কালো কেটলি
মূল গল্পঃ The Brass Teapot
লেখকঃ Tim Macy
দুটো থেকে তাড়া দিতে
শুরু করেছিল সম্বিত। বেরোতে বেরোতে প’নে তিনটে। মামেয়ের গল্পই ফুরোয় না। তিন ঘণ্টার
ড্রাইভ রবিবারের সন্ধ্যের ট্র্যাফিকে সাড়ে চার ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। তাও এখনও
আধঘণ্টার রাস্তা বাকি। খানিকটা মেজাজ গরম করেই গাড়িটা পেট্রল পাম্পে দাঁড় করাল
সম্বিত। না করালেও চলত। এই গোটা রাস্তাটা অনুরাধা ঘুমিয়েছে। নাকি ঘুমের ভান করেছে?
গাড়িটা ব্রেক কষতেই চোখ খুলে যে ভাবে সম্বিতের দিকে তাকাল তাতে সে রকমই সন্দেহ হয়।
গভীর ঘুম থেকে উঠলে চোখে অত প্রশ্ন থাকে না। হয়তো ঘুমোচ্ছিল না, হয়তো চোখ বুজে
ভাবছিল। কী ভাবছিল? সম্বিত যা ভাবছিল তা-ই?
গাড়ি থেকে নেমে
থামার সিদ্ধান্তে খুশিই হল সম্বিত। হাত পা ধরে গেছে। শেষ বসন্তের সামান্য উষ্ণ
হাওয়ায় পেট্রল পাম্পের চত্বর জুড়ে উড়ছে শুকনো পাতা। তখনই ভিখিরি বুড়িটাকে দেখতে
পেল সম্বিত। ঘাঘরা চোলি পরা, মাথা ওড়নায় ঢাকা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের দিকে আসছে।
হাতে একটা ভিক্ষের বাটি। ভিখিরি দেখলে এখনও অস্বস্তি হয় সম্বিতের। সামনে কেউ হাত
পেতে দাঁড়ালে নিজেকে ভয়ানক অপরাধী লাগে। এতদিন নিজেকে শুধু অতিরিক্ত সংবেদনশীল
ভাবত, সেদিন কোন একটা আর্টিকলে দেখল এটা দস্তুরমতো একটা ইংরিজি নামওয়ালা সিনড্রোম। সেখানেই পড়েছিল এই প্যানহ্যান্ডলারদের
সঙ্গে ব্যবহার করার টিপস অ্যান্ড ট্রিকস। টাকা দাও বা না দাও, চোখের দিকে তাকিয়ে
কথা বলা। তুমি যে নিজেকে ওর থেকে বড়লোক ভাবছ, ওর থেকে উন্নত কিছু ভাবছ, সেটাই নাকি
যত অপরাধবোধের মূল। নিজেকে ওর সমান উচ্চতায় নামিয়ে, চোখে চোখ রেখে কথা বললে, লোকটাকেও
মানুষ বলে সম্মান দেওয়া হবে, অপরাধবোধও থাকবে না।
সম্বিত অবশ্য
পরামর্শটা কাজে লাগানোর সুযোগ পেল না। ভিখিরিটা সোজা অনুরাধার সামনে গিয়ে
দাঁড়িয়েছে। বুড়িটার হাতের যে জিনিসটাকে দেখে ভিক্ষের বাটি মনে হচ্ছিল সেটা আসলে
একটা কেটলি। সাবেকি ডিজাইনের। ময়লা, তেলকালি মাখা। একটা সিলিন্ড্রিক্যাল বাটির গা
থেকে হাতির শুঁড়ের মতো একটা মুখ বার করা। কতদিন বাদে জিনিসটা দেখল সম্বিত।
ছোটবেলায় বাড়িতে এ রকম একটা কেটলিতেই চা হত। দিল্লির বাড়িতেও ছিল মনে হয় একটা
প্রথম প্রথম।
বুড়িটা অনুরাধার
হাতে কেটলিটা গুঁজে দিল। অনুরাধা ঘাবড়ে গেছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। বুড়িটা ফিরে
যাচ্ছে। ঘাগরার তলা থেকে দুটো পা বেরিয়ে রয়েছে। ঢোলের মতো ফোলা। গোদ নাকি? বুড়িটার
মুখচোখ ফর্সা না হলেও তামাটে, পা দুটো অত কালো কেন? নখগুলো থেঁতলে গেছে।
গাড়িতে ওঠার সময়
অনুরাধা কেটলিটা পেছনের সিটে রেখে দিল। এই ছোট্ট বিরতিটা ওদের মধ্যের শৈত্যটাকে
গলিয়ে দিয়েছে। যে কথাগুলো এতক্ষণ দুজনেরই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেগুলো
এতক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এল। টাকা কোথা থেকে আসবে? গত ছ’মাস ধরে সম্বিতের ফার্ম লাটে
ওঠার গুজবটা আর গুজব নেই, সত্যি। আর হয়তো টেনেটুনে তিনমাস মাইনে পাবে সম্বিত। মেয়ের
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচ প্রচণ্ড। সম্বিত বলেছিল সরকারি কলেজে পড়াতে, অনুরাধা রাজি
হয়নি। সরকারি কলেজে পড়ানো আর মেয়ের হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া দুটো নাকি একই
ব্যাপার। শেয়ার বাজারে রিটার্ন ক্রমশ কমছে। এখনই সংসারে টান পড়তে শুরু করেছে। মে-তে
দশদিনের গ্রিস-সাইপ্রাস টুর বুক করা ছিল সেটা ক্যান্সেল করতে হয়েছে।
হাত ফসকে গেল কি না
খেয়াল করতে পারল না সম্বিত, সুটকেস বার করতে গিয়ে অনুরাধার হাতের ওপর ট্রাংকের
দরজাটা বন্ধ করে দিল সম্বিত। চিৎকার করে উঠল অনুরাধা। সম্বিত হাত টেনে নিয়ে ফুঁ
দিতে লাগল। থেঁতলায়নি। অনুরাধার চিৎকার থামলে খুব ক্ষীণ একটা ঠন্ শব্দ এল গাড়ির
ভেতর থেকে। সুটকেস ঘরে আনার পর অনুরাধা আবার নিচে গেল কেটলিটা আনতে। ঘরে ঢুকে
কেটলির ঢাকনা খুলে উঁকি দিল অনুরাধা। ভেতরে কী যেন চকচক করছে। ডাইনিং টেবিলের ওপর
উপুড় করে ধরতেই দুটো পাঁচটাকার কয়েন ছিটকে পড়ল।
বুড়িটা ভিক্ষের টাকা
বার করে নিতে ভুলে গেছে। বেচারা। সম্বিত দেখল অনুরাধা ধুয়েমুছে যত্ন করে কেটলিটাকে
কাউন্টারের ওপর রাখছে।
*****
সকালবেলা নবারুণের
ফোনে ঘুম ভাঙল সম্বিতের।
“শুনেছিস?”
“কী?”
“অভিজিৎ চিঠি পেয়েছে।”
অবাক হল না সম্বিত।
আজ অভিজিৎ পেয়েছে, কাল সম্বিত পাবে, পরশু নবারুণ। আরও দু’চারটে কথা বলে ফোন নামিয়ে
রাখল সম্বিত।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখল
অনুরাধা কেটলিটায় চায়ের জল বসিয়েছে।
“কেন ঝামেলা করছ,
ইলেকট্রিকটায় কর না? কোথাকার জিনিস, কে ইউজ করেছে কে জানে।”
অনুরাধা জবাব দিল
না। তার মানে কেটলিতেই চা হবে।
“সরো, আমি করছি।”
অনুরাধা শক্ত হয়ে
উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চামচে মেপে মেপে চায়ের পাতা ঢালছে কেটলিতে। সম্বিত
হাত দিয়ে অনুরাধাকে টেনে সরাতে চেষ্টা করতেই ঝটকা দিল অনুরাধা। কেটলি কাত হয়ে পড়ল।
ফুটন্ত জল ছিটকে লাগল সম্বিতের চোখের নিচে। অনুরাধা চেঁচিয়ে উঠে আঁচল চেপে ধরল
সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাঁ চোখের নিচের চামড়াটা লাল
দগদগে হয়ে গিয়ে ফোসকা পড়ে গেল। বার্নল লাগিয়ে দিল অনুরাধা।
নতুন করে চা করে
কাপে ঢালতে গিয়ে কেটলি কাত করে অনুরাধা দেখল চা পড়ছে না। “বলেছিলাম এসব ঝামেলায়
যেও না” বলতে গিয়েও থেমে গেল সম্বিত। অনুরাধা ঢাকনা খুলে উঁকি মেরে দেখছে। চামচের
পেছন দিকটা ঢুকিয়ে একটা কী জিনিস বার করে আনল। ভিজে চুবড়ি হয়ে গেছে, কিন্তু তাও
বেশ চেনা যাচ্ছে জিনিসটাকে। একশো টাকার একটা নোট।
নোটটাকে ডাইনিং
টেবিলের ওপর মেলে সেটার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল দুজনে। তারপর সম্বিত
উঠে পড়ল। দেরি হয়ে যাবে নয়তো। অনুরাধাও উঠে পড়ল। কাপপ্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে
গিয়ে থমকে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকাল সম্বিতের দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টি। স্বাভাবিক দৃষ্টির থেকে অনেক নরম, ভেজা চাউনি।
অনুরাধা এগিয়ে এল সম্বিতের দিকে। কাছে এসে দাঁড়াল। কতদিন পরে এত কাছে এসে
দাঁড়িয়েছে অনুরাধা। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল সম্বিতের। এখনও এত সুন্দরী আছে
অনুরাধা? কই সম্বিত তো কত বুড়িয়ে গেছে। কখন অনুর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল জানে না, চোখের
তলার চামড়ায় অনুর আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে ছিটকে গেল সম্বিত। জ্বলে উঠেছে চামড়ার
ক্ষত। ঠন্।
কেটলির ভেতর থেকে
চাকতিটা দু’আঙুলে বার করে আনল সম্বিত। দু চকচকে একটা দু’টাকার কয়েন। নতুন।
“আ-উ-উ-উ . . .”
অনুর একটা সপাট চড়
এসে পড়েছে সম্বিতের বাঁ গালে।
ঠন্ ঠন্ ঠন্।
দু’মিনিট আগের অনুর সুন্দর মুখটা এখন আর সুন্দর নেই।
উত্তেজনায় বিকৃত হয়ে গেছে। সম্বিতের হাত টেনে নিয়ে নিজের গালে মারছে অনু।
“মারো, মারো, আমাকেও মারো। যাতে ব্যথা লাগে। কিচ্ছু হবে না,
আরও জোরে।”
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে অনু?”
সম্বিত ঠেলে দিল
অনুকে। ব্যাগ তুলে নিয়ে দরজা টেনে অফিসে চলে গেল। আর তো বেশিদিন নেই। যে ক’দিন আছে
সে ক’দিন লেট করে যাওয়ার মানে হয় না কোনও।
*****
ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল
বিকেল বিকেলই, ওরা নিচে খেতে যাবে বলছিলও, সম্বিত যায়নি। নিচে যাওয়া মানে মার্কেটে
গিয়ে ফুটপাথের পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে পঁচাত্তর টাকা প্লেট শিককাবাব। খাওয়ার পাঁচ
মিনিটের মধ্যে চোঁয়া ঢেঁকুর উঠতে শুরু করে। বছরকয়েক আগেও অফিসের নিচের
ক্যাফেটেরিয়ায় যাওয়া হত দল বেঁধে। তিনশো নিরানব্বই টাকার কাবাব প্ল্যাটার নিয়ে
খাওয়া হত। ঢেঁকুর ওঠেনি কখনও। তার কারণ বয়স হতে পারে, আবার সাদা টুপি সাদা গ্লাভস
পরা শেফের হাতের কাবাবের ধকের অভাবও হতে পারে। তার পরপরই ম্যানেজমেন্ট বদলালো আর
ক্যাফেটেরিয়ায় যাওয়া বন্ধ হল। সকলেই স্বাদের দোহাই দিল, এক নবারুণ ফস করে বলে উঠেছিল,
“তাছাড়া দামটাও বড্ড বেশি।” নবারুণের অনেক দোষ আছে, স্পষ্টবাদিতাটা মাঝে মাঝে
নেওয়া যায় না, তবে টিমে ওর ভণ্ডামিটাই সবথেকে কম। সম্বিত আজকাল আর মার্কেটেও যায়
না। এক তো বড্ড অম্বল হয়, তাছাড়া পঁচাত্তর টাকাই বা দিচ্ছে কে?
পেট চোঁচোঁ করা
ক্ষিদে নিয়ে রাতে ফিরে সম্বিত দেখল রান্নাঘরের আলো নেভানো। সাধারণত এ জিনিস ঘটে
না। এ সময়টা অনুরাধার রান্না করার সময়। জীবনে যে ক’টা সত্যিকারের ভালোবাসা আছে
অনুরাধার তার মধ্যে রান্নাবান্না একটা। নিত্যনতুন রান্না, দেশবিদেশের রান্না।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম হরমোনের তাড়নায় যখন সবই ভালো লাগে তখন অনুরাধার এই গুণের
পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিল সম্বিত। তখন অনু সকালবিকেল রাঁধত, প্রতি রবিবার লোক ডেকে
খাওয়াত, তারা প্রশংসায় প্রশংসায় উদ্বেলিত করে তুলত অনুরাধাকে। অবশ্য অনুর যা
চেহারা ছিল তখন তাতে খুব খারাপ রাঁধলেও পুরুষের প্রশংসা অনুর অমিল হত না, কিন্তু
অনুর রান্না যে সত্যিই ভালো হত সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপর লোক আসা কমে
গেল। হরমোনের তাড়নাও। ঘরভর্তি রান্নার ম্যাগাজিন, টিভিতে সারাদিন রান্নার চ্যানেল
খোলা দেখে রীতিমত বিরক্তই লাগত সম্বিতের। বুককেসে গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা খরচ করে জোগাড়
করা ফার্স্ট এডিশন আর বার্তের লেকচার সিরিজের ফাঁকে যেদিন ‘মাইক্রোওয়েভে পঞ্চাশ
রকম নিরামিষ রান্না’র বই আবিষ্কার হল সেদিন মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল সম্বিতের। একটা
লোক সারাদিন রান্না আর খাওয়ার কথা ভাবে কী করে? রাজনীতি নাটক সিনেমা যদি বাদও যায়,
বাড়িভর্তি গোয়েন্দা গল্পের বইয়ের একটাও তো মুখে নিয়ে বসতে পারে। সম্বিতের অনেকবার
ইচ্ছে হয়েছে কথাটা জিজ্ঞাসা করে। রুচিতে আটকেছে। শেষে বছরখানেক আগে আর থাকতে না
পেরে লাইব্রেরিতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শটা দিয়েই ফেলেছিল। প্রস্তাব শুনে চুপ করে ছিল
অনুরাধা। সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরলে বলেছিল, “আমার সময় নিয়ে তোমার চিন্তা ঘুচিয়ে
এলাম।” জানা গেল দুপুরবেলা গিয়ে অ্যাংলো মেমের কেকপেস্ট্রি শেখানোর স্কুলে ভর্তি
হয়ে এসেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ছ’মাসের সাবস্ক্রিপশনের সমান ছ’টা ক্লাসের মাইনে। সম্বিত
দাঁতে দাঁত চিপে চুপ করে ছিল। তারপর সে কেকপেস্ট্রির শিক্ষা কাজে লাগানোর জন্য
বিলিতি দোকান থেকে স্টেট অফ দ্য আর্ট আভেন কিনে আনা হল। নিজেই গিয়েছিল অনুরাধা,
বেকিং ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে।
অবশ্য কেক বানানোতেও
অনুরাধা মাস্টার হয়েছিল সেটা সম্বিতকে স্বীকার করতে হবে। আবার প্রতি উইকএন্ডে
বাড়িভর্তি লোক, চায়ের পার্টি, সোমবার সকালে বাক্স ভর্তি করে করে কেক ব্রাউনি কুকিস
সম্বিতের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল ক’দিন। সবই সেই আগের মতো, খালি সম্বিতের মুখে
কেকগুলো বালির তৈরি ঠেকল। একবার আত্মসংযম ভেঙে, “এত কষ্ট না করে দোকান থেকে কিনে
আনলেই হয়, কস্ট এমন কিছু বেশি পড়বে না” বলে ফেলেছিল, পরের সাতদিন বরফের মতো শক্ত
ছিল অনুরাধার মুখ। বিবাহবার্ষিকীর সাড়ে তিন মাস বাকি থাকতেই সলিটেয়ার কিনে এনে
দিয়ে তারপর সন্ধিস্থাপন করতে হয়েছিল সম্বিতকে। কস্ট নিয়ে কটাক্ষ করার আচ্ছা
শাস্তি।
শোবার ঘরে ঢুকে এল
সম্বিত। নাইট লাইট জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে আছে অনুরাধা। পেটের ওপর একটা আবছা মতো কী
যেন রাখা। বই? এই বয়সে? উঁহু, কালো কেটলিটা।
“কী গো? শরীর খারাপ?”
লাইট জ্বালিয়েই স্তম্ভিত
হয়ে গেল সম্বিত। অনুরাধার মুখচোখের এ কী অবস্থা! একটা চোখ ফুলে
প্রায় বুজে এসেছে, চারপাশে জমা রক্তের ঘন নীল রিং।
“অনু! কী হয়েছে? কী
করে হল?”
“কিছু না,
রান্নাঘরের কাবার্ড খুলতে গিয়ে লেগে গেছে।”
“বরফ দিয়েছ?”
ঘাড় নাড়ল অনুরাধা।
বীভৎস লেগেছে নির্ঘাত, অথচ অনুরাধার মুখে ব্যথার বদলে বেশ একটা তৃপ্তির চিহ্ন।
শুয়ে আছে কেটলিটাকে বুকের ওপর নিয়ে। মাঝে মাঝে আলতো হাত বোলাচ্ছে ওটার শুঁড়ে,
গায়ে। কেটলিটাও চুপ করে শুয়ে শুয়ে অনুরাধার চাঁপার কলির মতো আঙুলের আদর খাচ্ছে।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন ওটা একটা ভাঙা কেটলি নয়, যেন একটা পোষা কেঁদো হুলোবেড়াল।
কাছে এসে বিছানার
ধারে বসে অনুরাধার চিবুক ধরে নিজের দিকে টানতেই ঝটকা দিল অনুরাধ।
“আহ্, কিছু হয়নি
বলছি তো। সরো।”
হাত সরিয়ে নিল
সম্বিত। হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখল পাঁচটা চকচকে একশো টাকার নোট চাপা
দিয়ে রাখা আছে।
সম্বিতকে প্রশ্ন করতে
হল না, নিজেই কৈফিয়ত
দিল অনুরাধা।
“প্রথমটা আচমকাই
লেগেছিল। তাতে একশো টাকা দিল। তারপর আমি ইচ্ছে করে আবার
দু’বার ওই একই জায়গায় আবার দু’বার ক্যাবিনেটের দরজাটা ঠুকতে দুশো দুশো চারশো।”
সম্বিত আর কথা বাড়াল
না।
“রান্না আছে কিছু,
না বানিয়ে নেব?”
সিলিং-এর দিকে
তাকিয়ে খানিকক্ষণ ভাবল অনুরাধা। তারপর বলল, “চল আজ বাইরে খাই, অনেকদিন যাইনি।”
দোকানটাও পছন্দ করল
অনুরাধা। লাজপত নগরের মেট্রোর নিচটায় কতগুলো দোকান হয়েছে। বেসিক্যালি রাস্তার দোকান, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
গাছের টব ইত্যাদি রেখে জায়গাটাকে বেশ ঝাঁ চকচকে চেহারা দিয়েছে। খাবারের দামটাও
অবশ্য রাস্তার দোকানের থেকে বেশি। কিন্তু খাবারগুলোও রাস্তার খাবারের মতো নয়। অনু
যে নিজে থেকে এই দোকানে খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল সেটা দেখে অবাক হল সম্বিত। একসময়
মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা কাপড়ের ন্যাপকিনওয়ালা দোকান ছাড়া অন্য কোনও দোকানে ডিনার
করতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারত না অনুরাধা।
গাড়ি নিয়ে বেরোতে না
বেরোতেই বৃষ্টি নামল। সঙ্গে সঙ্গে জ্যাম হয়ে গেছে। জি কে ওয়ান মার্কেটের সামনে
দাঁড়িয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল সম্বিতের। আর ভেতরে ফুঁসে উঠছিল রাগ। অনুরাধার
ওপর। তার থেকেও বেশি নিজের ওপর। কেন সে বলতে পারল না যে আমি এখন অফিস থেকে ফিরেছি,
টায়ার্ড, কোথাও বেরোতে পারব না। কেন বলল না যে তুমি উঠে কিছু রান্না করে দাও।
নিজের ভদ্রতার মুখে থুতু ছুঁড়তে ইচ্ছে করছিল সম্বিতের।
মূলচন্দের কাছে আরও
প্রায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে অবশেষে দোকানে পৌঁছলো যখন সম্বিতের ঘড়িতে সাড়ে ন’টা বেজে
গেছে। খাওয়ার ইচ্ছে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে সম্বিতের। অনুরাধার মনের ভাব বোঝার
চেষ্টাও করল না সম্বিত। অনুরাধা জানালার বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।
খাওয়ার পর দাম দিতে
সম্বিতের মনে পড়ল এখানে ক্যাশ লাগবে, কার্ড চলবে না। কার্ড থাকলেও কাজে দিত না,
ম্যাক্স আউট করে গেছে। অনুরাধার দিকে তাকাতেই হাত উল্টে দিল অনুরাধা। ব্যাগ আনেনি
সঙ্গে। সামনেই এস বি আই-এর একটা এ টি এম দেখে সেদিকে এগোল সম্বিত। লাইন বেশি নেই। স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফ্রেলল সম্বিত। মেশিনের সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রোগাটে চেহারা,
চাপা জিনসে পাগুলোকে দেশলাই কাঠির মতো দেখাচ্ছে। বাঁহাতের কনুই থেকে একটা কালো
হেলমেট ঝুলছে। কতক্ষণ লাগাবে এ? ভাবতে না ভাবতেই ছেলেটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
“কাম নেহি কর রহা
হ্যায়।”
পাশেই একটা কানাড়া
ব্যাংকের এ টি এম-এর দিকে তাকাতেই ছেলেটা বলল, “ওহ্ ভি সালা খরাব হ্যায়।” তাও
নিজে মিলিয়ে নিতে একবার ঢুকল সম্বিত। এসি চলছে না। এ টি এম-এর ভেতরের ভ্যাপসা
বাতাস ঘামের গন্ধ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। বাস্কেট উপচে বিলের টুকরো ছত্রাকার হয়ে
রয়েছে মেঝেতে।
ঠিকই বলেছে ছেলেটা।
কাজ করছে না। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে কানাড়া ব্যাংকের এটিএম-টাতেও একবার ঢুকল
সম্বিত। সেখানেও একই ব্যাপার।
বৃষ্টিটা ধরেছে
খানিকটা। জানালার কাঁচ নামিয়ে তাকিয়ে ছিল অনুরাধা। অনুরাধার মেকআপ ছাড়া ফর্সা মুখ
ভূতের মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
“পেলে না?”
উত্তর না দিয়ে সিটে
গিয়ে বসল সম্বিত। ক্লান্তিতে, রাগে মাথা দপদপ করছে। চলন্ত গাড়ির হর্নগুলো কপালে
হাতুড়ি মারছে সম্বিতের। পেমেন্ট কী করে করা হবে সেটা নিয়ে ওর এখন চিন্তা করা উচিত।
অনুরাধাকে এখানে রেখে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে আশেপাশের এ টি এম পরীক্ষা করা উচিত।
কিন্তু সম্বিতের মাথায় সে সব কিছু এল না। উইন্ডস্ক্রিনের মাঝখানে ওয়াইপারের আঁকা
আধখানা বৃত্তের মধ্য দিয়ে বাইরের ধোঁয়া ধোঁয়া আলোর দিকে তাকিয়ে বসে রইল সম্বিত।
আর তখনই ও টের পেল
অনুরাধাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টে। ফাঁকা দৃষ্টি নয়। একটা কিছু বোঝাতে
চাইছে তাকে অনুরাধা। সম্বিত ঘাড় ঘুরিয়ে অনুরাধার দিকে তাকাল। জ্বলজ্বল করছে অনুরাধার
চোখ। মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল সম্বিত। অনুরাধার দৃষ্টির এই অস্বাভাবিক
ঔজ্জ্বল্যের কারণ সে জানে। কেটলিটা রাখা আছে অনুর কোলেই। ব্যাগ আনেনি, কিন্তু
বুদ্ধি করে কেটলিটা নিয়ে বেরিয়েছে অনুরাধা।
মেট্রোর বড় বাড়িটার
পেছনের অন্ধকার থেকে একহাতে কালো কেটলিটা আর একহাতে দোমড়ানো মোচড়ানো কতগুলো একশো
টাকার নোট নিয়ে বেরিয়ে যখন দোকানে টাকাটা দিতে গেল সম্বিত তখন ও পায়ের পাতা সোজা
করে ফেলতে পারছে না। দু’হাত মুঠো করতে পারছে না। টনটন করছে আঙুলের ডগাগুলো। কংক্রিটের
দেওয়ালে উপর্যুপরি ঘুঁষি ও লাথি মারার ফল। দুয়েকটা আঙুল ভেঙে গেলেও অবাক হবে না
সম্বিত। প্রথমে আস্তেই মারছিল কিন্তু তাতে কেটলি শূন্য পড়ে ছিল। তারপর যখন ক্রমশ
জোরে আরও জোরে কংক্রিটের দেওয়ালকে আক্রমণ করতে লাগল সে, যখন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ
করতে পারে জেনেও গলা থেকে ছিটকে বেরোনো আর্তনাদকে চাপা দিতে পারছিল না সম্বিত, তখন
কেটলি ভরতে শুরু করল, নিঃশব্দে। প্রথমে দশ, কুড়ির নোট। তারপর সম্বিতের হাতের চামড়া
ফেটে রক্তের বিন্দু ফুটে বেরোলো যখন তখন হঠাৎ একবারে দুটো একশো টাকার নোট।
*****
লম্বা উইকএন্ডে বাড়ি
এসে চমকে গেল মিষ্টু। “এ কী মা! তোমার চেহারা এ কী হয়েছে, এত কালশিটে কীসের? বাবা,
তুমি এত রোগা হয়ে যাচ্ছ কেন? ইস, তোমার পায়ের নখগুলো এ রকম থেঁতলে গেল কী করে?”
হেসে কথা ঘুরিয়ে নিল সম্বিত আর অনুরাধা। পরের দু’দিন মিষ্টু হাহা করে হাসল, দুমদাম
করে সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতে লাগল, ফোনে ঘন্টার পর ঘণ্টা বন্ধুদের সঙ্গে ফিসফিস
করে গল্প করল। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বাড়িটা ঝলমল করে উঠল নিমেষে। মেয়ে আসবে বলে কই মাছ
কিনে আনল সম্বিত বাজার থেকে। সত্যিকারের কই মাছ। হাজার টাকার নোটটা বের করে দেওয়ার
সময় অনুরাধার কবজিতে টাটকা ফোসকাটা দেখেও দেখল না সম্বিত। মাছটা চমৎকার রেঁধেছিল
অনুরাধা। খেতে খেতে মিষ্টু নানারকম উঃ আঃ শব্দ করছিল। “ইউ আর আ জিনিয়াস্, মা। ওহ্
ক্যালকাটা-ফ্যালকাটা জাস্ট দাঁড়াতে পারবে না।” মেয়ের তৃপ্ত মুখের
দিকে তাকিয়ে ভালো লাগছিল সম্বিতের।
“আরও একটু ঘন ঘন
আসতে পারিস তো। উইকএন্ডে তো কিছুই করার থাকে না আমাদের, তুই এলে
কত ভালো লাগে।”
সম্মতির আশায়
টেবিলের উল্টোদিকে তাকিয়েই থেমে গেল সম্বিত। অনুরাধা একটাও কথা শুনছে না। একদৃষ্টে
তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি অনুসরণ করে সম্বিত দেখল অনুরাধা তাকিয়ে আছে মিষ্টুর দিকে।
মুখের দিকে নয়, মিষ্টুর শরীরের দিকে। হাতকাটা লাল রঙের টপ থেকে বেরিয়ে থাকা
মিষ্টুর সাদা মোমের মতো নিটোল, ভরাট, কালশিটেহীন হাতের দিকে।
সোমবার সকালে ব্যাগ
গুছিয়ে দোতলা থেকে নামার সময় ঘটনাটা ঘটল। মায়ের স্বভাব পেয়েছে মিষ্টু, হোস্টেল
থেকে আসার সময় সব বয়ে আনবে আবার যাওয়ার সময় সব ভরে নিয়ে যাবে। অনেক বারণ করেছে
সম্বিত, মিষ্টু গোঁয়ারের মতো বলেছে, “দাও তোমাকে বইতে হবে না, আমি নিচ্ছি।” যেন
সম্বিত ভারি সুটকেস বইতে কষ্ট হচ্ছে বলে বলছে।
সকালবেলা বন্ধুর
গাড়ি এসে নিচে হর্ন দিচ্ছিল, মিষ্টু যথারীতি লেট, অনুরাধার নির্দেশে সম্বিত নিচে
গিয়ে বন্ধুর বাবার সঙ্গে ভদ্রতা করছিল এমন সময় চিৎকারটা কানে এল সম্বিতের।
ভারি সুটকেস টানতে
টানতে নামার সময় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে মিষ্টু। সিঁড়ির নিচে কুঁকড়ে পড়ে আছে, গোড়ালি
চেপে ধরে কাতরাচ্ছে। পাশে খোলা সুটকেস থেকে ছিটকে পড়েছে জামাকাপড় অন্তর্বাস।
মিষ্টুর ওপর ঝুঁকে পড়েছে অনুরাধা, বলছে, “খুব লেগেছে, মিষ্টু? বরফ দেব? মিষ্টু?”
নার্সিংহোমে নিয়ে
যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল সম্বিত। বন্ধুর বাবাও জোরাজুরি করলেন, কিন্তু মিষ্টু রাজি হল না।
বরফ লাগানোর পর নাকি ব্যথাটা অনেক কম লাগছে। আলমারি থেকে একটা পুরোনো ক্রেপ
ব্যান্ডেজ বার করে যত্ন করে মেয়ের পায়ে জড়িয়ে দিল সম্বিত। “থ্যাংক ইউ, বাবা” বলে
সম্বিতের গালে চুমু খেয়ে মিষ্টু চলে গেল গালে লেগে থাকা চোখের জল ঘষে মুছতে মুছতে।
ওপরে এসে সম্বিত আর
অপেক্ষা করল না।
“তোমার কি মাথা
খারাপ হয়ে গেছে অনুরাধা? মেয়েটার কত বড় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত জানো?”
অনুরাধা শুনছে না।
টেবিলের ওপর রাখা কালো কেটলির ঢাকনাটা সন্তর্পণে তুলে ঝুঁকে দেখছে ভেতরে। হাত
ঢুকিয়ে লাল রঙের বড় নোটটা বার করে আনল অনুরাধা।
“হাজার দিয়েছে!”
কখন যে ওর ডান হাতটা
শূন্যে উঠল, কখন যে সশব্দে আছড়ে পড়ল অনুরাধার গালে সেটা ঠাহর করতে পারল না সম্বিত।
অনুরাধাও চমকে গেছে, গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে সম্বিতের দিকে। টকটকে লাল হয়ে
গেছে অনুর গাল। সম্বিত এক পা এগিয়ে গেল।
“অনু, আমি সরি, অনু।
অনু . . .”
ঠন্ ঠন্ ঠন্।
অতর্কিত আওয়াজটায়
একমুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল সম্বিত। আর তক্ষুনি একটা থুতুর দলা ছুটে এল
সম্বিতের মুখ লক্ষ্য করে।
“অনু!”
ঠন্ ঠন্ ঠন্।
এবার আগের থেকেও জোরে।
অনুরাধা ঝাঁপিয়ে
পড়েছে সম্বিতের ওপর। পাগলের মতো আঁচড়াচ্ছে, ঘুঁষি মারছে, সম্বিতের চুল ধরে টানছে।
অনুরাধার হাত চেপে ধরে অনুরাধাকে শান্ত করতে চাইল সম্বিত। পোড়া জায়গাটায় চাপ
পড়েছে, যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেছে অনুরাধা।
কেটলির আওয়াজে
চিৎকার চাপা পড়ে গেল। ঝরে পড়া পয়সার আঘাতে কাঁপছে কালো কেটলিটা। মনে হচ্ছে সারা
শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে কেটলিটার কুচকুচে কালো শরীর।
সম্বিত টেবিল থেকে
কেটলিটা তুলে নিল। “আজই আমি এটাকে দূর করে ফেলে দেব।” মেঝেতে আছড়ে ফেলবে বলে
কেটলিটা মাথার ওপর তুলল সম্বিত।
“না!” চিৎকার করে
কেটলিটা ছিনিয়ে নিল অনুরাধা। “কিচ্ছু করবে না তুমি এটাকে।” অনুরাধার মুখ থেকে থুতু
ছিটকোচ্ছে। চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক, হিংস্র। “আমাদের টাকা দরকার। অনেক টাকা। এটা
না থাকলে আমরা আর কোনওদিন বড়লোক হতে পারব না।”
“বড়লোক হওয়ার জন্য
নিজের মেয়েকে মেরে ফেলবে তুমি?”
“যা করেছি, মিষ্টুর
ভালোর জন্যই করেছি। সামনের সেমেস্টারের টাকা আসবে কোত্থেকে? তোমার মাইনে থেকে?
মেয়ে বাড়ি এলে কইমাছ খাওয়াবে কী করে?” ব্যঙ্গে অনুরাধার গোলাপের মতো ঠোঁটদুটো
সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। “সে মুরোদ আছে
তোমার?”
“অনু, প্লিজ স্টপ।
প্লিজ।”
“কেন স্টপ কেন?
সত্যি কথাটা বলার সময় হয়েছে এবার। তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে লাইফ হেল হয়ে গেল আমার। আই আই টি-র গোল্ড মেডেল ভাঙিয়ে বড় বাড়ির সঙ্গে কুটুম পাতাতে
যাওয়ার সময় সে বাড়ির মেয়ের মেন্টেন্যান্সের কথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিল। আর ভালো
ছাত্রটাই বা কীসের? ভালো যদি তো সারাজীবন ইন্ডিয়ায় পচলে কেন? সব্বাই চলে গেল,
সব্বাই। খালি আমি . . .”
গলা ধরে এসেছে
অনুরাধার। হাঁপাচ্ছে অনুরাধা। এত কষ্ট পেয়েছে অনুরাধা সারাজীবন? কই সম্বিত কিছু
বুঝতে পারেনি তো।
“অনু, প্লিজ, শান্ত
হও।”
“কেন বিয়ে করলে
আমাকে? কেন? ইউ ডিসার্ভড দ্যাট পুওর, আগলি গার্ল।”
ছবিটা ভেসে উঠল সম্বিতের বুকের ভেতর। প্রায় ছাব্বিশ বছর
আগের ছবি, তবু এখনও কী উজ্জ্বল, কী স্পষ্ট। পাশ থেকে দেখা একটা মুখ, নাক, চিবুকের
ভাঁজ। কিছুক্ষণ আগেই সম্বিত খবরটা দিয়েছে ওকে। অনেক চেষ্টা করেছে সম্বিত। বাড়ির
লোক রাজি নয়। ঠাকুরদা মৃত্যুশয্যায়। সারাজীবন অনেক কষ্ট পেয়েছেন তিনি। উদ্বাস্তু
হওয়ার কষ্ট, একমাত্র পুত্রবিয়োগের কষ্ট। সম্বিত তাঁর নয়নের মণি। তার অসবর্ণ বিয়ে
দেখতে পারবেন না ঠাকুরদা।
সম্বিতের চোখ জ্বালা করে উঠল হঠাৎ। দিল্লির বাতাসে আজকাল এত
ধুলো উড়ে বেড়ায়।
“সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না অনু। ওকে পেলে আমার
জীবনটা অন্যরকম হত।”
ব্যস্? পঁচিশ বছর ধরে বুকের ভেতর পাথরের মতো জমিয়ে রাখা
সত্যিটা বলে ফেলা এতই সহজ? অনুর সঙ্গে কাটানো তুমুল সুখের সময়ে, নিবিড় যন্ত্রণার
সময়ে, অফিসের পার্টিতে, অনিদ্রার রাতে, পথ চলতে কোনও রোগা মেয়ের দিঘির মতো চোখে
চোখ পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে গোপন হৃদরোগের মতো যে সত্যিটা চিনচিন করে উঠেছে বুকের
ভেতর, সেটাকে আজ এতদিন পর চোখের সামনে দেখে সম্বিত অবাক হয়ে গেল। এই সামান্য
কথাটাকে অনুর কাছ থেকে, পৃথিবীর কাছ থেকে, নিজের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে এত আপ্রাণ
চেষ্টা করেছে সম্বিত? সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থেকেছে পাছে কথাটা কেউ জানতে পেরে যায়?
পাছে তার তিলে তিলে গড়া সংসার ধসে পড়ে? কই পড়ল না তো? কত সহজে তার মুখ থেকে বেরিয়ে
খোলা হাওয়ায় মিশে গেল কথাটা, কোথাও কোনও ঢেউ উঠল না, কোথাও কোনও পাড় ভাঙল না।
নাকি ভেঙেছে কোথাও? অনুর রাগে পুড়তে থাকা মুখটায় খুব আবছা একটা
হাসি ফুটে উঠেছে। অদ্ভুত হাসি। অবিকল কান্নার মতো দেখতে।
পাঁচশো একশোর নোট মিলিয়ে কেটলি সেদিন তিন হাজার টাকা দিল।
*****
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল
সম্বিতের ফার্ম। প্রথম দিকে ব্যাপারটা হালকা ভাবে দেখতে চেষ্টা করল সম্বিত। এ রকম
আকছার হচ্ছে আজকাল। ওর যা যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, তাতে আর একটা চাকরি খুঁজে নেওয়া কোনও
অসুবিধেই হবে না। কিন্তু অসুবিধে হল। যারা সম্বিতকে পছন্দ করত তারা সকলেই চেষ্টা
করার প্রতিশ্রুতি দিল, যারা সম্বিতকে হিংসে করত তারা বলল, “এখন আর নতুন করে চাকরি
খোঁজার দরকার কী ব্রাদার, আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে মিসেসকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোও।”
কেটলির টাকাও ধীরে
ধীরে কমে এল। এক সময় ঘুঁষি প্রতি অন্তত পাঁচটাকা করে দিত, এখন সেটা এক কিংবা দু’টাকায়
এসে ঠেকেছে। নিজেদের মধ্যে ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করে দেখেছে সম্বিত
অনুরাধা, কেটলি ধরে ফেলেছে, একটি পয়সাও দেয়নি। অনুরাধা একদিন সাবানজল ছড়িয়ে
বাথরুমে পিছলে পড়ায় শ’পাঁচেক টাকা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু এমারজেন্সিতে গিয়ে মাথায়
স্টিচ করাতে গিয়ে উল্টে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেরিয়ে গেল।
ফাইন্যালি নবারুণ
একটা খবর দিল। ওর কোন ভায়রাভাই নয়ডায় একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খুলেছে, সেখানে
ফ্যাকাল্টির জন্য লোক খোঁজা হচ্ছে। নবারুণ বলল, “কোনও রকম এক্সপেকটেশন নিয়ে যাস না। অলরেডি চল্লিশটার
ওপর অ্যাপ্লিকেশন পড়ে গেছে। আমি তোর কথা বলে রেখেছি। বাকিটা লাক।”
গেল সম্বিত। গাড়িটা না নিয়েই গেল। অসহ্য গরম। মেট্রোতে যেতে অবশ্য গরম লাগে না। তবে প্রচণ্ড ভিড়। নেমে আবার অটো। কোথায় কোথায় অফিস খোলে লোকজন। ওর আগের অফিসের লোকেশনের কথা মনে পড়ে একবার বুকটা মুচড়ে উঠল সম্বিতের। এখানে কিছু একটা হলেও আসতে যেতে তো জান কয়লা। হয়ে গেলে অবশ্য গাড়িটা ব্যবহার করা যাবে। নিজেকে সংযত করল সম্বিত। নবারুণের কথাটা নিজেকে মনে করাল। এক্সপেকটেশন রাখবে না সে। নবারুণ, নবারুণের ভায়রাভাই অত কথা অনুরাধাকে বলেনি ও। “এই একটা ভ্যাকেনসির খোঁজ পাওয়া গেছে, দেখা করে আসি” বলে বেরিয়েছে।
ভদ্রলোকের সঙ্গে
দেখা হয়ে অবশ্য এই উদাসীনতাটা আর মেন্টেন করতে পারল না সম্বিত। রিসেপশনের মেয়েটি
ফোনে ওর পৌঁছনোর খবর দেওয়া মাত্র ভদ্রলোক নিজে এসে সম্বিতকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আপাদমস্তক
ভদ্রলোক। এ ধরণের ভদ্রতা আজকাল চোখে পড়ে না। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। নিজের
চাকরিজীবনের কথা বললেন, চাকরি ছেড়ে কেন এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভূত মাথায় চেপেছে
সেই সব কথা। সম্বিত যে ওঁর কাছ থেকে একটা ফেভার চাইতে এসেছে সে প্রসঙ্গটাই উঠতে
দিলেন না। প্রথমটা সম্বিতের আড়ষ্ট লাগছিল, কিন্তু ভদ্রলোকের আন্তরিকতায় সেটা দূর
হয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগল না। সম্বিতকে জোর করে কোল্ড ড্রিংকস খাইয়ে ঘণ্টাখানেক পর যখন
দরজার কাছে ছাড়তে এলেন তখন সম্বিতের পিঠে হাত রেখে বললেন, “নবারুণের মুখে আপনার
কথা অনেক শুনেছি। আপনার মতো লোক পেলে আমাদের কলেজ বর্তে যাবে। আপনি কোনও চিন্তা
করবেন না।”
বাড়ি ফেরার পথে
কথাগুলো বার বার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল সম্বিতের। কোনও চিন্তা করবেন না। কোনও
চিন্তা করবেন না। তাও চিন্তা এসেই যাচ্ছিল সম্বিতের। সুখের চিন্তা। আচ্ছা যদি ধরেই
নেয় সে চাকরিটা তার হয়ে যাবে, জানালা দিয়ে দিল্লির ঘেমো ঘিঞ্জি ছাদের ভিড় দেখতে
দেখতে যদি একটু কল্পনাবিলাসের স্পর্ধা দেখায়ই সে, তাতে কার কী বলার আছে? যদি
খানিকটা সুখের এক্সপেকটেশন করেই, কী ক্ষতি আছে?
ফাঁকা কামরায় চড়া
এসিতে শরীরের ঘাম শুকোতে শুকোতে নিজেকে সুখস্বপ্নের অনুমতি দিল সম্বিত। সমস্ত
সতর্কতা উড়িয়ে দিয়ে ধরে নিল চাকরিটা তার হয়ে গেছে। দরজার বাইরে নেমপ্লেটে লেখা আছে
ডঃ সম্বিত মুখোপাধ্যায়। আবার আগের মতো চলছে সবকিছু। মাইনে পেয়ে কী করবে ভাবার
চেষ্টা করল সম্বিত। মিষ্টুর পড়াশোনার দিকে নিজে নজর দেবে। অনেক অবহেলা করা হয়েছে
মেয়েটাকে। জি আর ই-র খবর নিতে হবে। ওর মায়ের এত শখ। অনুর কথা মনে পড়ায় অনেক দিন পর
বুকের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল সম্বিতের। অনুরাধা, অনু। কালশিটেয় কালশিটেয় ঢাকা পড়া অনু। সম্বিতের বুকটা হুহু করে
উঠল। পঁচিশ বছর আগের সেই ঝলমলে অনুর চেহারাটা মনে পড়ে গেল এক নিমেষে। রক্তমাংসের
মানুষ যে এত নিখুঁত, এত মসৃণ, এত মোলায়েম হতে পারে বিশ্বাস হত না সম্বিতের। সেই
অনুর আজ কী অবস্থা। কার দোষে? পুরোটাই তো অনুর দোষ হতে পারে না। নিশ্চয় সম্বিতও
কোথাও ভুল করেছে। সম্বিত নিজের মনে মনে শপথ নিল, অনুর বাইরের ভেতরের প্রতিটি ক্ষত
সে সারিয়ে তুলবে। তার জন্য যা করতে হয় করবে সম্বিত। ওদের বিবাহবার্ষিকী আসছে
ডিসেম্বরে। পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী। সেদিন দিল্লির সবথেকে দামি দোকানে খাওয়াতে
নিয়ে যাবে সম্বিত্ অনুরাধাকে, ক্যান্ডেল লাইটের আলোয় বসে অনুর হাতে তুলে দেবে পরের
বছরের গ্রিস-সাইপ্রাস ট্যুরের টিকিট।
কিন্তু সবার আগে,
সবার আগে বিদায় করবে ওই কেটলিটাকে।
*****
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে
উঠতেই গলাটা শুনতে পাচ্ছিল, সামান্য খোলা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে লোকটাকে দেখতে
পেল সম্বিত। গাঁট্টাগোঁট্টা, বেঁটেখাটো একটা লোক। টাকমাথা। ফ্রিজ খুলে খুটুরখাটুর
করছে। পাশে অনু দাঁড়িয়ে। ফ্রিজ কাজ করছে না গোছের কিছু একটা বলছিল বটে অনু সকালে,
টেনশনে কান দেয়নি সম্বিত। অনু নিজেই উদ্যোগ করে লোক ডেকে এনেছে দেখে হাঁফ ছাড়ল
সম্বিত। অসম্ভব গরম লাগছে। টাইটা গলায় ফাঁসির দড়ির মতো চেপে বসেছে। অনুকে
পরিস্থিতি হ্যান্ডল করতে দিয়ে বেডরুমের দিকে রওনা দিল সম্বিত।
মুখেচোখে জল দিয়ে
বাথরুম থেকে বেরিয়ে সম্বিত দেখল অনরাধা আলমারি থেকে নীল রঙের ফাইলটা বার করে সব
বিছানার ওপর সব কাগজপত্র ছড়িয়েছে।
“ওয়্যার্যান্টিগুলো
এই ফাইলটাতেই থাকে তো? ফ্রিজেরটা কোথায় গেল?”
“ওয়্যার্যান্টি
দিয়ে কী হবে, পেরিয়ে গেছে এতদিনে শিওর। টু থাউজ্যান্ড থার্টিনে কেনা হল না এটা?”
“এই তো।” অনু একতাড়া
কাগজ হাতে চলে গেল। আর তার মিনিটখানেক পরেই লোকটার উত্তেজিত গলা শোনা গেল, “ম্যায়
আপকো বতা রহা হুঁ ম্যাডাম, ইয়ে ওয়্যারান্টি মে কভার নহি হোগা। আপকো পেমেন্ট করনা
পড়েগা।”
লোকটা অনুকে
বোঝাচ্ছে। ভেতরের যন্ত্রপাতি খারাপ হলে ওয়্যারান্টি সেটা কভার করে ঠিকই, কিন্তু এই
ফ্রিজটার সমস্যা বডিতে। “ক্যায়সে হুয়া ইয়ে সব, ইতনা ডেন্ট, স্ক্র্যাচ – খুব মারপিট
কিয়া কেয়া ইসকে সাথ?” লোকটা নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছে।
অনু তর্ক করে
যাচ্ছে। বডিতে সমস্যা তো ভেতর ঠাণ্ডা হচ্ছে না কেন?
লোকটা বলছে, “কেয়া মালুম।
বাহার ইতনা ড্যামেজ হুয়া হ্যায়, অন্দর উসকা হি কুছ এফেক্ট হুয়া হোগা। আপকো পেমেন্ট
করনা পড়েগা। ওয়্যারান্টি উইল নট কভার দিস।”
লোকটার গলায় আলোচনা শেষ
করার দৃঢ়তা। হাতের চিরুনিটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসতে আসতেই একসঙ্গে তিনটে শব্দ
শুনতে পেল সম্বিত।
অনুর গলা থেকে
বেরোনো একটা অস্ফুট হুংকার, দুটো শক্ত জিনিসে ঠোকাঠুকি হওয়ার আওয়াজ আর লোকটার গলা
থেকে বেরোনো একটা ছাদফাটানো চিৎকার।
দৌড়ে ডাইনিং রুমে
এসে দেখল সম্বিত লোকটা দু’হাত দিয়ে কপাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে, দু’চোখে ব্যথার থেকেও
বেশি বিস্ময়। দু’হাত দূরে অনু দাঁড়িয়ে আছে, উত্তেজনায় বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে
অনুর, মাথার ওপর তুলে ধরা ডানহাতে কাঁপছে রুটি বেলুনি।
ঠিক তক্ষুনি চার
নম্বর আওয়াজটা হল।
ঠন্ ঠন্ ঠন্ ঠন্
ঠন্ ঠন্।
কাউন্টারের ওপর
বসানো কালো কেটলিটা প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠেছে। যেন হা হা করে হাসছে।
হাততালি দিচ্ছে
জোরে জোরে।
ছুটে গিয়েও শেষরক্ষা
করতে পারল না সম্বিত, অনু ঝাঁপিয়ে পড়েছে লোকটার ওপর, অনুর হাতের বেলুনি লোকটার
মাথার ওপর নেমে এসেছে।
অনুকে টেনে ছাড়িয়ে
আনল সম্বিত। লোকটার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। লোকটা চেঁচাচ্ছে। “পাগল
হ্যায় কেয়া? পাগল হ্যায় আপকা বিবি?”
অনুকে টানতে টানতে
দূরে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে দৌড়ে কেটলির ঢাকনা খুলল সম্বিত। নোট, কয়েনে ভর্তি হয়ে
গেছে। মুঠো করে কতগুলো পাঁচশোর নোট তুলল সম্বিত। লোকটা তখনও চেঁচাচ্ছে, “পাগল
হ্যায়, পাগল হ্যায়, ম্যায় ছোড়ুঙ্গা নহি, পুলিস বুলাউঙ্গা।”
নোটগুলো লোকটার হাতে
গুঁজে দিয়ে টানতে টানতে দরজার দিকে নিয়ে চলল সম্বিত। “প্লিজ ভাইসাব, আপ যাইয়ে, ডক্টর
দিখা লে না।” লোকটা বলছে, “মেরা ব্যাগ দে দো মুঝে।” ফ্রিজের সামনে লোকটার পেটমোটা
ভুষোরঙা ব্যাগটা পড়ে আছে। লোকটাকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে সম্বিত ব্যাগটা আনতে
গেল। নিচু হয়ে ভারি ব্যাগটা তুলে পেছন ফিরে যে দৃশ্যটা দেখল সম্বিত সেটা এক নিমেষে
ওকে পঞ্চাশ বছর আগের একটা রবিবারের সকালে নিয়ে পৌঁছে দিল।
মন্দিরতলা বাজার। বাবা
মাছওয়ালার সঙ্গে কথা বলতেন, সম্বিত হাঁটুর ওপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখত জলের মধ্যে মাছগুলো
কেমন খেলে বেড়াচ্ছে, কালো পিছল গা বেঁকেচুরে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ মাছওয়ালার
প্রকাণ্ড থ্যাবড়া হাত নেমে আসত সেই দৃশ্যের মধ্যে, একটা মাছকে তুলে ধরত। মাছওয়ালার
আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা ল্যাজটা পাগলের মতো দুলত। বঁটিতে কাটা পড়ার আগের
মুহূর্তে একটা মাছের চোখ একবার দেখতে পেয়েছিল সম্বিত। নিজের মৃত্যুকে সামনে দেখতে
পাওয়া চোখ।
এই মুহূর্তে লোকটার ঠিকরে
বেরিয়ে আসা চোখদুটো অবিকল সেই মাছটার চোখের মতো দেখাচ্ছে। লোকটাও নিজের মরণ দেখতে
পেয়েছে। লোকটার গলার ভেতর থেকে অদ্ভুত গোঁগোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে। লোকটার টাকমাথা
ক্রমশ নেমে আসছে, লোকটার শরীরটা ভেতর দিকে মুচড়ে গেছে, লোকটার হাতদুটো পেটের কাছে
ক্যাচ লোফার ভঙ্গিতে জড়ো করা। মুঠোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একটা ছুরির কাঠের
হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলটা অনুরাধার হাতে ধরা। অনুরাধাও অবিকল লোকটার ভঙ্গিতেই
সামান্য ঝুঁকে আছে, অনুরও চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। অনুও মৃত্যু দেখতে পেয়েছে, তবে
নিজের নয়।
চোখের কোণ দিয়ে আরও
একটা জিনিস দেখতে পেল সম্বিত। ডাইনিং রুমের হাওয়ায় কী সব উড়তে শুরু করেছে। খোলা
জানালা দিয়ে ঝরা পাতা ঢুকে এসেছে নাকি? কিন্তু পাতা ঝরার সিজন তো এটা নয়। না, পাতা
নয়। নোট। হাজার টাকার নোট। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে সম্বিত-অনুরাধার ডাইনিং রুমে।
উড়ে উড়ে কোনওটা সিলিং ফ্যানের দিকে চলে যাচ্ছে, কোনওটা গিয়ে সেঁটে যাচ্ছে দেওয়ালে
টাঙানো সম্বিত অনুরাধা মিষ্টুর ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফের কাঁচে, আর অনেকগুলো নোট ঝাঁক
বেঁধে গোল হয়ে ঘুরছে অনুরাধার মাথার ওপর। জ্যোতির্বলয়ের মতো লাগছে দেখতে। নোটগুলো
ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিচের দিকে, ঘিরে ধরছে অনুকে, অনুর চোখের সামনে নাচছে, অনুর
ছুরি ধরা হাত ছুঁয়ে আদর করছে।
ছুরিটা বার করে আনল
অনু। ঢোকালো। বার করে আনল। ঢোকালো। লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে এখন, লোকটার গলা থেকে
আর কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। লোকটা এখন আর মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে নেই। লোকটার দৃষ্টি
এখন সোজা সম্বিতের দিকে।
ঘোর কেটে যাওয়ার পর সম্বিতের
প্রথম চিন্তা হল লাশটাকে নিয়ে। গাড়ি করে দূরে কোথাও গিয়ে ফেলে আসা ছাড়া উপায় নেই।
কোথায়, কত দূরে ফেলবে? আজ দুপুরে যেখানে গিয়েছিল, সেখানে? ফাঁকা মাঠ এখনও আছে
ওদিকে, বডিটা ফেলে গাড়িটা ক্লিনিং-এ দিয়ে আসবে যাতে চিহ্ন না থাকে। গ্যারেজের লোক
সন্দেহ করলে টাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করবে। লোকটা যে এ বাড়িতে এসেছে তার কোনও
প্রমাণ আছে কি? এজেন্সির লোক হলে তো নির্ঘাত আছে। লোকটা কী করে এসেছিল? নিজের
বাইকে? সে বাইকটা নিয়ে কী করবে সম্বিত? কাকে কাকে টাকা দেবে? কত টাকা দেবে সম্বিত?
বাথরুম থেকে একগাদা
বোতল নিয়ে বেরিয়ে এল সম্বিত। ফিনাইল, ব্লিচ, যা হাতের কাছে পেয়ে নিয়ে এসেছে। রক্ত
পরিষ্কার করতে হবে। অনু হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘর থেকে নোট কুড়োচ্ছে। লোকটাকে মোড়ার
জন্য একটা বড় প্লাস্টিক চাই।
“অনু, অনু, আমাকে
সাহায্য কর অনু। বডিটাকে ভালো করে মুড়তে হবে।”
অনু দু’হাত ভরে টাকা
নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পাগলের মতো হাসছে অনুরাধা। “কত টাকা দেখেছ সম্বিত? লাখ হবে না?
নাকি আরও বেশি?” অনুর মুখ জ্বলজ্বল করছে। সুখ ঝরে পড়ছে অনুর সর্বাঙ্গ দিয়ে। অনেক
বছর আগে যেমন পড়ত। সম্বিতের একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে অনু। অনেক বছর আগে যেমন
দাঁড়াত।
“আমরা বড়লোক হয়ে
যাব, সোনা! পাশের বাড়িতে বিশ্বাস কাকিমা একা আছেন। চল যাই। না না, তোমার কোনও কথা
আমি শুনব না। সেলফিশ হয়ো না সম্বিত। আমার কথা একবার ভাবো। মিষ্টুর কথা ভাবো,
সম্বিত। মিষ্টু! হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি কাকিমা একা আছেন, ওরা কেউ অফিস থেকে ফেরেনি
এখনও, আর ওদের কাজের মেয়েটা আসছে না এখন। চল যাই শিগগিরি। আমাদের কোনও কষ্ট থাকবে
না, সম্বিত। মিষ্টুর কোনও কষ্ট থাকবে না। একবার ভাবো সম্বিত।”
টেবিলের ওপর রাখা
কেটলিটা সম্মতি হিসেবে একখানা পাঁচশো টাকার নোট উগরে দিল।
সাংঘাতিক...অনুবাদ টা খুব ভাল হয়েছে
ReplyDeleteধন্যবাদ, সঙ্গীতা।
Deleteki bhoyonkor golpo... bhalo laglo.. accha Kuntala di tumi ei anubaad kora golpo gulo niye boi ber korte paro..
ReplyDeleteআইডিয়াটা মাথায় রাখলাম, ঊর্মি। থ্যাংক ইউ।
Deleteবাবা রে, ভয়ংকর গল্প!! অমি মূল গল্পটা পড়িনি, অনুবাদ পড়েই গায়ে কাঁটা দিল। অসাধারণ হয়েছে লেখাটা। কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ!
ReplyDelete- রম্যাণি
হাহা, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, রম্যাণি।
DeleteEkhuni originalta pore phellamm....and I liked your version better!
ReplyDeleteহাহা অর্পণ্, আস্তে বল, এক্ষুনি সবাই বলবে মায়েদের কলেজতুতো বন্ধুত্বের ল্যাজ ধরে পার্শিয়ালিটি করছে দেখেছিস কেমন?
Deleteআমি অবশ্য সে সব কিছু বলছি না। আমি তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করলাম আর নুয়ে পড়ে একগাদা থ্যাংক ইউ জানালাম।
amio originalta porlam..amaro satti torta beshi bhalo laglo!! darun darun :)
ReplyDeleteতোর কথা আরও কেউ বিশ্বাস করবে না, তিন্নি। এক আমি ছাড়া। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
DeleteBhoyonkor golpo. Tar thekeo bhoyonkor golper choritro der lobh ta.
ReplyDeleteযা বলেছিস, ভট্টা। লোভ ব্যাপারটা যে কী বিশ্রী, কী বিশ্রী, সেটা আমাদের বেশিরভাগ সময়েই মাথায় থাকে না, এই সমস্ত গল্প পড়লে মনে পড়ে যায়।
Deletebhoyonkor !!! ami asol golpo ta porini tabe tomar ei anubad pore ekdom chilling feeling holo...Bratati.
ReplyDeleteভেরি গুড, ব্রততী। তোমার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।
Deleteshanghatik :O ...chomotkar anubad--Pradipta
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রদীপ্তা।
Deleteস্বীকার করতে বাধা নেই, প্রত্যেক বার তোমার অনুবাদ গল্প পড়ার পরে খুঁজে খুঁজে মূল গল্পটাও পড়ি। বোধহয় তোমার লেখাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারতাম না। কি জানি? আসলটা পড়লে যদি আরও ভালো লাগে! এই প্রথম তোমার অনুবাদ পড়ে মূল গল্পটা পড়তে ইচ্ছেই করলো না। আমি নিশ্চিত যে আসলটা এর থেকে ভালো হতে পারে না। মূল আইডিয়াটা দুর্দান্ত, তবে তোমার লেখা তার সবটুকু রস নিংড়ে নিয়েছে। কোন অবিচার করেনি। দারুণ। আর ধন্যবাদ ও, কারণ এরকম ভালো একটা গল্প অপঠিত থেকে যেত তুমি অনুবাদ না করলে।
ReplyDeleteআরে চন্দ্রচূড়, অনুবাদে ফণিমনসার অবদানের কথা কিন্তু ভুললে চলবে না। গল্পটা ভালো না? আমার মাথায় কবে যে আইডিয়া আসবে ভগবান জানে। যাই হোক, অনুবাদটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
Deleteওটা ছিলো পাঠকের দাবী। অবদান নয়। :)
DeleteOre baap re, ki bhoyanok golpo. Darun hoyeche.
ReplyDeleteভয়ানক বলে ভয়ানক, ঘনাদা। অনুবাদ পছন্দ হয়েছে জেনে খুশি হলাম।
Deletedarun hoyeche bhai. Too good
ReplyDeletemithu
থ্যাংক ইউ, মিঠু।
Deleteঅনুবাদটি বেশ। শেষ পর্যন্ত টানটান ব্যাপার টা সুন্দর ধরে রাখা গেছে। ভালো লাগল পড়ে।
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ, সোমনাথ। আমারও খুব ভালো লাগল।
Deleteanubad ta porlam...r tarporei mul golpota....porar por anubad er theke mul ta ekebare panse laglo.. tumi golpotake jebhabe flesh out korechho tate onubad ta porte porte bhoy er aboho r atonkota aro onek beshi futechhey...
ReplyDeleteধন্যবাদ, ধন্যবাদ, চুপকথা। ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।
DeleteOsadharon !!!! ek niswase pore gelam purota. tomar onubad er kono tulona hoina. tobe sanghatik ekkhana galpo.... ki marattok.
ReplyDeleteধন্যবাদ, ইচ্ছাডানা। গল্পটা খুবই মারাত্মক।
Deleteবাবা গো!
ReplyDeleteআমারও গল্পটা পড়ে ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই হয়েছিল, অদিতি।
Deleteবাহ, বেড়ে হয়েছে। তোমার গপ্পটা পড়ে ম্যাড়মেড়ে দিনটা ইন্টারেস্টিং হয়ে গেল।
ReplyDeleteমূল গল্পটা পড়া হয় নি, সেটাও চেষ্টা করব পড়ে ফেলতে। যদি না পেরে উঠি, তাহলেও আফশোষ থাকবে না।
ব্রেজিলের কালো বাঘ ও তো কোনোদিন আসলটা পড়ি নি।
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, অনির্বাণ।
Deleteতোমার ভাবানুবাদ এর জুরি নেই। সত্যি অত্যন্ত শক্তিশালী কলম, আমরা অবান্তর এর পাঠককুল দারুন লাকি :) আরেকজন তোমার অনুবাদ করা গল্পের বই বার করার প্রস্তাব দিয়েছেন, ভেবে দেখতে পার, দারুন প্রস্তাব, ইদনিং কালে বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য কিন্তু তেমন জোরদার নয়, অনেক পাঠকের ইচ্ছে পূর্ণ হবে।
ReplyDeleteলাক ব্যাপারটা পুরোটাই আমার/অবান্তরের তরফে, কাকলি। এত ভালো পাঠককুল পাওয়া সোজা নয়। অনুবাদটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Deletekhuub bhalo laglo. Ami original golpo ta aage porechi. Tai naam ta dekhe khub utsaho niye porte shuru korechilam. Shotti anubaad ta beshi bhalo laglo. Darun hoyeche.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, নীলাঞ্জনা।
DeleteKi darun anubaad, oi banglay lekha biliti atmoshphere motei mon tanto na... arokom anubad porle mul golpo na porleo kono afsos thakbe na.. tobe ekta kotha bhabchhi, ebar theke karur bari jabar age bhabbo jodi tar kachhe erokom kono kettle thake !! takar lobh boro sanghatik ! :Papiya
ReplyDeleteসেটাই আশ্বাসের কথা, পাপিয়া। টাকা দেওয়া কেটলি বাস্তবে হয় না। অনুবাদটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। ধন্যবাদ।
Deletesottie ... manusher lov, epitome tao marattwok.. aboddho ekta ketli. amar mul rochona ta porte echhe korchhe.
ReplyDeleteporar somoy e pai na.. khub baje lage
oh ho ... dhonnyobaad
ReplyDeleteআহা আবার ধন্যবাদ কীসের জন্য, হীরক। অবান্তর যে পড়ার টাইম হয় না, সে জন্যও বাজে লাগার কোনও কারণ নেই। কাজ সেরে সময় পেলে তবেই পোড়ো। অবান্তর যতক্ষণ অকাজ, ততক্ষণই মজা। আমারও, তোমাদেরও। কাজের জায়গা নিতে গেলেই সব মাটিং চকার।
Deleteমূল গল্পটা এখানে পড়তে পাবে
http://www.eastoftheweb.com/short-stories/UBooks/BrasTeap.shtml
কী সাংঘাতিক! ভর দুপুরে গল্পটা পড়ে সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম।
ReplyDeleteদারুণ লিখেছেন কুন্তলা, টুপি খুলে সেলাম জানাই। :)
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, অরিজিত। আমি লিখিনি ঠিক, আমি লেখকের ওপর বাটপাড়ি করেছি। তবু আপনার সেলাম মাথা পেতে নিলাম।
Deleteore baba..ki galpo guru..puro nashto to ..full nashto..cinema hoa uchit..jomkalo ekta thrlier..
ReplyDeleteএই গল্পটা নিয়ে একটা সিনেমা হচ্ছে/ হয়েছে, আপনি ঠিকই বলেছেন, গল্পটা খুব সিনেমার মতো।
Delete