People Don’t Do Such Things
'I know, dear,' said Miss Marple, 'that your books are very clever. But do
you think that people are really so unpleasant as you make them out to be?'
'I mean,' said Miss Marple, puckering her brow a little as she counted the
stitches in her knitting, 'that so many people seem to me not to be either bad
or good, but simply, you know, very silly.'
এ বিষয়ে আমি মিস মার্পলের সঙ্গে একমত। আমি মনে করি না চোরডাকাতখুনিরা সব
একেকজন শয়তানের অবতার। (অবশ্য চোরডাকাতখুনিদের
সঙ্গে যে আমার খুব আলাপপরিচয় আছে তা নয়। এটাও প্রমাণ করে যে গল্পে এঁদের যত
সহজলভ্য হিসেবে প্রচার করা হয় এঁরা আসলে ততটাও নন। না হলে আমার এই আধবুড়ো বয়সে
একদু’জনের সঙ্গে দেখা হয়েই যেত।) আমার
বিশ্বাস তাঁরা সবাই আমাদেরই মতো দুটো
চোখ, দুটো কান, দুটো হাত, দুটো পাওয়ালা মানুষ। আমাদেরই মতো তাঁরা অটো চড়েন, ফুচকা
খান। শুধু কাম ক্রোধ লোভ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো তাঁদের আমাদের থেকে সামান্য বেশি আর
আত্মসংযম, পরিণতি সম্পর্কে চেতনা আমাদের থেকে সামান্য কম।
শেষ দৃশ্যে যখন অভিজিতের হাতের বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় এসে গালে পড়বে (মেয়ে
অপরাধী হলে অবশ্য অভিজিতের বদলে একজন মহিলা অফিসার চড়টা মারবেন) তখন সি আই ডি-র
ঘোর নীল রঙের দেওয়ালওয়ালা অফিসঘরে বসে এরা সবাই ভেউভেউ করে কেঁদে উঠে দু’হাত বুকের
কাছে জড়ো করে বলবেন, “গলতি হো গয়া সাব, অর কভি নেহি হোগা। মাফ কর দিজিয়ে।” আর আমি
নাইস বিস্কুট দিয়ে চা খেতে খেতে ভাবব, “যাক বাবা, ভালো লোকেরা জিতেছে, খারাপ
লোকেরা সব জেলে পচছে।
কিতনি শান্তি দুনিয়া মে।”
এই শান্তির আশায় থাকলে রুথ রেন্ডেলের (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০-২রা মে ২০১৫) গল্প পড়ে আপনি শান্তি পাবেন না। কারণ শেষ
সিনে দুষ্কৃতীর গালে চড় মারায় রুথের আগ্রহ নেই। তাঁর উদ্দেশ্য আরও গভীর। তাঁর
উদ্দেশ্য অপরাধীর মাথার ভেতর ঢোকা।
লোকটা কেন এ’রকম করল?
কেন মানুষটা অপরাধটা করল আদৌ? সে কি জানত না এর পরিণতি কী হতে পারে? নাকি জানা
সত্ত্বেও তার নিজেকে সংবরণ করার ক্ষমতা নেই? নাকি, এই সম্ভাবনাটা সবথেকে ভয়ংকর, সে
যেটা করেছে সেটাকে সে আদৌ অপরাধ মনে করে না? তার সংঘটিত অপরাধটা আসলে তার নিজের
মতো করে ন্যায়বিচার?
ক্লু নয়, রুথ রেন্ডেল সারাজীবন মানুষের মন নিয়ে ভেবেছেন। বিশেষ করে যে মানুষটি
অ্পরাধ করে, তার মন নিয়ে। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন সে কথা। সমকালীন আর একজন
দুঁদে অপরাধমূলক সাহিত্যিক পি ডি জেমস ছিলেন রুথের গভীর বন্ধু। পি ডি জেমসের
মৃত্যুর পর রুথ লিখেছিলেন “Both of us thought more about the characters than the crime.”
গত মাসের দু’তারিখে রুথ রেন্ডেল মারা গেছেন। পঁচাশি বছরের জীবনে পঞ্চাশেরও
বেশি অপরাধমূলক উপন্যাস লিখে রেখে গেছেন তিনি। আর সাতটি ছোটগল্প সংকলন। তাদের
মধ্যে একটি সংকলন The Fallen Curtain and Other Stories থেকে নেওয়া People Don’t Do Such
Things
গল্পটি আজ আমি অনুবাদের জন্য বেছে নিলাম।
*****
মূল গল্পঃ People Don’t Do Such Things
লেখকঃ Ruth Rendell
পিপ্ল্ ডোন্ট ডু সাচ থিংস!
খবরটা শোনার পর মুখার্জিদা বলেছিলেন। ইবসেনের লেখা হেডা গাবলার নাটকের শেষ
সংলাপটা নাকি এরকমই কিছু একটা ছিল। নায়িকার আত্মহত্যার খবর পেয়ে কেউ একজন উত্তেজিত
হয়ে বলছে, “বাট গুড গড! পিপল ডোন্ট ডু সাচ থিংস!”
আমি ইবসেনের নামটুকু ছাড়া আর কিছু জানি না। জানার আগ্রহও বোধ করিনি কোনও দিন। ইবসেন
তো দূরঅস্ত, আমি বিভূতিভূষণও পড়িনি। উঁহু, পথের পাঁচালীও না। বাড়িতে ছিল। সব
বাঙালি বাড়িতেই থাকে। আম আটির ভেঁপু নামে পথের পাঁচালীর যেটুকু অংশ সিলেবাসে ছিল শুধু সেটুকু পড়েছিলাম। সঙ্গে ছাত্রবন্ধু থেকে সারসংক্ষেপ
আর গোটা পনেরো প্রশ্নোত্তর। গোটা পথের পাঁচালী মুখস্থ করে ফেলা ছেলেদের থেকে বেশি
নম্বর পেয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষায়। আমার
কোনও আফসোস নেই।
শুনলে অনেকে অবাক হয়ে যায়। “পথের পাঁচালী পড়েননি কি মশাই, এত বড় পাবলিশিং হাউসে চাকরি করেন?” লোকে এই
রকমই। আমার এক মামাতো ভাই আকাশবাণীতে চাকরি করে, কোন এক কাজিনের বিয়েতে তার গলায়
বেসুরো গান শুনে সবার কি বিস্ময়। “সে কী রে, এই গলা নিয়ে রেডিওয় চাকরি পেলি কী
করে?”
শুধু সাহিত্যচর্চা করে যে একটা প্রকাশনা সংস্থা চলে না এটা অনেকেরই মাথায় থাকে
না। সে সব সংস্থাকেও বছর বছর অডিট জমা দিতে হয়, স্থায়ী কর্মচারীদের মাইনে, মেডিক্যাল
বিল, বিমার ব্যবস্থা করতে হয়। আর
পাঁচটা সরকারি বা বেসরকারি অফিসের সঙ্গে একটা পাবলিশিং হাউসের কোনও তফাৎই নেই।
আমি কলকাতার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ভালো মাইনে
পাই। গাড়িবাড়ি আছে। সুন্দরী, শিক্ষিতা বউ আছে।
সরি।
ছিল।
ছিল।
গার্গীর না থাকাটা এখনও আমার বিশ্বাস হয় না। এমনকি গার্গীর চলে যাওয়ার সময়টাও
আমি আজকাল মাঝে মাঝে ঠিক করে মনে করতে পারি না। মাথার ভেতরটা কেমন ঘুলিয়ে যায়।
সত্যি কি ঘটনাগুলো ঘটেছিল? নাকি আমি গোটাটাই কল্পনা করছি? পরমুহূর্তেই মনে পড়ে। নাঃ। গার্গী সত্যিই নেই। তার
সবথেকে বড় প্রমাণ হিসেবে প্রতিশ্রুতিমান বাংলা সাহিত্যিক শরণ্য বর্মণ, যাবজ্জীবন
জেল খাটছে। গার্গীকে, আমার স্ত্রীকে, খুন করার শাস্তি হিসেবে।
আই গেস, কখনও কখনও ট্রুথ রিয়েলি ইস স্ট্রেঞ্জার দ্যান দ্য ফিকশন।
অথচ আমার ক্ষেত্রে সে’রকমটা হওয়ার কথা ছিল না মোটেই। আমার জীবন ছিল এক্কেবারে
ছাঁচে ঢালা, সচ্ছল, আরামদায়ক। কোথাও কোনও ঝাঁকুনি ছিল না।
এক শরণ্যের উপস্থিতিটা ছাড়া। এখন ভাবলে মনে হয় পরবর্তী কালের সব ঘটনার থেকেও বেশি
আশ্চর্যের ছিল শরণ্যের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা। কী করে যে হল সেটা একটা রহস্য।
বন্ধুত্বের শুরুটা কবে হয়েছিল সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি
হচ্ছিল সেদিন। টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা শরণ্যের মাথার পেছনে খোলা জানালা দিয়ে
দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। শরণ্য যে আসবে সেটা জানা ছিল। সম্পাদক বলে রেখেছিলেন। ভ্যাংকুভারের
একটা রাইটিং ওয়ার্কশপ থেকে নেমন্তন্ন এসেছে শরণ্য বর্মণের। ভিসা নেওয়ার দিন পেরোয়
পেরোয়, এদিকে ট্যাক্স ডকুমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। “একটু দেখে দেবেন মিস্টার দত্ত।”
“ডকুমেন্ট ছাড়ুন, ট্যাক্স দিয়েছি কি না সে কথাটাই আমার মনে নেই।”
বলার সময় শরণ্যের নিখুঁত সাজানো ঝকঝকে দাঁতের সারি ঝলসে উঠেছিল। লেখার গুণাগুণ
বিচার হয়তো আমার দ্বারা সম্ভব নয়, তবে শরণ্য বর্মণের মতো সুপুরুষ লেখক বাংলা
সাহিত্যে এর আগে আসেনি সে কথা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। অনেকে বলেন সেই জন্যই
নাকি শরণ্যের ট্র্যাশ লেখাপত্তরও বাজারে চলত। চেহারা ভাঙিয়ে। “আমরা
সেক্স সিন লিখলে অশ্লীল, শরণ্য বর্মণ লিখলে সাহিত্য।” গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে
বলতেন অন্য লেখকরা। বিশেষ করে টাকমাথা, ভুঁড়িওয়ালা লেখকরা। সাহিত্যের দুনিয়াটা
ততদিনে বদলাতে শুরু করেছে। একসময় অনেক লেখককে লোকে মুখ দেখলে চিনতে পারত না।
দিব্যি তাঁরা ট্রেনে বাসে চেপে ঘুরে বেড়াতেন, অষ্টমীর রাতে বউছেলেমেয়ে নিয়ে ঠাকুর
দেখতে বেরোতেন। হয়তো একমাস আগে তাঁদের লেখার ভারেই পুজোবার্ষিকী হইহই করে বিক্রি
হয়েছে, কিন্তু ঠাকুর দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন দেখেও কেউ তাঁদের অটোগ্রাফ চেয়ে
বিরক্ত করেনি।
এখনকার লেখকদের ও’রকম অসূর্যমপশ্যা হয়ে থাকলে চলে না। রীতিমতো পাবলিক প্রেজেন্স থাকতে হয়।
প্রত্যেকেরই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে উপস্থিতি আছে। অনেকেই আছেন যাঁদের একটা উপন্যাসও
কেউ পড়েনি অথচ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ও মিডিয়ায় নিয়মিত উপস্থিতি থেকে লোকজন তাঁদের
সহজেই চিনতে পারবেন। এর পেছনে যে শুধু সাহিত্যিকদের যশলোভ কাজ করে যে তা নয়,
প্রকাশনা সংস্থাও তাঁদের এই সব পথে পরিচিতি বাড়াতে উৎসাহ দেয়। বলে ব্লগ লিখুন,
ফেসবুক করুন, টুইটারে নিয়মিত সমাজসংসার সম্পর্কে নিজের মতামত রাখুন। নিজের
গুগলেবিলিটি বাড়ান।
শরণ্য এর প্রত্যেকটাই করত। শুধু চেহারা থাকলেই হয় না। সঙ্গে চার্মও চাই। চাই
যৌন আবেদন। আর আত্মবিশ্বাস। এর সবক’টাই শরণ্যের ছিল। আর যেটা ছিল সেটা হচ্ছে
উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের খ্যাতি। শরণ্যের লেখার থেকেও অনেক বেশি বিখ্যাত (নাকি
কুখ্যাত?) ছিল ওর জীবনযাপন। ‘নাইটক্লাবে শরণ্য বর্মণ’ গোছের হেডলাইন আকছার দেখা
যেত বিনোদনের পাতায়। হেডলাইনের নিচে থাকত সুপুরুষ শরণ্য আর শরণ্যের বক্ষলগ্ন কোনও
নায়িকার ছবি।
লেখালিখির জগতে ব্যভিচারিতা খুব একটা আঁতকে ওঠার ব্যাপার না। সৃষ্টিশীল লোকেরা
যে সমাজের আর পাঁচটা লোকের মতো হবেন না, আর পাঁচটা লোকের দোষগুণের কষ্টিপাথরে যে
তাঁদের বিচার চলবে না – এ কথা মোটামুটি সকলেই মানে। আমাদের প্রকাশনাতেই
উচ্ছৃঙ্খলতার নজির সৃষ্টি করা বাঘা বাঘা সব সাহিত্যিকেরা আসাযাওয়া করতেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই
আমার মৌখিক আলাপ ছিল। অনেকে আমার কাছে টাকাপয়সাসংক্রান্ত উপদেশ নিতে আসতেন। ট্যাক্স
বাঁচানো, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ফাঁকফোকর জানতে আসতেন। হালিশহরে একটা, সাদার্ন
অ্যাভিনিউতে আরেকটা সংসার মেন্টেন করেন এমন লোককেও আমার সামনে বসে রয়্যালটির হিসেব
বুঝে নিয়ে যেতে দেখেছি।
আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার সময়ই একার জন্য একটা নিরিবিলি ফ্ল্যাট খুঁজছিল শরণ্য। আমিই
ওকে খবরটা দিই যে রুবির কাছে যে হাউসিং-এ আমি থাকি তাতে একটা ফ্ল্যাট খালি যাচ্ছে।
ঠিক যেমনটা ও চায়। শরণ্য দেরি করেনি। পত্রপাঠ যোধপুর পার্কের পৈতৃক বাড়ি বিক্রি
করে আমাদের হাউসিং-এ উঠে এসেছিল। তারপর থেকে মোটামুটি সপ্তাহে একবার আমরা একসঙ্গে
ডিনার করতাম। ওর সঙ্গ আমি উপভোগ করতাম। এতদিন এত লেখকসাংবাদিকের সঙ্গে এক অফিস
ভাগাভাগি করেও যা হয়নি, শরণ্যের সঙ্গে সপ্তাহে দু’ঘণ্টা করে সময় কাটিয়ে সে
অসাধ্যসাধন হয়েছিল। আমি ধীরে ধীরে লেখালিখির জগৎটার প্রতি একটা কৌতূহল বোধ
করছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি এতদিন কাছ থেকে দেখে কবিলেখকদের আমার মনে বেশ একটা
তাচ্ছিল্যের ভাব জেগেছিল। সাধারণ কয়েকটা লোক, বিশেষ উদ্যমী নয়, হয়তো পৃথিবীর যে
কোনও অন্য কাজ করতে গেলে তারা চরম ব্যর্থই হত। মানুষ হিসেবেও বেশ নিচুমানের, দিবারাত্র
একে অপরের নিন্দেমন্দ করে বেড়াচ্ছে। শরণ্য ওদের মতো ছিল না একেবারেই। কোনওদিন কারও
ব্যাপারে নাক গলাতে দেখিনি ওকে। কারও নিন্দে করতে শুনিনি। নিজের কাজ, নিজের
উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে সম্পূর্ণ মগ্ন একটা স্বার্থপর জীবন কাটাত শরণ্য। সে দিক থেকে
আমাদের একটা মিল ছিল বলতে হবে। ধীরে ধীরে আমার শরণ্যের প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব
জাগছিল। শরণ্য আমাকে ওর পরের উপন্যাসের আইডিয়ার কথা বলত, চরিত্রদের কথা বলত, কোন
পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মানাবে সে নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা বলত। রেনেসাঁসের সময়টা, নাকি
সুন্দরবনের নোনাজলে ডোবা ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে? “কোনটা ভালো হবে?” যেন সত্যি আমার মতামতের
সত্যি সত্যি ওর প্রয়োজন আছে এমন ভাবে
জিজ্ঞাসা করত। এখন ভাবলে হাসি পায়, আমিও মাঝে মাঝে ভাবতে বসতাম। কোনটা ভালো
হবে? ম্যানগ্রোভের জঙ্গল নাকি মান্ডুর ধ্বংসস্তুপ? নতুন বই বেরোলেই আমাকে দিত
শরণ্য। দুয়েকটা আমি পড়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি। অভ্যেস না থাকলে পারা যায় না।
গার্গীর অভ্যেস আছে, ও পড়ত। আর বলত, “বাপরে বাপ, ছত্রে ছত্রে এত ড্রামা লেখে কী
করে লোকটা?”
আমি বলতাম, “যার নিজের জীবনে এত ড্রামা সে নিজের চরিত্রদের জীবনও ড্রামাবহুল করবে
সেটাই তো স্বাভাবিক।”
গার্গী মানতে চাইত না। ওর মতে জীবনে ড্রামা আছে বলেই লেখার পাতায় শরণ্যের গল্পেরা
হবে নিরাপদ, ওর কল্পনার চরিত্রেরা হবে নিরীহ ও নিরাপত্তালোভী। সেটাই নাকি স্বাভাবিক।
যার যেটা নেই, কল্পনায় নাকি সে সেটাই চায়। স্বাভাবিক কি না জানি না। শরণ্যের ক্ষেত্রে
সেটা ঘটেনি। শরণ্যের সবক’টি মূল চরিত্রই আসলে ওর নিজের আদলে গড়া। সফল, সুপুরুষ,
নারীপরিবৃত।
শরণ্যকে আমি কখনও একাধিক প্রেমিকা ছাড়া দেখিনি। অসংখ্য, অগুন্তি প্রেমিকা।
নেশাখোররা যেমন ড্রাগ ছাড়া থাকতে পারে না, শরণ্য তেমনি নারীসঙ্গ ছাড়া থাকতে পারত
না। এমনও দেখেছি অফিসে কেউ বলেছে “শরণ্যদা, অমুকের শালী আপনার খুব ফ্যান।” হাতে
কোনও লেখা না থাকলে শরণ্য নিজে সেই শালীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ডেটে নিয়ে গেছে।
পরের তিনমাস তার সঙ্গে রাত জেগে এস এম এস চালাচালি করেছে। “এক মিনিট” বলে
ডিনারটেবিল ছেড়ে উঠে গেছে ফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে। তিনমাস বাদে আর খোঁজও নেয়নি।
আবার নতুন কেউ, কিংবা বহুদিনের পুরোনো কেউ, আবার নতুন করে। ডাক্তার, নার্স,
দিদিমণি, উকিল, মোটা, বেঁটে, সুন্দরী, অসুন্দরী – প্রেমিকা নিয়ে বাছাবাছি করতে
দেখিনি আমি কোনওদিনও শরণ্যকে। একটাই
শর্ত, শরণ্য বর্মণের প্রতি তাদের মুগ্ধতা অন্ধ হতে হবে।
শরণ্য অবশ্য সেটা স্বীকার করত না। মুচকি হেসে গার্গীর কান বাঁচিয়ে বলত, “তাও
লাগবে না। জাস্ট একটা ভ্যাজাইনা হলেই চলবে।”
আমি চিরকাল সেকেলে ধ্যানধারণার মানুষ। ব্যভিচার, পরকীয়া ইত্যাদি ব্যাপারে
কোনওরকম উৎসাহ বোধ করিনি কখনও। আমি বিশ্বাস করি ছেলেতে আর মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় না,
আর ওইসব সেক্সটেক্স বিয়ের পরেই করা ভালো। একটা মর্যালিটির ব্যাপার তো আছেই,
তাছাড়া প্র্যাকটিক্যালিটির ব্যাপারও আছে। ওসব করা মানে খামোকা জীবনকে জটিল করে
তোলা। মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান, ছোটবেলা থেকে একরকমের উচিতঅনুচিতের বোধ মনের মধ্যে
গেঁথে গেছে, আমি কখনও তাদের প্রশ্ন করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। বরং সব দেখেশুনে
আমার বোধ হয়েছে যে সামাজিক রীতিনীতি, নিয়মকানুন যে সব আছে ভালোর জন্যই আছে, না
থাকলেই বিপদ হত।
শরণ্য আমার সঙ্গে সহমত ছিল না, বলাই বাহুল্য। ও যেটা করত সেটাকে ও ব্যভিচার
বলে মনে করত না। ওর কাছে ওটা বেঁচে থাকার একটা অঙ্গ ছিল। অন্য কোনও ভাবে বাঁচার
কথা শরণ্য কল্পনা করতে পারত না। আমার মতো সমাজের ঠিক করে দেওয়া ঠিকভুল, ভালোমন্দ,
উচিতঅনুচিতের গণ্ডি কাঁটায় কাঁটায় মেনে, এক নারীতে অনুগত থেকে এবং কোনওরকম
অতৃপ্তিতে না ভুগে কী করে একটা সুস্থস্বাভাবিক লোক সারাটা জীবন কাটাতে পারে, সেটা শরণ্য
কল্পনাই করতে পারত না।
বিস্ময় অবশ্য আমার তরফেও কম ছিল না। আমাদের আলাপের গোড়ার দিকেই একদিন শনিবার
সকালে কী একটা টাকাপয়সার ব্যাপারে ওকে ফোন করেছিলাম। ঘুমজড়ানো চোখে শরণ্য কথা বলল
আর আমি স্পষ্ট শুনলাম পেছনে একজন মহিলা গুনগুন করে গান করছেন।
ফোন ছাড়ার পর আমার হাঁ করা মুখ দেখে আর ঘটনাটা শুনে গার্গী বলেছিল,
‘আহা, এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?”
“অবাক হব না? মহিলা কে বল তো? কস্তুরী সেন। পঞ্চাশের ওপর বয়স,
ছেলেমেয়েদের সব বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। অলোকদার রিটায়ারমেন্টের ফাংশানে এই গানটাই
গেয়েছিল।”
আমার সামনে এইসব ব্যাপারে না চমকানোর ভাব করলেও আসলে গার্গী বিচলিত হত খুবই।
হওয়াই স্বাভাবিক। যদ্দূর জানি আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার
আগে ও প্রেমট্রেমের রাস্তা পাড়ায়নি। আমার সঙ্গে অফিস পার্টিতে গেলে মদের টেবিলের
দিকে তাকাত না। পড়ার নেশা ছিল, কিন্তু যেসব গল্পে পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি থাকত সে সব
পড়তে ভালোবাসত না। সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। বিবাহিত দম্পতির কোন একপক্ষকে পরকীয়াতে
লিপ্ত হতে দেখলে গার্গীর পপকর্ন খাওয়ার স্পিড বেড়ে যেত। লাস্ট সিনে পরকীয়াকারীরা
যথাযোগ্য শাস্তি পেলে খুশি হয়ে আমার কনুই জড়িয়ে ধরে বাড়ি ফিরত। যদি দেখা যেত দুষ্কৃতীদের
কারও কোনও ক্ষতি হয়নি, চরিত্রহীনরা দিব্যি খেলেধুলে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে, নিজ নিজ
স্বামীস্ত্রীকে ছেড়ে অন্য পুরুষ বা নারীর সঙ্গে সুখে আছে, তাহলে আর রক্ষা থাকত না।
পরের দু’দিন খুঁটিনাটিতে ঝগড়া বাধিয়ে চোখে জল এনে ফেলত ।
ওর ছেলেমানুষি দেখে বাইরে হাসলেও আমি মনে মনে আসলে খুশি হতাম। আমার মতো লোকের
পক্ষে গার্গীর মতো সঙ্গীই দরকার ছিল। ঠিকভুল উচিতঅনুচিতের সীমারেখা ক্রমে ঘুলিয়ে
যাওয়া দুনিয়াটায় সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, দুশ্চরিত্রকে দুশ্চরিত্র বলতে পারা
সঙ্গীর।
গার্গীকে আমি ভালোবাতাম।
গার্গী ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে ভালোবাসার সুযোগ আমার হয়নি। অভাবও বোধ করিনি
কোনওদিন। কিন্তু গার্গী আমাকে ভরিয়ে দিয়েছিল। যেখানটায় কোনও শূন্যতা ছিল না, সে
জায়গাটা একটা লোক এসে ভরিয়ে দিল। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি।
গার্গীও আমাকে ভালোবাসত। ইন ফ্যাক্ট, আমার তুলনায় গার্গীর ভালোবাসা ছিল অনেক
সোচ্চার। বিয়ের পর দার্জিলিং-এর ম্যালে ঘেঁষাঘেঁষি করে
দাঁড়িয়ে তোলা ছবি বাঁধিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখেছিল। প্রতি বছর ভ্যালেনটাইনস ডে-তে
আমার জন্য স্পেশাল রান্না করত, টাকা জমিয়ে আমাকে উপহার কিনে দিত। আমার দেওয়া সবক’টা
উপহার, গ্রিটিংস কার্ড যত্ন করে জমিয়ে রেখেছিল গার্গী।
আমার সামনে শরণ্যের ব্যভিচারিতা নিয়ে উদাসীনতা দেখালেও, সামনাসামনি প্রতিবাদ করত
ও। বা বলা ভালো না করে পারত না। খানিকক্ষণ চুপ করে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করে বলত,
“এরকম করা উচিত নয়।”
তর্কের গন্ধ পেয়ে শরণ্য নড়েচড়ে বসত।
“কেন, উচিত নয় কেন?”
“কেউ আঘাত পেতে পারে তো।”
“কী কাণ্ড। আঘাত কেন পাবে?”
“আপনার দিক থেকে কোনও কমিটমেন্ট না থাকতে পারে, কিন্তু অন্যদিকেরও যে থাকবে না
তেমন তো কোনও কথা নেই। হয়তো কেউ সত্যি সত্যি আপনার প্রেমে পড়ে গেল। তখন?”
ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠত শরণ্য। ওর মত সফল, সুপুরুষ, ঝকঝকে, অন্ত-তিরিশের লোকের
প্রতি কারও প্রেমে পড়াটা যেন একটা মারাত্মক হাসির কথা।
“মাই গড, গার্গী। প্রেমে পড়ার কোনও সিনই নেই কোথাও। আমি যাদের সঙ্গে শুই তারা
সে কথাটা আমার থেকে বেটার জানে। ট্রাস্ট মি।”
“শুই” শব্দটায় সিঁটিয়ে গেলেও হাল ছাড়ত না গার্গী।
“একদিন আপনি কারও প্রেমে পড়ে যাবেন, আর তারপর সে আপনার সঙ্গে যখন এ’রকম
ব্যবহার করবে, তখন আপনার শিক্ষা হবে।”
“ফার্স্ট অফ অল, আমি প্রেমে পড়ব না। সেকেন্ড অফ অল, এ’রকম ব্যবহার বলতে তুমি
কী বলতে চাইছ? আমি আমার কোনও গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আজ পর্যন্ত কোনওরকম খারাপ
ব্যবহার করিনি। দ্যাটস নট মাই স্টাইল। উৎসাহ ফুরিয়ে গেলে সিম্পলি ক’দিনের জন্য ডুব
দিই। বলি, বাইরে যাচ্ছি। বলে সিন থেকে হাওয়া হয়ে যাই। ফোন তুলি না। ইমেলের উত্তর
দিই না। ব্যস। তাতেই যা কাজ হওয়ার হয়ে যায়। আফটার অল, দে আর অল ম্যাচিওর উইমেন।”
“প্রেমিকার ভয়ে শহর ছাড়া?” ঠাট্টার সুরে বলেছিলাম আমি।
“শহর ছাড়তে হবে কেন? বললাম ছাড়ছি, কিন্তু ছাড়লাম না। দরজাজানালা বন্ধ করে ঘরে
বসে রইলাম। মোবাইল সুইচড অফ, কাজের লোককে ছুটি। নিউজপেপার বন্ধ, দুধের প্যাকেট
বন্ধ। সামান্য প্ল্যানিং লাগে, হপ্তাদুয়েক তিনবেলা প্যাকেট খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম
করে খেতে হয়, বাট ওয়ার্থ ইট। সবথেকে ভালো যে ব্যাপারটা হয় সেটা হচ্ছে কাজ। ফাটিয়ে কাজ হয় ওই সময়গুলোয়।
নো ডিসট্র্যাকশন, ওনলি লেখা। অ্যাকচুয়ালি, আই শুড ডু ইট মোর অফেন।”
গার্গী থমকে গিয়েছিল।
সত্যি বলতে কি আমিও থমকে গিয়েছিলাম। আমি এমন কিছু ধোয়া তুলসীপাতা নই, হলে এ লাইনে
এত উন্নতি করতে পারতাম না। কিন্তু আমার অসততা শুধু প্রাণহীন হিসেবনিকেশের সঙ্গে, রক্তমাংসের
মানুষদের সঙ্গে এইরকম অম্লানবদনে শঠতা?
এখন ভাবি, খারাপ লাগার এতগুলো কারণ থাকতেও শরণ্যের সঙ্গে বন্ধুত্বটা আমি
রেখেছিলাম কেন।
আমিই রেখেছিলাম বলা উচিত, কারণ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব না থাকলে শরণ্য বর্মণের কিছু আসত
যেত না। টাকাপয়সার হিসেব রাখার জন্য আমার থেকে যোগ্যতর লক্ষ লক্ষ চার্টার্ড
অ্যাকাউনট্যান্ট এই শহরেই শরণ্য পেয়ে যেত। আমি নিশ্চিত আমাদের সাপ্তাহিক নৈশভোজও
শরণ্যকে এমন কিছু সমৃদ্ধ করত না যা থেকে ওর লেখালিখির কোনও উপকার হতে পারে। কলকাতা শহরের আরও
শ’খানেক নারীপুরুষ শরণ্যের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য মুখিয়ে থাকত। কাজেই সম্পর্কটা
আমি রেখেছিলাম আমার গরজেই।
তার মানে একটা হতে পারে যে সেলিব্রিটিহুডের থেকে নিজেকে আমি যতটা সুরক্ষিত মনে
করতাম ততটা আমি ছিলাম না। আমাদের অফিসের নিচে বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় উশকোখূশকো চুলের
ছেঁড়া জিনস আর আধময়লা পাঞ্জাবি পরা যে ছেলেগুলো প্রতিষ্ঠিত কবির কাছ থেকে আশীর্বাদ
পাওয়ার আশায় খাতা হাতে ঘুরঘুর করে, ওদের সঙ্গে সত্যি হয়তো আমার কোনও পার্থক্য নেই।
সাহিত্য সভায় শরণ্যের সঙ্গে ছবি তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়া শীৎকাররত মহিলারা, যাদের
দেখে আমি মনের ভেতর বিরাগ অনুভব করতাম আমি আসলে তাদের থেকে কোনও অংশে কম যেতাম
না। শরণ্যের খ্যাতি, আকর্ষণী ক্ষমতা আমাকে একই রকম ভাবে গ্রাস করেছিল। শরণ্য মাঝে
মাঝে ওর বাড়িতে পার্টি দিত। সিনেমা সাহিত্য রাজনীতি জগতের বড় বড় চেনা মুখেরা আসত
সে সব পার্টিতে। মদের গেলাস হাতে নিয়ে ঘুরত। তাদের সামনে শরণ্য যখন আমার কাঁধে
রেখে হাহা করে হাসত যখন, একটুও গর্ব কি হত না আমার? বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির প্রতি
আমার আস্থা থাক আর না থাক, সত্যিটা তো এই যে লোকে ওদের চেনে, আমাকে চেনে না। তাদের
সামনে শরণ্যের মতো একজনের কাছ থেকে অতখানি গুরুত্ব, অতখানি স্বীকৃতির লোভ কি কাউকে
না ছুঁয়ে পারে? আমিও তো মানুষ? যদিও আমি সে ছোঁয়ার বাইরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা
করতাম। কোনও কথোপকথনের সূত্র ধরে “হ্যাঁ হ্যাঁ শরণ্যও বলছিল বটে” মুখ থেকে বেরিয়ে
গেলে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। শরণ্যের সঙ্গে বন্ধুত্বটাকে আমি প্রদর্শন করছি কি না
সন্দেহে জর্জরিত হতাম।
আশ্চর্যের ব্যাপারটা হচ্ছে নিজের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ভাবনার গতিপ্রকৃতি নিয়ে
তটস্থ থাকা সত্ত্বেও আমার চারপাশের মানুষদের ভাবনাচিন্তা আচরণ ইত্যাদির প্রতি আমি
আশ্চর্যরকম অচেতন।
অন্তত তখন ছিলাম। গার্গী আর শরণ্যের সম্পর্কটা যে বদলাচ্ছে এটা আমি গোড়াতে বুঝতেই
পারিনি। হঠাৎ এক শুক্রবার চোখে পড়ল। দেখলাম ওরা আর সরাসরি নিজেদের মধ্যে কথা বলছে
না। যা কথা হচ্ছে সব আমার মাধ্যমে। আগে যেমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিঠাট্টা
খুনসুটিতে জমে থাকত টেবিল, কথায় কথায় তর্ক বেধে যেত শরণ্য আর গার্গীর মধ্যে, সে
রকমটা আর হচ্ছে না।
শরণ্য চলে যাওয়ার পর আমি গার্গীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
“তোমাদের কি কিছু হয়েছে?”
গার্গী চমকে উঠেছিল।
“কী হবে? কিচ্ছু হয়নি। কেন তোমার মনে হল কিছু হয়েছে?”
“না এমনিই। বেশি
কথা বলছিলে না। মনে হচ্ছিল কোনও কারণে ওর ওপর বিরক্ত হয়েছ।”
“না না। সে রকম হওয়ার তো কোনও কারণ নেই।”
কিন্তু কিছু তো একটা হয়েছিলই। আমার প্রতিও গার্গীর ব্যবহার বদলাচ্ছিল একটু
একটু করে। আগের থেকে অনেক ঠাণ্ডা, অনেক উদাসীন, অনেক দূরের। আমাদের সেক্স লাইফে
আগে কোনও সমস্যা ছিল না। ক্রমেই গার্গীর অনাগ্রহ প্রকাশ পেতে লাগল। আমি বুঝতে
পারতাম গার্গী অভ্যেস মতো সবকিছু করে যাচ্ছে কিন্তু আগের ভালোলাগাটা ওর মধ্যে আর
কাজ করছে না। একদিন আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল,
“বয়স তো হচ্ছে, এখনও আগের মতো প্যাশন আশা করলে তো মুশকিল।”
এমন গম্ভীর মুখ করে বলেছিল গার্গী কথাটা যে আমি হোহো করে হেসে উঠেছিলাম।
“কত বয়স? তোমার পঁয়ত্রিশ, আমার আটত্রিশ। এটা একটা বয়স হল?”
দিনকে দিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল গার্গী। সবেতে রাগ, সবেতে চোখে জল। আমার পক্ষেও
আর উদাসীন থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। আমাদের বিয়ের দশ বছর পূর্তিতে আমাদের দু’জনকে
উদ্দেশ্য করে শরণ্যের পাঠানো কার্ডটা দেখে অত রেগে গেল কেন গার্গী আমি তখন ভেবেই
পাইনি। আমি অন্যান্য বছরের মতোই আমি সে বছরও লাল গোলাপের সবথেকে বড়, সবথেকে সুন্দর
তোড়াটা এনেছিলাম ওর জন্য। বিবাহবার্ষিকীর দু’দিন পর একটা জরুরি বিল খুঁজতে ওয়েস্ট
পেপার বাস্কেট ঘাঁটতে গিয়ে দেখি তোড়ার সঙ্গে পাঠানো আমার কার্ডটা পড়ে আছে।
আমি বোকা নই। আমার বুদ্ধি আছে।
আমার যেটা ছিল না সেটা হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আমি যেন চোখে ঠুলি পরে দুনিয়ার ভেতর দিয়ে
হেঁটে এসেছি এতদিন, মানুষের মন কেমন হয়, কোন পথে চলে, এ সব আমার চোখেই পড়েনি। আমার
সবথেকে কাছের মানুষটার মনে যে টানাপোড়েন, দোলাচলের সৃষ্টি হয়েছে, এক ছাদের তলায় থেকে, এক বিছানায় শুয়ে আমি
তা বুঝতে পারিনি।
ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখার আগের মুহূর্তে জোর করে বন্ধ করে রাখা ওর দুচোখের তলায় গাঢ়
কালি দেখেছি, টের পেয়েছি আমার দু’হাতের ভেতর পাথরের মতো শক্ত হয়ে রয়েছে গার্গীর
চোয়াল, দাঁতে দাঁত চিপে রেখেছে গার্গী। অথচ আমার স্বার্থপর মন খালি নিজের কথাই
ভেবেছে। আমি কী করলে গার্গীর চোখের তলার কালি মুছবে, আমি কী করলে গার্গী আর একটু
ভালো থাকবে। গার্গীর মনের ভেতর যে আমি আর নেই কোথাও, সে জায়গায় যে অন্য কেউ বসে
আছে সেটা আমার কল্পনাতেই আসেনি। সেই লোকটা আমার নাকের সামনে ঘোরা সত্ত্বেও।
শরণ্যও বদলে যাচ্ছিল। ডিনার টেবিলে
বসে ওর নতুন নতুন গার্লফ্রেণ্ডদের কথা আর বলত না। মনে আছে আমি গার্গীকে বলেছিলাম,
“শরণ্য যেন পোষ মানছে মনে হচ্ছে? ”
গার্গী হেসেছিল।
“আমারও তাই ধারণা।”
কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল। মাসতিনেক
পর একদিন টিফিনে নিচে নেমে দেখি উল্টো ফুটপাথে শরণ্য, শরণ্যর বুকের ভীষণ কাছে একটা
মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা শরণ্যের মুখের দিকে তোলা। সারা মুখে একটা পুজো পুজো ভাব
মাখামাখি। এঃ, মেয়েটা একেবারে বাচ্চা।
গার্গীকে এসে কথাটা বলতে গার্গী
অবশ্য একটুও মায়া দেখাল না। উল্টে রাগে ফেটে পড়ল।
“আমি তোমার বন্ধুদের গল্প শুনতে
চাই না। নিজের অফিসের গল্প অফিসে সেরে রেখে আসবে।”
তার কিছুদিন বাদেই একদিন অফিসে
শরণ্যের ফোন এল।
“আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে
যাচ্ছি।”
শরণ্যের গলা টেনসড।
“এখন? ট্যাক্সের কী হবে? মাসখানেক
পর যা।?”
“তুই যা ভালো বুঝিস করে দিস। আমি ফিরে
দেখে নেব।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“ঠিক করিনি। দেখি পাহাড়টাহাড় কোথাও
একটা।”
“এত তাড়াতাড়ি টিকিট পেলি?”
“ড্রাইভ করব। থাকার জায়গা পৌঁছে
ডিসাইড করব।”
খবরটা শুনে গার্গী অবাক হয়নি।
বলেছিল, “ভালোই হয়েছে, একগাদা পুজোর লেখা বাকি, এখানে থাকলে ফ্যানেদের ঠেলায় সে সব
হওয়া মুশকিল।”
শরণ্যের ফ্ল্যাটটা আমার হাউসিং-এ
হলেও আমাদের বিল্ডিং আলাদা ছিল।যাতায়াতের পথে ওর ফ্ল্যাট চোখে পড়ত না আমাদের। হাউসিং-এর
প্রেসিডেন্ট জয়ন্ত নাগের বাড়ি ছিল ওর পাশের বিল্ডিং-এ। ধান্দাবাজ লোক। প্রতি বছর ট্যাক্সের
আগে আমাকে হয় ফোন করে নয় রাস্তায় পাকড়াও করে করে বাড়িতে ডাকবে। ব্যাটার টাকা আছে
প্রচুর তবু নিজের উকিল রাখবে না। কিপটের ঝাড়। গার্গী বলত, “অসুবিধে হলে সময় নেই
বলে দিলেই পার”, কিন্তু আমি লোকটাকে চটাতে চাইতাম না। বড় বড় জায়গায় হাত আছে, কখন
কী ঝামেলায় ফেলে দেবে বলা যায় না।
সেদিন অফিস বেরোনোর আগে ফোন করে ডাকল।
“মিস্টার দত্ত, একবার আমার বাড়ি
হয়ে যাবেন নাকি? দু’মিনিটের ব্যাপার।”
দু’মিনিটই হোক বা কুড়ি মিনিট, ও জানত
আমি “না” বলব না। রাজি হয়ে গেলাম। কথাবার্তা সেরে বেরোনোর সময় হঠাৎ পাশের
বিল্ডিঙের তিনতলার একটা চেনা ফ্ল্যাটের দিকে চোখ পড়ে গেল।
শরণ্যর ফ্ল্যাটের জানালার পর্দা
সরানো। শরণ্য সাবধানী লোক।
বাড়ি থেকে বেশ কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেলে পর্দা ফাঁক করে রেখে যাবে না।
দু’দিন পর আবার অফিস যাওয়ার আগে
জয়্ন্ত নাগের বাড়ি তলব। ফেরার পথে আবার অভ্যেসবশত শরণ্যের জানালার দিকে চোখও পড়ল।
আর চোখ পড়েই থমকে গেলাম আমি।
পর্দার ফাঁকটা আগের দিনের থেকে একটু বেশি মনে হচ্ছে না? চোখের ভুল? উঁহু। নিঃসন্দেহে পর্দাটা এই দু’দিনের মধ্যে
নাড়ানো হয়েছে। অফিস লেটের কথা ভুলে গিয়ে আমি তিনতলায় গেলাম। শরণ্যের দরজায় বেল
বাজালাম। বেল বেজে গেল। “আগরওয়াল” নেমপ্লেট সাঁটা পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে একজন
বয়স্ক মহিলা মুখ বার করলেন।
মিস্টার বর্মণ বাড়িতে নেই। বাইরে গেছেন। সামনের শনিরবিবার ফিরবেন।
আমি “থ্যাংক ইউ” বলে নিচে নেমে ঘুরে ফ্ল্যাটের পেছন দিকে গেলাম। সারি সারি
দরজা বন্ধ গ্যারেজ। ডানদিক থেকে তিন নম্বরটা শরণ্যের। শাটার বন্ধ। কিন্তু পুরো
বন্ধ নয়। নিচটা সামান্য ফাঁকা হয়ে রয়েছে। আমি ইস্তিরি করা প্যান্টের মায়া ভুলে
হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরের অন্ধকারে উঁকি মারলাম। স্পষ্ট কিছু দেখতে পেলাম না, কিন্তু
ভেতরে যে একটা গাড়ি আছে সেটা নিশ্চিত।
আর সেটা যে শরণ্যের নতুন কেনা লাল রঙের মানজা, সেটা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহই
ছিল না।
অফিসে বসে মাঝে মাঝে একা একাই হেসে ফেলছিলাম। শরণ্যকে কী রকম চেপে ধরব ভেবে।
দার্জিলিং গিয়েছিলি? কোন হোটেলে থাকলি? মিসেস আগরওয়ালের পাশের হোটেলে? গার্গীর
সঙ্গে মজাটা ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাড়ি ফেরার তর সইছিল না আমার। কিন্তু সেদিনই একের
পর এক কাজ আসতে থাকল। অবশেষে যখন বাড়ি পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে।
গার্গী অপেক্ষা করে ছিল। আমাকে দেখে রান্নাঘরে ঢুকল খাবার গরম করতে। আমি ব্যাগ
রেখে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গোটা ব্যাপারটা ওকে বললাম।
মাইক্রোওয়েভের হ্যান্ডেলে গার্গীর হাত থেমে গেল। আমার দিকে ফিরে তাকাল ও। মুখ
ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে।
“কী হল?”
“কী করে পারল?
“কে? কী পারল?”
“কী করে পারে কেউ কারও সঙ্গে এ’রকম করতে?”
“শরণ্য? কিন্তু ও তো এ রকমই। এ তো ও আগেও করেছে। বলেছিল, মনে নেই?”
হাতের বাসন নামিয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল গার্গী।
“আমি এক্ষুনি ফোন করছি।”
আমার বাড়ানো হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফোনের দিকে ছুটে গেল গার্গী।
“তুলবে না। আমি চেষ্টা করে দেখেছি।”
ফোন কানে চেপে ধরে কাঁদছিল গার্গী। নিঃশব্দে। ওর সুন্দর, নিষ্পাপ মুখটা
কান্নায় বেঁকেচুরে যাচ্ছিল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম।
“কাঁদে না, গার্গী। গার্গী . . .”
গার্গী ছুটে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।
পাঁচবছর আগের ঝাপসা হতে শুরু করা সময়টার মধ্যে একমাত্র ওই মুহূর্তটা আমার
মাথার ভেতর এখনও একেবারে টাটকা। দগদগে। গার্গী চলে গেছে, আমি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আছি। বিদ্যুতের মতো সত্যিটা ঝলসে উঠেছে আমার চোখের সামনে। আমাকে ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
আমি যে কেন গার্গীর পেছনে ছুটে গেলাম না, কেন যে পেছন ফিরে শোবার ঘরে ঢুকে
এলাম তা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। শোবার ঘরে পৌঁছে গার্গীর ওয়ার্ডরোবটা খুললাম
আমি। দশ বছরে এই প্রথমবার। ওপরের তাকটায় একটা বাক্স রাখা। কাজ করা বাহারি কাঠের
বাক্স। কাশ্মীর থেকে বাবামা এনে দিয়েছিলেন। বাক্সের ভেতর গ্রিটিংস কার্ডের গোছা,
আমার দেওয়া ছোটখাটো গয়না, একটা মসৃণ নুড়ি। নুড়িটা চিনতে পারলাম আমি। দশ বছর আগে
ডুয়ার্সে হানিমুনে গিয়ে মূর্তি নদীর পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা। দশ বছর ধরে এটাকে যত্ন
করে রেখেছে গার্গী? আর গার্গীকে কি না আমি সন্দেহ করেছিলাম? ভাবছিলাম গার্গী আমাকে
ঠকিয়েছে? নিজের ওপর ধিক্কারে মন ভরে গেল আমার। ওসব গল্পউপন্যাসে হয়, অন্য লোকদের
হয়, যাদের মনের জোর কম। যাদের মর্যালিটি বলে কিছু নেই। শরণ্যের প্রতি যদি গার্গীর
কিছু হয়ে থাকে তবে তা সামান্য ইনফ্যাচুয়েশন। আজীবন ঘেরাটোপে কাটানো একটা মেয়ের
সামনে শরণ্যের মতো একজন মানুষ ঘোরাফেরা করলে, তার সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটালে এ রকম
তো না হওয়াই অস্বাভাবিক। গ্রিটিংস কার্ডগুলো তুলতেই বাক্সের কোণায় রাখা একটা লকেট
বেরিয়ে পড়ল।। এই লকেটটাও আমি চিনি। এটার পাশে একটা ছোট বোতাম আছে যেটা টিপলে লকেটটা
খুলে যায় আর ভেতরে দুটো ছবি রাখার খোপ বেরিয়ে পড়ে।
গার্গীর ছবিটা আছে যেখানে থাকার। আমার ছবি যেখানে ছিল সেখান থেকে আমার দিকে
তাকিয়ে হাসছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শরণ্য বর্মণ।
বাক্সের ভেতর থেকে একটা বোতাম পেলাম। শরণ্যের জামারই হবে নিশ্চয়। তবে আমি
খেয়াল করলাম, বোতামটা কেটে নেওয়া হয়নি। জামা থেকে খসে পড়েছিল, গার্গী তুলে রেখেছে।
আর একটা ছোট সাদা রঙের খামের ভেতর দু’তিনটে চুল। পুরুষের। শরণ্যের বাথরুম ব্যবহার
করতে গিয়ে চিরুনিতে লেগে থাকা চুল তুলে এনেছে গার্গী।
আমি জানতাম গার্গী শরণ্যের বাড়ি যাবে। আমি এও জানতাম শরণ্য দরজা খুলবে না। আমি
যখন শরণ্যের ফ্ল্যাটের নিচে পৌঁছলাম তখন সারা হাউসিং ঘুমিয়ে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্টের
আলোয় দেখলাম গার্গী বেরিয়ে আসছে বিল্ডিং-এর দরজা দিয়ে। আমি দৌড়ে গেলাম।
“গার্গী, বাড়ি চল।”
গার্গী আমার হাত ছাড়িয়ে নিল। আমি প্রায় জোর করেই ওকে ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকে
সরিয়ে নিয়ে গেলাম। গ্যারেজগুলোর পেছনদিকে একটা জলা মতো আছে, শনিরবিবার সন্ধ্যেয়
হাঁটতে হাঁটতে আমরা মাঝে মাঝে যাই।
গার্গীর চোখ কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে গিয়েছিল। হাঁপাচ্ছিল বেচারা।
“আমি বুঝতে পারছি গার্গী, তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমার ওপর রাগ করিনি। আমি
জানি দশ বছর অনেকটা সময়। তাছাড়া আমি খুব বোরিং। শরণ্য অনেক ইন্টারেস্টিং, ঝকঝকে। তোমার
ওকে ভালো লাগাটা স্বাভাবিক। আমি কমপ্লিটলি বুঝতে পারছি।”
গার্গী আমার দিকে তাকাল।
“আমি শরণ্যকে ভালোবাসি। শরণ্যও আমাকে ভালোবাসে।”
কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল আমার নিজেকে সামলাতে।
“কী পাগলামো করছ, গার্গী। এটা ভালোবাসা নয়, এটা ইনফ্যাচুয়েশন।”
“আমি ডিভোর্স চাই।”
“গার্গী!” দ্রুত নিজের গলা নামিয়ে আনলাম আমি।
“কী হয়েছে তোমার, গার্গী? তুমি
শরণ্যকে চেনোই না। তার জন্য তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে?”
“চিনি না? আমি শরণ্যকে চিনি না? গত
ছ’মাস ধরে আমরা প্রেম করছি, অভিজিৎ। লুকিয়ে। আর লুকোব না। আমি শরণ্যর কাছে যাচ্ছি।
আমরা বিয়ে করব। সারাজীবন একসঙ্গে থাকব আমরা।”
গার্গী পেছন ফিরল। আমি ওর হাত টেনে
ধরলাম। খুব মৃদু একটা আগুন টের পাচ্ছি বুকের ভেতর।
“শরণ্যের কাছে যাচ্ছ তুমি? শরণ্যের
কাছে? শরণ্য তোমার থেকে লুকিয়ে বসে আছে গার্গী, তোমাকে এড়াতে ও দরজা বন্ধ করে বসে
আছে দিনের পর দিন, মাইক্রোওয়েভের খাবার খাচ্ছে। তোমাকে একটা কার্ড পর্যন্ত দেয়নি
যে ছ’মাসে, লুকিয়ে যার চুল আর বোতাম কুড়িয়ে তুমি বাক্সের ভেতর তুলে রেখেছ, সে
তোমাকে বিয়ে করবে? সারাজীবন থাকবে তোমার সঙ্গে?”
গার্গী কেঁদে উঠল।
“আমাকে ছেড়ে দাও, আমি শরণ্যের কাছে
যাব।”
জোর করে আমার হাত ছাড়িয়ে অন্ধকারের
মধ্য দিয়ে শরণ্যের ফ্ল্যাটের দিকে ছুটে চলে গেল গার্গী।
*****
রাত এগারোটার সময়ও গার্গী যখন বাড়ি ফিরল না আমি থানায় ফোন করলাম। বলল, “মিসিং
পার্সন রিপোর্ট লিখিয়ে যান।”
গেলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, বেশি পাত্তা দিল না। জিজ্ঞাসা করল, “ঝগড়াটগড়া কিছু
হয়েছিল?” আমাকে মুখের ওপর কিছু বলল না, কিন্তু বুঝতে পারলাম ধরে নিয়েছে অবৈধ
প্রেমের কেস। বউ কারও সঙ্গে পালিয়েছে।
পরদিন সকালে আমাকে কিছু করতে হল না। পুলিশ নিজেই কড়া নেড়ে আমার বাড়িতে এল।
গার্গীর বডি পাওয়া গেছে। কাল রাতে যেখানে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল গার্গী। হাউসিং-এর পেছনের জলার
ধারে।
হাউসিং-এর ওই প্রান্তে অত রাতে কী করছিল গার্গী জানতে চাইল পুলিশ। ওদিককার ফ্ল্যাটগুলোর
কাউকে চিনত কি? আমি ঘাড় নাড়লাম। খুব শান্ত, মুখচোরা মেয়ে ছিল, মিশত না বেশি। কলকাতা
পুলিশের হোমিসাইড স্কোয়্যাডের অফিসার ইমন গুপ্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“আপনি সত্যি কথা না বললে অন্য কেউ বলবে, মিস্টার দত্ত।”
“শরণ্যের ফ্ল্যাট ওদিকটাতেই।” যথাসম্ভব নিচু গলায় বলেছিলাম আমি।
“রাইটার শরণ্য বর্মণ?” অফিসারের ভুরু সামান্য উঠেছিল।
“কিন্তু ও এখন ফ্ল্যাটে নেই। বাইরে
গেছে।”
“কোথায়?”
“জানি না।”
“কবে ফিরবে?”
“জানি না। মোস্ট প্রব্যাবলি কালপরশুর মধ্যেই।”
*****
এর পরের ঘটনা আমি জানতে পারি ট্রায়াল চলাকালীন সময়। গার্গী দত্ত মার্ডার কেসে
স্টেট ভার্সাস শরণ্য বর্মণ ট্রায়াল। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরদিন পুলিশ শরণ্যের
ফ্ল্যাটে যায়। আমার ধারণা শরণ্যকে পুলিশ প্রথমে সন্দেহ করেনি। আন্দাজ করা শক্ত নয় ওরা
কাকে সন্দেহ করেছিল। শরণ্যের বাড়ি পুলিশ গিয়েছিল আমার আর গার্গীর সম্পর্ক নিয়ে
জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তার আগে হাউসিং-এর আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিল পুলিশ। জয়ন্ত
নাগ। মিসেস আগরওয়াল। কেউই ঘটনার রাতে কিছু দেখেনি। সকলেই বলেছিল শরণ্য বাইরে গেছে। আমি আন্দাজ করতে পারি শরণ্য দরজা খোলার প্রথম কী জানতে চেয়েছিলেন ইমন গুপ্ত।
“কবে ফিরলেন মিঃ বর্মণ? কোথায় গিয়েছিলেন?”
শরণ্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ও জানত এখানে মিথ্যে কথা বলে পার পাওয়া যাবে না।
গোয়েন্দাগল্পে পুলিশকে যে রকম হাবাগোবা দেখানো হয় আসলে তারা সে রকম হয় না। দার্জিলিং কিংবা
দীঘা গিয়েছিলাম বললে সে কথা যাচাই করতে পুলিশের আধবেলাও লাগবে না, সেটা
শরণ্য জানত। কাজেই ও সবকিছু স্বীকার করে বসল। বলল যে সবাইকে বললেও আসলে ও যায়নি
কোথাও, বাড়িতেই ছিল।
“কেন? লুকিয়ে বাড়িতে বসেছিলেন কেন?”
ইমন গুপ্তও কি চমকে গিয়েছিলেন? আমি আর গার্গী যেমন চমকেছিলাম প্রথমবার শরণ্যের
কাণ্ডকারখানা শুনে?
“এমনিই, কাজ করব বলে।”
গত পাঁচ বছর ধরে আমি কোটি কোটি বার তার পরের দৃশ্যগুলো কল্পনা করার চেষ্টা
করেছি। ঘুরিয়েফিরিয়ে। সংলাপ বদলে, চরিত্রদের অবস্থান বদলে। কখনও শরণ্যর বসার ঘরে,
কখনও শোবার। অদ্ভুত একটা আরাম হয়েছে। ঠিক
কোন মুহূর্তে শরণ্য বুঝল ওর আর পালানোর পথ নেই? ও কি তখন দাঁড়িয়ে ছিল, নাকি বসে?
কারণ দাঁড়ানোর মতো জোর ওর হাঁটুতে আর ছিল না? ঠিক কেমন হয়েছিল ওর মুখটা যখন ওর
পাড়াশুদ্ধু লোককে মিথ্যে কথা বলে দিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করার প্ল্যানের কথা শুনে ইমন
গুপ্ত ওর মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলেছিলেন,
“আপনি সত্যি কথা না বললে অন্য কেউ বলবে, মিস্টার বর্মণ।”
ঠিক তখনই কি শরণ্য ভেঙে পড়ল? প্যানিক? স্বীকার করল যে না কাজ না, আসলে বিশেষ একজনকে,
. . . হ্যাঁ হ্যাঁ, মহিলা মহিলা, . . . একজন মহিলাকে এড়াতেই ওর এই স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাস।
“মহিলাটির নাম জানতে পারি?”
শরণ্য কি গার্গীর নামটা বলেছিল, নাকি জেন্টলম্যানের মতো অস্বীকার করেছিল?
ডরোথি সেয়ার্সের কোন একটা বইতে . . . ইয়েস, ক্লাউড অফ উইটনেস-এ ওইরকম একটা চরিত্র
ছিল। ফাঁসিতে ঝুলবে তবু রক্ষিতার নাম বলবে না। কী, না, অনার অফ দ্য লেডি। শরণ্য
অবশ্য অত মহত্ব দেখিয়েছিল কি না আমার সন্দেহ আছে। দেখালেও অসুবিধে হত না। মিসেস
আগরওয়াল বলতেন। সাক্ষী দিতে উঠে তাঁর সপ্রতিভ ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই সব
প্রশ্নের উত্তর তিনি পুলিশের কাছে এর আগে একশোবার দিয়েছেন।
“মিসেস দত্তা ইউসড টু কাম টু মিস্টার বার্মান’স হাউস। ইয়েস, ইনিশিয়ালি শি ইউসড
টু কাম উইথ হার হাসব্যান্ড। মোস্টলি ইন দ্য ইভনিংস। বাট লেটার শি ইউসড টু কাম
অ্যালোন। দোপেহরকো। ফির তো উন দোনো কা জোর জোর সে ঝগড়া ভি হোতা থা। হাঁ, মিস্টার
বার্মান অর মিসেস দত্তাকা। ভেরি আনফরচুনেট।“
ঘটনার রাতে শরণ্যের কোনও অ্যালিবাই ছিল না। থাকবে আশাও করছিল না কেউ। পুলিশের জেরায় পাড়াপ্রতিবেশী, কাগজওয়ালা, মাদারডেয়ারিওয়ালা সকলেই
জোরের সঙ্গে জানিয়েছিল শরণ্য বাইরে গেছে। প্রত্যেকবারের মতোই
শরণ্যের অজ্ঞাতবাসের প্ল্যানিং নিখুঁত ছিল। অন্তত শরণ্য তাই ভেবেছিল।
কিন্তু শরণ্যের প্ল্যানে একটা নয়, তিনতিনটে খুঁত পেয়েছিল ইমন গুপ্তের লোকজন। গার্গীর
হাতের মুঠো থেকে একটা জামার বোতাম পাওয়া গিয়েছিল। বোতাম ছেঁড়া জামাটা বেরিয়েছিল শরণ্যের
ওয়ার্ডরোব থেকে। আর গার্গীর পোশাকে লেগে ছিল কয়েকগাছা ঘন কালো চুল। কাঠগড়ায়
দাঁড়িয়ে নিষ্কম্প গলায় জজকে ফরেনসিক ল্যাবের রিপোর্ট পড়ে শুনিয়েছিলেন ইমন গুপ্ত। চুলগুলো
শরণ্য বর্মণের।
*****
গার্গী নেই। শরণ্য থেকেও নেই। আমার বুককেসে ওর নিজের হাতে সই করে দেওয়া বইগুলো
এখনও আছে। শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরে ফাঁকা ফাঁকা ঠেকলে মাঝে মাঝে বইগূলো নামিয়ে
নেড়েচেড়ে দেখি। প্রথম পাতায় শরণ্যের কেতাদুরস্ত হাতের লেখা জ্বলজ্বল করে। ‘গার্গী আর অভিজিৎকে, শুভেচ্ছা সহ, শরণ্য।’ আমি বই বন্ধ করে শেলফে
গুঁজে রাখি। পাশেই সারি দিয়ে আমার গোয়েন্দাগল্পের বইগুলো। আমার এত সাধের বইগুলো।
গত পাঁচ বছরে আমি ওগুলোকে ছুঁতে পারিনি। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর কেউই কি পারে?
পিপল ডোন্ট ডু সাচ থিংস।
হাতে কোনও লেখা না থাকলে সায়ন নিজে সেই শালীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে ডেটে নিয়ে গেছে। - Sayan na Sharanya?
ReplyDeleteF - A - T - A - F - A - T - IIIIIIII.......... 100/100 ....
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, চন্দ্রচূড়।
DeleteFantastic. Proshongshoneeo!!!
ReplyDeleteShuteertho
ধন্যবাদ, সুতীর্থ। আপনার প্রশংসা পেয়ে সত্যি খুব ভালো লাগল।
DeleteSuperb!!!! khuuuub bhalo laglo
ReplyDeleteআরে ইনিয়া যে, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
DeleteUff uff, phataphati hoyechhe byaparta. Eka eka apishe boshe porte porte besh gaaye knata diye uthlo. :/
ReplyDeleteভেরি গুড, বিম্ববতী। শুনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Deletedurdanto..aro onek anubad golpo chai, emon chomotkar anubad pele kosto kore asol lekha porte hobe na :)
ReplyDelete--Pradipta
হাহা, সেটা কোরো না প্রদীপ্তা, আমার অনুবাদ ঠিকঠিক হয়েছে কি না সেটা ধরার জন্যও আসল গল্পটা পোড়ো। তোমার অনুবাদটা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Deletedarun hyechhey..
ReplyDeleteKhub bhalo
ReplyDeleteচুপকথা, তিন্নি, অসংখ্য ধন্যবাদ।
Deletedarun darun
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, দেবশ্রী। খুব খুশি হলাম।
Deleteখুব ভালো
ReplyDeleteমিঠু
ধন্যবাদ, মিঠু।
Deletekhub valo :) Paramita
ReplyDeleteধন্যবাদ, পারমিতা।
DeleteDarun! Abar Abantor ki anubad gulo niye hobe?
ReplyDeleteহাহা, কোনও ধারণা নেই, রুণা। তবে আবার অবান্তর নামটা বেশ পছন্দ হল আমার। থ্যাংক ইউ।
DeleteEtow din dhore karone, akarone , kaje , akaje, ichhe , anichhe, nidra, anidra ittyadi nana chhoto,khato ,boro ,mejo ajuhathey matha nichu kore chupi chupi astaam, ar tuk kore tatka ba sadyo basi abantor prolap gulo pore kete portaam..... Tai prothomei khoma cheye nichhi. Kintu aajker lekhata pore mone holo ebar o kichhu na bolle seta boroi anuchit hobe... People sudn't do such things.
ReplyDeleteJakge, amar chirrokaal chhanar theke rasogolla khete bhalo lage, ar apni tow chhana peye amader puro rasomalai khaiye dilen.
Anubaad noi, anupranito o noi.. Etow Pray moulik golpo .....
Apnara dujon ei anek boro hon, ghono ghono Archismaan ke edesh odesh e nana boro boro kaje deke pathak ... Ar apni sei phake portey thakun, liktey thakun , amader amulya somay kere nitey thakun !!!!
N.B
Ami rishra peronor somay mathar tupita ektu tule nebo aaj :)
সর্বনাশ, কত প্রশংসা করেছেন, আত্মদীপ। থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। মন একেবারে খুশি হয়ে গেল। আমরা দু'জন আপনার শুভকামনা মাথা পেতে নিলাম। আপনিও খুব ভালো থাকুন, মিঠাইও খুব ভালো থাকুক।
Deleteটেলিপ্যাথি ব্যাপারটা যে কত সত্যি সেটা আবারও একবার প্রমাণ হল। পরশু না তরশু মা ফোন করে আমার এক ছোটবেলার বন্ধুর খবর জিজ্ঞাসা করল। কথাপ্রসঙ্গে তার ছোট্ট ছেলের কথাও উঠল। ছেলের নাম রেখেছে আত্মদীপ। ফোন রেখে ভাবলাম, আমি আরেকজন আত্মদীপকে চিনি, আমাদের ওদিককার। আর আপনি অমনি এসে গেলেন।
হা: হা: হা: .... মিঠাই এর নাম মনে আছে দেখে অন্য রকম ভালো লাগলো !!! ধন্যবাদ :)
DeleteKi bhoyanok bhalo.bhabanubad jaake bole.lekho aaro.banglay ajkal thikthak lekhar boroi aakaal
ReplyDeleteধন্যবাদ, শ্রীমন্তী।
DeleteLekhatar jonno thanks. Kaalkei Ruth Rendell shob niye phellam Kindle-e.Fallen Curtain diyei shuru korechhi
ReplyDelete- Arpan
বাঃ বাঃ দারুণ ব্যাপার, অর্পণ। আশা করি ভালো লাগবে।
Deleteমন্ত্রমুগ্ধের মতন পড়ে ফেললাম গোটাটা। দুর্দান্ত হয়েছে, এটাকে অনুবাদ বলাটা ঠিক নয় কুন্তলা। :)
ReplyDeleteআহা, গল্পের বীজটাই তো অন্যের। যতই বাটপাড়ি করি, অনুবাদের বেশি কিছু এটা নয়। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
DeleteDarun darun darun....... Tor golpo tai darun.. mul galpo ta ar porboi na. Erom aro anek onubad kor.
ReplyDeleteএত প্রশংসা করিস না, ভট্টা, সবাই বলবে পুরোনো বন্ধু বলে পার্শিয়ালিটি করছে। তবে আমি সেটা মনে করছি না। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
Deleteকুন্তলা দি.. দারুন... কিন্তু পি ডি জেমস কি দোষ করলো?
ReplyDeleteধন্যবাদ, অরিন্দম। না না পি ডি জেমস কোনও দোষই করেননি, আমার ওঁর গল্প, ওঁর গোয়েন্দা অ্যাডাম ডালগ্রিশকেও খুব ভালো লাগে (যদিও আমার পছন্দের পক্ষে একটু বেশি গম্ভীর)। আসলে রুথ রেন্ডেলের মৃত্যুর খবরটা পড়ে ওঁর গল্প অনুবাদ করার কথাটা মাথায় এল আরকি।
Deleteami asol golpota porini Kuntala. Tbe tomar ei anubad besh tan-tan hoe pore fellam. khub bhalo laglo. Bratati.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী।
Deleteঅনুবাদ গল্প দেখেই মন তা নেচে উঠেছিল! ভালো লাগলো, শুধু একটা কথা কি বলব? অপরাধীর মাথার ভেতর আরেকটু কি ঢোকা যেত? মানে যেহেতু গল্পের শেষটা predictable, সেক্ষেত্রে অপরাধীর মনস্তত্ব আরেকটু গভীরে দেখলে আমার ভালো লাগত, নাহলে চারিত্রাটাকে একটু অনে ডাইমেনশনাল লাগলো। আশা করি বললাম বলে কিছু মনে করবে না।
ReplyDeleteআরে না, কাকলি, মনে করার কিছু নেই। মনে হওয়াটা খুলে বলার জন্য অনেক ধন্যবাদ। পরের গল্পটার সময় মনে রাখব।
Deletetomar onubad er jobab nei. hat's off to u Kuntala di.
ReplyDeleteami nijeo eisob porokiya ityadi topic eriye choli. injustice, harsh reality eisob bepar gulo amar kichutei hojom hoy na. manusher mon ki odvut tai na, tol pawa bhar. sottii khune bodmash ra jodi oi CID r moto unidimensional hoto tale murder mystery ba thriller er sei mojata thakto na akdomi. Agatha Christie r golpe sob somoyei poetic justice served hoy, tai onar boi porte ato bhalo lage. ei golpo ta pore kano jani na amar Manik babur Aami Bhoot er Nashkar da r kotha mone pore gelo.
এটা ঠিক বলেছ, কুহেলি। দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে জানার মধ্যে একটা শান্তি আছে। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
DeleteMugdho hoe pore chole gechhilam, comment kora hoeni .. "Osadharon" legechhe , eto bhalo likhechho ... aro chai ... :-)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। আপনার প্রশংসা, উৎসাহ, সবসময় স্পেশাল মনে হয়। অনেক ধন্যবাদ।
Deletebolchi je ye..mane khun ta ki asole victim er shami e korlo..mane jani prashno ta ektu boka marka..tao..
ReplyDeleteহ্যাঁ, স্বামীই খুনি। ওই চুল, বোতাম ইত্যাদি দিয়ে শরণ্যর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিল।
Delete