বাড়ি
এ বছর প্রথম (এবং শেষ)বারের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। আমরা রেডি, দু’তরফের বাবামা রেডি, বসের সম্মতি আদায় হয়ে গেছে,
টিকিট তো কাটা হয়ে গেছে, জানালার ধারের সিট বেছে চেক ইনও করে ফেলব, কেনাকাটা সারা, ব্যাগ গোছানো হয়নি কিন্তু হয়ে যাবে। বড়দিনে কী করছ?র উত্তরে যেই বলছি, বাড়ি যাচ্ছি, সবাই হিংসে হিংসে মুখে তাকাচ্ছে। তারপর জিজ্ঞাসা করছে, ক’দিনের জন্য? আমি বলছি এই তো শনিবার বেরোব, বুধবার ফিরব।
অমনি হিংসে উধাও।
মাত্র?
আরেকটু বেশিদিনের জন্য যেতে পারতে।
ছুটি পেলে না নাকি?
আমি সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা ধরে ঝুলে পড়ি। ছুটির কথা আর বোলো না, যা টানাটানি।
কিন্তু এটা মিথ্যে কথা। সত্যি কথাটা হচ্ছে ছুটি পেলেও আমি এর থেকে বেশিদিনের জন্য বাড়ি যেতাম না।
তার কারণ এই নয় যে আমার মাবাবাঠাকুমাকে যথেষ্ট ভালোবাসি না। মা যখন এনে জলের গ্লাসটা হাতে ধরান, আমার মনে হয় না, ওরে বাবা খেটে খেটে মরলাম। বাবা যখন সকালবেলা উঠে, কী সোনামা, কী খবর বলে খাটের পাশে এসে বসেন, বেড়ানোর গল্প করেন, চেনাঅচেনা জায়গার খোঁজখবর দেন, আমার মোটেই মনে হয় না যে এসব গল্প করার থেকে বরং রাজনীতির হেডলাইনগুলোতে চোখ বোলালে ভালো হত। ঠাকুমা যখন একশোবার বলার পরও একশো এক বারের বার অর্চিষ্মানের সঙ্গে আমার কখন কোথায় দেখা হল সে গল্প শুনতে চান, আমার একবারও মনে হয় না, উফ মহিলা বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলেন।
বরং রোজ সকালে উঠে ঠাকুমাকে জাপটে ধরে ঠাকুমার ভাঙা গালে গাল পাততে যে আরামটা হয় সেটা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। আমার পাঁচ আটের ঠাকুমা, খাটে শুয়ে থেকে থেকে আমার প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছেন। ঠাকুমার আঙুলগুলো এখন টেনে সোজা করে না ধরলে সোজা হয় না, অথচ ওই আঙুল একদিন দুধওয়ালাকে, বাবাকে, এমনকি জেঠুকেও বকত। ভাতের গ্রাস আমার মুখে পুরে দিত, রান্নাঘরের দরজা দিয়ে আকাশের দিকে তাক করে আমাকে আকাশের দিকে দেখাত। ওটা কী? ওটা ঘন কালো মেঘ। উঁহু। ওটা হচ্ছে বকাসুর। সোনা ভাত খেয়েছে না গালে পুরে বসে আছে দেখতে এসেছে।
মানুষগুলো যদি ছেড়েও দিই, বাড়িটাকেও আমার দারুণ ভালো লাগে। সুরকির দেওয়াল, উঁচু উঁচু চৌকাঠ, দরজায় খিল, জানালায় শিক, শিকের ওপারে পেঁপে আর রঙ্গনগাছ, ছাদ, ছাদের ওপর খোলা আকাশ। আকাশের গায়ে নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। আর স্পষ্ট শোনা যায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পরিশীলিত গলার ঘোষণা, দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে তারকেশ্বর লোকাল ঢুকছে।
তবু আমার বাড়িতে দু’দিনের বেশি থাকতে ভালো লাগে না কেন? কেন না, স্বাধীনতা হীনতায় আর কেউ চাক না চাক, আমি বাঁচতে চাই না।
এটাও বলে বোঝানো শক্ত। আমার বাড়িতে আমি কি পরাধীন? মোটেই না। যখন বাড়িতে থাকতাম তখন কি স্বাধীনতা নিয়ে বাবামাঠাকুমাপিসির সঙ্গে প্রভূত সংগ্রাম করতে হত? তাও না। জীবনের প্রথমবার প্রেম করার উত্তেজনায় মাস চোদ্দ আমি কিছু বাঁদরামো করেছিলাম, সেটুকু ছাড়া আমার বাবামা স্বীকার করবেন যে আমাকে সামলাতে করতে তাঁদের কোনও সমস্যা হয়নি। ডানে যেতে বললে ডানে গেছি, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে, উঠতে বললে উঠেছি, বসতে বললে বসেছি। এবং স্বেচ্ছায়ই করেছি। বাবামা যে বেঁধে মারছেন এ কথা মনে স্থানও পায়নি। এখন যখন বড়বড় লোকদের ইন্টারভিউতে তাঁদের ওয়াইল্ড ছোটবেলার কথা শুনি, কারও কথা শোনেননি, কোনওদিন নিয়মের নিগড়ে নিজেদের বাঁধতে পারেননি, আফসোস হয়। বুঝি কেন আমার কোনওদিন বড়মানুষ হওয়া হবে না। আমার ক্লেম টু ফেম, আমি ভয়ানক বাধ্য। এখনও পরিস্থিতি বিন্দুমাত্র বদলায়নি, বদলানোর আশাও নেই। আমার ছোটবেলার মতো বুড়োবেলাও আগাপাশতলা পোষমানা। কাজেই এমন নয় যে দিল্লির বাড়িতে আমি পার্টি করে ফাটিয়ে দিচ্ছি, রিষড়ার বাড়িতে সেসব করা যাবে না বলে আমি সেখানে থাকতে চাই না।
কিন্তু এই জানাটা, যে এঁরা চাইলে আমাকে বকতে পারেন, আমার ওঠাবসা, জীবনাচরণ নিয়ে মন্তব্য করতে বা আপত্তি তুলতে পারেন, এবং যদি সে রকম হয় তাহলে আমি, স্রেফ বাধ্য হওয়ার সুবাদেই, আমার রকম ছেড়ে তাঁদের রকমে নিজেকে গুছিয়ে নেব, এই জানাটাতেই আমার আতংক হয়। কোনও আদর, কোনও নস্ট্যালজিয়া, কোনও চেনা দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ আমার সে আতংক নিরাময় করতে পারে না। আমার পিঠেপায়েস চাই না, রাতে ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ার অধিকারটুকু চাই।
এই মুহূর্তে হাঁ করে আছি আর দু’দিন পর বাবামাঠাকুমাকে দেখব বলে, ছাদে উঠে ঘুরব বলে, মায়ের পাশে আমার চেনা জানালার পাশে শুয়ে ঘুমোব বলে। বাড়ি গেলে ভীষণ আনন্দ হবে জানি, কিন্তু আরাম হবে না।
আরাম হবে আবার যখন চাবি ঘুরিয়ে আমার এই দু’কামরার ভাড়াবাড়িতে ঢুকব। নিজেকে নিজে সুটকেস কাল গোছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোনওমতে জামাকাপড় ছেড়ে খাটের ওপর লেপের তলায় ঢুকে বুকের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে কানে হেডফোন গুঁজব। তখনই আবার আমিই আমার মালিক। তখনই আবার আমি সবথেকে সুখী।
আপনাদের বাড়িতে থাকতে ভালোলাগে? ক’দিন?
tomar eirakam lekha guli porte baro bhalo lage....khub sundor.
ReplyDeleteamar barite khub e bhalo lage..karon ta holo amar barir ashe pashe khu durdanto khabar..birani chinese roll fuchka..sob e soshtay e umda quality pawa jay..tai..ar karmokhetre...sei self cooked seddho khabar...tai janyo....tobe tomar kothatao thik..ei bhabe besidin sue bose thakle abar mon ta kajer jaygar janyo palai palai kore..
prosenjit
বরং রোজ সকালে উঠে ঠাকুমাকে জাপটে ধরে ঠাকুমার ভাঙা গালে গাল পাততে যে আরামটা হয় সেটা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। আমার পাঁচ আটের ঠাকুমা, খাটে শুয়ে থেকে থেকে আমার প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছেন। ঠাকুমার আঙুলগুলো এখন টেনে সোজা করে না ধরলে সোজা হয় না, অথচ ওই আঙুল একদিন দুধওয়ালাকে, বাবাকে, এমনকি জেঠুকেও বকত। ভাতের গ্রাস আমার মুখে পুরে দিত, রান্নাঘরের দরজা দিয়ে আকাশের দিকে তাক করে আমাকে আকাশের দিকে দেখাত। ওটা কী? ওটা ঘন কালো মেঘ। উঁহু। ওটা হচ্ছে বকাসুর। সোনা ভাত খেয়েছে না গালে পুরে বসে আছে দেখতে এসেছে।
ReplyDeleteমানুষগুলো যদি ছেড়েও দিই, বাড়িটাকেও আমার দারুণ ভালো লাগে। সুরকির দেওয়াল, উঁচু উঁচু চৌকাঠ, দরজায় খিল, জানালায় শিক, শিকের ওপারে পেঁপে আর রঙ্গনগাছ, ছাদ, ছাদের ওপর খোলা আকাশ। আকাশের গায়ে নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। আর স্পষ্ট শোনা যায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পরিশীলিত গলার ঘোষণা, দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে তারকেশ্বর লোকাল ঢুকছে।
bahudin por best of the best grade lekha pelam...great..carry on
prosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎ।
Delete"কিন্তু এই জানাটা, যে এঁরা চাইলে আমাকে বকতে পারেন, আমার ওঠাবসা, জীবনাচরণ নিয়ে মন্তব্য করতে বা আপত্তি তুলতে পারেন, এবং যদি সে রকম হয় তাহলে আমি, স্রেফ বাধ্য হওয়ার সুবাদেই, আমার রকম ছেড়ে তাঁদের রকমে নিজেকে গুছিয়ে নেব, এই জানাটাতেই আমার আতংক হয়। কোনও আদর, কোনও নস্ট্যালজিয়া, কোনও চেনা দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ আমার সে আতংক নিরাময় করতে পারে না। আমার পিঠেপায়েস চাই না, রাতে ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ার অধিকারটুকু চাই। "
ReplyDeleteবাঁচালেন মশাই| এই ভাবনাগুলো যে আমার একার মাথায় আসে না, এবং এগুলো আসা মানেই যে আমি আমার মা বাবা দিদাকে কম ভালোবাসি এমনটা নয় - এটা আরেকবার মনে পড়তে আরাম পাচ্ছি|
আমারও হোস্টেলবাসের প্রায় বছর আষ্টেক হল, আমিও উইকেণ্ডে বাড়ি যাই, ইদানীং এক-দেড়দিন যেতে না যেতেই হাঁসফাঁস করতে থাকি, মনে হয় কতক্ষণে হোস্টেলে নিজের বিছানায় গিয়ে শোব| রাতে কুঁদরীর তরকারী মেনে নিতে পারি, যদি তার পরে অখন্ড একলা থাকার সুখটুকু নিশ্চিত থাকে|"তখনই আবার আমিই আমার মালিক। তখনই আবার আমি সবথেকে সুখী।"
হাই ফাইভ|
বেশিদিন হোস্টেলে থাকার এক্সটারনালিটিজ, অন্বেষা। হাই ফাইভ।
Delete2 din moto. tao ami barir 2 tolai thaki, baba maa 3 tolai. khabar somoy ar kichu bolar thakle opore jai, generally :D
ReplyDeletesml
হাই ফাইভ।
DeleteHit the nail on the head korecho ekdom. Hit the nail on the head.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, বিম্ববতী।
Deletethakumar galpo sonar janyo bose achi :) tinni
ReplyDeleteদেখা যাক, কিছু গল্প জমে কি না।
Deletetumi ei Christmas e ekdom moner kotha likhecho Kuntala di.. ami pray 6.5 bochor pore abar barite ektana besh kichudin theke dekhlam same feeling hoyeche.. ami chara je onno oneke mane amar chokhe jara besh bhalo chele meyer modhye pore tader kotha bolchi.. tarao je ek i bhabe eta bhebe aro bhalo laglo... :) thakumar golpo onek din pore holo.. darun..
ReplyDeleteসবাই একই দয়ে আছি রে ঊর্মি, কাজেই একই রকম ভাবে যে ভাবব তাতে আর সন্দেহ কী।
Delete14 maser prothome prem Bolen ki
ReplyDeletekhub khub bhalo laglo eto honest lekha Kuntala. Ami jiboner ardhek tai barir baire. kono din sujog o hoyni besi thakar tai ei bishoy ta niye khub ekta motamot nei. Tabe ei feelings gulo anke kachhe loker hote dekhechhi... swadhinota bodh thaka ta anyay kichu noy borong it inculcates a sense of responsibility...
ReplyDeleteTabe badhyo howa ta khub bipojjonok trait, anyone besides own parents, siblings and significant other are always armed to take advantage of that, more so if that is coupled with the bhodrota you have. - Bratati.
থ্যাংক ইউ, ব্রততী। বাধ্য হওয়াটা বাচ্চার বাবামায়ের/মাস্টারমশাই দিদিমণিদের পক্ষে সুবিধেজনক হতে পারে, বাচ্চা বড় হলে তার নিজের পক্ষে খুব একটা নয় এ আমি নিজেও মানি।
Deleteআমার পিঠেপায়েস চাই না, রাতে ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ার অধিকারটুকু চাই। - sref ei karon tar jony barti firte amar voy korchilo , amar eka thakteo sobsomoy bhalo lagto emon na kintu bhalobasar dabitao amar sob somoy bhalo lage na - PB
ReplyDeleteআমার তো দাবি ব্যাপারটাই খারাপ লাগে, প্রদীপ্ত, সে ভালোবাসারই হোক কি অভালোবাসার।
Delete