যোগদিবসে কাবুলভ্রমণ
বছরের মাঝখানে পৌঁছে আমার বিবেক জেগে উঠেছে। আমার
এককালের প্রাতর্ভ্রমণের অভ্যেস, অব্যবহারে অযত্নে যা প্রায় বিস্মৃত হয়েছিল, তাকে
আবার ঝেড়েঝুড়ে রোজকার জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তাতে সারাদিন বেশি এনার্জি,
সকালবেলার মুক্তবায়ু সেবন (এটা অবশ্য বিতর্কযোগ্য। দিল্লির বায়ু সেবন করার থেকে
বর্জন করাই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো বলেন কেউ কেউ।) আরও যা যা প্রত্যাশিত উপকার
হওয়ার ছিল সে সব তো হয়েছেই সঙ্গে সঙ্গে কিছু অপ্রত্যাশিত উপকারও হয়েছে। এক, পাড়ার
সবক’টি কুকুরবেড়ালকে আমি আলাদা আলাদা করে চিনতে শিখেছি। বাদামি, কালো, ডোরাকাটা,
সাদা, রোগা, মোটা তো বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু কে শান্ত, কে দুষ্টু, কে বাধ্য
বা বদমাশ সে সবও এ ক’দিনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আমার হাঁটার রুটে এক পশুপ্রেমী
ভদ্রলোকের বাড়ি পড়ে। ভোর না হতেই তাঁর বাড়ির সামনে চারপেয়েদের মেলা বসে যায়। ওই
জায়গাটা আমি আজকাল একটু আস্তে হাঁটি। প্রথমত, সাবধানতার খাতিরে। দ্বিতীয়ত,
পশুচরিত্র পর্যবেক্ষণ করার লোভে। আগে আমি ভাবতাম কুকুর বেড়াল ইত্যাদি প্রজাতিগত
পার্থক্য বাদ দিলে সব চারপেয়েই আসলে একই রকম। ঘুম পেলে ঘুমোয়, ক্ষিদে পেলে খায়।
এখন দেখছি তাদের স্বভাবচরিত্র রীতিমত আলাদা। ওই ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে নিয়মিত দুই
বেড়াল হাজিরা দেয়। তাদের নাক চোখ মুখ গায়ের দাগের বিন্যাস সব হুবহু এক। কিন্তু
একজন খালি ল্যাজ আকাশের দিকে তুলে ভদ্রলোকের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে কাল্পনিক চার
লেখার মতো করে ঘোরে আর অন্যজন রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ে লাফ দিয়ে দিয়ে প্রজাপতি ধরার
চেষ্টা করে বেড়ায়।
সকালে হাঁটতে বেরোনোর দ্বিতীয় উপকারটা একেবারেই
সাংসারিক। সফল-এর দোকানে ওই সময় লরি ভর্তি হয়ে নতুন জোগান আসে। একেবারে টাটকাতাজা তরিতরকারি,
শাকপাতা, ফলমূল। সারা পাড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমিও হেঁটে ফেরার পথে মাঝেসাঝে যাই। আলুপটল
নয়, আমার চোখ থাকে পুদিনার দিকে। ঘন সবুজ পাতাগুলোর ওপর সদ্য ছেটানো জলের ফোঁটা
চিকচিক করে। একগোছা পুদিনা কিনে দোলাতে দোলাতে বাড়ি আসি। চায়ে দিয়ে খাই।
অর্চিষ্মানকেও সাধি। ও বলে, “রক্ষে কর বাবা, অত স্বাস্থ্যকর চায়ে আমার কাজ নেই,
আমার দুধচিনিই ভালো।”
রবিবার সকালে মেলা গ্রাউন্ডের মাঠে পৌঁছে চোখ কপালে
উঠল। মাঠের এক কোণে সাদা রঙের কাপড়ে
মোড়া উঁচু মঞ্চ, তার সামনে লাল রঙের কার্পেট বিছোনো। কার্পেট জুড়ে লাইন দিয়ে
বাচ্চাকাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্চের একপাশে তিনচারজন মোটা মোটা পুরুষমহিলা বসে
আছেন। আর ঠিক মাঝখানে সাদা পায়জামা আর ও গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা এক লিকপিকে ভদ্রলোক পি.
টি.-র ভঙ্গিতে একবার দু’হাত কানের ওপর তুলছেন, একবার দু’পাশে ছড়াচ্ছেন আর জমায়েত বচ্চেলোগকেও
সে সব করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এদিকসেদিক দুয়েকজন হাস্যকর রকমের ঢোলা খাকি
প্যান্ট আর সাদা জামা পরে গম্ভীর মুখে ঘোরাফেরা করছে।
অমনি মনে পড়ে গেল। আজ তো বিশ্ব যোগ দিবস! এমন
গুরুত্বপূর্ণ দিনটা আমি ভুললাম কী করে! এই দিনটা মনে রাখানোর জন্য গত একসপ্তাহ ধরে
ঘণ্টায় তিনটে করে এস এম এস আসছে। সংগীত বাংলায় ‘বাওয়াল’ আর ‘জামাই চারশো বিশ’
সিনেমার গানের ফাঁকে ফাঁকে অভিনেতারা, যাঁরা এতক্ষণ “ঢিচক্যাঁও ঢিচক্যাঁও” গানের
সঙ্গে (আমি বানিয়ে বলছি না, সত্যি সত্যিই গানের কথা “ঢিচক্যাঁও ঢিচক্যাঁও”) নেচে
ফাটিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা ভয়ানক সিরিয়াস মুখ করে এসে বলছেন, “সবাই ইয়োগা করুন। ইট ইস
সোওওও গুড ফর স্ট্রেস।”
আমার হাঁটা চলতে লাগল। এক পাক ঘুরে এসে দেখলাম হাত পা
নাড়া শেষ, ভদ্রলোক এখন দু’হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে হাফ সিটিং-এ বসেছেন। পরের পাক সেরে
এসে দেখলাম ভদ্রলোক পদ্মাসনে বসে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। পরের পাক সেরে এসে
আঁতকে উঠলাম। ভদ্রলোকের দুই পা এবার তাঁর ঘাড়ের পেছনে এসে উঠেছে। বচ্চেলোগ আর
তাঁকে অনুসরণ করার কোনও চেষ্টা করছে না, ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে আছে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। ওই যে আসনটার কথা বললাম
হঠযোগের গোটা সিলেবাসের মধ্যে ওইটাই অর্চিষ্মানের প্রিয়তম আসন। নিজে করার জন্য নয়
অবশ্যই। আমি যখন সাড়ে তিন মাস বাদে বাদে একদিন বসার ঘরের মেঝেতে যোগব্যায়াম করতে নামি (আপনারা
কী ভেবেছিলেন, শুধু চানাচুর খাওয়াতেই আমার প্রতিভার শুরু আর শেষ?) তখন অর্চিষ্মান
খুব বিরক্ত মুখ করে বলে, “ধুস্ কী সব সোজা সোজা আসন করছ, ওই পা তুলে ঘাড়ের পেছনে
নেওয়ার ব্যায়ামটা যদি করতে পার, তবে বুঝি।”
ভদ্রলোক তার পরেও আরও কোনও কঠিনতর আসন করেছিলেন কি না
জানি না, কারণ আমার বরাদ্দ পাক শেষ হয়ে গিয়েছিল। মাঠ থেকে বেরিয়েই দেখি পাঁচিল ঘেঁষে বাঁশ পোতা সারা। এখন
সেটা ঘিরে ব্যানার পেঁচানো চলছে। ব্যানারের গায়ে রংচঙে শিশিবোতলের ছবির ওপর বড় বড়
করে লেখা ‘গুরুকুল আয়ুর্বেদ ফার্মেসি’।
আমি পুদিনা কিনে বাড়ি চলে এলাম। চা করে অর্চিষ্মানকে
ঠেলা দিয়ে তুলে মেলাগ্রাউন্ডের ব্যাপারস্যাপার ফলাও করে বলতে বলতেই দেখি বন্ধ
জানালার বাইরে বাড়িওয়ালার সজনে গাছটা মাতালের মতো দুলতে শুরু করেছে। দৌড়ে দরজা
খুলে বারান্দায় বেরোলাম। কী ঝড়!
কী ঝড়! আমাদের বাড়ির পেছনের গলিটার ধুলোগুলো সব পাক খেয়ে উড়তে লাগল, উল্টোদিকের
বাড়ির ভদ্রমহিলা অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ছাদে উঠে দড়িতে ঝোলানো জামাকাপড় টেনে টেনে নামাতে
থাকলেন।। আমাদের বারান্দায় দিবারাত্র শুয়ে
রোদ পোয়ানো বেড়ালটার দুটো বাচ্চা হয়েছে, তারা সারাদিন দৌড়োদৌড়ি করে খেলে আর আমাদের
কাউকে আসতে দেখলেই এমন ধড়ফড় করে ল্যাজ তুলে পালায় যেন আমরা পেশাদার বেড়াল-কিলার। বেশিদূর
যায় না আবার, দেওয়ালের আড়াল থেকে মুণ্ডু বার করে দেখে আমরা আছি না গেছি। সেই
বাচ্চাদুটো খেলা ফেলে বারান্দার তলায় উদাস মুখে বসে থাকা মায়ের কোলে এসে সেঁধোলো। গলি
দিয়ে এক ভদ্রমহিলা এক বাড়ির কাজ সেরে অন্য বাড়ি যাচ্ছিলেন, তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে
নাকমুখ ঢেকে খুব আস্তে আস্তে পায়চারি করার ভঙ্গিতে হেঁটে চললেন। কাজের মাঝে যতখানি হাওয়া খেয়ে নেওয়া যায়।
এইসব দৃশ্যাবলোকন করতে করতে আমরা ভাবতে লাগলাম মাঠের
যোগসম্মেলনের কী হল? গুরুকুল ফার্মেসির চালা কি উড়ে গেল? বচ্চেলোগ কি ছত্রভঙ্গ হয়ে
ছুটে পালাল? এমন সময় প্রকাণ্ড ফোঁটায় চড়বড় করে বৃষ্টি নামল।
আর ঠিক তখনই কাবুল ঘুরতে যাওয়ার কথাটা আমাদের মাথায়
এল।
কাবুল?! ভিসা নেই, পাসপোর্ট নেই, কাবুল যাব মানে? এ
কি জয়পুর পেয়েছি যে হোস্টেলে সারারাত আড্ডা মেরে চারটের সময় মনস্থির করে পাঁচটার
বাস ধরে চলে যাব? তাও যাওয়ার আগে হাওয়াই চটি ছেড়ে জুতো পরতে গিয়েছিলাম বলে পরের
ছ’মাস সবার ঠাট্টার পাত্র হতে হবে?
আর ছ’মাস বাদে পঁয়ত্রিশ হবে, হাওয়াই চটি পরে জয়পুর তো
দূরস্থান, চুল না আঁচড়ে দু’নম্বর মার্কেটেও আর যেতে পারি না। কাবুল তো ছেড়েই
দিলাম।
তবে?
তবে আর কিছুই না। এক পাড়াতে পাঁচটা বাপি থাকতে পারে
আর এক পৃথিবীতে একটার বেশি কাবুল থাকতে নেই বুঝি? আমরা যে কাবুলে যাওয়ার প্ল্যান
করলাম সে ছিল আমাদের হাতের কাছেই। সেখানে যেতে ভিসা লাগে না, পাসপোর্ট লাগে না,
অটোতে মোটে ষাট টাকা ওঠে। (যদি
অবশ্য অটো ভাইসাব মিটারে যেতে রাজি থাকেন।)
দিল্লির লোকেরা এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছেন আমি কোন
জায়গার কথা বলছি। লাজপত নগর।
সি আর পার্কে যেমন বাঙালিদের, লাজপত নগরে তেমনি আফগানিদের
বাড়বাড়ন্ত অনেকদিনের। কবে প্রথম তাঁরা লাজপত নগরে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিলেন সে সব
সনতারিখ ঐতিহাসিকরা বলতে পারবেন। আমি শুধু জানি লাজপত নগরের অলিতেগলিতে তাঁরা ক্রমেই
জাঁকিয়ে বসছেন। এতই জাঁকিয়ে বসছেন যে পুরোনো পাঞ্জাবি অধিবাসীরা মুখ গোমড়া করে
বলছেন, “আমরাই তো এখানে সংখ্যালঘু এখন, লাজপত নগর নাম বদলে আফগান নগর করে দিলেই হয়।”
সবাই যে স্থায়ী বাসিন্দা তেমন নয় কিন্তু। অস্থায়ী
অতিথিও আছেন প্রচুর। প্রচুর আফগান ছাত্র আজকাল দিল্লিতে পড়তে আসেন। তাঁদের থেকেও
বেশি সংখ্যায় আসেন আফগান রোগীরা। বলাই বাহুল্য, তাঁরা এসে ভাইবেরাদরের কাছেই থাকতে
চান। তাছাড়া সাকেতের ম্যাক্স হাসপাতাল আর মূলচন্দ মেডসিটির হাতের নাগালে হওয়াটাও নাকি
আফগান রোগীদের কাছে লাজপত নগরের দর বাড়ার একটা কারণ।
আর থাকা মানেই খাওয়া। বিদেশে গিয়ে সে দেশের রান্নাবান্না চেখে দেখার বিলাসিতা শখের ঘুরিয়েদের পোষায়। যারা পড়তে এসেছে কিংবা অসুখ সারাতে কিংবা হয়তো ভিটেমাটির পাট চুকিয়ে এসেছে চিরজন্মের মতো, তাদের নিজেদের দেশের খাবার খেতে ইচ্ছে করে। লাজপত নগরের গলিতে গলিতে শের-ই-পাঞ্জাব আর পিণ্ড বালুচ্চির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলেছে আফগানি খাবারের দোকান। সে রকমই একটা দোকান হল কাবুল দিল্লি।
জি পি এস যেখানে গিয়ে বলল “ইউ হ্যাভ অ্যারাইভড”, যথারীতি
সেখানে গিয়ে আমরা কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। ঘাবড়াইনি অবশ্য। চোখের সামনে আফগান দরবার
জ্বলজ্বল করছে, কাবুল দিল্লি না পেলে সেখানেই ঢুকে যাব। একটা ওষুধের দোকানের সামনে
মাথায় পাগড়ি বাঁধা এক কিশোর সর্দারজী একাগ্রচিত্তে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি আর লোক না পেয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “কাবুল দিল্লি কাঁহা হ্যায় পাতা হ্যায়?”
সে ছেলে ফোন থেকে মুখ তুলে একবার আমার দিকে, একবার ওষুধের দোকানের বোর্ডটার দিকে
তাকিয়ে বলল, “ইয়ে তো নেহি হ্যায়।”
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। আমার মুখ দেখে ছেলেটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুটো সিঁড়ি উঠে গিয়ে দোকানের দরজাটা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা
করল, “ইয়ে কাবুল দিল্লি হ্যায় কেয়া?”
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুখ আরও বড় হাঁ করে অর্চিষ্মানের
দিকে তাকালাম, অর্চিষ্মান দাঁত বার করল যেন খুব হাসির ব্যাপার কিছু হয়েছে। দোকানের ভেতর থেকে কেউ একজন মুহ্তোড় জবাব কিছু দিলেন বোধহয়
কারণ ছেলেটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসল। তারপর ভেতর থেকে আরও কিছু একটা নির্দেশ এল
আর ছেলেটা গলির ভেতর দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাদের বলল, “ম্যাডাম, উধার চলে যাইয়ে।”
উধারপানে দশ পা যেতেই দেখলাম কাবুল দিল্লি রেস্টোর্যান্ট।
রেস্টোর্যান্টের টি আর ইউ-র পরের এ টার রং চটে গেছে। জোম্যাটোর ছবিতেও ঠিক এই
রকমই দেখেছিলাম! যাক বাবা, অথেনটিক কাবুল দিল্লিতে এসে পড়েছি।
কাবুল দিল্লি বেশ মনোরম রেস্টোর্যান্ট। দু’জন খাইয়ের
পাশাপাশি আরাম করে বসতে পারার মতো গদি আঁটা মুখোমুখি দুটি সোফার মাঝে একটি করে
টেবিল। দুটি বসার জায়গার মধ্যে কলকার কাজ করা কাঠের উঁচু দেওয়াল। আমাদের টেবিলের
আড়াআড়ি টেবিলের পাশের দেওয়ালে একজন আফগান বড়মানুষের চিত্র ঝুলছিল। আমি তখন নামটা
মুখস্থ করে নিয়েছিলাম কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না। সেই টেবিলে একজন একলা খাইয়ে
বসেছিলেন। তাঁর এক চোখে মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভদ্রলোকের বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছিল
কারণ তিনি মাঝে মাঝেই মাথা টেবিলে নামিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বেশি খেতেও পারলেন না
মনে হল। খালি বড় এক টি-পট ভর্তি চা নিলেন আর এক প্লেট কাবাব। সেটাই ধীরে ধীরে
খেলেন অনেক সময় নিয়ে।
আমরা অবশ্য প্রাণ ভরে খেলাম। দু’রকমের কাবাব, একরকমের
মাটন পোলাও। পোলাওয়ের সঙ্গে একটা ঝোলওয়ালা পদও অর্ডার করব ভেবেছিলাম, বিশেষ করে মেনুতে
ইয়াখ্নি দেখে মন নেচে উঠেছিল, কিন্তু শেষমেশ করিনি। ভাগ্যিস করিনি, কারণ ওই খাবার
শেষ করতেই আমাদের প্রাণ বেরোনোর দশা হয়েছিল।
আফগানি খাবার খুবই আমিষকেন্দ্রিক কিন্তু বেশি মশলাদার
নয়। এই যেমন কাবুল উজবেগি পোলাওয়ের কথাই ধরা যাক। আকারআকৃতিতে আমাদের বিরিয়ানির
মতোই, কিন্তু স্বাদেগন্ধে একেবারেই আমাদের বিরিয়ানির মতো নয়। অন্তত চারভাগের একভাগ
তেল দিয়ে বানানো, মশলাও নামমাত্র। তা বলে স্বাদে কোনও অংশে খাটো নয়। পার্সি দোকানে
বেরি পোলাও খেয়েছিলাম, তার সঙ্গে বেশ মিল আছে। তবে বেরি পোলাওয়ের থেকে অনেক বেশি সুগন্ধী। প্লেট এনে সামনে রাখা মাত্র সারা
টেবিল একেবারে ম’ ম’ করে উঠেছিল। গাজর, কিশমিশ আরও নানারকম ভালো ভালো জিনিস দিয়ে
তৈরি হয় এই পোলাও।
কিন্তু গাজর কিশমিশ যতই ভালো হোক না কেন, সেগুলো খেতে
তো যাইনি। প্লেটটা প্রথম দেখে গন্ধে অভিভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতংকও হয়েছিল।
মাংস কোথায় গো! ভেজিটেরিয়ান পোলাও দিয়ে গেল নাকি?
আহা, একটু দেখ আগে, ভাতের নিচে চাপা পড়ে গেছে হয়তো।
তাই বটে। চামচ দিয়ে ভাতের আড়াল খানিক সরাতেই তাঁরা
বেরিয়ে পড়লেন।
এই হচ্ছে গিয়ে জিগর কাবাব। বেসিক্যালি, আগুনে সেঁকা
মেটে। খাবার জিনিসের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কান, কানকো, মাথা, মগজ, কলজে, পাকস্থলী সবই
আমি খেতে পারি, অর্চিষ্মান আবার আলাপপরিচয় অত গভীরে নিয়ে যেতে পছন্দ করে না, “হ্যালো
ওয়াস্সাপ”-এই কাজ সারে। এই কাবাবটা মূলত আমার পছন্দের কথা ভেবেই অর্ডার করা
হয়েছিল। অর্চিষ্মান এক পিস খেয়ে “অ্যাঃ, গন্ধ” বলে আর ছোঁয়নি। আমার অবশ্য ভালোই
লেগেছে।
কিন্তু সেদিনের লাঞ্চের দিল, জান, জিগর যদি কিছু হয়ে
থাকে তবে তা আর কেউ নয়। সে এই চোপান কাবাব।
অন্য সব ভালো জিনিসের সংজ্ঞা যা, আমার মতে ভালো
খাবারের সংজ্ঞাও তাই। ভালো বন্ধু সে-ই যার সঙ্গে থেকে আপনি একটু ভালো হয়ে যান।
ভালো প্রতিযোগী সে-ই যাকে হিংসে করে আপনি নিজের কাজে ক্রমে ভালো থেকে ভালোতর হয়ে
ওঠেন।
চোপান কাবাব খেতে খেতে আপনিও ভালো মানুষ হয়ে উঠবেন।
আপনার বাচালতা কমে আসবে, দৃষ্টি মেদুর হবে, হৃদয় উদার হবে। মনে পড়ে যাবে, কতদিন
আপনি ঠাকুমাকে ফোন করেননি। শপথ নেবেন, আজ বাড়ি গিয়ে ঠাকুমার গলা না শুনে ক্যান্ডি
ক্রাশের চক্রব্যূহে পদার্পণ করবেন না। প্লেটের শেষ কাবাবটা তুলে নিতে গিয়ে ভাববেন,
নাঃ, আমি তো অনেক খেয়েছি, এটা ও খাক।
শেষ কাবাবটা নিয়ে তিনবার “তুমি খাও তুমি খাও” বলে একে
অপরের প্লেটে চালাচালি করার পর (সেটা সদ্যলব্ধ উদারতার কারণেও হতে পারে আবার আর
খেলে সত্যি সত্যি পেট ফেটে যাবে সেই আশংকাতেও হতে পারে) আমরা বিল আনতে বললাম।
খাওয়া শুরু করার আগে ডেসার্টে চা খাওয়ার যে পরিকল্পনাটা ছিল সেটা বাতিল করতে হল।
এখন সোজা বাড়ি গিয়ে প্রথমে খাটের ওপর দু’ঘণ্টা শবাসন, তারপর অন্য কথা।
সব অর্ডারের সঙ্গে আফগানি নান আর এক প্লেট রাজমা ফাউ
আসে। নানগুলো খুবই চমৎকার খেতে। নরম, ফুলকো। কিন্তু দুঃখের বিষয় পোলাওয়ের সঙ্গে
পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কাজেই আমরা দু’জনে খালি চেখে দেখার জন্য এক কামড়
এক কামড় করে খেয়েছিলাম, বাকি বাটি অধরা পড়েছিল। রাজমার প্লেটের দিকে তো তাকানোরও ফুরসৎ
পাইনি।
যুদ্ধ শেষ
কারা জিতেছে সেটা নিশ্চয় আর বলে দিতে হবে না
দিল্লিতে এত রকম খাবারের এত রকম দোকান যে খুব কম
দোকানে দ্বিতীয়বার যাওয়া হয়ে ওঠে। সেটা আমাদের একটা বড় আফসোস। কত
দোকানে খাবার খেয়ে উঠে আসার সময় বলাবলি করি, আবার আসব কিন্তু, আসবই। আর হয়ে ওঠে
না। মেঘালয় ভবনের ফিশ কাপ্পাটার কথা এখনও মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, ত্রিবেণী
কলাকেন্দ্রের ক্যান্টিনের ফিশফ্রাইটার কথাও। হাঁটু ধরে চারতলা সিঁড়ি ভেঙে পটবেলি
রুফটপ ক্যাফেতে উঠেছিলাম লিট্টি চোখা আর চম্পারণ মাটন খেতে। মেনুতে ম্যাগির রকমফের
দেখে চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল। ধামাকা ম্যাগি, কিমা ম্যাগি, ম্যাগি মাশরুম। যাব যাব করে
যাইনি, এখন তো ম্যাগি উঠেই গেল। শীতের সকালের রোদ পিঠে নিয়ে রোজ ক্যাফেতে বসে
দার্জিলিং চা আর পিটা চিপস খেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল অর্চিষ্মানকে চিমটি কেটে দেখি এই
পৃথিবীতেই আছি না স্বর্গে চলে গেছি। সেই স্বর্গেও আর ফিরে যাওয়ার সময় হয়নি। নতুন
একটা হিডেন জেম বেরিয়ে পড়েছে, কেউ ফোন করে খবর দিয়েছে, “ওই দোকানটায় যাসনি এখনও?
আর ইউ গাইস লিভিং আন্ডার রক অর হোয়াট?”
কাবুল দিল্লি-র সঙ্গেও সেরকমটাই ঘটবে হয়তো। এখন মনে
হচ্ছে খুব শিগগিরি যাব, যাবই। চোপান কাবাবের টান এড়িয়ে থাকব কী করে? সে টান সময়ে
কমে আসবে। কিন্তু আমরা যদি আর না-ও যেতে পারি, আপনারা, যারা কাছেপিঠে থাকেন, মাংস
খেতে ভালোবাসেন, তাঁরা অবশ্য করে যাবেন। আমি কথা দিচ্ছি, পস্তাবেন না।
*****
Kabul Delhi Restaurant
E 104, Ground Floor, Near Central Market, Lajpat
Nagar 2, New Delhi
011 29824782, +91 7838978899
Aha! Sune ar dekhei bhalo laglo!
ReplyDeleteখেলে আরও ভালো লাগবে, রুণা। একদিন ঘুরে এসো।
Deleteচমৎকার লেখা
ReplyDeleteধন্যবাদ, সোমনাথ।
DeleteNah ... ebaar Dilli shift korar kotha bhabte hobe. Eto bhalo bhalo khawar jayega ki ek visit toh charo, ek jomme o shesh kora jabe? :-)
ReplyDeleteশিফট করবে কেন, শর্মিলা, বালাই ষাট? গরমে পুড়তে আর শীতে জমতে? আমিই বরং ভাবছি তোমাদের স্বর্গের মতো পুনেতে গিয়ে থাকি। তার থেকে বেড়াতে এসে খাবারদাবার চেখে চলে যেও।
Deleteলেখাটা বেড়ে। ইরানের দিন গুল মনে পড়ল।
ReplyDeleteচা এর সাথে পুদিনা? চাপুদিনা খেলে কি দুধ থাকবে না লিকার ভাবতে পারলাম না। অনেক রকম চা ই ত খাই, এটা জানার ইচ্ছা রইল।
আপনি ইরানে ছিলেন বুঝি, শুভাশিস? নিশ্চয়ই অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে?
Deleteআরে পুদিনা চা খুবই সাধারণ ব্যাপার। দুধ থাকবে না। লিকার চায়ে একটা পুদিনার পাতা ফেলে দেবেন। ইচ্ছে হলে লেবু চিপে দিতে পারেন, তাহলে লেমন মিন্ট টি হয়ে যাবে, না হলে শুধু মিন্ট টি। ওই একটু মুখবদল আর কি।
ei pudinapata r byaparta ekbar kaje lagie dekhte hochhe. chhobigulo dekhlei oikhane khete jete ichhe korchhe, kintu "Delhi bohut dur hai .." :-( .
ReplyDeleteআরে কলকাতাতেও নিশ্চয় আছে ভালো ভালো খাবার জায়গা, ইচ্ছাডানা। তাছাড়া আপনার গন্ধরাজ চিকেন দেখার পর আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে আপনি বাড়িতেও ভালো ভালো খাবার খান। আমরা তো বাড়িতে স্রেফ টক ডাল আর কলমি শাক, তাই বাইরে এত ঘন ঘন খাই।
DeleteMukhe to afgan joyer hashi!!
ReplyDeleteযা বলেছিস, তিন্নি।
DeleteTor toh furtir pran gorer math re..... Hebby moja toh... Darun darun khacchis... Ar lobh lagano description ar photo dicchis...
ReplyDeleteAto baire kheyeo tui ki sundor ager motoi slim trim achis re... Ami toh kichu na kheyei fulchi , ato sundor khele toh ar dekhte hoto na...
Morning walk er upokarita ta darun describe korli toh... Ta yoga dibos ta darun celebrate korli kintu...
হ্যাঁ, যোগ দিবস বেশ ফুর্তিতে কাটিয়েছিলাম, ভট্টা।
DeleteKi je lekhen, amar khidhe paye galo
ReplyDeleteবাঃ, এইটা শুনে সত্যি খুশি হলাম, ঘনাদা।
Deleteচোপান কাবাবের মানুষকে ভালো করে দেবার এমন গুন ! গুগল করে রেসিপি টা না দেখে পারলাম না! প্লাস দেখলাম চপান কাবাব নামের একটা আস্ত রেস্টুরেন্ট ও আছে ক্যালিফর্নিয়া তে - কি কান্ড।
ReplyDeleteহাহা, রেসিপি সার্চ করতে গিয়ে রেস্টোর্যান্টের নামটা আমিও দেখেছি, কাকলি। আমি তো নিশ্চিত, নিয়মিত চোপান কাবাব খেলে আমার পরনিন্দাপরচর্চা করার বদভ্যেসটা কেটে যাবে।
Deleteদারুণ ভ্রমণ । কবে যে যাই দেখি । আমার ব্লগে কাবুলের পোস্ট টা পড়ে দেখতে পারো , সময় পেলে ।
ReplyDeleteমিঠু
নিশ্চয় পড়ব, মিঠু।
Deleteas usual.. khub bhalo.. jog dibos er description ta ekghor... :D
ReplyDeleteধন্যবাদ, ঊর্মি।
Deletekodin jor tor niye kahil chhilam.. blog porleo comment kora hoyni.. kabul r yogasan combo ta darun laglo
ReplyDeleteসেকী, এখন ভালো আছ তো, চুপকথা? সেদিনটা সত্যি ভালো কেটেছিল।
Deletehaan ekhon better..asole viral fever r allergy r combo ta thik poshayni r ki :)
Deleteখুবই খারাপ কম্বো। যাক, এখন যে নিরাময় হচ্ছে সেটা ভালো খবর।
Delete