এ মাসের বই/ নভেম্বর ২০১৭



Do Androids Dream of Electric Sheep?/Philip K. Dick


উৎস গুগল ইমেজেস

“Kipple is useless objects, like junk mail or match folders after you use the last match or gum wrappers or yesterday's homeopape. When nobody's around, kipple reproduces itself. For instance, if you go to bed leaving any kipple around your apartment, when you wake up the next morning there's twice as much of it. It always gets more and more." [...]"There's the First Law of Kipple," [...] "'Kipple drives out nonkipple.' [...]"No one can win against kipple," he said, "except temporarily and maybe in one spot, like in my apartment I've sort of created a stasis between the pressure of kipple and nonkipple, for the time being. But eventually I'll die or go away, and then the kipple will again take over. It's a universal principle operating throughout the universe; the entire universe is moving toward a final state of total, absolute kippleization.”

'ব্লেড রানার ২০৪৯' দেখতে গিয়ে পঁয়ত্রিশ বছর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা 'ব্লেড রানার'-এর কথা জানতে পারলাম, 'ব্লেড রানার' সম্পর্কে জানতে গিয়ে জানলাম ফিলিপ কে ডিক-এর দু’শো চুয়াল্লিশ পাতার উপন্যাস ‘ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ?’-এর কথা, যাকে ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল অরিজিন্যাল 'ব্লেড রানার'।

‘ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ’-এর ঘটনা ঘটছে পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে। তেজস্ক্রিয়ায় গাছপালা, পশুপাখি ধ্বংস হয়ে গেছে, চারদিকে ধুলো, সে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের চেনা পৃথিবীর কোনও মিল নেই।  যারা অ্যাফর্ড করতে পেরেছে তারা অন্য গ্রহে চলে গেছে। ইন ফ্যাক্ট, মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য কর্তৃপক্ষ সবাইকে পৃথিবী ছাড়াতেই উৎসাহ দিয়েছেন। সেখানে আছে পরিষ্কার হাওয়া, নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি এবং একান্ত নিজস্ব অনুকূল! অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড চাকর।

তা বলে পৃথিবী একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়নি। বলা বাহুল্য, গরিব লোকেরা পালাতে পারেনি, আর পারেনি যারা তেজস্ক্রিয়তায় বেশিরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ‘চিকেন হেড’ এ পরিণত হয়েছে। তারা আটকে গেছে এমিগ্রেশনের জন্য দরকারি আই কিউ না দেখাতে পারায়। গরিব, বোকা, ধুলোয় ভর্তি, গাছহীন, পশুপাখিহীন পৃথিবী ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঘুরে চলেছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেক আপদ, তা হল দুর্বৃত্ত অ্যান্ড্রুয়েড। যত নতুন নতুন মডেল বেরোচ্ছে তারা তত মানুষের মতো হয়ে উঠছে, কেউ কেউ আর ‘যেমন চালাও তেমন চলি’ নীতিতে বিশ্বাসী থাকতে চাইছে না। এইসব অ্যান্ড্রয়েডদের সামলানোর জন্য পুলিসফোর্সে আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে, তাছাড়া আরও নানারকম বাড়তি সাহায্যও দরকার হয়ে পড়েছে। যথা, বাউন্টি হান্টারস। 

গল্পের হিরো রিক ডেকার্ড এরকমই এক বাউন্টি হান্টার। ডেকার্ড দুর্বৃত্ত অ্যান্ড্রয়েডদের ‘রিটায়ার’ করে, পার রিটায়ার পয়সা পায়। ডেকার্ড সানফ্রান্সিসকো শহরে স্ত্রী আইরানের সঙ্গে থাকে। গল্প শুরু হওয়ার সময় আমরা জানতে পারি মঙ্গল থেকে ছ’জন নেক্সাস-৬ মডেলের অ্যান্ড্রয়েড পালিয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, তাদের ধরার জন্য যাদের লাগানো হয়েছিল, একজনকে অলরেডি তারা নৃশংসভাবে খুন করেছে। পুলিসকর্তা প্যানিকড হয়ে ডেকার্ডকে খবর পাঠিয়েছেন, অবিলম্বে মিশনে বেরোতে হবে। নেক্সাস-৬ মডেল এ যাবৎ অ্যান্ড্রয়েড ম্যানুফ্যাকচারিং ইতিহাসে বেস্ট মডেল, কাজেই সবথেকে বেশি মানুষের মতো এবং প্রায় মানুষের মতোই বিপজ্জনক। এদের ‘রিটায়ার’ করানোর জন্য চাই সেরা শিকারি।

সেই শিকারি আমাদের রিক ডেকার্ড। 

গল্পের শুরুতে আমরা এও জানতে পারি, ডেকার্ড নিজের কাজ নিয়ে অতৃপ্ত, সে এই বাউন্টি হান্টারের জীবন থেকে নিষ্কৃতি চায়। তবু সে এই মিশনে নামতে রাজি হয়। কেন? শুধু কি পুলিসকর্তাকে ‘না’ বলতে না পেরে? নাকি নিজের কাজের প্রতি এখনও কোথাও কোনও মায়া বা উত্তেজনা বাকি থেকে যাওয়ায়? এসবের কোনওটাই নয়। রিক ডেকার্ডের শেষবারের মতো অ্যান্ড্রয়েডনিধনে নামার অনুপ্রেরণা হচ্ছে টাকা। ছ’জন অ্যান্ড্রয়েডকে রিটায়ার করে ডেকার্ড যা রোজগার করবে তা দিয়ে সে একটা সত্যিকারের, রক্তমাংসের পোষ্য কিনবে। এখন তার যে ইলেকট্রিক ভেড়াটা আছে, অবিকল সত্যিকারের ভেড়ার মতোই, সেটার বদলে।

কল্পবিজ্ঞান শুনলেই আমাদের মাথায় আসে উদ্ভট পোশাক, উদ্ভট অভ্যেস, উদ্ভট যন্ত্র যারা আমাদের সমকালের থেকে ভবিষ্যৎকে আলাদা করে। ফিলিপ কে ডিকের উপন্যাসেও সে রকম অনেক জিনিস আছে। হভার কার, যে গাড়ি বায়ু, জল, মাটি সবেতে চলতে পারে, অত্যাধুনিক লেজার বন্দুক। কিন্তু যে উদ্ভট যন্ত্রটিকে আমার সবথেকে ইন্টারেস্টিং লেগেছে সেটার উল্লেখ আছে বইয়ের প্রথম দৃশ্যেই। 

পেনফিল্ড মুড অর্গ্যান। 

যন্ত্রটি সরল। যন্ত্রের সঙ্গে একটি ম্যানুয়াল আছে, তাতে নানারকম মুড এবং তার করেসপন্ডিং নম্বর দেওয়া আছে। মুড অর্গ্যানে সেই নম্বর ডায়াল করলেই উক্ত মুড আপনি পেয়ে যাবেন। যেমন ধরুন, অ্যান্ড্রয়েড মারতে বেরোনোর সকালে রিক ডেকার্ড সকালবেলা যন্ত্রে সেট করল ‘Optimistic businesslike attitude’। আরেকটা কমন মুড হচ্ছে ‘the desire to watch television, no matter what is on.  মুড অর্গ্যানে শুধু যে এইসব ভালো ভালো মুডই সেট করা যায় তা নয়, নিজেকে অত্যাচারের ইচ্ছে থাকলে তার সুযোগও আছে, রিক ডেকার্ডের স্ত্রী আইরান যেমন সারাদিনের জন্য শেডিউল করে রাখছেsix hours of existential despair.’  

কিন্তু এইসব অত্যাধুনিক যন্ত্র, বন্দুক, রোবট ইত্যাদিতে ঠাসা গল্প হলে ‘ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ’ এত বিখ্যাত হত কি না সন্দেহ। এ উপন্যাসের মূল কথা সেই অন্যরকম পৃথিবীটার অন্যরকম যন্ত্রপাতি নয়। মূল কথা হচ্ছে সেই অন্যরকম পৃথিবীর মানুষরা। তাদের বাঁচামরা, আশানিরাশা, চাওয়াপাওয়া, ভালোমন্দ, ন্যায়নীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, বিনোদন। ফিলিপ কে ডিকের উপন্যাসে এই ধর্ম এবং বিনোদনের একটা সম্মুখসমর আমরা দেখতে পাই। ধর্মের দিকে রয়েছে মার্সারিজম, উইলবার মার্সার বলে একজন সে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এ ধর্মের মূল কথা ‘এমপ্যাথি’ বা সহানুভূতি। এ ধর্মের অনুরাগীরা বিশ্বাস করে, ব্যক্তি এবং সমষ্টির প্রতি সহানুভূতি অনুভব করাতেই মোক্ষ। এখানে সহানুভূতি বলতে আমরা রোজ সকালবিকেল রাস্তার গরিব ভিখিরি বাচ্চাদের দেখে যে জিনিসটা ফিল করি সেটা নয়, এ অনুভূতি আক্ষরিক। চার্চ, মসজিদ, মন্দিরের বদলে এ ধর্মের বিশ্বাসীদের বাড়িতে বাড়িতে একখানা করে এমপ্যাথি বক্স আছে, সে বাক্সের মধ্যে ঢুকে একটা হাতল ছুঁয়ে দাঁড়ালেই ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে মানুষ অন্য মানুষের যন্ত্রণা, আনন্দ এবং যাবতীয় অনুভূতির নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ে। একে অপরের যাবতীয় অনুভূতি নিজের শরীরে মনে অনুভব করে। এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে রয়েছেন উইলবার মার্সার স্বয়ং, তিনি একটা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ক্রমাগত প্রস্তরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন, এমপ্যাথি বাক্সের মধ্য দিয়ে তাঁর অনুগামীরা তাঁর সেই যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছে। যেন মার্সার নন, পাথর এসে লাগছে তাদের নিজেদের শরীরেই। আবার কোনও অনুরাগীর পোষা প্রাণী মরে যাওয়ার যন্ত্রণা, বা পোষা প্রাণী কেনার আনন্দও অনুরাগীরা এমপ্যাথি বাক্সের মধ্য দিয়ে নিজেদের শরীরে, মনে অনুভব করতে পারছে । এইসব আনন্দ, দুঃখ, যন্ত্রণা কাটাকুটি হয়ে চলেছে অবিরত। 

আর এর ঠিক উল্টোদিকে আছে বাস্টার ফ্রেন্ডলির টোয়েন্টি ফোর সেভেনের রুদ্ধশ্বাস টক শো। সেলেব্রিটিদের অবিরাম সাক্ষাৎকার চলে এই শোতে, তারা কারা, কী কারণে সেলেব্রিটি সে সব স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাদের জীবন, অভিজ্ঞতা, হাসি, কান্না, গিলছে সবাই বসে বসে চব্বিশঘণ্টা। বিনোদন ছাড়াও বাস্টার ফ্রেন্ডলির শোয়ের আরেকটা মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মার্সারিজম তথা উইলবার মার্সারকে ভণ্ড প্রমাণ করা। ক্রমাগত ‘তদন্তমূলক সাংবাদিকতা’ চালিয়ে বাস্টার ফ্রেন্ডলি উইলবার মার্সার সম্পর্কে নানা খতরনাক সত্য উদ্ঘাটন করতে থাকে। 

একদিক থেকে দেখলে, মার্সারিজম আর বাস্টার ফ্রেন্ডলি টক শোয়ের তফাৎটা সাদাকালোর। মার্সারিজম যেখানে একে অপরের সঙ্গে সংযোগের কথা বলে, বাস্টার সেখানে ওয়ান-ওয়ে এন্টারটেনমেন্ট। মার্সারিজমে একা ঘরে বসে এমপ্যাথি বক্সের মধ্য দিয়ে অনেকের সঙ্গে এক হওয়া যায়, আর বাস্টার ফ্রেন্ডলির টক শো শুনতে শুনতে মানুষ একাকীত্ব অনুভব করতে পারে না। মার্সারিজম সংবেদনশীলতাকে ক্রমাগত শান দিতে দিতে চূড়ান্ত পর্যায় নিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার পাশের মানুষের অনুভূতির সশরীরে অনুভব করতে পারে, আর বাস্টার ফ্রেন্ডলি ক্রমাগত শব্দ, দৃশ্য, রঙের হুল্লোড়ে আমাদের ইন্দ্রিয় ভোঁতা করতে থাকে।

কিন্তু আমার মতে (ওয়েল, যারা যারা এই বই পড়েছেন তাঁদের সবার মতেই), এই সব খুঁটিনাটি ‘ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ?’-এর মূল প্রশ্ন নয়। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে মানুষ কীসে মানুষ হয়? আর অ্যান্ড্রয়েড কীসে মনুষ্যেতর থেকে যায়? আর মানুষ আর অমানুষকে আলাদাই বা চেনা যায় কী করে?

অ্যান্ড্রয়েডরা, বিশেষ করে নেক্সাস-৬ মডেলের অ্যান্ড্রয়েডরা এত বেশি মানুষের মতো, যে মারার আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হয় যে তারা মানুষ না অ্যান্ড্রয়েড। সে জন্য নানারকম পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু স্টেট অফ দ্য আর্ট যে পরীক্ষাটিতে রিক ডেকার্ড ব্যক্তিগতভাবে ভরসা করে তা Voigt-Kampff test. এই টেস্টের অংশ হিসেবে প্রশ্নকর্তা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা অ্যান্ড্রয়েডকে কয়েকটি নৈতিক এবং দার্শনিক প্রশ্ন করেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নয়, উত্তর দেওয়ার সময় উত্তরদাতার সূক্ষ্মতম শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখে তার মনুষ্যত্ব কিংবা মনুষ্যত্বের অভাব নির্ধারণ করা হয়। 

একটা প্রশ্নের নমুনা এই রইলঃ 

"Now consider this. You're reading a novel written in the old days before the war. The characters are visiting Fisherman's Wharf in San Francisco. They become hungry and enter a seafood restaurant. One of them orders lobster, and the chef drops the lobster into the tub of boiling water while the characters watch."

যাঁরা রেড লবস্টার-এ গিয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে সবথেকে মোটা আর লাল লবস্টার বেছে সেটা শেফকে রান্না করতে দিয়েছেন, এই পরীক্ষায় তাঁরা একজনও মানুষ বলে গণ্য হবেন না।

Voigt-Kampff test-এর অধিকাংশ, প্রায় সব প্রশ্নই অন্য প্রাণের প্রতি প্রাণের সাড়া বা এমপ্যাথি মাপার। সেটার কারণ সম্ভবত ওই সময়কার পৃথিবীতে প্রাণ এত বিরল, সাপ্লাই ডিম্যান্ডের নিয়ম মেনেই তা প্রায় হীরের মতো দামি হয়ে উঠেছে। জ্যান্ত পশু বা পাখি পুষতে পারা সামাজিক প্রতিষ্ঠার সংকেতে পরিণত হয়েছে। 

বলা বাহুল্য, এই পরীক্ষা ফুলপ্রুফ নয়। প্রথমত এতে 'এমপ্যাথি' কেই মনুষ্যত্বের একমাত্র মাপকাঠি বলে ধরা হয়েছে, যেটা তর্কসাপেক্ষ। তাছাড়াও কেন একজন মানুষ এমপ্যাথেটিক আর অন্যজন নয়, সেটার নানারকম কারণ থাকতে পারে। হয়তো বিকাশগত বাধা একটা কারণ। তাছাড়া যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এমপ্যাথিই মনুষ্যত্বের শেষ কথা, তখনও আরও অনেকগুলো প্রশ্ন উদয় হয়। কার প্রতি এমপ্যাথি? মার্সারিজম অনুযায়ী অন্য মানুষের প্রতি, Voigt-Kampff test-এর প্রশ্নপত্র অনুযায়ী জীবজন্তুর প্রতি। মেশিনের প্রতি এমপ্যাথি কেন নয়? অ্যান্ড্রয়েডদের প্রতি কেন নয়? 

তাছাড়াও মানুষ-অ্যান্ড্রয়েড চেনায় পরীক্ষাটির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন জাগে। একটি দৃশ্যে রিক ডেকার্ডকে স্বয়ং ওই টেস্টে বসতে হয়, এবং সন্দেহ জাগে সে নিজে মানুষ না অ্যান্ড্রয়েড। 

এই সব দাঁতভাঙা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে রিক ডেকার্ডের অ্যান্ড্রয়েড-শিকার চলতে থাকে। ক্রমাগত আবিষ্কার হতে থাকে যে অ্যান্ড্রয়েডরা মানুষের সমাজের কত গভীরে ঢুকে পড়েছে, রিক ডেকার্ড যাদের সঙ্গে উঠেছে বসেছে অ্যান্ড্রয়েড মেরেছে, বোন ম্যারো পরীক্ষায় বেরোচ্ছে তারাও আসলে অ্যান্ড্রয়েড ছিল। হভার কারে চড়ে, লেজার গানে চেপে যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে এই সব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি আরও একটা মারাত্মক ওল্ডস্কুল, চিরচেনা অস্ত্রের বহুলব্যবহার হতে থাকে এই কল্পবিজ্ঞানের পৃথিবীতে। কী বলুন দেখি?

নারীশরীর। 

এই পৃথিবীতে এবং পৃথিবীর সৌরজগতের অন্যান্য উপনিবেশেও নারীশরীরের চাহিদা গগনচুম্বী। রক্তমাংস এবং অ্যান্ড্রয়েড, দুই ভ্যারাইটিরই। পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহে রক্তমাংসের নারীর সঙ্গে অ্যান্ড্রয়েড নারী শরীরের বাজার চলছে রমরম করে, এ বাজারকে কর্তৃপক্ষ বেআইনি ঘোষণা করেছেন, কিন্তু পুরুষের কাছে নারীশরীরের চাহিদাই নাকি আদিমতম এবং অনতিক্রম্য, কাজেই সে আইনকে সবাই কাঁচকলা দেখাচ্ছে। এমনকি অ্যান্ড্রয়েডরাও বুদ্ধি খাটিয়ে তাদের আর্মিতে কিছু নিখুঁত শরীরওয়ালা নারীমডেল রেখেছে, যাদের কাজই হচ্ছে বাউন্টি হান্টারদের প্রলুব্ধ করে অ্যান্ড্রয়েডনিধন মিশন থেকে তাদের বিচ্যুত করা। বলা বাহুল্য, লেজার গানের থেকে এই স্ট্র্যাটেজি কোনও অংশে কম কাজ দিচ্ছে না।   

মানুষ মঙ্গলে পৌঁছে গেলেও যে কিছু জিনিস অবিকল একরকম থেকে যাবে, এটা আশ্বাসের।

*****

A Kiss Before Dying/ Ira Levin


উৎস গুগল ইমেজেস

এ মাসের গোড়ায় একজন বুকব্লগারের মুখে একটি বিখ্যাত গোয়েন্দা উপন্যাসের নাম শুনলাম। আইরা লেভিন-এর লেখা ‘আ কিস বিফোর ডাইং’। বইটা সম্পর্কে উৎসাহ সম্বন্ধ আরও বাড়ল যখন জানলাম ‘বাজিগর’ সিনেমাটি এই বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। পড়ে বুঝলাম বাজিগর বইটি থেকে অনেকটাই আলাদা, তারপর জানলাম 'আ কিস বিফোর ডাইং' নিয়ে হলিউডে খানদুয়েক সিনেমা বানানো হয়েছে, বাজিগর তাদের একটার কপি। আমি সে সব সিনেমা দেখিনি, কাজেই সত্যিমিথ্যে বলতে পারব না। 

বলার দরকারও নেই, কারণ আজ আমাদের আলোচ্য 'আ কিস বিফোর ডাইং'-ভিত্তিক সিনেমা নয়, 'আ কিস বিফোর ডাইং' গল্পটি স্বয়ং। গল্পটি শুরু হয় এক চরিত্রের সীমিত প্রথম পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সে তার বর্তমান প্রেমিকাকে খুনের প্ল্যান করছে। বইয়ের গোড়ার কয়েকটি পাতায় তার ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য আমরা জানতে পারি। জানতে পারি সে নার্সিসিস্টিক এবং সাইকোপ্যাথ। ন্যায়অন্যায়ের ধারণাটা আর পাঁচজন লোকের থেকে তার আলাদা। বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে সুখে জীবন কাটানোর যে প্ল্যানটি সে ফেঁদেছে, সেটা ভেস্তে যাওয়া আটকানোর জন্য সে যা খুশি করতে পারে, হ্যাঁ, মার্ডার পর্যন্ত। ডরোথিকে খুনের তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্ল্যান করা দেখে আমরা ইমপ্রেসড হই। এবং ওই ক’পাতায় লেখক আমাদের চরিত্রটির সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হন যে সে প্ল্যানে বিন্দুমাত্র গোলযোগের সম্ভাবনা জাগলে আমাদের প্যালপিটেশন হয়। 

এটা করা মারাত্মক রকম শক্ত, কারণ লেখক আমাদের চরিত্রটির নামটাই বলেননি।

অর্থাৎ এর পর যখন সাসপেক্টদের মিছিল শুরু হবে, তখন খুনের মোটিভ, অপরচুনিটি, মোডাস অপারেন্ডি সব জানা থাকা সত্ত্বেও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে না যে খুনি কে।

ব্রিলিয়ান্ট, তাই না?

আরও ব্রিলিয়ান্ট লাগবে যদি মনে রাখেন যে 'আ কিস বিফোর ডাইং' আইরা লেভিনের প্রথম উপন্যাস। তেইশ বছর বয়সে লেখা।

তেইশ। 

আমার মতে 'আ কিস বিফোর ডাইং'-এর সেরা অংশ হচ্ছে ওই শুরুর অংশটুকু, যখন আমরা অজ্ঞাতনামা ‘হি’-র মাথার ভেতর ঘুরছি। টানটান, নির্মেদ, টেনশনে ভরপুর। দুঃখের বিষয়, গোটা বইটা ওরকম নয়।

ডরোথি খুন হওয়ার পর ডরোথির দিদি এলেন বোনের হত্যারহস্য সমাধানে নামে। আর তখন থেকে গল্পের বাঁধুনিও ঢিলে হতে থাকে। খুনির নামটা আমরা জেনে যাই গল্পের মাঝামাঝি, তারপর থেকে শেষ পর্যন্ত খালি সুতো গোটানোর অপেক্ষা। এবং মাঝেমাঝেই সে অপেক্ষা দীর্ঘ লেগেছে আমার।

স্টিফেন কিং যদিও আইরা লেভিনকে ‘সুইস ওয়াচমেকার অফ সাসপেন্স নভেলস’ খেতাব দিয়েছেন, সেটার প্রমাণ আমি এই বইতে খুব একটা পাইনি। রহস্য টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু চরিত্রকে অবিশ্বাস্যরকম নির্বোধ বানিয়ে রাখা ইত্যাদি গোঁজামিলও লেভিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করেছেন।

তবে মনে রাখতে হবে এটা তাঁর প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস হিসেবে 'আ কিস বিফোর ডাইং'-এ প্রভূত প্রতিশ্রুতি ছিল। পরে এই আইরা লেভিন ‘রোজমেরি’স বেবি’ লিখবেন। 

জয় অর্জুন সিং-এর সাবধানবাণী পড়ে আমি বইটা পড়ার আগে বেশি রিভিউটিভিউ পড়তে যাইনি, আপনারাও যাবেন না, কারণ কিছু কিছু জায়গায় খুনির নাম দিয়ে রিভিউ শুরু করা হয়েছে। স্পয়লার নিয়ে সেনসিটিভ হলে বিপদে পড়ে যাবেন।

*****

The Poisoned Chocolates Case/Anthony Berkeley 


উৎস গুগল ইমেজেস

বিবিসি রেডিওর একটা সুবিধে হচ্ছে, প্রচুর নতুন নতুন গোয়েন্দা গল্প এবং সিরিজের সন্ধান পাওয়া যায়। নাটক হিসেবে গল্প শোনার একটা সুবিধে হচ্ছে, ব্যাপারটা আমার পোষাবে কি না, সেটা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করা সোজা হয়। অভিজ্ঞ অভিনেতা  অভিনয় বা পাঠ শুনেও যদি কোনও গল্প সম্পর্কে আমার উৎসাহ না জাগে, তবে পড়ে ভালো লাগা মুশকিল। সম্প্রতি গোয়েন্দাগল্পের স্বর্ণযুগের বিখ্যাত লেখক অ্যান্থনি বার্কলের 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস' উপন্যাসটির নাট্যাভিনয় শোনার সুযোগ হল। শুনে এত ভালো লাগল যে আমি উপন্যাসটা বই হিসেবে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এখানে আরও একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা যায়, যে বই পড়া আর শোনার মধ্যে তফাৎ কী? বা আদৌ কিছু আছে নাকি। আমি এ বছর একটা গোটা বই (কমেডিয়ান মাইকেল ম্যাকিনটায়ারের আত্মজীবনী) অডিওবুকে শুনেছি। সেটাকে এ বছরের পড়া বইয়ের গুনতিতে ধরেওছি। কিন্তু এখনও আমার পড়ার প্রতি পক্ষপাতিত্ব যায়নি, পড়লে পাতা উল্টে পেছনে যাওয়ার সুযোগ থাকে। বা বইয়ের পাতায় আঙুল গুঁজে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে নেওয়া যায়। রেডিওতে শুনে 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস'-এর চরিত্র, প্লট, রহস্য এবং সমাধান সবই জানা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমি বইটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, কারণ আমার মনে হল এমন জমাটি একটা গল্প বই হিসেবে না পড়লে মাটি।

দ্বিতীয় যে কারণের জন্য আমি 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস' বই হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা হচ্ছে গোয়েন্দাসাহিত্যের ইতিহাসে 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস' একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে বার্কলে এই উপন্যাসের মাধ্যমে স্বর্ণযুগের গোয়েন্দাগল্পের ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস করেছেন, যে অ্যানালিসিসের রেজাল্ট সমসাময়িক গোয়েন্দালেখকদের পক্ষে স্বস্তিজনক নাও হতে পারে।

সে সব অস্বস্তিকর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে গল্পের প্লট সম্পর্কে বলা যাক। অ্যান্থনি বার্কলের রজার শেরিংহ্যাম সিরিজ বেশ নামকরা, যদিও আমার পড়ার সুযোগ হয়নি। রজার শেরিংহ্যাম নিজে গোয়েন্দাগল্পের লেখক এবং দরকার পড়লে স্বয়ং গোয়েন্দার ভূমিকায় নামেন। রজার শেরিংহ্যাম লন্ডনে ‘ক্রাইম সার্কল’ নামের এক প্রেস্টিজিয়াস ক্লাব পত্তন করেছেন। (ইন্টারেস্টিং ট্রিভিয়াঃ দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস প্রকাশিত হয় উনিশশো ঊনত্রিশে, আর পরের বছরই বার্কলে, সে সময়কার বিখ্যাত রহস্য ঔপন্যাসিকদের সঙ্গে মিলে বিখ্যাত ‘ডিটেকশন ক্লাব’ পত্তন করেন। ক্লাবের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন চেস্টারটন।) 'ক্রাইম সার্কল'-এর সদস্যসংখ্যা হাতে গোনা, কারণ ক্লাবে নাম লেখাতে গেলে রহস্যসমাধানের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হয়। গল্প শুরু হওয়ার সময় আমরা দেখি ক্লাবের ছ’জন সদস্য উপস্থিত। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট ঔপন্যাসিক এবং গোয়েন্দা রজার শেরিংহ্যাম, বিখ্যাত বড়লোক ব্যারিস্টার স্যার চার্লস ওয়াইল্ডম্যান, অ্যালিস ড্যামারস নামের একজন ইন্টেলেকচুয়াল, ‘হাই ব্রাও’ ঔপন্যাসিক (বার্কলে হেল্পফুল হয়ে ‘হাই ব্রাও’ লেখকের সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েছেনঃ যে সব লেখকের উপন্যাসে প্লট থাকে না), নাট্যকার মেবল ফিল্ডার-ফ্লেমিং, পটবয়লার এবং মাসমার্কেট গোয়েন্দাগল্প লেখক মর্টন হ্যারোগেট ব্র্যাডলি এবং অ্যামব্রোস চিটারউইক। এই শেষজন এই নক্ষত্রসভার একমাত্র সাধারণ মেম্বার, জনগণেশের প্রতিনিধি। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে ক্লাবে ঢুকেছেন।

গল্প যখন শুরু হচ্ছে, তখন এই ছ’জন ছাড়াও আরেকজন ক্লাবে উপস্থিত আছেন, তিনি হচ্ছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিসকর্তা ইন্সপেক্টর মোরেসবি। তাঁর উপস্থিতির কারণ অচিরেই প্রেসিডেন্ট শেরিংহ্যাম পরিষ্কার করেন। ইদানীং লন্ডনের অভিজাত মহলে একটি হত্যারহস্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছে, সেটা হচ্ছে মিসেস বেন্ডিক্সের হত্যারহস্য। ঘটনা ঘটেছে এইরকমঃ রেনবো ক্লাব নামের লন্ডনের এক অভিজাত ক্লাবের সদস্য স্যার ইউস্টাস পেনেফাদার, রোজকার মতো বেলা সাড়ে দশটার সময় ক্লাবে এসে দেখেন এক চকোলেট কোম্পানি তাঁকে সৌজন্যমূলক একবাক্স চকোলেট পাঠিয়েছে। এইসব আধুনিক মার্কেটিং পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী স্যার পেনেফাদার তৎক্ষণাৎ বাক্সটি তাঁর সহমেম্বার গ্রাহাম বেন্ডিক্সকে চালান করেন। বেন্ডিক্স আবার এদিকে তাঁর স্ত্রী জোয়ান বেন্ডিক্সের সঙ্গে কী একটা বাজি ধরে হেরেছেন, শর্তস্বরূপ একবাক্স চকোলেট তাঁর জোয়ানের জন্য কেনার কথা। স্যার পেনেফাদারের দেওয়া চকোলেট তিনি বাড়ি নিয়ে যান। সেই চকোলেট খেয়ে জোয়ান মারা যান, তদন্তে বেরোয় চকোলেটে বিষ মেশানো ছিল।

রজার শেরিংহ্যাম ক্রাইম সার্কলের সবাইকে জানান, যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বহু চেষ্টা করেও খুনিকে ধরতে না পেরে অবশেষে হাত তুলে দিয়েছে, এবং তিনি ইন্সপেক্টর মোরেসবিকে প্রস্তাব দিয়েছেন যে থিওরেটিক্যাল রহস্য রহস্য খেলা অনেক হয়েছে, এবার ক্রাইম সার্কলের শখ হয়েছে সত্যিকারের রহস্য সমাধানে নিজেদের ক্ষমতা চেখে দেখার, কাজেই এই মিসেস বেন্ডিক্স হত্যারহস্যের তাঁরা সমাধান করতে চান।

স্থির হয় প্রতি সদস্য নিজের মতো করে ঘটনাটির তদন্ত করবেন, এবং একসপ্তাহ পরে শুক্রবার সন্ধ্যেয় সে তদন্তের ফলাফল ক্লাবের সবাইকে জানাবেন। তদন্তের পদ্ধতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ফলাফল ঠিক না ভুল।

চোর ডাকাত পুলিস বাবু খেলার মতো করে চিরকুট বেছে তদন্তকারীদের ক্রম স্থির হয়। প্রথম সপ্তাহে স্যার ওয়াইল্ডহ্যাম, তারপর যথাক্রমে মেবল ফিল্ডার ফ্লেমিং, তারপর মর্টন হ্যারোগেট ব্র্যাডলি, তারপর রজার শেরিংহ্যাম, তারপর অ্যালিস ড্যামারস, সবশেষে অ্যামব্রোস চিটারউইক।

তদন্ত শুরু হয়, ছ’জন ছ’সপ্তাহ ধরে তাঁদের তদন্ত এবং ফলাফলের কথা ফলাও করে সবাইকে বলেন। বলা বাহুল্য, বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যদের তদন্তের ভুল ধরেন। অবশেষে একটা সমাধান বেরোয়, এবং সবাই মেনে নিতে বাধ্য হন, যে এটাই ঠিক। 

আর এই গোটা প্রসেসটার মধ্য দিয়ে অ্যান্থনি বার্কলে গোল্ডেন এজ মিস্ট্রি রাইটিং-এর নিখুঁত ব্যবচ্ছেদ করেন। আর সেখানেই পয়জনড চকোলেটস কেস সমসাময়িক গোয়েন্দাগল্পের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে।

প্রথম তফাৎ হচ্ছে, রজার শেরিংহ্যামের সিরিজের পাঁচ নম্বর উপন্যাস হলেও এ গল্পে রজার শেরিংহ্যামের ভূমিকা বাকি তদন্তকারীদের থেকে একটুও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোল্ডেন এজের গোয়েন্দাগল্পের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রহস্য কিংবা সমাধানের থেকেও ‘গোয়েন্দা’ বা গল্পের হিরোর প্রতি ফোকাস। গোয়েন্দার বদলে 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস'-এর সম্পূর্ণ ফোকাস তদন্তপ্রক্রিয়ার ওপর। ছ’জন গোয়েন্দার রহস্যসমাধানের মধ্য দিয়ে অ্যান্থনি বার্কলে বিবিধ তদন্তপদ্ধতির আলোচনা করেন। ইন্ডাকটিভ বা বটম আপ অ্যাপ্রোচ, অর্থাৎ যেখানে অলরেডি জানা তথ্য এবং বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, সেই বিশ্বাসের পক্ষে বা বিপক্ষে উদাহরণ জোগাড় করে করে সমাধানে পৌঁছোনো হয়। ডিডাকটিভ বা টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ, ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তথ্য, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে সমাধানে পৌঁছোনো। কেউ আবার ফরেনসিক ছাড়া আর কিছুকে মানেন না, কারও কাছে সাইকোলজিই শেষ কথা।

(এই লিংকে ডিডাকশন বনাম ইনডাকশন পদ্ধতি নিয়ে, উদাহরণ দিয়ে (তাও আবার শার্লক হোমসের) বেশ ভালো করে প্রাঞ্জল করে বোঝানো হয়েছে, ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন।)

গতে বাঁধা গোয়েন্দাগল্পের সঙ্গে দ্বিতীয় তফাৎটা আমার মতে 'পয়জনড চকোলেটস কেস'-এর সবথেকে বড় অবদান। সেটা হচ্ছে এইটা পয়েন্ট আউট করা যে রহস্যসমাধানের প্রক্রিয়া এবং সমাধান কী অসম্ভব রকম ব্যক্তিগত। এই যে ছ’জন শখের গোয়েন্দা ছ’টা সলিউশনে পৌঁছোলেন, সেই সলিউশনগুলো সম্পূর্ণরকম তাঁদের ব্যক্তিত্ব, দর্শন এবং অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ। এ যেন ঠিক অন্ধের হাতি দেখার মতো ব্যাপার। কেউ লেজ দেখছে, কেউ পা, কিন্তু সকলেই হাতিই দেখছে আবার কেউই হাতি দেখছে না। সকলেই যে যার বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা খাটিয়ে ছ’টা সলিউশনে পৌঁছেছেন, ছ’টাই কনভিন্সিং আবার একইসঙ্গে অন্য আরেক গোয়েন্দার দৃষ্টি থেকে দেখলে ছিদ্রে ভরপুর।

তৃতীয়ত, ক্রাইম সার্কেলের সদস্যদের মধ্যে লেখকদের সংখ্যাধিক্যটা আপনার চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়। তার মধ্যে দুজন আবার গোয়েন্দাগল্প লেখক। এটার একটা কারণ হচ্ছে অ্যান্থনি বার্কলে এটাও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে গোয়েন্দাগল্প আর কিছুই নয়, পাঠক এবং লেখকের বুদ্ধির লড়াই। এবং লেখকের পাঠককে বোকা বানাতে সক্ষম হওয়ার পরীক্ষা। গোয়েন্দাগল্পের সফল লেখক মর্টন হ্যারোগেট ব্র্যাডলি বলছেন, 

"Artistic proof is, like artistic anything else, simply a matter of selection. If you know what to put in and what to leave out you can prove anything you like, quite conclusively. I do it in every book I write."

পয়জনড চকোলেটস কেসের চতুর্থ প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে সবের পরে কিন্তু সবার ওপরে সত্য আবিষ্কার আর প্রমাণের মধ্যে একটা পরিখা থেকে যায়। সে পরিখার ব্যাপারে আর বিশদে বললে স্পয়লার দেওয়া হয়ে যাবে, কাজেই বলছি না।

উপন্যাসে বলা আছে, গোয়েন্দাগল্পে লেখক সর্বশক্তিমান, কাজেই অ্যান্থনি বার্কলের পক্ষপাতও এ উপন্যাসে পরিস্ফুট হয়েছে। নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দা বলেই হয়তো শেরিংহ্যামের প্রতি দুর্বলতা রয়ে গেছে তাঁর। বাকি পাঁচজনের তদন্তপ্রক্রিয়া আমরা পুরোটাই তাঁদের জবানিতে জানতে পারি, কিন্তু শেরিংহ্যামের তদন্তটা নিজেদের চোখে দেখি। শেরিংহ্যাম কোথায় কোথায় যাচ্ছেন, কাদের সঙ্গে কথা বলছেন সে সব বিস্তারে লেখা আছে। ইন ফ্যাক্ট, ওই অংশটুকুই ধ্রুপদী গোল্ডেন এজ গোয়েন্দাগল্পের মতো পড়তে লাগে।

গোয়েন্দাগল্পের থিওরি প্র্যাকটিক্যাল নিয়ে উৎসাহ থাকলে অ্যান্থনি বার্কলের 'দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস' অবশ্যপাঠ্য, এটুকু বলতে পারি।

পুনশ্চঃ এই রিভিউ লেখার সময় দ্য পয়জনড চকোলেটস কেস সম্পর্কে আরও কে কী বলেছেন খুঁজতে গিয়ে একটা তথ্য পেলাম। (বাই দ্য ওয়ে, পয়জনড চকোলেটস নিয়ে রীতিমত রিসার্চ পেপার লেখা হয়েছে। নেটে আছে, উৎসাহ থাকলে খুঁজে পড়তে পারেন।) পরবর্তী কালে। সম্ভাব্য আরও দুখানা তদন্তপদ্ধতি এবং সমাধান পয়েন্ট আউট করে, পয়জনড চকোলেটস কেস উপন্যাসে দুটো বাড়তি চ্যাপ্টার যোগ করেছিলেন দুজন লেখক। উনিশশো ঊনআশিতে ক্রিশ্চিনা ব্র্যান্ড এবং মার্টিন এডওয়ার্ডস (কবে জানি না)। আমি এঁদের চ্যাপ্টারদুটো পড়িনি, সুযোগ পেলেই পড়ে ফেলব।


Comments

  1. Excellent review.

    Do Androids dream... Sci-Fi er duniyar legendary boigulor ekti. Otar naam ta shona chhilo, kintu Poisoned Chocolate Case.. ami ei boitar kotha jantam na. Onek dhonyobad. Pode felbo.

    Poisoned Chocolate case-er review ta bodo shundor hoyechhe. Review lekha oti shokto kaaj. You need to know what to put in and what to leave out. More than any other form of writing. Khub-i bhalo likhechhen!

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, সুতীর্থ। রিভিউ লেখা যে শক্ত সেটা মানি এবং রিভিউ লেখা শেখার ইচ্ছেও মনে মনে রাখি। আপনি এত উৎসাহ দিলেন, ভালো লাগল।

      Delete
  2. অনবদ্য, আর "অবিলম্বে আমাজন অভিযান আবশ্যক"-অনুভূতিমূলক আলোচনা।
    প্রসঙ্গত, আগাথা ক্রিস্টি তাঁর 'টুওয়ার্ডস জিরো' শুরু করেছিলেন অপরাধীর মগজে আমাদের ঢুকিয়েই, তাই না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ঋজু। টুওয়ার্ডস জিরো-র সঙ্গে আ কিস বিফোর ডাইং-এর তফাৎ আছে বোধহয় সামান্য, কারণ যতদূর মনে করতে পারছি টুওয়ার্ডস জিরোর উক্ত ব্যক্তি কীভাবে খুনটা করবেন সে বিষয়ের কোনও ডিটেল পাঠক পায় না। বা কে তার ভিকটিম সেটা সম্পর্কেও জানা যায় না। আ কিস বিফোর ডাইং-এ সেসব কোনও রাখঢাকই নেই।

      টুওয়ার্ডস জিরো আমার ভীষণ প্রিয় উপন্যাস। আপনি উল্লেখ করলেন দেখে ভালো লাগল।

      "অবিলম্বে আমাজন অভিযান আবশ্যক"-অনুভূতিমূলক আলোচনা।... এটা বুঝতে পারলাম না। আপনি কি কমলেশ্বরের নতুন সিনেমাটার কথা বলছেন? রিলিজ করে গেছে? দেখলেন নাকি? আমি সংগীত বাংলায় ট্রেলার দেখেছি, তাতে কমলেশ্বর বললেন শুনলাম, 'ছবিটা ছোটদের দেখার, আর বড়দের ভেবে দেখার।' শুনেই ভয় পেয়ে গেছি, সম্ভবত দেখব না।

      Delete
    2. আরে না-না! আমাজন মানে সেই ওয়েবসাইট যা আমার যাবতীয় বই কেনার জায়গা। আমাজন অভিযান আমাকে সপরিবারে দেখতেই হবে, কারণ এই বইগুলো দেখে আমার বউ ও মেয়ে প্রচুর আমোদ পায়। সংসারে শান্তি রাখার জন্য যে কী-কী করতে হয়...

      Delete
  3. Ami joddur bujhlam Riju amazon.in (othoba uni je deshe achhen shetar corresponding website) er kotha bolchhen!! Riju, thhik bijhechhi ki?

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. হে ভগবান, আপনি বলার পর আমারও তাই মনে হচ্ছে, সুতীর্থ। আজ সকালেই আমাজন অভিযানের ট্রেলার দেখছিলাম তো ওটাই মাথায় ঘুরছে। জঘন্য।

      ভেরি সরি, ঋজু।

      Delete
    2. একদম সঠিক, সুতীর্থ।

      Delete
  4. আমার একটা নেক্সাস ৬ ফোন ছিলো। 😐

    ReplyDelete
    Replies
    1. রিটায়ার্ড আশা করি?

      Delete
    2. হুঁ, বেগড়বাঁই খুব যে করছিলো তা নয়, কিন্তু করছিলো। কুলোর বাতাস দিয়ে রিটায়ার করিয়ে দিয়েছি।

      Delete
    3. বেশ করেছেন।

      Delete
  5. The Poisoned Chocolates Case-er review ta khasha. net e search kore edik-sedik theke kichhu document o pore fellam, ebare mul boiti porbo. Erokom ekta boi niye alochonar jonyo onek shubheccha.
    A Kiss Before Dying tao besh interesting laglo, pore felte hobe. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. পয়জনড চকোলেটটা সম্ভবত বেশি ভালো লাগবে, জানাবেন, অরিজিত।

      Delete
  6. Khub khub bhalo review. Wishlist e boigulo rekhe dilam. Bisesh kore pratham ar seshboita :-)

    ReplyDelete

Post a Comment