দিল্লি চলো
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ
করা হয়ে গেছে, অফিসের ল্যাপটপ, লকারের চাবি প্রত্যর্পণ হয়ে গেছে, একে একে সবার গলা
জড়িয়ে “ডোন্ট ফরগেট টু কিপ ইন টাচ” বলা হয়ে গেছে, ট্যাক্সি বুক করা হয়ে গেছে। সকাল
সাড়ে আটটায় এসে আমাকে হোটেল থেকে তুলে হপ্টবানহফ পৌঁছে দেবে। টুথপেস্ট, হাওয়াই
চটি, রাতের পাজামা---যেগুলো শেষমুহূর্তে ব্যাগে পোরা ছাড়া গতি নেই, এমন কয়েকটি
আইটেম ছাড়া সুটকেস গোছানও একরকম শেষ।
এই যাব যাব যাব, যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি, এলাম এলাম এলাম করতে করতেই ফেরার পালা চলে এল। মিথ্যে বলব না, মাঝামাঝি নাগাদ বেশ
একটু অধৈর্য লাগছিল, মনে হচ্ছিল এত দীর্ঘ ছ’মাস বোধহয় আগে কখনও কাটাইনি। এখন মনে
হচ্ছে সময়টা হুশ্ করে ফুরিয়ে গেল। এই তো সেদিন, অর্চিষ্মানের সঙ্গে অটোয় চড়ে ঘুরে
ঘুরে মেডিক্যাল চেক-আপ করাচ্ছিলাম---নাকের পরীক্ষা, কানের পরীক্ষা, দাঁতের পরীক্ষা,
ফুসফুসের পরীক্ষা---বাস্রে বাস্, পরীক্ষার আর শেষ নেই। মেডিক্যাল চেকলিস্টের বহর
দেখে মনে হচ্ছিল ইউরোপ নয়, ইউরেনাস সফরে যাচ্ছি বোধহয়।
সব পরীক্ষা শেষ,
এবার আমি গটগটিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি। আমি কানাই হই কি আমার দাঁতে পোকাই থাক
(নেই, অন গড ফাদার মাদার) সে দেশে ঢোকা থেকে আমাকে কেউ রুখতে পারবে না।
বৃহস্পতিবারই অফিশিয়াল ট্রেনিং শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিকেলে ছিল সার্টিফিকেট বিতরণ, সন্ধ্যেয় ডিনার। রাইনের
ওপর ঝুঁকে পড়া “Zur Lese” রেস্টোর্যান্টের
কাঁচঘেরা বারান্দায় বসে দীর্ঘ ফেয়ারওয়েল ডিনার সারলাম আমরা। সম্মিলিত ভোজে আগেও
অনেকবার গিয়েছি সকলে, কিন্তু সেদিনের ডিনারের সুর স্বাভাবিকভাবেই, সামান্য অন্য
তারে বাঁধা ছিল। অনেকখানি রিলিফ, একটুখানি মনখারাপ। ছ’মাস বাদে বাড়ির লোকের সঙ্গে
দেখা হওয়ার উত্তেজনা, আর যাদের সঙ্গে গত ছ’মাস সকালবিকেল ওঠাবসা করলাম---তাদের
সঙ্গে খুব সম্ভবত জীবনে আর কোনওদিনও দেখা হবে না---এই সত্যিটা জানার বিষাদ।
কাজেই সন্ধ্যেটুকু
নিংড়ে নেওয়ার এজেন্ডা ছিল সবার মনেই। খুব হুল্লোড় হল, শিক্ষক-ছাত্র, মডারেটর-পার্টিসিপেন্টের
সীমারেখা ঘুচিয়ে সবাই মিলে গলা জড়িয়ে লাখোলাখো ছবি তোলা হল। ন’টা ভাষায় একে অপরকে “আই
লাভ ইউ”, “আই উইল মিস ইউ” বলা হল। ছোট ছোট উপহার, কোনওদিন না ভোলার প্রতিশ্রুতি
দেওয়ানেওয়া হল। আশেপাশের টেবিল থেকে বিরক্ত জনতা খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল,
টেবিলের মোমবাতি জ্বলে জ্বলে নিভে গেল, রাইনের জলে চাঁদের ছায়া ঘনিয়ে এল, আমাদের
গল্প তবু ফুরোয় না।
আমি আর কোসি যখন
হপ্টবানহফে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন ক্রিসমাস মার্কেটের আলো অবশেষে নিভে
গেছে।
*****
ছুটি ছুটি ছুটি!
এবার আর মাস নয়, সপ্তাহ নয়, এমনকি দিনও নয়। এবার গুনতি শুধু ঘণ্টায়। প্লেন যদি লেট
না করে, তাহলে আর ঠিক আঠেরো ঘণ্টা পর আমাদের ট্যাক্সি আই. আই. টি. ফ্লাইওভার বেয়ে
হুহু করে ছুটছে। প্রথমটা নিজের টিকিটের টাইমিং দেখে নিজের গালেই চড় বসাতে ইচ্ছে
করছিল, এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। এতদিন পর দিল্লির সঙ্গে দেখা বলে কথা---ভিড়,
জ্যাম, হর্নের চিৎকারের বদলে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা সে দেখা হওয়ার পক্ষে কোটিগুণ
ভালো প্রেক্ষাপট। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি---ওই দূরে ইউ. এফ. ও.-র চাকতির
মতো জ্বলছে নেহরু স্টেডিয়াম, ফ্লাইওভারের নিচে চিরাগ দিল্লির জনপ্রাণীহীন মোড় ঘুমন্ত
অক্টোপাসের মতো হাত পা মেলে পড়ে আছে। কাল সকাল ন’টার সময় ওই মোড়ের চেহারা কল্পনা
করে মনে মনে শিউরে উঠছি। আবার কে জানে কেন, মনের গভীরে কোথাও একটা পরম স্বস্তিও
বোধ হচ্ছে। ট্যাক্সির মাথার ওপর দিয়ে হামদর্দ ইউনিভার্সিটি লেখা বোর্ডটা হুশ্ করে
বেরিয়ে গেল।
আর দেরি নেই, এবার
সত্যি সত্যি বাড়ি চলে এসেছি।
*****
সবটাই যে আনন্দ আর
হাঁফ-ছাড়া তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কাল শেষমুহূর্তের খুচরো কেনাকাটি সেরে বাসে
চেপে ফিরছি, হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল যে আমার মনে নেই আমার চেকবইটা দিল্লির
বাড়ির ঠিক কোথায় আছে। নো আইডিয়া। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই আইডিয়া থাকে না, আর এটা
তো আনকোরা নতুন একটা বাড়ি। যদ্দুর মনে পড়ে, বাড়িবদলের সময় দরকারি কাগজপত্র (আশা
করা যায়, তখন চেকবইটাকে দরকারি কাগজপত্রের দলেই ধরেছিলাম) একটা লাল রঙের হাতব্যাগে
পোরা হয়েছিল, কিন্তু এ বাড়িতে পৌঁছে সে লাল ব্যাগ আর দেখেছিলাম কিনা, সিরিয়াসলি,
মনে নেই।
লাল ব্যাগ কোথায় মনে নেই, নীল ফোল্ডার কোথায় ভগবানই জানেন,
মা শেষবার এসে একটা জয়পুরি লেপ কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন---সেটাই বা কোন চুলোয় ঘাপটি
মেরে বসে আসে কে জানে। এখন তো আবার খোঁজার জায়গাও ডবল হয়ে গেছে, দু’খানা কাবার্ড,
দু’খানা খাটের দু’খানা গর্ভগৃহ, দু’খানা টেবিলের দু’খানা ড্রয়ার। ওরে বাবারে। সব
হাঁটকানোর কথা কল্পনা করতেই আমার বাড়ি যাওয়ার আনন্দ অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। জঘন্য।
*****
নাহ্, মিথ্যে বলে লাভ নেই।
আনন্দ মোটেই অর্ধেক হচ্ছে না। ব্যাংকে গিয়ে পায়ে ধরলে চেকবই আবার পাওয়া যাবে, নীল
ফোল্ডারে কী ছিল সেটাই যখন মনে নেই তখন সেগুলো এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হতে
পারে না। জয়পুরি লেপও পাখা মেলে যে উড়ে যায়নি সে বিষয়ে আমি একরকম নিশ্চিত, কাজেই টেনশন
নিষ্প্রয়োজন। এখন শুধু ট্যাক্সির অপেক্ষায় বসে পা দোলানো, আর টি-থ্রির গেট দিয়ে
বেরোতে বেরোতে ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে জেগে থাকা চেনা হাসিমুখ প্রথম দেখার মুহূর্তটা, বার বার মাথার ভেতর রিওয়াইন্ড করে দেখা।
ব্যস্।
bah :) ki ananda .. khub bhalo laglo pore ..ki sundar lagche toke dekhte ..
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ তিন্নি।
Deleteআহা এই ছবিটা যদি কদিন আগে পেতাম... Welcome back!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ সুগত। ভেরি ভেরি গ্ল্যাড টু বি ব্যাক।
DeleteTale ebar ghorer chele...thuri...ghorer meye ghore firche? amar erom short term European onsite trip khub pochonder...thik apnar moto ekta onsite er sopno dekhi ami ekhun..jak, sabdhan e ghore firun...have a safe journey..
ReplyDeleteChobi dekhe mone porlo...apnar bikhhato howar kotha kintu halka bhabe jante perechi...apnar boi beronor khobor ta kintu ebar detail e janano uchit...opekhha e roilam...
আরে আপনার স্বপ্ন পূর্ণ হল বলে সৌমেশ, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খবরটা পেয়েছেন...গুড। এই তো এইবার ঘোষণা বেরোবে অবান্তরে।
Deleteহাসি আর ধরে না দেখছি! :D
ReplyDeleteআমার মুখ গোমড়া করলে ছবি ভীষণ খারাপ ওঠে।
DeleteArre, daroon byapar! Dillitey ki sundor thanda porechhe na? Market 2r mishtir dokane kintu nolen gurer mishti eshe gachhe! :D
ReplyDeleteহাহা, বিম্ববতী, আমার এখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। আজ বিকেলে একবার ট্রাই নেওয়া যেতে পারে। আর দিল্লি কি সর্দি তো ভালোই, সেই অমৃতা অরোরা নেচে নেচে বলে গিয়েছিলেন মনে নেই?
DeleteKuntala,never had the time to comment,but you deserve all the praises dear, excellent blog..keep writing..
ReplyDeleteThank you.
Deleteare bah daruun bapar to. boi er bapar ta kintu chotpot amader janate hobe detail e. chobita sotti e sundor. welcome back. :)
ReplyDeleteআরে থ্যাঙ্ক ইউ রাখী। জানাব জানাব, সত্বর জানাব।
DeleteWelcome home.. :)
ReplyDelete-Aparajita
থ্যাংক ইউ অপরাজিতা।
Deleteবুক লঞ্চে ডাকবেন কিন্তু
ReplyDeleteহাহাহাহা, আস্তে ক'ন কত্তা, ঘুড়ায়ও হাসব।
Deletenatun post er ki holo, dillite ese amader ki bhule geche keu ?? :x
ReplyDeleteদাঁড়া এখন কেক খাচ্ছি, এখন পোস্ট লেখার টাইম নেই। কাল নতুন পোস্ট পড়বে, প্রমিস।
DeleteBhari onyay kotha to!! AAP k janate hobe mone hochhe.. :P
Deleteহাহা সৌমেশ, এখন কেজরিওয়ালের আপনার অভিযোগ শোনার টাইম নেই, এখন বিন্নিবাবুকে নিয়ে তিনি ঘোল খাচ্ছেন।
Delete