাইজ করলাম, এক প্রবল গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাসন্তী প্রায় উড়ে এসে আমার পায়ে দাঁত বসিয়ে দিল।
এই দেখুন, এখনও সে দাগ আছে। ওরে বাবাই বটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছিল। জাস্ট ভাবুন একবার, আমি ভেবেছিলাম কোনও ফরেনসিকের বাবা আমাকে ধরতে পারবে না, আর এদিকে বাসন্তীর কল্যাণে বালি ব্রিজের ফুটপাথে ফোয়ারার মতো আমার বি পজিটিভ রক্ত ছিটকোচ্ছে। ব্যথা লাগেনি আবার? কিন্তু তখন ব্যথা ওয়াজ লিস্ট অফ মাই কনসার্নস। আমি দুই হাতে বাসন্তীকে পা থেকে কোনওমতে টেনে ছাড়িয়ে ফুটপাথে ছুঁড়ে ফেললাম। ওর দাঁতে আমার জিনসের একটা টুকরো ফড়ফড় করে ছিঁড়ে এল। ফুটপাথে আছাড় খাওয়ার পরমুহূর্তে আবার ছুটে এসে বাসন্তী আমার পায়ে লটকে গেল।
আমার সমস্ত ফোকাস তখন বডিটাকে নদীর জলে ফেলে দেওয়ায়। বাসন্তী চিৎকার করে গোটা ব্রিজ মাথায় তুলেছে, এক্ষুনি কেউ এল বলে, কিংবা গাড়ি থামিয়ে নামল বলে। আমি কোনওমতে লোকটাকে হিঁচড়ে টেনে তুললাম। সেটাকে নিয়ে রেলিং-এর গায়ে ভর দিয়ে রেখে রামধাক্কা দিতে রেডি হচ্ছি এমন সময় ঝমঝম করে ট্রেন এসে গেল।
আমার পারফেক্ট প্ল্যানে ট্রেন আসার সম্ভাবনাটা ছিল। কিন্তু এতক্ষণের ঘটনার ঘনঘটায় সম্ভাবনাটা আমার মাথা থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল। আওয়াজে চমকে উঠে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। হলদে আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ততক্ষণে ডেডবডি আর বাসন্তীর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আমার হুডি মাথা থেকে খসে গেছে। আই ওয়াজ ইন ফুল ভিউ। স্পষ্ট দেখলাম প্রতিটি কামরার জানালা দরজা থেকে সারি সারি মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অত রাতে অত ভিড় ট্রেন আগে আমি দেখিনি কখনও।
তখনও, তখনও বাঁচার চেষ্টা করা যেত, যদি আমি বডিটা হাওয়া করে দিতে পারতাম। পারলামও। সর্বশক্তি দিয়ে বডিটাকে রেলিং-এর ওপারে ঠেলে দিলাম।
তখনও, তখনও বাঁচার চেষ্টা করা যেত, যদি আমি বডিটা হাওয়া করে দিতে পারতাম। পারলামও। সর্বশক্তি দিয়ে বডিটাকে রেলিং-এর ওপারে ঠেলে দিলাম।
ধপ করে একটা শব্দ হল।
ইয়েস, ধপ করে। ঝপ করে না।
সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার। “উরিত্তারা! এ মালটা কী রে?”
আমি রেলিং-এর ওপর দিয়ে উঁকি মারলাম।
জলপুলিশের লঞ্চ। আলোকিত ডেকের ওপর একটা পুলিশ কোমরে হাত দিয়ে মুখ হাঁ করে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার পায়ের কাছে হাত পা ছত্রাকার করে পড়ে আছে, না অগোছালো বাপি নয়, নাককাটা পচা।
নামটা জানতে আরও কিছুদিন লেগেছিল, অফ কোর্স। তক্ষুনি যেটা শুনলাম সেটা সাইরেন। আকাশবাতাস এক করা সাইরেন। আমার অরিজিন্যাল প্ল্যানে এর পরের স্টেপ ছিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া, কিন্তু সে সিঁড়িটার দশ হাতের মধ্যে সেই মুহূর্তে পুলিশ লঞ্চ সাইরেন বাজিয়ে বনবন করে চতুর্দিকে সার্চলাইট ঘোরাচ্ছে। আমি রেলিং ছেড়ে নেমে ব্রিজের উল্টোদিকে ছুটে গেলাম, বাসন্তী তখনও আমার পা থেকে ঝুলছে এবং আমার পা থেকে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি দিকবিদিকশূন্য হয়ে সেই সব শুদ্ধু দৌড়লাম। একটা ভারি কিছু (একটা হলদে কালো ট্যাক্সি) প্রচণ্ড বেগে এসে আমাকে ধাক্কা মারল।
জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বেডে। নিউমোনিয়া আর রক্তক্ষয়। দুর্বলতা সামান্য কমলে বিচার হল। উল্টোদিকের কাঠগড়ায় একের পর এক এসে দাঁড়াল ট্যাক্সির ড্রাইভার, লেবু। কার্তিকের স্ট্যান্ডিং থ্রেট আছে, তাই পুলিশ লেবুকে প্রোটেকশন দিয়ে নিয়ে এসেছিল। কাঠগড়ায় উঠে সে কী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না লেবুর, “পচা আমার ভাইয়ের মতো ছিল স্যার, একেবারে আপন ভাইয়ের মতো” জাজও কালো আলখাল্লার খুঁট দিয়ে চোখ মুছছিলেন। তবে লেবুর থেকেও স্টার উইটনেস ছিল একজন, সে এল লাস্টে। বাসন্তী। পুলিশের বকলস পরে, সিংহের মতো গটমট করে এল। আমাকে দেখে কী চিৎকার। মোটা মোটা পুলিশরা টেনে রাখতে হিমশিম। শুনেছিলাম বাসন্তী সাহসিকতার জন্য কী সব অ্যাওয়ার্ডট্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। আর আজীবন ওসি-র লাঞ্চের মুরগির হাড় পেনশন।
তারপর থেকে এই জেলেই আছি। তা হল অনেকদিন। আরও অনেকদিন থাকতে হবে। খুন তো একটা না, দুটো। টেনশনে সুনন্দার গ্লাসে অ্যানাস্থেটিকের মাত্রা বেশি দিয়ে দিয়েছিলাম। অ্যাকচুয়ালি, এই একটাই দুঃখ আমার জানেন। আমি সিরিয়াসলি ভেবেছিলাম অগোছালো বাপিকে সরিয়ে দিলে আমার আর সুনন্দার সংসারটা আবার আগের মতো সুখের হয়ে যাবে।
তাহলে? মর্যাল অফ দ্য স্টোরি কী দাঁড়াল? মর্যাল অফ দ্য স্টোরি দাঁড়াল এই যে গোয়েন্দাগল্পে সব বাজে কথা লেখা থাকে। মার্ডার ইজ নট ইজি। ডেফিনিটলি নট। চারদিক দেখেশুনে, ভেবেচিন্তে, গুনেগেঁথে প্ল্যান করা মার্ডারও না।
উঠছেন? ওহ। তা হলও অনেকক্ষণ। আমাকেও যেতে হবে। তবে, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে জানেন। বহুদিন বাদে কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলে আরাম লাগল। আসবেন আবার, যদি সময় পান। তবে বেশি দেরি করবেন না, বুঝলেন, হেহে। কেন? ওয়েল, আপনি বলেই বলছি, মার্ডারটা পারফেক্ট হয়নি, কিন্তু আমি একটা পারফেক্ট এসকেপ প্ল্যান করছি। এখানে পেশেন্টের ঝামেলা নেই, সুনন্দার খ্যাচখ্যাচ নেই, কাজেই এবারের প্ল্যানটা আগেরটার থেকেও ফুলপ্রুফ হবে, আমি শিওর। ডিটেলসটা এক্ষুনি আপনাকে বলছি না, কয়েকটা জায়গা আরেকটু ঠিক করতে হবে। ঘটনাটা কাগজে বেরোবে নিশ্চয়, তখন পড়ে নেবেন, ওকে? কিছু মাইন্ড করলেন না আশা করি? প্লিজ করবেন না। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
besh moja legeche kintu eta pore:)
ReplyDeleteonubad jothariti fatafati -- PB
থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং কুন্তলা বন্দোপাধ্যায়ের পর হুগলি জেলার নবতম সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন লেবুগুন্ডা। অতি অবশ্য, পুরো কৃতিত্বটাই অবান্তরের।
ReplyDeleteগল্পটা দারুণ হয়েছে।
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, দেবাশিস।
Deleteeta darun hoyeche :)
ReplyDeleteবলছিস? থ্যাংক ইউ।
Deleteঅসামান্য| একেবারে আক্ষরিক অর্থেই এজ অফ দ্য সিট| দুর্দান্ত| শুধু "আসতে লাগে।" কেন ?
ReplyDeleteওহ, ওখানে অন্য কিছু লেখার চেষ্টা করব তবে। ধন্যবাদ, অন্বেষা।
Deleteআমার আরও দুটো বক্তব্য আছে| এক, বক্তার বয়েস হয়েছে (নাককাটা পচা বলেছে 'বুড়ো') তাহলে সুনন্দাও কিছু কচি খুকি নন, আর বাপির যা ডেসক্রিপশন (প্যাংলা, বাপের হোটেলে খেয়ে কবিতা লেখা ইত্যাদি) তাতে তার বয়েস সুনন্দার চেয়ে অন্ততঃ কমই হবার কথা, মানে, বেশ কম আর কি | এই ব্যাপারটা ভেবে দেখার মত|
ReplyDeleteদুই, যার পেটে ছুরি আমূল বসে গেছে (যাকে মেরে ফেলার জন্যেই ছুরিটা মারা হয়েছে) আর পক্ষে যে মারছে তার এত খুঁটিনাটি বর্ণনা দেওয়া সম্ভব? মানে "আমাকে মাডার করছে, মাডার! বালি ব্রিজের ওপর।....লেবুদাআআ, পুলিস ডাকো, পুল্লিস্স্…মাগো… হেববি ব্লিডিং হচ্চে গো, ওরে ব- স-ন্-তি রে এ এ এ এ এ” ' ইত্যাদি ঠিক আছে, কিন্তু বাকিটা ?
আমি এত কথা বলছি বলে ভাববেন না গল্পটা আমার ভালো লাগেনি, ইন ফ্যাক্ট, এটাই এখন পর্যন্ত আপনার পারফেক্টতম রহস্যগল্প|
ধন্যবাদ অন্বেষা।
Deleteএক নম্বর, এটা আমার গল্প নয়। অ্যান্থনি হরউইটজ একজন অতি পরিচিত রহস্যরোমাঞ্চ লিখিয়ে, গল্প পারফেক্ট হওয়ার কৃতিত্ব তাঁর।
দুই, মাঝবয়সী মহিলার যুবকের সঙ্গে প্রেম (বা যুবকের মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে) তো ভয়ানক কমন ব্যাপার বলেই আমি জানতাম।
তিন, আমি অবশ্য হরউইটজ-এর সঙ্গে কথা বলিনি, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল গল্পটা যতখানি রহস্য, তার থেকে বেশি হাসির। হাসির গল্পে ওই সমস্ত ছিদ্র, যে একটা লোক মরে যেতে যেতে অত কথা বলছে, থাকা অ্যালাউড বলেই আমার মনে হয়। অবশ্য আমার অনুবাদ পড়ে গল্পটা যে হাসির সেটা বোঝা না যেতে পারে, সে জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
awesome hoyechhey... ar agochhalo bapi nam ta chorom. antiquarian book seller er theke dher bhalo. :) tomar one of the best.
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, চুপকথা।
Deleteএকটি অবান্তর প্রশ্ন : কোন বাংলা ফন্ট টি ব্রাউজার অথবা কিন্ডেলে আপনার মতে সবচেয়ে বেশি পঠনযোগ্য ? অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষর পরিচ্ছন্ন এবং সুস্পষ্ট দেখা যায় কোন ফন্টে ? আমি বর্তমানে Noto Sans Bengali ব্যবহার করছি ।
ReplyDeletehttps://www.google.com/get/noto/#sans-beng
কৌস্তভ, আমি কিন্ডলে বাংলা পড়িনি এখনও আর কম্পিউটারে একমাত্র কোহিনুর বাংলা ফন্টই ব্যবহার করি। কাজেই তুলনামূলক রিভিউ দেওয়া অসম্ভব। আপনার বলা ফন্টটা দেখব ঘেঁটে। ধন্যবাদ।
Deleteওহহ কুন্তলা! জবাব নেই গো।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
Deleteজাস্ট দুর্ধর্ষ!! যেমন অনুবাদ, তেমন টান টান উত্তেজনা!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, কাকলি। খুব খুশি হলাম।
DeleteEtomon diye khub kom kaj e kore6i jibone. Triphala r alo te hulo der O eyesight ghuliye ge6e- tomar bhasay 'hi-five' !
ReplyDeleteহাই ফাইভ।
Deleteগপ্পোটা খুব ভালো, কিন্ত লেবুগুন্ডাকে বাদ দিলে হতোনা,অ্যাঁঁ??
ReplyDeleteকেন? আপত্তি কীসের?
Deleteমানে ভদ্রলোকের অনেক সুখ্যাত শুনেছি কিনা...
DeleteDarun hoyeche. Basanti-r idea ta ki apnar na ki original golpe chilo ?
ReplyDeleteধন্যবাদ, ঘনাদা। বাসন্তী গল্পে ছিল। তবে সে কুকুরের নাম ছিল না, নামটা আমি দিয়েছি, ফুটেজও বাড়িয়েছি।
DeleteDarun hoyechhe.. jemon tan tan lekha r temon I satires
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deletetotal paglaaa...total
ReplyDeleteprosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎ।
Deleteঠিক বলেছেন । প্রমান না রেখে খুন করা প্রায় অসম্ভব। আমিও খুজছি একটা ফুল প্রুফ প্ল্যান। পেলেই আপনাকে দিয়ে চেক্ করিয়ে ব্যাপারটা সেরে ফেলব ভাবছি।
ReplyDeleteহাহা, ক্রাইম সিন বালি ব্রিজেই নাকি আত্মদীপ?
Deletedurdanto laglo. jemon uttejona, temni satire. khasha :) :)
ReplyDeletekurnish!
থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
Deletekhuner golpo porte porte moja pachhi ei prothom holo... darun Kuntala- Bratati.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী। কৃতিত্ব পুরোটাই আসল লেখকের, তবু তোমার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে।
Delete