মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস




অর্চিষ্মান একবার বলার চেষ্টা করেছিল, রিভিউ ভালো নয় কিন্তু। কিন্তু ও-ও জানত, 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' সিনেমা হয়ে বেরিয়েছে যখন আমি দেখব। ক্রিটিকে, দর্শকে কী বলল তোয়াক্কা না করেই। শনিবার সাড়ে বারোটার শোয়ের টিকিটের দাম মোটামুটি ভদ্রলোকের মতো দেখে আমরা রওনা দিলাম। টিকিট অনলাইন কাটা যেত, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘কনভেনিয়েন্স ফি’ বলে একটা জিনিস হয়, সেটা আমার চরম অসুবিধেজনক লাগে। তাছাড়া আমার ভরসা ছিল, ফুকরে রিটার্নস রিলিজ করেছে, থরঃ রাগনারোক চলছে, এই বাজারে বেশি লোক পোয়্যারো নিয়ে উৎসাহী হবে না। ভরসা বিফলে যায়নি,হলে গিয়ে টিকিট পেতে কোনও অসুবিধেই হয়নি। 

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ট্রেলার আর অ্যাড চলার পর মার্গসংগীতের ছোঁয়া লাগানো জনগণমন বাজিয়ে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি করে সিনেমা শুরু হল। পবিত্র শহর জেরুজালেমে একটি রহস্যের সাফল্যের সঙ্গে সমাধা করে (বইয়ের সমস্যাটির সঙ্গে সিনেমার সমস্যাটির মিল নেই) পোয়্যারো লন্ডনে ফিরছেন, ইচ্ছে ফেরার আগে ইস্তানবুলে ক’টা দিন বিশ্রাম নিয়ে যান। কিন্তু খবর আসে, আরেকটি রহস্য সমাধানের জন্য পোয়্যারোকে অবিলম্বে লন্ডনে ফিরতে হবে। ট্রেন কোম্পানির কর্তা মঁসিয়র বুকের ভাইপোর (ইনিও মঁসিওর বুক, যদিও বইয়ে এই ভূমিকায় সিনিয়র মঁসিয়র বুকই ছিলেন) সহৃদয়তায় টইটম্বুর ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের ক্যালে কোচে পোয়্যারোর একটি সিটের বন্দোবস্ত হয়। যাত্রার শুরুতেই স্যামুয়েল র‍্যাচেট নামের একজন অ্যামেরিকান বড়লোক পোয়্যারোকে নিজের ‘বডিগার্ড’ হিসেবে নিযুক্ত করতে চান, বলেন কেউ বা কারা তাকে হুমকি চিঠি পাঠিয়ে খুন করতে চাইছে। পোয়্যারো ‘না’ করে দেন। সেই রাতেই র‍্যাচেট নৃশংসভাবে খুন হন, আর তুষারঝড়ে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস আটকা পড়ে যায়। মঁসিওর বুকের ভাইপো পোয়্যারোর হাতে পায়ে পড়ে খুনিকে ধরে দেওয়ার অনুরোধ করেন, না হলে কোম্পানির বড়বাবু হিসেবে তাঁর একেবারে নাককাটা যাবে।

'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' আগাথা ক্রিস্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখা, প্লটের অভিনবত্বের জন্য তো বটেই, কিন্তু সে অভিনবত্ব তো ক্রিস্টির সব বইতেই কমন। মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' স্পেশাল এই জন্য যে এই বইতেই ঠিক আর ভুল, ন্যায় এবং অন্যায়, শাস্তি এবং ক্ষমার মাঝামাঝির ধোঁয়াটে জায়গাটা হারক্যুল পোয়্যারোর কাছে প্রথম প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়। টিভি সিনেমার পরিচালক প্রযোজকদের কাছে এই গল্প তাই চিরকালই লোভনীয়। সিনেমার পর্দায় উনিশশো চুয়াত্তরে সিডনি লুমের পরিচালনায় 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'-এ পোয়্যারোর ভূমিকায় ছিলেন অ্যালবার্ট ফিনি। এই ছবিতেই একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ইনগ্রিড বার্গম্যান সেরা সহঅভিনেত্রীর অস্কার জিতেছিলেন। টিভির পর্দায় দুহাজার দশ সালে ডেভিড সুশে ছাড়াও 'মার্ডার ইন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'-এ পোয়্যারোর ভূমিকায় নেমেছিলেন আলফ্রেড মলিনা, দুহাজার এক সালে।

দু'হাজার সতেরোর 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' পরিচালনা করেছেন কেনেথ ব্রানা, পোয়্যারোর ভূমিকাতেও তিনিই অভিনয়ও করেছেন। র‍্যাচেটের ভূমিকায় জনি ডেপ, গ্রেটা অলসন (যে ভূমিকায় অভিনয় করে ইংগমার বার্গম্যান অস্কার পেয়েছিলেন) চরিত্রের নাম বদলে হয়ে গেছে পিলার এস্ত্রাভাদোস (এই চরিত্রের নাম নেওয়া হয়েছে 'হারক্যুল পোয়্যারো’স ক্রিসমাস' বই থেকে), অভিনয় করেছেন পেনেলোপি ক্রুজ, প্রিন্সেস দ্রাগোমিরফের ভূমিকায় আছেন ডেম জুডি ডেঞ্চ। দু’চারটে চরিত্র এবং তাদের ভূমিকা অদলবদল করা হয়েছে। কর্নেল আরবাথনট আর ডাক্তার মিলিয়ে তৈরি হয়েছেন ডাক্তার আরবাথনট, গল্পে ডাক্তারের ভূমিকাও বদলেছে। এ ছাড়া গল্পের কাঠামো তেমন কিছু বদলায়নি।

বদলেছে গল্পের ফোকাস। 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'-এ থিম (ন্যায়অন্যায় ঠিকবেঠিকের সংজ্ঞায়ন) জরুরি, কিন্তু ক্রিস্টির বাকি সব গল্পের মতোই প্লট আরও জরুরি। ব্রানার 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' প্লট প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে, বইয়ের প্রতিটি ক্লু, রেড হেরিং আছে সিনেমাতেও, কিন্তু সেগুলোকে যথেষ্ট খেলিয়ে ব্যবহার করা হয়নি, তাদের পেছনে যথেষ্ট সময় খরচ করা হয়নি। সম্ভবত এই ভেবে যে এত চেনা গল্পে কী হবে, কেন হবে, কী করে হবে এসব সবাই জানে, কাজেই সে সবের গভীরে না গেলেও চলবে। তার থেকে বরং পোয়্যারোর দোলাচল, অন্যান্য চরিত্রদের অন্তর্লীন টানাপোড়েনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কথাটা সত্যি, কিন্তু আরও সত্যি কথাটা হচ্ছে, ওই ক্লুয়ের লেজ ধরে ধরে, রেড হেরিংয়ের পিছু নিয়ে পথ ভুল করে আবার ঠিক পথে ফিরে আসার খেলাটা বাদ দিলে গোয়েন্দাগল্পের পনেরো আনা মজা মাটি।

সামান্য বদল এসেছে পোয়্যারোর চরিত্রেও। আগাথা ক্রিস্টির পোয়্যারো দৌড়োদৌড়ি তো দূরে থাক, জুতোর পালিশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বাড়ি থেকে বেরোন না, গুলিগোলা মারাত্মক অপছন্দ করেন। সেই পোয়্যারো বিপজ্জনক ব্রিজ বেয়ে অপরাধীকে ধাওয়া করছেন, হাতে গুলি খেয়ে টসকাচ্ছেন না। বিশ্বাস করা শক্ত। তবে এসব বদলে আমার আপত্তি নেই। এর থেকে ঢের আপত্তিজনক ব্যাখ্যা এর আগে হয়েছে (পিটার উস্তিনভ, অ্যালবার্ট ফিনি, আলফ্রেড মলিনা) যেখানে পোয়্যারো রীতিমত ভাঁড়ে রূপান্তরিত হয়েছেন। সে সব দেখে রাগ হয়েছিল খুব, কিন্তু ক্রমে বুঝেছি এইরকম আইকনিক চরিত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হবেই। না হলেই অদ্ভুত হত। 

আমার 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস' ভালো লেগেছে । বরফঢাকা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য ভালো লেগেছে, অভিনয় ভালো লেগেছে, মূল গল্পের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকার সিদ্ধান্ত ভালো লেগেছে। তবে ভালো যে লাগবে জানাই ছিল।


Comments

  1. আমিও সিনেমাটার আদ্যন্ত নেগেটিভ রিভিউ দেখে না-দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে ঋজু, সিনেমাটা কিন্তু মোটামুটি, আহামরি একেবারেই নয়, কিন্তু আমি দেখব বলেই দেখেছি, এবং আফসোস করিনি।

      Delete
  2. আমারও ভালো লেগেছে । মূল গল্প থেকে খুব ডেভিয়েশন ছিলো না বলেই কিনা কে জানে , আমার অবশ্য বেশীর ভাগ জিনিসই ভালো লাগে , মানে এর আগে টিনটিন হয়েছলো যখন তাও আমার মন্দ লাগেনি ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা আমার মায়েরও মত, প্রদীপ্ত। মা বলেন, বড় পর্দায় সুন্দর দেখতে লোকজন সুন্দর জামাকাপড় পরে নানারকম কাণ্ডকারখানা করছে, দেখতে খারাপ লাগার তো কোনও কারণ নেই।

      Delete
  3. Murder 'On' the....
    Apnar blog last kichu mash dhore porchi, ebong bolai bahulyo bare bare fire fire ashi, tai amar prothom comment ekta bhul dhorar janya hoyay sorry! Asole apnar post-e cinema-r poster-e 'On' jwoljwol korche, ar lekhar madhey bare bare 'In' ache, tai chokhe laglo :P
    But promise je amar porer comment-ta anek beshi sundor hobe :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে শমীক, এটাও যথেষ্ট সুন্দর এবং জরুরি কমেন্ট। ভুলটা অমার্জনীয়, ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. Bah, etodin pore bangla horofe thik banan-e (ingriji banan-ta ami nije 'bhul' lekha sotteo) nijer nam dekhe ki bhalo laglo :D

      Delete
    3. এটা আপনার সামনেই বলছি বলে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এত সুন্দর নামের বানান ভুল লেখা পাপ।

      Delete
    4. Satyi bolechen mene nichhi :(
      tobe ingriji-te ei banan-ta lekhar ekta functional subidha holo bideshe jokhon lokjon beshir bhag Indian nam pronounce korte dant bhenge fele, amarata sohojei kore fele (bhul pronunciation-e jodio) :P

      Delete
    5. সে আজকাল দেশীরাও চেনা নাম ভুল উচ্চারণে বলে। সংগীত বাংলা চ্যানেলে আজকাল ভট্টাচারিয়া বলে একটা নতুন পদবী শুনতে পাচ্ছি প্রায়ই।

      Delete
  4. এইটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আর আপনার কাছে ভাল বলে টেনশনেও ছিলাম। যদি আপনার ভালো না লাগে, তখন কি আড়ালে আমায় গালাগালি দিতে ছাড়বেন? এখন নিশ্চিন্তি।

    পোয়ারোর চরিত্রের অদলবদলগুলো আমারও চোখে লেগেছে, কিন্তু ভেবে দেখলাম, পোয়ারো এককালে পুলিশ অফিসার ছিল, তাই তার একটু আধটু ছুটোছুটি করা বা গুলি খেয়ে হজম করাটা আমার মতন গোঁড়া ক্রিস্টি ফ্যানদের হয়তো ভালো লাগবেনা কিন্তু চরিত্রটার সঙ্গে ওভারঅল চলে যায়। গোঁফটাও ডেভিড সুশের সঙ্গে মেলেনি, কিন্তু একটা মানুষ যদি সারাজীবন গোঁফ রেখে থাকে আর সেটা নিয়ে গর্ব করে বলে যে ইউরোপে এমন গোঁফ আর কারোর নেই তাহলে সে সেটা নিয়ে একটু আধটু এক্সপেরিমেন্ট করবেনা এটা হতে পারেনা। চুলে আর গোঁফে কলপ করা থাকলে অবশ্য খুশি হতাম।

    তবে আমার এত কিছু সত্ত্বেও ভাল লাগার কারণ হল, পোয়ারোকে দেখে ভাঁড় না মনে হওয়া। কেনেথ ব্রানা নিজের মতন করে করেছেন ঠিকই, কিন্তু সিরিয়াস চরিত্র হিসেবেই করেছেন। হাসির জায়গাটায় হাসি পায়, কিন্তু সারাক্ষন কাতুকুতু বুড়ো মনে হয়না। আরেকটা মজার ব্যাপার জানেন, প্রথম দৃশ্যে যখন পোয়ারোর ব্রেকফাস্ট খাওয়ার দৃশ্যে শুধু পোয়ারোর গলা শোনা যাচ্ছে, মুখ দেখায়নি, তখন আমার অবচেতন মনে ডেভিড সুশের মুখটাই ভেসে উঠছিল। তাই একসেন্টটা ঠিকই হয়েছে বলা যায় (এখানে "ঠিক" মানে ডেভিড সুশের মতন)।

    ReplyDelete
    Replies
    1. 'ঠিক' পোয়্যারো হচ্ছেন ডেভিড সুশে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই, সুগত। কলপটা সত্যিই করা উচিত ছিল, পোয়্যারোর মতো ভেন লোক পাকা চুল পাকা গোঁফ নিয়ে ঘুরছে, এটা মানা যায় না। তবে আমারও আপনার মতো, সব মিলিয়ে ভালোই লেগেছে।

      Delete

Post a Comment