ম্যাকলয়েডগঞ্জ ১




বেড়ানোর গল্প ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়? বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে মনের মধ্যে জাগার মুহূর্ত থেকে? বাসের টিকিট কাটা আর হোটেল বুকিং হয়ে যাওয়ার পর থেকে? নাকি সেই জায়গায় পৌঁছোনো থেকে?


শেষেরটা যদি হয় তাহলে কেজরিওয়ালের গল্পটা বাদ পড়ে যাবে, কারণ সে গল্পটা শুরু হয়েছিল ম্যাকলিওডগঞ্জে পৌঁছনোর পাঁচশো কিমি পথ আর দশঘণ্টা বাকি থাকতেই। যখন আমরা আই এস বি টি-র বাসে উঠে নিজেদের সিট বেছে বসলাম আর কানের কাছে শুনলাম, “ম্যাডাম, ওহ্‌ উইন্ডো সিট মেরা হ্যায়।”

অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে মুখ্যমন্ত্রী তাকিয়ে হাসছেন। সিট ছেড়ে দিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে সরে এসে বললাম, “লোকটাকে দেখলে?”

বলাই বাহুল্য, ভদ্রলোক কেজরিওয়াল নন। খালি দৈর্ঘ্যপ্রস্থউচ্চতায়, মুখের আদল, গোঁফের কায়দায় কেজরিওয়ালের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল। আমার ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করা ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তারপর দেখলাম ওঁর কথা বলার চাহিদাটা প্রায় প্যাথোলজিক্যাল। অন্তত চোদ্দটা ফোন করলেন, তারপর বৃহস্পতিবার রাতে টিকিট কাউন্টারে এত ভিড় কেন সেই নিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলেন। একবার শুরু করলে পাছে সারারাত কথা বলে যেতে হয়ে সেই ভয়ে আমি আর আলাপ বাড়ালাম না। বাসের ভিড়ের চেহারা যেমন আশা করেছিলাম তেমনই ছিল। গোটা তিন নবদম্পতি, কিছু এমনি লোক, একজোড়া নাচের মাস্টারমশাই ও ছাত্রী (নাচের ব্যাপারটা আমি ছাত্রীর হেয়ারস্টাইল আর কাজলের ঘটা দেখে আন্দাজ করেছিলাম, নিশ্চিত করল অর্চিষ্মান। মাস্টারমশাই ভদ্রলোক বসেছিলেন ওর কোণাকুণি সামনের দিকে, কাজেই তাঁর আইপ্যাডের স্ক্রিন অর্চিষ্মানের দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। ভদ্রলোক নাকি সারারাস্তা নাচের খবর পড়তে পড়তে আর নাচের ছবি দেখতে দেখতে চলেছিলেন। কী নাচ জিজ্ঞাসা করতে অর্চিষ্মান মাথাটাথা চুলকে বলল, ওই যে মহাপাত্র ভদ্রলোক যে নাচটা নাচতেন মোস্ট প্রব্যাবলি সেটা।) আর ব্যাকপ্যাক কাঁধে নেওয়া অল্পবয়সী ছেলের দল। ধরমশালার বাসে ড্রাইভার ও কন্ডাকটরের পরেই যাদের থাকা নিশ্চিত। তারা বসেছিল আমাদের আশেপাশেই। কথাবার্তা শুনে মনে হল আই আই টি। ধরমশালা পৌঁছনোর কথা ছিল বেলা দশটা নাগাদ, আমরা পৌঁছে গেলাম সকাল আটটায়। দু’ঘণ্টা আগে নিয়ে আসার জন্য ড্রাইভারজীকে মনে মনে ধন্যবাদ দেওয়াই উচিত ছিল কিন্তু এই সময়টুকু বাঁচানোর জন্য ভদ্রলোক সারা রাস্তা যে বেগে গাড়িটাকে ছুটিয়েছেন আর ঝাঁকিয়েছেন আর তার পরিণতি হিসেবে শেষ সিটে বসে আমাকে যে পরিমাণে লাফাতে হয়েছে, সেটা মনে করে আর দিতে পারলাম না।

বাস আসে ধরমশালা পর্যন্ত। ধরমশালা থেকে ম্যাকলিওডগঞ্জ সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ওপরে। চাইলে আপনি ধরমশালাতেও থাকতে পারেন, তবে কেউ থাকে না। সকলেই ওই রাস্তাটুকু উজিয়ে ম্যাকলিওডগঞ্জে আসে। আমাদের সঙ্গে যে ছাত্রের দলটি যাচ্ছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল স্বভাব-ওস্তাদ। কে নাকি বলেছে তাকে “আরে ধরমশালা মে কুছ নেহি হ্যায়, ফ্রেন্ডস কে সাথ মস্তি করনা হো তো ম্যাকলিওডগঞ্জ মে যাও।” আমরা অবশ্য মস্তি করব না, তবু আমরাও ম্যাকলিওডগঞ্জে যাব।

নানারকম করে ধরমশালা থেকে ম্যাকলিওডগঞ্জ যাওয়া যায়, তবে সবথেকে সোজা হচ্ছে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীল বাসের যে কোনও একটায় উঠে পড়া। ঘনঘন ছাড়ে, দশটাকা টিকিট। মোটে দশটাকা খরচ করে কিছু একটা করতে পারছি ভেবে আনন্দও যেমন হয়, তার সঙ্গে অভিজ্ঞতাও হয় অমূল্য। ছোট সাইজের টাটা মার্কোপোলো বাস। দেওয়ালে লেখা ইউ আর আন্ডার ইলেকট্রনিক সারভেইলেনস, কিন্তু যেখানে ক্যামেরা থাকার কথা সেখানে স্রেফ একটা গর্ত। পেছনের কাঁচের মাথার ওপর বড় বড় লালরঙের অক্ষরে লেখা এমারজেন্সি ডোর। এমারজেন্সিতে পড়লে কীভাবে সেই ডোর ওপেন করতে হবে সে নির্দেশও দেওয়া আছে। টেক দ্য হ্যামার অ্যান্ড ব্রেক দ্য উইন্ডো। হ্যামারের খোপটা শূন্য পড়ে আছে। কাজেই এমারজেন্সি হলে ওঁ মণিপদ্মে হুম জপা ছাড়া উপায় নেই।

বাস চলল। বাসে চড়লে লোকের রসবোধ বৃদ্ধি পায় এটা আগেও দেখেছি। ট্রেনে কিংবা প্লেনে এটা হয় না। কন্ডাকটর যেই না বলবেন “পেছন দিকে এগিয়ে যান” অমনি কেউ বলবেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ এদিকে আসতে বল, ফুটবল খেলার জায়গা আছে।” কিংবা ফাঁকা স্টপেজে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে লোক ডাকতে থাকলে বলা হবে, “আহা এখান থেকে কেন, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আয় গিয়ে।” পাহাড়ি বাসেও সে সব রসিকতা চলে। তবে কিনা এখানে ঘাম হয় না আর জ্যামও নেই, তাই রসিকতা শুনে গা জ্বলার বদলে হাসি পায়। তাছাড়া পাহাড়ি লোকেরা ভয়ানক পরোপকারী হয়। বাসে ওঠা মাত্র রোগা মহিলারা আমাকে দেখে সরে গিয়ে তাঁর অর্ধেক সিট আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান। এই সব আধুনিক বাসের আবার দরজা বন্ধ করার ব্যাপার থাকে। এক স্টপেজে এক ভদ্রলোক উঠতে গিয়ে কিছুতেই দরজা খুলতে পারছিলেন না, অমনি বাসশুদ্ধু লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “প্রেশার ডালো ভাইয়া, প্রেশার ডালো।” বাসের সকলের সম্মিলিত উৎসাহে ভদ্রলোক প্রেশার ডাললেন, আর অমনি দরজা খুলে গেল।

আগের পোস্টে আপনাদের আমাদের কাছে ম্যাকলিওডগঞ্জের তাৎপর্য সম্পর্কে বলেছিলামবলেছিলাম যে এটা আমাদের দু’জনের প্রথম একসঙ্গে বেড়াতে আসা জায়গা। এ ছাড়াও অন্য সব বেড়ানোর জায়গার সঙ্গে একটা তফাৎ আছে এই জায়গাটার। এখানে এলে আমরা সরকারি হোটেলে থাকি না। আগেরবারও থাকিনি, এবারও থাকব না। এবারও আমরা থাকব আগেরবার যেখানে ছিলাম সেখানেই, পেমা থাং গেস্টহাউসে। পেমা শব্দের অর্থ পদ্ম, থাং-এর অর্থ মাঠ বা বাগান।

সারারাত ঝাঁকুনিতে সন্ধ্যেরাতের ভাত মাছের ঝোল হজম হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা প্রথমেই খেতে চলে গেলাম। হোটেলের লাগোয়া রেস্টোর‍্যান্ট লম্বাটে ঘরে সারি সারি কাঠের টেবিলচেয়ার, দেওয়ালে তিব্বতি থাংকা আর ছবির জমকালো সাজ। কিন্তু বাইরে এমন রোদ ছেড়ে সেই ঘরে যে বসে সে পাগল।




আমি নিলাম প্লেন অমলেট। অর্চিষ্মান নিল চিজ অমলেট। টোস্টও নেওয়ার কথা হয়েছিল। একটু পরে জানালা দিয়ে মুখ বার করে পরিবেশক জানালেন টোস্ট নেই, কিন্তু তিব্বতি চাপাটি আছে। চলবে?


চলবে মানে? দৌড়বে। প্লেটে করে এসে গেল গরম গরম বালেপ। ময়দার তৈরি, আর আমাদের রুটির থেকে সামান্য মোটা।

ম্যাকলিওডগঞ্জে লামা আছে, ধওলাধারের দমবন্ধ করা ভিউ আছে, হাজার হাজার ‘এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ’ ক্যাফে আছে, আর আছে কুকুর। বেওয়ারিশ, পোষা সব রকম। মানুষের পোষা তো আছেই, তাছাড়া ম্যাকলয়েডগঞ্জের সব হোটেল রেস্টোর‍্যান্টেরও একটা করে নিজস্ব কুকুর আছে। তারা সকলেই ভয়ানক স্বাস্থ্যবান আর কুঁড়ের বাদশা। সারাদিন রোদ এসে পড়া জায়গা বেছে শরীর যতখানি সম্ভব টানটান করে শুয়ে থাকে আর খাবারের গন্ধ পেলে ধীরেসুস্থে আড়মোড়া ভেঙে উঠে জিভ বার করে সে দিয়ে হাঁটা দেয়। আমরা খাওয়া শুরু করতেই আমাদের হোটেলের পোষা কুকুরটিও কোথা থেকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে উপস্থিত। ইয়া দশাসই চেহারা, মুখ ঘিরে লোমের কেশর। খালি জিভটা একহাত বার না করে রাখলে আর পশমি ল্যাজটা আকাশের দিকে তুলে ঘনঘন না নাড়ালে সিংহের সঙ্গে তার তফাৎ করে কার সাধ্য।

রোদ্দুরে বসে ব্রেকফাস্ট খেতে চমৎকার লাগছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল, ছোটবেলায় রুটি দিয়ে অমলেট খেতে খুব ভালোবাসতাম। যেদিন টিফিনবাক্স খুলে এই দুটি বস্তু আবিষ্কার করতাম মন নেচে উঠত। এত প্রিয় আর এত সোজা একটা খাবারের কথা আমার মনেই ছিল না সেটা ভেবে বেশ অবাক লাগল।

রোদ্দুরের সঙ্গে ফাউ ছিল গিটারের টুং টাং বাজনা। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি একটু দূরে আমাদের একটু আগেই যে খাবার দিয়ে গেল সেই ছেলেটা একটা গিটার নিয়ে বাজাচ্ছে বা বাজানোর চেষ্টা করছে আর তার সামনে বসে আছে আরেকজন যে আমাদের তিব্বতি রুটির খবর দিয়েছিল। দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে গিটার বাজানো শেখাচ্ছে। ছাত্রের হাত কাঁচা তবে শুনতে মন্দ লাগছিল না।

কিছুক্ষণ পরেই গিটার ছাপিয়ে আরেকটা শব্দ কানে এল। অসম্ভব নিচু পর্দায় একটা বোঁ বোঁ আওয়াজ। আচমকা শুনলে তাকে শুধু আওয়াজ বলেই মনে হয়, কিন্তু কান করে শুনলে বোঝা যায় ব্যাপারটার সুর আছে, নিচু পর্দা হলেও ওঠানামা আছে, এমনকি আপনার কান যদি তেমন কাজের হয় তাহলে দুয়েকটা কথাও আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন।

খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা শব্দের উৎসের দিকে হাঁটা লাগালাম। আমাদের গন্তব্য Tsuglagkhang মন্দির।

এত শক্ত শব্দ যদি উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায় তাহলে আপনি আরও নানারকম করে জায়গাটাকে বোঝাতে পারেন। বলতে পারেন যে তিব্বতের বাইরে পৃথিবীতে যে সবথেকে বড় মনাস্টেরি আছে সেখানে যাব। বা দলাই লামার বাড়ি যাব। বা তিব্বতের গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল-এর হেডকোয়ার্টার্সে যাব।

বিবরণগুলো শুনেই বুঝছেন জায়গাটার গুরুত্ব কী অপরিসীম। অথচ বাইরে থেকে দেখলে সেটা আপনি আন্দাজ করতে পারবেন না। সাধারণ ইটকংক্রিট দিয়ে বানানো একটা বাড়ি। উনিশশো ঊনষাট সাল থেকে এই বাড়িতেই থাকেন চোদ্দ নম্বর দলাই লামা। যে বছর চিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ভারতে এসে আশ্রয় নেন, আর তাঁর সঙ্গে আসেন হাজার হাজার তিব্বতি নাগরিক। উনিশশো ষাট সালে ম্যাকলয়েডগঞ্জের এই বাড়িতেই স্থাপিত হয় গভর্নমেন্ট অফ টিবেট ইন এক্সাইল। এখনও প্রতি বছর প্রায় হাজার তিব্বতি শরণার্থী ম্যাকলয়েডগঞ্জে আসেন। এসে রাস্তায় মোমোর দোকান দেন, পাহাড়ি নুড়ির মালা গেঁথে পথের পাশে সাজিয়ে বসেন। সংসার পাতেন, ছেলেপুলে হয়। আবার নতুন করে একটা গোটা জীবন শুরু হয়। তবে সিংহভাগ তিব্বতিই ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন না। কখনও নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারবেন, সেই আশায়।

মন্দিরে আমরা অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। সারি সারি ঘুরন্ত প্রার্থনা চক্রের পাশ দিয়ে হাঁটলাম, লাসা শহরের তিনদিকে তিন পাহাড়ঘেরা দলাই লামার আসল বাড়ি রাজকীয় পোটালা প্রাসাদের রাজকীয় ছবি দেখলাম। জুতো খুলে মন্দিরের ভেতর ঢুকে অবলোকিতেশ্বরের শান্ত মুখশ্রী দেখলাম, নাম না জানা দেবতার করালবদন দেখলাম। গুনে দেখার ধৈর্য ছিল না, তবে তার ন’টা মাথা আর চৌত্রিশটা হাত হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়।* মন্দিরের চারদিক ঘেরা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে ছড়িয়ে থাকা বিরাট কাংড়া উপত্যকা দেখলাম, উপত্যকার ওপর ঝুঁকে পড়া আরও বিরাট ঝকঝকে নীল আকাশ দেখলাম। অর্চিষ্মান বলল, ওই গল্পটা মনে আছে? দ্য নাইন বিলিয়ন নেমস অফ গড? আমি বললাম, না তো, শুনি শুনি। গল্পটল্প শুনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি একঘণ্টাও হয়নি। ল্যাপটপ, ফোন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে সময় অন্তত তিনগুণ আস্তে চলে এটা আগেও দেখেছি।

প্রার্থনা তখনও চলছিল। মূল মন্দিরের ভেতর মেরুন রঙের কাপড় পরা লামারা বসে মন্ত্র পড়ছিলেন আর বাইরে সাধারণ মানুষরা বই হাতে ধরে লামাদের সঙ্গে সঙ্গে সেই মন্ত্র বলছিলেন। কারও কারও হাতে সাদা পুঁতির জপমালা ছিল, কারও কারও হাতে জপযন্ত্র। এরই মধ্যে টুরিস্টরা ঘোরাফেরা করছিলেন, সেলফি স্টিক তুলে ছবি তুলছিলেন, তাঁদের শিশুরা লে’স-এর ফাঁপা প্যাকেট বুকে জাপটে ধরে ধাঁইধাঁই করে দৌড়চ্ছিল, চিৎকার করে নিজের অপছন্দ ও আপত্তি জাহির করছিল। আমি নিজেও টুরিস্ট এবং আমিও হয়তো প্রার্থনায় একই রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলাম, তবু ব্যাপারস্যাপার দেখে আমার মনে নানারকম হিংস্র অনুভূতির জন্ম হচ্ছিল। বৌদ্ধধর্মে ক্ষমা, শান্তি, করুণা ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস প্র্যাকটিস করা শেখানো হয় বলেই কি না জানি না, লামা এবং বাকি প্রার্থনাকারীরা দেখছিলাম ওই হট্টগোলে একটুও বিচলিত হচ্ছিলেন না। একমনে নিজেদের প্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন। দেখেশুনে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা একলাফে বেড়ে গেল।

মূল মন্দিরের সামনের চত্বরের পেছনদিকে যেখানটায় আমরা বসেছিলাম সেখানে কয়েকটা নিচু কাঠের পাটাতন পাশাপাশি রাখা ছিল। সেগুলো খায় না মাথায় দেয় সেই নিয়ে আমরা নিচুগলায় বলাবলি করছি এমন সময় একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা বগলে করে একটা তোশকমতো নিয়ে উপস্থিত হলেন। লম্বাটে তোশকটা পাটাতনের ওপর বেছালেন। তারপর দুই হাতে দুই তোশকের গ্লাভস নিয়ে শুরু হল তাঁর প্রণাম। ব্যাপারটা দেখতে অনেকটা আমাদের সূর্যপ্রণামের মতো। দাঁড়িয়ে, হাঁটু ভেঙে বসে, সাষ্টাঙ্গ হয়ে শুয়ে, হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠে, হাঁটু ভেঙে পিছিয়ে এসে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানো। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত দ্রুত ব্যাপারটা করে চললেন, একবার দু’বার, পাঁচবার, দশবার, কুড়িবার . . . অন্তত বারপঞ্চাশেক প্রণাম সেরে ভদ্রমহিলা আবার তোশকটোশক গুটিয়ে রেখে এসে নিজের জায়গায় বসে শান্ত মুখে মালা গুনতে শুরু করলেন। একটুও হাঁপালেন না, একটুও ঘামলেন না।

দেখেশুনে আমার আর অর্চিষ্মানের এমন হীনমন্যতা জাগল যে আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে উঠে পড়লাম।

                                                                                                                               (চলবে)

বোনাস কুইজঃ নটা মাথা আর চৌত্রিশটা হাতওয়ালা তিব্বতি দেবতার নাম কী?  
   

Comments

  1. Chotobelaye highway'r dhaare dhaba te gorom gorom ruti omelette khawar kotha mone pore gelo. amar o khub priyo khabar.
    Amra borsha e giyechilam ... ek poshla kore brishti hoto ar pine er shugondho aro beshi kore choraato. Tobe khub thanda chilo.
    Tomar lekha pore mone hocche abar ghure elam. Abar o jete icche korche. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, বর্ষায় ম্যাকলিওডগঞ্জ তো চমৎকার হবে, শর্মিলা।

      Delete
  2. amake HP jetei hobe. Dalai Lama'r bari na dekhle amar ei jonmo britha.
    quiz er uttor Yamntak. Gangtoke Gondogol.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, কুহেলি, তুমি ম্যাকলিওডগঞ্জ ঘুরে এস। তোমার টিবেটান বৌদ্ধধর্মে উৎসাহ আছে বলেছিল, মনে আছে।

      কুইজে একেবারে একশোয় একশো। কনগ্র্যাচুলেশনস।

      Delete
  3. lekhata besh bhalo laglo.. tomar sathe mone mone amio beriye elam ektu... Ajke dekhchhi tomake Satyajit e peyechhey.. Yamantak to botei Brazil er Kalo Bagh boitake ke niyeo tanatani korechho. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওই ভদ্রলোক আমাকে পেয়েই থাকেন, চুপকথা। কিন্তু ব্রেজিলের কালো বাঘ-এর ব্যাপারটা বুঝলাম না তো?

      Delete
  4. Satyajit Ray "Nine Billion Names of God" golpota banglay onubad korechhilen. Seta "Brazil er Kalo Bagh" boita te chhilo.. Golpotar bangla namta thik mone nei. :)

    ReplyDelete
  5. https://www.youtube.com/watch?v=cbPkjx2MPjc

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete
    2. This comment has been removed by the author.

      Delete
    3. Quiz to botei, bonus quiz er o uttor dilam tao examiner nombor dilo na :P :(

      Delete
    4. ছি ছি ছি, বড় অন্যায় হয়েছে। তোমাকে একশোয় তিনশো দিচ্ছি চুপকথা। ইউটিউবের লিংকটার কথাও তো ভুললে চলবে না।

      Delete
  6. Replies
    1. একশোয় একশো, বিম্ববতী।

      Delete
  7. darun laglo Dharamshala ghurte :) ki apurbo rod...toke khub bhalo lagche

    ReplyDelete
    Replies
    1. kaner dulta to besh bahari mone hocche :)

      Delete
    2. রোদ্দুরটা সত্যি অতুলনীয় উঠেছিল, তিন্নি। কানের দুলের প্রশংসা করেছিস শুনে মা খুশি হবে, আমার প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও কিনে দিয়েছিল।

      Delete
  8. ভীষণ ভালো লাগছে পড়তে। একটা প্রশ্ন: জায়গাটার নাম ম্যাকলিওডগঞ্জ না ম্যাকলয়েডগঞ্জ? বাস জার্নির বর্ণনাটা অনবদ্য। আপনি ভাগ্যিস ওই অংশটা বাদ দিয়ে লেখাটা শুরু করেননি!

    ঈশ্বরের ন লক্ষ কোটি নাম গল্পটা পড়লে কেমন ভয় ভয় করে। আপনি সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট সিনেমাটা দেখেছেন?

    ছবির কথা আর কি বলব, একটা বাক্য মনে পড়ে গেল: "নাইস ডে ফর কালার।" এখন কালার ফিল্ম আবার দুষ্প্রাপ্য বা দুর্মূল্য হয়েছে হয়ত, কিন্তু কালার ফিল্ম তো আর লাগেনা, তাই আশা করছি আরও অনেক ছবি দেখতে পাব।

    ক্যুইজের উত্তরটা আর আলাদা করে দিলামনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, সুগত। আপনি "নাইস ডে ফর কালার"-টা যা দিলেন, আমি এক্কেবারে ফেলাট। ভেরি গুড জব। সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট দেখিনি তো, দেখব তাহলে।

      আর এবার থেকে ম্যাকলয়েডগঞ্জই লিখব। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  9. Prothom chhobita dekhei amar pahar e berate jete ichhe korchhe. darun chhobi ar darun lekha... tomake khub bhalo lagchhe...jhok jhoke... next part er ashai roilam. Mcleodganj namta chhotobelai Anandamela i pora Ruku Suku r galper kotha mone porie dai

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। জায়গাটার নামটাই কী সুন্দর না?

      Delete
  10. খুব ভালো লেখা হয়েছে, যথারীতি। আমরাও ম্যাকলিওডগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিলাম, আর দালাই লামার মন্দিরের ঠিক পাশেই একটা হোটেলে ছিলাছা
    বাই দ্য ওয়ে, সিধুজ্যাঠা বলছেন যে McLeod এর উচ্চারণ হওয়া উচিত Mak-Loud (ম্যাকলিওড আর ম্যাকলয়েড দুটোই অ্যাপারেন্টলি ভুল)। ব্যাপারটার গোড়া অবধি যাবার অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য সুগতকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ম্যাক(?)গঞ্জ ভ্রমণ হাই ফাইভ, দেবাশিস। উরুশ্চারণ ব্যাপারটা বড়ই গোলমালের।

      Delete
  11. Dharamshala ami gechilam jokhon tokhon class viii... Eto kachei je macleodgunj seta jantam na... Ar tokhon ato sundor dekhar moton chokh o chilo na hoito... Tor lekha tar sathe amio tai ghure elam... Khub sundor hoyeche... Chobi gulo khub jholmole sundor rodmakha... Ekta abdar ache... Rakhle bhalo... Er porer beranor chobite , kono lok ke potiye patiye tor ar archisman er chobi dis... Eka toke dekhar theke toke tor heror sathe dekha ta besi sundor... Abdar ta besi holo kina janina...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আবদারটা একেবারেই বেশি হয়নি, ভট্টা, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অবান্তরে অর্চিষ্মানের ছবি ছাপলে ও এমব্যারাসমেন্টে অজ্ঞান হয়ে যাবে। বেচারার প্রতি সেটা করা উচিত হবে না। তার থেকে তোর সঙ্গে সাক্ষাতে আলাপ করিয়ে দেব কখনও সুযোগ হলে।

      তুই যখন ধরমশালা গিয়েছিলি তখন আমি তোকে চিনতাম! ক্লাস সেভেনের এ সেকশনের ঘরটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। লেখাটা তোর ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  12. tomar chhobi r tomar lekha sob khub bhalo laglo... r oi debota holen Jamantak. - Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. একশোয় একশো, ব্রততী। লেখা ভালো লেগেছে শুনে খুব খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment